#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব – ৩৫
প্রায় কয়েক দিন হতে চলল শরীফ আর টুম্পা নেই বাড়িতে। দুজনেই বেড়াতে গিয়েছিলো টুম্পার বাপের বাড়ি, কবে ফিরবে সে ঠিক নেই। বাড়িটা চুপচাপ। উঠোনে আগের মতো হুলস্থুল শব্দ হয় না। রান্নাঘর থেকেও আর শোনা যায় না টুম্পার লতির আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে বিরক্তিতে ‘উহ্’ করা আওয়াজ, কিংবা জমেলা বেগমের হাঁকডাক—“এই টুম্পা! জিনিসপত্র কই রাখছস?” এসব যেন নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে।
তবে এই নির্জনতাও যেন শান্তির নয়, বরং অদৃশ্য কোনো চাপ জমে আছে দেয়ালের গায়ে গায়ে। জমেলা বেগম দিনভর ঘরের একপ্রান্তে বসে থাকেন, পানের বাটা খুলে খুলে পান কাটেন, আবার নিজের মনে চিবুতে চিবুতে আড়চোখে সব দেখেন—বিশেষ করে পারুলকে। কিন্তু যা ভাবতেন, তা আর হয় না এখন। পারুল এখন আগের মত না।
তাকে দিয়ে আর সহজে কিছু করিয়ে নেওয়া যায় না। আগে যেমন মুখ নিচু করে চুপ করে শুনে যেতো, এখন সময়মতো দু’চোখে চোখ রেখে উত্তর দেয়। খুব চেঁচামিচি না করে, গলা না তুলেই এমনভাবে বলে—যাতে শ্বাস আটকে আসে, অথচ মুখে কথা ওঠে না।
এইতো সেদিন, ভাতের পরিমাণ নিয়ে কিছু একটা বলেছিলেন জমেলা বেগম, যেন কটাক্ষ করে বলেছিলেন,
“ভাত রান্ধিস ঠিকই, কিন্ত খাইতে শক্ত লাগে।”
পারুল থেমে গিয়েছিলো। তারপর ধীরে এগিয়ে এসে বলেছিলো,
“ভাত ডইল্যা খাইবেন আম্মা। শক্ত লাগব না আর।”
জমেলা বেগম ঠিক তখনই কিছু বলে উঠতে পারেননি। গলায় গিলে রাখা কথা দলা পাকিয়ে গিয়েছিলো।এখন তিনি নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রায়ই ভাবেন
“সবাই এত্ত সাহস কই পায় ? আমার মুখের উপর কথা কয়! এই পারুল পর্যন্ত! এই বাড়ির কর্ত্রী তো আমি! আমি হই।”
হ্যাঁ, ঠিক এই “আমি হই” বলেই নিজেকে বোঝান তিনিতাঁর কর্তৃত্ব এখনো অটুট। কিন্তু ঘরের হাওয়ার দিক বদলে গেছে সে তো টের পান। আগে এই বাড়িতে তিনি হাঁ করলে বাকিরা তা মানতো, এখন পারুল কী শান্ত স্বরে কথা বলে, অথচ তার মধ্যে এমন দৃঢ়তা—যার সামনে জমেলা বেগমের বহু বছরের তর্জন গর্জনও থেমে যেতে চায়
জমেলা কখনো কখনো নিজের চুলে হাত দিয়ে ভাবে—
“সবাই কি এক এক করে মুখ উঁচু করে কথা কইবো? আমারে দেখলে কেউ ভয় পায় না ক্যান?”
তার ঠোঁট বাঁকা হয়ে যায়।
কপাল ভাঁজ হয়ে যায়। আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে তাকান। পারুল হয়তো গামছা পেঁচিয়ে ঘর মুছছে, কিংবা হাঁড়িতে ডাল চাপাচ্ছে, আবার হয়তো শুকনো কাপড় রোদে দিচ্ছে—
সবই করে, কিন্তু আর মুখ নিচু করে নয়।
রান্না শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়েছিলো পারুল, এখন ঘরের কোণে বসে ধীরে ধীরে আলনা গোছাচ্ছে। পুরোনো এক ওড়নার আঁচল সেলাই করা, পাশেই ঝুলছে জোড়াতালি দেওয়া কালো একটা কাপড়, বহু ধোয়া আর পরিধানে যার রঙ ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। আলনার কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পারুলের বুক ফুঁড়ে। ঠিক তখনই ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে সজীব। চোখে মুখে দিনের শেষে ধুলোমাখা ক্লান্তি, তবু হাসিটা আলগা নয়। পারুল তাকিয়ে পড়ে—
“এই কই গেলা?”
