#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৫
সায়ন মেয়েটার ঠিকানা দিয়েছে, ওই কাজে লেগে পড়লে দেরি হবে। জায়ান তার আগে নিজের কাজটা সেরে নিলো। বন্ধের দিন, স্টুডিওতে কেউ নেই এই সুযোগে জায়ান ওখানে এলো। স্টুডিওতে সবার জন্যে আলাদা করে ছোটো ডেস্ক আছে। ডেস্কের ড্রয়ারেই সকলে এখানকার কাজের প্রয়োজনীয় জিনিস রাখে, সাধারণত কোনো ড্রয়ারে তালা থাকেনা। জায়ান সবার ডেস্কের ড্রয়ার চেক করলেও, কবিরের ড্রয়ার চেক করতে গিয়ে দেখলো তালা! তখন ওর সন্দেহ আরো প্রবল হলো, কায়দা করে কবিরের ড্রয়ার খুলে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই যা সন্দেহ করেছিলো তাই পেলো। দেখলো ওর স্ক্রিপ্টের একটা ফটোকপি! জায়ান শুধু কিছুক্ষণ কাগজটা হাতে ধরে রইলো, কবির মাস কয়েক আগেই এখানে এসেছে। জুনিয়র হিসেবে ওকে বিভিন্ন বিষয়ে হাতে ধরে শিখিয়েছে জায়ান, সেসবের প্রতিদান যে ছেলেটা এভাবে দেবে ভাবেনি। কাগজটা নিয়ে ড্রয়ার আটকে দিলো। কবিরের সঙ্গে এ বিষয়ে পরে কথা বলবে। এখান থেকে বেরিয়ে সায়নের ওই মেয়েটার খোঁজ নিতে গেছিলো কিন্তু আশেপাশের মানুষের থেকে তেমন কিছু জানতে পারেনি কারণ তারা এই এলাকায় মাত্র কয়েক মাস আগেই ভাড়া এসেছে তবুও যতটুকু সম্ভব খোঁজ করার চেষ্টা করেছে জায়ান। পিকনিক থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে আলিশার, এসেই কাধের ব্যাগটা রেখে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো। যদিও পিকনিকে গেছিলো কিন্তু জার্নি করে শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে! তখনই জায়ান ফিরলো, আলিশাকে দেখে হেসে বললো…
‘ চলে এসেছো?’
আলিশা উঠে বসলো — ‘ সারাদিন আজ খুব ব্যস্ত ছিলে মনে হচ্ছে?’
জায়ান বসে এক গ্লাস পানি খেয়ে বললো…
‘ হ্যাঁ, আজ হঠাৎ অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। তোমার পিকনিক কেমন কাটলো?’
‘পিকনিক তো ভালো গেছে কিন্তু তোমার কিসের এত ব্যস্ততা ছিলো?’
‘সায়নের ওই মেয়ের কেসটা এখনও ঝুলে আছে, আমি হেল্প করতে চেয়েছি আর ও রাজিও হয়ে গেছে। সেটা নিয়েই একটু ব্যস্ত ছিলাম, মেয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর এনে দেবো ওকে’
এ কথা শুনেই আলিশার ক্লান্তি যেনো উবে গেল, হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে জায়ানের কাছে এসে দাঁড়ালো…
‘ কিঃ! ভাইয়া তোমার হেল্প নিতে রাজি হয়েছে?’
‘ হাতি যখন কাদায় পড়ে তখন তার সব ভাব ঘুচে যায়, সায়নের এখন ওই অবস্থাই হয়েছে। আমার হেল্প না নিয়ে কিছু করতে পারবে না বুঝেই মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে ‘
‘ বাহ! দারুন ব্যাপার তো। এই সুযোগে ভাইদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে উন উন্নতির পথে এগোচ্ছে। মেয়েটা তোমাদের সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে লাকি চার্ম ‘
‘ ওসব কিছুনা! কদিন ধরে সায়ন দেবদাস হয়ে ঘুরছিলো তাই আমি ভাবলাম এই বেচারাকে একটু দয়া করি। নাহলে ও চোরাবালিতে ডুবে গেলেও আমার কিছু যায় আসেনা ‘
‘ এ্যাই! এসব কি কথা? ভাই হয় তোমার। যাই হোক, কি হলো ওখানে?’
আলিশাকে এতো উৎসুক দেখে জায়ান ভ্রু কুচকালো!
‘সায়নের এই কেস নিয়ে তোমার আগ্রহ দেখছি দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে, মাত্র ফিরলে আর এখনই এসব কথা নিয়ে বসে পড়লে?’
‘ আহা, তোমাকে বলেছিলাম তো সব কেনো আমার আগ্রহ। আচ্ছা কি কি জানতে পারলে আর মেয়েটা কে? কি করে?’
