#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#সূচনা_পর্ব
প্রাক্তন প্রেমিকের হবু স্ত্রীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হয়েছে আলিশা। শুনতে অদ্ভুত লাগছে তাইনা? দিন সাতেক আগে আলিশার প্রেমিক নিশান ওর সঙ্গে হুট করে সব সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে বিয়ের কথা জানায়। সম্পর্কে ভাঙার কারণ হিসেবে দর্শায় তার মা বাবার আলিশাকে পছন্দ নয়। দীর্ঘদিনের এই সম্পর্ক শুধু এই একটা কারণে ভেঙে যাচ্ছে? মন ভেঙেছিল বটে তবে আলিশাও আর দ্বিমত করেনি, কিছু বলেনি শুধু নিজেরে ধি-ক্কা-র জানিয়ে এক দফা হেসেছিলো। আলিশাকে হাসতে দেখে সেদিন নিশান প্রশ্ন করেছিলো..
‘ হাসছো কেনো তুমি আলিশা?’
‘ নিজের ওপর ক্ষো-ভ হচ্ছে তাই হাসছি ‘
‘ আলিশা, দেখো আমি জানি হুট করেই এসব..কিন্তু তুমি জানো আমি আমার মা বাবাকে কতোটা সম্মান করি আর তাদের জন্যে..’
‘ এখন এসব বলার কোনো আদৌ কোনো মানে আছে নিশান?’
‘ মানে?’
‘ একটু আগেই আমার সঙ্গে তুমি সব সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছো, এখন আমরা একে অপরের জন্যে অপরিচিত ছাড়া কেউই নই। আর অপরিচিত কাওকে সাফাই দেওয়ার দরকার পড়েনা। তাইনা নিশান?’
‘ আই অ্যাম সরি আলিশা ‘
‘ প্লিজ নিশান, সরি বলে তুমি আমাকে আর হাসিও না। আজ আমি একটা কথা বুঝলাম জানো তো? তুমি আমায় কোনোদিন ভালোই বাসোনি। তাহলে আজ, এতো সহজে এসব করতে পারতে না’
‘ যাই হোক, এখন এসব বলার আর মানে নেই। জানিনা কাকে বিয়ে করছো তুমি, কে তোমার জীবনে আমার জায়গাটা নিতে যাচ্ছে তবে.. নতুন জীবনের জন্যে শুভ কামনা রইলো আর এভাবে আমার মন ভাঙার জন্য ধন্যবাদ ‘
বাড়ি ফিরে সেদিন থেকে টানা দুদিন খুব কেঁদেছিল আলিশা, কিছুদিন পর যে মানুষটাকে বিয়ে করার চিন্তা করছিলো সে আজ বাদে কাল অন্য কারো স্বামী হতে যাচ্ছে! মনকে কিছুতেই মানাতে পারছিল না আলিশা আর না বাসায় কিছু বলতে পারছিলো। কারণ মনের কথা বলার মত বাসায় কেউই নেই। আলিশার মা বাবার ডিভোর্স হয়েছে অনেক আগেই, নিজের বড় ভাই ও বাবার সঙ্গে থাকে সে। যদিও মায়ের সঙ্গে আলিশার যোগাযোগ আছে কিন্তু উনি দূরে থাকেন। এ মুহূর্তে জার্নি করে অতদূর যাওয়ার শক্তি নেই মেয়েটার। নিজেকে একপ্রকার ঘরবন্দী করে নিয়েছিলো আলিশা, বোনের এই অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে ওর বড় ভাই আদিল। আলিশার বাবা কর্মব্যস্ততায় বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকেন, আদিলই বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকে। কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গেও এসব বিষয় শেয়ার করেনি মেয়েটা, অবশেষে নিজের মনকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে যে নিশানের সঙ্গে ওর সব সম্পর্ক শেষ এবং সেই সম্পর্কের ইতি টানতেই আজ নিশানের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ভীষণ সেজেগুজে এসে হাজির হয়েছে! নিশান সচারাচর নিজের বন্ধুদের সঙ্গে আলিশাকে দেখা করাতো না, কিন্তু দু – একজন চিনতো। নিশানের বাড়ি থেকে ওর হবু স্ত্রীর বাড়িতে বিয়ের জিনিস নিয়ে ওর বন্ধুরা গেছে। হলুদের অনুষ্ঠান চলছে, সেখানে আলিশাকে উপস্থিত দেখে নিশানের বন্ধুরা চমকে ওঠে! আলিশা স্টেজে গিয়ে হবু স্ত্রীর গালে হলুদ লাগিয়ে মুচকি হেসে বললো…
‘ ভীষণ মিষ্টি লাগছে তোমায়, নিশানের সঙ্গে তোমায় বেশ মানাবে ‘
‘ থ্যাংক ইউ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না আপু। আপনি কি নিশানের বন্ধু?’