“বাইরে গেছিলাম, পুকুর পাড়ে বইসছিলাম একটু। এখন তোরে লইয়া যামু।”
পারুল ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
“কই যামু?”
“বোরখা পইরা রেডি হ । তারপরে কই।”
পারুল থমকে দাঁড়ায়।
“এই বিকেলো? আমগো তো কুনো গন্তব্য নাই!”
“আছে। তোরে লইয়া যাইতাছি দোকানে।”
“দোকানে?”
সজীব মুচকি হেসে এগিয়ে এসে বলে—
“হ, তোর পছন্দমতো একটা কাপড় কিনা দিমু। কতোদিন ধইরা দেখতাছি, দুইটা কাপড় দিয়া ঘুরিস। জোড়াতালি দিয়া যেইডা রক্ষা করছস, ওইডা কাপড় না লাজ বাঁচানো চাদর!”
পারুল চোখ নামায়। কাঁধের আঁচলটা টেনে আরও ঠিক করে নেয়।
“টাকা দিমু কই থেইকা? ঘরে তো খরচের টানাটানি।”
“যে টাকা বেঁচে গেছিলো হেইডা দিয়া তোর কাপড় কিনুম।”
“ওমা ওইডা তো রির্পোট আনার পরের টুকু সংসারের খরচের লাগব। সংসারের দায়িত্ব আছে না?”
”বউরে খুশি রাখাও তো স্বামীর দায়িত্ব।”
পারুল এবার একটু গম্ভীর হয়ে যায়। গলা ভার করে বলে,
“না, আমি যামু না। সংসারে টাকা লাগবো, কাপড় না।”
“তুই কিছু বুঝিস না। সবকিছুরই একটা সময় আছে। আজকে আমি খুশি, আজকে তোরে কিছু দিতে চাই। এইটা নে।”
সজীব হেঁটে গিয়ে আলমারির দিকে এগোয়। পরনের লুঙ্গির খুঁট থেকে চাবির গোছা বের করে আলমারির লক খোলে। পারুল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখে।
আলমারির নিচের তাকে রাখা একটা পুরনো স্টিলের গোলকান পেটি—যেখানে পারুল হাতে তুলে দিয়েছিলো সেদিন শহর থেকে ফেরার পর বেঁচে যাওয়া টাকা। সজীব সেটার মুখ খোলে। তারপর—
চোখ কুঁচকে তাকায় সজীব। তারপর হাত ঢুকিয়ে খোঁজে। কিছু নেই। পাশেও না। সে আলমারির ভিতর ঝুঁকে পড়ে পুরো তাক নেড়েচেড়ে দেখে। নিঃশব্দ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। মুখে বিস্ময়ের রেখা।
পারুল ধীরে কাছে এসে বলে—
“কি হইছে?”
সজীব আস্তে বললো,
“টাকা নাই।”
পারুলের মুখে কিছু পড়ে না। সে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে। মাথার ভিতর দিয়ে অনেক প্রশ্ন দৌড়ায়, সন্দেহও হয়, ভয়ও হয়। আবার নিজেকেই শান্ত করে।
“ ঠিকঠাক জায়গাতেই রাখছিলেন?”
“হ, এই আলমারিতেই, এইডা তো!”
