শুভমুহূর্ত পর্ব-০৪

0
26

#শুভমুহূর্ত (চতুর্থ পর্ব)
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
Feminine Wisdom

আগের বার মেলা থেকে কেনা সোনালী হার আর কানের দুলটা সাথে একটা লাল নতুন শাড়ি পরিয়ে লাজুকে একদম নতুন বৌয়ের মত সাজিয়েছে লক্ষ্মী, নিজের সামর্থ্যতে যতটা কুলিয়েছে আর কী! কোনো আশা নেই! শুধু গিন্নিমার নজরে পড়ুক! সেই যে মেয়েটা প্রথম দিন ঢোকার সময় দেখেছিলো! আর একবারও তাকায় নি সুমিত্রা!

লাজুর চুলটা ঠিক করে ওকে নিয়ে নিচে নেমে এলো লক্ষ্মী! লক্ষ্মী নিশ্চিত আজ সুমিত্রা চোখ ফেরাতে পারবে না।আসলে মোহরের সাজ পোশাক সুমিত্রার একদম পছন্দ নয়, লক্ষ্মী সেটা ওঁর কথাবার্তায় অনেক বুঝেছে! তাই তো আজ লাজুকে সাজানোর এতো আয়োজন!

সুমিত্রার এঁকে ভালো লাগবে বেশ জানে লক্ষ্মী। আর মোহরের থেকে এই মেয়ে অনেক সুন্দরী, লক্ষ্মীমন্ত সংসার আঁকড়ে ধরতে জানে! লাজুকে নিয়ে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে লক্ষ্মী দেখলো সবাই কথা থামিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। লক্ষ্মীর নজর শুধুই সুমিত্রার দিকে। লক্ষ্মী যা ভেবেছিল ঠিক তাই – চোখেমুখে মুগ্ধতা ! পুরো ঘর যেন চুপ!

নিস্তব্ধতা ভাঙলো মোহরের মা শুভ্রা -“এমন মেয়েকে কেউ বিক্রি করে ! কি মায়াভরা মুখ! ” ওঁর মুখে এমন কথা শুনে যেন আরও আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল লক্ষ্মীর! যতই হোক প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রশংসা কিন্তু বড় পাওনা!

লক্ষ্মী এবার ভয়ে ভয়েই অর্কর দিকে তাকালো! একটু ভয়ে ভয়েই তাকিয়ে আছে লাজুর দিকে। দৃষ্টিটা বোঝার চেষ্টা করলো লক্ষ্মী! ” তা তোমার সাথে কি হয়েছিল!” অতুল মানে মোহরের বাবা জিজ্ঞেস করলেন! আরেকবার যাচাই করতে চাইছেন বোধহয়!

মিনমিন করে বলা শুরু করলো লাজু “আমার লিজের মাটো মারা গেছলো, বাবাটা আরেকখান বিয়ে করি আসতেই লতুন মা টো আমাক পছন্দকটা করতোক লা। আর বাবা এই নুতন মাটোকের কথা খানা শুনতো। বিয়ার নামটা করি আমাকে এক বুড়ার কাছটাতে বিক্রিটো করে দিচ্ছিল। আমি চেঁচামেচি করতি এই বাবু এসি আমায় বাঁচালো । ”

অতুল দেখলেন মাথায় সিঁদুর পড়ানোর কথাটা বললো না মেয়েটা, মানে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। একটু যেন ভালো লাগলো ওনার, মায়াও হচ্ছে! “সত্যি নিজের মেয়ের সাথে কিভাবে করে এইসব! মনুষ্যত্বটুকু নেই ছি ছি ” – একজন মেয়ের বাবা হিসেবে খুব রাগ দেখা গেলো অতুলের চোখে মুখে! এটাই তো হওয়ার কথা! যতই হোক মেয়ে তো ওঁরও আছে!

এবার মোহর চিকেন নাগেটসের প্লেটটা এনে লাজুর সামনে ধরলো কিন্তু লাজু নিলো না। মাথা নাড়িয়ে বললো ” তুই খা কিনে! আমি খবুক লাই!”
সুমিত্রার মনে মনে মেয়েটিকে খারাপ লাগলো না , সহবৎ জ্ঞান আছে, দেখতেও বেশ মিষ্টি শুধু মুখ খুললেই মুশকিল। মুখটা বন্ধ রাখলে তাও যেন মানিয়ে নেওয়া যায়!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “আচ্ছা তুমি যাও এখন, লক্ষ্মী ওকে নিয়ে যা, আর ডিনারের ব্যবস্থা কর। রাত হোলো অনেকখানি। ওনারাও যাবেন অনেক দূর ” বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো সুমিত্রা। তারপর অতুলের দিকে তাকিয়ে বললো – “আপনারা বসুন আমি বরং একটু গিয়ে শুই।”- অর্ক ব্যস্ত হয়ে বললো “কেন গো শরীর খারাপ লাগছে ?” না শোনার ভান করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সুমিত্রা!

