অর্ধাঙ্গ পর্ব-৩১+৩২

0
20

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব–৩১

ঘরের বাতাস থমথমে। জানালার কাচ গলে ঢুকে পড়া সকালের আলো ঝিম ধরা প্রহরের মতন নিস্তরঙ্গ হয়ে মেঝেতে ছড়ায়ে আছে। কাঁথার উপর শুয়ে আছে পারুল। তার মুখে বেদনার ছায়া, চোখে ক্লান্তির রেখা। কপালে ভাঁজ। চোখের পাতা হঠাৎ কাঁপে, তারপর ধীরে ধীরে খুলে যায়। ঘরের ভিতর তার দৃষ্টির প্রথম আলো পড়ে সজীবের মুখে। কুঁকড়ে যাওয়া মুখে শান্ত চোখ।

“পারুল, তুই ঠিক আছিস?”

সজীবের গলা কেঁপে ওঠে।

পারুল এক ঝলক তাকায় তার দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নেয়।

“আমি আমি বন্ধ্যা!”

গলার স্বর কেঁপে ওঠে তার। সে যেন নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চায়। মনে বাসা বাঁধে এক অদ্ভুত ভয়ের! সজীব হাত বাড়ায়। পারুলের কাঁধে হাত বাড়ায়। যার অর্থ সে তো আছে। মৃদুস্বরে বলে,

“তুই আমার বউ। তোরর লইয়া কুনো ভন্ডে কথা কয়, আমি তারে সহ্য করুম না। আমি তোরে কখনো ছাড়ুম না। তুই একদম ভয় পাইস না পারুল।”

পারুল একটানা তাকিয়ে থাকে সজীবের চোখে। সেই চাহনি নিষ্পলক। যেনো তাকে আশ্রয় দিচ্ছে, তবুও ভর্য়াত কন্ঠে শুধোয়,

“কবিরাজ যা কইছে…”

“ভন্ড হেতে! কিছু বুঝিস না, তাই তো ভয় পাইছোস। ভন্ডে কইলে তো সব সত্য হয় না। তোরে আমি হাসপাতালে লইয়া যামু। ডাক্তারি পরীক্ষা করামু। জেনেই ছাড়ুম আসলে তোর ভিতরে কুনো সমস্যা আছে কিনা। আমি প্রমাণ করমু। মুখের কথায় কিচ্ছু হইব না!”

পারুল চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসে। ভাবেনি সজীব তার পাশে থাকবে। তার মুখটা এবার সাহসে ভরা, চোখে যেন সজীবের সাহস ঢেউ তুলে দিয়েছে। তবুও ভাঙা মনে প্রশ্ন যেনো যাচ্ছেই না!

“আম্মা, আব্বা সবাই তো আমনেরে বিয়া করাইতে চায়।”
“ধুরো! আমি কবুল না কইলে কি, আমার আব্বায় কবুল কইব? আমি তাগো মুখের উপর যহন ডাক্তার রির্পোট খান দিমু, দেখবি কেউ চোখ তুইল্যাও কথা কইব না, বিয়া তো বহুত দূর!”

পারুল মুঁচকি হেঁসে ফেলে সজীবের দিকে চেয়ে। সজীবের কথাগুলো শুনে যেনো মনে হচ্ছে এই জীবনে তার সবকিছু পাওয়া হয়ে গেলো। আর কিছু না হলেও চলে যাবে। মাথা দুলিয়ে বলে,

“হ, এডাই ঠিক হইব।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎই সজীব থমথমে গলায় বলে,

“কিন্তু শহরে গেলে খরচ আছে পারুল। গাড়ি ভাড়া, ডাক্তার ফি, পরীক্ষা—কত কিছু লাগবো। তুই তো জানোস, আমার এখন কুনো টাকাই নাই। আমি কেমনে পারমু!”

সজীব মাথা নিচু করে ফেলে। কথাগুলো বলতে গিয়ে গলাটা ভারী হয়ে আসে। পারুল আশ্বস্ত স্বরে বলে,

“আমি দিমু।”

সজীব তাকায় পারুলের দিকে। চমকে ওঠে।

“তুই দিবি? কী দিবি তুই?”

