তোর রঙে হবো রঙিন পর্ব-০৬

0
36

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৬

রাতের টিকিট ম্যানেজ করতে না পারায় সায়ন সকালের টিকেট বুক করে দিয়েছিলো। আলিশার গাড়িতে উঠে কখন ঘুমিয়ে গেছিলো টের পায়নি। দুপুরের দিকে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া করতে করতে পাহাড়মুখো গাড়িতে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো। গন্তব্যে পৌঁছাতে আরো সময় লাগবে। গাড়ির ভেতর রেডিওতে পুরোনো গান বাজছে। মাঝে পাহাড়ের ঘন সবুজ ধীরে ধীরে গাড়ির কাচে ছায়া ফেলছে, বেশ শান্ত একটা পরিবেশ। একসময় গাড়ি থামে, আলিশা সায়নের থেকে সব ডিটেলস জেনে এসেছিলো তাই জায়ান কোন রিসোর্টে আছে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি। গেট পার হয়ে রিসোর্টের কটেজে যায়। রিসিপশন থেকে জায়ানের কটেজ নাম্বারটা জেনে নেয়। যদিও রিসিপশনিস্ট প্রথমে বলতে চাইছিলো না কিন্তু আলিশা কোনোভাবে ম্যানেজ করে রুম নম্বর কালেক্ট করে নেয়। আলিশা ধীরে ধীরে দরজায় পৌঁছে দরজায় টোকা দিলো। ভেতর থেকে দরজা খোলে জায়ান, চোখে ক্লান্তি, হাতে একটা বই। চোখে মুখে অবাকভাব…

‘তুমি!

আলিশা দরজা পেরিয়ে ভিতরে পা রাখতেই একটা শীতল নিঃশ্বাসে বুকের মধ্যে অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে। জায়ান দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে, তাকে দেখে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। তার চোখ লালচে, ক্লান্ত, কিন্তু সেই চিরচেনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রখরতা এতটুকু কমেনি!

‘তুমি এখানে কিভাবে এলে?’

‘ সবাই যেভাবে আসে সেভাবেই এসেছি!’

‘ তুমি এতদূরে একা এসেছো?’

‘ তো? আমি ছোটো বাচ্চা নই!’

‘ আমি এখানে আছি জানলে কিভাবে?’

‘ এতো ক্লান্ত হয়ে সবে এলাম আমি, আর তুমি এখনি প্রশ্নের খাতা খুলে বসলে? দেখি, সরো’

আলিশা জায়ানকে ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, এদিকে জায়ান ভেবে পাচ্ছেনা যার থেকে কিছু সময়ের জন্যে দূরে পালানোর চেষ্টা করছিল সেটাই মেয়েটাই বিনা আমন্ত্রণে এখানে কিভাবে পৌঁছালো? ও কোনো প্রশ্ন করার আগেই আলিশা বললো…

‘ আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে, তার উত্তর আমার কাছে আছে কিন্তু একটু রেস্ট নিতে দাও এখন। জীবনে প্রথমবার এতটা রাস্তা একা জার্নি করলাম, ক্লান্ত লাগছে ‘

আলিশার আকস্মিক আগমনে ছেলেটা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে, তবে চোখে একটা অদ্ভুত কোমলতা খেলে গেলো। যেটা শুধু সে মেয়েটার জন্যই সংরক্ষণ করে রেখেছিলো এতদিন!আলিশা নিজের ব্যাগটা একপাশে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। জানালা দিয়ে দূরের পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। বাতাসে একটা শীতলতা, গায়ে হালকা কাঁপুনি লাগলো তার! একটু ফ্রেশ হয়ে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো মেয়েটা, এরপর লম্বা একটা ঘুম! বিকেল হয়ে গেছে, মেয়েটা এসে থেকেই ঘুমাচ্ছে। জায়ান খাওয়ার জন্যে ডাকতে চেয়েও ডাকতে পারেনি কারণ মেয়েটাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জায়ান চেয়ার টেনে আলিশার কাছে বসলো, মেয়েটা সব ছেড়ে এতদূর ওর জন্যে ছুটে এসেছে? জায়ান স্ত্রীর কপালে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে মৃদু হাসলো….
___________________________________

আলিশার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার কিছু সময় আগে, ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতেই বলে উঠলো…

‘উফ্, কী ঘুমটাই না দিলাম! আমি তো এসেছিলাম জায়ানকে শাসন করতে এদিকে নিজেই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলাম!’

বিছানায় বসা অবস্থাতেই আলিশার চোখ পড়লো ঘরের এক কোণে, জায়ান কফি বানাচ্ছে। আলিশা পা টিপে টিপে পেছন থেকে গিয়ে জায়ানকে জড়িয়ে ধরলো, জায়ান অবাক হলো না বরং স্বাভাবিকভাবেই নিজের কাজ করতে লাগলো’

‘ আবারো কি আমাকে একা ফেলে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিলে?’