সজীব দেয়ালের দিকে তাকায়, যেন কিছু মনে করতে চাইছে। তারপর মুখটা কেমন রুক্ষ হয়ে যায়। পারুল তার মুখের চেহারার পরিবর্তন লক্ষ করে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখে।
“ভাবেন কই রাখছিলেন ঠিকমতো।”
সজীব গভীর শ্বাস নেয়। আলমারির এখনো খোলা। ঘরের নিরবতাও এখন কান্না করতে চায়। সজীবের হাতে সেই খালি স্টিলের বাক্স। চোখে কেবল বিস্ময় নয়—অবিশ্বাস, অভিমান, কষ্ট, ক্ষোভ—সব মিলে এক গভীর ব্যথা। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যায়। ঠোঁট কাঁপে তার—
“টাকাগুলা তো… রাখছিলাম… রির্পোট আনতে…”
তার কণ্ঠ যেন নিজের কাছেই অচেনা ঠেকে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছে। অনেক স্বপ্ন, অনেক সাহস নিয়ে জমা করা সেই সামান্য কটা টাকা, যা পারুল নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলো—সে টাকা নেই! নেই বলেই যেন এখন এই নীরব ঘরের ভিতর আরও এক চিৎকার ভেসে বেড়ায়। পারুল চুপ। তার ঠোঁট নড়ে না, গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। মুখটা ফ্যাকাশে। চোখে বিস্ময়—আর খানিকটা ভয়।
পারুল আলতো করে সজীবের হাতে হাত রাখে—
“সব বুঝা যাইবো। খালি আগে চিন্তা কইরেন না।”
ঠিক সেই মুহূর্তে চিৎকারে কেপে উঠলেন জমেলা বেগম!
“এইহ! কি হইছে? সজীবরে ডাকতাছো ক্যান?”
জমেলা বেগম ঘরে ঢুকে পড়লেন দড়জা ঠেলে। মুখে বিরক্তি, পায়ে জোর। চোখে রাগের আগুন, মনে হয় এই বুঝি গলা চিপে ধরেন কারো।
“কি হইছে? দুচোখ কাঁদা কইরা বইসা আছোস ক্যা?”
সজীব কোনো শব্দ করে না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু ঠোঁটের কোণে একটুকরো দুঃখ জমে থাকে।
পারুল ধীরে বলে, —
“আমরা কিছু টাকা রাখছিলাম। রির্পোট আনার লাইগা। আলমারি খুলে দেখি নাই!”
জমেলা বেগম হেসে ওঠেন—
“হাঁ! আমি বলছি না! এই মাইয়ারই দোষ! তার চক্রান্ত, তার ভাগ্য! ঘরে থাকলেই অশান্তি! আমার ছেলেরেও অপদস্ত করবো! কয়দিন পর!”
সজীব চোখ তোলে, মুখে তীব্র ধকল।
“আম্মা, চুপ করেন। ওইডা তো রাখছিলাম আমি। নিজেরে ভরসা করছিলাম, পারি নাই। দোষ আমার।”
তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে। সে ধপ করে বিছানার পাশে বসে পড়ে। চোখ ফেলে রাখে মাটির দিকে। পারুল কিছু বলতে যায়, পারে না।
সজীব ফ্যালফ্যাল করে পারুলের দিকে তাকিয়ে বলে
“আমি তো ভাবছিলাম, রিপোর্ট আনমু তোরে কলংকমুক্ত করুম। বলুম, তুই ঠিক আছস। তারপর কাম কইরা গয়নাটা ছুটামু। সব কিছু সাজাইছিলাম মনে মনে। কিছুই হইল না!”
তার গলার ভিতর কি যেন শব্দ আটকে গেছে। কণ্ঠ ফেটে আসে। তবু কান্না আসে না। চোখে জল নেই। আছে কেবল শূন্যতা আর নিজের ব্যর্থতার অপরাধবোধ। পারুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তার সামনে বসে এক যুবক, যার বুকের ভেতর এখন লাটিমের মতো ঘুরছে দুঃখ। যার দুচোখে নিজেরই জন্য ঘৃণা। তারা কেউ কোনো শব্দ করে না। কেবল সজীবের নিঃশ্বাসে এক একটা চাপা কান্না—
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে। জমেলা বেগম হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। এমন করে ছেলে কখনো মুখ নিচু করে ছিল না তার সামনে। তিনিও কিছু বলতে পারেন না। পারুল কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বলার ভাষা নেই তার।
#চলবে?
