#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-১৭
পারুল খুব ভোরে উঠে পড়ে ঘুম থেকে, অন্যদিনের তুলনায়। স্বভাবে চুপচাপ মেয়েটা, কিন্তু আজ তার চেহারায় অন্য রকম কিছু। দরজার ফাঁক গলে সোজা রিয়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। কড়া নাড়ে না। শুধু একবার “রিয়া” বলে ডাকে।
রিয়া তখন জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিল। সেই চেনা স্বর শুনেই শরীরটা কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে ফিরে তাকায়। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, পারুলের আওয়াজ শুনে উঠে বসে।
“রিয়া দরজাডা খুলো, দরকার আছে!”
রিয়া আস্তে করে শব্দহীনভাবে দরজা খুলে দিতেই পারুল ভেতরে ঢুকে দরজাটা আবার লাগিয়ে দেয়। যেন বাহির থেকে কেউ কিছু দেখতে না পায়! কাপড়ের আঁচল থেকে প্লেটটা বের করলো। কালকে জমেলা বেগম খাবার ফেলে দেবার পরও খাবার বেঁচে যায়। পারুল প্লেটটা বিছানার এক পাশে রেখে রিয়াকে বলে,
“কালকে কোনসময় খাইছো! এহনো খাও নাই। এরকম হইলে বাচ্চাটার ক্ষতি হইব, যা হওনের হইয়া গেছে। বাচ্চাটার তো দোষ নাই, তুমি চটপট খাইয়া লও তো, আম্মা ঘুমেত্তে উডার আগেই!”
উত্তরে রিয়া কিচ্ছু বলে না শুধু হু হু করে কেঁদে ফেলে।
পারুল কোনো প্রশ্ন করে না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। রিয়ার মাথায় হাত রাখে স্নেহে, না কি মা হওয়ার সহানুভূতিতে, নিজেও জানে না। ঘরের ভেতর তখনো অন্ধকার, জানালার ফাঁক দিয়ে একটা ম্লান আলো ঢুকছে, আর সেই আলোয় দুটো নারীর মুখ একটা অপরাধে গুমরে কাঁদছে, আরেকটা বোঝার চেষ্টা করছে, না জেনে যে কতখানি বোঝা সম্ভব। রিয়ার কান্না ধীরে ধীরে নিঃশব্দ থেকে ভারি হতে থাকে।
“এমনে কানলে আম্মা টের পাইয়া যাইব, তাইলে কাইলকা রাইতের মতন ভাতের থালা ফালাইয়া দিব রিয়া!”
তার আম্মা ভাতের প্লেট ফেলে দিয়েছে! কথাটুক শুনে রিয়ার কান্নার গতি আরো বেড়ে গেলো। পারুল সযত্নে রিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
“না কাইন্দা দ্রুত খাইয়া লও।”
আর কথা বাড়ায় না রিয়া। দুপুর রাত না খাবার ফলে বেশ জোরেই ক্ষিদে ছিলো পেটে। তাড়াহুড়ো করে সবটুকু ভাত খেয়ে নেয়! খুব দ্রুতই, তা দেখে পারুল আফসোসের সুরে বলে,
“ইশ! এই কয়ডা ভাতে তোমার পেট ভরে নাই না? কিন্তু কিছু করার নাই রিয়া, ভাত বাকিডি পঁচে গেছে।”
“আর লাগব না ভাবী। বাচ্চাটার লাইগ্যা দু মুঠ খাইছি।”
“তুমি নামডা কইয়া দিলেই তো পারো রিয়া! নাম কইতাছ না ক্যান? তাইলে তো তোমার ভাইয়েরা একটা সমাধান করতে পারতো কও!”
রিয়া নিশ্চুপ কালকের মতন। পারুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ে। বুঝে গেছে রিয়া কিছু বলবে না! অগত্যা যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রিয়া আচমকা পারুলের পায়ে পরে!
“ভাবী! তোমারে আম্মার লগে মিল্যা কত কটু কথাই না কইছি! অথচ সেই তুমিই আমার পাশে! আমারে তুমি মাফ কইরা দিও ভাবী!”
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে রিয়া! পারুল তৎক্ষনাৎ রিয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়, পা থেকে।
“আমারও তিন বইন আছিল, তোমারই মতন। ভাগ্যের দোষে তাগো চেহারাও দেহি না অহন! তোমার ভিতরেই আমি তাগো স্মৃতি মনে করি রিয়া। হেই লাইগ্যা তোমার কোনো কথা ধরিই নাই।”
রিয়া অবাক দৃষ্টিতে পারুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবতে থাকে এমনও মানুষ হয়! পারুলকে না দেখলে সে জানতোই না! জমেলা বেগম উঠে যাবে সে তাড়া দিয়ে পারুল রিয়ার রুম ছেড়ে চলে যায়।
“খালা আমু?”