পারুল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। আলমারির ভেতর থেকে খুলে আনে ছোট্ট এক রুপালি ডিব্বা। খুলে ধরে সামনে। ডব্বার ভিতরে এক জোড়া কানের সোনার দুল, আর এক পাতলা সোনার চেইন। তার বিবাহের দিন যা পরেছিলো। তারপর আর কখনো নয়।

“বিয়ার সময় দিছিলো। আর কিছু নাই।”

সজীব তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দৃষ্টিতে তীব্র লজ্জা, কৃতজ্ঞতা, একধরনের আত্মগ্লানির ছাপ। তবুও বলে,

“এইডা তোর শেষ স্মৃতি পারুল। তুই এইডা দিবি?”

পারুল মাথা নাড়ে। চোখে জল টলমল।

“এইডা দিলেই যদি প্রমাণ হয় আমি শুদ্ধ, আমি বন্ধ্যা না, তাইলে আমি দিমু। একটা দুল দিয়া যদি প্রমান হয়, আমি সব গয়না ছাড়তে পারুম।”

সজীব এগিয়ে আসে। তার কাঁধে হাত রাখে, চুপ করে থাকে। তারপর একটানা বলে ফেলে—

“তোরে নিয়া আমি শহরে যামু। ডাক্তার দেখামু। লইয়া যামু কাইলই। তারপর সবার সামনে প্রমান কইরা দিমু। তোরে আমি ছাড়মু না বউ!”

