#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৯
অকস্মাৎ এনায়েত সাহেবের আগমনে মেঘনা কিছুটা চিন্তিত বটে, ও এক কাপ চা করে আনার কথা ভাবছিল কিন্তু এনায়েত সাহেব বসেই বললেন…
‘এই ঘরেই থাকো তাহলে তুমি? অবশ্য একা থাকার জন্যে এটাই যথেষ্ট ‘
মেঘনা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে, ওনার কথার ধরন শুনেই ওনার এখানে আসার কারণ যেনো মেঘনা এখনই আন্দাজ করতে পারছে।
‘আমার ছেলের তোমাকে পছন্দ, এমনকি আমাদের বাসার সবাই তোমাকে পছন্দ করে। তুমিও নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ির বউ হওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছো?’
‘সায়ন স্যার শুধুই আমার বস, আমি ওনাকে এর বেশি কিছু ভাবি না ‘
‘রিয়েলি? তোমার যদি বিয়ের মোটিভ না থাকতো তাহলে আমার ছেলেকে পাত্তা দিতে না। আমার সামনে অস্বীকার করলেও মনে মনে তোমার সায়নের বউ হওয়ারই ইচ্ছা’
এনায়েত সাহেব যেনো ওর মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করছে, যেনো জানার চেষ্টা করছে মেঘনার মনে আদৌ সায়নের জন্যে কোনো অনুভূতি আছে কিনা। মেঘনা এবার মাথা তুলে তাকালো…
‘আমার বিপদের দিনগুলোতে সায়ন স্যার আমাকে সাহায্য করেছে, আমি ওনার কাছে কৃতজ্ঞ। যে আমার উপকার করেছে তাকে আমি ইগনোর করতে পারিনা’
‘উত্তম চিন্তা তোমার, আজকাল তো মানুষ এতো স্বার্থপর হয়ে গেছে কেউ কারো সাহায্য নিয়েও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়না। ভালো একটা সেক্রেটারি পেয়েছে আমার ছেলে’
মেঘনার এখানে বসে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, ওখান থেকে কিছু সময় রেহাই পাওয়ার জন্যে চা বানানোর কথা বলে উঠে আসতে যাচ্ছিলো, তখনই…
‘শুনেছি তোমার বাবার টাকা ছিলো না বলে তোমার মা কোনো এক বড়লোকের সঙ্গে পালিয়ে গেছিলো?’
এনায়েত সাহেবের কথাগুলো মেঘনার বুকে যেনো কাঁটার মতো বিঁধল, অনেক বছরের চেষ্টায় যে কথা ও প্রায় ভুলতে বসেছিলো সে অতীত আবারো যেনো সামনে চলে এলো। বহু মানুষের কাছে এই আলাপ শুনে মেঘনার যেনো অভ্যাস হয়ে গেছে এর উত্তর দেওয়াটা! ও ঘুরে তাকালো..
‘ কিন্তু আমার বাবা নিজের দায়িত্ত্ব থেকে পিছু হটেননি, উনি আমাদের সৎভাবে মানুষ করেছেন ‘
‘অবশ্যই, তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় বাবা হিসেবে তোমার পিতা সফল কিন্তু তুমি একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে এ বিষয়ে তো সন্দেহ নেই। তাছাড়া তোমার মায়ের এই কাহিনীর জন্যে লোকসমাজ ও আত্মীয়দের মধ্যেও নিশ্চয়ই তোমাদের সম্মানহানি ঘটেছে? তাছাড়া এখন তো তোমার পরিবারে কেউই নেই। তোমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস শূন্য!’
মেঘনা নিরব রইলো, এনায়েত সাহেবের বলা প্রতিটি কথা যেনো আঙ্গুল তুলে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে ও সায়নের যোগ্য নয়। সে মুহূর্তে মেঘনা কিছু বলতে পারেনি, প্রতিবাদ করতে পারেনি কারণ ওর বলার কিছুই নেই। এনায়েত সাহেবের বলা প্রতিটা কথাই যে সঠিক!
‘ আমার ছেলে তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে বিয়ে করার জন্য হয়তো ও অনেক পন্থা অবলম্বন করবে কিন্তু তোমার মত একটা মেয়ে আমাদের পরিবারের বউ হয়ে এলে আমাদের পরিবারের আর সায়নের সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে কথা নিশ্চয়ই আমার তোমাকে বোঝাতে হবেনা। সায়নের সঙ্গে এতো বছর ধরে আছো, আমাদের। বাড়িতেও গেছো। নিশ্চয়ই আমাদের স্ট্যাটাস সম্পর্ক অবগত তুমি ‘
এনায়েত সাহেব উঠে দাড়ালেন…
‘অফিসে তোমার বেশ প্রশংসা শুনেছি, সব বিষয় তুমি পারফেক্টভাবে সামাল দাও। আশা করি ভবিষ্যতে নিজের ব্যক্তিগত বিষয়টাও ঠিকঠাক সামাল দিতে সক্ষম হবে ‘
কথাগুলো বলে বেরিয়ে এলেন উনি, মেঘনা ঠায় দাঁড়িয়ে। হাতগুলো কাঁপছে, ঠোঁট চেপে নিজের কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মেয়েটা। সায়নের জীবনে যাওয়ার চিন্তা কোনোদিনই ওর ছিলো না। ওর মায়ের ঘটনার পর মেঘনা এক প্রকার পন করেই নিয়েছিল বড়লোক ছেলে বিয়ে করবে না কিন্তু বিগত কিছু মাসে সায়নের কর্মকাণ্ড ওকে দুর্বল করলেও আজ এনায়েত সাহেব আবারো মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন ও সায়নের যোগ্য না। নিজের মন ও মস্তিষ্কের কাছে যেনো দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। সায়নকে যে ও পছন্দ করতে শুরু করেছে, কি করবে এখন? কিছুদিন ধরে আলিশা লক্ষ্য করছে জায়ান বাসায়ই বেশি সময় কাটাচ্ছে…
‘কয়দিন ধরে বাসায়ই আছো, কাজ নেই?’
