মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব ১০
সকাল সাড়ে ছয়টা। হলের টানা বারান্দায় সকালের হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে। গাছগাছালিতে পূর্ণ বুয়েট ক্যাম্পাসে পাখি ডাকছে সুর করে। সে ডাকে ঘুম ভাঙছে কারও কারও, আবার কেউ সারারাত জেগে মাত্রই চোখ বন্ধ করেছে। জীবন এখানে একেক রকম।
বাথরুম থেকে ভেসে আসছে ট্যাপের শব্দ, রাফিদের রুম থেকে সুরা আর রহমান তেলাওয়াতের শব্দ। তূর্য বারান্দায় মৃদু পায়ে দাঁড়ালো। এই সকালে একটা প্রশ্ন ওর মাথায় আঘাত করল – তন্দ্রার সাথে ওর কী কথোপকথন হয়েছে, এই বিষয়টা চিঠি যে লিখেছে সে কিভাবে জানলো?
হঠাৎ একটা কষ্ট এবং ক্রোধ উঠে আসলো ওর মনে। ঠোঁট কামড়ে ভাবলো, এ মেয়ে নিশ্চয়ই তন্দ্রা। ওকে কোনোভাবেই শান্তি দেবে না।
রাফি ব্রাশ করতে করতে পাশে এসে দাঁড়ায়। ওর মুখে এখনো রাত জাগার ক্লান্তি। তূর্যের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়।
হলের মাঠে কয়েকজন দৌড়াচ্ছে। অরণ্য আছে তাদের মধ্যে, কেউ শরীরচর্চা করছে। বারান্দার কাপড় শুকানোর তারে দুলছে সারি সারি তোয়ালে আর টি-শার্ট। সারা রাত বারান্দায় ছিল, কিছু এখনো ভেজা, সদ্য মেলে দেওয়া।
রাফি তূর্যের পাশে এসে দাঁড়ায়,
“কি হল সকাল সকাল? কাল একটা যুদ্ধ জয় করলি, আর আজ মুখ গোঁজ করে আছিস?”
“একটা বিষয় ভাবছি।” দৃষ্টি চলে গেল দূরের একটা গাছের দিকে। কিছু দোয়েল পাখি উড়াউড়ি করছে। “এই চিঠি যে বা যারা লিখছে, মানুষটা আমাকে এত কিভাবে বুঝে? সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়, তন্দ্রার সাথে আমার কী কথা হয়েছে কিভাবে জানলো? আর সেটা লিখে এত দ্রুত কিভাবে আমাকে পাঠালো? তাও কুরিয়ারে?”
রাফি জিভে কামড় দেয়। ইস! আসলেই বিষয়টা ভুল হয়ে গেছে। তূর্য তো গাধা না, বুঝে ফেলেছে।
“তোর কী মনে হচ্ছে?”
“আমার মনে হচ্ছে এটা তন্দ্রার কোনো চালাকি। আমার ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে সারাক্ষণ নজর দিয়ে রাখে। হয়তো ভেবেছে, এভাবে আমাকে নাচাবে!”
রাফি মৃদু কন্ঠে বলে,
“এটা তোর বোঝার ভুলও হতে পারে। আমার তো মনে হয় চিঠি দেয় যে মেয়েটা, সে তোকে ভালবাসে।”
“ভালোবাসা! হাহ! পুরো একটা টাইম ওয়েস্ট বিষয়, জঘন্য জিনিস।” মুখ কুঁচকে নেয় তূর্য।
তখনই এসে দাঁড়ায় অরণ্য। ঘামে ভেজা শরীর। তার থেকে নিজের টাওয়ালটা টেনে নেয়।
“কি হল? কী সিরিয়াস আলাপ চলছে? আমি কিছু মিস করেছি?”
“কিছু না।” উত্তর দেয় তূর্য। মাথায় কিছু একটা চলছে।
তটনীর দৃষ্টি মোবাইলের স্ক্রিনে। তূর্য একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে আজকে। আর সেটা ওকে উদ্দেশ্য করেই। কিন্তু হঠাৎ কী হল?
“পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসে শুধু হৃদয়ের হাতে অপদস্ত হতে। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আমার মস্তিষ্ক দিয়েই চলবো।
যে বা যারা ভাবছে, আমার আবেগ নিয়ে খেলা খুব সহজ, তাদেরকে বলছি – আপনাদের আড়ালটা গুড়িয়ে গেছে, আমি আপনাদের চেহারাটা চিনে ফেলেছি।
সুতরাং কথার ফাঁদে আমাকে আর ফেলা যাবে না।
আমাকে বরং একা ছেড়ে দিন। আমি একা একাই নিজের যত্ন নেই। ধন্যবাদ।”
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো তটিনী। আস্তে করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এখন সন্ধ্যা সাতটা। আজ যেন অতীতের স্মৃতি মন্থন এর রাত।
তটিনী সবে সেবার এসএসসি দিয়েছে। অরণ্য ভাইয়া বুয়েটে পড়ে। একদিন ওদের বাসায় উপস্থিত বন্ধু তূর্যকে নিয়ে। তখন বয়স অল্প। তটিনী যেন ঠাস করে তূর্যের প্রেমে পড়ে গেল, একদম “প্রথম দেখায় প্রেম”- যাকে বলে। বিশেষ করে নামটা এত ভালো লেগেছিল। হাইট আর কন্ঠস্বর, সবই আকর্ষণ করেছিল ওকে।
কি এক উন্মাদনা! সারাদিন অরণ্য ভাইয়ের প্রোফাইলে গিয়ে খুঁজে খুঁজে উনার ছবি দেখা। তারপর উনার প্রোফাইলে ওঁত পেতে থাকা। সেখান থেকেই একদিন জানতে পারে তূর্য আর তন্দ্রা সম্পর্কে। সেদিনটা তটিনীর জন্য ছিল মেঘে ঢাকা। সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হবার দিন।
তখন কলেজে ভর্তি হয়েছে। সারাদিন সারারাত শুধু কান্নাকাটি করত। নিজের ভাঙা মনটাকে অনেক কষ্টে জোড়া দিয়ে লেখাপড়া শুরু করে দেয় পুরোদমে। এই কষ্টটার আসলে কোন তুলনা নেই। প্রথম ভালবাসা ভেঙে গেলে, সেটা যন্ত্রণা হয়ে হৃদয়ে আজীবন থাকে।
এরপর তূর্যের আর কোনো খবর নেয়নি তটিনী। ও একটু সংস্কারী টাইপের মেয়ে, যে ছেলে অন্য মেয়েকে ভালোবাসে, তাকে ভেবে কি হবে?তবে মনের মাঝে মানুষটা সেরকম থেকেই যায়।
তূর্য আর তন্দ্রার ব্রেকআপের বিষয়টি জানতে পারে অরণ্য ভাইয়ের কাছে। এরপর তুরাগ ভাইয়ের বিয়েতে, মানুষটাকে দেখে অনেক কষ্ট লাগে। সেখানেই ভালো আলাপ হয় রাফি ভাইয়ের সাথে। না, প্রেম-ভালোবাসা কিছু না, ও শুধু চেয়েছিল তূর্যকে সাহায্য করতে, এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে।
মনে হচ্ছে সেটা হয়ে গিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে।
“আমার প্রাপ্তির খাতা শূন্য থাকুক, তুমি জীবনে এগিয়ে যাও। হয়তো কোনো কারণে তুমি ভুল বুঝেছ, ভুলটা নিয়েই ভালো থাকো।”
এসব ভাবছে, তখনই মোবাইলে রাফি ভাইয়ের মেসেজ আসলো –
“আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো? আর বলো না, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।
তূর্য ভাবছে, চিঠিগুলো তন্দ্রা লিখছে বা কাউকে দিয়ে লেখাচ্ছে। কী করা যায় বলো তো?”
তটিনী চোখ মুছে ফেলল। একটা মেসেজ টাইপ করলো –
“ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের কাজ হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার দরকার নেই। আমি আর চিঠি পাঠাবো না। আশা করি, আমাদের এই কথাগুলো আপনি আমানত হিসেবে গোপন রাখবেন।”
ফিরতি মেসেজ আসলো –
“কিন্তু তুমি তো ওকে ভালোবাসো?”
