অর্ধাঙ্গ পর্ব-১৪

0
43

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-১৪

বাড়িটার পেছনের আমগাছটা যেন ছায়া দিয়ে গরমটাকে একটু সহ্যযোগ্য করে রেখেছে। চারদিকে অসহ্য রোদ, বাতাস নেই একটুও। পারুল বসে আছে পিঁড়িতে, মাছ কাটছে মন দিয়ে। এক হাতের কনুই দিয়ে আবার মাঝেমধ্যে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নিচ্ছে। পাশেই একটা থালা, মাছের গা থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছে সাবধানে। পারুলের পায়ের কাছে একটা বিড়াল লেজ মুড়িয়ে ছায়ায় ঘুমাচ্ছে, গরমে তারও নড়ার শক্তি নেই। না হলে মাছ নিয়ে এতক্ষণ কাড়াকাড়ি হয়ে যেতো! এই সময় হঠাৎ পেছন থেকে সজীব এসে হাজির হয়। কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে একটা ঢাকনা দেওয়া স্টিলের বাটি এগিয়ে দেয়। পারুল একটু বিরক্ত হয়ে বলে,

“অহনই তো আমনের বাডি দেখতে যাইয়া আমার হাত কাইট্টা যাইত!”

সজীব মৃদু হেসে বলে,
“আগে ঢাকনা তো উল্টাইয়া দেখ, কি আনছি!”

“আমি না মাছ কুটতাছি? কেমনে দেখুম?”

পারুলের কথা শুনে সজীবই বাটির ঢাকনা উঠায়, সঙ্গে সঙ্গে গরম জিলাপির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। মিষ্টির গন্ধে হঠাৎ মনটা খুশি হয়ে যায় পারুলের। বাটির একপাশে চিনির রস জমে আছে। পারুলের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক স্পষ্ট বিদ্যমান!

“আমনে আমার লাইগ্যা জিলাপি আনছেন!”

সজীব একটু রসিকতা করে উত্তর দেয়,

“নাহ্, অন্য বেডির লাইগ্যা!”
“ধ্যাত। আমনের আবার অন্য বেডি কই থেইক্যা! কিন্তু জিলাপি কইত্তে আনলেন?”
“গেছিলাম কামের খুঁজে, দেহি আকবর চাচা সবে দোকান খুলে জিলাপি ভাজা শুরু করছে। বিকালে দোকান খুলতো৷ কিন্তু গরম গরম দেইখ্যা আমি তোর লাইগ্যা নিয়া আইছি। তুই তো গরম, মচমচে জিলাপি খাইতে পছন্দ করছ হেই লাইগ্যা!”

পারুল কিছু বলে না, শুধু একবার তাকায় সজীবের দিকে। সজীব যে তার পছন্দের কথা মনে করে এই ভর দুপুরবেলা জিলাপি নিয়ে এসেছে এতেই সে কতই খুশি! একেবারে ছোটোবেলার ঈদের চাঁদ দেখার মতন খুশি!
“তাকাইয়া তাকাইয়া জিলাপিরে ঠান্ডা করবি?”

পারুল আশাহত কন্ঠে জবাব দেয়,

“আমি তো মাছ কুটতাছি, কেমনে খামু কন?”

পারুলের উত্তর শুনে সজীব আর দেরি না করে বাটি থেকে নিজ হাতে জিলাপি নিয়ে পারুলের মুখের সামনে ধরতেই পারুল মিষ্টি হেঁসে জিলাপি খেতে লাগলো।
“মজা হইছে বউ?”
“বহুত!”
তখনই পাশে পড়ে থাকা শুকনো পাতায় হালকা শব্দ হয়, যেন দুপুরের নিস্তব্ধতার ভেতরে কারো পায়ের আওয়াজ। পারুল তৎক্ষনাৎ গলা উঁচিয়ে বলতে লাগে!

“কে ওইখানে?”

হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে তখনই সামনে এসে হাজির হয় টুম্পা। এসেই নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে থাকে,

“আমি গো আমি!”
“তুমি লুকাইয়া আছিলা ক্যান?”

পারুলের প্রশ্নে টুম্পা থতমত খেয়ে জবাব দেয়,
“লুকায় থাকমু ক্যান? আমি তো আইতেই নিছিলাম!”
“ওহ্!”

তৎক্ষনাৎ টুম্পার দৃষ্টি যায় সজীবের দিকে। সজীবকে প্রশ্ন করে,
“বউরে লুকায় লুকায় একলাই জিলাপি খাওয়াইতাছো! আমারে দিবা না বুঝি?”
“না টুম্পা, সব জিনিস সবাইরে দেওন যায় না!”

