অর্ধাঙ্গ পর্ব-১৮

0
45

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-১৮

শরীফ, সজীব, কালাম হোসেন। বাড়ির সব পুরুষ মানুষ একত্রে বসেছে ভাত খেতে। কালকে রাতে কারোর’ই খাওয়া হয়নি ভালো করে, পারুল ভাতের বোল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়। কারো পাতে লাগলে দিবে সেজন্য। ঠিক তখুনি জমেলা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। বাড়ির পুরুষ মানুষরা খাবার পরপরই সাধারণত বাড়ির মেয়ে বউরা খায়। তবে সবাইকে খাইয়ে সব শেষ করে, শেষে খেতে বসতো পারুল। এখনো সেইটা মেনে চললেও নিয়মের উল্টো করেন জমেলা বেগম। কাউকে খেতে দেখলে যেন তার ক্ষিদে দ্বিগুণ হয়ে উঠে! সেজন্যই তো ভাতের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাত খেতে খেতে সবার সামনে এসে উপস্থিত হয়। আদেশের সুরে পারুলকে বলে,

“বউমা? এক টুকরো মাছ দেও তো!”

পারুল মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“আম্মা, মাছ তো শ্যাষ!”
“কিহ্! মাছ শেষও? আইচ্ছা আমার লাইগ্যা না রাখতা, টুম্পার লাইগ্যা অন্তত এক টুকরা রাখতা? মাইয়াডা তো বেড়াইতে আইছে না-কি!”
“মাছ ভাজনের সময় টুম্পা আমার থেইক্যা চাইয়া খাইছে আম্মা।”

পারুলের কথা শুনে জমেলা বেগম চুপ করে গেলেন, বলার কিছু রইল না। কিন্তু সেই জায়গায় এসে উপস্থিত হলো টুম্পা! মুখ বেঁকিয়ে ন্যাকামো করে বলতে থাকে,

“এক টুকরো মাছই তো খাইছি, তার লাইগ্যা এমনে কওন লাগে?”
“আম্মা জানতে চাইছে, তাই কইছি।”

পারুলের উত্তরে সঙ্গে সঙ্গে তেতে উঠলেন জমেলা বেগম।
“আমার দোষ দিতাছ ক্যান? আমি কিছু করি নাই!”
“আমনে জিগাইছেন, আমি কইছি। এটুকুই তো!”
“আইচ্ছা ভাবী, খালারে আর এমনে কইয়েন না, দরকার হইলে আমারে আগে থেইক্যাই কইয়া দিয়েন। আমি মাছ খামু না!”

টুম্পার কথায় এবার বেশ বিরক্তি ধরলো পারুলের! ছোট্ট একটা বিষয়কে মেয়েটা এভাবে এনে প্যাঁচ প্যাঁচ করো যাচ্ছে সেটা তার মোটেও ভাল্লাগছে না। তবে এরকম মেয়েদের সাথে কথায় পেরে উঠা যায় না, সহসা। এরা কিছু হলেই ফ্যাঁচফ্যাচ করে কেঁদে দেয়। সেজন্য পারুল প্রসঙ্গ ঘোরাতে অন্য কথা বললো,

“আব্বা, কি সিদ্ধান্ত নিলেন রিয়ার ব্যাপারে!”

কামাল হোসেন উত্তর দেবার আগেই জমেলা বেগম রেগেমেগে বলে উঠে,

“তুমি আমার সোয়ামীরে প্রশ্ন করো! তোমারে জবাবদিহি দেওন লাগব?”
“আহ্ জমেলা! পারুল বাড়ির বউ হিসেবে জিগাইতেই পারে। তুমি ক্যান এমন করতাছ?”

শ্বশুড়ের উত্তর শুনে পারুল মনে মনে বেশ খুশি হলো। কামাল হোসেন খেতে খেতে পারুলকে জবাব দেয়,

“তারা নাকি পরের সপ্তাহে আইব। আমি কইছি তহন জানামু।”
“আব্বা রাগ না করলে একটা কথা জিগামু?”
“কও।”

শ্বশুড়ের অভয় পেয়েই পারুল আমতা আমতা করে বলে,
“আমার মনে হয় রিয়ারেই জিগান উচিত, হেয় কারে বিয়া করতে চায়!”

