#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১০
দিন বয়ে চলেছে আপন গতিতে, শ্বশুরবাড়ি – স্বামী – সংসার ও জব সব মিলিয়ে আলিশার মনে হয় সে জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিনগুলো পার করছে। ওর চাকরি যেদিন নিশ্চিত হলো সেদিন ওর থেকেও বেশি খুশি হয়েছিল জায়ান, কাজের প্রথমদিন আলিশাকে সে অফিসেও দিয়ে গেছে। চেনা জায়গায়, চেনা লোকেদের মাঝে দু বছর পর ফিরে যেতে পেরে আলিশাও ভীষণ খুশি। সৃষ্টিকর্তার কাছে মাঝে মাঝে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যে উনি জায়ানের মতো কাউকে জীবনে এনে দিয়েছে নাহলে হয়তো এ জীবন এতো সহজ লাগতো না, এতো সুন্দর হতো না! ওদিকে জায়ানদের স্টুডিওর সঙ্গে একটা বড় অর্গানাইজেশন কোলাব করার অফার করেছে, জায়ান প্রথমে ইতস্তত করে কিন্তু টিমের সবার সাপোর্টে কাজ করতে আগ্রহ দেখায়। জায়ান এখনও এই কাজের কথা আলিশার কাছে প্রকাশ করেনি, এমন নয় যে সে গোপন রাখতে চায় কিন্তু অজানা কোনো কারণবশত গোপন রেখেছে আর যতদিন রাখতে পারবে রাখবে। এক সন্ধ্যায়, ওরা দুজনে মুভি দেখতে যাবে বলে ঠিক করে। জায়ান ওয়াশরুমে ছিলো তখন ওর কল আসে, কল রিসিভ করেই মেয়ের কণ্ঠ পেলো আলিশা…
‘ জায়ান, একবার আসতে পারবি?’
মেয়েলি কণ্ঠ শুনে ভ্রু কুচকালো আলফা..
‘ কে বলছেন?’
এলিনা তৎক্ষণাৎ বুঝলো জায়ানের স্ত্রী ফোন ধরেছে, ও সালাম দিয়ে বললো…
‘ আমি এলিনা বলছিলাম, জায়ান এলে ওকে আমাকে কলব্যাক করতে বলবেন। কাজের ব্যাপারে ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে ‘
মেয়েটা খুব তাড়াহুড়োয় কল কেটে দিলো, জায়ান বেরোনোর পরই আলিশা ওকে জানালো কেউ ফোন করেছিল। জায়ান যখন কল চেক করে দেখার পর গোমড়া মুখে আলিশা প্রশ্ন করে….
‘ মেয়েটা কে ছিলো?’
‘ আমার ফ্রেন্ড!’
‘ ফ্রেন্ড নাকি গার্লফ্রেন্ড?’
আলফাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে হাসলো জায়ান…
‘ বউ কি আমাকে সন্দেহ করছে?’
‘ নো, এই ট্রাস্ট ইউ! কিন্তু কাজের ব্যাপারে কিসের কথা বললো, কি কাজ করো তোমরা?’
জায়ান নিরব রইলো, সামনের বড় প্রজেক্টটা শেষ হলে ওর কাজের বিষয়টা আলিশার কাছে ও প্রকাশ করবে বলে ঠিক করেছিলো। এখন কি আগেই রিভিল করে দিতে হবে? ভেবে পেলো না জায়ান, আলিশার দিকে চেয়ে ও কোনো কথা বললো না দেখে আলিশা খানিকটা অস্থির হয়ে বলে উঠলো…
‘ এই, তুমি আবার বাবার কথায় হার্ট হয়ে কোনো অবৈধ কাজে জড়িয়ে যাওনি তো?’
আলফার এহেন কথা শুনে আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারলো না জায়ান, উচ্চস্বরে হেসে আলফার কপালে একটা টোকা দিয়ে বললো…
‘ এসব উল্টোপাল্টা কি ভাবতে শুরু করেছ? আমাকে ক্রি’মি’নাল মনে হয় নাকি তোমার?’
‘ মানুষের বাইরের রূপ দেখে কি আর ভেতরের রূপ বোঝা যায়? একটা কথা জেনে রেখো, তুমি যেমনি আছো তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কে কি বললো তাতেও আমার কিছু যায় আসেনা’
জায়ান কিছু একটা ভেবে দু হাত পেছনে নিয়ে আলফার দিকে কিছুটা ঝুঁকে ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো…
‘আচ্ছা, যদি কখনো জানো আমি তোমার থেকে বড় কোনো বিষয় গোপন করেছি তখন কি করবে?’
‘ সত্যিই কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে?’