জমেলা বেগম কপালে হাত দিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন, টুম্পার কথা শুনেই তিনি বলতে লাগে,
“আমার ঘরে আইতে জিগান লাগে? আইয়া পর!”
টুম্পা ইতস্তত করে বলে,
“না মানে, যদি খালু থাকতো, হেই লাইগ্যাই জিগালাম!”
“তোর খালু তো আজান দিলেই বিছানায় থাকে না আর! সে মসজিদে গেছে। তুই ভিতরে আয়।”
খালার থেকে আশ্বাস পেয়েই টুম্পা ভেতরে ঢুকলো। গিয়েই জমেলা বেগমের পাশে বসলো।
“চোখ দুইডা লাল,রাইতে ঘুমাও নাই খালা?”
“যে খবর হুনছি, আর ঘুম আইয়ে চক্ষে!”
“হেই লাইগ্যাই আমি একটা কথা কইতে আইছিলাম!”
“কি কইবি?”
জমেলা বেগমের সাড়া পেয়ে টুম্পা আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করে,
“হেইদিন আমার লগে গল্প করলা না তুমি? ওই শেফালী খালার দেবরের সমন্ধ? আমি কই কি তুমি ওইডা পাকা কইরা দেও!”
টুম্পার কথা শুনে জমেলা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বলে,
“অবৈধ বাচ্চা যার পেডে, হেই ছেমড়িড়ে কে বিয়া করব হুনি?”
“রিয়ার যে বাচ্চা পেডের মইধ্যে এইডা তো না জানাইলে জানব না খালা, বুদ্ধি দিয়া চিন্তা করো। রিয়ার অহনো পেট বোঝা যায় না। মনে হয় দেড় দুই মাস হইব। এখন যদি তুমি রিয়ারে বিয়াডা দিয়া দিতে পারো সম্মানও থাকব, রিয়া সুখী পরিবারে যাইব! মানে তোমার সাপও মরবো, লাঠিও ভাঙব না! বুঝছ খালা?”
টুম্পার কথা শুনে জমেলা বেগমের চোখ দুটি বড়বড় হয়ে উঠলো! রাগে দুঃখে এরকম চিন্তা ভাবনা তো মনেও আসে নি!
“এমনে তো ভাবি নাই!”
টুম্পা খুশি হয়ে বলে,
“আমি আছি না ভাবার লাইগ্যা! আমি কইয়া দিলাম!”
জমেলা ভেগম ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
“তা করা যায়, কিন্তু এইডা তো পাপ!”
“হুঁশ খালা! কিসের পাপ। ওই অবৈধ বাচ্চা বাপের পরিচয় পাইব, রিয়া ভালো থাকব। বড়লোক বাড়িতে সুখে থাকব!”
“তাইলো আমি আইজই শেফালীর বাড়িত যামু!”
টুম্পা খুশিতে গদগদ হয়ে পরে জমেলা বেগমের কথা শুনে!
“আইচ্ছা খালা।”
“তোরে অনেক ধন্যবাদ টুম্পা, আমারে এমনে কওয়ার লাইগ্যা!”
“ধন্যবাদের কাম কি খালা? আমারে তোমার কাছে রাইখ্যা দিবা, এতেই খুশি।”
জমেলা বেগমের বুঝতে বাকি রইল না টুম্পা কিসের ইঙ্গিত দিয়েছে।
“তোর মনস্কামনা দ্রুত পূর্ণ হইব!”
টুম্পা আর অপেক্ষা করে না, জমেলা বেগমের ঘর থেকে চলে যায়। সে এসেছিল তার স্বার্থে, আর জমেলা বেগমও নিজের সম্মানের স্বার্থেই টুম্পার বোঝানো বাক্যগুলো কি অনায়াসেই মেনে নিলো! ভাবলো না আগেপিছে কোনো কিছুর কথা!
~~~~~~~
“একটা বিয়াইত্তা বেডা! তার বউ নিশ্চয়ই এমনে এমনে যায় নাই? হেই বেডা মাইনষের লগে আমার মাইয়ারে বিয়া দিতে চাও!”
বেশ রাগী কন্ঠে কামাল হোসেন স্ত্রী’কে কথা গুলো বললো। একটু আগেই দুই ছেলে আর স্বামীকে ডেকে এনে এই প্রস্তাবখানা রাখেন তিনি! স্বামীর ধমকেও চোখেমুখে কোনো রেশ নেই তার। তিনি নিজের ভাব বজায় রেখেই বলতে লাগে,
“ওই মাইয়ায় তো পেট বান্ধাইছে! ওরে যত সম্ভব বিদেয় করে দেওন উচিত!”