জায়ানের বাহু ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলো আলিশা, ঘড়িতে রাত আটটা বেজে গেছে দেখে জায়ান ওকে ফ্রেশ হওয়ার জন্যে তাড়া দিলো…
‘ওসব নিয়ে পরেও আলোচনা করা যাবে, আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো!’
জোরাজুরি করেও একটা কথা জায়ানের মুখ থেকে বের করতে পারলো না। কি আর করার? তোয়ালে আর জামা নিয়ে যেই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়েছে তখনই শু করে জায়ান ওকে কোলে তুলে নিলো…
‘ চলো, একসঙ্গে ফ্রেশ হই!’
‘তুমি না মাত্র বাইরে থেকে ক্লান্ত হয়ে এলে?’
‘কে বলেছে ক্লান্ত? আমি কতটা স্ট্রং এ সম্পর্কে আপনার বোধহয় এখনও ধারণা হয়নি’
আলিশা লজ্জায় নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরতেই জায়ান ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো। আলিশা চোখ বড় বড় করতেই…
‘ ইউ আর সিডিইসিং মি! তোমাকে আজ ছাড়ছি না ‘
কথাটা বলেই চোখ টিপলো জায়ান। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। শুভ কাজে দেরি কিসের??!
_______________________________
রোজকার মত আজও আগেই কবির স্টুডিওতে এসেছে, জায়ান সাধারণত সবার পরে আসে কিন্তু আজ ও সবার আগে এসেছে দেখে কবির কিছুটা অবাক হলো!
‘ আজ এতো সকালে?’
জায়ান মৃদু হাসলো — ‘ একটু দরকার ছিলো, তাই ভাবলাম আগেই আসি ‘
কবির গিয়ে ডেস্কে বসতেই জায়ান স্ক্রিপ্টের ফটোকপিগুলো একপ্রকার ছুঁড়েই দিলো। ওগুলো দেখেই কবিরের বুক ধুকদুক করতে শুরু করেছে।
‘একটা কথা বল তো কবির, আমার স্ক্রিপ্টের ফটোকপি তোর ড্রয়ারে কি করছে?’
‘ এ..এটা তো…’
কবির ভয় পেয়ে দাড়িয়ে পড়লো, দ্রুত নিজের ড্রয়ারের দিকে তাকাতেই জায়ান বললো…
‘ হুম, তোর ড্রয়ারে যত্ন করে রাখা ছিলো ‘
কবির কিছু বললো না, মাথা নিচু করে রইলো!
‘জানিস না কিছু? ফাইন! আমিই বলে দিচ্ছি। গত সপ্তাহে আমাদের রাইভাল স্টুডিওর একটা ডকুমেন্টরি দেখলাম, স্ক্রিপ্টটা চেনা লাগলো। আমারই স্ক্রিপ্ট ছিলো, আমার স্ক্রিপ্টে তারা কিভাবে কাজ করলো?’
জায়ান অত্যন্ত ঠান্ডা কণ্ঠে কথাগুলো বলেছে কিন্তু সেই ঠান্ডা কথাগুলো শুনেও কবিরের গা শিউরে উঠছিল। অপরাধীর অপরাধ ধরা পড়লে হয়তো এমনই অনুভব হয়! কবিরের গলা কাঁপলো…
‘ ভ..ভাই আমি…’
‘কবির, আমার স্ক্রিপ্ট যে তুই চুরি করেছিস সেটা কিন্তু আমি বুঝে গেছি তাই আর লুকিয়ে লাভ নেই। তোর এক্সকিউজ শুনে নষ্ট করার মতো বাড়তি সময় আমার নেই। শুধু এইটুকু বল, কেনো করেছিস এমন?’
কবির অনেক ভয় পেয়ে গেলো, প্রায় কান্নাই করে ফেলেছিল ছেলেটা…
‘আমাকে ক্ষমা করো ভাইয়া, আমার ওই মুহূর্তে টাকার অনেক প্রয়োজন ছিল। আমাকে তারা বড় অঙ্কের টাকা দিতে চেয়েছিল তাই এই অফার যখন পেলাম আর না করিনি। কিছু না ভেবেই এমন একটা কাজ করে ফেলেছি ‘
সামান্য কিছু টাকার কাছে নিজের যত্ন করে লিখা কিছু অন্যের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে গেছে শুনে জায়ানের ঠিক কি বলা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না। ওই মুহূর্তে মনে মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিলো ওর! এখানে রাগারাগি করেও লাভ নেই, তাই জায়ান নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো…
‘টাকার প্রয়োজন হলে আমায় বলতে পারতিস, এরকম একটা কাজ করার প্রয়োজন ছিলো না। তুই এখনও ছোটো, একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে কতোটা কষ্ট করতে হয় কতোটা মাথা খাটাতে হয় জানিস না।’
কবির লজ্জা ও ভয়ে মাথা তুলে তাকাতে পারছে না…
‘ তুই যা করেছিস তাতে তোকে দোষ দিয়ে বা আফসোস করে আমার আর লাভ হবেনা। তবে চিন্তা করিস না, এ বিষয়ে আমি কাউকে বলবো না কিন্তু এমন আর অন্যকারো সঙ্গে করবি না ‘
‘আমি আর কোনোদিন এমন করবো না, এটাই শেষবার। বিলিভ মি প্লিজ!’
