শুভমুহূর্ত পর্ব-০১

0
16

#শুভমুহূর্ত (প্রথম পর্ব )
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা

Feminine Wisdom

“সকালে চা খাস না?”—লাজু হাত দুটি তুলে আরমোড়া ভাঙতে ভাঙতে জিজ্ঞেস করল। লক্ষ্মী তখন সদ্য ঝাঁটা হাতে ঢুকেছে! সকালে এটাই ওর প্রথম কাজ—বাসি ঘরগুলো ঝাঁট দিয়ে ফেলা! তারপর ঘরগুলোতে একটু জল ছিটিয়ে দেওয়া।

এতদিন এই গেস্ট রুমটায় কিছু করতে হতো না! এই মেয়েটা আসতেই এই একটা কাজ বেড়েছে লক্ষ্মীর! লক্ষ্মী দেখল, মেয়েটা বড় করে হাঁ করে হাই তুলল! নবাবিয়ানা সহ্য হচ্ছে না লক্ষ্মীর! দিব্যি হাসিখুশি পরিবার—মেয়েটা আসাতে সব বদলে গেল! গিন্নিমাও আজকাল হাসে না! দাদাও বাড়ি থাকে না! এরকম ভালো লাগে না লক্ষ্মীর।

লক্ষ্মী তাকিয়ে আছে দেখে হঠাৎ মনে পড়ল—লাজুরও তো এই বাড়িতে আসাটা অযাচিত। উড়ে এলেই তো জুড়ে যাওয়া যায় না! তাই একটা ঘরে ওকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, বন্দী জীবদের মতো! লুকিয়ে রাখা হয়েছে! শুধু সময়মতো বাইরে থেকে খাবারটা দিয়ে যায়!

এই ঘরের মধ্যেই স্নানঘর। গ্রামে ওদের পুরো ঘরে উঠোনে যা যা ছিল, এই একটা ঘরেই সব আছে। সামনে আবার একটা দাঁড়ানোর জায়গা—ওখানে দাঁড়ালেই নিচে কত গাছ, সারাদিন হাওয়া। এই ঘরটায় থাকতে লাজুর ভালোই লাগছে। নরম গদির বিছানা! সুন্দর বারান্দা!

বাড়িতে থাকলেই কাজ করো আর কথা শোনো। আর এখানে না এলে এতক্ষণে কী না কী হয়ে যেত লাজুর জীবনে! ভাবলেই বুকটা কেঁপে ওঠে! মা এতক্ষণে ওই বুড়ো লোকটার হাতে দিয়ে দিত—ভাবতে ভাবতেই একদৃষ্টে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল লাজু।

মেয়েটার ওপর রাগ হলেও, এত মায়াভরা মুখ দেখে লক্ষ্মীর একটু যেন খারাপই লাগে—কে জানে, বেচারির হয়তো খিদে পেয়ে গেছে! চা তো সত্যি এই বাড়িতে কেউ খায় না! সে ওকে একটু করে দিলেও কেউ কিছু বলবে না! এই বাড়ির মানুষগুলো আর যাই হোক, খারাপ নয়! তাই সেই ভরসা থেকেই বলল—
“চা এই বাড়িতে কেউ খায় না, কর্তাবাবু—মানে তোমার শ্বশুরঠাকুর—আগে খেতেন, গিন্নিমার সুগার ধরা পড়ার পর বন্ধ করে দিয়েছে। আর তোমার স্বামী আর কতক্ষণ ঘরে থাকে!”

শ্বশুর, স্বামী—এসব শুনে একটু যেন অবাক হয়েই তাকাল লাজু।
“তোমার খুব কষ্ট হয় না এখানে থাকতে?”—লক্ষ্মীর গলায় কেমন দুঃখের ছোঁয়া পেয়ে যেন মনে বল পেল লাজু, বলল—
“না দুক্ষু কিসে? এখানেই না আসলে দুক্ষু হতো! ওই বুড়ো মিনসেটার কাছে এতক্ষণে আমার মা-টো বিক্রি কইরা দিত! কী বলব তোকে সে কুথাখানা!”