“এইরকম একটা
পুরো কথা শেষ করে উঠতে পারলেন না কামাল হোসেন। বাহির থেকে এক পুরুষালি কন্ঠের আওয়াজে তার কথা থেমে যায়।
“কামাল ভাই? ভেতরে আছেন নি? কথা আছিল একটু!”
“বাইরে মানুষ আইছে, এই বিষয়ে আর একটা কথাও যেন না হুনি জমেলা!”
জমেলা বেগমকে শাসিয়ে কামাল হোসেন বাহিরে যেতেই দেখে এক ভদ্রলোক হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে আরো একজন লোক আছে। সেই ভদ্রলোক কামাল হোসেনকে দেখেই প্রথমে সালাম বিনিময় করলেন।
“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”
“জ্বি, কিন্তু আমনে কে?”
ভদ্রলোকটি মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দেয়,
“যদি অনুমতি দেন ভেতরে আইলে ভালা হইত, যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা কথা আছিলো।”
“ঠিকআছে আইয়েন।”
অনুমতি পেয়ে ভদ্রলোক দুজন ভেতরে গেলেন। পারুল দু’টো চেয়ার এনে দিলেন বসার জন্য।
“এবার কন, কি কথা?”
“আমি হইতাছি কবিরের বাবা। আমনের ছুডো মাইয়ারে যে পড়ায়। মানে আমনের বন্ধুর বড় ভাই। ভাই বাইচ্যা থাকলে আইজ হেয় নিজেই আইতো। হেয় নাই দেইখ্যা চাচা হিসেবে আমিই আইছি, দায়িত্ব পালন করতে।”
পরিচয় শুনে কামাল হোসেন মুখে মৃদু হেঁসে বললেন,
“ওহ্ আমনে! খবর কি? ভালানি সব?”
“হ ভাই খবর ভালোই, তয় আরেকখান খবর লইয়া আইছি।”
“কি খবর?”
ভদ্রলোক কামাল হোসেনের দিকে মিষ্টির হাঁড়িটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ধরেন, এইডা রাখেন।”
“খবর কি?”
“আমার ভাতিজি কবিরের লাইগ্যা আমি আমনের ছুডো মাইয়ার সমন্ধ আনছি। মাইয়া যেহেতু পোলায় আগেই দেখছে আর দেখনের কিছু নাই। আমগো মাইয়া পছন্দ হইছে। আমনেরাও পোলারে দেখছেন যদি প্রস্তাব গ্রহণ করতেন!”
ঘরের ভেতর দরজার আড়ালে জমেলা বেগম সব কথা শুনছিলেন, পারুলও দাঁড়িয়ে ছিলো পিছনে। ভদ্রলোকের কথা শুনেই জমেলা বেগম চোখ দু’টি বড়বড় করে স্বামীর দিকে তাকালেন! কামাল হোসেন তখন স্থির হয়ে বসে আছে!
“উত্তর দেন ভাই সাহেব?”
“কি উত্তর দিমৃ ভাই, হুট করেই এমন প্রস্তাব!”
ভদ্রলোক তখন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি, হুট করে আসলে কুনো কিছু হয় না! আমনে আমনের পোলাগো লগে আলোচনা কইরা জানান ভাই।”
“ঠিকাছে!”
কামাল হোসেন ঘরে যেতেই জমেলা বেগম বেকে বসলেন।
“ওই গরীব পোলার লগে আমি আমার মাইয়ারে বিয়া দিমু! কক্ষনই না সজীবের বাপ!”
“আম্মা, কবির পোলাডা শিক্ষক, পোলাপান পড়ায় পাঠশালায়, কত সম্মানজনক পেশা ভাবো তো!”
“তুই ছুডো ছুডোর মতন থাকবি শরীফ! এত বেশি কথা কইবি না! সম্মান ধুইয়া কি পানি খাইব? শেফালীর দেওরের টেকা আছে, রিয়ারে শহড়ে লইয়া যাইব! দয়া কইরা মাইয়া মানুষ পড়াতে পারছে, বইতে দিছি আর শুইতে চায়! আমনে এক্ষণি গিয়া তাগো মানা কইরা দেন!”
স্ত্রী’র এরকম কথায় কামাল হোসেন দমে গেলেন। আশাহত দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন সজীবের দিকে! সজীব তখন বাবাকে ভরসা দিয়ে বলে,
“তোমার যেইডা ভালো মনে হইব, ওইডাই কইয়া দেও!”
ছেলের কথার উত্তরে জমেলা বেগম স্বামীকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“খবরদার! না যেন থাহে তোমার উত্তর!”
জমেলা বেগমের কথা শুনে নিয়ে বাহিরে পা বাড়ালেন, তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে।
#চলবে?