শুভমুহূর্ত পর্ব-২+৩

0
21

#শুভমুহুর্ত (দ্বিতীয় পর্ব ও তৃতীয় পর্ব)
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা

Feminine Wisdom

গ্যাসে চায়ের জল বসিয়েই লক্ষ্মীর মনে পড়লো আজ কজন আসবে তারা কি খাবে কি বানাতে হবে সেসব তো কিছুই বললো না গিন্নিমা ! গ্যাসটা কমিয়ে সোজা চললো সুমিত্রার ঘরে। ঢোকার মুখেই শুনতে পেলো সুমিত্রা বলছে রঞ্জনকে – “আজ মোহরের বাবা মা কে বলে ডেটটা ফাইনাল করে নেবে। আর তোমার এন জি ও তে ঘোষ বাবুর মিসেস একমাস আগে ফোনে বলছিলো লক্ষ্মীর মত সবসময়ের কাজের লোকের কথা ! এই জঞ্জালটাকে আমি ওখানে ব্যবস্থা করছি।” এটুকু বলেই চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফেলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো সুমিত্রা ! মনে যে কি ঝড় চলছে সেটা লক্ষ্মী পর্দার আড়াল থেকে বেশ বুঝতে পারছে ! কি দরকার ছিল অর্কর ওরকম হিরো সাজার ! থাকতো ওই লাজু ওর গ্রামে ! বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে করতো নাকি পালাতো সেটা ও বুঝতো ! আজকে সবার এতো হেনস্থা তো হতে হতো না ! লক্ষ্মী এসবই ভেবে চলেছে !

“আর মোহরকে সব জানিয়েছে বাবু কিন্তু মেয়েটা নাকি বলেছে কাকে কি সিঁদুর পড়ালো তাতেই যে কেউ বউ হয়ে গেল এসব ও বা ওর বাবা মা মানে না। মেয়েটাকে এতদিন ভালো লাগতো না বুঝলে ! আজ বুঝছি মেয়েটা যথেষ্ট বড় মনের রুচিশীল সব থেকে বড় কথা শিক্ষিত ! ওরকম গাঁইয়া নয়!” – ওরকম গাঁইয়া মানে ! সুমিত্রা কি ওই লাজুকে টেনে নিয়ে বললো ! কোথায় লাজু আর কোথায় মোহর ! এই তুলনার মানে টা কি ! আর লক্ষ্মী তো জানে এই মোহরকে একদম পছন্দ করতো না সুমিত্রা ! ওর সাজ , পোশাক , কথা বলার ধরণ , বাড়িতে ঢুকে অর্ককে নিয়ে সোজা ঘরে চলে যাওয়া এই বিষয়গুলোই অপছন্দের ছিল ! কম কথা কাটাকাটি হতো মা আর ছেলের ! আজ সেই মেয়েই রুচিশীল হয়ে গেলো ! লক্ষ্মী এটাই ভাবছে দাঁড়িয়ে !

” কী এক সমাজসেবার পাল্লায় পড়েছে! সারাটা জীবন আমার শেষ করে দিলো! আগে তুমি এখন ছেলে! কথা নেই বার্তা নেই সোজা সিঁদুর! এতো সস্তা সব কিছু!” – বলেই যাচ্ছে সুমিত্রা! আর ভাস্কর মাথা নিচু করে পেপারের দিকে তাকিয়ে আছে।

কথাগুলো বলতেই সুমিত্রার নজরে পড়লো লক্ষ্মীর দিকে! দরজার পিছনে দাঁড়ানো! কথা থামিয়ে বললো “কিছু বলবি?”
” গিন্নিমা আজ যারা আসবে তাদের কি খাওয়ানো হবে?” – লক্ষ্মী একটু ঘাবড়িয়ে গিয়ে বললো। ঘাবড়ানোর কারণ ওদের ঘরের কথা শুনে ফেলা! আগে হলে অসুবিধা হতো না কিন্তু এখন হচ্ছে! কারণ ওই মেয়ে আসার পর থেকে ভালোভাবে কথা বলছে না সুমিত্রা!