#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব – ৩৬
দিন কাটে, দিন গড়িয়ে রাত আসে। তারপর আবার নতুন ভোর। বিকালের রোদ তখন গলে গলে পড়ছে। উঠোনের এক কোনে পুরনো খয়েরি রঙের মাদুর পেতে বসে আছেন কামাল হোসেন। পাশে মুখ শক্ত করে জমেলা বেগম। দু’জনের মধ্যে আজকের আলাপ একটু দীর্ঘ, একটু মন খুলে। কামাল হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“গুড়া মাছের চচ্চড়ি খাইতে মন চাইতাছে।”
“কইত্তে খাইবা? তোমার পোলারা কি সংসারে টেকা দেয়?”
মুক বেকিয়ে কথাগুলো বললো জমেলা, কামাল তখন কিছুটা গম্ভীর থেকেই বলে,
“তোর বাপের বাড়ি থেইকা, টাকা আনোস তাইলে?”
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন জমেলা বেগম।
“আমার বাপের বাড়ি থেইকা আনমু ক্যান? পোলা দুইডা জন্ম দেইনাই?”
“হেই পোলা দুইডা যদি সংসার না দেখে তো বাঁইচা আছোস কেমনে?”
জমেলা বেগম চোখ কুঁচকে তাকান—
“দুইডা পোলাই নষ্ট হইয়া যাইতাছে, তুমি একটু সংসারে কর্তাগিরি করতে পারো না?”
“ক্যা? তোর সংসারে না আমি নাক গলাই? তোর সংসার তুই ধইরা রাখবি। তাইলে আমারে কস ক্যান?”
জমেলা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“দুনোডা পোলাই বউভক্ত হইয়া গেলো।”
“চুপ কর তো! পোলারা এহন ছুডো নাই। ওগো সংসারে ক্যান নাক গলাবি তুই?”
জমেলা চোখ বড়বড় করে বলে,
“ওইডা আমার সংসার না?”
কামাল হোসেন এবার বিরক্ত হয়ে বলে,
“নাহ্! তোর বয়স হইছে। আইজ আছিস, কাইল নাই। সময় অহন ওগোই।”
“বুঝছি!”
“হুন, জমেলা। পোলাগো লগে বেশি তেড়িবেড়ি করিস না। তাইলে ভাত পাবি না খাইতে। রাস্তায় রাস্তায় থাকা লাগবো। দুইডা পোলার বউ আছে, তুই খালি মিলমিশ দিয়া চলবি। দেখবি কোনো কথা নাই! আমারে দেখোস না? আমি নাক গলাই? খালি দুইডা পেডে দেই আর আল্লাহর নাম লই। তুইও তাই কর। সংসারেও শান্তি পরকালেও শান্তি!”
জমেলা কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। যে ভয় থেকে বড় ছেলেকে হাত করে রেখেছিলো অবশেষে সেটাই যেনো সত্যি হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার!
এমন সময় উঠোনের গেটের দিকে চোখ পড়ে যায় দুজনেরই। শরীফ! কাঁধে একটা খালি বস্তা, গায়ে মাটি লেগে আছে, শার্টের হাতা গুটানো, মুখে ক্লান্তির রেখা। একেবারে চুপচাপ ঢুকে পড়ল উঠোনে।
জমেলা চোখ বড় বড় করে বলে ওঠেন—
“আরে! তোর এই অবস্থা ক্যা?”
শরীফ কপাল ঘসে ঘামে ভেজা মুখ মুছে নিয়ে বলে
“সরাসরি মাঠ থেইকাই আসতাছি। ক্ষেতে কাম করতাছিলাম।”
জমেলা মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন কামালের দিকে। একবারও ভাবেননি তার ছোটো ছেলেটা এভাবে বদলে যাচ্ছে, সবদিক দিয়ে!
“যা হাত মুখ ধুইয়া, ভিতরে যা বাপ।”
কামাল হোসেন হালকা হেসে বললেন—
“ছেলেটার কামের হইছে দেখছো? এবার বুঝছো সংসার, বিয়া কি জিনিস? আমার ভবঘুরে ছেলেটাও সংসারী হইছে।”
গলায় কেমন যেন গর্ব মেশানো তৃপ্তি। বহুদিন পরে এই কথা তার মুখে। ছেলেটার কাঁধে এখন পরিণতির ছায়া। পারুল তখন রান্নাঘরে। হাঁড়িতে ডাল ঢালছে শুনে ফেলেছিল শরীফের আগমনের কথা। সে কেমন একটা শান্ত হাসি দিয়ে কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে। শরীফ ঘরে ঢুকেই টুম্পাকে বলে—
“ টুম্পা, ভাবী কই? পাকঘরে?”