“জ্বি ভাইয়া, উনি তো আর বাসেন না। যদি কখনো বাসেন, আমি ফিরে আসবো।”
মেসেজটা পড়ে রাফির একটু কষ্টই লাগলো। তূর্যর দিকে তাকালো, টেবিলে বসে পড়ছে। আরেক টেবিলে অরণ্য। কি বোকা ছেলেটা, মরীচিকার পিছনে ছুটেছে…
যাক, তবুও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে – এটাই শান্তি। উঠে নিজের রুমে চলে গেল।
_________________
সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে, অথচ অরণ্য অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আপা আর ভাবির রেষারেষিতে। সেদিন ভাবি ফোন করেছিলেন, উনার ভাষ্য–উনি কি অরণ্যকে কখনো তার বোনকে বিয়ে করতে বলেছে?এখন যদি অরণ্য নিজেই নিজের বোনের ননদকে বিয়ে করতে না চায় এতে উনার কি দোষ?”
অরণ্য বুঝে যে, আসলে সত্যিই ভাবির দোষ নেই। কিন্তু যখন আপাকে এটা বোঝাতে যায়, তখন আপা আরও রেগে যায়। সেদিন তো রাগের মাথায় অরণ্যকে “বেইমান” বলেও ফেলে। খুব কষ্ট পেয়েছিল অরণ্য। সব কিছুই ছেলেমানুষি মনে হচ্ছে, একটা দড়ি টানাটানির মাঝে যেন ফেসে গেছে।
এসবের ফাঁকে বড় ভাইয়ের ফোন করছেন ক্রমাগত, বলছে, দেশে যেতে একবার হলেও। আপা-দুলাভাই নাকি বারবার বলছে ওর বড় ভাই অরণ্যকে ঠকিয়ে ওর জমি খেয়ে ফেলবে। ভিটে, জমি, সব ভাগাভাগি করে দিতে হবে। তাই ওর বাড়ি যাওয়া খুব প্রয়োজন। এসব শুনে অরণ্যর অসহ্য লাগে। দুই দিক থেকে টানাটানি….ক্রমাগত দম বন্ধ করা এক অবস্থা।
এই পারিবারিক টানাপোড়েন লাবণ্যকে বলতে চায় না অরণ্য। কে জানে, লাবণ্য যদি ওর ভাইবোনদের ছোট ভাবতে শুরু করে? কিন্তু লাবণ্য কিভাবে সব যেন বোঝে, অরণ্যর অন্যমনস্কতা, মন খারাপ, অল্প কথা বলা,সব কিছু খুঁটিয়ে ধরে ফেলে যেন।
আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয় অরণ্য। কত ভাগ্য করে ও পেয়েছে লাবণ্যের মতো কাউকে! আজ দেখা করতে যাচ্ছে, কাল ফোনে লাবণ্য বলেছিল—”তোমায় এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব,যেখানে তোমার সব অস্থিরতা কেটে যাবে।”
আনমনে হাসে অরণ্য, আচ্ছা, মেয়েটা কি জানে না! ওকে দেখলেই তো অরণ্যর সমস্ত অস্থিরতা, সমস্ত কষ্ট মিলিয়ে যায়?
লাবণ্য অরণ্যকে সাথে নিয়ে ওর বান্ধবী রিয়াদের বাসায় যায়। যেতে যেতে অরণ্য বলে,
“কি ব্যাপার মানুষের বাসায় নিয়ে যাচ্ছ যে!কি মতলব ভাই তোমার? মায়ের কথাটা ভুলে যেও না।”
লাবণ্য তীর্যক চাহুনি দেয়, “ মুখে লাগাম দাও বজ্জাত লোক, খালি আজাইরা কথা।”
“বারে, বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যাচ্ছ, আবার বললা বাসায় কেউ থাকে না। আমি ভয় পাব না?”
লাবণ্য গভীর চোখে তাকায়, “ আমাকে তেমন মেয়ে মনে কর?”
