#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব–২৯
সকাল হয়েছে। উঠোন পেরিয়ে আলোর রশ্মি ঢুকছে ঘরের মেঝেতে। রান্নাঘরের চুলা এখনো ঠান্ডা, আগুন জ্বলেনি। ঘরের কোণটায় বসে আছে পারুল। সজীবের পুরনো নীল শার্টটা কোলে রেখে বোতাম লাগাচ্ছে। শার্টটা বেশ নরম হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় রঙ মুছে গেছে, কাপড়ও পাতলা। বোতামটা টান দিতেই উঠে এসেছে। নিত্য নতুন কাপড় কেনার মতো সামর্থ্য নেই তাদের সংসারে। তাই পুরনোগুলোকেই আঁকড়ে বাঁচতে হয়। পারুল সূচে সুতো গেঁথে মন দিয়ে সেলাই করছে। এমন সময় দরজার আড়াল সরিয়ে ঘরে ঢুকে সজীব। কিছুক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে বলে—
—“তোর খুব কষ্ট না রে পারুল?”
পারুল ভ্রু কুঁচকে তাকায়, উত্তর দেয় না।
সজীব আবার বলে,
—“এই সংসারে তোর ভালা লাগে? আমি তোরে একটা নতুন জামাও দিতে পারি না। তুই কিছু কস না ক্যান?”
পারুল মাথা নিচু করে বলে,
“কষ্ট থাকলে বুঝা যায় সুখটা কত দামি।”
সজীব চুপ করে বসে যায় পাশে। কথা আটকে যায় গলায়। তবুও বলে,
“তোর পড়নের কাপড়টাও ছিঁড়ে গেছে!”
“সেলাই কইরা নিলে আরো কয়েক মাস পিন্দন যাইব।”
সজীব বুঝলো সে পারুলের সাথে কথায় পেরে উঠবে না!
“আমি টাকা পাইলেই আগে তোরে লাল টুকটুইক্যা একটা কাপড় কিইন্যা দিমু, বউ।”
পারুল এবার মুঁচকি হেঁসে বলে,
“রিয়ার বিয়ার লাইগ্যা মুদি দোকানে ধার জমছে। আগে ওইডি পরিশোধ করবেন।”
সজীব উত্তর দিচ্ছিলো তার আগেই, ঠিক তখনই উঠোন থেকে ভেসে আসে কড়া কণ্ঠস্বর।
জমেলা বেগম,
“চুলাত এখনো আগুন জ্বলে নাই ক্যান? এইডা কেমন বউ রে বাবা!”
জমেলা ঘরে ঢুকেই পারুলের দিকে তেড়ে আসে। বাঁজখাই কন্ঠে বলে,
—“এইডা বউয়ের কাম? এহনো রান্ধা শুরু হয় নাই!”
পারুল ধীরে উঠে দাঁড়ায়, গলার স্বর নরম রেখে বলে,
—“আমি তো শার্টের বোতাম লাগাইতাছিলাম। টুম্পা তো ঘরে আছে।”
জমেলা চোখ পাকায়,
“টুম্পা চুলায় যাইব? তুই এখন রাণী হইয়া গ্যাছস?
পারুল শান্ত স্বরে বলে,
—“আমি রাণী হইছি কবে আম্মা? আমি তো শুধু কইলাম, টুম্পাও এই বাড়ির বউ! ওরও দায়িত্ব আছে।¡
জমেলা খেপে যায়,
—“এইসব মুখের জবাব কই থেইকা শিখছো? এখন কিছু কইলেও উল্টা কথা হুনাইয়া দেও!”
সজীব এবার উঠে দাঁড়ায়, চোখে চোখ রেখে বলে,
—“আম্মা, পারুল দোষ কি করছে? সারাক্ষণ কাম করে না? আর ঠিকই তো কইছে, টুম্পা বাড়ির বউ না? এতদিন পারুল একা ঘরের বউ আছিলো দেইখ্যা সব করছে, এখন ছুডো বউ হইছে। তার কি উচিত না সংসারের দায়িত্ব কাঁধে লওয়া!”
ছেলের কথা শুনে জমেলা বেগম এবার মিথ্যা কান্নার অভিনয় করে বলে,
“ওরে বাজান! তোরে এত কষ্ট কইরা মানুষ করছি। আর তুই এহন বউর পক্ষ লইয়া কথা কস, তাও মা’র উপরে! এমনই দিন বুঝি দেহনের আছিলো রে বাপ!”
