তোর রঙে হবো রঙিন পর্ব-০৭

0
40

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৭

খোলা টিলার ওপরে বসে থাকা মানুষ দু’জনের চারপাশটা মোটামুটি নিস্তব্ধই বটে। বাতাস বইছে ধীরে ধীরে। সূর্যের নরম আলো আলিশার চুলে খেলে যাচ্ছে, সেই দৃশ্য দেখে জায়ান এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ফেরাতে পারছে না…

‘ খিদে পায়নি তোমার? চলো কিছু খেয়ে আসি ‘

‘ ভালোভাবে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো এখনও উপভোগই করতে পারলাম না, এখনই চলে যাবো নাকি? ওয়েট!’

আলিশা ব্যাগ থেকে কিছু স্ন্যাকসের প্যাকেট বের করে বললো…

‘ যদিও আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তেমন নেই, তবে খাবার যে লাগতে পারে সেটা আগেই ভেবেছিলাম। তাই স্ন্যাকস নিয়েই এসেছিলাম’

‘ আমি প্রায় দু – তিনবার এখানে এসেছি, কিন্তু প্রতিবারই অপ্রস্তুত হয়ে এসেছি কিন্তু তুমি তো দেখছি প্রথমবারেই একেবারে প্রস্তুত হয়ে এসেছো’

‘ ওহ! এবার বুঝেছি তোমার বাবা কেনো তোমাকে এতো বকাঝকা করে। ইউ আর নট অ্যা কিড এনিমোর জায়ান, এবার তো দায়িত্ব নিতে শেখো’

জায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো…

‘ তুমি হঠাৎ মুরুব্বিদের মতো কথা বলছো কেনো? বউয়ের মত কথা বলো ‘

‘ আমি তোমার মুরুব্বী বউ, হয়েছে এখন?’

একসময় দু’জনেই হেসে উঠলো একসঙ্গে, সেই হাসিতে কেমন একটা ঘনিষ্ঠতার রঙ মিশে যায়। পাহাড়ের নৈঃশব্দ্যে যেনো আলাদা সুর বাজছে তাদের চারপাশে। জায়ান হঠাৎ প্রশ্ন করলো….

‘ আমার বাবা কি তোমাকে কিছু বলেছে?’

‘ উহু, কেউই কিছু বলেনি তবে উনি একটু রেগে আছে তোমার ওপর ‘

‘ এ আর নতুন কি, উনি তো সবসময়ই আমার ওপর রেগে থাকেন’

আলিশা কিছু বললো না, কারণ জায়ানের বাসায় থাকা অবস্থাতেই ও বুঝেছিল যে এনায়েত সাহেব তার ছোটো ছেলের প্রতি কড়া! আলিশা ওই প্রসঙ্গ না তুলে অন্য কথা জিজ্ঞাসা করলো…

‘ তুমি কি মনে করো আমাদের বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেছে?’

জায়ান একটু চিন্তাভাবনা করে বললো…

‘হয়তো, কিন্তু সব হুট করে হওয়া জিনিস খারাপ হয় না সেটা বুঝতে একটু সময় লেগে গেলো আমার ‘

আলিশা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর এক টানে জায়ানের হাতটা ধরলো।

‘জায়ান, আমি তোমাকে সময় দিতে রাজি আছি। কিন্তু আমি চাই না তুমি আর কখনো পালিয়ে বেড়াও। তোমার মনে যদি কোনো কথা থাকে সেটা অবশ্যই আমার সঙ্গে শেয়ার করবে, আমরা উভয়েই যদি একে অপরের দোষগুনগুলো প্রকাশ না করি তাহলে কিভাবে ব্যালেন্স হবে?’

জায়ান ভেবে দেখলো কথাগুলো সঠিক! কোনো বিষয় মনে রেখে গুমড়ে দিন কাটানোর তো মানে হয় না, আলিশার দিকে চেয়ে ও ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালো! দুজনে অনেকটা সময় গল্প করেছে, একে অপরের সম্পর্কে কিছু বিষয় জানারও চেষ্টা করেছে। পাহাড়ি বাতাসে তখন শুধু পাখির ডাক আর হৃদয়ের শব্দ। পাহাড়ের সেই নির্জন টিলা থেকে ফিরে আসতে আসতে রোদ কিছুটা কমে গেছে। আলিশা আর জায়ান দুজনেই ক্লান্ত, কিন্তু মনটা প্রশান্তিতে ভরে আছে। আজকের দিনটা যেন দুজনের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন গড়ে তুলেছে। রিসোর্টে ফিরে এসে আলিশা ফ্রেশ হতে গেলে জায়ান ওর জন্য গরম কফি বানাতে যায়। ছোট ছোট মুহূর্তগুলোতে ওদের বোঝাপড়ার ছায়া পড়ছে। এমন এক পর্যায়ে এসে আলিশা লক্ষ্য করলো জায়ান যেনো কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছেনা…

‘কী হলো? কিছু বলবে?’

