#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব–৩৩
সজীব পারুলকে সঙ্গে নিয়ে সদর হাসপাতালের পুরান গেট পেরোয়। পারুল বোরখার ঘোমটা টেনে কাঁধের কাছে নামিয়ে রাখে—চোখে মুখে ভয় ঠিকরে উঠছে। সজীবের ডান হাত নিজের বাঁ-হাতের মুঠোয় গুঁজে ধরে ফিসফিস করলো—
“এই শহড় যেন, আলাদা জগৎ!”
সজীব চোখে ঠাণ্ডা আত্মস্থতা রাখে—
“ডর পাইস না। আমি আছি।”
দুপুর গড়িয়ে গিয়ে বেলা তিনটে বাজছে প্রায়। অনেক ঝামেলা পোহাতে হলো তাদের ডাক্তারের কাছে যেতে। তারপর ডাক্তার সজীব এবং পারুল দু’জনেরই কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করলো। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতেই বৃদ্ধ চিকিৎসক একবার চোখ তুলে বললেন—
—“আজ আর কিছু জানতে পারবেন না। সব রিপোর্ট একসঙ্গে দরকার। আপনারা কিছুদিন পর আসবেন।”
পারুলের বুকের মাঝে কেঁপে উঠলো নির্দিষ্ট-পরিচিত শঙ্কা! বাইরে বেরোতে বেরোতেই সজীব ফিসফিস করে—
“দ্রুত চল, সন্ধ্যা তো হইয়া গেলো!”
পারুলও দ্রুত হাঁটা ধরে। কিন্তু নদীর ঘাট শুনিয়ে দিল কঠিন বাস্তব—শেষ যাত্রী-নৌকাটা ঠিক আধঘণ্টা আগে পাড়ি দিয়েছে। মেঘলা গোধূলিতে কেবল নোঙর-গোঁজা দু-তিনটে খালি ডিঙ্গি দুলে দুলে ঢেউ গুনছে। ঘাটের বাঁশ-ছাউনিটা আধখোলা। পাশে জং-আঁশটে সাইনবোর্ড—
“রাত্রে কোনো লঞ্চ/নৌকা চলিবে না”। দূর থেকে ভেসে আসা চায়ের দোকানের ফুঁসফুঁস শব্দ। পারুল সেখানে তাকিয়ে আছে।
“এই দ্যাখ, নৌকা নাই, কিছু নাই। বাড়ি ফিরতে পারমু না।”
“হ, তাই তো দেখতাছি।”
“চল ছাউনির নিচে যাইয়া খাড়াই।”
দু’জনেই দাঁড়িয়ে ছিলো যাত্রী ছাউনির নিচে। পারুল ছাউনির বাঁকানো বেঞ্চে চুপচাপ বসলো। সজীবও বসে। মাথাটা সজীবের কাঁধে এলিয়ে দিলো। অবচেতন-স্বস্তিতে। সজীব আকাশের দিকে তাকিয়ে দম ছাড়লো। আলোর নিচে তাদের দুজনের দীর্ঘ ছায়া কাঁপছে, মাঝেমাঝে বাতাস এসে ছায়াদের ওলট-পালট করে দেয়।
“এইনে রাত পার করা লাগবো। তোর ডর করতাছে নিশ্চয়ই?”
“ডর তো আছে, কিন্তু আমনে থাকলেই হইব।”
সজীব মৃদু হেঁসে পারুলের মাথায় হাত রাখে। পারুল তখন সোজা হয়ে বসে। পুটলি থেকে কিছু শুকনো খাবার এনে রাখে সজীবের সামনে,
“ কি খাইছেন না খাইছেন! নৌকা থেইকা নাইমা কলা খাইছেন! এহন তো হোটেলও বন্ধ হইয়া গেছে। এইডিই খাইয়া লন।”
সজীব পারুলের হাত থেকে বিস্কিটের বয়ামটা নেয়। নিজে খেতে খেতে বলে,
“তুইও খা কয়ডা।”
“নাহ্, আমি খামু না। পেট এহনো ভরা। একটু না আগে না খাইলাম!”