জায়ান আর কিছু বললো না তবে এই সুযোগে আলফার এই সন্দেহবাদী দিকটার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে। সিনেমা দেখতে যাওয়ার পথেও অনেকবার আলফা প্রশ্ন করেছে কিন্তু সিনেমা হলে যাওয়ার পর ওসব ভাবনা ভুলে গেছিলো মেয়েটা। একটি রোমান্টিক-কমেডি ধাঁচের মুভি দেখেছে ওরা, প্রথমবারের মতো কাপল হিসেবে মুভি দেখতে এসে অনেক মজা করেছে দুজনে। সিনেমা থেকে বেরোনো সময় কাকতালীয়ভাবে নিশানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো আলফার! নিশান ওকে দেখে চমকে উঠলেও আলফার মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া নেই। যে মানুষটাকে এক নজর দেখার জন্যে বুক ছটফট করতো তাকে দেখে আজ বিন্দুমাত্র অনুভূতি কাজ করছেনা মেয়েটার মনে। নিশান এক নজর জায়ানের দিকে চাইলো…
‘ আলফা, তুমি এখানে?’
জায়ানের বাহু ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে একগাল হেসে বলে…
‘ হাসবেন্ডের সঙ্গে এসেছি, জায়ান মিট মাই এক্স!’
এই সেই নিশান? জায়ানের মুখ শক্ত হয়ে গেলো! আলফার মন ক্ষত বিক্ষত করা সেই মানুষটির সঙ্গে অবশেষে দেখা হলো কিন্তু তার সঙ্গে আলাপ বা পরিচিত হওয়ার কোনো কারণই তো নেই! এরই মধ্যে নিশান মুখ ভার করে বললো…
‘ তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে চাইছিলাম, কিন্তু সেসময় আমার পরিস্থিতি সুবিধার ছিলো না। তোমার হয়তো মনে হয় আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি কিন্তু বিশ্বাস করো কষ্ট দিয়ে আমিও ভালো নেই ‘
প্রাক্তনের কথা শুনে আলফা নিজের হাসি থামিয়ে রাখতে পারলো না! কটাক্ষ করে বললো…
‘এই দেখেছো জায়ান? তোমাকে আগেই বলেছিলাম না আমার প্রাক্তন ভীষণ আবেগী? দেখো, দেখা হতেই আবেগ দেখানো শুরু করে দিয়েছে’
নিশানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জায়ান বললো
‘আপনি ভালো থাকুন আর নাই থাকুক, আমার স্ত্রী অনেক ভালো আছে। তাছাড়া অতীতের জন্যে ক্ষমা চাইলেও আর কিছু বদলাবে না। ওইসব নিয়ে আলোচনা না করাই উত্তম ‘
নিশান কি একটা ভেবে বললো…
‘ আমরা কি আলাদা একটু কথা বলতে পারি আলিশা?’
‘নো থ্যাংকস! তোমার সঙ্গে আলাদা গিয়ে আলাপ করার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু বউ কোথায় তোমার? একা একা সিনেমা দেখতে এসেছো নাকি বউকে না জানিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে এসেছ? তোমার তো আবার ধোঁকা দেওয়ার অভ্যাস’
‘ আলফা, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আমি জানি তোমার সঙ্গে যেটা হয়েছে অন্যায়, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি…’
আলফাকে পুরোনো দিনগুলো মনে করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে চাইছিল নিশান কিন্তু আলফা তার সুযোগই দিলো না…
‘ আরে নাহ! তুমি আমার সঙ্গে এই অন্যায় করে ভালোই করেছো নাহলে আমি এমন একটা হাসবেন্ড পেতাম না। আমাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। জায়ান, চলো কিছু খাবো। খুদা লেগেছে ‘
নিশান আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু আলফা এমনভাবে ওকে ইগনোর করলো যেনো ও অদৃশ্য! নিশান ভেবেছিল এই মেয়েটা বুঝি ওকে ছাড়া অচল হয়ে পড়বে কারণ ওর প্রতি আলফা খুবই দূর্বল ছিলো কিন্তু আজ আলফাকে নিজের স্বামীর সঙ্গে এতো আনন্দে দেখে ওর সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ে গেলো। আলফাকে আগে দিয়ে জায়ান একটু দাঁড়ালো। নিশানের কাঁধ সর্বশক্তি দিয়ে নিজের হাতটা চেপে ধরে শীতল হেসে বললো…
‘ ডোন্ট এভার ট্রাই টু কনট্র্যাক্ট ইউথ হার অ্যাগেইন, ভবিষ্যতে কোনোদিন যদি আবার ওর আশেপাশে আসার চেষ্টা করতে দেখি তাহলে আমাদের আবার দেখা হবে কিন্তু তার রেজাল্ট ভালো হবেনা। আন্ডারস্ট্যান্ড?’