‘ হুমম, তেমনি কিছু ধরে নাও ‘
মেয়েটির সঙ্গে আরো মিনিট পাঁচেক কথা বললো আলিশা, ততক্ষণে নিশানের কয়েকবার ফোন এসে গেছে হয়তো এতক্ষণে হয়তো খবর ওদিকে পৌঁছে গেছে। যে মানুষটির নাম্বার সবচেয়ে ওপরে রেখেছিল সেই নাম্বারটি আজ ব্লক করে দেওয়ার সময় দ্বিতীয়বার ভাবেনি আলিশা। অতীতের সব সম্পর্কের স্মৃতি আজ এখানেই ফেলে যাচ্ছে আলিশা, পিছু ফিরে আর তাকাবে না। ওখান থেকে হলুদের অনুষ্ঠানের খাবার খেয়েই বাসায় ফেরে আলিশা। এতক্ষণে হয়তো নিশান ভয়ে- চিন্তায় জবথব হয়ে গেছে! তাতে কি? নিশানকে আজ এই মুহূর্ত থেকে নিজের জীবনের এক তিক্ত অতীতের হিসেবে ফেলে দিলো আলিশা!
________________________________
জে’লের মধ্যে বসে মশার কামড় খেয়ে বিরক্ত হচ্ছিলো জায়ান। এই নিয়ে এ বছর চতুর্থবারের মতো এখানে আসতে হলো ওকে, প্রতিবার আরো আগেই ছাড়িয়ে নিয়ে যায় কিন্তু এবার কেনো এতটা দেরি হচ্ছে ভেবে পাচ্ছেনা জায়ান। তখনই এক কনস্টেবল এসে সেলের তালা খুলে বললেন…
‘ তোমার বেইল হয়ে গেছে, চলে এসো ‘
সেল থেকে বেরিয়ে উকিলের সঙ্গে বাবার সেক্রেটারি হেলাল সাহেবকে দেখে হাসলো জায়ান, প্রতিবার উনিই আসেন! পুলিশের খাতায় সাইন করে হেলাল সাহেবকে বললো…
‘ ওহ, হাই আঙ্কেল! অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হলো। ভালো আছেন তো?’
‘ জায়ান, তুমি কেনো বারবার এমন কাজ করো যাতে স্যার রেগে যান? এখনও তো আর ছোটো রওনি তুমি, একটু ভালো ছেলে হয়েও তো থাকতে পারো নাকি? খুব কঠিন কিছু তো না!’
‘ ভালো ছেলে বলতে? ওহ আমার ভাইয়ের মতো? সরি আঙ্কেল, আমি অমন ভালো হতে চাইনা ‘
‘ এটাই শেষবার, এরপর যদি তুমি এমন ঝামেলা করো তাহলে আর আশা করো না যে আমি তোমাকে ছাড়াবো। বারবার তোমার জন্যে আমি নিজের সম্মান খোঁয়াতে পারবো না — তোমার বাবা এই কথাটা বলেই আমাকে পাঠিয়েছে ‘
‘ আঙ্কেল! এই নিয়ে এই একই ডায়লগ কতবার বললেন খেয়াল আছে তো? আমার বাবা শুধু মুখেই এসব বলবে, দিনশেষে আমাকে হেল্প করতে চলে আসবে। আফটার অল, আই অ্যাম হিজ সান!’
