তোর রঙে হবো রঙিন পর্ব-১৪

0
23

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৪

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আলিশা, কিছুতেই ঘুম আসছেনা। নিশানের সঙ্গে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় আশেপাশের মানুষ বা পরিচিতদের কথায় নিজেকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করলেও জায়ানের সঙ্গে বিয়ের পর সেসব প্রায় ভুলেই গেছিলো কিন্তু সন্ধ্যায় আসা ওই ভদ্রমহিলার কথাগুলো শোনার পর আবারো এমন ফিল হচ্ছে। জায়ান ওর দিকে ফিরে ঘুমাচ্ছিল, আলিশা জায়ানের দিকে কাত হয়ে শুয়ে ওর গালে হাত রাখতেই জায়ান অর্ধ চোখ মেলে তাকালো…

চমকে উঠলো আলিশা — ‘তুমি জেগে আছো?’

জায়ান ওর পেটের ওপর দিয়ে হাত রেখে বললো…

‘আপনি এতো নড়াচড়া করলে আমি ঘুমাবো কিভাবে?’

‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?’

‘ বলো ‘

‘আমাকে তো তুমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলে, বলা যায় আমিও একপ্রকার তোমাকে জোর করেছিলাম। তুমি তো বিয়ে করতে চাওনি। এই সম্পর্ক নিয়ে তোমার কোনো অভিযোগ আছে?’

জায়ান এবার ভালোভাবে চোখ মেললো, ওই মহিলার কথার পরিপ্রেক্ষিতেই যে আলিশা এমন প্রশ্ন করছে তা ওর বুঝতে বাকি রইলো না। জায়ান আলিশাকে টেনে ওর গলার মধ্যে মুখ গুঁজে বললো…

‘ হুমম, অভিযোগ আছে ‘

এ কথা শুনে আলিশার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এলো!

‘ কি অভিযোগ?’

‘তোমার সঙ্গে আমার আরো আগে দেখা বলে ভালো হতো, তাহলে আমাদের আরো আগেই বিয়ে হয়ে যেতো আর আমি তোমার সঙ্গে আরো বেশি সময় ধরে একসঙ্গে থাকতে পারতাম ‘

‘ এটা তোমার অভিযোগ?’

‘ হুমম!! তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে এটাই তো অনেক নাহলে সেসময় আমি যেমন ছিলাম, তোমার জায়গায় অন্য কতো মেয়ে দেখা করতে এলে নির্ঘাত রিজেক্ট হতাম ‘

জায়ানের কথা শুনে আলিশা থ মেরে গেলো, ও আরো চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল যে কি অভিযোগ করবে সেখানে জায়ান এমন অভিযোগের কথা বললো যে হাসবে না কাঁদবে মেয়েটা ভেবে পাচ্ছেনা! মেয়েটা দুম করে পিঠে একটা কিল মারতেই জায়ান মুখ বের করে ভ্রু কুঁচকে তাকালো…

‘ কি হলো!’

‘এমন এমন কথা বলো না মাঝে মাঝে, চিন্তায় ফেলে দাও আমায়, আমি আরো ভাবলাম…যাই হোক, ছাড়ো ওসব আমার অফিস থেকে পিকনিকে যাচ্ছে সবাই। আমাকেও যেতে বলছে, কি করবো?’

‘ উম্ম! তোমার যাওয়া উচিত কারণ এমন প্রোগ্রামে প্রায় সকলে উপস্থিত থাকে আর এই সুযোগে সবার সঙ্গে আরো ভালোভাবে কথা বলে পরিচিত হওয়া যায়’

‘ বলছো? তাহলে যাবো ‘

‘ কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে, ছেলে কলিগদের সঙ্গে হেসে কথা বলা যাবেনা আর ছবি তুললেও সিঙ্গেল তোলা যাবেনা। তুমি গ্রুপ ফটো তুলতে পারো তাতে সমস্যা নেই ‘

‘আর যদি তুলি কি করবে? গিয়ে ছেলেদের মা’রবে?’