মনের মধ্যে আজ জোর লড়াই চলছে ওঁর। বিয়ের আগেই বাবুর এতো পরিবর্তন, সুইডেন যাবে! সেই কথা টুকু পর্যন্ত জানায়নি! অথচ প্ল্যান প্রোগ্রাম সব সারা! ওরা যে নাও ফিরতে পারে সেটাও পরিষ্কার জানিয়ে দিলো মোহর!

বাবুর সাথে আর সম্পর্ক থাকবে না বুঝে গেল সুমিত্রা। এতো বড় বাড়ি, এতো স্বপ্ন , নাতি নাতনির মুখ এসব আর হবে না, যাক গে আর কতদিনই বা বাঁচবে ! অতো আশা না করাই ভালো। শাড়িটা ছেড়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে আলোটা নিবিয়ে চোখ বন্ধ করলো সুমিত্রা।চোখ বন্ধ করা থেকেই বারবার চোখের সামনে মেয়েটার মুখ মনে পড়ছে !এরকমই একটা মুখই তো বউ হিসেবে চেয়েছিলো ও।

আচ্ছা একে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া যায় না !ভেবেই নিজেকে নিজে ধমক দিল সুমিত্রা। তা কি করে সম্ভব!এই মোহর যেভাবে বাবুকে বেঁধে রেখেছে কোনোভাবেই সম্ভব নয় ! তার চেয়ে এই মেয়ের অন্য ব্যবস্থা হোক, ভালোভাবে বাঁচুক। আগের জীবনটাও বেচারির বড্ড দুঃখের! নিজের বাবা মা যার ভালো না তার আর কী ভালো রইলো! সন্তান খারাপ মেনে নেওয়া যায় তাই বলে বাবা মা!

কেন যে এতো ভাবছে ওই মেয়ের জন্য সুমিত্রা নিজেই
জানে না! নিজের ছেলেই আজ পর হয়ে গেছে, আর ওই মেয়ে, আর মায়া নয় !এবার আসতে আসতে সব মায়া কাটানোর সময় হয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই চোখদুটো ভিজে গেল সুমিত্রার, শুধু মনে মনে বললো “ঠাকুর আমার ছেলেটাকে রক্ষা করো। বড্ড সরল ও, দেখো ওকে !” এই হয়তো মায়ের মন সন্তানের দোষগুলো ওদের সরলতা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা।

” গিন্নিমা!” – লক্ষ্মী রাতের খাবার নিয়ে এসে আলোটা জ্বালিয়ে দিলো ঘরের! “গিন্নিমা খাবার এনেছি!” আবার বললো লক্ষ্মী! দেখলো কেমন গুটিয়ে শুয়ে আছেন!

“ওদের দিয়েছিস খেতে “- বলতে বলতে উঠে বসলো সুমিত্রা। চোখমুখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে কান্নাকাটি বেশ খানিকক্ষণ চলেছে। লক্ষ্মীর খুব খারাপ লাগলো, বললো “তুমি খাও, অনেক রাত হোলো, তোমার ওষুধ আছে আর ওদের দেখার জন্য অর্কদাদা আর কর্তা বাবু আছে। আর না করলো না সুমিত্রা! দুধ রুটির বাটিটা টেনে নিয়ে খেতে বসলো।

লক্ষ্মী দেখলো বৃষ্টির পর নরম মাটিতে চাষ করা সোজা , কাল রোদে আবার তেতে ওঠার আগেই লক্ষ্মী বললো- ” গিন্নি মা আমি একটা কথা বলবো? ” খেতে খেতে সুমিত্রা বললো – “বল ” লক্ষ্মী আর সময় নষ্ট করলো না! বলতে শুরু করলো “বলছি এই ক বছরে আমার যে টাকাটা জমেছে আমাকে দেবে? ” খাওয়াটা থামিয়ে অবাক চোখে তাকালো সুমিত্রা! “কি করবি? ” এতো সরাসরি প্রশ্ন হয়তো করেই নিজের কানেই লাগলো, ওর পাওনা টাকা ও নেবে এতে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হলোনা বোধহয় তাই আবার বললেন ” মানে তোর কিসে লাগবে বল আমায়, সেরকম হলে আমার থেকে নে, ভবিষ্যত সঞ্চয়ে হাত দিবি কেন?

” লক্ষ্মী সুযোগ হাতছাড়া না করে বললো “গিন্নি মা অর্ক দাদার বিয়ে হয়ে গেলে তো দিদিমণি চলে আসবে তখন আমার আর দরকার হবেনা। আমি বরং এই মেয়েকে নিয়ে একটা ছোটোখাটো দোকান খুলে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবো!” এইটুকু বলেই সুমিত্রার পায়ে এসে পড়ে বললো -” মা গো- মেয়েটা বড্ড মায়াবী ! ওকে একা ছেড়ে দিতে আমি পারবো না মা, শেয়াল কুকুর ছিঁড়ে খাবে!”