‘ আমি আমার বউ ছেড়ে কেনো পালাবো?’

জায়ানের মুখে “বউ” শব্দটা শুনে মুচকি হাসলো আলিশা, বুঝলো জায়ান স্বাভাবিকই আছে!

‘ তাহলে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, তবুও আমাকে ডাকোনি কেনো?’

‘ তুমি আরামে ঘুমাচ্ছিলে, তোমার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। তাছাড়া উঠেই বা কি করতে, বিকেল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, বাইরে যেতে পারতে না ‘

‘ তাতে কি? আমি তো আর এখানে ঘুরতে আসিনি, আমি এসেছি আমার নির্দয় হাসবেন্ডের কাছে যে কিনা বিয়ের পরদিনই তার বউ রেখে ঘুরতে চলে এসেছে’

জায়ান আলিশাকে টেনে নিজের সামনে এনে কিছুটা ধমকে বললো…

‘ তাই বলে তুমি এভাবে একা চলে আসবে? রাস্তায় যদি কোনো বিপদ হতো?’

‘ আচ্ছা সরি, আর করবো না কিন্তু তুমিও আর কেমন কাজ করবে না। দুদিন ধরে কোনো খবরই ছিল না তোমার। জানো আমি কতো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম?’

মেয়েটা যে সত্যিই চিন্তিত ছিলো তা ওর কথা কর্মের মাধ্যমেই জায়ান বুঝতে পারছে, জায়ান মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে। আলিশার এলোমেলো চুলগুলো দুহাতে ঠিক করে দিয়ে ওকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললো। আলিশার জন্যে রুমে আগেই খাবার এনে রেখেছিলো জায়ান, প্লেট দেখেই খেতে বসলো মেয়েটা! সারাদিন বলতে গেলে না খাওয়াই ছিলো। আলিশা খেতে খেতে হুট করে প্রশ্ন করলো…

‘ আচ্ছা এই রিসোর্টে কি কেবল পিকনিক, ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস এসবের জন্যই বুকিং
দেওয়া হয়? নাকি হানিমুন কাস্টমারও আসে?’

জায়ান দু হাত ভাঁজ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একটু ভেবে বললো…

‘ রুম বুক করা নিয়ে কথা, এখন ভেতরে কে কি করবে সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। তোমার যদি হানিমুন কাস্টমার হতে ইচ্ছে হয়, আমার আপত্তি নেই ‘

আলিশা চামচটা ঠোঁটের কাছে হেলিয়ে বললো…

‘ আচ্ছা! তারমানে আমরা এখানে হানিমুন করতেই পারি ‘

জায়ান ভ্রু উচিয়ে তাকালো, ভেবেছিল মেয়েটার ঘুম ভাঙলেই বুঝি নানান প্রশ্নের ফোয়ারা খুলে বসবে কিন্তু ওসব কথা না তুলে আলিশা অন্যকিছু বলছে? হানিমুন করতে চাইছে? জায়ান কিছুটা অবাক হলো…

‘ তুমি হানিমুন করতে চাও?’

‘ উম্ম! হানিমুন মানে তো প্রচুর প্ল্যানের ব্যাপার কিন্তু তেমন প্রস্তুতি তো নিয়ে আসিনি তবে ছোটখাটো একটা হানিমুন সেরে গেলে মন্দ হয় না’

বউ নিজের মুখে আবদার করেছে তা কি জায়ান ফেলতে পারে? ঠিক হলো যে কাল আলিশাকে কোথাও একটা ঘুরতে নিয়ে যাবে। যদিও রাতেই কাছে কোথাও নিয়ে যেত কিন্তু কিছুদিন যাবত এখানে সন্ধ্যা নামলেই বৃষ্টি শুরু হয়, সারারাত বৃষ্টি থেকে ভোরের দিকে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। তবুও রাতে রিসোর্টের ভেতরেই আলিশাকে ঘোরালো জায়ান। আলিশা যথাসম্ভব ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করছে জায়ানের সঙ্গে, জায়ানও কমফোর্ট ফিল করছে। দুজনে অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে আজ। রাতে ঘুমানোর সময় বিদ্যুৎ চমকানোয় আলিশা ভয় পেয়ে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল, জায়ান তখন ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। যেহেতু আলিশা স্বাভাবিক আচরণ করছে, ওর জন্যে এতদূর ছুটে আসতেও দ্বিধা করেনি তাই জায়ানও আর প্রাক্তন সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন করলো না, অপ্রয়োজনীয় আলাপ করে এই মুহূর্তগুলো নষ্ট করার মানেই হয় না!
___________________________________