“পক্ষ লইয়া কথা কই নাই, তোমগো বউ গো ঝুট ঝামেলা আমার ভাল্লাগে না আম্মা! আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। এসবে আমারে বেহুদা জড়াইবেন না তো!”
জমেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ গোমড়া করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে সজীব জমেলা বেগমের উদ্দেশ্য বলে,
“টুম্পারে কও গিয়া চুলা ধরাইতে।”
সজীব আবার বসে পড়ে পারুলের পাশে। চুপচাপ তাকায় তার কাজ করা হাতে।
“তুই আরএত চুপচাপ থাকিস না, তোরে খালি খাটায়!”
পারুল কিছু বলে না। সজীবের পরিবর্তন দেখে কেবল হাসে। এতটুকুই তো চেয়েছিলো সে। মনে হয় পেয়ে ও যাচ্ছে! সূঁচে সুতার গিঁট পড়তে থাকে। পারুল সেগুলো ছাড়াতে থাকে মনোযোগ সহকারে।
—
হারিকেনের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। চৌকিতে কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছে শরীফ। পাশেই টুম্পা চিন্তাগ্রস্ত চেহারা নিয়ে বসে আছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর রাত, আশেপাশে কোনো টু শব্দও নেই। সে তার মতন নিচেই মাদুর পেতে শুয়েছিলো হঠাৎই শরীফের গোঙানির আওয়াজ শুনো ঘুম ভেঙে যায়। তারপর উঠে দেখে শরীফ কাঁপছে! কপালে হাত দিতেই বুঝে বেশ জ্বর এসেছে। তৎক্ষনাৎ টুম্পা শরীফের মাথায় পানি দিয়ে দেয়। তারপর একটি ওষুধও খাইয়ে দেয়। শরীফের জ্বর কিছুটা কমলেও শরীর এখনো দুর্বল। টুম্পা পাশে বসে তার দিকে চেয়ে আছে, চোখে চিন্তার ছায়া। শরীফ ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে টুম্পার গালে নরম একটা স্পর্শ দিলো, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তুই আমার পাশে থাকলে, আমিও ঠিক হইয়া য়ামু।”
টুম্পা কিছু না বলেই শরীফের পাশে বসে রইলো। এভাবে সময় গড়াতে থাকে। টুম্পা ঘুমে ঢুলঢুলু অবস্থা প্রায়। তবুও না শুয়ে বসে আছে। কিছু সময় এভাবে যাওয়ার পর হুট করেই টুম্পা অনুভব করে শরীফের স্পর্শ। কিছু বুঝে উঠার আগেই, শরীফ আর একটু এগিয়ে এসে, ভালোবাসার মায়াজালে টুম্পার ঠোঁটের কাছে তার ঠোঁট নিয়ে এলো। শরীফের প্রথম চুমুটা ছিলো কোমল, নরম, একধরনের মধুর স্পর্শের মতো, যা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হলো।
চুমুর স্পর্শ ছড়িয়ে পড়লো টুম্পার গালে, লজলজে চোখগুলো ঢেকে গেলো। চোখের ঘুম তখন বিদায় নিয়েছে। টুম্পার কেমন লাগছে, অদ্ভুত অনুভূতি। শরীফকে কাছেও টেনে নিতে পারছে না, দূরেও ঠেলতে পারছে না। আচমকাই শরীফ তার হাত বেঁধে ধরলো, ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে নিলো টুম্পার গলার নীচে, কাঁধ পেরিয়ে পেটের দিকে। টুম্পা বোঝার মতো আভাস পেলো, কিন্তু তার বিরক্তির চেয়ে শরীফের অনুভূতি আর ভালোবাসা বেশি প্রবল ছিল।
শরীফের হাত পেটে আসতেই টুম্পার শরীর একটু কাঁপলো, টুম্পাও হাত ছেড়ে দিলো না, চোখ বন্ধ করে শরীর ছেড়ে দিলো সেই নরম স্পর্শের কাছে।