‘আমাকে কি গু’ন্ডা মনে হয় তোমার? ওদের কিছু বলবো না, আমি তোমাকে সোজা ওখান থেকে তুলে নিয়ে আসবো’

সন্ধ্যার পর থেকে ভার হওয়া মনটা জায়ানের এসব কথা শুনে নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো। আলিশা নিঃশব্দে হেসে জায়ানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে বললো..

‘আচ্ছা, হয়েছে! ঘুমাও এবার ‘

জায়ানও সুযোগ পেয়ে বাচ্চাদের মতো আলিশার ওপর দিয়ে হাত পা তুলে ঘুমাতে শুরু করলো। পূর্বে ঘুমের মাঝে কেউ ছুয়ে দিলেও আলিশার বিরক্ত লাগতো কিন্তু এখন জায়ান রীতিমত ওকে কোলবালিশ বানিয়ে ঘুমায় তাও আলিশার অভিযোগ নেই। কারণ ওর সকল খুশির কারণ, চিন্তার অবসান, সব সমাধান এই একজনই “জায়ান”! পরেরদিন…সায়নের কেবিনে এসেছে মেঘনা, ডেস্কের কোণে অনেক ফাইলের স্তূপ! সেগুলো দেখিয়ে সায়ন বললো…

‘এখানে গত তিন বছরের কোম্পানির সব ডিল সম্পর্কিত ফাইল আছে, এর মধ্যে যেগুলো অপ্রয়োজনীয় সেগুলো সরিয়ে ফেলুন আর প্রয়োজনীয়গুলো গুছিয়ে স্টোররুমে রেখে দিন ‘

‘ জ্বি স্যার ‘

মেঘনা ফাইলগুলো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, অনেকগুলো হওয়ায় হাত থেকে ফস্কে যাচ্ছিলো দেখে সায়ন বললো…

‘অনেকগুলো ফাইল এখানে, নিয়ে যেতে সমস্যা হবে। আপনি এখানে বসেই কাজ করুন’

মেঘনা কিছু বলবে তার আগেই সায়ন নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে মেঘনার জন্যে চেয়ার টেনে দিলো..

‘ সমস্যা নেই স্যার, আমি নিয়ে যেতে…’

মেঘনার দু কাঁধ ধরে ওকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের স্থানে গিয়ে বসলো সায়ন। একটু পরে মেঘনার আরেক কলিগ কোনো এক দরকারে এসেছিলো সায়নের কাছে, যাওয়ার সময় সে আড়চোখে মেঘনার দিকে তাকিয়েছিল এটা আবার মেঘনা লক্ষ্য করেছে। কলিগ বেরিয়ে যাওয়ার পরেই মেঘনা বললো…

‘স্যার, প্লিজ! আপনি যদি এমন করতে থাকেন তাহলে এখানে কাজ করাটা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে ‘

‘আপনাকে আনকমফোর্ট ফিল করানো আমার উদ্দেশ্য নয় মেঘনা, আপনার সমস্যা হবে তাই ভেবেই…’

‘ আমি জানি এটা আপনার উদ্দেশ্য নয় ‘

সায়ন এবার নড়েচড়ে বসলো…

‘ আপনি তো জানেনই সব, তাহলে আর লুকিয়ে লাভ নেই। আমি শুধু একটা বিষয়ের স্পষ্ট উত্তর জানতে চাইছি। কেনো আমাকে পছন্দ নয়?’

‘ কারণটা আমি আপনাকে বলেছি স্যার ‘

‘ ওইটা কোনো কারণ হতে পারেনা ‘

‘ ঐটাই কারণ, আপনি আমার বস আমি আমার সেক্রেটারি এর থেকে বেশী আমি চাইনা আমার সম্পর্ক এগোক’

‘ কিন্তু আমি চাই আমাদের সম্পর্ক এগোক, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এই অফিসে অনেক মেয়েই আছে যারা আমাকে পছন্দ করে। সেখানে আমি আপনাকে পছন্দ করি, আপনিও আমাকে এতদিন ধরে দেখছেন। আমার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি হিসেবে মোটামুটি আমার সম্পর্কে সবই জানেন তাহলে সমস্যা কোথায়?’

