#শুভমুহূর্ত (পঞ্চম পর্ব )
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
Feminine Wisdom
ভাস্কর দু কাপ চা নিয়ে এসে ঢুকলো! আজকাল বাড়িতে আবার চায়ের পর্ব চালু হয়েছে! জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দিলো ভাস্কর! সুমিত্রা যেমন চির রুগী ভাস্কর ঠিক ততটাই ফিট!
সকালে উঠছে, ফুল তুলছে, বাজার করছে, এন জি ওর কাজে এদিক ওদিক যাচ্ছে! বয়স যে এতখানি হলো কে বলবে! ” ওঠো সুমি চা টা খাও, দেখবে শরীরটা অনেক ঝরঝরে লাগবে!” বলেই জানলার পর্দা গুলো তুলে জানলা গুলো খুলে দিলো!
” বলছি বাবুর বিয়ে তো সামনের মাসেই ঠিক করে নিলে, কেনাকাটা, নিমন্ত্রণ, এতো কাজ কে করবে শুনি? ” ভাস্কর সামনের সোফাটায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো। ঘরে ঢুকে থেকেই কিছু না কিছু বলেই যাচ্ছে ভাস্কর! সুমিত্রা শুধুই নীরব শ্রোতা! আজকাল এমনিতেই খুব কম কথা বলে সুমিত্রা তারপর সকাল বিকেল বেলার জড়তা কাটতেই চায় না!
কিন্তু ভাস্কর এখন এমন একটা টপিক নিয়ে কথা বলছে যে চুপ থাকতে পারলো না সুমিত্রা! একটু রেগেই বললো – “সে নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না, তোমার ছেলের বউ ঠিক সে ব্যবস্থা করবে! কিভাবে বিয়ে হবে, কোথায় হবে! কত লোক আসবে, কারা আসবে না সব সারা ওদের! তোমার ছেলে প্রতিটা পা বৌয়ের কথায় ফেলে। বিয়ে করবে তারপর সুইডেন যাবে ওখান থেকে আর ফিরবে না সব ঠিক হয়ে গেছে। আমরা মা বাবা খালি জানিনা। ”
বলতে বলতে রাগখানা মুখে বেশ ফুটে উঠেছে সুমিত্রার! “তোমাকে অতো মাথা ঘামাতে হবে না! বাবার দায়িত্ব হিসেবে বাবুকে ধরে ক্যাশ টাকা দিয়ে দাও ,ও নিজের মত বৌকে নিয়ে গুছিয়ে করে নেবে। ছেলেকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। “একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দিল সুমিত্রা। মনে জমে থাকা রাগ যেন একেবারে বের করলো!
সারাদিন ভাস্কর যতই কথা বলুক সুমিত্রা বলতে শুরু করলে ও শুধুই শ্রোতা! তাও যেন দুঃখের সাথীকে নিরাশ না করে বললো -” আজকাল বাবু কথাই বলে না। অফিস থেকে এসে সেই যে ঘরে ঢোকে রাতে খাওয়ার সময়টুকুই দেখা হয় !” সুমিত্রা তাকালো ভাস্করের দিকে! ও বেশ কষ্ট পায় কিন্তু দেখানো হয়ে ওঠে না। আর দেখানোর সময় কোথায়! দুঃখ বিলাপ এইগুলোরও সময় লাগে কখনই বা দেখাবে নিজেও সারাদিন এন জি ও নিয়ে ব্যস্ত।
আজ অনেকদিন পর বিকেলে একটু বৌয়ের কাছে এসে বসেছে দুদন্ড। ভাস্কর একটু থেমে বললো- “আচ্ছা সুমিত্রা ওপরের মেয়েটার কি হবে গো? বড্ড মায়ায় ফেলে দিয়েছে এই কদিনে। সকালে আমার সাথে ছাদে গিয়ে ফুল তোলে, কত কথা মেয়ের! ওর ভাষাখানা শুনতে বেশ লাগে জানো !”
সুমিত্রা দেখলো ভাস্কর কেমন বাচ্চা ভেবে ওই মেয়ের নামে কথাগুলো বলছে! আজকাল ওই মেয়ের কথা শুনতে বেশ লাগে সুমিত্রার! ইচ্ছে করে ডেকে কথা বলে! কিন্তু না আশা দেখিয়ে লাভ নেই! কী দিতে পারবে সুমিত্রা ওই মেয়েকে!