‘সবাই কিছুদিনের জন্যে ছুটিতে গেছে, আপাতত আমাদের কাজ নেই। সবাই ফিরলে আবার শুরু হবে’
‘তাহলে তুমি বাসায় কেনো? কোথাও গিয়ে ঘুরে এসো ‘
‘আমি আমার ছুটি কাটাচ্ছি তো, আমার বউয়ের সঙ্গে ‘
‘উম্ম! তোমার কাজ তো ভালোই চলছে। এবার কি বাসায় জানিয়ে দেওয়া উচিত না?’
‘এতো তাড়া কিসের? এভাবেই বেশ আছি। তবে সঠিক সময় এলে অবশ্যই অ্যানাউন্স করবো ‘
‘ ঠিক আছে, কিন্তু আমার একটা অ্যানাউন্সমেন্ট করার আছে’
‘ কি?’
আলিশা ব্যাগ থেকে একটা কাগজ এনে জায়ানের হাতে দিয়ে ওর কোলে বসে পড়লো, কৌতুহল নিয়ে কাগজটা খুলে দেখলো একটা আল্ট্রা রিপোর্ট! জায়ানের খুব একটা বুঝতে সময় লাগলো না। একরাশ আনন্দ দিয়ে বউয়ের দিকে তাকালো…
‘আর ইউ সিরিয়াস?’
আলিশা মুচকি হেসে জায়ানের গলা জড়িয়ে বললো..
‘আমার কিছুদিন ধরে সন্দেহ হচ্ছিলো, তাই ভাবলাম আর দেরি না করে ল্যাব টেস্ট করে ফেলি। ডাক্তার বলেছে নয় সপ্তাহ চলছে। এইযে, এই ছোট্ট ডটটা দেখছো? এটা আমাদের বেবি’
আলিশা আল্ট্রার রিপোর্টে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। জায়ান কিছুক্ষণ ওদিকেই তাকিয়ে ছিলো। একজন পুরুষের জন্যে হয়তো সবচেয়ে সেরা আনন্দের খবর তার সন্তানের আগমনের খবর! জায়ান লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাগজটা একপাশে ভাঁজ করে রেখে আলিশার গালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞাসা করলো..
‘তুমি হ্যাপি?’
‘ভীষণ! সত্যি বলতে আমি এতো দ্রুত মা হওয়ার জন্যে মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম না কিন্তু আল্ট্রা করার সময় যখন বেবির হার্টবিট শুনলাম তখনই যেনো নিজের মধ্যে কেমন “মা” ভাব চলে এলো। Now, I’m very excited to meet our baby’
পরেরদিন পরিবারের সবার সঙ্গে এই সুখবর ভাগ করে নেয় ওরা, কাবেরী বেগম ভীষণ খুশি। এনায়েত সাহেবও খুশি হয়েছেন কিন্তু উনি অন্য চিন্তা করলেন। জায়ানকে ডেকে বললেন…
‘দায়িত্ব নিতে শেখ এবার, একটা কিছু কর। নাহলে তোর সন্তান কি জানবে? তাদের বাবা বেকার?’
‘ আগেই দেখছি তুমি টাকার চিন্তা করছো, ডোন্ট ওরি। আমার বাচ্চাদের জন্যে তোমার কাছ থেকে টাকা নেবো না, ওদের পালার জন্যে টাকা আছে আমার’
‘ ওগুলোও তো আমারই টাকা
‘ না, আমার উপার্জনের টাকা ‘
‘ তুই উপার্জন করতে শুরু করলি কবে?’
অবশেষে মা বাবার কাছেও নিজের কাজের কথা জানালো জায়ান, তাদের বোঝার সুবিধার্থে নিজের কাজের বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়েছে জায়ান। এনায়েত সাহেব এসব শুনে বিশেষ খুশি না হলেও কাবেরী বেগম খুশি হলেন…
‘বাহ! দারুন একটা কাজ তো। আগে কখনো তো বলিসনি। কবে থেকে শুরু করেছিস এটা?’
