মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব–৫
তটিনী আর লাবণের মধ্যে অনেক সুন্দর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তবে মেয়েটা পাজি আছে অরণ্যর কথা কখনো বলে না। আর লাবণ্যর জন্য অরণ্য হচ্ছে একটা ধাঁধা, যে ধাঁধার সমাধান লাবণ্য চায়না।
সেদিনের কথার পর কেটে গেছে প্রায় তিন মাস। আর মাস দুই পর লাবণ্যদের পরিক্ষা। ওদের একটি শিক্ষাবর্ষকে দুটি সেমিস্টারে পরিক্ষা হয় একটি শীতকালীন সেমিস্টার এবং একটি গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টার। সামনে ওদের গ্রাষ্মকালীন সেমিস্টারের পরিক্ষা। লাবণ্য পড়াশোনায় ব্যস্ত। ভেবেছিল অরণ্য হয়ত ওকে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠাবে কিন্তু না, পাঠায়নি। একটু কষ্ট পেয়েছে, পরে ভেবেছে আসলে কি সম্পর্ক ওদের?
পাশেই বসা তটিনী আর রিয়া। দুজন গল্প করছে, ক্লসের ছেলেদের সাথে সখ্যতা থাকলেও ওরা তিনজন মূলত সবসময় একসাথে থাকে। তটিনীর এক ভাই বিদেশ থাকে, অস্ট্রেলিয়া। সে ভাই দেশে এসেছে, বিয়ে করবে। কনে ঠিক হয়ে আছে, বিয়ে নিয়ে হলুস্থুল চলছে। এই কথার মাঝেই লাবণ্য বুঝতে পেরেছে অরণ্য ওর আপন খালাতো ভাই না। দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই, তবে ঢাকায় অরণ্যের আর কোন আত্মীয়-স্বজন না থাকায় এদের সাথে সম্পর্ক বেশ ভালো। সামনের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ওর ভাইয়ের হলুদ, সেখানেই দাওয়াত পেয়ে গেল লাবণ্য। সবাইকে সবুজ রঙের জামদানি করতে হবে। লাবণ্যর খুব অস্বস্তি লাগছিল,
“ বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে তোকে জানাবো।” আনমনে বললো লাবণ্য।
এটা শুনে তটিনী আর রিয়া হেসে গড়িয়ে পড়েছে। “ আরে তুই কি বাচ্চা?আমাদের বাসায় অনুষ্ঠান, আর কাছাকাছি এলাকা। ”
লাবণ্য খুব রাগ হয়ে গেল, “ আমি বাচ্চা নই, আমার বাবা-মা আমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়। তোরা জানিস আমি একা একা কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চলে আসি। কিন্তু তোদের অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় বাবা মায়ের অনুমতি নিবো না?”
“তুই আসলেই খুব ভাল মেয়ে রে….! কিন্তু আসা চাই বুঝলি।” তটিনীর দৃষ্টি মোবাইলে।
লাবণ্যর দৃষ্টি ওর মোবাইল স্ক্রিনে পড়ল, অরণ্যদের একটা গ্রুপ ফটো। ওর মনের ভেতরটা কেমন করে উঠল এই ছবিটা তটিনী এত মনোযোগ দিয়ে দেখছে কেন?
________________________
গরমে অস্থির হয়ে, প্রাইভেট পড়ানো শেষ করে রুমে এসে ঢুকলো অরণ্য। তক্ষুণি রাবেয়া খালার ফোন আসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুরাগ ভাইয়া দেশে এসেছেন, অরণ্য পড়াশোনার জ্বালায় আর টিউশনি তোড়ে এখনো দেখা করতে পারেনি। তবে এখন আর এড়ানো সম্ভব না। ভাইয়ার বিয়ে এই সপ্তাহে।
“আসসালামু আলাইকুম খালা, কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, শুধু ফোন করলেই খালা কেমন আছেন? খালাকে দেখতে তো আসো না!”
অরণ্যের একটু অস্বস্তি লাগছিল। এটা ঠিক, খালা ওকে অনেক আদর করেন, মাঝেমধ্যে এটা-সেটা রান্না করে পাঠিয়ে দেন। আর অপরপক্ষে, অরণ্য আসলেই স্বার্থপরের মতো কোনো খোঁজখবর রাখে না।
“আরে খালা, একটু ব্যস্ত আছি! আপনারা কেমন আছেন? ভাইয়ার বিয়ের কতদূর?”