“তাইলে, আমারে ধইরা শুইয়া পড়, ভোরে প্রথম নৌকা ধরুম।”
পারুল চোখ বুজলো। অশান্তির মাঝেও একরকম মৃদু হয়ে আসে। সজীব তার কাঁধে একটা হাত রাখে। যেন আগলে রাখছে।
“এইভাবে রাত কাটাইছিলি কুনোসময়?”
সজীব ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
পারুল মাথা নাড়ে—
“নাহ্।”
“আইজ রাত আমগো লাইগ্যা নতুন না রে? বিয়ার প্রথম রাইতের মতন নতুন!”
পারুল লজ্জায় মাথা নোয়ায়। মনে পড়ে যায় তাদের বিয়ের প্রথম রাতের কথা। প্রথম স্পর্শ থেকে প্রথমবারের মতন আপন করে নেওয়া সবকিছু যেন কল্পনায় ভাসছে।
মাথার ওপর রাতের একচিলতে আকাশ, দূরের নদী গাঢ় নীল হয়ে ঝিমুচ্ছে। নিস্তব্ধতা। কোনো শব্দ নেই—শুধু সজীব আর পারুল, পাশাপাশি বসে থাকা দুই মানুষ, কারো মুখে কোনো অভিযোগ নেই, অনিশ্চয়তার মাঝে সঙ্গটাই যেন আশ্বাস হয়ে থাকে।
একসময় পারুল সজীবের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলে—
“রির্পোটে যদি নেগেটিভ থাহে, আমনে আমারে ছাইড়া দিবেন না?”
সজীব একবারও চোখ না নামিয়ে বললো,
“ভুলেও না।”
পারুল কিছুটা অধিকার খাটিয়ে বলে,
“কথাডা যেন মনে থাহে। আমনে কেবলই আমার।”
সজীব কিছু বলে না। চুপচাপ থাকে। দুজন মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে, কাঁধে কাঁধ রেখে, মৌন প্রত্যয়ে।
নিশুতি রাত। চৌচালা ঘরের সামনে একটা হারিকেন টিমটিম করে জ্বলছে। বাতাসে কেরোসিনের হালকা গন্ধ। টুম্পা চুপচাপ বসে আছে দরজার পাশে। পিঁড়ি নয়, মাটির উপর একটা পুরনো বস্তা বিছিয়ে বসেছে কোলের ওপর হাত ভাঁজ করে বসে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উঠোনের দিকে—যেখানে অন্ধকার গাঢ় হয়ে ঘুমিয়ে আছে ঝোপঝাড়। ঘরে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
জমেলা বেগম খেয়েদেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। এক থালার বেশি ভাত খেলেও কোনো তৃপ্তি নেই তার মুখে। ঠোঁট কুঁচকে রেখেছেন সারাক্ষণ। মুখের ভাব এমন, যেন সারা সংসারটাই এখন তার শত্রু।
আর কামাল হোসেন—
সে হয়তো এশার নামাজের পর থেকে পাটকলের মোড়ের চায়ের আড্ডায়। যেভাবে নেমে যায়, আধা রাত পার না হলে ফেরে না কখনো।
শরীফ ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পরনে একটা ফতুয়া, চোখে ঘুম-ভাঙা ক্লান্তি। টুম্পাকে দেখে থেমে যায়।
“তুমি এনো বইয়া আছো ক্যা?”
টুম্পা মুখ তোলে না। আগুনের আলোয় তার মুখের ছায়া আরও কুচকে ওঠে।
“ভাবীরা এহনো আইলো না তো!”
পারুলকে নিয়ে টুম্পার উদগ্রীবতা বেশ মনে ধরে শরীফের। সে বলে,
“তাতে তোমার কি? তাগো সময় হইলেই আইব!”
“কত রাইত হইয়া গেলো।”
“মনে হয় আইব না!”