আবেগ আর উত্তেজনার মাঝখানে শরীর দুটো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। শরীরের এই ঘনিষ্ঠতা ছিলো নতুন, প্রথম, যা কেবল ভালোবাসার ভাষায় বলা যায়। দুজনেই একান্ত ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে দিচ্ছিল। এমন মুহূর্তে, কথারা হারিয়ে যায়।, শুধু ভালোবাসার নীরব স্পর্শ আর অনুভূতিরই ভাষা চলে।
“বউমা? ও বড় বউমা! দেইখ্যা যাও কে আইছে।”
আজান দিয়েছে একটু আগেই। ফজরের নামাজ পড়ে পারুল শুয়েছিলো কেবল। চোখ দু’টি লেগে এসেছিলো তখুনি জমেলা বেগমের আওয়াজ শুনে উঠে পড়ে! এর আগো কখনো তিনি এভাবে, এত সকালে ডাকেনি। কি হয়েছে দেখতেই পারুল আগ্রহ নিয়ে বাইরে যায়। পারুলকে দেখে জমেলা বেগম তখন এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আরে বউ! ঘোমটাটা বড় কইরা দেও তো।”
পারুল কিছু না বুঝে আহাম্মকের মতন বড় করে ঘোমটা টেনে দিলো। একটু আগাতেই দেখে সাদা চুল দাঁড়ি ওয়ালা, কালো পাঞ্জাবী পড়নে। আর কাঁধে একটা পুটলি নিয়ে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আবার তসবিহ ও আছে। পারুল কিছু না বলে চুপচাপ রইলো।
“মেহমানের লাইগ্যা৷ নাস্তার আয়োজন করো।”
পারুল কিছু জিগেস করার সুযোগ পেলো না। তার আগেই জমেলা গিয়ে ভদ্র লোকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনাসামনিও জিগ্যেস করা যায় না দখেই পারুল চুপচাপ চা বসাতে চলে গেলো। পারুল বুঝে উঠতে পারছে না জমেলা বেগম চাইছে কি! সকাল সকাল এই লোক কোথা থেকে হাজির হলো! কালকে ছেলের অপমান হজম করতে পারেনি?
#চলবে?
#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব–৩০
সকাল তখন খানিকটা চওড়া হয়েছে। রান্নাঘর থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে, চুলায় হাঁড়ি চাপানো। ঘরের ভেতরে চায়ের কাপ সাজাচ্ছে পারুল। তার চোখেমুখে একরাশ বিস্ময়, জিজ্ঞাসা সকালবেলায় এমন অচেনা ভদ্রলোক এলেন কেন? আর আম্মা এমন আচরণ করছে কেন? জমেলা বেগম এদিক ওদিক তাকিয়ে এসে বললো নিচু গলায়,
“এই যে, পারুল! চায়ের লগে খইভাজা দিয়া আনো। কবিরাজ কবিরাজ নাস্তাপানি না কইরা দোয়াগুজা দেয় না।”
পারুল ধপ করে থেমে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ধীরে বললো,
“কোন কবিরাজ? কি দোয়া?”
“কবিরাজতো কবিরাজই, কোন কবিরাজ মানে কি?”
“হেয় আওনের কারণ কি?”
জমেলা হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলো,
“তুমি সবকিছুতেই কিয়ের এত প্রশ্ন করো? কবিরাজ আছেন, বড় কবিরাজ মুরুব্বি লোক। তোমার ভালোর লাইগ্যাই আনছি! যত সব বাতাস লাগাইয়া রাখছো শরীরে! ক্যান বাচ্চা হয় না এতদিনেও!”
পারুল থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে। এমন সময় কামাল হোসেন এসে উঠোনে ঢোকে। গলায় টুপি, চোখে ঘুম ঘুম ভাব। চোখ মুছতে মুছতে বলে,
—“ওই কবিরাজরে তো আমি ছোটবেলা থেইক্যা চিনি। বড় মানুষ। পানির দোয়ায় কত কাম হয় উনার!”
জমেলা গদগদ হয়ে বলে,
—“তাই তো কইলাম, এমন কবিরাজ ঘরে আইছে, এত ভাগ্য ঘরে আনছি, আর তোমার বউমা হেইডা বুঝতাছ না।”
এইসময় কথার আওয়াজ শুনে বেরিয়ে আসে সজীব। জামার বোতাম বন্ধ, চোখে ঘুমের ছাপ। দরজায় দাঁড়িয়েই বলে,
“কি হইতাছে? কেডা এতো সকালে আইছে?”