সজীবের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পরে পারুল। চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রু জমে ওঠে। সুখের অশ্রু যাকে বলে।

~~~~~~~~~
রোদ দুপুরের মেজাজে পৌঁছায়নি তখনো। উঠোনে বিক্ষিপ্তভাবে পড়েছে ছায়া-রোদের খেলা। ঘরের কোণায় একটা কাক জড়িয়ে ডেকে উড়ে গেছে। সেই নিঃস্তব্ধতা ছিঁড়ে শরীফ ঢুকলো ঘরের ভেতরে। টুম্পা তখন সদ্য গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, ভেজা চুল খামচে মুছছে। কাঁধে তোয়ালে, চোখে এখনও জলের ঝিলিক। শরীফ দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সেটা দেখে টুম্পা কিছুটা লজ্জা পায়। শরীফ গলা নামিয়ে বললো—

—”ভাবী তো খুব দুর্বল। মাথা ঘুরায় পইড়া গেছে। রান্নাডা তুমি কইরা লও তো টুম্পা।”

টুম্পা অবাক চোখে ফিরে তাকায়। ঠোঁট কাঁপে কিছু বলবে বলে, তবে তার আগেই শরীফ ঘুরে বেরিয়ে যায় দরজার ফাঁক গলে। চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে টুম্পা দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ। শরীরটা ভিজে ঠান্ডা লাগছিলো গোসল করাতে! শান্তিতে ছিলো, এখন শরীফের কথা অমান্য করলে, অচিরেই কষে একটা ধমক জুটবে। তাই শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নেমে আসে নিচে। ঘরের চৌকাঠে দাঁড়াতেই দেখে জমেলা বেগম মুরগীকে আদার দিচ্ছেন। টুম্পা সুযোগ বুঝে বলে ফেলে,

“আম্মা, রান্নাডা আমনে কইরা লন তো। ভাবী এহন শুইয়া আছে। কইরা উঠতে পারবো না হুনছি।”

জমেলা বেগম তখন উঠোনের ধারে বসেছিলেন, গাছের ছায়ায়। কথাটা শুনে যেন তার রক্তে আগুন ধরে যায়। হাতে রাখা মুরগীর খাবার রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে আসে টুম্পার দিকে। গলার স্বর কাঁপতে থাকে ক্ষোভে,

—”কী কস? রান্নাডা আমি কইরা লমু? এইডা আবার কোন নিয়ম, ভাবী অসুস্থ মানেই আমি লইয়া রান্না করমু? আমি কি কাজের বেটি, রে?”

টুম্পাগলা নরম রাখে, কিন্তু চোখে ভয়াল দৃঢ়তা টানে—

“আমি রান্না পারি না, হেইডা আমনেও জানেন!”
“তার লাইগা কি আমি রানমু? পারোস না তো শিখে নে!”

টুম্পাও দমে যাবার পাত্রী না।

“আমনে যদি রান্না না করেন, আমি সবার সামনেই কইয়া দিমু, যে কবিরাজরে আনছেন হেইডা ভুয়া! আর এই নাটকটা আপনের বানানো, ভাবীরে ছোট করার লাইগা।”

জমেলা বেগমের মুখ লাল হয়ে ওঠে। চোখমুখ বিকৃত হয় অপমানে। শিরদাঁড়াটা সোজা করে দাঁড়ান তিনি। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় গর্জে ওঠেন—

“তুই এইরকম কথা কস আমারে! বাড়ির ছোট বউ হইয়া আমার নামে এত বড় কথা! ওই অমঙ্গল মুখ বন্ধ কর! আমি কইলাম, কবিরাজ আছিলো সত্যিকারের। তোর ভাবীর গায়ে জিন আছিলো! তুই ভুলভাল কস ক্যান?”

টুম্পা এক চুলও সরে না। গলার স্বর কঠিন করে বলে,

“সত্যি হইলে ডাক্তারে নিতেন , কবিরাজে নিছেন ক্যান? আর যদি আমার কথা কেউ না বিশ্বাস না করে আমি প্রমান দিমু।”

এই হুমকিতে জমেলা বেগম যেন কাঁপে, থতমত খেয়ে যায়। কিছুক্ষণ মুখ খুলে থাকে, কথা খোঁজে। শেষে জিহ্বায় রাগ-ক্ষোভ গিলে বলেই ফেলেন—

“কিয়ের প্রমান দিবি তুই?”
“ক্যান মনে নাই? আমনে কন নাই সজীব ভাইয়ের লগে আমার বিয়া না হইলেও, বন্ধ্যার দোষ দিয়ে ভাবীরে খেদাইবেন? আর আইজকা কবিরাজ আইছে,,মানে দুইয়ে দুইয়ে চাইর স্পষ্ট! এহন যদি আমি এইসব কথা সবার সামনে কইয়া দেই। সবাই বিশ্বাস করব আমারে। তহন আমনের অবস্থা কি হইব ভাবছেন? এই বুড়া বয়সে করবেন কিই?”

কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে জমেলা বলে,

“ঠিক আছে, করতাছি রান্না! কিন্তু এইডার মানে এই না যে, তোরে আমি ডরাইছি। তুই রান্না পারছ না দেইখা করতাছি।”