“কি বলো গো! এত সুন্দর পুতুল মেয়েকে কেউ বিক্রি করে!”—জিজ্ঞেস করল লক্ষ্মী।
“হুঁ, পুতুল বিক্রি করলেই টাকা পেত না?”—বলেই লাফ দিয়ে খাট থেকে নামল লাজু।
“তুদের এই বাবুটা না থাকলে আজ আমি মরেই যেতাম রে! তোর এই পুতুলের সাথে দেখা হতো না রে! দেব কে চিনিস লয়?”—চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল লাজু।

লক্ষ্মী ওর হাবভাব দেখে চমকে গেছে—এসে থেকেই এতটা শান্ত মুখে ছিল! এই ছটফটে মেয়েটার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না ও।

“সে আবার কে?”—জিজ্ঞেস করল লক্ষ্মী।

“টিভিতে দেখিসনি? ঢিসুম ঢুসুম মেরে কোয়েল দিদিকে কেমন বদমাশদের থেকে বাঁচায়!”—বলেই দুই হাত দিয়ে মারার ভঙ্গি করল লাজু, যেন লাজবন্তী সোড়েল! খুব শখ করে মেয়ের নামটা রেখেছিল মালতি—লাজুর মা! তারপর কোথায় সে! পাঁচ বছরের মেয়েকে রেখেই মারা গেল, আর সেই সূত্র ধরেই নতুন মা পেয়েছে লাজবন্তী!

লাজুর অঙ্গভঙ্গি দেখে হেসে লুটোপুটি লক্ষ্মী।
“তোদের বাড়ির ছিলেখান একদম দেবের মতন! কী মারপিট! উফ! যখন ওই বুড়ো মিনসে আমায় সিঁদুর দিতে যাচ্ছিল, অমনি বাবু আমায় মা কালির সিঁদুরটো নিয়ে পড়ি ঠাক দিলো! জানিস, আমিও আরও জোরে চিৎকারটা করলাম!”—বলেই খিলখিল করে হেসে চলেছে লাজু। চোখেমুখে দুষ্টুমি, আর ওর অঙ্গভঙ্গি করে বলা কথাগুলোতে লক্ষ্মী হাসতে হাসতে থমকে গেল!
এইগুলো গিন্নিমা শুনলেই বিপদ—আবার রেগে যাবে! লক্ষ্মীকেও বকবে! তাই ধমক দিয়ে বলল—
“আচ্ছা হয়েছে, এবার থামো দেখি! শান্ত হয়ে খাটে বসো, আমি ঘরটা মুছে দি।”

লাজু পা গুটিয়ে বসল ঠিকই, কিন্তু আবার বলল—
“এখানটায় সব ভালো, কিন্তু সুকালে তোরা চা খাস না, এটা খারাপ!”
লক্ষ্মী বুঝল যে মেয়েটার চা ছাড়া চলে না। আজ এক সপ্তাহ হতে চলল মেয়েটা এসেছে, এই প্রথম এত কথা হলো লক্ষ্মীর সাথে! লক্ষ্মীর এখন খারাপ লাগছে না—ও সারাদিন এই বাড়িতে সব কাজকর্ম করে, কিন্তু কথা বলার লোক নেই। আগে গিন্নিমা তাও দুটো কথা বলত, কিন্তু এই মেয়ে আসার পর সেই যে কথা বন্ধ করেছে!

এই বাড়িতে চা না খাওয়া হলেও চা, দুধ সব ব্যবস্থাই আছে। গিন্নিমা অনেকবার বলেছে—
“লক্ষ্মী, তুই চা করে খা!”
কিন্তু চা জিনিসটা একার জন্য করতে ইচ্ছে হয় না। আজ থেকে এই মেয়ের জন্য নিজের হাতে চা বানাবে লক্ষ্মী —দুজনে মিলে বসে চা খাবে! ভেবেই কেমন ভালো লাগছে লক্ষ্মীর! হাত চালিয়ে ঘরটা মুছে ফেলল ও—বড্ড মায়াবী মেয়েটা! কেমন একটা টানছে ওকে!

“লক্ষ্মী, একবার এ ঘরে আয় তো!”—আজ অনেকদিন পর গিন্নিমা ডাকল ওকে। আজকাল খুব কম কথা বলেন উনি—কি রান্না হবে, এটুকু বলে নিজের কাজ সেরে আবার ঘরে। কর্তাবাবু যাও একটু বেরোয়! কী সব লোকসেবা-টেবা করে! গিন্নিমা তো এই জন্য আরও রেগে থাকে—কর্তাবাবুর জন্যই নাকি আজ অর্ক দাদা এসব করল! ছোট থেকে এই লোকজনের উপকার করতে নাকি কর্তাবাবুই শিখিয়েছেন! আর সেটা করতে গিয়েই যত বিপদ!