পারুলের কথা শেষ হওয়া মাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন জমেলা বেগম। চোখমুখ কুঁচকে রাগী কন্ঠে বলে,
“কি জিগাইব আবার? মাইয়া মাইনষের এতকিছু জিগান লাগে না! আমগো বাপ মা যেমন পছন্দ কইরা বিয়া দিছে, তেমন আমি যেমন শেফালীর দেওররে পছন্দ করছি রিয়াও তারেই বিয়া করব! বড় ঘর, বড়লোক মানুষ, রিয়া হেনেই সুখে থাকব! তুমি তোমার লম্বা নাক গলান বন্ধ করো! না হইলে নাক আর নাকের জায়গায় থাকব না কইলাম!”

বিনিময়ে পারুল কিছু না বললেও সজীব উত্তর করে,

“আম্মা, জিগাইয়াই দেহেন না হয়!”
“তুইও তোর বউয়ের দলের হইয়া গেছস! বাহ্! তোর বউ দেহি আমার জায়গা লইয়া গেছে! তোর বাপরে তো আগেই! আর এহন তোরেও শেষমেশ! নির্ঘাত কালাজাদু শিখছে!”

মায়ের এরকম আচরণের সাথে পরিচিত সজীব। সেজন্য সেও আর কথা বাড়ায় না। তাছাড়া রিয়ার ব্যাপার নিয়ে মন মেজাজও ভালো নেই। কথা বলতেও ইচ্ছে করে না তার!

“খাওনের সময় এত ঝামেলা কইরো না জমেলা!”
“হ, আমিই যা কই ঝামেলা। এহন তো তোমার পোলার বউ’র কথাই ভালা মনে হইব!”
“চুপচাপ খাইবা? না আমি উইঠ্যা যামু খাওন ছাইড়া?”

স্বামীর কথায় এবার চুপ হলেন জমেলা বেগম। পারুলের দিকে চোখ বড়বড় করে একবার তাকিয়ে নিলেন, যার অর্থ এতো কথা শোনার উত্তর সেও সুদে আসলেই দিয়ে দিবে! তবে তার হম্বিতম্বি বজায় রেখে খাবারের আধোয়া প্লেট পারুলের দিকে ঠেলে দিয়ে চলে গেলেন! রেখে গেলেন পারুলের প্রতি তার রাগ আর ক্ষোভ! একে একে সবার খাওয়া শেষ হতেই পারুল, ভাতের থালা গুছিয়ে রিয়ার রুমে যায়। মেয়েটা লজ্জায় বেরও হয় না, এমনকি খেতেও না! কিন্তু এমন হলে তো বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না, কেউ না বুঝলেও পারুল ঠিকই বুঝেছে, রিয়া এতকিছু করছে বাচ্চাটাকে বাঁচাতেই! একে একে সবকিছু শেষ করে পারুল নিজের রুমে যায় রেস্ট নিতে। তখুনি দেখে সজীব গায়ে শার্ট পড়ে কোথাও একটা যাচ্ছে! পারুল প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সজীবের দিকে,

“কই যাইতাছেন দুপুরবেলা?”

সজীব শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে উত্তর দেয়,
“বদলি দিতে, সুজনের ক্ষেতে।”
“এই দুপুরেই?”
“হ,আমার মনে হইতাছে খুব দ্রুতই রিয়ার বিয়া লাগব। আমরা তো কেউই ভাবি নাই রিয়া এরকম একটা কাজ করবো। তার লাইগ্যা তেমন টেকা পয়সাও গুছাই নাই। এহন যা কাম পামু, হেইডাই করমু! না হইলে হইব না।”

পারুলের মন খারাপ হলেও সংসারের দায়িত্ব পালন করার জন্য স্বামীকে খারাপ লাগা থেকেই বিদায় দেয়। সজীব চলে যেতেই, সেখানে কড়া নারে শরীফ।

“ভাবী?”
“ভেতরে আইও।”

শরীফ ভেতরে গিয়ে পারুলের হাতে একটা প্যাকেট দিতেই পারুল অবাক নয়নে শরীফকে প্রশ্ন করে,