কথা শেষ হওয়ার আগেই জমেলা এগিয়ে গিয়ে সজীবের হাত ধরে বলে,
“এই যে বাপ, কবিরাজ হুজুর আইছেন। তোদের ঘরের জন্য দোয়া পড়বেন। তোর বউরে একটু দেখা লাগবো। ওর দেহে বাতাস আছে। বাচ্চা না হইবার হেতু এইডাই!”
সজীব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার চোখ গড়িয়ে গেল পারুলের দিকে। পারুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝে ফেলে, মা যা করার করেছে। এখন সে যদি কিছু বলে, মা আবার একরাশ কান্নাকাটি করবে! সজীব গলা খাঁকারি দিয়ে ধীরে বলে,
—“এইডা কি ঠিক কাজ আম্মা? এখন কবিরাজ? আমি তো আর…”
“কবিরাজের পানি পড়া, তাবিজ, দোয়া—হেইডা কাজে দেয় না? তোর আব্বারে জিগা?”
কামাল হোসেনও মাথা নাড়ে,
“বাবা সজীব, আমরা আল্লাহর কালাম পড়ি, নামাজ রোজা করি। আমরা কবিরাজেও বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বাস কবিরাজ হেয় পারুলরে দেখলে ঠিক হইয়া যাইব! হের বহুত নাম ডাক। আমরাও নাতির মুখ দেখতে পারমু।”
সজীব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সবাই তাকায় সজীবের দিকে। চারপাশে নিরবতা। কিছুক্ষণ পর সজীব ধীরে মাথা নাড়ে।
—“ঠিক আছে, যা ভালা মনে করেন করেন। আমিও চাই সব ভালা হউক।”
জমেলা বেগম হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, মুখে হাসি ফোটে।
—“ তুই বোঝদার পোলা, বাপ। বউরে ভিতরে লইয়া যা, হুজুর দোয়া পড়বেন।”
সজীব ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। পারুল পেছনে পেছনে হাঁটে, নিঃশব্দে। তার বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছে। কেমন যেন এক অজানা ভয় গিলে নিচ্ছে তাকে। দরজার আড়াল দিয়ে সে একবার তাকায় সেই মানুষটার দিকে, যিনি নাকি তাকে “সুস্থ” করবেন।
রাত জাগার ক্লান্তি এখনো পুরোপুরি কেটেছে বলে মনে হয় না টুম্পার। চোখের পাতাগুলো ভারী, নিঃশ্বাসও যেন আলসে। নিঃস্তব্ধ ঘরের শান্ত বাতাসে সে এখনো গভীর ঘুমে ডুবে আছে। মাথা রাখা শরীফের প্রশস্ত বুকে, শরীফও তাকে তার দু’হাতের ঘেরাটোপে এমন করে জড়িয়ে রেখেছে, যেন কোনো মূল্যবান জিনিস বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে সে—যার একচুল নড়াচড়া মানেই হারিয় যাওয়া! সেই কোমল বাঁধনে জড়িয়ে শরীফও ঘুমাচ্ছে এক অনাবিল শান্তির ঘুম। হঠাৎই বাহিরের দিক থেকে ভেসে এলো কিছু শব্দ। অস্পষ্ট, তবে কানে লাগার মতো। ঘুমে বিভোর টুম্পার দৃষ্টিতে তবুও ভাঙন এল না, সে যেন ঠিক করে নেয়—উঠবে না এখনই। শরীফের ঘুম যেন না ভাঙে, সেই ভয়েই সে আরও গুটিয়ে নেয় নিজেকে, নিঃশব্দে শুয়ে থাকে আগের মতন। শরীফের মুখের দিকে তাকায়। কত শান্ত, কত নির্ভার সেই মুখ! মনে পড়ে যায় ঠিক রাতের কথা—আলোর নিচে লুকানো একরাশ আবেগ, নরম তুলোর মতো ভালোবাসা সেসব স্মৃতি মনে পড়তেই চোখেমুখে ধরা দেয়। লজ্জার গোলাপি আভা। টুম্পা মিটিমিটি হাসে। ঠিক সেই মুহূর্তেই, আবারও কানে আসে কিছু কথা। এবার আর আগের মতো মৃদু নয়, খানিকটা জোরেই। কণ্ঠটা পরিচিত মনে হচ্ছ।
“টুম্পা? ঘুম থেইক্যা উঠ তাড়াতাড়ি!”