তারচোখে বিদ্বেষের বিষ। খাবার হাঁটার ভঙ্গিতে নেমে গেলেন রান্নাঘরে। পেছনে রইলো টুম্পা, মুখে মিটিমিটি হাসি। চোখে তখন একধরনের কঠিন স্বস্তি প্রথমবারের মতো সে অনুভব করলো নিজের সাহসে জমেলা বেগমের মতন জাঁদরেল মহিলাকেও নুইয়ে ফেলেছেন! এবং এই কঠিন ভূমিকা পালনের পরেও ভিতরে একফোঁটা দোলা জাগছে না তার। এদিকে পাতা দিয়ে আগুন ধরানোর সময় আচমকাই ধোঁয়া উঠে এসে জমেলা বেগমের চোখে ঢুকে গেলো। যেন ধোঁয়ার পিকনিক লেগেছে চোখে! জ্বালায় চোখ দু’টো শক্ত করে বন্ধ করে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর চোখ মুছতে মুছতে পাতার বস্তার দিকে তাকিয়ে বলে

“আরে বাপরে! পাতা তো শেষ। একেবারে ফুরায়া হাওয়া। এখন আবার উঠানে রাখা পুরনো বস্তা টাইন্যা আনা লাগব!”

সবে তো ভাত বসাইছে, তরকারির কাঁটা-বাছা তো এখনও শুরুই করেনি। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো তার। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো, যেন জীবনের প্রতি ক্ষোভ আর কষ্ট মিশে আছে তাতে। মনে মনে টুম্পার নামে গালি দিতে দিতে তার মুখের চেহারাটাই বদলাইয়া গেল।

— “হা°রামজাদী! আমার বিলাই আমারেই কয় ম্যাও! খা°ল কাইট্যা কুমির আনছি আমি!
নিজে কাম করবো না, উলটা আমারে শিখায়! ”

একটা থালা হাতে নিয়ে ছ্যাঁৎ করে মাটিতে ফেলে দিল। আশেপাশে কেউ ছিল না, না থাকলেও তার রাগ যেন কাঁপিয়ে দিতো। একটু থেমে নিজের গা থেকে আঁচলটা ঠিক করে আগুনের দিকে ফিরে গেল জমেলা। চোখে এখনও একটু জ্বালা, মনে আরও বেশি জ্বলছে টুম্পার কাজে!

#চলবে…

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব–৩২

সকালবেলা যেন ঘরে আগুন নেমেছে। উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে চড়া কণ্ঠস্বরে তর্ক—গৃহস্থালির টুকটাক কাজ নিয়েই শুরু, কিন্তু সে তর্ক গড়িয়ে গিয়ে ঝগড়ায় ঠেকে গেছে যেন।
জমেলা বেগমের গলা প্রচণ্ড রকমের খোলামেলা।

—“নতুন বউ হইছস দেইখা কি ঘরের কাম করবি না? তোর মতন বউ মনে হয় না, গেরামে কেউ আছে।”

টুম্পা থতমত খেয়ে গেলেও চুপ থাকে না। গলার স্বর স্বভাবতই উচ্চগ,

“আমি কি খালি খালি ঘুরতাছি? আমনেরে সাহায্য কইরা দেই না আমি?”

—“তা হইলে এখন আবার ঘরের কাম থেইক্যা পলায়া গেছিস ক্যা?”

—“একটু দম নিতে দিবেন না আম্মা, আমনে কি পাষান?”

“হাছা কথা কইলেই আমি ভালা না, টুম্পা?”

তর্ক তুঙ্গে। উঠোনের বাতাস ভার হয়ে ওঠে। তর্কের মূল কারন হচ্ছে জমেলা রোজ রোজ রান্না করতে পারবে না। আর টুম্পাও পুরো রান্না একা হাতে করবে না কিছুতেই! আজকে টুম্পা তরকারি কেটে দিচ্ছিলো জমেলা ভাত দিয়েছিলো চুলায়। তরকারি হিসেবে লতি ছিলো, সেই লতি কুটতে গিয়ে টুম্পার অবস্থা নাজেহাল হয়ে যায়। সেজন্যই সে লতি কুটা বন্ধ করে দেয়। আর তাতেই তেলেবেগুনে ক্ষেপে উঠে জমেলা বেগম। তার ভাষ্যমতে টুম্পা রান্নাও করবে না, কাজও করবে। সব তাকে দিয়েই কেনো করাবে? সে কি ফ্রীতে কাজের লোক? আর টুম্পার বক্তব্য সে এসব পারে না। তাদের বাড়িতেই মা লোক দিয়ে কাজ করিয়েছে। সে এসব পারবে কি করে? সেও তো কাজের লোক নয়! এই নিয়েই দুই শ্বাশুড়ি বউমার তর্কবির্তক শুরু! ঠিক তখনই দড়জা ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সজীব। তার পরনে সাদা শার্ট, মুখে একরাশ গম্ভীরতা। পাশে আসে পারুল, বোরখা পরে, গা ঢাকা কালো কাপড়ে মুখের অর্ধেক ঢেকে রেখেছে সে। জমেলা বেগম এ দৃশ্য দেখে চোখ কুঁচকে তাকায়। বলেই ফেলেন—

—“এই যে, এত সকালে রেডি হইছো ক্যা? কই যাও?”

সজীব শান্ত স্বরে উত্তর দেয়,

—“ডাক্তারের কাছে যাইতেছি। পারুলরে লইয়া শহরে।”