‘ না বাবা, এবার বিষয়টা একটু সিরিয়াস। স্যার তোমাকে ছাড়ানোর জন্য এবার মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। দেখলে না এবার তোমাকে ছাড়াতে কতোটা দেরি হলো? ওটা তো সায়ন স্যার তোমার বাবাকে বলে তারপর রাজি করালো ‘
এ কথা শুনেই জায়ানের হাসি গায়েব হয়ে গেলো!
‘ ওহ! তার করুণায় ছাড়া পেয়েছি? তাহলে তো কিছুদিন এখানে থাকলেই ভালো লাগতো। এখানে অন্তত মুখের ওপর কেউ সায়নের নাম তো নেয় না।’
‘তোমার বাবা বলেছেন আর একটা ভুল করলে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন, এবার অন্তত একটু সিরিয়াস হও!’
‘ উনি তো এসবই বলবেন। আমি তার প্রোজেক্ট ফেইলিউর। আর সায়ন? গোল্ডেন চাইল্ড!’
জায়ান যেনো এসব কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না, হেলাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন…
‘জায়ান, একবার নিজেদের মতো করে ভাবো। বারবার এইসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। তোমার বাবার একটা সম্মানের ব্যাপারও তো আছে!’
‘আঙ্কেল, আপনি জানেন? একটা মানুষ যখন বারবার শুনতে পায়—‘তুমি পারবে না’, তখন সে হয় ভেঙে পড়ে, না হয় অবাধ্য হয়ে যায় করে। আমি দ্বিতীয় অপশন বেছে নিয়েছি।’
জায়ান আর কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো, সায়ন ওর বড় ভাই। বয়সে মাত্র তিন বছরের বড় হলেও কর্মক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই প্রায় নিজের বাবার সমতুল্য হয়ে উঠেছে সে তাই এনায়েত সাহেবের কাছে তার বড় ছেলে ভীষণ প্রিয়। ছোটো ছেলে জায়ান, ছোটো থেকেই ভীষণ দুষ্টু ছিলো বিধায় এনায়েত সাহেব সর্বদা ওকে কঠোর শাসনে রাখতেন। বড় ছেলে দোষ করলেও সেটা মাফ করে দিতেন এনায়েত সাহেব। ছোটো থেকে এসব দেখতে দেখতে জেদের বশে এখন জায়ান ভীষণ অবাধ্য হয়ে গেছে। ভালো হওয়া তো দুর, উল্টে এমন কাজ করে বেড়ায় যাতে ওর বাবার ঝামেলা হয়। ছোটো থেকেই বাবার চোখে খারাপ সে তাই খারাপ কাজ করেই খারাপ হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই জায়ানের! ওদিকে… রাতে আজ বাবা – ভাই দুজনেই বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গেই রাতের খাবার খাওয়ার সময় আলিশার ভাই প্রশ্ন করে…
‘ আলিশা, কদিন ধরেই দেখছি তুই কেমন মনমরা হয়ে আছিস। সারাক্ষণ ঘর আটকে বসে থাকিস। কিছু হয়েছে?’
আলিশা খেতে খেতে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো..
‘ হুম! মুড অফ ছিলো তবে এখন আমি ঠিক আছি। উম্ম! আমার তোমাদের একটা জরুরী কথা বলার আছে। আমি বিয়ে করতে চাই ‘
আলিশার মুখে বিয়ের কথা শুনে ওর বাবা – ভাই কেউই তেমন অবাক হলেন না কারণ তারা জানতেন আলিশার একজনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। আদিল বললো…
‘ তোর ওই বয়ফ্রেন্ডকে? ঠিক আছে ওকে ওর পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় আসতে বল। বড়রা মিলে কথা বলে না হয়…’
‘ নিশানের সঙ্গে আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে! কাল ওর বিয়ে হচ্ছে তাই আমার জন্যে তোমাদের অন্য ছেলে খুঁজতে হবে’
এ কথা শুনে আদিল বেশ অবাক হলো!