অরণ্য ফোঁস করে একটা নি:শ্বাস ফেলে, “ তোমার সাথে ইয়ার্কিও করা যায় না! অনেক সিরিয়াস তুমি।”
রিয়াদের বাড়িটা খুব সুন্দর ধানমন্ডি লেকের একদম সাথে। রিয়াদের বাসায় কেউ থাকে না বলতে গেলে, ওর বাবা মা সর্বক্ষণ বাহিরে। লাবণ্য অরণ্যকে সাথে নিয়ে রিয়া’দের ছাঁদে যায়।
সময়টা গোধূলির, রিয়াদের দোলনাতে বসে দুজনে সূর্যাস্ত দেখে, সূর্যের স্তিমিত আলো অরণ্যর চোখে মুখে পড়ে, অরণ্যকে এত সুন্দর লাগে যে, লাবণ্য ওর গাল টিপে দেয়।
“এটা কি হল?” অবাক কণ্ঠে জানতে চায় অরণ্য।
“গাল টিপে দিলাম।“ দুষ্টু হাসে লাবণ্য।
“আমি ও দেই? ” বলেই অরণ্য লাবণ্যর গাল টিপে দিল। তারপর ওর কপালে ঠোট স্পর্শ করল। ফিস ফিস করে বলল, “তোমাকে ঠিক হলদে পরী লাগছে।”
“একদিন আসবে যখন আমরা এক সাথে সূর্যাস্ত, সূর্য উদয় সব দেখবো।” ফিসফিস করে লাবণ্য।
“তুমি অপেক্ষা করবে তো? আমি তোমার পরিবারকে ভয় পাই, বিশ্বাস করতে পারি না জানো?”
“অনন্তকাল করবো। কারণ তুমি ছাড়া আমার কোন গতি নাই। ব্যাপারটা এমন, তুমি আমার একটা অংশ হয়ে গেছো। এমন অংশ যা কেটেও বাদ দেওয়া সম্ভব না। এখন বল এটাই তোমার চিন্তার কারন?”
সময়টা খুব সুন্দর পাখিরা কিচির- মিচির করতে করতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আকাশটা ক্ষনে ,ক্ষনে রঙ বদলাচ্ছে। কখনও বাসন্তি –নীলের মিশেল ,কখনও বা লাল- বাসন্তি আর ছাই বর্ন । মৃদু মিষ্টি বাতাস চুল উড়িয়ে দিল লাবণ্যর ,স্পর্শ করল অরণ্যর গাল! দুজনেই চুপচাপ।
লাবণ্য হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি জানো অরণ্য, আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমরা কি আসলেই একদিন এমন একটা ঘর বানাবো , যেখানে ছাদ থাকবে, দোলনা থাকবে… আর এইরকম সূর্যাস্ত?”
অরণ্য একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
“তোমার জন্য আমি এমন একটা ঘর বানাবো, যেখানে, ঘরের প্রতিটি কোনে আলোর খেলা থাকবে।আমাদের বাসায় সকাল শুরু হবে তোমার প্রশান্ত মুখের হাসিতে, এতটুকু নিশ্চিয়তা তোমাকে আমি দিতে পারি।”
লাবণ্য হেসে ফেলে, “বাহ! আর সেটা কিভাবে?”
অরণ্য ভুরু কুঁচকে বলে, “ বুঝ নাই আমি এত ভালোবাসা দিব যে তুমি সারাক্ষণ হাসিমুখে থাকবে।”
এই কথা শুনে লাবণ্য অরণ্যর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকায়।
“আচ্ছা, তাহলে ঝগড়া আর রাগ সেগুলো কে করবে?”
অরণ্য আস্তে ফিসফিস করে, “,কেন ম্যাডাম আপনি!”
লাবণ্য হেসে ফেলে, “ ইশ! নিজে খুব সাধু পুরুষ।”
অরণ্য আরেকটু কাছাকাছি আসে, “ সত্যি করে বল, নই আমি সাধু পুরুষ?”
লাবণ্য থতমত খায়, “ হু..তারপর অরণ্যের চোখের দিকে তাকায়, “ তোমার চোখ দুটো খুব সুন্দর!”
অরণ্য মুচকি হাসে, কথা ঘুরিয়ে ফেলেছে লাবণ্য “হুম! এতে লিখা আছে, তোমায় ছাড়া আমার সব কিছু শূন্য।”
লাবণ্য আনমনে বলে,
“তুমি কখনো শুধু আমার হাতটা ছেড়ে দিও না, ঠিক আছে?”
অরণ্য আস্তে ওর হাতটা চেপে ধরে বলে,
“আমি হাত ধরেছি চিরকালর জন্য। ছেড়ে দিলে তুমি আর আমি আমরা হব না। হয়ে যাব দুটো আলাদা মানুষ । সেটা কি সম্ভব?”