নিশান দীর্ঘশ্বাস ফেললো…
‘ মাঝে মাঝে পরিস্থিতির চাপে পরে অনেককিছুই করতে হয়, আমার আলিশাকে ছাড়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু আমি বাধ্য ছিলাম। পরিবারের চাপে পরে আমি…’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো জায়ান…
‘ চার বছরের সম্পর্ক ছিল শুনেছি, পরিবারের চাপ কখনো এতদিনের সম্পর্ক ভাঙার কারণ হতে পারে না। ইউ আর অ্যা কাওয়ার্ড, তাই এইরকম লেইম এক্সকিউজ দিচ্ছিস! প্রকৃত পুরুষ কখনো এসব ঠুনকো কারণের জন্যে তার ভালোবাসার মানুষকে একা ফেলে চলে যায়না ‘
নিশান কিছু বলতে পারলো না, ওই মুহূর্তে সত্যিই নিজের পরিবারের ভয়ে আলিশাকে ছেড়েছিল সে। যদিও পরে আফসোস করেছে কিন্তু ততদিনে যে অনেক দেরি হয়ে গেছিলো। জায়ান আসছেনা দেখে আলিশা কিছুটা দুর থেকে জোড়ে ওর নাম ধরে ডাকতেই জায়ান ছুটে চলে যায়।
‘ দুজনে কি নিয়ে আলাপ করছিলে?’
‘ নাথিং! লেটস গো ‘
দুজনে হাতে হাত রেখে কোনো একটা বিষয় নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো, দুর থেকে সেই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশান। পরিবারের ভয়ে পিছিয়ে না গেলে আজ হয়তো আলিশা ওর সঙ্গে থাকতো!
____________________________________
আজ দুজনে মিলে বাইরে ভালো একটা সময় কাটিয়েছে, কিন্তু বাসায় ফেরার পর থেকেই জায়ান নিশানের বিষয় নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে শুরু করেছে!
‘ তোমার ভাষ্যমতে ওই ছেলে সবসময়ই নিজের মা বাবাকে এতো ভয় পেতো। তারমানে ভবিষ্যতে পরিবারের কথা শুনে ছেলেটা তোমায় ছেড়ে যেতে পারে এটা ভাবোনি?’
আলিশা আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়ানোয় ব্যস্ত ছিলো, জায়ানের কথা শুনে ওর নিজের অতীত কর্মের ওপরই রাগ উঠছিল…
‘ আরে আমিই তো সবসময় ওর জন্যে স্ট্যান্ড নিতাম, ভেবেছিলাম আমি পাশে থাকলে সাহস পাবে কিন্তু ও যে এত্ত ভীতু ভাবতেই পারিনি। ছেলেমানুষ এতো ভীতু হয় জানা ছিলোনা’
‘ তোমার আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, এমন ছেলেরা বিশ্বাসযোগ্য হয় না ‘
‘ প্রেমে পড়লে মানুষ অন্ধ হয়ে যায় বুঝলে, তখন ভালোমন্দের বোধ থাকেনা। তুমি ওসব বুঝবেনা ‘
দুজনে যখন এসব আলোচনায় ব্যস্ত ছিল তখনই দরজায় টোকা পড়লো, আলিশা দরজা খুলতেই দেখলো সায়ন এসেছে…
‘ ভেতরে আসতে পারি?’
‘ অবশ্যই, আসুন ভাইয়া ‘
সায়ণকে নিজের ঘরে দেখে জায়ান একপ্রকার চমকেই উঠলো! সায়ন এক নজর জায়ানের দিকে চেয়ে পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে বসে বললো, তার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট…
‘ তোর সঙ্গে কথা আছে ‘
জায়ান শোয়া থেকে উঠে বসে একটু ভাব দেখিয়ে বললো…
‘ আমি যেখানে থাকি তার ধারের কাছে তো তোকে দেখা যায়না, আজকে হঠাৎ আমার সঙ্গে কি কথা?’
জায়ানের পিঠে হালকা চাপর মে’রে ইশারায় আলিশা ওকে থামতে বললো…
‘ কি হয়েছে ভাইয়া? আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে ‘
‘ হ্যাঁ, একটা বিষয় নিয়ে একটু চিন্তিত আছি। তার জন্যে তোর হেল্প প্রয়োজন জায়ান ‘
এ কথা শুনে জায়ান আরো অবাক হলো, কয়েক মুহূর্তের জন্যে নিজের কানকেই যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল ওর…
‘ হোয়াট! দ্যা গ্রেট সায়ন আমার কাছে হেল্প চাইছে? সূর্য আজ কোনদিক থেকে উদয় হলো?’
জায়ান মজা নিচ্ছে দেখে সায়ন রেগে গেলো…
‘ জায়ান স্টপ ইট! একটা সিরিয়াস কথা বলছি ‘
‘ হেল্প চাইছিস আবার ভাব দেখাচ্ছিস? হেল্প চাইতে হয় অনুনয় করে, রিকোয়েস্ট করে। রিকোয়েস্ট কর আমায় ‘
সায়ন এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে ছিলো, নিজের সব ইগো একদিকে রেখে সাহায্য চাইতে এসেছিলো কিন্তু জায়ানের কথা শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেলো ওর। আর কথা না বাড়িয়েই উঠে চলে গেলো!
চলবে…