‘ কি বলছিস এসব? চার বছর ধরে না তোদের সম্পর্ক চলছিলো? আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ের কথা বলবি তাহলে হুট করে এসব হলো কখন?’
আলিশা কোনো উত্তর দিতে পারলো না, কি বলবে? বাসায় সবসময় নিশানকে নিয়ে অনেক পজিটিভ কথা বলতো ও, সেই ছেলে কেনো ছেড়ে চলে গেছে সেই ব্যাখ্যা কি করে দেবে?
‘ জানতাম আমি এমনকিছুই হবে, শুরুতেই তো মানা করেছিলাম কিন্তু আমার কথা শুনিসনি। ওই ছেলের চক্করে পড়ে নিজের পড়াশুনার বারোটা বাজিয়েছিস। কি হলো এখন? ওই ছেলে তো শুনেছি ভালো রেজাল্ট করতো, চাকরিও পেয়েছে আর তুই কি করলি? যাই হোক, তুই বিয়ের কথা যখন তুলেছিস আমার চেনা একটা ছেলে আছে। তার সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি’
‘বাবা, তুমি কি ওই আমাদের ক্লায়েন্ট এনায়েত সাহেবের ছোট ছেলের কথা বলছো?’
‘ হ্যাঁ! সম্ভ্রান্ত পরিবার ওনার, ওখানে আলিশার বিয়ে হলে মন্দ হয় না ‘
বাবার কথায় বাঁধ সাধলো আদিল!
‘ বড়জন হলেও একটা কথা ছিলো কিন্তু ছোটোজন? বাবা, ও তো সুবিধার না। শুনেছি ছোটো থেকেই এখানে সেখানে ঝামেলা করে বেড়ায়, এমন একজনের সঙ্গে আলিশার বিয়ে কিভাবে হবে?’
‘ বিয়ের আগে কতো ছেলেই তো কতরকম থাকে, পরে সব ঠিক হয়ে যায়। তাছাড়া সেদিন এনায়েত সাহেব নিজেই আমাকে এ বিষয়ে বলছিলেন। এখন যেহেতু আলিশারও আর ওই ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তাহলে সম্মন্ধ করতে অসুবিধা কোথায়?’
‘ ওই ছেলেটাই তো সমস্যা বাবা, ওর সঙ্গে আমাদের আলিশা থাকতে পারবে না ‘
‘ ছোটো ছেলেকে নিয়ে সমস্যার কি আছে ভাইয়া?’
‘ আলিশা তুই জানিস না কিছু, এনায়েত সাহেবের বড় ছেলে সবদিক থেকে উপযুক্ত আর পারফেক্ট। ওর সঙ্গে বিয়ের কথা বলা যায়, কিন্তু ছোটোজন তো…’
ভাইয়ের কথায় মলিন হাসলো আলিশা, অবশ্য এই হাসিটা ও নিজেই নিজেকে তাচ্ছিল্য করে হাসলো। নিশানও ওদের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে পারফেক্ট ছেলে ছিলো!
‘ পারফেক্ট একজন আমার জীবনের চার বছর নষ্ট করে দিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ভাইয়া। পারফেক্ট থাকলেই সম্পর্ক টেকে না। যদি আগুনে পোড়াই ঠিক থাকে, তবে আমি নিজেই আগুনে ঝাঁ’প দেবো। অন্তত জানব যে নিজের ইচ্ছায় জ্বলছি। বাবা, তুমি যার কথা বলছো তার সঙ্গেই বিয়ের ব্যবস্থা করো। আমার কোনো আপত্তি নেই ‘
চলবে….
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…]