“জানো যহন জিগাও ক্যা?”
শরীফ চলে যায়। রান্নাঘরে দরজার চৌকাঠে কাঁধ ঠেকিয়ে বলে,
“ভাবী, কি রানতাছো?”
পারুল পেছনে না তাকিয়ে বলে,
“ভাত, ডাইল, শুঁটকির ভর্তা, আর নিরামিষ। তোমার পছন্দের।”
শরীফ হেসে বলে,
“তাড়াতাড়ি খাওন দেও।”
“দিতাছি, তুমি যাও।”
যেতো শরীফ আবার ফিরে এসে বলে,
“ও ভাবী? কাইলকা মাছ আইন্যা দিমু। তুমি আমারে ভূনা ভূনা কইরা রাইন্ধা দিবা কেমন?”
“আইচ্ছা দিমুনে।”
শরীফের আবদার শেষ করেই সে চলে যায়। পারুল তখ খাবার ঘরের ভিতর গিয়ে দিয়ে আসে। টুম্পা তখন সুঁইয়ে সুতা গাঁথছিলো। শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিলো বোধহয়। টুম্পার ভেতর আজকাল বদল ঘটেছে। সেটা বেশ টের পায়। পারুলকে ভেতরে আসতে দেখে বলে,
”তোমার দেওরের লাইগ্যা আনছো নাকি?”
“হ, শরীফ কাম কইরা আইছে, কইলো ক্ষিদা লাগছে তাই। ওর তো আবার ভাত ছাড়া পেট ভরে না।”
টুম্পা কিছুটা মুখ বাঁকিয়েই বললো,
“কত কিছু জানো।”
“অভ্যস্ত আমি।”
“হেয় কিন্তু অহন তোমার দেওর নাই, আমার জামাই।”
পারুল হয়ত বুঝতে পারলো টুম্পা কি ইশারা করছে। তবুও উত্তর দেয়,
“হ, জানি তো।”
“তাইলে তার দেখাশোনা আমারই করা উচিত?”
পারুল যা ভেবেছিলো তাই। যতই যাই হউক না কেনো, মেয়েদের কাছে তার স্বামী জিনিসটা আলাদা, অন্যরকম ভালোবাসার।
“একদম! এহন থেইকা তুমিই সব করবা বাপু। তোমার জামাইর খেদমত আর আমি করতাম পারতাম না।”
“কইরেন না, আমিই আছি।”
পারুল মুঁচকি হেঁসে চলে যায়। শরীফ ভেতরে আসতে আসতে সবটা শুনে। গামছা দিয়ে গা হাত পা মুছতে মুছতে বলে,
“ভাবীরে ওরম করে কইলি ক্যান?”
টুম্পা কিছুটা অভিমান দেখিয়ে বলে,
“তোমার বউ কে?”
“তুই!”
“তাইলে অবাক হইতাছো ক্যান? বউ করবো না কি ভাবী করবো?”
শরীফ বাঁকা হাসে।
“বউ তো সব করে না।”
“করতে কতক্ষণ?”