পারুলের কথা শ্রবণ হতেই তৎক্ষনাৎ টুম্পার চোখ দুটি বড়বড় হয়ে উঠলো! যেন কোঠর থেকে বেরিয়ে আসবে! এভাবে তার মুখের উপর না বলে দিলো পারুল! তাও সজীব সামনে থাকা অবস্থায়! একপ্রকার অপামানিত বোধ করলো টুম্পা, এই অপমান তো সহ্যনীয় নয় কিছুতেই!

“তোমার বউ আমারে কেমনে কইলো দেখলা? আমারে একটা জিলাপি দিলে কি এমন হইত?”

এক বুক আশা নিয়ে সজীবকে কথাগুলো বললো টুস্পা, আর সজীবও টুম্পার আশায় পানি ঢেলে দিয়ে উত্তর দেয়,
“কইছে সব জিনিস দেওন যায় না, কয়ডা জিলাপিই তো! হেইডি পারুল তোরে দিলে খাইবো কি? আপাততো পারুল একলা খাক, ওর ক্ষিদে লাগছে না? তুই তো ভাত খাইছস! অয় অহনো কিছু খায় নাই।”

বজ্রপাতের ন্যায় কানে আঘাত আনলো টুম্পার কানে সজীবের কথাগুলো! সজীবের কাছে টুম্পার ধ্যান ধারনাই আলাদা! সে তো সজীবকে পছন্দ করে, পছন্দ বললে ভুল হবে, ভালোবাসে! তাও ভীষণভাবে। সেজন্যই তো সজীব বিবাহিত হওয়া সত্বেও টুম্পা আজও সজীবের আশায়ই করে। সেই মানুষটা তাকে এভাবে বললো! চোখের কোটরে পানি জমা হলো টুম্পার, যেনো এখনি টুপ করে গড়িয়ে পড়বে। কাঁদো কাঁদো সজীবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

“ঠিকআছে, তোমার বউ’ই খাক না হয়। আমার খাওন লাগত না।”
“আরে তোরে শরীফে আইনা দিব নে।”

সজীবের কথা বোধহয় সে অব্দি টুম্পার কানে গেলো না! তার আগেই প্রস্থান!

“আহারে, টুম্পা মনে হয় রাগ হইল!”
“আমনে আমারে ঠান্ডা জিলাপি খাওয়াইবেন?”
“না না, মুখ খোল।”

পারুল পরম তৃপ্তি ভরে সজীবের হাত থেকে জিলাপি খেতে লাগলো। অন্য সময় হলো পারুল তার ভালো মানুষি দেখিয়ে টুম্পাকেই জিলাপি দিয়ে দিতো, কিন্তু এখন নিজেকে কঠিন করেছে। ওই বাড়িতে গিয়ে আর শ্বাশুড়ির আচরণে এটুকু বুঝে গেছে তার সংসার, স্বামী তাকেই ধরতে হবে, বেশ শক্ত করেই!

মাছ কুটা শেষ করে সেগুলো ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করতে বেশ সময় লাগলো পারুলের। যেহেতু তারা হুট করেই চলে এসেছে সেজন্য রাতের রান্নাও করা বাকি! একে তো গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার! তারউপর এতগুলো মাছ মাংস কুটে পারুলের ইচ্ছে হচ্ছে না রান্নাঘরে আসতে, ইচ্ছে না হলেও সে বাড়ির বউ সে দায়ে তাকে আসতেই হলো শেষমেশ!

“ভাবী? দেও আমি রাইন্ধা দেই তোমারে?”

হুট করেই রান্না ঘরে রিয়া এসে বললো। পারুল কিছুটা অবাকই হলো। যে রিয়া কখনো রান্না ঘরেও আসতো না সে যখন বলছে রান্না করে দিবে তখন অবাক হবারই কথা!

“না থাক, তুমি পারবে না।”
“তুমি গেছো আর সবই পারছি ভাবী, গরমে তোমার কষ্ট হইব। দেও আমি একটু সাহায্য কইরা দেই।”

পারুল এবার আর না করলো না। তাছাড়া তারও অত ইচ্ছে হচ্ছে না!
“আইচ্ছা তুমি কাইলে সব্জি গুলো কুইট্যা ধুইয়া দেও। ততক্ষণে মাছ ভাজি করি।”

রিয়া মাথা দুলিয়েই রান্নাঘরের এক পাশে বসে সবজি থেকে আলু কুটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

“ভাবী? মাছগুলা মনে হয় পঁচা, কেমন গন্ধ বাইর হইছিলো আমার তো বমিই আইয়া পড়ছিল।”
“মাছের গন্ধই ওরম, তারউপর কয়েক ঘন্টা আছিলো তো! তুমি তো মাছ কুটো নাই তাই মনে হইছে মাছ পঁচা।”
“তা হইতে পারে, আমি তো ঘরের কুনো কামই করি নাই তেমন।”
“মাইয়া মানুষ বাপের বাড়িতে বড়ই আদরের হয় গো রিয়া। পরের বাইত গেলে বুঝবা।”

