মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব-১১
অরণ্য যশোরে পৌঁছে লাবন্য কে ফোন করলো, কিন্তু লাবণ্যের ফোনটা বন্ধ। আনমনে হাসলো অরণ্য, লাবণ্যর এই মান অভিমানগুলো ওর ভালো লাগে, এটাই তো ভালোবাসা!
রাস্তায় রিকশা ধরে গ্রামের ভিটের দিকে এগিয়ে চলেছে। ভিটেতে ঢুকতে ঢুকতে আগের মত অনুভূতি হল, উঠানের পাশে একটা নিমগাছের পাশে দাঁড়িয়ে যায়।গতবার এখানে কিছু চারা লাগিয়েছিল, এখন গাছগুলো মাটি আঁকড়ে বড় হয়ে উঠেছে। সময় বদলায়, প্রকৃতি বদলায় না। গতবার এসেছিল সে অনেক আগে।
“মুমিন! মুয়াজ!” উঠানে দাঁড়িয়ে দু’জনকে ডাক দিল অরণ্য।এখন সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক ওরা ফোনে অনেক কথা বলে।
ওর কন্ঠ শুনে ওর ভাবি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো, “ এতদিন পরে এলে, বাড়ির কথা তো ভুলেই গিয়েচো।”
অরণ্য অপ্রস্তুত হয়, তারপর হাসে, “না ভাবি ভুলে যাইনি, ব্যস্ত থাকি।”
ভাইকে কোথাও দেখে না।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ক্ষেতের দিকে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে পথের দুই পাশে চোখ পড়ে—সবুজ ধানের ক্ষেত, কচি পাতায় রোদের ঝিলিক। মাঝখানে মাটির সরু আল, যেখানে খালি পায়ে হাঁটলে ঠান্ডা মাটি শরীর ছুঁয়ে যায়।
দূরে দেখতে পায় ভাইকে, ধানক্ষেতে কিছু কাজ করছে।
অরণ্য কাছে গিয়ে বলে, “কেমন আছেন ভাইজান? এই গরমে কাজ করছেন, একদম ঘেমে গেছেন, একটু বিশ্রাম নিয়ে নেন।!”
ভাই হাসেন, “ তোকে দেখে ভালো লাগচে রে, এলি শেষ পর্যন্ত, অনেক দিন পর এলি।”
অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল, তারপর ইতস্তত করে সরাসরি বলল, “… ভিটের জমিটা নিয়ে কি ঝামেলা? তাহলে ভাবি আর আপার মাঝেও কি দ্বন্দ? সব ভাগ করে ফেলবেন এবার?”
ভাইয়ের মুখ থমথমে হয়ে যায়। কাদার ওপর থেমে দাঁড়িয়ে বলে, “আচ্ছা তোর জমি বুঝি আমরা মেরে খাব? খুকি কেন অযথা এগুলো বলে?যাইহোক আমিও ভাবছি ভাগ করে দিব এবার। আর ওদের নিয়ে তোকে ভাবতি হবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা কর।আমি প্রতিদিন মুখোমুখি হই ওদের কথার।”
অরণ্য শান্ত গলায় বলে, “তাই করেন ভাইজান। শান্তি আসুক।”
ভাই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, “ঠিক বলেচিস…বাবা আর মা নেই তোরাই আচিস। সম্পর্কই আসল, জমি সম্পদ তো পৃথিবীর বোঝা।”
অরণ্য অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়, সূর্যের আলো মুখে পরে চিকচিক করছে, ঘাম গড়িয়ে পরছে। কি একটা কথা বলল ভাইজান!অশিক্ষিত কৃষক ওর ভাই বয়সের ব্যাবধান অনেক দুই ভাইয়ের। আজ ওর ভাই যেন ওকে শিক্ষা দিল, অভিজ্ঞতাও একটা শিক্ষা যা জীবন নামক প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায়। দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। তিক্ত বাস্তবতা যেন ওদের দুই ভাইয়ের সম্পর্ক আর একটু পরিণত করে দিল।
গ্রামে অল্পতেই রাত নামে। ঝিঝি পোকার একটানা চিৎকার আর জোনাক পোকার মিটিমিটি আলো উদাস করে অরণ্যকে। ভাবে, এতটুকুতেই এই মেয়ের এত অভিমান! সেকেন্ড ইয়ারে যে ওকে একজন পছন্দ করত, সেটা জানলে সম্ভবত মেরেই ফেলবে। হাসলো আনমনে, অবশ্য সেই মেয়েকে চিনেই না অরণ্য—লাভ কনফেশন গ্রুপে একটা চিঠি দিয়েছিল, ব্যাস। অরণ্য পাত্তা দেয়নি। যাই হোক, সারাদিন আর ফোন করার সুযোগ হয়নি। এখন খুব লাবণ্যর কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছে।
তিনবার পুরো রিং বাজার পর ওপাশ থেকে লাবণ্য ফোন ধরলো। ফোন ধরে চুপ করে রইলো।
“কথা বলবে না?” ছোট্ট করে বলে অরণ্য।
“একটা খোঁজও নিলে না, দেখলাম তোমার ভালোবাসা। রাস্তাঘাটে একটা বিপদও তো হতে পারত।”
“ফালতু লোক, অসহ্য! কাল থেকে কষ্ট দিচ্ছে, এখন আবার এসব কথা বলছে। এজন্যই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না।” রাগী কণ্ঠ লাবণ্যর।
“যাক, ম্যাডামের মুখ খুললো অবশেষে। আমি কিভাবে কষ্ট দিলাম বলো? তুমি গল্পের গরু গাছে তুলে, নিজেই কষ্ট পাও।” লাবণ্যকে রাগিয়ে দিতে শব্দ করে হাসলো।
“আসবে কবে? তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।”
“ইচ্ছেতে লাগাম দাও, ফালতু মানুষ দেখতে হয় না।” খোঁচা দিয়ে বলল অরণ্য।
“অবশ্যই ফালতু, কিন্তু আমার মানুষ। কবে আসবা?”
