নীল আকাশের ধ্রুবতারা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
15

#নীল_আকাশের_ধ্রুবতারা ( গল্পের বাকি অংশ )
#মৌসুমী_হাজরা

…এই নীলু শুনেছিস? এইবার কলেজের অনুষ্ঠানে সব্যসাচী বাবু আসবেন। তিনি কবিতা পাঠ করবেন।

…তাতে আমার কী মাধুরী?

…আহা! মেয়ের কথা শোনো। যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, তাকে এত কাছ থেকে দেখবে। আর বলে কিনা তাতে আমার কী!

…যদি তাঁর কবিতা শুনে, কাছে চলে গিয়ে বলে বসি, আমি আপনার নীল আকাশ। তখন কী হবে?

…সে দেখা যাবে তখন। এইরকম হলে অবশ্য মন্দ হবে না।
মুখ টিপে হাসতে থাকে দুজনে।

মঞ্চের থেকে অনেকটা দূরে বসেছে নীলিমা আর মাধুরী। সব্যসাচী বাবুর চোখ যাতে না পড়ে। মঞ্চে উঠতেই সকলে হাততালি দিতে শুরু করলো, এমন সুদর্শন প্রেমিক কবির প্রেমে সবাই হাবুডুবু খেতে পারে। সব্যসাচী শুরু করলেন, আমার কবিতা আপনারা সবাই পড়েন, তাই আমি আজ এই জায়গায়। তবে আজ একটা খোলা চিঠি পাঠ করবো আগে, আমার নীল আকাশের জন্য।

প্রিয় নীল আকাশ,
তুমি চাইলে আমি অপেক্ষা করতে পারি আজীবন। তবে কৃষ্ণচূড়া কথা দিয়েছে, সে ফুটবে খুব তাড়াতাড়ি। বেনামী চিঠি আজ আমার দরকারী ফাইলে স্থান পেয়েছে, রোজ তাদের একবার করে আমি ছুঁয়ে দেখি। পাতার পর পাতা কবিতা লিখে চলেছি, একদিন সব তোমাকে পড়ে শোনাবো বলে। অপেক্ষার মাঝেও যে এত আনন্দ, তা আমি আগে বুঝিনি। যেদিন কৃষ্ণচূড়া ফুটবে সেদিন আমি আমার নীল আকাশকে, নীল শাড়িতে প্রথম দেখবো, এই আশাতেই কা’টিয়ে দিচ্ছি দিন।

এরপর সব্যসাচী বাবু কবিতা পাঠ করলেও, নীলিমা চোখ বন্ধ করে খোলা চিঠির কথা গুলো শুধু অনুভব করছে। আর কোনো কিছু কানে ঢুকছে না তার।

এইভাবে কে’টে যায় মাসের পর মাস। বেনামী চিঠি আর কবিতার সংসার শুরু হয়েছে আগেই। এই মাধ্যমেই কথোপকথন চলতে থাকে দুজনের। না দেখে, শুধু অনুভব করে সব্যসাচীর মনে নীল আকাশের জন্য প্রেম দিন দিন বেড়ে চলে। অবশেষে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল আসে। নীলিমা চিঠিতে লিখে জানিয়ে দেয় দেখা করার দিন-তারিখ- সময়।

নীল শাড়িতে নীল পরী সেজে উঠেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে বারবার লজ্জা পাচ্ছে। ভ য়-উত্তেজনা সব মিলিয়ে বুকের মধ্যে উঠতে থাকা ঝড়কে শান্ত করে বেরিয়ে গেল নীলিমা, সব্যসাচীর সামনাসামনি হওয়ার জন্য।

সেই রাতেই, এক্কেবারের জন্য গ্রাম ছেড়ে বাবার কাছে চলে গেল নীলিমা। কোনোদিন ফিরবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে গেল।

ঋতিকা সব শুনে ঘাবড়ে গিয়ে বললো, কেন মামনি কী হয়েছিল? ধ্রুবতারা আসেনি দেখা করতে? বলো না মামনি, চুপ কেনো তুমি? বলো না কী হয়েছিল নীল আকাশের?
নীলিমা দেবীর চোখে তখন আ’গুন ঝরছে, চেপে রাখা ক ষ্ট আর রা গ নিয়ে বললেন, বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছিল।
ঋতিকা আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলো না।

ঋতিকা নিজে ড্রাইভ করছে, সামনের সিটে বসে আছেন নীলিমা দেবী। গতরাতে আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হয় নি ঋতিকার। সব প্রশ্নের উত্তর এখন, একমাত্র মাধুরী আন্টি দিতে পারবেন। মামনিকে দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে, তিনি ঠিক নেই। মনের মধ্যে অনেক কিছু চলছে। হয়তো অনেক কিছু মামনিও জানে না।
বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন নীলিমা দেবী। একের পর এক গাছ পেরিয়ে যাচ্ছে। কত কি বদলে গেছে জায়গাটাতে। একসময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এইখানে আর ফিরবেন না। আর আজ সময় তাকে আবার অতীতের সামনে নিয়ে এসেছে। কোন সকালে বেরিয়েছে দুজনে, দরকারী টুকটাক কথা ছাড়া দুজনেই চুপ। ঋতিকা ইচ্ছে করেই বেশি কথা বলছে না, এইসময় মামনিকে একটু নিজের মতো থাকতে দেওয়া ভালো। ঋতিকা আছে তো, বাকি টুকু সামলে নেওয়ার জন্য।