“তুরাগের বিয়েতে তোমাকে চাই, তোমার ব্যস্ততার অজুহাত শুনছি না। কালকে সকাল সকাল চলে আসবে, কথা আছে।”
অরণ্য মনে মনে হিসেব করল, গায়ে হলুদ আসতে আরো তিন দিন বাকি, এত আগে যাবে না। তাই বলল,
“খালা, বৃহস্পতিবার একদম সকালে চলে আসব। পড়াশোনা যা আছে, কয়দিনে শেষ করে ফেলি, ঠিক আছে?”
“আচ্ছা আচ্ছা বাবা, তোমার পড়াশোনা আগে। আর শোনো, তোমার বন্ধুদের নিয়ে এসো—যাকে যাকে মন চায়, সবার দাওয়াত।”
ফোন রেখে অরণ্য বাথরুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। একবারে গোসল করেই আসবে।
সামনের মাসে সেমিস্টার ফাইনাল। দুই বন্ধু অনেক পড়ছে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অরণ্য তূর্যের দিকে দেখছিল—ছেলেটার চেহারাটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। ইদানিং সিগারেট খায়, মাত্রাটা একটু বেশি। তবে অরণ্য বেশি কিছু বলে না। একটা দাগা খেয়েছে, একটু সামলে নিক।
এখন তূর্য মোবাইল হাতে বসে আছে। অরণ্যের একটু সন্দেহ হলো। আস্তে করে উঠে পেছনে দাঁড়ালো। যা ভেবেছিল, তন্দ্রার প্রোফাইলে ঢুকে তন্দ্রার বিয়ের ছবি দেখছে।
“ফেইক আইডি খুলেছিস?”
চমকে ফিরে তাকালো তূর্য, চেহারাটা রাগী হয়ে গেল।
“তুই আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছিস কেন? একসাথে থাকি, তাই বলে এমন না যে আমার পার্সোনাল লাইফ বলে কিছু নেই!”
কথা বলতে বলতে তূর্য হনহন করে বেরিয়ে গেল।
অরণ্যেরও রাগ লাগছিল। মনে মনে কটা খিস্তি করল—‘যা বেটা, যা ইচ্ছা কর!’ তারপর নিজের ফোনটা বের করল। ‘জাফরান খান’ এই আইডিতে প্রতিদিন একবার ঢু মারে। না, মেয়েটার আইডি লক করা, কোনো ছবিও দেওয়া নেই। বায়োটা খুব সুন্দর,
“ভালোবাসা না, আমার ভয় মায়াকে। ভালোবাসা ভোলা যায়, কিন্তু মায়া কাটানো যায় না।”
তটিনীর সাথে খুব সখ্যতা বোঝা যায়। তটিনীর আইডিতে ঢুকলেই দেখা যায়, কমেন্টে দুজনের কথাবার্তা। একটা ছবি পেয়েছে তটিনীর আইডিতে—তিন-চারজনের গ্রুপ ফটো। সেটা মনের অজান্তেই ক্রপ করে বড় করে লাবণ্য কে দেখছিল অরণ্য!
তখনই তূর্য রুমে আসলো, কোনো কথা না বলেই অরণ্যকে জাপটে ধরল। অরণ্যর হাত থেকে ফোনটা পড়েই যাচ্ছিল প্রায়।
“আরে কী হয়েছে? এই তূর্য, কি হয়েছে?”
“আমাকে মাফ করে দে! আমি কেন তন্দ্রাকে ভুলতে পারছি না? বিয়ের ছবিগুলো দেখলে অনেক কষ্ট পাই, তবুও কেন যেন দেখতে ইচ্ছে করে। আমি ওকে ঘৃণা করতে পারছি না কেন, অরণ্য?”
“দেখ, তুই শান্ত হ। শোন, তুই তন্দ্রার মায়ায় জড়িয়ে গেছিস। তোকে এই মায়াটা কাটাতে হবে। ধর, আজকে ও অসহায় হয়ে বিয়ে করত, অথবা মারা যেত—তাহলে কষ্ট পাওয়া যেত। কিন্তু মেয়েটা তোকে ধোঁকা দিয়েছে। তুই একটু বুঝতে চেষ্টা কর।”
“আমি এগুলো বুঝি, কিন্তু মনকে বুঝাতে পারি না। ঠিক আছে, আজ থেকে আমি ওর ছবি আর দেখব না। এই তোকে ছুঁয়ে কথা দিলাম।”
অরণ্য চমকে ওঠার ভঙ্গি করল, “শালা, মারতে চাস আমাকে?”