“নিজের মানুষকে যখন, এর ভয় কিসের? পরশু আসবো ইনশাআল্লাহ। সামনে পরীক্ষা না?”
“ইস! তাহলে তো দেখা হবে না। আশার বিয়েতে আমরা সবাই সিলেট যাচ্ছি।”
“বিয়েতে যাচ্ছ? আমাকে আজ বলছ, অথচ তুমি এটা আগেই জানতে, তাই না? নিশ্চয়ই হলুদে শাড়ি পরবে?” গলাটা ভার হয়ে গেল অরণ্যের।
“সুযোগে খোঁচা দিচ্ছ? আর হ্যাঁ, শুন না, জামদানি পরব বুঝলা।” কণ্ঠ এখন আহ্লাদী। “অন্য অনুষ্ঠানে সালোয়ার কামিজই পরব। একটা হলুদ জামদানি নিয়েছি।”
অরণ্য চোখ বন্ধ করলো—হলুদ শাড়িতে লাবণ্য। কিন্তু জামদানিতে তো খুব পাতলা হয়…
“জামদানি পরবে কেন? খুব পাতলা হয় কিন্তু…”
লাবণ্যও পাশে হেসে গড়িয়ে পড়ল। “আরে আমি শার্টের মতো মস্ত ব্লাউজ বানিয়েছি জনাব! শাড়ি পরে ছবি দিব নে।”
“প্রথম ছবিটা আমাকে দেবে, আমি আগে দেখতে চাই তোমাকে। আর জানো… আমার খুব ভয় লাগে, এসব বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ের প্রস্তাব আসে বুঝলা? যদি কেউ তোমাকে পছন্দ করে ফেলে?”
“আরে দূর! আমি এত সুন্দর বুঝি? তোমার সব অনর্থক কথা। এখন ঘুমাও তো।”
“তুমি অনেক সুন্দর, লাবণ্য। সেটা আমার চোখে। বাকি দুনিয়ার কাছে তুমি অসুন্দর হলেও আমি খুশি।”
“কি বাজে লোক একটা! কি দোয়া করে! পাজি! পরে তোমার পরিবার আমাকে রিজেক্ট করে দিবে। আর শুন, সেম টু ইউ। তোমার দিকে নজর দেওয়া সব মেয়ে কানা হয়ে যাক। তুমি তাদের চোখে ভিলেন হয়ে যাও…”
“থাম বাবা, থাম… শুভ রাত্রি।”
ফোন রেখে হাসে অরণ্য। আজ আপার সাথেও কথা হয়েছে। আপার অভিযোগ, অভিমান সব শুনেছে। আসলে আপা একটু কর্তৃত্ব চায়, আর কিছু না। এক সময় দরিদ্র সংসারে অনেক সাহায্য করেছেন আপা। কিন্তু তাকেও বুঝতে হবে, সময় এখন বদলে গেছে। বড় ভাই-ভাবি একটু করে সংসার গুছিয়ে নিচ্ছে। তাদেরও সারা জীবন অন্যের কর্তৃত্ব ভালো লাগবে না।
ভাগাভাগির বিষয়টা আলোচনা করে ফেলেছে। অরণ্য শুধুমাত্র ভিটার আর অল্প কিছু জমি নিবে, বাকিটা দুই ভাতিজাকে দিয়ে দিবে। আপাও শুধুমাত্র ভিটের অংশ নেবে, আর কিছু না। অরণ্য আপাকে অনেক তেল দিয়ে দিয়ে কথা বলেছে, আপার মনটা নরম, এতেই খুশি হয়ে গেছে। তখনই আপা জিজ্ঞেস করেছে লাবণ্যর কথা, অরণ্য সবকিছুই বলেছে আপাকে। আপা খুশি হয়েছে, এখন আর অরাজি নয়।
বড় ভাবিও ছবি দেখে পছন্দ করেছে। বলেছে, “সুন্দর আছে, নইলে আমার রাজপুত্র দেওরকে বশ করতে পারে?” একটা উপমাও দিয়েছে লাবণ্যকে—“পদ্ম ফুলের মত মুখটা একদম।”
মনে একটা প্রশান্তি অরণ্যের। হঠাৎ একটা কথা মনে হতে, আবার ফোন করলো লাবণ্যকে।
“আসসালামু আলাইকুম, ঘুম আসে না জনাবের?” কণ্ঠে খুশি ঠিকরে পড়ছে।
“না, ম্যাডাম শাড়ি পরে স্বপ্নে হানা দিচ্ছেন—হলুদ জামদানি! আহ!”
