অর্ধাঙ্গ পর্ব-১৩

0
45

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-১৩

বাড়িটার চৌচালা টিনের চালের উপর দুপুরের রোদ্দুর যেন আগুন ছড়াচ্ছে। ঘাম ভিজে গেছে জামাকাপড়, পাড়ার কুকুরগুলোও গরমে অতিষ্ঠ হয়ে, নিঃশব্দে ছায়ায় শুয়ে আছে। বাতাসও যেন আজ ক্লান্ত, একটা পাতাও নড়ছে না কোথাও। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু দূরে কোথাও একটা ভেসে আসছে কাকের কর্কষ আওয়াজ! জমেলা বেগম গরমে হাঁপাচ্ছেন। মুখে জমা ঘাম গাল বেয়ে বেয়ে পড়ছে! দুুপুর এখনো হয়নি পুরোপুরি ভাবে, অথচ কি তীব্র গরম।

“এই দুপুরবেলার গরমে জান বাইর হইয়া যায়! জ্বর লাগার মতো গরম হইয়া রইছে পুরা শরীর। এই লাইগ্যাই কইছি বাজান, বিকেলে রওনা দিছ।”
“আম্মা দুপুর যেই কথা, সকালও হেই একই কথা।”

ছেলের কথার পৃষ্ঠে আর উত্তর দিলো না জমেলা বেগম! মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ তিনি সজীবের উপর, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। প্রকাশ করলেও বিপদ! এমনিতেই তার অগোচরে ছেলে এই কয়দিনে বদলে গেছে। নিশ্চয়ই পারুল কান ভাঙিয়েছে! নাহ্ ছেলেকে আবার তার আয়ত্তে আনতে হবে পুরোপুরি ভাবে। সেজন্য চুপ থাকতে হলেও সমস্যা নেই। একটু আগেই বাড়িতে ফিরেছে পারুলেরা। পারুল ভেতরে গেছে। টুম্পা আর জমেলা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন! তখন টুম্পা জমেলা বেগম কে বলেন,

“খালা, আমারই গরমে গলা শুকাই গেলো গা, তোমার কি অবস্থা! ভাবী এক গেলাস পানিও তো দিতে পারে!”

আগুনে যেন ঘি ঢাললো টুম্পা, চেঁচিয়েই জমেলা বেগম বলতে লাগলো,

“এই বউডা বউ হইছে ঠিকই। কিন্তু গেরস্তর চাল চলনের কাম অহনো কিচ্ছু শেখে নাই। ভিতরে যাইয়া বইয়া রইছে, শ্বাশুড়িরে এক গেলাস পানি দিতেও কষ্ট হয়?”

ভেতর থেকে পানি হাতে বেরিয়ে আসলো রিয়া। মায়ের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।

“আরে টুম্পা তুইও আইছস দেহি!”
“হ, আপা। তোমাগো কথা মনে হইতেই আইয়া পড়ছি।“
“ভালা করছস, আমার সঙ্গী পাইলাম।”

রিয়া আর টুম্পার কথোপকথনের ভেতরেই আসলো পারুল। হাতে ট্রে’র মধ্যে দু’টো গ্লাস। একটা তার শ্বাশুড়ির দিকে এগিয়ে দিলো,

“লন আম্মা, গরমে দিয়ে শরবত খান খাইয়া লন। আরাম লাগবো।”

জমেলা বেগম কিছু না বলে ঢকঢক করে গ্লাসের পুরো শরবতটুকু খেয়ে নিয়ে খালি গ্লাস পারুলের হাতে দিয়ে বললো,
“এতক্ষণ লাগে নি শরবত আনতে! মা’গো মা পরানডা বাইর হইয়া যাইতাছিল!”