টুম্পা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি জানো?”
“উমমম আন্দাজ করলাম। কারন শহড় থেইকা ডাক্তার দেখায় এক দিনে আওন যায় না।”
টুম্পা মুখটা মলিন করে বলে,
“ওহ্, আমি মনে করছি ভাবীরা আসব ক্লান্ত হইয়া। আমি তাদের খাইতে দিমু।”
শরীফ অবাক হয়ে বলে,
“তুমি এজন্যই বইয়া আছো?”
টুম্পা মুঁখ কুঁচকে বলে,
“এমনে কইতাছো ক্যান? ভাবী আমারে অনেক সাহায্য করতো। আমি এই কয়দিনে তোমার আম্মার লগে থাইকা বুঝছি, ভাবী কেমনে সহ্য করছে!”
শরীফ মৃদু হাসে। সে হাসি টুম্পা দেখে না। মনে মনে বুঝতে পারছে, তার টুম্পার পরিবর্তন হচ্ছে একটু একটু করে। তার পেছনে যে জমেলা বেগমের আসল রূপ ফাঁস হওয়াই মূখ্য ভূমিকা রাখছে সেটাও শরীফ বুঝতে পারছে। যাক সে একটু নিশ্চিন্ত হলো। তার মায়ের খপ্পড়ে পড়ে টুম্পার মনে যে বিষ ছিলো সেটা তবে আস্তে আস্তে যাচ্ছে!
“ওরা আইব না, অপেক্ষা কইরা লাভ নাই।”
“আইচ্ছা তুমি যাও, আমি একটু পরে আসমু।”
শরীফ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“পরে ক্যান?”
“আমার ভাল্লাগতাছে এনে। বাতাস আইতাছে কি সুন্দর!”
শরীফ টুম্পার হাত ধরে বলে,
“এত ভালা লাগা লাগবো না। আমি যে তোমার অপেক্ষা করতাছি হেইডা দেখতাছো না?”
কথাটা বলেই শরীফ এক ঝটকায় টুম্পার হাত ধরে বসা থেকে দাঁড় করায়। তারপর ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। দরজা বন্ধ করে ফেলে। হারিকেনটাও নিভিয়ে দেয়।
~~~~
পাশেই একটা ফুটপাত ঘেঁষা চায়ের দোকান আগুন ধরিয়েছে। দূর থেকে তার নীলচে ধোঁয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশের সীমানা। সজীবের ঘুম ভেঙেছে একটু আগে। পারুল পাশেই বসে আছে, চোখে ঘুম নেই, তবু নিঃশব্দ। দুজনেই কিছু না বলে ব্যাগ খুলে দুটো শুকনো পাউরুটি আর একটা কলা বের করেছে।
হাত বাড়িয়ে পাউরুটি এগিয়ে দিতে যাবে সজীব, ঠিক তখনই কাঁধে এক স্পর্শ পড়ে।
একটা ছোট ছেলে—আট কি নয় বছরের হবে। গায়ে ময়লা শার্ট, পায়ে জুতো নেই, হাতে একটা ছেঁড়া টিফিন কৌটো। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলে না, শুধু চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে পারুলের মুখে।
“আমারে কিছু খাইতে দিবেন?”
সজীব একটু বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু পারুল থেমে যায়। সে নিজের ভাগের পাউরুটি আর কলাটা শিশুটির হাতে তুলে দেয়।
—“নাও খাও।”
ছেলেটা কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে নেয় খাবার। তারপর দুপা হেঁটে সরে যায়, আবার থামে, আবার ফিরে তাকায়।
পারুল সেই দৃষ্টির গভীরে কিছু দেখার চেষ্টা করে, কী যেন! সে ভাবে—
“এই শহরে কত শত শিশুর জন্ম হয়, কিন্তু তাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না। কেউ ঠাঁই দেয় না। একটা শিশুর জন্য তার হৃদয় কেঁপে ওঠে!”