‘হুম? না, আসলে তেমন কিছু না। একটা কথা মনে হচ্ছিল’

‘বলো, আমি শুনছি’

জায়ান একটু ইতস্তত করছিলো, কিন্তু আলিশা যে বলেছে কোনো কথা মনে না রাখতে তাই জায়ান বলেই ফেললো…

‘ ডু ইউ স্টিল মিস হিম?’

‘ কার কথা বলছো?’

প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝেছে জায়ান কার কথা বলছে! আলিশা চোখ তুলে তাকাতেই জায়ান বললো…

‘ বিয়ের রাতে নিশান তোমাকে ফোন করেছিলো, তোমার ফোনটা বাজছিল তাই আমি রিসিভ করেছিলাম। বিয়ের রাতে তোমার এক্স তোমাকে ফোন করছে বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি। রাগ হয়েছিলো আমার, এসবের চক্করে যদি তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে ফেলি? সেজন্যেই এখানে চলে এসেছিলাম মুড ঠিক করার জন্যে। আ’ম নট অ্যা পজেসিভ টাইপ পারসন আর তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে এখনই নাক গলানো উচিত নয়। কিন্তু জানিনা কি হয়েছিলো, ওই মুহূর্তে মেজাজ গরম হয়ে গেছিলো। এতো বছরের সম্পর্ক ছিল তোমাদের। জানি সেসব এতো সহজেই তুমি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি শুধু চাইছিলাম তুমি যেটুকু আমার, সম্পূর্ন আমার হয়ে থাকো। সেখানে অন্যকেউ চলে এলে আমি মেনে নেব না’

আলিশা মনোযোগ দিয়ে জায়ানের কথাগুলো শুনলো, মেয়েটার চোখেমুখে এ মুহূর্তে কেবল একটা অদ্ভুত স্থিরতা বিদ্যমান। কি একটা ভেবে আলিশা নিজের ফোনটা আনলো, সিমকার্ড বের করে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই জায়ান উঠে দাড়ালো…

‘এটা কি করলে?’

‘সবকিছু যখন নতুন করে শুরু করেছি তাহলে আর এটা রেখে কি করবো? এমনিতেও এ নাম্বার থাকলে ওই ঠকটা আবার ফোন দেবে ‘

আলিশা ফোনটা টেবিলে রেখে এসে জায়ানকে জড়িয়ে ধরে বললো…

‘ থ্যাংক ইউ জায়ান, তোমার মনের কথা আমাকে বলার জন্যে। নাহলে আমি ভাবতাম তুমি হয়তো এই বিয়েটা নিয়ে সন্তুষ্ট না তাই আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ ‘

জায়ান উত্তর দিলো না বটে তবে আলিশার স্বস্তি ও নিজে অনুভব করতে পারছে। মেয়েটা হয়তো সত্যিই এ কয়দিন দারুন চিন্তায় কাটিয়েছে। আলিশা আশ্বাস দিয়ে বললো…

‘তুমি আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জায়ান, আর তোমার জায়গায় কেউ কোনোদিন আসবেনা’

এ কয়দিন যে দোটানায় ভুগছিল তা দুর হতেই জায়ান যেনো ভরসা পেলো, আলিশার কপালে চুমু খেয়ে পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে নিলো নিজের সঙ্গে এবং মনে মনে ঠিক করলো এরপর থেকে আলিশার প্রতি সম্পুর্নভাবে বিশ্বাস রাখবে।
________________________________

পাহাড়ি বাতাস তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আলোর সঙ্গে মিশে গেছে। সূর্য একবার ঢলে পড়েছে দিগন্তের আড়ালে, চারপাশটা যেন কমলা ও বেগুনি রঙে ডুবে আছে। আলিশা আর জায়ান দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট কাঠের ব্রিজের উপর, নিচে পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দ যেন হৃদয়ের সাথে তাল মেলাচ্ছে…

‘এটাই শেষ সন্ধ্যা এখানে, কালকে আবারো ফিরে যেতে হবে কোলাহল পূর্ন চেনা শহরে। মিস করবো এই জায়গাটাকে ‘

‘তোমার কি মন খারাপ লাগছে?’

আলিশা মৃদুভাবে মাথা নেড়ে জায়ানের কাঁধে মাথা রাখলো…

‘ এখানে কি অদ্ভুত শান্তি তাইনা? এখানে আমরা ছাড়া কেউ নই, শুধুই তুমি আর আমি। আমার না এমন শান্ত জায়গা ভীষণ ভালো লাগে ‘

‘ ফাইন, এরপর তাহলে আবারো আমরা আসবো ‘

পাহাড়ি সন্ধ্যার শান্ত ছায়া ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে, দুজনে ততক্ষণে রিসোর্ট ফিরে এসেছে। দুজনে মিলে পপকর্ন নিয়ে মুভি দেখতে বসেছিলো তখনই জানালায় হঠাৎ টুপটাপ শব্দ হলো। আলিশা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো বাইরে। অন্ধকার পাহাড় আর ঝাপসা আলোর ভেতর ধীরে ধীরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে!