একটা মেয়ে আসে এই বাড়িতে, লক্ষ্মী দেখেছে দুই একবার—ছোট ছোট জামা পরে, ধিঙ্গি মেয়ের এমনধারা জামা বিচ্ছিরি লাগে! যেভাবে অর্ক দাদার সাথে কথা বলে, লক্ষ্মী ভেবেছিল ওকেই বিয়ে করবে বোধহয় অর্ক দাদা। ওই মেয়ে এই বাড়ি ঢুকলে লক্ষ্মীর ছুটি হয়ে যেত—কোথায় যেত, ভগবান জানে! তার থেকে এই নতুন মেয়েটাই ভালো। সারাদিন “লক্ষ্মী দিদি” করে! এই মেয়ে ঢের ভালো দেখতে ওটার চেয়ে! চায়ের দুধ উথলে উঠছে! এবার পাতা গুলো দেবে! হঠাৎই—

“লক্ষ্মী!”—খুব জোরে চিৎকার করে ডেকে উঠলেন গিন্নিমা।
এনার যথেষ্ট ডাঁট আছে, তাই একটু ভয়েই থাকে ও। তাড়াতাড়ি পড়িমরি করে ছুটল রান্নাঘর থেকে। পানটা সবে সেজে মুখে নিতেই লক্ষ্মী দরজার সামনে।

“কোথায় ছিলি তুই দোতলার ঘরে? আজকাল তো ওই ঘর ছেড়ে নামিস না! তা তোদের চায়ের আসর কেমন চলছে?”

“মানে গিন্নিমা… বলছি… মানে…”—আমতা আমতা করে ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করতে থাকল লক্ষ্মী।
চা খাওয়া শুরু করার আগে ও অনুমতি নিয়েছিল বৈকি, কিন্তু সেটা শুধু নিজের জন্য! আর তাই জন্যই লক্ষ্মীর কাপ চা বানায়, আর আধা করে খায় দুজনে! লক্ষ্মী গরিব হতে পারে, কিন্তু লোভী নয়! মনে মনে এসব ভাবলে মানসিক জোর বেড়ে যায়। একটু স্বতন্ত্র হয়ে বলল—
“গিন্নিমা, চা এক কাপই করি।”

কথাগুলো বলার সময় এতটা গলার জোরে বলল যে গিন্নিমাও থমকালেন।

“হয়েছে! আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাবুর ঘরে যা! ওর ঘরটা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে দে। আমার এই ঘর থেকে বেরোতে ইচ্ছে করে না। আজকাল তো শুনি, পুরো ওপর জুড়ে ঘুরে বেড়ায়! ওকে নিচে নামতে মানা করবি—কখনো সামনে এলে ওরই সম্মান যাবে! আর এটাও বলে দিস—ওর ব্যবস্থা আমি ঠিক করব!”

চোখেমুখে যেন রাগ ঠিকরে বেরোচ্ছে। লক্ষ্মী মনেমনে কিছু আঁচ করতে পেরে শিউরে উঠল যেন। এই কদিনে মেয়েটা বড্ড কাছের হয়ে গেছে লক্ষ্মীর। কতবার বলেছে মুখপুড়িকে—
“যা, মাঝে মাঝে অর্ক দাদার চোখের সামনে যা, রাতের দিকে প্রায় ছাদে যায়, তুইও যা—কে দেখতে যাচ্ছে রাতে!”
কিন্তু সে শুনলে তবে না! বোঝ এবার!

লক্ষ্মী বেরোনোর আগে জিজ্ঞেস করল—
“গিন্নিমা, অর্ক দাদার কোন ঘরটা পরিষ্কার করব? নিচেরটা না ওপরের?”

লক্ষ্মীর মুখে এরকম প্রশ্ন শুনে যথেষ্ট বিরক্ত রায় গিন্নি, বললেন—
“ওই মেয়ে যতদিন না বেরোচ্ছে, অর্কর ঘর নিচেরটাই। আর শোন, ভালো করে ধুলো ঝাড়িস—আজ মোহর আসবে।”

কথাগুলো বলার সময় বেশ খুশি লাগল রায় গিন্নির মুখখানি। অথচ লক্ষ্মী ঠিক জানে, এই মোহরকে গিন্নিমা একদম পছন্দ করে না। ওর পোশাক, চালচলনে যথেষ্ট রেগে থাকতেন। নিজেই লক্ষ্মীর সামনে একবার বলেছিলেন সে কথা। অথচ আজ দেখো—একেই মনে হয় বলে “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা”!

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লক্ষ্মী।

চলবে…