‘তোর কোনো হেল্প লাগলে আমি সিনিয়র হিসেবে হেল্প করতে প্রস্তুত কিন্তু বিশ্বাস? সেটা দ্বিতীয়বার আর পারবো না’
কথাগুলো বলেই কবিরের কাঁধে হাত রাখলো জায়ান, ছলছল চোখে কবির তাকালো। এ মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। তখনই তুহিন আসে, কবির ও জায়ানকে একসঙ্গে দেখে সে প্রশ্ন করলো…
‘ কি হয়েছে? কোনো সিরিয়াস বিষয়ে আলোচনা চলছিলো নাকি?’
তুহিনের প্রশ্নের উত্তরে জায়ান শুধু স্মিত হেসে নিজের ডেস্কে বসে পড়লো। কবির তখনও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, জায়ানকে দেখছে। যদিও জায়ান রুক্ষ আচরণ করেনি কিন্তু ওর ওই শান্ত আচরণও কবিরকে গিল্টি ফিল করাচ্ছে। কারো বিশ্বাস হারানোর অনুভূতি কেমন হয় সেটা কবির ওই মুহূর্তের অনুভব করেছে। জায়ান আজ স্টুডিওর কাজে মোটেও মন দিতে পারেনি। যতোই নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখুক, কিন্তু একসঙ্গে কাজ করা কেউই এভাবে ধোঁকা দিয়েছে সেটা মন কি এতো সহজে মেনে নেবে? আজ বিকেলেই বাসায় ফিরে এসেছিল জায়ান, সন্ধ্যার নাস্তাও আজ জায়ান বানিয়েছে। পাকোড়া আর চা! সায়ন এসেই কফির জন্যে মাকে ডাকতেই জায়ান বললো…
‘ আজকে কফি হবেনা, কারণ নাস্তা আমি বানিয়েছি। চুপচাপ চা খেয়ে নে ‘
সায়ন কথা না বাড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসলো…
‘ কাজ কতদূর এগোলো?’
‘ এমনভাবে জিজ্ঞাসা করছিস যেনো হাতের মোয়া? একদিনে কতটুকু জানা যায়?’
‘ তারমানে ওই কাজে আজ যাসনি?’
‘ না গেছিলাম। পুরোনো বাসিন্দা হলে এলাকার মানুষের কাছ থেকেই বাড়ির খবর বের করা যেতো কিন্তু ওরা নতুন ভাড়াটিয়া। তাছাড়া ওদের নিজেদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিশেষ একটা কথাবার্তা হয় না বোধহয় ‘
‘ কিন্তু ও তো তেমন মেয়ে নয়, অফিসে সবার সঙ্গেই মিলেমিশে থাকে ‘
‘ অফিসের ব্যাপার আলাদা, ওখানে তো দায়িত্বের প্রয়োজনে সবার সঙ্গে না চাইলেও মিশতে হবে। মানুষের কর্মক্ষেত্রে আর ব্যক্তিগত জীবনে আলাদা ইমেজ থাকে। তুই তো দেখছি হেবি গর্দভ!’
সায়ন রেগে গেলো! — ‘তোকে একটা কাজ দিয়েছি তারমানে এই না তোর যা মুখে আসবে তাই আমাকে বলবি ‘
‘ শুকরিয়া কর যে আমি তোকে সাহায্য করছি নাহলে ওই মেয়ের চিন্তায় চুল পাকিয়ে বসে থাকতি তুই আর কাজের কাজ কিছুই হতো না ‘
তখনই পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো..
‘কোন মেয়ের কথা হচ্ছে?’
বাবার কণ্ঠস্বর শুনে দুজনেই পেছনে ফিরলো, এনায়েত সাহেব সামনে এসে বসে কিছুক্ষণ দুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে জায়ানকে হুট করে প্রশ্ন করলেন…
‘ তুই আবার কোনো মেয়ের চক্করে পড়িসনি তো?’
বাবার কথা শুনে জায়ানের দুঃখে হেসে ফেললো!
‘বাবা, এমন দোষারোপ করার আগে একটু ভেবেচিন্তে কথা বলো! আমি একজন বিবাহিত পুরুষ’
ছোটো ছেলের কথা শুনে এনায়েত সাহেব দ্বিমত করতে পারলেন না কারণ বিয়ের পর থেকেই জায়ানের মধ্যে অনেকটা বদল এসেছে। উনি এবার বড় ছেলের দিকে তাকালেন, ওনার সন্দেহ হলো! তারমানে কি সায়নের জীবনে কোনো মেয়ে এসেছে?
চলবে…