তূর্য হেসে ফেলল। ওর হাসির দিকে তাকিয়ে অরণ্য ঠিক করল, তুরাগ ভাইয়ের বিয়েতে তূর্যকে নিয়ে যাবে। বলা যায় না, হাসিখুশি পরিবেশে থেকে হয়তো কষ্টটা ভুলতে পারবে।
রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা আর চাঁদ দেখছিল অরণ্য। হঠাৎ একটা কথা মনে হলে হৃদপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে গেল,বিয়েতে নিশ্চয়ই লাবণ্য আসবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবার বাড়ি যাওয়ার পর ভাবি ওকে বলেছে, ওর আপা চায় আপার খালাতো ননদের সাথে ওর বিয়েটা হয়ে যাক। এতে শ্বশুরবাড়িতে আপার একটা প্রতিপত্তি বজায় থাকবে।
কিন্তু আপা কথাটা কখনো সরাসরি অরণ্যকে সেভাবে বলেনি, অন্য লোকের মুখে শুনেছে।তবে আপা ফোন করলেই ইনিয়ে বিনিয়ে ‘রুপা’ নামে মেয়েটার অনেক প্রশংসা করেছে। হঠাৎ এমন দম বন্ধ লাগছিল অরণ্যের। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল।
______________________
লাবণ্য তৈরি হচ্ছে ওর কেমন একটা থ্রিল ফিল হচ্ছে। অরণ্য নিশ্চয়ই আসবে। আসুক লাবণ্য পাত্তাই দিবে না। জাফরান নাম নাকি কাব্যিক। আচ্ছা ঐ ব্যাটার ভালো নাম কি? কত কবিতাই তো আছে…ধুর। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখলো,সবুজ জামদানি পরেছে। আরেকটু রেডি হওয়া বাকি।
এদিকে রিয়া এসে বসে আছে।রিয়াদের নিজেদের গাড়ি তাই আরও সুবিধা হয়েছে লাবণ্যর মা বাবা তেমন আপত্তি করে নাই।
“ওরে হুর পরি তোর হল?” রিয়া খিল খিল করে হাসছে, রিয়াকেও সুন্দর লাগছিলো। শ্যামলা গায়ের রঙ কিন্তু চেহারায় একটা চটক আছে।
হাতে কয়েক গাছা চুড়ি পরতে পরতে ফিরে তাকালো লাবণ্য, “ এই তো শেষ, সুন্দরী ম্যাডাম, চলেন।”
গাড়িতে উঠেই রিয়া গান ছেড়ে দিল, এত গান পাগলা এই মেয়ে…
“প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ
তোমায় যত গল্প বলার ছিল
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়ে ছিল
দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ…”
গান শুনতে শুনতে আনমনা হয় লাবণ্য লিরিকটা ওর জন্য কত সত্যি। জানলার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে ব্যাস্ত নগরের ছুটোছুটি দেখে। তক্ষুণি আরেকটা গান বেজে উঠে,
“বাহির বলে দূরে থাকুক
ভিতর বলে আসুকনা
ভিতর বলে দূরে থাকুক
বাহিরে বলে আসুকনা
ঢেউ জানা এক নদীর কাছে
গভীর কিছু শেখার আছে
সেই নদীতে নৌকো ভাসাই
ভাসাই করে ভাসাই না
না ডুবাই না ভাসাই
না ভাসাই না ডুবাই”
লাবণ্য চমকে যায় পর পর দুইটা গান ওর মনের অবস্থা কিভাবে বর্ননা করে ফেলছে… গান থামলে রিয়া কে জিজ্ঞেস করল, “ আচ্ছা বলতে পারিস কাউকে ভালোবাসার অনুভূতি কেমন?”