সাঁকোর কাছে এসে গাড়ি থামালো ঋতিকা। আগের মতো সাঁকো আর নেই, এখন বেশ উন্নত। তবে কৃষ্ণচূড়া গাছটি বেশ বড়ো হয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নীলিমা, সেদিনও সে এসেছিল। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সব্যসাচী, কিন্তু সাথে আর একজনও ছিল। আর নীলিমার চোখের সামনে সেদিন সব্যসাচী তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়েছিল।

ঋতিকা, নীলিমা দেবীকে ধরে বললেন, চলো মামনি, মাধুরী আন্টি ওয়েট করছেন। এগিয়ে যাচ্ছে নীলিমা কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে, তার তলায় বসে আছে বছর পঞ্চাশের মাধুরী। বত্রিশ বছর পর দেখা। একে অপরকে দেখে সেই সময়টা খুঁজতে লাগলো। এতদিন পর দেখা হওয়ার পর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরার কথা, কিন্তু ঋতিকা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মামনির চোখে রা গ, ঘৃ ণা আর অনেক প্রশ্ন।
মাধুরী দেবী কাছে এসে জড়িয়ে ধরলেন নীলিমা দেবীকে। তারপর বললেন, তোকে কিচ্ছু বলতে হবে না, তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো।
মাধুরী দেবী বলা শুরু করলেন, সব্যসাচীকে তুই একা ভালোবাসিস নি, আমিও বেসে ছিলাম। এমন সুদর্শন প্রেমিক কবিকে কে না ভালোবেসে থাকতে পারে বল? তবে কখনো তোকে সেটা বুঝতে দিই নি। আমি নিজেই চেয়েছিলাম তোদের মিল হোক। তাই তো দাদার কাছে সব্যসাচীর বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে তোকে জানিয়ে ছিলাম, চিঠি লেখার কথা বলেছিলাম। তোর প্রতিটা চিঠি লেখার সাক্ষী ছিলাম আমি। তুই খেয়াল করিস নি, আমি বসে বসে চোখের জল ফেলেছিলাম। তবুও চেয়েছিলাম তোদের দেখা হোক, তোদের মিল হোক। কিন্তু সেদিন আর পারিনি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম নিজেকে আটকানোর। কিন্তু কেন জানি না, আমি ভীষণ স্বার্থপর হয়ে গেলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, এইসব কিছু আমার জন্য হচ্ছে, আমিই সব্যসাচীর বই আর পত্রিকা কিনে এনে তোকে দিতাম, ঠিকানা আমিই জোগাড় করেছিলাম, এমনকি চিঠি লেখার কথাও আমিই বলেছিলাম। তাহলে এই সব কিছুর অধিকার আমার। সব্যসাচীর কবিতা, সব্যসাচীর নীল আকাশ আমিই, সেখানে তোর কোনো অস্তিত্বই নেই। আমি যদি সাহায্য না করতাম, তাহলে সব্যসাচীর জীবনে নীল আকাশ বলে কেউ আসতো না। আমি এতটাই হিং’সাত্মক হয়ে পড়লাম যে, এক মুহুর্তে ভুলে গেলাম, তোর আর আমার সম্পর্ক, আমাদের একসাথে বড়ো হওয়া, দুষ্টুমি, সেই রঙিন শৈশব।
আমি জানতাম, তোর বলা সময়ের আগেই সব্যসাচী আসবে, তাই তোর আগেই আমি গেলাম। ঠিক যেভাবে সব্যসাচী নীল আকাশকে দেখতে চেয়েছিল, নীল শাড়ি পরে আমি সামনে দাঁড়ালাম তার। বাকিটা তুই দেখেছিস। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি, তুই এখান থেকে চিরদিনের মতো চলে যাবি। প্রতিদিন তোর মামিমার কাছে গিয়ে তোর বাড়ির ঠিকানা চেয়েছি। কিন্তু আমাকে তিনি দেননি। হয়তো তুই বারণ করেছিলি বলে।
সব্যসাচীকে পেয়েও আমি পেলাম না। সে যে শুধু নীল আকাশকে ভালোবেসেছিল। প্রতিটা সময় সেটা আমি অনুভব করেছি। বহুবার সব্যসাচী আমার কাছে আবদার করেছিল, আবার আগের মতো চিঠি লিখতে। আমি পারি নি। আমি যে নীল আকাশ নই। কতবার একা একা এই কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে এসে কেঁ’দেছি। মাঝরাতে ঘুমাতে ঘুমাতে দমবন্ধ হয়ে যেত। আমি যে বড্ড অ’ন্যায় করেছি, তোর সাথে, সব্যসাচীর সাথে। এইভাবেই চলছিল। দুই পরিবার থেকে বিয়ের ঠিক হলো। আমি আর থাকতে পারিনি, বারবার তোকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে সব্যসাচীকে সব সত্যিটা জানালাম। তারপর থেকে সব্যসাচী একদম চুপ হয়ে গেল। আমাকে কোনো প্রশ্ন করলো না। লেখালেখির জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। তবে বিয়েটা হলো। বড্ড ভালোমানুষ যে সে। কাউকে কিছুই বুঝতে দিল না। এটা ঠিক যে, সে আমাকে স্ত্রীর অধিকার দিয়েছিল কিন্তু আমি কোনোদিন তার প্রেমিকা হতে পারিনি, ভালোবাসার সেই মানুষ হতে পারিনি। আমাদের কোনো সন্তান নেই। দশ বছর এক ছাদের তলায় থাকলাম, সে আমাকে অত্যন্ত যত্নে রেখেছিল। আমার ভু’লের জন্য আমাকে কোনোদিন দো’ষারোপ করে নি। কিন্তু আমার পাপের শাস্তি আমাকে পেতেই হতো, সব্যসাচীর মা’রণ রোগ ধরা পড়লো। বহু চেষ্টা করেছিলাম তাকে বাঁচানোর। কিন্তু ভিতর থেকে সে আগেই মা’রা গিয়েছিল, লেখালেখি ছেড়ে, নীল আকাশকে হারিয়ে। এরপর আবারও তোকে খোঁজা শুরু করলাম। ভাবলাম শেষবারের মতো সব্যসাচী নীল আকাশকে দেখুক। শেষবারের মতো ক্ষণিকের জন্য হলে সব্যসাচী আবার মন থেকে বেঁ’চে উঠুক, শেষবার আবার কলমটা ধরুক। কিন্তু তা আর হলো না। এক বুক ক ষ্ট নিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো সব্যসাচী। মা’রা যাওয়ার আগে তার অপ্রকাশিত কবিতার পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, এটা শুধু নীল আকাশের অধিকার। তোমার জন্য বাকি সব রেখে গেলাম।