জমেলা বেগম যেন এক মুহূর্ত থমকে যান। তারপর খেঁকিয়ে ওঠেন—

—“ডাক্তারের কাছে! হেইডা আবার ক্যা? তাবিজ-কবচ দিয়া তো কিছু হইলো না, এখন আবার শহরের ডাক্তার? কই থেইক্যা এত খরচ আইব রে বাপ?”
“খরচ না হইলে হউক, তাও যামু।”

ছেলের একরোখা জবাবে রেগে গেলেন জমেলা বেগম। রাগত স্বরে বলে,

“ঘর বাড়ি বেইচ্যা দিবি নাকি, তোর বউর লাইগ্যা?”
“না, আম্মা।”
“তাইলে খরচ কে করব? কইত্তে আনবি টাকা?”

পারুল এবার এগিয়ে আসে। তার কণ্ঠ স্বাভাবিক,

—“আম্মা, দোষ যখন আমারে দিছেন, তখন অপবাদ ঘুচাইতে খরচও আমি দিমু।”

জমেলা বেগম এবার অবাক হয়ে বলে,

“তুমি খরচের টেকা কইত্তে দিবা হুনি? বড়বড় ডায়লগ কেনো ছাড়তাছো?”

“আমার গয়না বন্ধক দিছি। আমনেগো থেইক্যা কুনো টাহার দরকার হইবো না।”

জমেলা হতভম্ব হয়ে যায়। তার চোখ কিঞ্চিত বড় হয়ে ওঠে। মুখ থেকে স্বাভাবিক আওয়াজ বেরোয় না কিছুক্ষণ। যেনো পারুল সপাটে তার গালে চড় দিয়েছে, মুখের উপর উত্তর দিয়ে।

—“তুমি তোমার গয়না দিবা? ওইডা তো তোমারে দিছিলো। ওইটুকুই তো লইয়া আনছো।”

শেষ লাইনে জমেলা বেগমের তিরস্কার স্পষ্ট।

—“হ্যাঁ আম্মা, সেই গয়নাই দিমু। কারণ আমি জানি, প্রমান না করলে আমনের মুখ বন্ধ হইতো না।”

জমেলার চোখে এবার ধিকি ধিকি আগুন। মুখে দুঃখবিলাপ। পারুল এভাবে তার মুখের উপর কথা বলছে! কি আশ্চর্য ব্যাপার স্যাপার!

—“ও আল্লাহ! এইদিনও দেখতে হইলো! বউয়ের মুখে এ রকম কথা! শহরের ডাক্তার মানেই হাজার হাজার টাকার খরচ! আমাগো তো খালি ভাঙা চাল, চোরা হাড়ি!”

সজীব এবার বলে,

—“আম্মা, আমি তো বিয়া করমু না কইছি। পারুলরে আমি ছাড়তাম না কোনোদিনই। এখন কেবল আপনাদের শান্তি লাইগা প্রমাণ করতে যাইতাছি।”

দেখা যায়, কথার ফাঁকে শরীফ দাঁড়িয়ে পড়েছে উঠোনের এক পাশে। তার চোখে জেগে ওঠে এক ধরনের সমর্থন।

—“ভাইজান আমিও তোমার লগে আছি। ডাক্তাররে বিশ্বাস করি আমি। কবিরাজ ভণ্ড, হেইডা আইজ প্রমাণ কর! যা লাগবো সব করো৷ আমি দেবার চেষ্টাও করমু। আমার কিছু সঞ্চয় আছে।”

সজীব শরীফের দিকে তাকিয়ে একবার মাথা ঝাঁকায়—ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতার ভাষা প্রকাশ হয় না। পারুল বোরখার আড়াল থেকে শেষবারের মতো একবার তাকায় ঘরের দিকে। এই ঘরই তার সবকিছু। এত বছরের স্মৃতি। তারপর সজীবের পিছু পিছু হাঁটা শুরু করে। দুইজন মানুষের ছায়া মাটির উপর লম্বা হতে হতে মিলিয়ে যেতে থাকে। তাদের চলায় যেন একধরনের মৌন ঘোষণা। বাড়ির উঠোনে কেবল জমেলা বেগমের দীর্ঘশ্বাস।

বাড়ির উঠোনটা যেন হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। গেটের দিকে তাকালে এখন আর দেখা যায় না সেই সদ্য বেরিয়ে যাওয়া দুটো ছায়া—সজীব আর পারুলের। জমেলা বেগম বসে পড়েছেন কলাগাছের গুঁড়িতে। মুখে দুই হাত ঠেকিয়ে বিলাপ করছেন ধীরে ধীরে। প্রথমে চোখে জল ছিল না, এখন যেন ইচ্ছা করেই কান্না টেনে আনছেন। তার মনটা ধু ধু করছে, বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে, কিন্তু মুখে রাগের জ্বালাও কম নয়।

—“হায় রে আমার কপাল! বড় বউ আমার ছেলেরে নিজের দিকেই টানি নিলো। আমিই এ সংসারে অপদার্থ!”

এই বিলাপের মাঝখান দিয়েই উঠে দাঁড়ান জমেলা বেগম। তার হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিটাও যেন ক্রোধ আর ক্ষোভে জর্জরিত। তিনি সোজা পা চালিয়ে ঢুকে পড়লেন ছোট ছেলের ঘরের দিকে। শরীফ তখন খালি গায়ে পিঁড়িতে বসে চুল আচড়াচ্ছে। চেহারাটা শান্ত, চোখে একটু ঘুমের রেশ। কিন্তু মায়ের মুখ দেখে সবকিছু ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

—“শরীফ! তোর ভাই বউয়ের পাল্লায় পড়ে আজ ডাক্তার নিয়া শহরে চইলা গেলো!”