“না না ঘরের রান্না মোহর একদম পছন্দ করে না, তাই বাবু নিজেই ওদের পছন্দের খাবার অর্ডার দিয়ে আনবে ! বাবুও ওদের সাথেই রাতে খাবে! আমাদের চারজনের জন্য রাতের রুটি তরকারি করবি। ” নির্দেশটুকু ছুঁড়ে দিয়েই আবার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় মজে গেলেন কর্তা গিন্নি। লক্ষ্মী ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকলো।

চা করতে করতে বড্ড আনমনা হয়ে গেল লক্ষ্মী।যখন ওর স্বামী মারা গেল বাড়িতে ভাসুর জায়ের অত্যাচার আর নিতে পারছিলো না । তখন এই কর্তাবাবু গেছিলো ওদের গ্রামে ডেঙ্গুর ওষুধ দিতে। সেই ওষুধ আনতে গিয়েই এদেরকে একটা কাজের কথা বলেছিলো ও। তখন কর্তাবাবু আলাদা করে নিয়ে বলেছিলো – “শোনো আমার বাড়িতে আমি, আমার বউ আর আমার ছেলে থাকি। আমার বউয়ের বড্ড সুগার। মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন ওকে সাথে সাথে ওষুধ দিতে হয়। আমি তো কাজে এখানে ওখানে যাই। ছেলেটাও অফিসে যায়। ওর জন্য একজন সবসময়য়ের লোক লাগবে। খাওয়া, পড়া ছাড়াও মাইনা দেবো।”

কী মাইনে, কত দেবে লক্ষ্মী আর কিছু না শুনেই পায়ে পড়ে গেছিলো ভাস্করের । বলেছিলো “পারবো খুব পারবো, আমাকে একটু থাকতে দিন!” সেই থেকে আজ তিন বছর এভাবেই চলছে। তখনও প্রথম প্রথম সুমিত্রা রাগ করতো! লক্ষ্মীকে সহ্য করতে পারতো না! লক্ষ্মী যতই ওর লোক হোক আসলে ভাস্কর যে সমাজ সেবা করতে গিয়ে নিয়ে এসেছে! এটাই সহ্য হয়নি! কিন্তু এখন লক্ষ্মী ছাড়া চলতে পারেনা সুমিত্রা!

তবে খাওয়া পরা নিয়ে কখনো কিছু বলতে হয়নি।এরা মানুষ ভালো, আজও সুমিত্রা রাতের রান্নার কথা বলতে গিয়ে চারজনের কথাই বললো। এটুকু এদের সহবত জ্ঞান যে খাবারটা ঠিক সময় সময় লাজুর ঘরে পৌঁছানোর অনুমতি দিয়েছে!

চা টা হয়ে যেতেই ছেঁকে নিয়ে সোজা চলে গেল ওপরের গেস্ট রুমে যেখানে লাজু থাকে। এই সময়টা খুব প্রিয় লক্ষ্মীর! পুরো বাড়িতে ঐটুকুতেই যা প্রাণ আছে! দরজা খুলে ঢুকতেই দেখলো লক্ষ্মী মেয়েটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছে। একমাথা কোঁকড়ানো চুল গোল পানপাতার মত মুখ তাতে ডাগর ডাগর চোখ।

ইস গিন্নি মা যদি একবার মুখটা দেখতো ভালো করে ! লাজু লক্ষ্মীকে খেয়াল করে বললো “এই লুকখি দিদি দিক দিকিনি আমার সিঁথি পানে দিক ইকবার। সিন্দুর টা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে। আমাকি একটু সিন্দুর ইনি দি দিকিনি। আমি মায়ের পা থিকে একটু খানি ইনে ছিলেম।” বলেই যাচ্ছে লাজু!

মনে হচ্ছে লক্ষ্মীর -ওকে বলে আর তোর সিঁদুরের দরকার নেই রে মুখপুড়ি। যার জন্য সিঁদুর পরবি তার কাছে আর তোর সিঁদুরের কোনো দাম নেই । নিচে সে যাতে নতুন সিঁদুর পরাতে পারে তার পরিকল্পনা চলছে! ”

লক্ষ্মীর খুব ইচ্ছে করে একবার অর্ক দাদাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে খেয়াল বসে লোক দেখিয়ে যে মেয়েটাকে সিঁদুর পড়ালে এর আজ কি হবে? ” মেয়েটার মায়া ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ্মী!