শরীফ কিছুটা এগিয়ে যায় টুম্পার কাছে। বেশ কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আইজ রাতের থেইকাই তাইলে দেখমু। সব করে কি-না! নাকি খালি কামই করবা? ভালোবাসায় ফাঁকি দিয়া।”
টুম্পা তৎক্ষনাৎ লজ্জায় মাথা নোয়ায়। শরীফ টুম্পাকে ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ভাতে হাত দেয়। আগে এসব কাজ টাজের অভ্যেস ছিলো না। পরে বুঝেছে তার বউয়ের শখ আহ্লাদ তারই মেটানো লাগবে। তার জন্য হলেও টাকা রোজগার করতে হবে। মূলত টুম্পা যেদিন শরীফের টাকার অক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো? সেদিন থেকেই শরীফ বসে না থেকে, হন্যে হয়ে কাজের খুঁজ করেছে। টুম্পার যে শরীফকে নিয়ে অনুভূতি হচ্ছে সেটা শরীফও বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। টুম্পা বসা থেকে উঠে গিয়ে হাতপাখা দিয়ে শরীফকে বাতাস করতে থাকে।
রাত তখন অনেক দূর। হারিকেনের শিখা টুপটাপ করে কাঁপছে, ঘরের ভেতর সজীব আর পারুল বসে আছে পাশাপাশি। হঠাৎ সজীব দম টেনে বললো,
“ আজকা রিপোর্ট আনবার ডেট পাইরা চার দিন গেলো! পকেটে পয়সা নাই, কেমনে শহরে যামু? কেমনে হাসপাতাল থেইকা কাগজটা আনুম?”
কথাগুলো উচ্চারণে সজীবের গলায় অনুতাপ, নিজের উপর রাগ, আর ক্ষীণ গলাটুকুতে লজ্জা।
পারুল ধীরে মুখ তোলে। আলতার দাগ উঠে যাওয়া পা দুটো নিজের আঁচলের ভাঁজে ঢেকে নিয়ে বললো—
“আমি বাপের বাড়ি যামু।”
সজীব অবাক হয়ে তাকালো,
“এত রাইতে এই কথা মাথায় আইলো?”
“ভাবছি ক’দিন ধইরা। ওইখানে গেলে কিছু না কিছু ব্যবস্থা হইয়া যাইব।”
“আরেকটু অপেক্ষা করলে মনে হয় হইব। বেশি কামলা দিলে টাকা হইয়া যাইব।”
“কতদিন লাগব?”
“ধর এক মাস!”
পারুল দম নিয়ে বলে,
“নাহ্, ততদিনে যদি রির্পোট হারায় যায়?”
“তার লাইগা তুই তোর বাপের বাড়ি যাবি!”
“হ, আমি কাইল সকালেই রওনা দিমু। আমনের পায়ে পড়ি বাঁধা দিয়েন না।”
“কাইল আমার কাম আছে!”
“আমি একলা যাইতে পারমু তো।”
“মানুষজন কইব কী? বউ একা একা যাইব?”
“আমি তো দিনেদিনেই ফিরুম। ভোরে নৌকা ধরুম, দুপুরে পৌঁছায় যামু। রাতের আগে ফিরা আমু। আমনে দয়া কইরা আমারে বাঁধা দিয়েন না! এইডা আমার অস্ত্বিত্বের প্রশ্ন!”
শেষের লাইনে গিয়ে সজীব কাবু হয়ে যায়। কত অপারগতা—সব মিলেও স্ত্রীর এই সাহসী প্রস্তাবের কাছে খড়কুটোর মতো নিঃশেষ হয়ে যায় তার কথা। মাথা নিচু করে বলে,
“যদি তারা কিছু কয়?”
পারুল শান্ত স্বরে,
“কি কইব? আমার ওনে আমার মা’র অধিকার আছে। সবকিছু এহনো শেষ হইয়া যায় নাই। আমি নিশ্চিত মামা আমারে ফিরাইব না! আমি তারে চিনি। কুনোদিন কিছু চাইনাই। আজ আমারে দেয়ালে পিঠ ঠেইকা গেছে।”
সজীবের আত্মসম্মানে লাগছিলো পারুলের কথাগুলো। তার ব্যর্থতাগুলো স্পষ্ট সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যেনো। তবুও স্ত্রী’র সম্মান রর্ক্ষাথে না পারতেই অনুমতি দিয়ে দেয়। রোজ রোজ তার মায়ের অপবাদ, তাকে বিয়ে করানোর জন্য চাপাচাপি, সংসারে অশান্তি এসব আর ভাল্লাগছে না। তার চেয়ে বড় কথা তারও একটা সন্তান চাই।
পারুল, বিছানা পেতে দেয়। পুরনো, জোড়াতালি দেওয়া ধবধবে চাদর। পারুল আলনা থেকে একটা কাপড় নামায়। কালকের প্রস্তুতি নেয়।
#চলবে?