রায় গিন্নি রুটিটা মুখে ঢোকাতে গিয়েও থমকে তাকিয়ে আছে লক্ষ্মীর দিকে, বললো “তুইও চলে যাবি আমায় ছেড়ে ! যা তাহলে ! আর কি !চলে যা !” বলেই হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে ওরকম দাপুটে রায় গিন্নি। লক্ষ্মীও আর থাকতে না পেরে কেঁদে ফেললো। “শান্ত হও গিন্নি মা শান্ত হও। আমি যাব না তোমাকে ছেড়ে যাব না!” মাথায় হাত বুলিয়ে বললো লক্ষ্মী। সব হারিয়ে লক্ষ্মীও যে ভালোবাসার কাঙাল। কি করে উপেক্ষা করবে এত্ত ভালোবাসা !

সবাই চলে যেতে প্লেটে খাবার সাজিয়ে চললো ওপরে লক্ষ্মী। ওদের জন্য আনা মাংস একটু বাঁচিয়ে রেখেছিলো লাজুর জন্য। কেন যে এসব করে লক্ষ্মী নিজেও জানে না। ঘরে ঢুকতেই দেখলো মেয়েটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। লক্ষ্মীকে দেখেই বললো “দেক কেনে আজ আকাশ খানা কি সুন্দর। আর চান্দ টাও কুত্ত বরোটা আছেক। জানিস লুকখি দিদি আমাদের গ্রামটাতে আকাশ খানা আরও সুন্দর। ” লক্ষ্মী বুঝলো মেয়ের মন ভালো নেই আজ । “গ্রামের কথা মনে পড়ছে?” – লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করলো ” তোমার মা যখন বিয়ে দিচ্ছিলো তখন তোমার বাবা কিছু বলেনি?”

“কি বোলবেক বল দিকি !ওর তাড়ি খাউয়ার টাকা খানা তো ওই নুতন মা টাই দিচ্ছিলক। আমাকি বিক্রি করি অনেকগুলা টাকা নিয়াছিল।” মেয়েটা দিনদিন মায়ায় ফেলে দিচ্ছে লক্ষ্মীকে, লক্ষ্মীরাও গরিব ছিল কিন্তু এরকম পরিবার ওদের একদমই না। ওর বর ভাসুরের একসাথে বড় মুদি খানা ছিল। হঠাৎ লক্ষ্মীকে চমকে প্রশ্ন করলো লাজু

“ওই ঘরে সুন্দর মত মাইয়াটা কে ছিল রে? ” লক্ষ্মী জানতো এই প্রশ্নের সামনে ওকেই পড়তে হবে। কথাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললো ” কে সুন্দর? ওই মেয়ে? তার থেকে ঢের সুন্দর তুমি বুঝলে? ” বলেই পুতুল পুতুল গালদুটি টিপে দিলো লক্ষ্মী। হেসে রুটিটা ছিঁড়ে মুখে দিয়ে আবার বললো লাজু “আমি জানি রে উও মাইয়াটার লগে দাদাবাবুটার বিয়াটো হবেক, তাই না বল? ” লক্ষ্মী সুযোগটা কিছুতেই হাত ছাড়া করলো না, বলে ফেললো “ঠিক বলেছো, এই বিয়েটা আগেই ঠিক হয়ে ছিল, তোমায় তাও যে কেন বিয়ে করলো !” লক্ষ্মীর কথায় ও একটু অবাক হয়েই বললো “আমাকি বিয়েটো করবে কিনে !

এই লাল রঙটুক দিয়া আমাকে তো ঔ বাচাইলো !” এতদিনে তোর এই পুতুল মুরে জিতো রে !”
“আচ্ছা তাই যদি হয় তাহলে সকালে সিঁদুর চাইলে কেন?” প্রশ্নটা না করে পারলো না লক্ষ্মী। “কি করবো বল লুকখি দিদি, আমাদের গ্রাম টোতে না এই লাল রংটার অনেক দাম টো আছে! এই লাল রংটা আমি সারাজীবুন পুরব, তাতে ওই দাদাবাবু আমার থাক আর নাই থাক। আর বল তুই আমাকে কি মানায় উটোর পাশে। ওই মাইয়াটা বেশ । পুরা টিভির কোয়েল দিদি আর দেব দাদা।”- বলেই হাসতে শুরু করলো লাজু ।

লক্ষ্মী মনে মনে ভাবলো হায় রে বোকা মেয়ে এভাবে নিজের অধিকার হারালি ! বড্ড সরল তুই তাই এরা বেঁচে গেল, ভগবান মেয়েটাকে দেখো। বড্ড সরল। অর্ক দাদার কথাই ভাবো এনে থেকে একবারও খোঁজ নিলো না, কিছু লাগবে কিনা, ঠিক আছে কিনা! বড়লোকদের বোঝা বড় দায়! গিন্নিমার সাথে কথা বলে একে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে, যেতেই হবে! নাহলে ওই মোহর এসে সব তছনছ করে দেবে ! সেটা লক্ষ্মী কিছুতেই হতে দেবে না! বুকে আগলে রাখবে এই মেয়েকে!

চলবে।