অর্ধাঙ্গ পর্ব-২০

0
42

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২০

রিয়ার বিয়ের সব কাজ শেষ করে পারুল ফিরেছে নিজের রুমে, একেবারে ক্লান্ত। ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ে জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ঘরটা পুরো অগোছালো। সারাদিন রিয়ার বিয়ের দৌড়ঝাঁপে নিজের জন্য একটুও সময় পায়নি। এখন এই এলোমেলো ঘরটাকে গুছিয়ে নিতে হবে, তারপরই মিলবে একটু বিশ্রাম। সজীবও ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে অগোছালো বিছানাতেই শুয়ে পড়েছে। পারুল একবার চারপাশটা তাকিয়ে দেখে, তারপর ধীরে ধীরে গুছানোর কাজে নেমে পড়ে সব ঠিক না করলে কি আর শান্তি মেলে? ঠিক সেই মুহুর্তেই সজীবের কন্ঠস্বর কানে এসে বাজলো,

“বউ?”

সজীবের কন্ঠ অন্যরকম ঠেকলো। যেন কেমন জানি। সে ডাকে পারুলের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পারুল ধীর পায়ে সজীবের দিকে এগিয়ে গিয়ে উত্তর দিল,

“কি হইছে? কন আমারে?”

সজীব বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,

“তোর অনেক কষ্ট হইছে না?”

সজীবের এরকম বোকা প্রশ্নে পারুল হেঁসে দিয়ে উত্তর দেয়,
“কিয়ের কষ্ট আবার? রিয়া তো আমার নিজের ছুডো বইনের মতনই।”
“সবই বুঝলাম, কিন্তু তুই তোর কানের দুল জোড়া দিয়া দিলি? তোর কান খালি কইরা?”

পারুল চৌকির দিকে এগিয়ে যায়। সজীবের একটা লুঙ্গি ভাঁজ করতে থাকে। তাড়াহুড়ায় যখন সজীব পুরো টাকার ব্যবস্থা করতে পারেনি, আবার রিয়ার বিয়ের তারিখও চলে এসেছিল, এমতাবস্থায় স্বামীর পাশে দাঁড়াতেই পারুল নিজের কানের দুল জোড়া খুলে সজীবের হাতে দিয়ে দেয়। নিরুপায় সজীব তখন দায়িত্বের ভাড়ে পরে বাধ্য হয়ে পারুলের সেই দুল জোড়া বিক্রি করে বোনের বিয়ের বন্দোবস্ত করে। বিয়ের পর সে কখনো পারুলকে কোনো অলংকার গড়িয়ে দিতে পারেনি, উল্টে যেটুকু ছিল সেটুকুও সে নিয়ে নিয়েছে। এক প্রকার অপরাধ বোধ জেঁকে ধরেছে সজীবকে।

“বিপদের সময় মাইয়াগো গয়নাই সম্বল! স্বর্ণ হইছে বিপদের বন্ধু, বিপদের সময়ই যদি তারে কামে না লাগাই তাইলে কি করুম?”

পারুলের প্রশ্নে সজীব নিশ্চুপ থাকে। সে জানে পারুলকে বলে কোনো লাভ নেই, সে বরাবরের মতনই এরকম। সবার জন্য ভাবে শুধু নিজেরটুকু বাদ দিয়ে। সজীবের চুপ থাকার মানে বুঝলো পারুল। এরকম পরিস্থিতি বদলাতে সে নিজেই বলতে লাগে,

“আমার কাছে দামী একখান অলংকার এহনো আছে জানেন?”
“কী?”
“আমনে, আমার স্বামী! স্বামীই তো মাইয়াগো সবচেয়ে বড় অলংকার। আমনে আছেন না?”

সজীব অবাক দৃষ্টিতে পারুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকালো৷ তারপর ছোট্ট করে জবাব দিলো,

“আমি আছি বউ, আজীবনের লাইগ্যা আছি তোর লগে।”

যেন এরকমই উত্তর আশা করছিল পারুল সজীবের কাছ থেকে। কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে ঠোঁটের কোনে দেখা দিল মৃদু হাসি।

“তাইলেই হইব।”
“তাও।”

পারুল বুঝলো সজীবের মনের খচখচানি এখনো যায়নি, বড্ড সরল কি-না মানুষটা! মাঝেমধ্যে পারুলের ভয় ধরে৷ এই সরলতার জন্য না জানি কোন বিপদ চলে আসে তাদের মাঝখানে।

“শুনেন, আমার এহনো আমার মা’য়ের দেওয়া একখান গয়না বাকি আছে। মন চাইলে হেইডা ভাঙায় দুল এক জোড়া বানাই নিমুনে, এইডা ধইরা মন খারাপ কইরেন না।”
“না! আমিই তোরে বানাই দিমু, নতুন।”
“আইচ্ছা ঠিকআছে। এহন এমন মন খারাপ বাদ দেন তো।”
“একটু বুকে আয় তো বউ। বড্ড অশান্তি লাগতাছে।”

পারুল দ্রুত গিয়ে সজীবের কাছে দাঁড়াতেই সজীব নিজের বুকের মধ্যে পারুলকে নিয়ে নিলো। চুপটি করে সেখানে রইলো পারুল, ছোটো বাচ্চাদের মতন।