রিয়া স্বভাব মত খিলখিল করে হাসে, “ আমি কিভাবে বলব, ক্রাশ খাইছি বহুত কিন্তু প্রেম ভালোবাসা তো হয় নাই।” এরপর রহস্য করে বলে “কিন্তু তটিনীর ভাবসাব ইদানিং কেমন যেন লাগে।” এরপর লাবণ্য কে খোঁচা দিয়ে, “ তোকেও সন্দেহ হয়।”
লাবণ্য তখন মনে পড়ে যায়, তটিনীর এক দৃষ্টিতে অরণ্যদের গ্রুপ ফটো দেখার কথা। বুকের ভিতরে, কেমন একটা যন্ত্রনা, যেন কিছু ভেঙে পড়ছে। মুখে কিছু বলল না, ততক্ষণ একটা হিন্দি গান চালিয়ে দিয়েছে রিয়া। বিয়ার অবশ্য বিয়ে ঠিক, নিজের দূর সম্পর্কে কাকাতো ভাইয়ের সাথে। ছেলেটা দেখতে সুন্দর, দেশের বাইরে থাকে।
গায়ে হলুদের স্টেজ, ছাদের উপরে করা হয়েছে। তটিনীদের ছাদটা খুব সুন্দর। সেগুনবাগিচার পারে, একটু ভেতরের দিকে ওদের বাড়িটা। ছাদটা বেশ বড়, এক পাশে স্টেজ, সামনে চেয়ারের সারি। বড় বড় সাইন্ড সিস্টেমে গান বাজছে, তবে অনেক বিকট চিৎকারে না। বাংলা গান হচ্ছে, “তোকে হৃদ মাঝারে রাখবো…” এই গানটা।
ওদের দেখে তটিনী দুই হাত উঁচু করে ছুটে আসলো, জড়িয়ে নিল দিব বান্ধবীকে নিজের সাথে।
“মাশাল্লাহ! দুইটা ডানা কাটা পরি উপস্থিত,” মুখ টিপে হাসছে।
লাবণ্য, ওর দিকে তাকালো। তটিনীকে প্রচলিত অর্থে সুন্দর বলা যায় না। গায়ের রং ফর্সা, কিন্তু চোখগুলো বেজায় ছোট, আবার নাকটা ঠিকঠাক। প্রথম দেখায় মানুষকে তেমন একটা আকর্ষণ না করলেও ওর সাথে মিশতে থাকলে ওর চেহারার মায়াটা ধরা যায়। এদিক-সেদিক দৃষ্টি দিল। না, অরণ্যকে দেখলো না।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। হলুদ দেওয়া হচ্ছে, গান বাজছে। এখন মেয়েরা হালকা নাচানাচি করছে। লাবণ্যর কেন যেন এগুলো টানে না। যে কোন বাড়াবাড়ি ওর পছন্দ না। গান এখন উচ্চ শব্দে বাজছে, তাও তেমন ভালো গান না—মমতাজের কোন একটা গান, “লোকাল বাস”!
অরণ্যকে দেখেছে দুইবার। একটা সবুজ পাঞ্জাবি পরেছে, ওর সাথে আরও দুইটা ছেলে আছে। একজনের চোখে চশমা, লম্বা। আরেকজন ফর্সা, লম্বা, কিন্তু অনেক শুকনা।
ছাদের একদম কোনার একদিকে গিয়ে দাঁড়ালো লাবণ্য। গান ভেসে আসছে, কানে আঘাত করছে। তবু আকাশটা দেখতে ভালো লাগছিল। গুনগুন করছিল নিজেই,
“আমি আকাশ হতে পারি যদি সূর্য জ্বেলে দাও,
আমি বাতাস হতে পারি যদি পাপড়ি মেলে দাও।”
“আমি অরণ্য হতে পারি, যদি সবুজ ঢেলে দাও
যদি ফাগুন ঢেলে দাও।”
কানের কাছেই অরণ্যের বেসুরো গলায় গানের দুইটা লাইন চমকে দিল লাবণ্যকে।
“আপনি?”
“হুম! তখন থেকে আপনাকে দেখছিলাম, পাত্তাই দিচ্ছেন না। যাই হোক, আমি বলেছিলাম না সবুজ শাড়িতে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগবে? প্রমাণ পেলেন তো?”
হঠাৎ, লাবণ্যর গাল লাল হয়ে গেল। ভাগ্যিস জায়গাটা আধার আধার, ও নিজেই টের পাচ্ছিল ওর হাত-পা কাঁপছে। সেটা সামলে নিয়ে মুখ খুলল,
“এড়িয়ে গেলাম কোথায়? আর আপনাকে পাত্তা না দেওয়ার কী আছে? পাত্তা সেটা তো আপনি দেন না।”
অরণ্য রেলিংয়ের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো,
“বাহ! নিজে এতক্ষণ ভাব নিয়েছেন, এখন আমাকে বকা হচ্ছে! ভালো ভালো। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?”
দমকা বাতাস এসে অরণ্যের চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। লাবণ্য চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ খুলে অরণ্যের দিকে তাকালো। কী সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে! ছেলেটা ওকে এত টানে কেন? এড়িয়ে যেতে চায় ও …
“আমি কোনও ভাব নিই না। ভাব নিতে হলে যেসব যোগ্যতা লাগে, সেসব আমার নেই। খাবার কী দেওয়া হয়েছে?”