‘ আমি আপনার সম্পর্কে খোঁজ রেখেছি কারণ সেটা আমার দায়িত্ত্ব ছিলো ‘

‘ আমিও আপনার সম্পর্কে জানতে চাই, কিন্তু আপনি আমাকে সুযোগই দিতে চাইছেন না ‘

‘ কারণ আমার জীবন অতো সুন্দর নয়। আর আমার জীবনে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই যা আপনার জানা প্রয়োজন। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমি একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্যে লড়াই করছি সেখানে আপনি… দেখুন আপনার আর আমার মাঝে আকাশ জমিনের ফারাক, আপনি কেনো আপনার সুন্দর জীবনটা আমার সঙ্গে জড়িয়ে নষ্ট করতে চাইছেন?’

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ মেঘনার চোখদুটো পানিতে টলটল করতে শুরু করলো, দু ফোঁটা জল গাল গড়িয়ে ইতিমধ্যে পরেও গেছে। হতবিহ্বল হয়ে পড়ল সায়ন…

‘ মেঘনা, আমি..’

মেঘনা দ্রুত চোখ মুছে উঠে দাড়ালো…

‘ আমি এগুলো সব গুছিয়ে দিয়ে যাবো ‘

ফাইলগুলো কোনরকম হাতে নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো মেঘনা, সায়ন যেনো দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ল। সায়নের মনে হলো মেঘনা যেনো ইন্ডিরেকটলি বলে গেলো যে ও সায়নকে নিজের প্যাথেটিক জীবনে জড়াতে চায়না। তারমানে কি ওর পারিবারিক কোনো সমস্যা আছে? সায়ন কোনোদিন মেঘনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি কিন্তু আজ হঠাৎ ওর মনে আগ্রহ জন্মাচ্ছে, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে মেঘনাকে! আজ একটা আউটডোর শ্যুটার জন্যে গেছিলো সবাই। সেখান থেকে আবার প্রয়োজনীয় সবকিছু রাখতে স্টুডিওতে ফিরেছিল সবাই। এখান থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর জায়ান আবার ঘুরে আসে, ভবনের দারোয়ানের কাছে খোজ নিয়ে জানতে পারলো দু – তিন সপ্তাহ আগে এক ছুটির দিনে ওদের টিমের এক মেম্বার কবির অফিসে এসেছিলো। সাধারণত ছুটির দিন স্টুডিওতে ওদের কাজ থাকেনা আর বিশেষ কোনো কাজ থাকলেও ছুটির দিন সেটা বিকেলে করে। সকালে কবির এখানে কেনো এসেছিলো এটা নিয়ে সন্দেহ হলো জায়ানের। তারমানে কি কবিরই ওর স্ক্রিপ্ট চুরি করেছে? জায়ান কাউকে কিছু বলেনি তবে ওর সন্দেহ কবিরের দিকেই রইলো! আজ আলিশার অফিস থেকে পিকনিকে যাওয়ার দিন, অফিস থেকেই বাস ঠিক করা হয়েছে। সবাই অফিস থেকে বাসে উঠলেও যাওয়ার পথে আলিশাকে বাড়ির কাছ থেকেই তুলে নেয়। জানালার পাশের সিটে বসেছে আলিশা, জায়ান বাইরে থেকে বললো…

‘ আনন্দ করার চক্করে আবার না খেয়ে থেকো না ‘

‘ এমনভাবে বলছো যেনো আমি পাঁচ বছরের বাচ্চা আর নিজের টিফিন খেতে ভুলে যাবো?’