” লুকখি দিদি দে রে চা খানা,” বলেই লক্ষ্মীর হাত থেকে সিঁদুরের কৌটোটা টেনে টেবিলের ওপর রাখলো! ” জানিস ই সমতে আমরা কুত্ত খিলতাম – ইক্কা দুক্কা, কিত্ কিত্, ” এটুকু বলেই হাঁটুর ওপর শাড়িখানা তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা দোক্কা খেলতে শুরু করে দিলো লাজু। লক্ষ্মী মেয়ের কাণ্ডে হেসে যাচ্ছে খিলখিল করে । এমন খেলার চোট আরেকটু হলে শাড়ি, পায়ে বেজে পড়তো।

লক্ষ্মী চেঁচিয়ে বললো “কতবার বলেছি শাড়ি না পরে ম্যাক্সি গুলো পরো, ” নিজের কাছে থাকা নতুন দুটো দিয়েওছিল। মেয়ের সে কি হাসি ম্যাক্সি দেখে। আগে হাঁটু অবধি শাড়ি পড়তো ব্লাউজ ছাড়া। গিন্নি মাকে বলে দুটো লাল শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, ভেতরের জামা সব আনিয়ে দিয়েছে লক্ষ্মী।

“এই লুকখি দিদি ইকটা কুথা বল ইটা কুলকাত্তা তো!” লাজুর কথায় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো লক্ষ্মী। “এই সামনি তো দুর্গাপুজো, প্যাকলা বলেছিল বটে কি ইয়া বুরো ঠাকুর টো হয়ে নাকি ইখেনে। লিয়ে যাবি দেখতে!”- ওর কথাগুলো একদম বাচ্চাদের মত। লক্ষ্মীর মনে হয় সারাদিন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শোনে।লক্ষ্মীর যদি ঠিকঠাক সব হোতো আজ ওর তো একটা সন্তান থাকতো। লাজুর মত এতো বড় না হলেও থাকতো। এই মেয়েকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলে দিলে লক্ষ্মী বড্ড কষ্ট পাবে। তার থেকে যদি এমন হয় ওর এই তিনবছরের কোনো টাকাই নেয়নি সব জমাচ্ছে গিন্নিমা, সেটা তুলে নিয়ে যদি ওকে নিয়ে লক্ষ্মী বেরিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকে আর একটা ছোটো দোকান খুলে নেয় ! তিন বছরের কম টাকা তো হয়নি! ওই দিয়ে দুটো পেট ঠিক চলে যাবে!

অর্ক দাদার বিয়ে হয়ে গেলে এমনিতেই ওই বউ আমায় রাখবে না, তার থেকে এটাই ভালো। কাল পরশু একবার গিন্নিমার সাথে আলোচনা করতে হবে।- মনে মনে ঠিক করে নিলো লক্ষ্মী! আজ রাতেই একবার কথা বলবে!

“এই লুকখি দিদি বল না দিখাবি মা দুগ্গা কে!” জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো লাজু । লক্ষ্মী হুমম বলতেই শুনলো কলিং বেলের আওয়াজ। কে এসেছে বুঝেই উঠে বেরিয়ে গেল লক্ষ্মী আর বলে দিলো লাজুকে “তুমি এখানেই থাকো আমি একটু পরে এসে মুড়ি দিয়ে যাব!” ওর উত্তর না শুনেই তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেল লক্ষ্মী।

লক্ষ্মী আজ খুব সজাগ সারাদিন, কি কথা হচ্ছে জানাটা খুব দরকার। লাজুকে কিছুতেই হারাতে পারবে না ও। সবাই আজ নিচে অর্কের ঘরেই বসেছে। মোহর আজ একটা ব্ল্যাক কালারের শিফন পরেছে গোল্ডেন ব্লাউজ দিয়ে। চুলটাও সুন্দর করে বাঁধা। ঘরে কোল্ডড্রিঙ্কস আর চিকেন নাগেট নিয়ে ঢুকলো লক্ষ্মী।

শুনতে পেলো মোহর বলছে “আন্টি আমাকে অর্ক সেদিন ফোন করেছিল, বললো একটা মেয়েকে সাংঘাতিক হ্যারাস করা হচ্ছে, অর্ক বাঁচাতে গেছে গ্রামের লোকেরা বলছে এরা কলকাতার লোক, ওদের গ্রামের মেয়েকে নিয়ে বেচে দেবে ! তখন আমি ফোনে। শুনছি মেয়েটার কান্নার আওয়াজ। ওরা আরও বলছে সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে যাক ক্ষমতা থাকলে ! জানো একজন বললো বেঁধে রাখ বেটাকে দেখি কি করে যেতে পারে, যেমন ওদের ভাষা তেমন গলার জোর।

খুব ভয় পেয়ে আমি বললাম অর্ককে পরিয়ে দে সিঁদুর। একটু লাল রঙের জন্য ও তোর বউ হয়ে যাবে না বা আমি তোর মন থেকে চলে যাব না, বিশ্বাস করো আন্টি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম সেদিন !”