বিনিময়ে রিয়া কিছু বললো না। পারুল বলতে লাগে,

“তোমার না মাস্টার আইয়া পড়ব? যাও যাও জলদি যাও!”
“না ভাবী, হেয় কয়দিন আইব না কইছে।”
“আইচ্ছা।”

এভাবেই দুই ননদ ভাবী মিলে টুকটাক গল্প করতে থাকে। রিয়ার এভাবে কাছে আসা দেখে পারুলেরও বেশ ভাল্লাগে। কিন্তু সেই ভালো লাগা স্থায়ী হলো না বেশিক্ষণ। সেখানে এসে উপস্থিত হলো জমেলা বেগম! এসেই তার হম্বিতম্বি শুরু আগের ন্যায়!

“আমার মাইয়ারে তুমি চুলায় আনছো! মাগো মা!”

রিয়া বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো।

“আহ্ আম্মা! খালি না জাইন্যা কথা কও কিল্লিগা? আমিই আইছি। ভাবীর লগে গল্প করতে।”

জমেলা বেগম অবাক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“তুই গল্প করবি তোর সমবয়সী টুম্পার লগে। হেইডা না কইরা তোর ভাবীর কাছে বইয়া রইছছ!”
“হ, অহন তোমার কুনো সমস্যা আছে নি হেইডা কও!”

জমেলা বেগম এবার আশ্চর্য হয়ে বলে,

“আম্মার লগে এমনে কথা কইতাছস তুই! নির্ঘাত এই মাইয়া তোরে কিছু শিখাইছে!”
“আম্মা! ভাবী তো আইছেই একটু আগে! তুমি এমন শুরু করছো ক্যান?”

“তুই আমার পেডের মাইয়া রিয়া! কথাডা মনে রাহিছ কইলাম।”
“তই আমি কি কইছিনি আমি অন্য বেডির পেডেত্তে হইছি!”

মেয়ের এরকম কথায় চটে গেলেন জমেলা বেগম! গর্জে উঠে বলেন,
“কিহ্! যত বড় মুখ না তত বড় কথা! হারা°ম°জাদী মাইয়া! এই বন্ধ্যা বেডির হইয়া কথা কস তুই আমারে!”

তখুনি প্রবেশ করে কামাল হোসেন, স্ত্রীর এরকম গর্জে উঠা দেখে অবাক হউন!

“এতদিন ঝগড়া করতা, পোলার বউরে নিয়া। অহন মাইয়ারে নিয়াও শুরু কইরা দিছো!”

আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো কামাল হোসেনের কথা। কিন্তু স্বামীকে দেখে জমেলা বেগম দমে গেলেন। কন্ঠ নরম করে এনে বলে,

“তোমার অপেক্ষায়ই আছিলাম!”
“ক্যান?”
“আরে হুনো না! আমি এতক্ষণ কই আছিলাম জানো?”
“ঘরে আছিলা না? আইয়াই আবার পাড়া বেড়ানি শুরু করছো জমেলা?”

বেশ গম্ভীর কন্ঠে স্ত্রী’র উদ্দেশ্য কথাখানা বললো কামাল হোসেন, কিন্তু জমেলা মাথা ঠান্ডা রাখলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো।

“শেফালীর কাছে গেছিলাম, শেফালী আমারে দেইখ্যাই আমগো রিয়ার লাইগ্যা প্রস্তাব দিল! পোলায় অনেক বড়লোক লগে আমগো কোনো যৌতুকও দেওন লাগব না!”
“আর বাকিডা কয় নাই?”

জমেলা বেগম আগ্রহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে শুধোয়,

“মানে তুমি জানো?”
“আমি জানি এবং এই বিয়া আমি দিমু না।”

স্বামীর মুখে কথাখানা শুনে যেন বাজ পড়লো জমেলা বেগম এর মাথায়! এত ভালো পাত্র সে হাতছাড়া করবে! নাহ্ এ জমেলা বেগমের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না! যে করেই হউক তাকে কিছু করতেই হবে। বিয়ে তো সে দিবেই মনস্থির করেছে, তাছাড়া অত বড় মুখ করে শেফালীকে কথা দিয়ে এসেছে সেটাই বা খেলাপ করবে কি করে! বড় কথা হলো ছেলে অনেক বড়লোক তার মেয়েকে সুখে রাখবে, এখানে তো সমন্ধ করতেই হবে তাকে!

#চলবে?