পারুল বিনিময়ে কোনো বাক্য ব্যয় না করে চলে গেলো! জমেলা বেগম এবার গলা ছেড়ে ছেলেকে ডাকতে লাগলো! সজীব ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে জিগাস্যা সূচক দৃষ্টিতে মা’য়ের দিকে তাকাতেই জমেলা বেগম বলেন,

“শরবত খাইছস বাপ?”
“হ, আম্মা।”
“তাইলে কষ্ট কইরা বস্তাডা খুইল্যা দ্যাখ কি দিছে তোর খালায়।”
“দিছে তো আমেনেরে, আমি দেইখ্যা কি করুম?”
“আরে বাজান, এই সংসারে যা আমার তা তোর, আবার যা তোর হেইডা আমার। তাইলে এমনে কইতাছস ক্যান?”
“আইচ্ছা খুলতাছি।”

সজীব বস্তার খুলতে গিয়ে ঠেকলো বস্তায় বাঁধা গিটে! কিছুতেই খুলতে পারছে না। শেষমেশ পারুলকে ডাকতে বাধ্য হয়,

“পারুল? ওই পারুল?”

মিনিট দুয়েক হবার পরও পারুল আসছে না দেখে জমেলা বেগম ঠেস মেরে ছেলেকে বলে,

“তোর বউ নিখোঁজ হইয়া যায় মাঝেমধ্যেই!”

সজীব বিরক্তিতে ভ্রুঁ কুঁচকালো, তখন সেখানে উপস্থিত হয় কামাল হোসেন,

“নিখোঁজ ক্যান হইব? বউমা তোমগো লাইগ্যা ভাত বারতাছে, হেয় হের দায়িত্ব সবসময়ই সঠিকভাবে পালন করে।”

স্বামীর কথায়ও জমেলা বেগম উত্তর দিলেন না, মনে পড়ে গেলো আগেরবারের ঘটনা! ছেলে আর স্বামীর সামনে চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করলো। পারুল এসেই শ্বশুড়ের সামনে দাঁড়াতেই সজীব বলে,

“পাক ঘর থেইক্যা বটনি খান নিয়া আয়, গিট্টু খুলতে পারতাছি না!”

পারুল নিঃশব্দে গিয়ে দা এনে দিতেই সজীব বস্তার মুখ কেটে ফেলে। বস্তা খুলতেই ভেতর থেকে কতগুলো সব্জি এসে পড়ে মাটিতে! আলু, বেগুন হতে মৌসুমের যত সব্জি আছে বেশ ভালো করেই আছে। তারপর সজীব নুইয়ে বস্তা থেকে একে একে সব বের করতে থাকে। আতপ চালের পলিথিন হতে ভাতের চাল, একটা বড় রুই মাছ দু’টো বড়বড় জবাই মোরগ আর একটা হাঁস সাথে আরো কিছু জিনিসপাতি! মাছ আর মাংসগুলো থেকে কেমন বোটকা গন্ধ বের হতেই সজীব নাক টিপে ধরলো!

“আম্মা! খালায় এইডি কি করছে?”

জমেলা বেগম হেঁসে হেঁসে বললেন,

“দেখছ না? কত জিনিসপত্র দিছে!”
“গন্ধ বাইর হইতাছে আম্মা!”
“আমরা বাইর হওনের আগে আগেই জবাই করছে, হেই লাইগ্যাই তো!”
“আর অহন একটু পরই জোহরের আজান দিব!”
“তো কি হইছে? মাছ গোস্ত কি তোরা জীবিত খাইবি? খাছ তো জবাই কইরাই! এরম করছ ক্যান!”
“দেহো পইচ্যা গেছে নি!”

জমেলা বেগম চোখমুখ কুঁচকে উত্তর দেয়,

“হুন বাপ, এই সব জিনিসপত্রর দেয় পোলার শ্বশুরবাড়ি থেইক্যা৷ আমের সময় আম, রোজার সময় ইফতারি, আরো কত্ত কিই! এমন বস্তা ভইরা ভইরা দেয়। আমি তো দেহি সবই। হেই জায়গায় আমার বইনে দিছে। আমার তো আর কুনোসময় এত জিনিসপত্র আইলো না বাজান! আর আইবোও না মনে হয়, তোর শ্বশুরবাড়ি তো নাইই কইলে চলে। নিজেই তো কিছু পাইলা না! তুই এসব পাবি কইত্তে? আমার বইনে যত্ন কইরা দিলো এতডি জিনিস, এরম করছ ক্যান?”

শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পারুল, কিছু না বলে। সে জানে জমেলা বেগম তাকে খোঁচা দিয়েই কথাটা বললো! তবুও নির্বাক রইলো। যৌতুকের এই সময়েও যে সজীব তাকে এভাবেই বিয়ে করেছে সেটাই বা কম কিই! সজীব বিরক্তি নিয়ে মা’কে বলে,

“তুমি দেহোগা এইডি! পারুল? আমার ক্ষিদা লাগছে কয়ডা ভাত দে আগে।”

পারুল আর দেরি না করে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলো তখুনি থমকে দাঁড়ায় রিয়ার ডাক শুনে,

“ভাবী? তুমি খাইয়া আইও। আমি এইডি রাখতাছি।”

কপাল কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকায় জমেলা বেগম! কিছুটা রেগেই বলে,

“ওই ছেমড়ি, তুই রাখবি কি? মাছ আর মাংস তো কুটা লাগব!”
“তো কি হইছে? আমি কুইট্যা দিমু!”

জমেলা বেগম মেয়ের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালেন, যার অর্থ বুঝতে বেগ পেতে হলো না রিয়ার। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইলো। সে টুম্পাকে তাড়া দিয়ে বলে,

“কি’রে টুম্পা? ভাত খাইতে যা।”
“হ, যাইতাছি আপা!”
“তুমি যাইবা না আম্মা?”
“তুই তো মহারানী’রে ছুটি দিয়া দিছস! একলা একলা পারবি নি এতডি জিনিস ঘরে নিয় রাখতে! হেই লাইগ্যাই আমি খাড়াই রইছি।”

রিয়া কিছু না বলে এক দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে। জমেলা বেগমের স্বভাব যেমনই হোক, রিয়া জানে এই কঠিন পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার শেষ আশ্রয় হলো তার মায়ের বুক। আম্মা যেমনই হউক কখনো তাকে ভালোবাসতে কার্পন্য করেনি! ব্যাগগুলো একে একে খুলে গোছাতে থাকে রিয়া। সবজি, চাল, ডাল—সব কিছু ঠিকঠাক জায়গামতো রাখে সে। এবার পালা মাছের। পলিথিনে মোড়া মাছটা হাতে নিয়েই হঠাৎ যেন শরীরটা কেঁপে ওঠে রিয়ার। চোখে-মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া! মুহূর্তের মধ্যেই সে গড়গড় করে বমি করে দেয় ভাসিয়ে দেয় নিজের ক্লান্তি, বিতৃষ্ণা আর গোপন এক ভয়! অপ্রস্তুত এই দৃশ্য দেখে জমেলা বেগম স্থির হয়ে যান। বিস্ময়ের ছায়া মাখানো চোখে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের দিকে।

“কি’রে বমি করলি ক্যান তুই! তোর কি শরীর খারাপ?”
রিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দেয়,

“আম্মা মাছে খুব গন্ধ বাইর হইতাছে, পইচ্যা গেছে মনে হয়!”
“ধুর! ঠিক আটটার পরপর তোর খালা এইডি কাটছে, টুম্পা রেডি হওনের সময় আমি দেখছি, আর এহন বারোটা বাজবো মনে হয়। এই কয় ঘন্টায় মাছ পঁচবো ক্যামনে? হের উপর সব মাছ আছিল টাটকা, আমি নিজে দেখছি!”
“তাইলে তুমি পরিষ্কার করো এইডি, আমার সহ্য হইতাছে না।”

বলেই রিয়া ঘরে দৌড় লাগালো। জমেলা বেগম সেখানে একা দাঁড়িয়ে সবগুলো বের করলো! বড় গলায় ডাক দিলো,

“বউমা? ও বউমা!”