পারুল কেমন চিন্তিত হয়ে পড়ে। সজীব সেটা খেয়াল করে বলে,
“এহন তুই কি খাবি?”
পারুল ধীরে মাথা নাড়ে।
“খামু না। এই শহর অনেক বড়। কিন্তু একটা ছুডো বাচ্চার লাইগা এনে জায়গা নাই। কি আফসোস!”
সজীব চুপ করে থাকে। তারপর আকাশের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে সত্যিই তো একটা বাচ্চার জন্য কত্তকিছু! এই বাচ্চার জন্যই তার মা তাকে বিয়ে করাতে চায়। বংশধরের জন্য! একটা বাচ্চা কতই না ভূমিকা রাখে একটা সংসারে।
#চলবে?
অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব – ৩৪
নদীর বিরামহীন ঢেউ পেরিয়ে, বিকেলের শেষ আলোয় সজীব আর পারুল বাড়ির গেট পেরোলো। দু’জনের চোখে ক্লান্তির ছায়া। উঠোনের মাটিতে পা ছোঁয়াতেই ঘর থেকে ছুটে এলেন জমেলা বেগম। মুখে কান্নার রেখা, ললাট ভাঁজে আক্ষেপের ঘন ছায়া। হাত লাগিয়ে কান্না শুরু করলেন
“ওরে বাপ সজীব! তোর ভাই তো বউ পাইয়া আমারে পাত্তা দেয় না এহন আর!”
কথার ভেতর তিরের মতো দুঃখ, আবার গুপ্ত ইঙ্গিত—ছেলের মন যেন মা-মুখোই থাকে। সজীব কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল,। গলা শুকনো। খুব ধীরে বলল—
“আম্মা, আমি এহন খুব ক্লান্ত। এসব কইয়েন না।”
কথাটুকু নরম নয়, অথচ চিৎকারও না। জমেলা বেগম থমকে দাঁড়ালেন। কান্না যেন মুহূর্তে মাটির বাতাসে ঝুলে থাকলো, নামলো না, চেপেও রইলো না। চোখেমুখে কেমন অন্য ভাব!
“ক্লান্ত! তুই যদি আমার কথায় ক্লান্ত দেখাছ, আমি কারে ধরমু বাপ! তুই না থাকলে আমার কপাল পুড়ব!”
“আম্মা? আমনে এসব সব কথাবার্তা না কইলেই ভালা হয়। একটু চুপ করেন। আমি আগে একটু পানি খাই।”
এইটুকু বলেই পারুলের দিকে একবার তাকালো। পারুল বোঝে। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কলস থেকে পানি ঢেলে দেয় মাটির গ্লাসে। সজীব নিঃশব্দে চুমুক দেয়। জমেলা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন নিস্তব্ধতায়। তাঁর বুকের ভেতর কেমন ঢাক ঢাক আওয়াজ ওঠে—এই ছেলে তো কখনো এ রকম রুক্ষ ভাষায় কথা বলে না।
সজীব নিঃশব্দে কুঁজো হয়ে ব্যাগ তুলে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো পুরনো ঘড়িটায় তখন পাঁচটা পেরিয়েছে। সজীব দড়াম করে পাশের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। পারুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো দোরগোড়ায়। মুখটা নিস্তব্ধ, চোখে হালকা ক্লান্তি। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ও সে একবার সজীবের দিকে তাকালো। তারপর ধীরে পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলো।
রান্নাঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই, একধরনের কেরোসিন আর পুরনো চালের গন্ধে তার ভ্রু কুঁচকে যায়। পাতিল খুলেই মুহূর্তেই একটা ধাক্কা খায় মনে। পাতিলের তলায় যেন কেবল এক থালার একটু বেশি ভাত লেগে আছে—তাও আবার ঠান্ডা,মানে ভেজা ভেজা টাইপ ভাত। হয়ত রান্নার পর ভাত ছ্যাকা দেওয়া হয়নি।এরকম কাজ, হয়ত টুম্পার!