_________________
কয়েক মাস কেটে গেছে মাঝে, তূর্যর কাছে আর কোন চিঠি আসেনি। তবে তূর্য কিন্তু অপেক্ষা করে, অবচেতন মনে। বহুবার পড়া হয়ে গিয়েছে চিঠি গুলো তবে হ্যাঁ নিজেকে সামলেও নিয়েছে অনেক। কিন্তু মনে কোথায় একটা দ্বিধা রয়ে গেছে, কিছু সূত্র মিলাতে পারছে না।
“আচ্ছা রাফি তোর কি সত্যি মনে হয়, তন্দ্রা এগুলো করেছে, বা করতে পারে?”
অরণ্য মোবাইলে কিছু একটা দেখছিল, মাথা উঁচু করলো, “ তোর কি তন্দ্রাকে এত ক্রিয়েটিভ মনে হয়? না ওর এত সময় আছে। হুদাই এগুলো ভাবছিস।”
দাঁত দিয়ে কলম কামড়ে ধরল তূর্য, “তাহলে কে হতে পারে?”
রাফি এখানে থেকে উঠে এসো পেছনে দাঁড়ায়, পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে, “ এখন এসব ভেবে কি লাভ? তুই কি ভালোবাসি চিঠি লিখে দেওয়া মেয়েটাকে?”
“আরেহ নাহ!” সচকিত হয় তূর্য, “ একটু কৌতুহল শুধু? আর কিছু না!”
“তাহলে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে পর।” আরমোড়া ভাঙ্গে অরণ্য, “ আমার যে কি বিপদ বাড়ি যেতে হবে। ভাল্লাগেনা ভাই জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে এত ক্যাঁচাল।
_____
ক্লাস শেষ হয়েছে, তটিনী লাবণ্য আর রিয়া এক সাথেই বের হয়েছে। আজ আকাশটা খুব পরিষ্কার, তিন বান্ধবী হাঁটতে হাঁটতে আগাতে লাগলো। লাবণ্য খেয়াল করেছে, তটিনী বিগত কয়েক মাস ধরেই খুব মনমরা থাকে। কিন্তু কিছু বলে না মেয়েটা একটু চাপা স্বভাবের। প্রেম ভালোবাসা নয়তো! কি জানি কাঁধ ঝাকায় লাবণ্য। দৃষ্টি যায় দূরের একটা নাম না জানা গাছের দিকে, তাতে একটা দাড়কাক বসে আছে।
লাবণ্য নিজের মনটাও খারাপ, ওর মামাতো বোন আশা, প্রায় দুই বছরের প্রেমের সম্পর্কটা ভেঙে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছেলেটা একই সাথে দুজনের সাথে সম্পর্ক করছিল। আচ্ছা ছেলে মানুষ এরকম কেন? আশার বিয়ে ঠিক করছে মামা, আশা এখন রাজি হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আশা এখন প্রেম ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। কালকে বরং লাবন্য কে উস্কাচ্ছিলো, লাবণ্য যেন অরণ্যের দিকে নজর রাখে। ব্যাটা মানুষ খুব খারাপ।
তটিনী আর রিয়া চলে গেল। লাবণ্য ভাবলো আজ বুয়েট ক্যাম্পাসে যাবে। নিজে আগে খুঁজবে অরণ্যকে, সারপ্রাইজ দিবে। আনমনে ভাবে, নাকি অরণ্যকে পরিক্ষা করতে….ধুর কি ভাবছি।
বুয়েটের ক্যাফিটোরিয়ারের পাশে বসে চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়িয়ে, হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে, গল্পে গল্পে সময় উড়ে যায় বন্ধুদের। আজ ও ব্যাতিক্রম না। দূর থেকেই অরণ্যের বন্ধুরা লাবণ্যকে দেখে উঠে অন্য দিকে চলে যায়, যাবার আগে চাপা গলায় বলে, “ নে সুযোগ দিলাম শালা।”
অরণ্য অবাক হয়, আজ না বলেই এলো লাবণ্য। কাছাকাছি এসে লাবণ্য বলে,
“এটা কি বুয়েট ক্যাম্পাস? মি:অরণ্যকে খুজছিলাম।”
অরণ্য হেসে ফেলে, “ একদম সঠিক জায়গায় এসেছেন ম্যাডাম, আর টাইম ট্রাবল বা ভুল করেননি, এবার আমার হৃদয়ে ল্যান্ড করেন তো!