“এইডা কি দিছো?”
“হেইদিন বাজি ধইরা জিতছিলাম, মেলায়ও গেছিলাম। এই শাড়িডা পছন্দ হইছে। তুমি আমার লাইগ্যা এত করো, আমি গভীর রাইতে বাড়ি ফিরলে আমার লাইগ্যা ভাত লইয়া বইয়া থাহো, আমার না খাওয়া তরকারি হইলে তুমি আলাদা কইরা তরকারি রান্ধা থেকে কত্ত কিছু যে করো! আর আমি দেহো? কিছুই করতে পারি নাই তোমার লাইগ্যা। তোমারে কুনোদিন তো কিছু দেওয়া হয় নাই। তাই তোমার লাইগ্যা আনছি।”

পারুল প্যাকেট খুলে শাড়িটা বের করে দেখে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি! আচলের দিকে সাদা ফুলের ডিজাইনও আছে। শাড়িটা বেশ পছন্দ হলো পারুলের। তবে শরীফকে উত্তর দেয়,

“কে কইছে তুমি কিছু করো নাই? এই যে আমার হইয়া তোমার আম্মারে উত্তর দাও, যেইডা তোমার ভাইজানের কওনের কথা হেইডা তুমি কও! এগুলো কি কম কিছু?”

শরীফ খুশি হয়ে বলে,

“ভাইজান আম্মারে ভালোবাাসে, মানে বহুত। আর ছুডো বেলা থেইক্যাই দেখছি আম্মাও ভাইজানরে বেশি ভালোবাসে। হেই লাইগ্যাই হয়ত ভাইজান এরম!”
“হইতে পারে!”
“আইচ্ছা কন, উপহার কেমন কইছে?”
“বেশ সুন্দর তো!”
“আমনের পছন্দ হইছে?”
“ম্যালা পছন্দ হইছে ভাই!”
“তাইলেই হইলো।”

শরীফ খুশি মনে চলে যাচ্ছিল, পারুলের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায়,

“হুনো একটু?”
“কন ভাবী।”
“এইসব বাজি ধরা ভালা না, কোন সময় কোন ক্ষতি হইয়া যায় ঠিক না, ভাই।”

শরীফ বিনিময়ে কিছু না বলে মাথা নিচু করে রাখে, সেটা দেখে পারুল আবারো বলে,

“ছাইড়া দিও। বিপদ আপদ কইয়া আইয়ে না।”
“আইচ্ছা। ভাবী শাড়িডা একদিন পইড়েন।”

পারুল মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দেয়,

“তুমি দিছো, না পইড়া কি থাকমু? অবশ্যই পড়মু!¡

“হয়, সুন্দর শাড়ি কয়দিন পর স্বর্ণের গয়না! আল্লাহ গো, বড় পোলার লগে লগে আমার ছুডো পোলাডারেও এই কা°লনাগিনী বশ করতাছে! কে কই আছো, দেইখ্যা যাও গো। আমার সব শেষ হইয়া গেল!”

সুন্দর একটি মুহুর্তের ভেতর জমেলা বেগমের এরকম চিৎকারে চমকে উঠল শরীফ আর পারুল দুজনই! জমেলা বেগম মাথায় হাত দিতে দিতে উঠোনে গিয়ে চিৎকার করতে লাগলো। পারুলের মনে এবার ভয় ধরে উঠলো পাড়া প্রতিবেশী চলে আসছে তো আরেক বিপদ! পারুলও আর দেরি না করে দ্রুত উঠোনে গিয়েই জমেলা বেগমকে বলে,

“আম্মা, এইডি কি কইতাছেন! মান সম্মান তো সব শ্যাষ হইয়া যাইব!”
“যা শ্যাষ হওনের হইয়া গেছে! যদি কিছু রাখতে চাও তাইলে আমার সম্মান রক্ষা কইরা রিয়ার বিয়া শেফালীর দেওরের লগেই ঠিক করো! সবাইরে বুঝাও! না- হইলে এখন তোমার সম্মানেরও সমাপ্তি হইব!”

#চলবে?