তরকারির হাঁড়িতে ঢাকনা তুলে দেখে—শুধু আলু ভাজি। তেল-ঝরানো, কুচি কুচি করে কাটা আলু। আর কোনো তরকারি বলতে কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। আধোয়া কড়াই দেখে বুঝলো, হয়ত রান্না করা হয়েছিলো কিন্তু সেই তরকারি তাদের ভাগ্যে নেই।
পারুল স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে পড়ে—সে কতবার সবাইকে খাইয়ে শেষে নিজে না খেয়ে ছিলো! আলগোছে মাথা নাড়ে। তারপর নীরবে চুলোর ধারে রাখা একটামাত্র ডিম হাতে নেয়।
একটু তেল, এক টিপ নুন,আগুনের আঁচের মৃদু শব্দে ভাজা ডিমের গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ডিমভাজির ছোট্ট বাটি পাতিলের পাশে রাখে। নিজে কিছু না তুলে, শুধু সজীবের জন্য সেটা গরম ভাতের সঙ্গে থালায় সাজিয়ে নেয়। এরপর সে ঘরে ফিরে আসে। সবাই তখন বসে বা আধশোয়া হয়ে ঘরের ভেতর নানা কথায় সময় পার করছে। কামাল হোসেন এখনো ফেরেনি। আর জমেলা বেগম পাশের চৌকিতে বসে কপাল কুঁচকে খুন্তি ঘুরাচ্ছেন যেন তার রাগের আগুন নিভে যায়নি।
“তা বউমা? রির্পোটে কি কইছে? তোমারই দোষ তাই না! আমি তো জানতামই!”
জমেলার মুখে খেলে গেলো অদ্ভুত হাসি। পারুল ধীরে ধীরে বলে,
“রিপোর্ট এখনো দেয় নাই ডাক্তার। ক’দিন পরে যাওন লাগবো।”
এই কথা বলতেই যেন একটা অদৃশ্য সুই খোঁচা মেরে, কণ্ঠে চিরচেনা শ্লেষ মিশিয়ে বলে ওঠেন—
“হ! দোষ তো এই মাইয়ারই! নইলে এত বছর পার হইলো, ঘরে বাচ্চা নাই ক্যা?”
পারুল মুখ নিচু করে থাকে। নিঃশব্দ উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে—ঁ
“আম্মা, রির্পোট দেইখ্যা কইয়েন।”
পারুলের উত্তরে জমেলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন!
“আমার মুখের উপরে কথা কওন লাগতো না, তোমার। সবই জানি। খালিখালি আমার পোলার টেকা পয়সা গুলান নষ্ট করতাছো!”
পারুল এবার বড় করে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়,
“টেকা আমনের পোলার না, আমি জোগাড় কইরা দিছি।”
জমেলা বেগম হতভম্ব হয়ে যায়। চোখ দু’টো বড়বড় করে বলে,
“কিহ্! যত বড় মুখ না, তত বড় কথা!”
“সত্যি কথা আম্মা!”
বলেই পারুল আর এক মুহুর্ত ও দাঁড়ায় না, চলে যায়। জমেলা বেগম সেখানেই ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। মনে এক আংশকা! তার রাজত্ব যেন শেষ হয়ে আসছে। ছেলে, বউ কেউই তার হাতে নেই বললেই চলে! এবং তা তিনি কিছুতেই মানতে পারছেন না। পারুল সজীবের ঘরে থালা নিয়ে যায়। ঘরের বাতি তখনো জ্বালানো হয়নি। জানালার ফাঁক গলে ম্লান আলো এসে পড়ে বিছানার চাদরে। সজীব চোখ বুজে শুয়ে ছিল, চোখ মেলে তাকায়—
“তুই খাইলি?”