” জানো সেদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের গ্রামে সকালে কি করতে? বলে কী জানো – শুকালে বেরিয়ে ফুল তুলতাম, গুরুগুলাকে তাড়া কুরতাম, পুতুলগুলার বিয়ার দিন খুব খাটুনি হুতো রে আবার জানো লাফিয়ে লাফিয়ে আমায় এক্কা দোক্কা খেলা শেখাচ্ছিল!” -ভাস্কর বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে প্রায়! আর সেই দেখাদেখি সুমিত্রাও আজ বহুদিন পর হাসলো দুজনে, বেশ ভালো সময় কাটছে আজ দুজনের।
একটা কিছু চিন্তা করে ভাস্কর জিজ্ঞেস করলেন “সুমি !মেয়েটা জানে বাবুর যে বিয়ে? ” সুমিত্রা বললো “জানে, লক্ষ্মী তো তাই বললো, মেয়েটা নাকি বলেছে বাবু ওকে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করেনি- বাঁচিয়েছে। ” শুনেই ভাস্কর বললো – ” আমি বলিনি তোমায় বলো যে এই মেয়ে খারাপ না। “খুব খুশি লাগছে আজ ভাস্কর কে!
চেয়ার ছেড়ে খাটে সুমিত্রার প্রায় গা ঘেঁষে এসে বসতে বসতে বললো ভাস্কর – “আজ মাথাটা বড্ড ধরেছে, যাক গে শোনো একটা প্ল্যান করেছি। তুমি অবশ্য রাজি না হলে করবো না। বলছি আমি রিটায়ারমেন্টে যা পেয়েছি সবই ধরা আছে। পেনশন দিয়ে দিব্বি তোমার আমার আর এই এন. জি. ও চলে যাচ্ছে । বলছি বাবুকে বিয়ে বাবদ যা দেবো দিলাম আরও কিছু এই বাড়ি বাবদ কিছু দিয়ে দি, মানে ভাগেরটা!
বাকি টাকার কিছুটা লক্ষ্মী আর কিছুটা লাজু আর তোমার নামে রেখেও কিছু টাকা থাকবে। তাই দিয়ে এই বাড়িটাতে একটা ওল্ডএজ হোম খুললে কেমন হয়? ঘোষ অনেকদিন ধরেই বলছে এতো বড় বাড়িটা মিস ইউজ করছিস। আসলে ওর মেয়ে সোসিওলজি নিয়ে পড়ছে। তাই এরকম কিছু করতে চায়, বিয়েও করবে না, আর ওকে হেল্প করার জন্য থাকলো আমাদের লক্ষ্মী আর লাজু। ”
কথা গুলো বলতে বলতেই মাথায় হাত দিয়ে হঠাৎ দাঁত মুখ খিচিয়ে বেঁকে শুয়ে পড়লো ভাস্কর। মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে! হাত পা কাঁপছে সুমিত্রার! কী করবে, কাকে ডাকবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না! এই সময় যেন আরও আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো!
“লক্ষ্মী এই লক্ষ্মী তাড়াতাড়ি আয় দেখ তোর কর্তাবাবু কেমন করছে।” সুমিত্রার ভয় ভয়ার্ত গলা শুনে তাড়াতাড়ি করে এসে হাজির হোলো লাজু আর লক্ষ্মী। ততক্ষণে দাঁতের ওপর দাঁত বসে গেছে ভাস্করের! লাজু পাশের টেবিলে রাখা একটা চামচ ঢুকিয়ে দিলো ভাস্করের মুখে লক্ষ্মী সেই ফাঁকে একটা ওষুধ দিয়ে দিল জিভের তলায়।
ওদের ডাক্তার মুখার্জী এটা শিখিয়ে রেখেছে লক্ষ্মীকে। মুখার্জি ডাক্তার বলেছে এতে কিছু সময় পাওয়া যায়।শিখিয়েছে অবশ্য সুমিত্রার জন্য কিন্তু তাই বলে ভাস্কর! বিশ্বাস হচ্ছে না লক্ষ্মীর! লক্ষ্মী কথা বললো ডাক্তার মুখার্জির সাথে! ডাক্তার বাবু এক্ষুণি নিয়ে যেতে বলছে ওঁর নার্সিংহোমে!