শরীফ কপাল কুঁচকে তাকালো,
-”তো কি হইছে?”

জমেলা বেগম এবার দুই হাত মাথায় দিয়ে কান্না শুরু করলেন।

—“পোলাডা কেমন বউ ভক্ত হইয়া গেলো! আমার বুকটা ফাইটা যাইতাছে রে পোলারে হারাইয়া!”

শরীফ উঠে দাঁড়ালো ধীরে। মুখে বিরক্তি।

“মা ভক্ত হইয়া থাকলে খুশি হইতেন?”

জমেলা চোখ গোল করে তাকালেন, এমন কথা হয়তো প্রত্যাশা করেননি। শরীফ তখন হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়, জমেলা বেগম আবার বলে,

“তোর বউও তো তেমন। কুনো কাম কাইজই করে না!”
“ক্যান আম্মা? আমনের না টুম্পারে খুব পছন্দ? এহন আইছেন বড় বউরে না পাইয়া ছুডো বউর নামে নিন্দা করতে?”

জমেলা বেগম আশেপাশে চোখ বড়বড় করে তাকালেন। তারপর বললেন,

“শরীফ বাপ? এইডা কি কইলি তুই? আমি যা কইছি সত্য! টুম্পা একদম ভালা মাইয়া না। কোনো কাম করব তো দূর, মুখে মুখে খালি কথা কয়। আর আমারে তো তুই তুকারিও করছিলো একবার। কথায় কথায় পারতাম না কয় কেবল। আমার বইনের মাইয়া দেইখ্যা তোরে আর কিছু কই নাই। আর অনেক বেয়াদবি করছে। হেই কথা পরে কমুনি। তুই একটু শাষন করিস বাপ।

মায়ের কথা শুনে শরীফ উত্তর করে,

“আইচ্ছা, খাড়ান। টুম্পা ডাইক্যা আনি।”

জমেলা বেগমের মুখে তখন বিজয়ের হালকা হাসি। ভাবছেন, ছোটো ছেলে বুঝি এবার বউরে ধমক দেবে। একটু আগেই তো টুম্পার সাথে রান্নাঘরে ঝামেলা লেগে গেল। শরীফ ঘরে যেতেই টুম্পা তেড়ে আসে। শরীফের বুঝতে বাকি নেই সে জমেলা বেগমের সব কথা শুনেছে। শরীফ তাকে আশ্বস্ত করে বাইরে আনে কিছুক্ষণ পর টুম্পা আসে। মুখ কালো করে, জমেলা বেগমের দিকে তাকায়।
শরীফ এক চেয়ারে বসে ছিলো, এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর বললো—

—“টুম্পা, তুই আমার বউ, তোকে কিছু কইলে আমারই কষ্ট লাগে। কিন্তু তুই আম্মার লগে এভাবে ঝগড়া করিস না, বুঝলি?”

টুম্পা বলে,
—“আমি ঝগড়া করি নাই। আম্মা আমারে….

শরীফ হাত তুললো, শান্তভাবে। থামিয়ে দিলো।

—“চুপ। আমি জানি আমার মা কেমন। আর আমি জানি তুইও কেমন। তোরা দুইজনই আমার আপনজন। কাজ কাম কইরা মিলেমিশা থাকবি।”

তারপর খানিক থেমে বললো—

“আম্মা তোরে দেখাইয়া দিব, তুই সব দেখবি।”

জমেলা বেগম তখন হঠাৎ গর্জে উঠলেন—

—“তোরও কি হুঁশ উড়াইছে নাকি? আমার পোলা দুইটারে মাইয়ারা প্যাঁচায়া ফেলছে গো খোদা!”

শরীফ স্থির কণ্ঠে বলে,

—“প্যাঁচায়া না, শান্তি দিছে আম্মা। কষ্ট দিলে কেউ কারো হয় না। আমনে যান গিয়া রান্ধেন। কয়দিন পর টুম্পা সব করবো।”

জমেলা এবার দাঁড়িয়ে রইলেন হতভম্ব হয়ে। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো যেন। ছেলেগুলো যে একদিন এমন করে মুখের উপর কথা বলবে—তা তিনি কল্পনাও করেননি। রেগে মেগে চলে গেলেন। কামাল হোসেনও নেই। গেছেন দাওয়াতে, না হলে আজ কান্ড তিনি ঘটিয়েই ছাড়তেন! শরীফ হঠাৎ মৃদু হেসে বললো,

—“কি টুম্পারানী? আম্মারে তুই কইরা কইছো?”

টুম্পা বলে,
“আল্লাহ্র কসম! বিশ্বাস করেন আমি এতকিছু কইনাই। হ এইডা সত্য আমি কাম করি নাই। কিন্তু আমি আম্মারে এতকিছু কইনাই। আম্মা মিছা কইছে।”

“আমার আম্মার স্বভাব আমি জানি। ভাবীরে দেইখা অভ্যস্ত বুঝলি? সেই কারনেই তোরে কইছি চুপ থাকতে। এবার বুঝলি তো তোর আদরের খালাম্মা মানে শ্বাশুড়ি আম্মা কেমন চুগলখোর?”

টুম্পা মাথা নাড়িয়ে বলে,

“বেশ বুঝছি!”
“বুঝলে, আম্মার সঙ্গ ছাইড়া দে পুরোপুরি ভাবে। ভালো বউ হইয়া উঠ। ভাবীর মতন।”

এই বলেই শরীফ চলে যায়। টুম্পা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। যতদিন যাচ্ছে ততই তার প্রিয় খালার মুখোশ যেন বেরিয়ে যাচ্ছে আর তার সহ্যসীমা অতিক্রম করছেন তিনি!