এক ডাকে বেরিয়ে আসলো পারুল।

“লও, মাছ আর মাংসগুলা ভালা মতন ধুইয়া লও।”
“আম্মা আমি ভাত খাই নাই অহনো।”

পারুলের কথা কানে যেতেই জমেলা বেগম গলার কন্ঠ কঠিন করে বলে,

“অহনো তুমি ভাত খাও নাই! এতক্ষণ করছো কি!”
“আমনের পোলা আর টুম্পারে ভাত বাইরা দিছি!”
“তই তোমারে খাইতে কে মানা করছে? নাকি কেউ মুখ ধইরা রাখছে যাইত্যা?”
“আমনের পোলারে বাতাস কইরা দিছি আম্মা!”
“হুনো সংসার করতে গেলে চালু হওন লাগে, না হইলে হেই সংসার টিকে না। তোমার উচিত আছিলো, ভাত বাইরা হেগো লগে লগে ভাত খাইয়া লওয়া! এহন এই যে মাছ গোস্ত এইডি তো পরিষ্কার না করলে পইচ্যা যাইব! এইডি কে করব!”

পারুল নিচু কন্ঠে জবাব দিলো,
“আমি।”
“তাইলে খাড়াইয়া রইছ ক্যান? করো!”

আদেশ দিয়েই জমেলা বেগম পগারপার! অন্য সময় হলে পারুল কিছু বলতো, এখন যেন ইচ্ছেই হলো না উত্তর দেবার! সেজন্যই চুপ ছিলো। তাছাড়া পথে সজীব এটা ওটা খাইয়েছে বলে তেমন ক্ষিদেও পায়নি। ফলাফল পারুল বাড়ির পেছনের দিকের আমগাছের ছায়ায় চলে যায় মাছ কুটতে।

আজান দিবে দিবে তখন। খেয়ে দেয়ে ভরপেটে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে টুম্পা। সজীব আর রিয়া নিজেদের ঘরে। কামাল হোসেন চলে গেছেন মসজিদের উদ্দেশ্য! আর জমেলা বেগম, হয়ত গিয়েই শেফালী বেগমের সঙ্গে গল্পে মজেছেন! এতদিনকার কথা সব জমেছে, সেজন্যই বোধহয় এই দুপুরবেলায়ই তিনি দৌড় লাগিয়েছে! ঠিক সেই সময়ই টুম্পার চোখে পড়ে দূর থেকে ঘামে ভেজা শরীফকে! শরীফকে দেখেই পড়নের উড়না ঠিক আছে কি-না দেখে নিলো একবার।
“ আসসালামু আলাইকুম ভাইজান, কেমন আছো?”

শরীফ বিস্ময় নিয়ে টুম্পার দিকে তাকায়,
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম, কি’রে টুম্পা? তুই কতক্ষণ আইলি? কার লগেই বা আইলি? একলা একলা না-কি ভাইজানের লগে আইছস!”
“কেমন আছি না জিগাইয়াই এত প্রশ্ন!”
“মনে প্রশ্ন আইলে জিগামু না?”

শরীফের এরকম জবাবে টুম্পার হাসিখুশি মুখটা নিমিষেই কালো আঁধারে ছেয়ে যায়! মুখটা কিছুটা নিচু করেই বলে,

“আমি আইছি দেইখ্যা কি খুশি হও নাই না-কি!”
“যদি কই খুশি হই নাই, তাইলে কি আমারে খুশি করতে যাইবি গা, আমগো বাড়ি থেইক্যা?”

টুম্পা মাথা তুলে তাকালো! এরকম জবাব যে আশা করেনি সেটা তার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে! ভাবেনি শরীফ এরকম নির্মম ভাবে তাকে মুখের উপর এভাবে বলে দিবে!

#চলবে?