অঝোরে কেঁদে চলেছে মাধুরী, বারবার বলছেন, তোর ধ্রুবতারা আর নেই, সব্যসাচী আর নেই। এতদিনের রা গ, ক্ষো ভ নিমেষেই উধাও নীলিমার। জড়িয়ে ধরলেন মাধুরীকে। ঋতিকাও কেঁ দে চলেছে। কিছুক্ষণ পর মাধুরী দেবী নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যাগ থেকে কবিতার পাণ্ডুলিপি বের করে বললেন, এই দেখ নীলু, সব্যসাচীর কবিতা, যা শুধু তোর অধিকার। আমার এবার দায়িত্ব শেষ। কবিতার পাণ্ডুলিপি বুকে জড়িয়ে নীলিমা কেঁ দে চলেছে। সব অভিমানের বরফ গলেছে। মাধুরী দেবী, নীলিমাকে ধরে বললেন, শৈশবকাল থেকে সব্যসাচী আমাদের জীবনে আসার আগে অব্দি, কোনো স্মৃতি যদি তোর আজও মনে থাকে, তাহলে আমাকে ক্ষ মা করে দে। এই নিঃস্ব মানুষটাকে ক্ষ মা করে দে। আমি সব হারিয়ে ফেলেছি নিজের ভু’লের জন্য। নীলিমা কোনো কথা না বলে ঋতিকাকে ইশারা করে ব্যাগটা দিতে বললেন, সেখান থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করে বললেন, সামনের ফাল্গুনে আমার ছেলের সাথে এই মেয়েটির বিয়ে হবে। প্রথম কার্ড আমি আমার কাছের আর ভালোবাসার মানুষকে দিলাম।

নীল শাড়ি পরে, আয়নার সামনে দাঁড়ালেন নীলিমা দেবী। সাদা-কালো বাঁধা চুল খুলে দিলেন। তারপর কপালে ছোট্ট টিপ পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন। গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে ঋতিকা আর মাধুরী দেবী। কিছুক্ষণ পর তাঁরা পৌঁছে গেলেন যথাস্থানে। সব্যসাচী বাবুর অপ্রকাশিত কবিতা আজ ত্রিশ বছর পর প্রকাশ পেল, বইয়ের নাম “এক নীল আকাশের জন্য।”
একই সাথে নীলিমা সেনের লেখা কবিতাও প্রকাশ পেল, বইয়ের নাম, “ধ্রুবতারা থেকে যায়।” সবার হাততালিতে চারিদিক মুখরিত।

ঋতিকা, নীলিমা দেবীর কাছে এসে বললো, মামনি, নীল আকাশে ধ্রুবতারা থেকে যাবে চিরদিন। চোখের জল আর লুকিয়ে না রেখে জড়িয়ে ধরলেন তিনি ঋতিকাকে।

সমাপ্ত