~~~~~~~

আকাশে সূর্য মামা তার পুরো রোদ ঢেলে দিয়েছে, পৃথিবীর বুকে। নদীর বুক দিয়ে ছুটে চলেছে ছোট ছোট ঢেউ, যেন কেউ একের পর এক ফিসফিস করে কিছু বলছে আবার মুহূর্তেই চুপ মেরে যাচ্ছে।
নৌকাটা বাঁশের খুঁটি ছেড়ে যখন একটু একটু করে ভাসতে ভাসতে কখন যে ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে টের পাওয়া মুশকিল। সজীব আনমনে তাকিয়ে নদীর স্রোত দেখছে। তার পাশে বসে পারুল। পরনেবোরখা, মাথার ঘোমটা সামান্য নামানো। চোখে-মুখে ক্লান্তি লেগে আছে। পারুলের হাতে একটা হালকা ব্যাগ। নৌকায় উঠেই ব্যাগ খুলে একটুকরো পোটলা বের করলো। তার ভেতর চিড়া, গুড়, মোয়া আর দুটো মাঝারি আকারের পেয়ারা।

“এইডা খাইয়া নেন, দুপুর হইয়া যাইতাছে।¡

সজীব কিছু না বলে চিড়ার কৌটাটা নিয়ে নেয়। এক চিমটি মুখে দিয়ে বলে,

— “তুই কি খাবি না?”

—“আমনে খান আগে।”

সজীব আর কিছু বলে না। চুপ করে খানিকটা খায়। তারপর একটা পেয়ারা তুলে পারুলের হাতে দেয়।

— “এইটা তুই খা।”

পারুল হাসে না, তবে পেয়ারাটা হাতে নেয়। হঠাৎই চোখ চলে যায় নদীর বুকে। বালির চরগুলো এখনো জেগে আছে, আর মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও পানির ওপর মাথা বের করে থাকা বাঁশের গোড়ার মতো ঝোপঝাড়। নৌকা যত সামনে যাচ্ছে, পারুলের বুকের মধ্যে যেন ততটা ভার বাড়ছে। অনিশ্চয়তা বড় ভয়ংকর জিনিস। হয়তো সে-ই বন্ধ্যা। হয়তো রিপোর্টে তাই লেখা থাকবে। হয়তো এই পথচলা আর চলবে না। হয়তো সজীব…

চিন্তার জাল ছিঁড়ে দেয় এক হালকা স্পর্শ। সজীব তার হাতটা ধরে ফেলেছে। মুখে হাসি নিয়ে সজীব পারুলকে বলো,

“আল্লাহ্ আছে না? এত ভাবিস না বউ। যা হওনের হইব।”

পারুল মুঁচকি হাঁসে। চোখ উচিয়ে সামনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল।

#চলবে?