‘জায়ান, বৃষ্টি নামছে!’

জায়ান তখন বিছানায় আধশোয়া, পপকর্নের প্যাকেট পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো, জানালার পাশে এসে আলিশার পাশে দাঁড়ালো…

‘এই তো, আজ আমাদের ট্রিপের শেষ রাত, আর প্রকৃতি নিজেই একটা গিফট দিলো ‘

আলিশা হঠাৎ চোখ বড় করে বললো…

‘চলো, বাইরে যাই!’

‘বৃষ্টিতে ভিজতে চাও?’

‘হ্যাঁ! সবসময় শুধু জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখেছি, এবার একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই।

জায়ান প্রথমে একটু দ্বিধা করলেও, আলিশার টান উপেক্ষা করতে পারেনি। দু’জনেই ছুটে বেরিয়ে পড়লো রিসোর্টের ওপাশে থাকা ছোট্ট খোলা জায়গাটায়। চারপাশে ঝমঝম বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাস আর অন্ধকার পাহাড় ঘিরে রেখেছে তাদের। আলিশার ভেজা চুল ঘাড়ের পাশে লেপ্টে আছে, গায়ের কাপড় পানিতে ভিজে গিয়ে আরও গাঢ় হয়ে গেছে। জায়ান ভেতরে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে, যেন এই দৃশ্যটা সারাজীবন মনে রাখতে চায়। আলিশা জোরে বলে উঠলো…

‘কখনো কখনো নিজের ভেতরের পাগলামিটাকেও প্রশ্রয় দিতে হয়, তাই না? ইশ! বৃষ্টিতে ভেজার যে এত আনন্দ কোনোদিন অনুভবই করতে পারিনি ‘

আলিশা এবার দুই হাত ছড়িয়ে ঘুরতে লাগলো বৃষ্টির ভেতর। গায়ে ভেজা কাপড়ের ভার, ঠান্ডা বাতাসের কাঁপুনি, তবু ওর মুখে কেমন এক শান্তি।জায়ান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। অপছন্দের বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ধীরে ধীরে কাছে এসে আলিষকে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তটা যদি ধরে রাখা যেতো কতই না ভালো হতো! দুজন একসঙ্গে কিছুক্ষণ বৃষ্টিবিলাস করলো। তাদের নিঃশ্বাসে তখন শুধু বৃষ্টির ঘ্রাণ, শরীরী কম্পন যার আড়ালে হয়তো তৈরি হচ্ছে মৃদু অনুভূতি! বৃষ্টির গতি বাড়তেই দুজনই রুমে ফিরে এলো। চুল ভেজা, শরীর কাঁপছে। জায়ান বাধ্য হয়ে হিটার অন করলো, তোয়ালে এগিয়ে দিলো আলিশাকে। একে অপরের যত্নে, আদরে ওরা যেন আরও গভীরে বাঁধা পড়লো। এ রাতে আর কোনো কথা নেই, শুধু চোখে চোখ রাখা, গায়ে গায়ে এক হালকা প্রশান্তি!
____________________________________

পরদিন, সকালে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে দুজনে একটা পাহাড়ি বাজারে ঢুকলো। রঙিন দোকান, কাঠের ছোট ঘর, আর পাশে হালকা কুয়াশার মতো ধোঁয়া যেন পুরো পরিবেশটা এক রহস্যময় শান্তিতে ভরিয়ে রেখেছে। আলিশার চোখ ছুটে গেল একটা দোকানে। টেরাকোটা ও কাঠের তৈরি হস্তশিল্প, বোনা ব্যাগ, এবং হাতে আঁকা শাড়ির দিকে! এনায়েত সাহেবের জন্যে একটা পাঞ্জাবি, কাবেরী বেগমের জন্যে হালকা রঙের পাহাড়ি জামদানি শাড়ির মতো এক প্রকারের তাঁতের শাড়ি, ও সায়নের জন্যে হাতে বানানো বাঁশের কলমদানি ও কাঠের পেন সেট কিনলো আলিশা। সঙ্গে মিষ্টি শুকনো ফলের একটা প্যাকেট, দোকানদার বলেছে এগুলো এখানকার ফার্ম থেকে আনা হয়। এছাড়া নিজেদের জন্যে জায়ান একটা হ্যান্ডক্রাফটেড কাপল মগ কিনে নিলো। এসব কেনাকাটা শেষে এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যায় পাহাড়ি হাওয়ার ছোঁয়া, বৃষ্টিভেজা রাত, আর নিঃশব্দ ভালোবাসার মেঘগুলো ফেলে আলিশা আর জায়ান ফিরে এলো শহরে। গাড়ির জানালা দিয়ে আলিশা তাকিয়ে আছে, শহরের চেনা ভিড়, কোলাহল, ধোঁয়া যেন একটুখানি ভার চাপিয়ে দিচ্ছে ওর শান্ত মনটাতে। কিন্তু সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে এটা ভেবে উভয়েরই মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেছে

চলবে….