পারুল মুখে হাসি আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তারপর চুপ করে প্লেটটা এগিয়ে দেয়।
“আমি পরে খামু। এইডা আগে খাইয়া লন।”
সজীব বসে পড়ে। তার হাতটা ধরা পারুলের কাঁধে রাখে।
“আমি জানি, তুই কিছু খাস নাই।”
—“তবুও খাইয়া লন।”
সজীব কিছু না বলে খাওয়া শুরু করে। বাইরে তখন রাত গাঢ় হয়ে আসছে। বেলি ফুলের গন্ধ ঢুকে পড়েছে জানালার ফাঁক দিয়ে। আর কোনো হাঁকডাক নেই। রান্নাঘর নিঃস্তব্ধ, গৃহস্থের ঘরেও নিস্তব্ধতা জমে উঠেছে একরকম গুমোট ক্লান্তি নিয়ে।
পারুল চুপচাপ বসে কাপড়ের ছোট্ট পুঁটলি খুলে। তার মধ্যে কয়েকটা টাকার নোট, আর কয়েকটা ছোট খুচরো। বিয়ের সময় পাওয়া গয়না বন্ধক দিয়ে যেটুকু টাকা উঠেছিলো, তা দিয়েই শহরে চিকিৎসা, রিকশা ভাড়া, ওষুধের দাম মিটিয়ে শেষে যেটুকু বেঁচেছে, এগুলো দিয়ে রির্পোট আনতে হবে।
সে বিছানার ধারে বসে থাকা সজীবের দিকে এগিয়ে দেয় পুঁটলিটা। সজীব অবাক চোখে তাকায়।
“এইটা কি?”
“বেঁচে যাওয়া টাকা। আমনে রাখেন।”
সজীব পুঁটলিটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে খোলে। টাকা গুনে দেখে, হালকা মাথা নাড়ে।
“তুইই তো রাখতে পারতি!”
পারুল নিচু গলায় বলে,
“আমি হইলে হারায়া ফেলতাম। আমনেরে বেশি বিশ্বাস হয়।”
সজীবের ঠোঁটে একটা আবছা হাসি খেলে যায়। সে আলমারির এক কোণ থেকে একটা পুরোনো গোলাপি রঙের সাবানদানি টেনে আনে, যার ঢাকনায় ফেটে যাওয়া দাগ। সাবধানে টাকা ভাঁজ করে তার মধ্যে রেখে ঢাকনাটা চেপে দেয়। ঠিক তখনই পারুল একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকায়। দরজার চৌকাঠে টুম্পা দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে কৌতূহল আর একটু লজ্জা—মনে হয়, অনেকক্ষণ থেকেই সে তাকিয়ে ছিল। পারুলের চোখে চোখ পড়ে যেতেই টুম্পা একটু কুণ্ঠিতভাবে বলে ওঠে—
—“ভাবী, আমি আসলে জিগাইতে আইছিলাম, কিছু লাগবে কি-না।”
পারুল এক চিলতে হেসে বলে,
“না, লাগবো না। টুম্পা।”
টুম্পা চুপচাপ ঘরে ঢোকে, কিন্তু চোখের কোণে যেন কী একটা ঝিলিক খেলে যায়। রাগ নয়, হিংসাও নয় , যেন এক অদ্ভুত উপলব্ধি।
সজীব টুম্পার দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নাড়ে।
“তোর কিছু দরকার?”
“না, ভাইজান।”
“হুট কইরা আইলি যে? তুই তো আবার অন্যরকম!”
সজীবের কথাটার পূর্ন অর্থ বুঝে উঠতে বেগ পেতে হলো না টুম্পার। সে হাসি মুখেই বলে,
“ভাইজান, একটা কথা কইতে আইছিলাম।”
“কি?”
“আমি চাই কালকে বাপের বাড়ি যাইতে। আমার আম্মায় কইছিলো যাইতে।”
“তাতে যাইবি! কওনের কি আছে? অনুমতি নেওয়া লাগে? তুই এই বাড়ির বউয়ের আগে তো আমার বইন!”
