#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#শেষ_পর্ব
এক বিকেলে, ছাদে বসেছিলো সায়ন। আয়ান খেলছিলো, মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে এসে সায়নের কোলে বসে বিশ্রাম করে আবার খেলতে যাচ্ছে বাচ্চাটা। ভাইয়ের ছেলেকে ভীষণ আদর করে সায়ন। একটু পরে জায়ান এসে বসতেই আয়ান ছুটে এসে বাবার কাছে আবদার জুড়ে দিলো…
‘আব্বু! আমাদের স্কুলের পাশে একটা নতুন দোকান দিয়েছে। ওখানে আমি অনেকগুলো নতুন চকলেট দেখেছি, আমাকে কিনে দেবে ওগুলো?’
‘এর আগে তোকে চকলেট কিনে দিয়েছিলাম বলে আলিশা যখন তোকে বকছিলো তুই আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলি মনে আছে? পরে তোর থেকে বেশি আমি বকা খেয়েছিলাম’
আয়ান ঠোঁট উল্টে বললো — ‘ এবার বলবো না, প্রমিজ!’
ছেলের সঙ্গে চকলেটের বিষয়টা আলিশার থেকে লুকানোর ব্যাপারে ডিল করছিলো জায়ান এদিকে ভাই ও ভাতিজার কথোপকথন শুনে পাশ থেকে হাসলো সায়ন। বাবার সঙ্গে আলাপ শেষে আয়ান আবার ছুটলো খেলতে, সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেললো…
‘নিজের একটা ফ্যামিলি থাকা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার, তুই বেশ লাকি জায়ান ‘
‘তুইও যদি বাবার সম্মতির অপেক্ষায় এতো বছর বসে না থাকতি তাহলে তোরও আজ একটা সুন্দর পরিবার থাকতো’
‘হুম ভুল করেছিলাম, বাবা যে আমাকে কোনোদিন বুঝবে না সেটা ভাবিনি। বোকার মত অপেক্ষা করে গেছি এতদিন কিন্তু এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি’
‘ কি সিদ্ধান্ত?’
‘ আমি মেঘনার কাছে ফিরে যাবো ‘
জায়ান প্রথমে কিছুটা অবাক হলো কারণ এতবছরে সায়ন কখনো এমন কথা বলেনি! জায়ান অবশ্য এতে খুশীই হলো…
‘ তুই যদি এই সাহস দেখাতে পারিস তাহলে ভালো থাকবি, অন্যের ছত্রছায়ায় অনেক বেচেছিস। এবার শুধু নিজের কথা ভেবে নিজের জন্যে বেচেঁ দেখ, এর থেকে শান্তি আর কোথাও নেই ‘
সায়নকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করলো জায়ান, সায়নও আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আর পিছু হটবে না! ঘরের ভেতর সন্ধ্যার আলো জ্বলছে। জানালার পাশে সায়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে আজ অদ্ভুত এক প্রশান্তি। আজ জীবনের চরম একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সে। এনায়েত সাহেব তখন চা খাচ্ছেন। খবরের কাগজে চোখ রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু সায়নের পায়ের আওয়াজে চোখটা একবার তুলে তাকালেন। মুখে সেই চিরচেনা গাম্ভীর্য, ঠোঁটে চাপা অভিমান।
‘কিছু বলবি?’
‘আমি মেঘনাকে বিয়ে করতে চাই, বাবা।’
কথাটা যেন ছু”রির মতো এসে বসলো ঘরের ভেতর। এনায়েত সাহেব কপাল কুঁচকে তাকালেন, কিন্তু কণ্ঠে ধৈর্যের অভিনয়!
‘এতো বছর হয়ে গেলো তাও ওই মেয়েটার নাম তুই ভুলিসনি? যার পরিবারে কেউ নেই, যার বংশের নাম কেউ শোনেনি, যার সামাজিক অবস্থান আমাদের ছায়ার কাছাকাছিও না তাকে তুই কোন আক্কেলে বিয়ে করতে চাস?’
‘ হ্যাঁ বাবা, তোমার কাছে স্ট্যাটাস বড় হতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয়। এতগুলো বছর শুধু তোমার জন্যে আমি চুপ ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো নিজেই আমায় বলবে যে মেঘনাকে তুই ফিরিয়ে আন। ভেবেছিলাম হয়তো আমার সুখের কথা ভাববে কিন্তু তুমি তা করোনি। তুমি আমাকে সব দিয়েছো বাবা, তাহলে কেনো নিজের মতো করে কাউকে ভালোবসে কাছে পেতে দিচ্ছ না?’
‘এটা কি তোর নিজের কথা, না ওই মেয়েটা মুখস্থ করিয়েছে?’
সায়নের মুখে ব্যথা ফুটে উঠলো, এতকিছুর পরেও তার বাবা যে এতটা কঠোর ভূমিকা পালন করবে ভাবেনি!
‘মেঘনা আমাকে কোনদিন জোর করেনি। ও তো চুপ করে নিজের মতো করে কষ্ট বেছে নিয়েছে, শুধু তোমাকে সম্মান দেখানোর জন্য। অথচ আমি? আমি কি করেছি? আমিও তোমার সম্মতির জন্যে নিজের জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করে ফেললাম ‘
‘এতো বছর পরেও তোর মুখে এই ধরনের কথা শুনবো ভাবিনি সায়ন ‘
‘একটা কথা কি জানো বাবা? জায়ানের সঙ্গে আমি একটা বিষয়ে একমত না হয়ে পারছিনা। তুমি শুধু নিজের মতো সবাইকে চালাতে চাও। মেঘনার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদের কারণটা যে তুমি এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না তাইনা? তুমি কখনও আমায় জিজ্ঞেস করোনি, আমি কেমন আছি? ভাবায় আমার পজিশন, আমার সামাজিক মর্যাদা’
কথা বলতে বলতে সায়নের গলাটা ভার হয়ে এলো। ওর চোখে পানি এসেছে অভিমানে, অভিজ্ঞতায়, ও সবচেয়ে আপনজনের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার বেদনায়। এনায়েত সাহেব কিছুক্ষণ নিরব রয়ে বললেন…
‘ ওই মেয়েকে আমি কোনোদিন মানবো না ‘
‘ জানি! বাবা, আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি। কিন্তু আমি এবার নিজেকে হারাতে পারবো না। তুমি ওকে মানবে না কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি মেঘনার পাশে দাঁড়াবো ‘
এনায়েত সাহেব এবার চোখ তুলে তাকালেন, কিছুটা গর্জন করে বললেন…
‘ওই মেয়ের জন্যে তুই নিজের পরিবারকে ত্যাগ করতে চাইছিস?’
সায়ন মৃদু হাসলো — ‘আমি নিজের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে নতুন একটা পরিবার গড়তে চাইছি ‘
এনায়েত সাহেব ছেলেকে নানাভাবে বোঝানোর, ওকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু লাভ হয়নি। সায়নও এবার বাবার কথা শোনেনি। সেই সন্ধ্যায় সায়ন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।এনায়েত সাহেব থেমে গেলেন। আর কিছু বললেন না। কিন্তু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঘরের নিস্তব্ধতায় ছড়িয়ে পড়লো।
______________________________
সেদিনের পর কেটেছে অনেকগুলো দিন, সেদিন থেকে বাবার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি সায়ন। এনায়েত সাহেবও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেননি যদিও কাবেরী বেগম বহুবার সায়নের কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু এনায়েত সাহেব শুনতে আগ্রহী ছিলেন না। এ বাড়ি থেকে যাওয়ার পরেই নিজের প্রায় ছয় বছরের ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে সক্ষম হয়েছে সায়ন। যদিও ও বাড়ি থেকে চলে এসেছে শুনে মেঘনা প্রথমে বিয়ে করতে রাজি হয়নি কিন্তু বহু চেষ্টার পর সায়ন ওকে রাজি করিয়েছে। একসময় জায়ান নিজের বাসা ছেড়ে একটা আলাদা বাসায় থাকার প্ল্যান করেছিলো কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ি একা পরে যাবে বলে আলিশা রাজি হয়নি। একসময় জায়ান নিজেও উপলব্ধি করে এই মুহূর্তে ওর বাবাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যে একমাত্র ওই আছে। যতোই মন্দ বলুক, দিনশেষে সে বাবা তো! সায়নের যাওয়ার পর জায়ান ওর বাবাকে সবভাবেই সাহায্য করার চেষ্টা করেছে, এতদিন বড়ছেলের জন্যে অন্ধ থাকলেও জায়ান যখন ওনার টেক কেয়ার করতে শুরুর করলো তখন ধীরে ধীরে উনিও ছোটো ছেলের প্রতি কিছুটা নরম হন। সবমিলিয়ে দিনগুলো এখন ভালোই কাটছে। দীর্ঘদিন কাজের চাপে জায়ান বা আলিশা কেউই ছেলেকে ঠিকমতো সময় দিতে পারছিল না বলে আয়ান বেশ অভিমান করেছিলো। তো দুজনেই এক সপ্তাহের ছুটি প্ল্যান করে ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে সারপ্রাইজ দিলো। আয়ান তো ঘুরতে এসে ভীষণ খুশি! সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। তার রঙিন আলো পড়ে সমুদ্রের নোনা জলে সোনালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঢেউগুলো যেন ছুটে এসে তিনজন মানুষকে ছুঁয়ে যেতে চাইছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। শান্ত আর স্বস্তির একটা পরিবেশ যেটা বহুদিন পর জায়ান, আলিশা আর ছোট্ট আয়ান একসাথে অনুভব করছে। আয়ান নুড়ি কুড়িয়ে হাসছে, দু’হাতে বালি মাখছে। একটা নির্ভেজাল শৈশবের উচ্ছ্বাস ওর চোখে-মুখে। আলিশা হাঁটু ভাঁজ করে বসে, ছোট আয়ানকে একটা বালির দুর্গ বানাতে সাহায্য করছে। ওর চুলে কিছুটা বালু ঢুকে গেছে, আর গাল জুড়ে লেগে আছে মায়াবী হাসি। পেছন থেকে এসে জায়ান ওর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে…
‘ তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে ‘
আলিশা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো, জায়ানের এই হুটহাট প্রশংসার মানে তো অন্যকিছু! আলিশা মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো…
‘ আপনার মতলব তো ভালো ঠেকছে না ‘
‘ হ্যাঁ, আমার মতলব তো ভালো না। ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে তারপর আমরা দুজনে একটু…’
জায়ান কাছে এগোনোর চেষ্টা করছিল আর আলিশা ওকে দূরে সরাচ্ছে, চারপাশে এতো মানুষ তার মধ্যেও জায়ানের মনের ফুর্তি কমেনি। এসবের মাঝে আয়ানের হঠাৎ চোখে পড়ে দূরে এক ছোটো ছেলে তার ছোট্ট বোনকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো ঢেউয়ের হাত থেকে বোনকে রক্ষা করার মতো করে। দৃশ্যটা দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আয়ান। তারপর ধুপ করে উঠে দাঁড়িয়ে, দু’হাতে কোমরে রেখে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে..
‘ আমারও একটা বোন চাই ‘
আলিশা ও জায়ান, দুজনেই চমকে তাকায় ওর দিকে। জায়ান মনে মনে খুব খুশি হলো,
‘ দেখেছো, ছেলেও অনুমতি দিয়ে দিলো! দেখো ছেলে আমাদের সারাক্ষণ একা থাকে, বোন এলে ওর একজন খেলার সাথী হবে তাইনা?’
‘ছেলের সুবিধার জন্যে না নিজের সুবিধার কথা ভাবছো?’
‘ চেষ্টা তো আমাকেই করতে হবে, তারপর না ছেলে আমার তার আবদার করা জিনিস পাবে ‘
আলিশা এ কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে কাশির ভান করে উঠে দাঁড়ালো, হাতের বালু ঝেড়ে বললো…
‘আমার ছেলে যখন আবদার করেছে তখন পূরণ করতে আমার সমস্যা নেই!’
জায়ান অবাক হয়ে উঠে দাড়ালো, হালকা হেসে ওর গাল হাত রাখলো — ‘ সত্যিই?’
‘ কেনো নয়? আমাদের তিনজনের পরিবারে যদি একজন নতুন সদস্য আসে তাহলে সমস্যা কি? আমি তৈরি!’
ওরা দুজনেই একে অপরের দিকে চেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠলো, জায়ান আলতো করে আলিশার কপালে চুমু খেতেই আয়ান উঠে দাঁড়ালো! আয়ান ছোট্ট দু’হাত বাড়িয়ে বলে…
‘ আব্বু! তুমি আম্মুকে আদর করছো! আমাকে করবেনা?’
জায়ান-আলিশা দুজনেই হেসে আয়ানকে তুলে নেয়, আলিশা দ্রুত ফোন বের করে একটা ছবি তুলে নিলো। একটা নিখুঁত ফ্রেম যেন এই মুহূর্তটা। যার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ভালোবাসা, মায়া, বিশ্বাস আর একটি পূর্ণতার সুবাস। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে, এবার হোটেলে ফিরতে হবে! জায়ান ও আলিশা আয়ানের দু হাত ধরে সমুদ্রের পাড় থেকে ফেরার পথ ধরলো। পেছনে পড়ে থাকে তিনজনে মিলে বানানো বালির দুর্গ। সামনের ঢেউ এসে তা ধুয়ে নিয়ে গেলেও যেনো রেখে গেলো এক টুকরো ভালোবাসার ছোঁয়া!!
____ সমাপ্ত ____