“আপনিই নিজেই নিজের সম্পর্কে জানেন না। কখনো আমাকে আয়না বানাবেন! চলুন, আপনার খাদেমদারি করি।”
লাবণ্য হেসে ফেললো। তারপর কি মনে হতে, ” আপনার হাতের কি অবস্থা দেখি।”
অরণ্য ডান হাত দেখালো দাগ আগে অল্প। সেদিক তাকিয়ে লাবণ্যর ইচ্ছে করলো হাতটা একটু স্পর্শ করে দেয়। নিজের হাতেই একটা শিরশির অনুভূতি।
তূর্য আর রাফি এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের উচ্ছ্বাস দেখছে। অন্য মানুষের আনন্দ আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। তূর্যর আজকে একটু ভালো লাগছে। রাফি চোখ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, অবশ্যই সুন্দরী মেয়ের খোঁজে। তবে তূর্যর সেসব খেয়াল নেই।
“আপনারা খেয়েছেন?”
অসম্ভব সুন্দর মিষ্টি একটা কণ্ঠ কানে বারি দিল দুই বন্ধুর। দুইজন তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটা তটিনী, অরণ্যর বোন।
“না, এখনো না।”
“আল্লাহ! অরণ্য ভাইয়াটা যে কী! আসুন, আসুন আপনাদের খেতে দেই,” মেয়েটা হাত নেড়ে বললো। সাজসজ্জার জন্য আসল চেহারা বোঝা দায়।
“আমরা অরণ্যর সাথেই খাব, আপনি চিন্তা করবেন না।” চশমাটা নাকের উপরে আরও ঠেলে দিতে দিতে বলল তূর্য।
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কোল্ড ড্রিংস হাতে সবাই গল্প করছে। তটিনী আচমকা অরণ্যকে ডাক দিল।
“ভাইয়া, এদিকে আসো। আমার বান্ধবীদের সাথে পরিচয় করাই। একজনকে অবশ্য তুমি আগেই চেন লাবণ্য। ওই যে ভর্তি পরীক্ষার দিন সাহায্য করেছিলে। আর অন্যজন হচ্ছে রিয়া—তোমার সাথে কিন্তু একটা মিল আছে,” কণ্ঠটা রহস্যময়।
অরণ্য অবাক হয়, চোখ তুলে তাকায় তটিনীর দিকে। এতক্ষণ ছুটোছুটি করে একটু ক্লান্ত, চা খুঁজতে নিচের দিকে যাচ্ছিল।
“তোমার যেমন আপুর ননদের সাথে বিয়ে ঠিক, ওরও ঠিক তেমন দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক। কী মজা, তাই না!”
লাবণ্য কোল্ড ড্রিংস হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। ভাবছিল বাসায় যেতে হবে, রাত হচ্ছে। কিন্তু এখন খুব সম্ভবত আবার নাচ হবে। রিয়ার খুব ইচ্ছা নাচানাচি করবে। তটিনীর কথাগুলো কর্ণকুহরে যাওয়া মাত্র কেমন যেন কেঁপে উঠল লাবণ্য। বুকের ভিতর কিছু দলা পাকালো। চোখ তুলে তাকালো অরণ্যর দিকে। দুইজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল।
অরণ্য বিপন্ন বোধ করল, অপ্রস্তুত হয়ে গেল। প্রথমেই চোখ গেল লাবণ্যর দিকে। মেয়েটার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস আর অভিমান—দুইটাই খেলা করছে।
“তোরা গল্প কর, আমি একটু নিচ থেকে আসছি।” মুখ খুললো লাবণ্য।
“হঠাৎ কী হল, কোথায় যাচ্ছিস?” ব্যস্ত হয়ে উঠলো তটিনী।
লাবণ্য আর এক মুহূর্ত থাকবে না। বাসায় চলে যাবে। কিন্তু এটা বললে ওরা যেতে দেবে না। ওর প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে, হাত-পা ভেঙে আসছে। কিন্তু কেন?
কোনোমতে বলল, “মাথা ব্যথা করছে খুব, তোদের বাসায় গিয়ে বসি একটু।”
লাবণ্য দ্রুত প্রস্থান করল।
অরণ্য সাথে যেতে চাইলো, কিন্তু কেউ একজন ডাক দিল, কিছু লাগবে…
চলবে……