টুম্পা একটু দম নিয়ে বলে,
“আমি খালারে মানে আম্মারে কইছিলাম আজকে যাওনের কথা। হেয় কইয়া দিছে,আমি যাতে না যাই!”
সজীব ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করে,
“ক্যান? যাবি না ক্যান?”
“আমি নাকি আম্মার কান্ধে সব কাম দিয়া যাইতাছি গা, উনারে বিপদে ফালাইতে। হেই কারনেই যাইতে দেয়নাই। সকালে তো তুমুল ঝগড়া হইছে এই নিয়া!”
এতক্ষণ পারুল সবটা চুপচাপ শুনলেও এবার বলে উঠে,
“তারপর?”
“তারপর আর কি! আম্মায় রাগ কইরা কইছে আজকে সে খাইব না। কিন্তু আমি দেখছি, তার শেফালী চাচী আছে না? তাগো বাইত যাইয়া খাইয়া আইছে। আমারে কইছে তার লাইগা যাতে ভাত তরকারি না রান্ধি। আমিও করি নাই। ওমা পরে আইয়া দেহি কি, আম্মায় লুকায় লুকায় এক থালা ভাত সব খাইছে! তোমার দেবরে কামলা দিয়া যে মাছ আনছিলো? দুই টুকরা মাছ আছিলো, দুনো টুকরা আম্মায় খাইয়া ফালাইছে।”
টুম্পার কথা শেষ হতেই পারুল মুঁচকি হেঁসে বলে,
“আম্মা কইছে তার লাইগা ভাত না রানতে, আর তুমিও রান্ধো নাই?”
“আমিই কইছি, না রানতে।”
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো শরীফ। তা দেখে সজীব বলে উঠে,
“ভাই! এইডা কিন্তু ঠিক না!”
শরীফ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“ভাইজান! কি ঠিক করতাম কও তো? ভাবছি বউডারে মানুষ করুম। ওমা দেহি বউ শ্বাশুড়িয়ে যুদ্ধ করে প্রতিদিন!”
সজীব গা ছাড়া ভাব করে জবাব দেয়,
“আরে আম্মা ওরকমই।”
“হ, আমিও ভাবছি যে টুম্পা তো আম্মার বইনঝি। পছন্দের। মিলেমিশে থাকবো। কিন্তু টুম্পা যে ফটফট করে, ঠাসঠাস উত্তর দেয়, আম্মা তা সহ্য করতে পারে না। ব্যস লাইগ্যা যায় তাগো যুদ্ধ! এহন আমি বউরে কি সোজা করমু? না আম্মারে থামামু তুমিইই কও!”
শরীফের কথা শেষ হতেই টুম্পা বড়বড় করে চোখ করে তাকে চোখ রাঙায়। সজীব বিচক্ষণের মতন জবাব দেয়,
“আমার বউ হইছে মাটির মানুষ। আমার সংসারে এই কারনেই কোনো যুদ্ধ নাই ভাই।”
“হেই লাইগ্যাই তো কইছি, আম্মারে বুঝান লাগবো। আমিই কইছি ভাত না রানতে।”
“এসব কইরা লাভ নাই। আম্মার বয়স হইছে। খিটখিটে হইয়া গেছে। আপনাই ঠিক হইয়া যাইব দেখিস।”
টুম্পা মাঝখানে বলে উঠে,
“আমি এই দশ বারো দিনে, খালারে চিইন্যা গেছি।”
“হইছে হইছে, আর কথা কইও না। কালকে টুম্পা বাপের বাড়িতে যাইও। আমি তো আছিই এহন।”
পারুলের কথা শুনে, টুম্পার মুখে খুশির ঝলক খেয়ে যায়। মাথা নাড়িয়ে ঘর থেকে চলে যায়। শরীফও বউয়ের পেছন পেছন চলে যায়। পারুল এবার বাহিরের দিকে পা বাড়ায়। সারাদিন ধুলোবালি মেখে এসে এখন, গোসল না করলে যেনো শান্তিতে শ্বাস নিতে পারবে না।
#চলবে?