” লাজু তাড়াতাড়ি মোড়ের মাথা থেকে একটা ট্যাক্সি ডাক!” – লক্ষ্মী বলতেই লাজু ছুটলো! সে তো ছুটলো কিন্তু ও যে কিছুই পারে না! ট্যাক্সি মানে ঠিক কোন গাড়ি সেটাও জানে না! সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির মালিকের কাছে হাত জোড় করেছিল সাহায্যের জন্য । সুমিত্রা কাঁদতে কাঁদতেই ফোন করলো ছেলেকে। রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোন তুলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সুমিত্রা।
“বাবু তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়, তোর বাবা আর নেই মনে হয় !” শুধু এইটুকুই বলতে পেরেছিলো সুমিত্রা! ওপাশ থেকে একটা নিরুত্তাপ গলা শুনেছিল – “আন্টি আমি মোহর। অর্ক পাসপোর্টের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেছে। আমি এলেই ফোন করতে বলছি। ” বলেই কেটে দিলো ফোনটা। প্রচন্ড অসহায় হয়ে গেল সুমিত্রা, এটাই যে শেষ ভরসা ওঁর। মেয়েটা একবারও জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না কি হয়েছে, পাছে পাসপোর্ট না হয়!
ততক্ষণে ট্যাক্সি নিয়ে হাজির লাজু। লক্ষ্মীও পাশের বাড়ির বৌদিকে ডেকে সুমিত্রার কাছে থাকতে বলে বেরিয়ে পড়লো। সুমিত্রা শুধু লক্ষ্মীর হাতে এ টি এম কার্ডটা দিয়ে দিলো। এইটুকু ভাস্করই শিখিয়ে রেখেছিলো লক্ষ্মীকে! বাড়ি থাকতো না কখন কাজে লাগে! এইটুকু বিশ্বাস তো করতেই হতো! আসলে সুমিত্রা সবসময় অসুস্থ কিন্তু ভাস্করই যে এরকম একটা পরিস্থিতির শিকার হবে ভাবতেই পারেনি!
খাট থেকে নামতেই পারেনি সুমিত্রা! ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাহায্যে ভাস্করকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো দুজন অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ে। শিক্ষিত ছেলে তখন নিজের যোগ্যতা বিচারে ব্যস্ত ! হায় রে ভবিতব্য কত কি তুলে রেখেছিলে দেখাবে বলে।
**********
“গিন্নি মা মোহরদিদির মা বাবা এসেছে। “লক্ষ্মী এসে শোয়া থেকে বসিয়ে দিল সুমিত্রা কে।” ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে সুমিত্রা। মাত্র দুদিন আগে স্বামীকে হারিয়ে সুমিত্রা আজ নির্বাক। হয়তো বাকরুদ্ধ অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এরকম ছেলের মায়েদের স্বামী ছাড়া গোটা পৃথিবীটা অন্ধকার।
সেদিন রাতে পাসপোর্টের সব ঝামেলা মিটিয়ে প্রায় দশটায় ফিরেছিল অর্ক। ভেবেছিলো বাবার হালকা কিছু হয়েছে।
ফোন করেছিল সুমিত্রাকে একবার! অভিমানে, রাগে দুঃখে ফোন ধরেনি সুমিত্রা! সেই রাতে ফিরেই তারপর নার্সিংহোমে গেছিলো অর্ক! তবে মেয়েদুটোর ছুটি হয়েছিল। তখন ডাক্তার মুখার্জির চিকিৎসায় ভাস্কর অনেকটা স্থিতি শীল!