মেয়ের কথা শুনে মোহরের মা আর অর্কর মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আসলে ওনাদের অবধিও সিঁদুরের দাম ছিল। এবার মোহরের বাবা সব থেকে দামি প্রশ্নটা করেই ফেললো -“কি ভাবলেন মেয়েটাকে নিয়ে!” দরজার পাশের ঠায় দাঁড়িয়ে আজ লক্ষ্মী , কানদুটো আরও সজাগ করলো।
আজ সব প্রশ্ন উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব রায় গিন্নি মানে সুমিত্রার ওপর পড়েছে। বললো “কি আবার করবো, ওর এন জি ও এর কোনো কাজে লাগাতে হবে। যাতে খেয়ে পরে কিছু টাকা পায় হাতে। একটা মেয়েকে তো হেলায় ফেলতে পারিনা। এসে যখন পড়েছে! কথা হয়েছে দুই একজনের সাথে, ওদের বিয়ের আগেই ব্যবস্থা করবো !”

কথা শেষ না হতেই মুখ খুললো মোহর “আরে আন্টি ও এখানে থাকলেই বা কি!অর্কর অফিস থেকে সুইডেন যাওয়ার অফার এসেছে, আমরা বিয়ের পর ওখানে চলে যাব, আপাতত তিন বছর তারপর এক্সটেন্ড করতে পারে !” মোহরের সাবলীল ভাবে বলা কথা গুলোতে জোর ধাক্কা খেলো রায় গিন্নি, সাথে অর্কও। অর্ক ভেবেছিলো কথাগুলো ধীরেসুস্থে বাবা মাকে বলবে !

মোহর যে কি করে! লক্ষ্মী বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝলো কর্তাবাবুর শেষ কথা যেমন গিন্নিমা বলে অর্ক দাদার শেষ কথাও বলবে এই মেয়ে ! কার জিত এটাই দেখার ! সুমিত্রা অবাক হওয়াটাকে মুখের পিছনে লুকিয়ে রেখে বললো “সে তিন বছর আর চার বছরের জন্যই যাও, ফিরে তো আসবে ! ততদিনে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই আগের কাজ আগে করাই ভালো।”

মায়ের বলা কথায় খানিকটা শান্তি পেলো অর্ক! ভাবছিলো এই বুঝি তর্ক শুরু হয়! মোহরের বাবা মা দুজনেই খুশী সুমিত্রার সিদ্ধান্তে । মোহর বলে উঠলো “আমার মনে হয় না ওই লাইফস্টাইল কাটিয়ে আমরা আবার এই কলকাতায় ফিরে আসবো !”

মোহরের মা মহিলা অতটাও জটিল নয়, সবটা বুঝতে পেরে বললো “আচ্ছা সে হবেখন! মেয়েটাকে একটু দেখা যাবে?” উনি পরিস্থিতিটা হালকা করতে গিয়ে আরও জটিল করে ফেললেন নিজের অজান্তেই। ভাস্কর বলে উঠলো – “নিয়ে এলেই হয় একবার, আমাদের সাথেও খুব একটা আলাপ নেই!”

একটু আগে সুমিত্রা যা ধাক্কা খেয়েছে ওনার মুখ থেকে আর কথা বেরোচ্ছে না। ঘরে আর কেউ না করলো না দেখে লক্ষ্মীকে ডাকলো ভাস্কর । “লক্ষ্মী যা তো মেয়েটাকে একবার নিয়ে আয়। ” লক্ষ্মী মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে এলো, আজ বড্ড খুশী ও এই সুযোগে একবার গিন্নিমার সামনে আনা যাবে। কিছু একটা ভাবলো লক্ষ্মী তারপর সরাসরি ঢুকলো সুমিত্রার শোয়ার ঘরে!
সিঁদুরের কৌটো থেকে কিছুটা একটা ঠোঙায় ঢেলে নিলো তারপর সোজা ওপরে।

চলবে।