“এইবার শান্তি মিলছে।”
~~~~~~~

“সাতটা বাজছে সকাল! অহনো পেডের মইধ্যে কিছু পড়ে নাই, ক্ষিদায় জান বাইর হইয়া গেলো!”

উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পারুলের রুমের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে পারুলের উদ্দেশ্য কথাগুলো বলছে জমেলা বেগম। চিৎকারে শরীফের ঘুম ভেঙে যায়। মা’য়ের কথার প্রতি উত্তর করে,

“জান বাইর হইয়া গেলে চিল্লান কেমনে আম্মা?”

আগুনের মধ্যে ঘি পড়লো শরীফের কথায়, জমেলা বেগম অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো ছেলের দিকে। কিছু বলবে তার আগেই কামাল হোসেন এসে হাজির হয়।

“চিল্লাইতাছো ক্যান, সকাল সকাল?”
“আমনের পোলার বউ অহনো উঠে নাই, না খাওয়াইয়া শুটকি দেওনের বুদ্ধি করছে আমারে!” “এইডা কি কথা জমেলা? বউমা কাইলকা রিয়ার বিয়া দেইখ্যা বহুত কাম করছে, ক্লান্ত দেইখ্যা আজকে উঠতে দেরি হইতাছে, এই কারণে তুমি এমন করবা?”

জমেলা বেগম মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দেয়,

“আমি কিছু করি নাই!”
“না করলেও এহন করবা, যাও পাকঘরে গিয়া আমার লাইগ্যা কড়া কইরা এক কাপ চা বানাইয়া আনো।”

অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছালেন জমেলা বেগম। পারুল বউ হয়ে আসার দ্বিতীয় দিন থেকেই তার রান্নাঘর থেকে ছুটি মিলেছে। যাও ছেলেকে হাত করতে দু এক বার রান্না করতো সেসবও জোগাড় করে দিতো পারুল। সে শুধু নাম করতে পিড়িতে বসে আরামে রান্নাটুকু করতো। এই সকাল সকাল ক্ষিদে পেটে নিয়ে রান্নাঘরে সে যাবে? অসম্ভব!

“আমি যামু পাকঘরে?”

কামাল হোসেন নির্দ্বিধায় বললো,

“হ, তুমিই যাইবা।”

জমেলা বেগম কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দেখে কামাল হোসেন ধমকের স্বরে এবার জমেলা বেগমকে বলে,
“জমেলা! দশ মিনিটের ভিতরে যেন চা আমার সামনে হাজির হয়! আমারে যেন তোমার সামনে হাজির হওয়া না লাগে।”

আদেশ দিয়েই কামাল হোসেন সেখান থেকে চলে গেলো। স্বামীর এরকম ধমক শুনে অগত্যা জমেলা বেগম রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। রান্নাঘরে গিয়েই দেখে পাতার বস্তা চুলার এক পাশে পড়ে আছে। আরেকটু হলেই আগুন ধরে যেতো এরকম অবস্থা! পুরো রান্নাঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাতা। কীরকম হয়ে আছে অগোছালো অপরিষ্কার, ইচ্ছে করছে এখুনি চিৎকার করে পুরো পাড়া মাথায় তুলে নিবে কিন্তু কামাল হোসেনের মতিগতি ভালো না, সেদিন সবার সামনে জমেলা বেগমকে চড় দেবার পর থেকে স্বামীকে বেশ সমঝে চলেন তিনি। ঠিক তখুনি উঠোন দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে টুম্পাকে।

“ও টুম্পা, এদিকে আয় তো।”

ডাক শুনে টুম্পা রান্না ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাই তুলতে তুলতে জিগ্যেস করে,

“খালা? আমনে পাকঘরে কি করেন? ভাবী কই?”
“মহারানী আরামে ঘুম যাইতাছে, আর আমি চুলা গুঁতোই! পাকঘরের কি অবস্থা করছে দেখছত? আর একটু হইলেই পাতার বস্তায় আগুন ধইরা সব পুইড়া শ্যাষ হইত!”

রাগে গিজগিজ করতে করতে জমেলা বেগম কথাটা বললেন। কালকে রান্নাঘরে তরকারি গরম করতে এসেছিল টুম্পা, এই কাজ তারই সেটা ভুলেও বলা যাবে না।

“হ দেখলাম তো খালা। নিশ্চয়ই কামে মন আছিল না, হেই লাইগ্যা এই দশা!”

“আর মন! না দিতে পারলো আমার বংশের বাত্তি! না করতে পারতাছে ভালা মতন কাম। কবে যে এ বিদায় হইব!”

“এহন তো মুখও চলে, থামার নামই নাই!”
“অর মুখ কেমনে বন্ধ করে, হেই রাস্তা আমি চিন্তা করছি। আমার মাইয়ারে খেদাইছে না? আমিও তারে আজকেই খেদানের ব্যবস্থা করুম, তাও চিরতরে!”

কথা শেষ করে জমেলা বেগম চুলোয় পাতা গুঁজে দিলেন। আগুনের আঁচ বাড়িয়ে দিলেন আরো। এদিকে টুম্পা খুশিতে গদগদ অবস্থা! সে জমেলা বেগমের কথানুযায়ী ধরেই নিয়েছে আজকে ধামাকা হবে।

#চলবে?