‘ বয়স কত তোমার হ্যাঁ? বাচ্চাই তুমি, যেটা বললাম মনে রেখো। আর কোথাও থাকলে তার পাড়ে যেও না ‘

জায়ান বাচ্চাদের মত আলিশাকে বোঝাচ্ছে আর বাসের সবাই তা দেখে মজা নিচ্ছে, এক পর্যায়ে আলিশা লজ্জায় পড়ে গেলো। পাশ থেকে এক মেয়ে মুখ চেপে হেসে বললো…

‘ তোমার হাসবেন্ড তো অনেক কিউট আলিশা ‘

জায়ান নিজের প্রশংসা শুনে নিজেই উত্তর দিলো!

‘ থ্যাংক ইউ!’

বাসের সবাই ওদের নিয়ে চর্চা শুরু করলো ততক্ষণে বাস ছেড়ে দিয়েছে। আলিশা জানালা দিয়ে জায়ানকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। স্ট্যান্ড থেকে আলিশাকে বাসে তুলে দেওয়ার পর হেঁটে বাসার দিকে যাচ্ছিল, রাস্তায় সায়নের সঙ্গে দেখা। ছুটির দিন হওয়ায় একটু দেরিতে হাঁটতে বেরিয়েছিলো। সকাল সাতটায় জায়ানকে রাস্তায় সায়ন কিছুটা অবাক হলো কারণ নয়টার আগে ও ঘুম থেকে ওঠেনা!

‘ তুই মর্নিং ওয়াক শুরু করলি কবে থেকে?’

‘ সকালের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ওসব মর্নিং ওয়াক আমার দ্বারা হবেনা। নেহাৎ বউ আমার আজ পিকনিকে যাচ্ছে, তাই সকালে উঠেছি। ওকে মাত্র বাসে তুলে দিলাম’

‘ সারাদিন কি বউ বউ করিস? নাম ধরে তো বলতে পারিস। বউ বললে চাইল্ডিশ শোনায়!

‘এটার একটা আলাদা মজা আছে, তুই বুঝবি না। আমার কথা ছাড় তোর খবর বল, কতদূর এগোলো?’

সায়ন কিছু না বলেই যখন হাঁটা দিলো জায়ান বুঝে গেছে তার ভাইয়ের প্রেমের চাকা এখনও কাঁদায়ই আটকে আছে! বিরক্ত হলো জায়ান!

‘তোর দ্বারা কিছু হবেনা, মেয়েটার বাসার ঠিকানা আছে তো? আমাকে দে, আমি লোক লাগিয়ে সব খবর বের করে আনছি ‘

সায়ন রেগে গেলো! — ‘তুই একটা মেয়েকে স্টক করবি? এটা কোন ধরনের ভদ্রতা ‘

‘আমি তোর সাহায্য করতে চাইছি আর তুই উল্টো আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস? কতদিন ধরে তুই এভাবে ঘুরছিস কোনো ব্যবস্থা করতে পেরেছিস? সব জায়গায় দম্ভ কাজ করেনা বুঝেছিস?’

সায়নের কোনো রেসপন্স না পেয়ে জায়ান চলে যেতে যাচ্ছিলো, তখনই সায়ন বলে উঠলো…

‘এমনকিছু করিস না যাতে ওর সমস্যা হয় ‘

জায়ান ঘুরে তাকালো, গত আটাশ বছরেও যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারেনি তা হয়তো এখন বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। জায়ান মৃদু হাসলো…

‘ তুই আমার সাহায্য নিতে রাজি হবি ভাবিনি ‘

সায়ন গলা ঝেড়ে অন্যদিকে চোখ ঘোরালো…

‘এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই, উপায় নেই তাই তোর সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছি নাহলে…’

ভাইয়ের কাধ চেপে জায়ান বললো…

‘ব্যাস, আর কিছু বলতে হবেনা। তুই ঠিকানা দিবি তারপর আমি সব বের করে আনছি ‘

চলবে…