টুম্পার এবার রাগ হলো। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও উঠলো।
এদিকে পারুলের পড়নে নতুন কাপড়। একটু আগে জমেলা বেগমের কথানুযায়ী সে গোসল করে নতুন কাপড় পড়ে এসেছে। কবিরাজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করেই কবিরাজ বললেন,
“তোমার বউরে আমি একটু পর্যবেক্ষণ করতে চাই।”
জমেলা বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“নিশ্চয়ই! এইডা আবার কওন লাগে নি? আমনে দেহেন।”
দেখার নাম করে সেই কবিরাজ প্রথমে পারুলের মুখ উঁচু করলে ধরলো। তারপর পারুলের চোখ দেখলো। কিছু দোয়াদরুদ পড়লো। শেষমেশ পুঁটলি থেকে কিছু একটা নিয়ে ফু মেরে পারুলের চোখের মধ্যে দিতেই পারুল চিৎকার করে উঠলো! সজীব পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা অবলোকন করছিলো। পারুলের চিৎকারের আওয়াজ শুনে পারুলকে ছুঁতে যাবে এমতাবস্থায় কবিরাজ সজীবকে শাসিয়ে বলে,
“খবরদার ওরে ছুঁইবা না!”
সজীব গলার কন্ঠ কঠিন করে বলে,
“আমার বউরে আমি ধরমু না?”
“ধরবা ঠিকই তবে একটু পর! আমি একটা দোয়া পইড়া ওর চোখে ফু দিছি। এহন যদি ওর চোখ লাল না হয়, তাইলে বুঝবা তোমার বউর কুনো দোষ নাই। আর যদি পারুলের চোখ লাল হইয়া যায়, তয়লে বাপ, বুঝবা দোষ আছে!”
পারুল তখন যন্ত্রণায় চোখে হাত দিয়ে ডলছে। কবিরাজের কথা শুনে জমেলা আদেশের সুরে বলে,
“বউমা, চোখ খুলো!”
পারুল চোখ খুললো। খুলেই বললো,
“আম্মা, চোখে খুব জ্বলতাছে, পানি দেওন যাইব?”
“পরে!”
কবিরাজ তখন এগিয়ে গেলো পারুলের দিকে। ভালো করে পারুলের দিকে তাকালো। তারপর কিছু দোয়া পড়ে উচ্চস্বরে বলে উঠে,
“তোর বউর উপরে আছড় আছে! বদ জ্বীন মেলামেশা করছে তার লগে! এই কারণে তোমগো বউর বাচ্চা হইব না কুনোদিনও। সে বন্ধ্যা হইয়া থাকব!”
কথাটা শুনা মাত্রই পারুল চোখ বড়বড় করে তাকালো। পাথরের ন্যায় জমে গেছে সে। মুখ দিয়ে যেন কোনো শব্দ বের হচ্ছে না! সজীব রেগেমেগে কবিরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“মিছা কথা ছাড়েন! আমনেরে কে কইছে আমার বউ বন্ধ্যা? এইডি গুজব!”
“তোর বউ শুদ্ধ হইলে চোখ লাল হইতো না। আমার দোয়ায় কাম হইতো। কাম হয়নাই। আমি যা কইছি তাইই ঠিক, তোর বউর কুনোসময় বাচ্চা হইব না।”
কবিরাজের কথা শেষ হতেই জমেলা বিলাপের সুরে বলেন,
“হায় আল্লাহ কি কন! কুনো উপায় কি নাই কবিরাজ সাব?”
কবিরাজ তখন ভাব নিয়ে ফের বলে,
“বন্ধ্যা তো বন্ধ্যাই! তাগো কুনো বাচ্চা হয়? হয় না! তেমনি তোমার পোলার বউরও বাচ্চা হইব না, কুনোদিনো!”
জমেলা বেগম এবার কেঁদে দিলেন। বিলাপ করতে করতে বলে,
“ও আল্লাহ গো, আমার কি সর্বনাশ হইলো গো! আমার পোলায় জীবনেও বাপ হইতে পারবো না গো! এই জীবন রাইখা কি লাভ বাপ?”
“আহ্, আম্মা! কানবেন না তো! আমনে এই কবিরাজের কথা বিশ্বাস করছেন?”
“তোমরা জুয়ান পোলাপাইন। তোমরা যে বিশ্বাস করবা না এইডাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যা কইছি তাইই দেইখো। তোমার বউর কুনোদিনও বাচ্চা হইতো না!”