‘প্রায় চার বছর ধরে করছি’
‘কয় টাকা কামাই হয় তোর ডকুমেন্টরি তৈরি করে?’
‘ যেটুকুই রোজগার হোক, সেভিংস করছি আমি ‘
‘ ওসব ছেলেখেলা বাদ দিয়ে কাল থেকে সায়নের সঙ্গে অফিসে যাবি, অনেক সময় অকাজে ব্যয় করেছিস। এবার কাজের কাজ কিছু কর ‘
জায়ান জানতো ওর কাজের কথা জানলে এনায়েত সাহেব এমনকিছুই বলবেন তাই কোনোদিন বাসায় এসব কথা বলেনি। জায়ান উঠে দাঁড়ালো…
‘ বাবা, আমি যেটা করছি সেটাও কাজই। বলতে গেলে এখানে তোমাদের থেকে আরো বেশি কষ্ট করতে হয়। তোমরা তো শুধু একটা ঘরে বসে কাজ করো আর আমাদের ইনডোর – আউটডোর উভয় জায়গাতেই কাজ আছে। আমি আমার কাজ নিয়ে অনেক খুশি ‘
এনায়েত সাহেব আরো কিছু বলতেন কিন্তু জায়ান বলার সময়ই দিলো না। ওখান থেকে চলে এলো কারণ আজকের মত একটা শুনে দিন বাবার সঙ্গে তর্ক করে কাটাতে চায়না না ও। কাবেরী বেগম আজ স্বামীর ওপর রেগে গেলেন!
‘ আচ্ছা তোমার সমস্যা কি বলোতো? কিছু করতো না তাতে সমস্যা ছিলো এখন বলছে যে ও কিছু করে সেটা নিয়েও সমস্যা?’
‘ ও যেটা করে ওটা কোনো কাজ হলো? কোনো নিশ্চয়তা আছে ওসবের?’
‘ আহহা, করুক না। বললো তো এত বছর ধরে করছে। সমস্যা তো হয়নি, তাছাড়া যদি কখনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় আমাদের তো বলবেই। আগেই কেনো এমন করছো?’
এনায়েত সাহেব নিরব রইলেন, দুই ছেলের চিন্তায় উনি মনে মনে প্রায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। একদিকে বড় ছেলে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আরেকদিকে ছোটো ছেলেকে নিজের বাগে আনতে পারছেন না। ওনার যেনো মনে হচ্ছে সব ওনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
____________________________________
সন্ধ্যায় আলিশাকে নিয়ে ওর মায়ের বাসায় যায় জায়ান, সুখবর শুনে জিনিয়া বেগম তো ভীষণ খুশি। প্রাণভরে অনাগত নাতি/নাতনির জন্যে দোয়া করলেন। ওখান থেকে আলিশার বাবার বাসায়ও যাওয়া হলো। আজ রাত ওরা আলিশার বাবা বাসায়ই থাকবে। আলিশা ইদানিং খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে, জায়ান এতদিন ভাবত হয়তো অফিসের কাজের চাপে ক্লান্ত থাকে তাই কিন্তু এখন বুঝতে পারছে হয়তো এটা প্রেগনেন্সি এফেক্ট! আলিশা ঘুমানোর পর দরজা চাপিয়ে বাইরে আসতেই দেখলো জাফর সাহেব কিচেনের দিকে যাচ্ছেন, জায়ানকে দেখেই উনি বললেন…
‘আমাদের বাবা ছেলের রাতে কফি খাওয়ার অভ্যাস, তোমার জন্যেও এক কাপ বানাবো নাকি?’
‘ আপনি বানিয়ে দিলে আপত্তি করবো না ‘
জাফর সাহেব তিন কাপ কফি বানালেন। এরপর ড্রইংরুমে বসে আদিল, জায়ান ও জাফর সাহেব মিলে গল্পে মজলেন। জাফর সাহেব বললেন…
‘ভেবেছিলাম আমার মেয়ে হয়তো অতীত সম্পর্ক থেকে সহজে বেরোতে পারবে না, ওর যা অবস্থা হয়ে গেছিলো তখন! কিন্তু তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মনে হচ্ছে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম’
‘কি যে বলেন আব্বু। আপনি আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন তার জন্যে আমি বেশি কৃতজ্ঞ’
আলিশার বাবা ভাইয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো জায়ান, আজকে অবশ্য আড্ডার মূল বিষয় ছিলো আলিশাই। কিভাবে এখন থেকে ওর প্রোপার কেয়ার করতে হবে সেসব নিয়েই জাফর সাহেব বুঝিয়ে বলছিলেন। জায়ানও সব মনোযোগ দিয়ে শুনে নিচ্ছিলো, কিছু বিষয় আবারো নোটও করে নিলো। প্রথমবার বাবা হচ্ছে, প্রথমবারের যত্নে সবকিছু শতভাগ পারফেক্ট না হলেও যতটা সম্ভব খামতি কমানোর চেষ্টা করবে। শ্বশুরবাড়িতে এটাই জায়ানের প্রথম রাত আর রাতটা দারুন কেটেছে!
চলবে…