শব্দ করে হেসে উঠে লাবণ্য।
তক্ষুনি সামনে এসে দাঁড়াল একটা মেয়ে, লম্বা, ফর্সা, চোখে ফ্রেমহীন চশমা। “অরণ্য! রুম নম্বর ঠিক হয়ে গেছে কালকের গ্রুপ মিটিংয়ের জন্য!
অরণ্য হালকা বিব্রত হেসে, “হ্যাঁ ঠিক আছে, লাবণ্য…অর্পা, আমার ক্লাসমেট।”
অর্পা হেসে চলে যায়। কিন্তু লাবণ্য আর হেসে উঠতে পারে না, ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে, “বন্ধু, তাই না?”
“উহু!ক্লাসমেট, গ্রুপ প্রজেক্টে আছে ও।” কথা শেষ করে লাবণ্যর হাত ধরে।
লাবণ্য ঠান্ডা গলায়, “ বাহ! ক্লাসমেটের সাথে অনেক ভালো বোঝাপড়া মনে হলো। সুন্দরী ও অনেক।”
অরণ্য বুঝতে পারে কী হচ্ছে, “ওহ, তুমি কি জেলাস? আমার কিন্তু ভালো লাগছে।” মুচকি হাসে।
আরও কিছু বলার আগেই মেয়েটি ফিরে আসে,
“ও ভুলেই গিয়েছিলাম কাল তো তুমি যশোর থাকবে, আজ রাতেই রওনা হচ্ছ?
“হ্যা। এসে যোগাযোগ করব ইন শা আল্লাহ।”
লাবণ্যর মুখ পুরাই থমথমে সেদিক তাকিয়ে অরণ্যের রাগ হল হঠাৎ,
“মানে, তুমি কি সত্যিই ভাবো, তুমি ছাড়া আমি আর কাউকে ওইভাবে দেখছি? বা দেখতে পারি?”
“যশোর যাচ্ছ, সামান্য ক্লাসমেট জানে, অথচ আমি জানি না…ঠিক এতটাই গুরুত্বপূর্ণ আমি তাই না?” লাবণ্য দৃষ্টি ফেরায় এদিক সেদিক।
অরণ্য এবার একটু দমে যায়, “পারিবারিক কিছু ঝামেলা, জমি জায়গা নিয়ে। তোমাকে এসব বলতে ইচ্ছে হয়নি, বিশ্বাস কর।”
“এই ক্লাসমেট কে বলেছ সেসব?”
“নাহ, তা কেন? কি পাগলের মত কথা বলছ তুমি, যশোর যাচ্ছি এটা বলেছি কারন আমাদের গ্রুপ মিটিং করার কথা।”
“সেটাই, যশোর যাচ্ছ সেটাই বলতে আমায়, পেছনের কারন বাদ দিয়ে। আমি তো আকাশে বড় চাঁদ দেখলে, আমার গাছে ফুল ফুটলেও তোমাকে জানাই…আর তুমি?”
কিছুক্ষণ নিরবতা শুধু বাতাসে যেন কিছু তিক্ততা আর মন খারাপের গান।
লাবণ্য অশ্রু সামলে, “ আমি ভয় পাই অরণ্য… কাউকে আমার নিজের ভাবার পরও যদি হারিয়ে ফেলি…মানুষ মনের কোন ভরসা নেই। আশার ভালোবাসাও তো শুদ্ধ ছিল ভেঙে তো গেলই।”
অরণ্য ধীরে কিন্তু শক্ত গলায় বলে, “ আমি তোমাকে অবশ্যই বলে যেতাম যাওয়ার আগে। আর অন্য মানুষের সম্পর্ক ভাঙার গল্প আমাকে শোনাবে না। অন্য মানুষ কেমন আমি জানিনা। কিন্তু আমি জানি তুমিই প্রথম, যাকে আমি হারাতে চাই না।”
লাবণ্য উঠে দাঁড়ালো, “ সাবধানে যেও, আমি যাই।”
অরণ্য বুঝতে পারছে লাবণ্য নিজের কান্না সামলাচ্ছে, তাই কিছু বললো না। পাছে লাবণ্য আরও কান্না করে দেয়। কি তুচ্ছ কারনে এই মেয়েটা কষ্ট পায়, অরণ্য ভাবলো ঝামেলা মিটিয়ে আসি তোমার অভিমান, রাগ অভিযোগ সব মিটিয়ে দিব।
চলবে…
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেস