মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব–৪
দীর্ঘ প্রায় দেড় মাসের পর পাঁচটি কোর্সের পাঁচটি পরীক্ষা শেষ হবার অরণ্যদের মনে হয় যেন বিশ্বযুদ্ধ জয় করে ফেলেছে। এখন কিছুদিন ছুটি, তাই ঘোরাঘুরি করা কিংবা ঘুমানোর জন্য আদর্শ এক সময়।
তূর্য নিজের গ্রামে যাবে, ইদানিং মুখটা অসম্ভব গম্ভীর থাকে। তন্দ্রার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সামনের সপ্তাহেই বিয়ে। এই সময়টা তূর্য কিছুতেই ঢাকায় থাকতে চায় না।
অরণ্যর খুব ইচ্ছা হয়েছিল তন্দ্রাকে কিছু কথা শোনাতে। কিন্তু তূর্য বাধা দিয়েছে, বলেছে “যার বিবেকটাই মরে গেছে, তার কাছে কিছু আশা করাই ভুল।”
অরণ্যর খুব রাগ হয়েছিল, “তাই বলে এভাবে ছেড়ে দিবি?”
“আমি ছাড়লাম কই, ছাড়লো তো ও। আমি তো এখনো ধরে রেখেছি, যেদিন আমিও ছাড়তে পারবো, সেদিন আমি মুক্ত হয়ে যাব।”
অরণ্য কিছু বলে না। ওর নিজেরও নিজের গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছিল। দুই বন্ধু পরদিন যার যার গ্রামের পথে রওনা দিলো।
ঢাকা থেকে রাতের বাসে এসে অরণ্য ভোরের দিকে নিজের গ্রামে পৌঁছায়। বিখ্যাত কপোতাক্ষ নদ বয়ে চলেছে গ্রামের পাশ দিয়ে। বাস থেকে নেমে বড় রাস্তা থেকে নেমে হাঁটতে থাকে। ওদের গ্রাম আরও খানিক দূরে… পরিচিত কাঁচা রাস্তার সোঁদা গন্ধে ওর মন ভরে ওঠে। চারপাশে ধানক্ষেত, প্রধান পেশা কৃষি এখানে। তবে ইদানিং ফুলের চাষ হচ্ছে কোথাও, কোথাও। গদখালি গ্রামের অনুকরণে। গদখালি গ্রাম তো মোটামুটি ফুল চাষে বিপ্লব করে ফেলেছে, তাই ফুলের রাজধানী এর অন্য নাম।
কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছে, চারপাশে কি সুন্দর গাছগাছালি, কড়া রোদেও তাই তেমন একটা গরম লাগছে না। হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হল, ও মোটামুটি গ্রামের পরিচিত। সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে নিজ বসতভিটার কাছাকাছি আসলো।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটু থমকে গেল, ওর শৈশবের কত স্মৃতি এই বাড়িতে। বাড়ির ভিতরে নানা গাছপালা।
বসতবাড়িটা বড় ভাই গত বছর ঠিক করিয়েছে। চারদিকে ইটের দেয়াল, উপরে টিনের চাল। সামনে টানা বারান্দা। রান্নাঘর একটু দূরে, রান্নাঘরের পাশে আবার অনেক গাছগাছালি।
রান্নাঘরে ওর বড় ভাবি কাজ করছিলেন।
তবে ওর আসার খবরটা বাড়িতে পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে । ওর বড় ভাই, পেছন থেকে হাঁক লাগালো,
“খোকন!”
অরণ্য ফিরে তাকালো, বড় ভাইয়ের বেশ বয়স হয়েছে। খুব সম্ভবত ক্ষেতে কাজ করছিলেন।
“আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন ভাইজান?”
কাছাকাছি এসে ছোট ভাইকে জড়িয়ে নিল ওর বড় ভাই, “ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভালো আছি। এতদিনে তোর বাড়ির কতা মনে হলো?”
অরণ্যর অস্বস্তি লাগছিল, দীর্ঘদিন বাড়ি থেকে দূরে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে টানটা আরো কমে গেছে। তবে বড় ভাইকে অনেক ভালোবাসে, অরণ্য হওয়ার আগে মায়ের অনেকগুলো সন্তান মারা গিয়েছেন। তাই অরণ্যকে ওর দুই ভাইবোন খুব আদর করে বড় করেছে। কিছু বলতে পারছে না কেমন একটা লাগছে। রক্তের টান কি এটা?
ওর বড় ভাবি বের হয়ে আসলো রান্নাঘর থেকে, “খবর দিয়ে আসলে কি হতো? তুমি তো আমাগের ভুলেই গেছ, খালি বড় বোনের খোঁজ নাও। বড় ভাই কিন্তু একজন আছেন।” অনুযোগ করলো ওর বড় ভাবি।
অরণ্য লজ্জা পেয়ে গেল, কথাটা ঠিক– শহরে গিয়ে অরণ্য কেমন যেন হয়ে গেছে।
“আচ্ছা, তুই যা, আগে গোসল করে নে।” তারপর হাক লাগালেন, “মুয়াজ, মুমিন, দেখ কে এয়েচে?”
অরণ্যর ভাতিজা দুইজন, মুয়াজ আর মুমিন। দুইজন জমজ। দুইজন মাদ্রাসায় পড়ে। আরো দুইটা সন্তান ছিল ওর ভাইয়ের, দুইটাই জন্মের পর বিভিন্ন অসুখে মারা গেছে।
ওর বড় ভাই হুলস্থুল করে ফেলেছে, পুকুর থেকে মাছ ধরেছে ওর জন্য। দুপুরে পালা মুরগির মাংস আর ডাল ছিল কিন্তু রাতে নানা পদের মাছ। রাতে একসাথে খেতে বসেছে। ওর বড় ভাবি খাবার দিতে দিতে বলল,
“মাজে মাজে এসেনে, খোঁজখবর রেকেনে, এই ভিটে তুমারও। আমরা মানষেরটা মেরে খাতি চাই নে।”
ওর ভাই বিরক্ত সূচক শব্দ করলো মুখ দিয়ে।
“আপনি চুপ থাকেন, আপনার বুনির কি কম আছে? তারপরেও ভিটের ভাগ চায়। সে থাকে বিদেশে, খোকন ভালো জায়গায় পড়তেছে। ভবিষ্যৎ ভালো। আমাদের মতন কষ্ট করে খাবে?
এরা গ্রামে আসে শখে ঘুরতি, থাকতি নয়, তাই না?”
অরণ্য চুপচাপ খাচ্ছিল। বড় ভাবি বিয়ে করে
আসার পর ওর জন্ম। ভাবি ওকে খুব আদর করেই বড় করেছেন। ওর মনে আছে পরপর দুইটা সন্তান মারা যায় ভাবির। এরপরে জমজ দুই ছেলে। ওর সাথে ওর ভাতিজাদের বয়সের পার্থক্য ছয়-সাত বছর হবে। দুজন চুপচাপ মুখ নীচু করে খাচ্ছে, দুজনেই দেখতে অনেক সুন্দর, মাশাল্লাহ।
তাদের সাথে ওর একটা দূরত্ব আছে। অরণ্যর মনে হল, একবার শেকড় ছেড়ে চলে গেলে সেখানে আরেকবার এসে ঠিকঠাক মত সবকিছু করা সম্ভব নয়। ওর নিজেরও দায় আছে, এরা সবাই আপনজন। খেতে খেতে ভাবে,এরপর থেকে খোঁজখবর রাখবে।
রাতে শুয়ে শুয়ে যখন গাছপালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছিল গায়ে,আর ঝিঝি পোকার চিৎকার আঘাত করছিল কানে। তখন অরণ্য ভাবছিলো মানুষ অনেক বৈষয়িক। বাবা কৃষক ছিলেন,বড় ভাই সেই কাজই করেছেন বাবার মত। এ ভিটে, চাষের জমি– সবকিছুতে ওদের তিন ভাইবোনের হক আছে। কিন্তু বড় ভাবি মনে লকরে ল হকটাই বেশি। কিন্তু এদিকে ওর বোন ও নিজের অংশ ছাড়বে না। অরণ্যর অবশ্য বিষয়টা ভালো লাগে না।তবে এটাও ঠিক, ওর বোন শুধু ভিটার অংশ চায়, অন্য কিছু না। ওর বোনের ইচ্ছে একটা ছোট বাড়ি করবে বাবার ভিটায়। অরণ্য চিন্তা করল ওর অংশ মুয়াজ মুমিন কে দিয়ে দিবে। তবে ভিটার জমি দিবে না। একটা সুন্দর বাড়ি করবে। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে গেল।
অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। ভাবি আগেই উঠে পড়েছে। ওকে দেখে কাছাকাছি আসলো,
“আমার কতায় কি রাগ করিচো?
অরণ্য হাসে,
“না ভাবি, তুমিই ঠিক বলেছ। আমি ইট্টু বাইরে যাই হাঁটতে। ভাইজান কনে?”
“আচ্ছা যাও ভাই, উরে ক্ষেতে পাবানে আমি রুটি আর আলুভাজি করি।”
দূরে একখণ্ড সবুজ জমির মাঝে বড় ভাই, লুঙ্গি পরা, হাতে কোদাল…মাঠের কিনারায় দাঁড়িয়ে। এত সবুজ চারিদিকে… অরণ্য ডাক দেয় তাকে
“ভাইজান!”
ওর বড় ভাই মুচকি হাসেন, বলেন,
“আরেহ! তুই যে এই সকালেই এস গেলি!লআরেকটু ঘুমোতিস!”
অরণ্য কাদামাটির মধ্যে হেঁটে যায়…. সামনের জমিতে সদ্য লাগানো ধান গাছের সারি দেখে অনেক ভালো লাগে। মাটির একটা সোঁদা গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, ঢাকায় এই গন্ধ নেই..এই গন্ধটা অরণ্য ভীষণ মিস করে।
ভাইয়ের সাথে হাঁটছে, পুকুরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল ওর ভাই,
“এই পুকুরে এবার নতুন করে তেলাপিয়া ছাড়িচি। চল, খাওয়াই দেকি।”
অরণ্য তাকালো, পুকুরের পানিতে সোনালি রোদ পড়ে চকচক করছে। অরণ্য নিজের হাতে মাছের খাবার ছুড়ে দেয়। মাছেদের খাবার খাওয়ার দৃশ্য দেখে খানিক। ভালো লাগে ওর।
একটু দূরে দেখা যায় ফুলের মাঠ। ওর ভাই বলে “ইদানিং অনেকেই ফুলের চাষ করিচে।”
হলুদ গাঁদা, লাল-সাদা গোলাপ আর রজনীগন্ধার সারি। দৃষ্টি আটকে যাবার মত সৌন্দর্য। হঠাৎ অরণ্যের মনে হয় কখনো যদি লাবণ্যকে গাদখালি গ্রামে নিয়ে যায়, মেয়েটা কি এত্ত ফুল থেকে খুশি হবে? ভাবনাটা ওকে চঞ্চল করে, অরণ্য ফিসফিস করে বলে,
“এত সুন্দর… এখানে মন চায় পাশে কেউ থাকুক, যে আমার ভীষণ প্রিয়।”
_________________
ক্লাস শেষ করে এসে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিল লাবণ্য। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে অনেকদিন হলো। থেরাপি সম্পর্কে নিজে একটু পড়াশোনা করেছে। চোখ বুজে ভাবল, ডাক্তার কি বলেছিল? বাবা-মাকে মন থেকে মুক্ত করে দিতে। সে চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত, ধীরে ধীরে নিজেকে বুঝিয়ে যাচ্ছে।
“লাবণ্য, ভাত খাবি? আয়।” পাশে এসে বসলেন রেহানা বেগম, গালে আলতো করে হাত রাখলেন, “খারাপ লাগছে মা?”
লাবণ্যের মনে পড়ে গেল, আজ সকালে মায়ের সঙ্গে ওর মন কষাকষি হয়েছে। দোষটা অবশ্য ওর, সব সময় তাই হয়। মা সব সহ্য করে যান, চুপচাপ। বাবা, মানে বড় চাচা— যাকে ও বাবা ডাকে, লাবণ্যের পক্ষ নিয়ে আজ সকালে মাকে বকা দিয়েছেন। তখন ভালোই লেগেছিল, কিন্তু ভার্সিটিতে যেতে যেতে মনে পড়েছে লাবণ্যের বড় চাচা যাকে ও বাবা ডাকে সে ওর রক্তের সম্পর্কের মানুষ।কিন্তু এই যে রেহানা বেগম, যিনি ওকে পাগলের মতো ভালোবাসেন, ভালোবাসার আদরে অক্টোপাশের মতো জড়িয়ে রাখেন— তিনি তো রক্তের কেউ না, ওর জন্মদাত্রী ‘মা’ও তো নন।
এসব ভাবতেই হঠাৎ যেন বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল লাবণ্য।
রেহানা বেগম চমকে উঠলেন। আজকে লাবণ্যের প্রতি একটু অভিমান হয়েছিল। কিন্তু কেন যেন এই মেয়েটার ওপর রাগ, অভিমান কিছুই বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না। কারণ এই মেয়েটাই তো তাঁর শূন্য মাতৃত্বকে পূর্ণতা দিয়েছে।
“কি হয়েছে মা? ব্যথা পেয়েছিস? ব্যথা করছে?” উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
লাবণ্য ফট করেই মাকে জড়িয়ে ধরল, বুকে মুখ গুজে দিল। তেল-মসলার পরিচিত গন্ধে মনটা ভরে গেল। এটাই তো তার সবচেয়ে প্রিয় গন্ধ, মায়ের গন্ধ।
“আমাকে মাফ করে দাও মা,” কান্না গলায় বলল লাবণ্য। “সকালে তোমার সঙ্গে খুব অন্যায় করেছি।”
রেহানা বেগম দুই হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। “মায়ের সঙ্গে বাচ্চারা এসব করেই মা। আর মা তো কখনো রাগ ধরে রাখে না, মাফ করেই দেয়। তুই তো আমার সোনা বাচ্চা, কলিজার টুকরা। আয়, খেতে আয়।”
মায়ের মুখে আদরের এই ডাকগুলো লাবণ্যের খুব ভালো লাগে। আরেকটু আহ্লাদী হয়ে বলে উঠল, “আজ তুমি খাইয়ে দাও।”
সন্ধ্যার নুইয়ে পড়া আলো বারান্দা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। লাবণ্য মোবাইলটা হাতে নিল। আজ অনেক কায়দা করে তটিনীর মোবাইল থেকে অরণ্যর নাম্বারটা নিয়েছে। নাম্বার সেভ করেছে ‘ঝগড়াটে ছেলে’ নামে। মনে হতে একা একাই হেসে উঠলো।
আশার বাচ্চাকে এসব বলা যাবে না। ওর কেমন একটু থ্রিল লাগছে, মজা লাগে ব্যাস। লাবণ্য ভালো মত জানে ও কখনোই কোনও সম্পর্কে যাবে না, যেতে পারবে না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনগুন করতে লাগল— “প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ।”
ঠিক তখনই আজানের ধ্বনি ভেসে এল। মাথায় ওড়না টেনে লাবণ্য ঘরে চলে এল। পড়াশোনা করতে হবে, সামনে পরিক্ষা, এর উপর হোম ওয়ার্ক …. উফ! মুখ দিয়ে একটা শব্দ করলো।
রাত তখন অনেক, রাতের খাবার শেষ করে লাবণ্য মোবাইলটা হাতে নিল। অরণ্যের ইনস্টাগ্রামে গেল। দুই দিন ধরেই দেখছে গ্রামের নজরকাড়া সব ছবি। কখনো ফুলের ক্ষেত, কখনো নদীর ছবি। আজ প্রোফাইলে ঢুকেই, ওর বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল! মুখে হাত দিয়ে নিজেকে সামলাতে লাগল।
অরণ্যের পোড়া হাতের একটা ছবি, ক্যাপশনে— “আজ পুড়েই গিয়েছিলাম প্রায়।”
লাবণ্য কমেন্ট চেক করার মত শক্তি খুঁজে পেল না। জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলাল। ঘড়ির দিকে তাকাল,রাত এগারোটা বেজে ৩৫ মিনিট। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। ঠিক-বেঠিক, ভদ্রতা-শালীনতা সব ভুলেই গেল যেন। ফোন করে বসলো। বুকের ভিতরের অস্থিরতাটা কমছে না।
অরণ্য গভীর ঘুমেই ছিল। গ্রামে এলেই ঘুমের রুটিন ঠিক হয়ে যায়।ফোনটা এক দফা বেজে থেমে যায়।আবার দুই বার রিং হতে অরণ্য বাম হাতে ধরে, ডান হাতটা পুড়ে গেছে খানিক।
অচেনা নাম্বার প্রথমেই মাথায় আঘাত হানল…তূর্য ঠিক আছে তো!
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।” ঘুম জড়ানো কন্ঠ।
লাবণ্য হঠাৎ করেই যেন কথা হারিয়ে ফেলল।
মাথায় যেন বাজ পড়ল, কি করে ফেলেছে!
চুপচাপ থাকাটাই বা কেমন!
তাই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
লাবণ্যের কণ্ঠ শুনে অরণ্যের ভিতরে একটা শিহরণ বয়ে গেল।এই অনুভূতিটা যেন ও আজই প্রথম অনুভব করল।নিজেও কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।এরপর এক সাথে অনেকগুলো কথা বলে ফেলল অরণ্য।
“আরেহ ! আপনি! কেমন আছেন? নাম্বার কোথায় পেলেন? আর হঠাৎ আমাকে মনে হল কেন?”
“আপনি হাত কিভাবে পুড়লেন? আগুন কোনো ভালো জিনিস না… সাবধানে থাকবেন।”
লাবণ্য চেষ্টা করেও গলার কাঁপুনিটা আটকাতে পারছে না।
অরণ্য বুঝে গেল, মেয়েটা ওর ছবি দেখেছে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে। লাবণ্যের গলার কাঁপুনি আর উদ্বেগ অরণ্যর ভালো লাগছিল। যেন ও খুব গুরুত্বপূর্ণ কারো জন্য। লাবণ্য কে অভয় দিতেই খুব সহজ গলায় বললো,
“আরে ম্যাডাম, পুরুষ মানুষের জন্য এগুলো কোনো বিষয় না। হঠাৎ করে রান্না ঘরে আগুন ধরেছিল, সেটা নেভাতে গিয়েই আর কি!
একটা মজার কথা শুনুন… আমি ফেসবুকে আপনাকে অনেক খুঁজেছি, পাইনি।এদিকে আপনি চুপি চুপি ঠিকই আমার প্রোফাইলে ঘুরাঘুরি করেন!”
লাবণ্য একটু লজ্জা পেয়ে গেল।এই ছেলেটা প্রচুর কথা বলে! ঠোঁট কাটা একদম।
কোনোমতে বলল, “তটিনীর সাথে আমার অ্যাড আছে, আপনার পোস্টগুলো সামনে চলে আসে।
আপনার নাম্বারটা ওর থেকেই নেওয়া। আমি দুঃখিত, এত রাতে বিরক্ত করার জন্য।”
“আচ্ছা শুনুন, দুঃখিত যখন হয়েছেন, তখন আমি মাফ করে দিলাম।এখন বলেন তো, আপনার ভালো নাম কী?”
“জাফরান খান। কেন?”
“জাফরান… নামটা একটু বেশিই কাব্যিক, না? ফেসবুক আইডি এই নামেই তাই না?”
লাবণ্য হাসে, “ হয়ত! আপনার ভালো নাম কি?”
অরণ্য রহস্য করে বলে, “ আমার নামে একটা বিখ্যাত ছড়া আছে, ক্লু দিলাম খুজে বের করুন।” তারপর হঠাৎ করেই বলল, “আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”
“করুন।”
“আপনি কি কখনো কাউকে খুব মিস করেছেন, অথচ সে জানেই না?”
লাবণ্য থমকে যায়, এই প্রশ্ন কেন?
“হ্যাঁ, ” ধীরে বলে লাবণ্য, “করেছি। অনেকবার।
আর আপনি?”
অরণ্য আবার শব্দ করে হাসলো, “আপনার প্রোফাইল খুঁজে না পেয়ে যে অস্থির লাগত, সেটা মিস বলা যায় তো? তাহলে করেছি।”
লাবণ্য ফোনের ওপাশে হেসে ফেলে
“এই যে আপনি এত কথা বলেন… তাতে আমি কনফিউসড হয়ে যাই। কি দিয়ে কি বলেন? আদৌ সব মন থেকে বলেন না বলার জন্য….”
“আমি যা বলি মন থেকেই….., আচ্ছা লাবণ্য আপনার কি জোনাকি পোকার আলো অথবা ঝিঝি পোকার চিৎকার এগুলো ভালো লাগে?
“লাগবে না কেন?”
“যদি পারতাম গ্রামের থেকে আপনার জন্য বোতলে করে এগুলো নিয়ে আসতাম। আচ্ছা এখন রাখি।”
ফোনটা রেখে লাবণ্য অনেকক্ষণ ফোনটা গালে ঠেকিয়ে রাখলো। আমার জন্য কেন আনতেন? আমি আপনার কে? কথাটা ওর মুখে বলা হলো না কিন্তু ফিসফিস করে নিজেকে বলল।
চলবে……