এতক্ষণ সব শুনলেও সজীব এবার আর দেরি করলো না! উঠোনের কোনে পড়ে থাকা ঝাড়ু হাতে নিলো। কবিরাজের মুখের সামনে ঝাড়ু তুলে বললো,
“তুই শালা ভন্ড কবিরাজ! যাবি এহান থেইক্যা? না ঝাড়ুর বাড়ি খাইবি?”
কবিরাজ তখন পুটলা গুছিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলে যায়,
“আল্লাহ্র গজব পড়ব দেখিস! তোর বউর কুনোদিনও বাচ্চা হইতো না, তুই বাপ ডাক হুনতে পারতি না!”
সজীব আমলে নিলো না, সে কথা। পারুলের কাছে এগিয়ে যাবে তখনই দেখে পারুল জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে! এতক্ষণ সেটা খেয়ালই করেনি সজীব। পারুলের শরীর ধরে কয়েকবার ডাক দিলেও পারুল ফিরতি কোনো সাড়া দেয় না। তা দেখে জমেলা বেগম বলে উঠে,
“মাইয়া মানুষ যদি মা’ই হইতে না পারে, তাগো আর কুনো দাম থাহে বাপ? পারুল এইডা মানতে পারেনাই। আঘাত পাইয়া জ্ঞান হারাইছে!”
“আম্মা, আমনে এইডি কইয়েন না! আমি এইডিতে বিশ্বাসী না।”
“কিন্তু কবিরাজে কইছে তোর বউর বাচ্চা হইব না। আর এইডা অনেক নামীদামী কবিরাজ!”
“আব্বা! আমনে না নামাজী মানুষ? আমনে কেমনে এসবে বিশ্বাস করছেন?”
কামাল হোসেন এতক্ষণ নিরব দর্শকের ন্যায় সবটা দেখছিলো। শেষমেশ সে-ও বলে ফেলে,
“এই কবিরাজের অনেক নাম ডাক বাজান। তুই কষ্ট পাইস না।”
জমেলা বেগম স্বামীর মুখ থেকে কথা কেঁড়ে নিয়ে বললোন,
“দোষ ওর বউর, আর কষ্ট আমার পোলায় ক্যান পাইব? আমি আমার পোলারে আবার বিয়া করামু! তকইলে সজীব বাপ হইতে পারব!”
সহ্যের সীমা এবার ছাড়িয়ে গেলো সজীবের। শান্ত সজীব এবার আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠলো। চোখ দুটো বড়বড় করে গলার কন্ঠ উঁচু করে মা’য়ের উদ্দেশ্য বললো,
“আমি বিয়া করতাম না আম্মা!“
জমেলা বেগমও থামলেন না। তিনি পুনরায় বললেন,
“তোর বউরতো বাচ্চা ও হইব না! তাইলে তোর ভবিষ্যৎ কি?”
“কে কইছে আমার বউর বাচ্চা হইব না? ওই কবিরাজে! শালা ভন্ড! কোনো প্রমান দিছে? প্রমান আমি দিমু! ডাক্তারের কাছে লইয়া যামু আমার বউরে। হেরপর ডাক্তারি কাগজ আইনা দিমু তোমগোরে। তারপর দেখবা!”
জমেলা বেগম হতভম্ব হয়ে যায় তার শান্ত শিষ্ট ছেলের এরকম ভর্য়াত রূপ দেখে! আরো এক দফা অবাক হয় ডাক্তারের কথা শুনে!
“তুই ডাক্তার দেহাবি?”
“হ আম্মা, আমনের আল্লাহর দোহাই লাগে এহন থামেন। ডাক্তারি রির্পোট দেখবেন, প্রমান সহ। তাও এসবে কান দিয়া আমি আমার বউরে ছাড়মু না! দরকার হইলে সবটা প্রমান করাইয়াই ছাড়মু!”
আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে সজীব নিরবে পারুলকে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। পারুল তখন জ্ঞানহিীন। সে জানলোও না তার সরল সোজা, শান্ত স্বামী কেমন অশান্ত হয়ে উঠলো তার জন্য। জমেলা বেগম চোখ বড়বড় করে কামাল হোসেনকে বলে,
“এত বউ ভক্তি, কেমনে আইলো সজীবের বাপ!”
কামাল হোসেন তখন নিশ্চুপ। ছেলে আর কবিরাজের কথা শুনে কি বলবে যেনো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
#চলবে?