রাতের বৃষ্টির শব্দ শুনে চোখে ঘুম নামলেও পরদিন ঘুম ভাঙে মিষ্টি পাখির ডাকে আর হালকা রোদে। পাহাড়ি সকালে এক অদ্ভুত রকম প্রশান্তি, যেন সারাটা দুনিয়া থেমে গেছে। আলিশা উঠে বসলেই দেখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জায়ান বাইরে তাকিয়ে আছে। সাদা টি-শার্ট গায়ের ওই চওড়া কাঁধওয়ালা পুরুষটিকে দেখেই সকাল সকাল আলিশার মনে দুষ্টু ভাবনা খেলে গেলো, সে বলে উঠলো…

‘বাহ, এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো ফিল্মের হিরোকে বিছানার পাশেই পেয়ে গেছি। আ’ম ফিলিং সো লাকি ‘

জায়ান ঘুরে হেসে তাকায়…

‘ তারমানে তুমি ফিল্ম বানালে আমি হিরো হবো?’

‘না! তুমি হিরো কেনো হবে? হিরো হলে সবাই তোমার দিকে নজর দেবে তো। তুমি থাকবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো, মানে সবসময় থাকবা, কিন্তু সবার অলক্ষে!

জায়ান হেসে ফেলে। বউয়ের মুখে এমন প্রশংসা শুনতে কোন পুরুষেরই না ভালো লাগবে? নাস্তা শেষ করে সকাল সকালই দুজনে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে। ড্রাইভারসহ একটা জিপে উঠেছে, গন্তব্য। পাহাড়ের এক নির্জন টিলার উপর ছোট্ট একটা স্পট, যেখান থেকে নিচের উপত্যকা দেখা যায়। যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে রঙিন ছাতা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্থানীয় ছোট ছোট বাচ্চারা, হাতে পাহাড়ি ফুল আর খিলখিল হাসি। আলিশা জানালা দিয়ে মুখ বের করে বাতাসে চুল এলোমেলো করে বলে…

‘ প্রথমবার আমার পাহাড়ি এলাকায় আসার অভিজ্ঞতা হলো, অবসর সময় কাটানোর জন্যে দারুন জায়গা’

জায়ান মুগ্ধ চোখে তাকায় ওর দিকে, মেয়েটার হাসি যেনো অদ্ভুত প্রশান্তি বয়ে আনছে ওর মনে।ঘণ্টাখানেক পর গাড়ি থেমে যায়। সামনের খোলা টিলায় সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে, একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পিঠে ব্যাগ রেখে জায়ান বলে….

‘ জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন নিজেকে সময় দেওয়া প্রয়োজন হয়। আমি যখন এমন পরিস্থিতিতে পড়ি, যখন নিজেকে খুঁজে পাই না, তখন এখানে চলে আসি ‘

জায়ানের কথাগুলো শুনে আলিশা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। বাতাসে তার চুল উড়ছে, চোখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি—তবুও ভেতরে যেন কোথাও কিছু না বলা কথা জমে আছে. সে ধীরে ধীরে কাছে এসে জায়ানের পাশে বসে পড়ে, চোখ রেখেছে নিচের সবুজ উপত্যকার দিকে।

‘নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলে তাই এসেছিলে আমি বুঝতে পারিনি। বরং ভেবেছি তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো’

জায়ান পাশ ফিরেই একদৃষ্টে আলিশার দিকে তাকিয়ে থাকলো…

‘এড়িয়ে যাওয়া যদি হতো, তাহলে তোমাকে কিছু না জানিয়েই চলে আসতাম। সবকিছু এতো দ্রুত হয়ে গেছিলো যে আমি কিছুটা কনফিউজড হয়ে গেছিলাম। আফটার অল, বিয়ের মতো এত বড় একটা ঘটনা তো জীবনে প্রথম ঘটলো। আমি একটু সময় চাইছিলাম আলিশা নিজেকে বোঝার জন্য, পরিস্থিতি বোঝার জন্যে। নিজেকে বুঝে না উঠলে কাউকে ভালোবাসাও যায় না ঠিকভাবে ‘

আলিশা কিছু বললো না বরং জায়ানের এই গভীর ভাবনা সম্পর্কে শুনে মৃদু হাসলো। বৃষ্টি নেই, ভেজা মাটি, চারপাশে পাখির ডাক। জায়ান ও আলিশা দুজনেই নিঃশব্দে বসে থাকে কিছুক্ষণ। একটা পাহাড়ি ফুল তুলে আলিশা কানে গুঁজে বলে…

‘জায়ান, চলো না একটা ছবি তুলি ‘

জায়ান নিজের মুড ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো, দেরি না করে দ্রুত ওর ফোন বের করে সেলফি আলিশার সঙ্গে বিবাহিত জীবনের প্রথম ছবিটা তুলেই নিলো যা ছিলো তীব্র, শান্ত আর অসম্ভব জীবন্ত!

চলবে….