কিন্তু হলেও মাঝ রাতে আবার সেরিব্রাল এটাক হয়েছিল ভাস্করের । আর তার সাথে এঁটে উঠতে পারেনি। বাড়িতে যখন নিথর দেহ নিয়ে এসেছিলো তখন লক্ষ্মী আর লাজুর ভেঙে পরা কান্না দেখে সত্যি বোঝা দায় কে আপন আর কে পর।
চুপ করে এটাই ভাবছে সুমিত্রা! ঘরে এখন অনেক লোক! মোহর, ওর বাবা মা, অর্ক! ভরা সংসার যেন সুমিত্রার! তাও ও যেন লাজু আর লক্ষ্মীকেই খুঁজছে! – “ভেঙে পড়বেন না দিদি, নিজের যত্ন নিন, আপনার ছেলে মেয়েদুটোর কথা ভেবে যত্ন নিন। যা মোহর মায়ের কাছে গিয়ে বস ! ” নিস্তব্ধতা ভাঙলো মোহরের মা! খুব বুদ্ধিমতী আর ভালো মনের মানুষ! মেয়ে ওঁর শিক্ষায় বড় হয়নি এটা বেশ বোঝে সুমিত্রা!
কিন্তু সুমিত্রা আজ কোনো ভালো কথাতেই গলবে না! আজ মনে মনে ঠিকই করে কোনো ভূমিকা নয়। যা হবে আজ সরাসরি।- “ছেলেমেয়ে কোথায় দিদি বলুন দুটো মেয়ের জন্য! ওই দুটো মেয়ের জন্যই বেঁচে থাকা!”
কথা গুলো বলতে চাইলেও যেন গলার কাছটা আটকে গেল। মা বলেই হয় তো পারলো না নিজের রক্তকে অস্বীকার করতে ! মোহরের মা মানুষটা খারাপ না হলেও মোহর যে বাবার ধাঁচে গড়া সেটা বুঝিয়েই বলে ফেললেন মোহরের বাবা “এবার বিয়েটা কি হবে বুঝতে পারছি না। ”
মোহরকে জায়গা করে দেবে বলেই হয়তো বাবার এহেন প্রশ্ন। মোহর ঝোপ বুঝেই কোপ মারলো “আঙ্কেল এমন সময় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ! না এখন আমরা বিয়ে পিছোতে পারবো না সুইডেন যাওয়া, আচ্ছা অর্ক তোমার অফিস কি বলছে? ”
” বললো যে যাওয়াটা ওরা বড়জোর একমাস পিছোতে পারে। ” অর্ক খুব সাবধানে বললো! উত্তর শুনে সুমিত্রার মা হিসেবে বুঝতে মোটেই অসুবিধা হোলো না পুরো ট্রেনিংটা ভালো মত পেয়েছে ওনার ছেলে । মোহর আবার মাঝ পথ থেকে ধরলো “সেটাই তো ওরা কি করবে! একজনকে পাঠানোর জন্য ওরা অনেক টাকা খরচ করে, সেগুলোতে ঘাটতি পড়লে অর্কর চাকরি নিয়ে না টানাটানি হয় ! তার চেয়ে বরং এক কাজ করা যাক আমরা রেজেস্ট্রি করে বেরিয়ে যাই পরে মাঝে একসময় এসে বিয়েটা সেরে নেবো। ”
প্রত্যেকে সুযোগ বুঝে নিজেরটা বলছে দেখে
সুমিত্রাও সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বললো “না তোমরা বিয়েটা সেরেই যাও। আজকাল আর কেউ এসব মানে না। আর তাছাড়া ওর বাবার কাজটা তো হয়ে যাবে। তোমরা বিয়েটা করে নিতেই পারো। আজকাল আর সিঁদুর কজন মানে রেজিস্ট্রিটাই আসল বিয়ে। আর অর্ক তুই বাবা আর একমাস পিছোস না, যেদিন যাওয়ার কথা সেদিনই যাবি অফিসে জানিয়ে দে। চাকরি চলে গেলে সে আবার কেলেঙ্কারি হবে। ”
কথাগুলো বলেই গলার কান্নাটা গিলে নিলেন সুমিত্রা! ওনার কথায় সবাই খুশী হলেও চোখ সরু করে তাকিয়েছিলেন মোহরের মা। বোঝা গেল ওই পরিবারে ওনার কথা একটু কম দামি।কিন্তু মায়ের মন বোঝার মতো দূরদর্শিতা ওনার আছে, হয়তো নিজেও একজন মা বলেই!
চলবে।