ওপাশে লাবণ্য লজ্জা পেয়ে গেল হঠাৎ, “হিংসুক ব্যাটা, আমি সেজেগুজে বিয়েতে যাব, তা হজম হচ্ছে না?”
“কেন সাজবে লাবণ্য, কে দেখবে?” কণ্ঠ ব্যাকুল অরণ্যের।
“নিজের জন্য। মেয়েরা সাজে নিজের জন্য, আর অন্য মেয়েদের দেখাতে—মূর্খ পুরুষ।” খিলখিল করে হাসছে লাবণ্য।
“আচ্ছা, তাই? শুনো একটা কথা, তোমার জানা প্রয়োজন।” হঠাৎ কণ্ঠটা গম্ভীর হয়ে গেল অরণ্যের।
“আমার বাবার জমির বেশিরভাগ অংশ আমি আমার বড় ভাইকে দিয়ে দিয়েছি। ভাই আমার কৃষক মানুষ, ছেলে দুটো মাদ্রাসায় পড়ে। এখন মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। আমার সবকিছুতেই তো তোমার দাবি।”
কথাগুলো শুনে লাবণ্যর খুব ভালো লাগলো। মনে হলো ওর বাবা-মাও সব কিছু নিয়েই এরকম পরামর্শ করে।
“তুমি যা করেছ ভালো করেছ। আমি কী বলব বা মতামত দেব? তুমি যদি স্বেচ্ছায় তোমার দাবি ছাড়তে পারো, আমিও তো মেনে নিতে পারি।”
সেদিন রাতে দুজনের ঘুম খুব ভালো হলো।
_________________
সূর্য ডোবার পরে,আকাশে আজ কেমন একটা কালো, ধূসর মেঘের খেলা, চাঁদটাও মেঘের লুকোচুরি খেলছে। ঠিক তূর্যের মনের মতো! সে আস্তে করে নোটবুকটা তুলে নিল সাবধানে, অরণ্য কিংবা রাফি দেখলে খুব ক্ষেপাবে।
চিঠিগুলো তে হাত বুলায়,চিঠিগুলোর মধ্যে এক ধরনের হালকা, অদ্ভুত ঘ্রাণ পায় তূর্য। প্রতিটি চিঠিতে কিছু স্টিকারও থাকে, মেয়েটা নিজ হাতে লাগায় নিশ্চয়ই। ওর মনে হয়, এটা কি তন্দ্রার চালাকি হতে পারে? কেন? কি লাভ ওর এসব করে? কেমন এক দ্বিধা।
হঠাৎ, দৃষ্টি চলে যায় বারান্দায় ঝুলানো সাদা টাওয়ালগুলোর দিকে। চকিতে একটা কথা মনে পড়ে যায়, একদিন এক ফুল বিক্রেতা মেয়ে ওর হাতে কিছু ফুল আর চিঠি দিয়েছিল। তখন চিঠি দেওয়া মেয়েটাকে এক ঝলক পেছন থেকে দেখেছিল তূর্য। না, সেই মেয়েটা তন্দ্রা হতে পারে না।
কি মনে হতে মোবাইলটা হাতে নেয় তূর্য।এই রহস্যটা তাকে শান্তি দিচ্ছে না চিঠি পায় না সে আজ প্রায় ছয় মাস। তবু মন অস্থির, সারাক্ষণ কিসের যেন এক অদৃশ্য অপেক্ষা…এটা কি মায়া? নাকি ভালোবাসা?
“কি ভাবছিস?”
কানের কাছে রাফির গলা চমকে দেয় ওকে।
হাত থেকে নোটবুকটা ছিটকে পড়ে যায় মেঝেতে।
মাটি থেকে সেটা তুলে, ওর দিকে বাড়িয়ে দেয় রাফি। শান্ত কণ্ঠে বলে,
“চিঠির মেয়েটা তন্দ্রা না, এটা আমি তোকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি। শুধু শুধু এসব ভাবিস কেন?”
তারপরে ওর দৃষ্টি চলে যায় অরণ্যের দিকে,
যে বিছানায় শুয়ে এক মনে মোবাইল ঘাঁটছে।
“দুই বন্ধু যেভাবে ভালোবেসে লাট্টু হয়ে গেছিস, আমি ভালো আছি।”
রাফির কথাগুলো কান দিয়ে ঢুকছে না তূর্যের,
ও শুধু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
“তুই এত শিওর কিভাবে?”
“কমনসেন্স।তন্দ্রার কি দরকার তোকে এসব পাঠানোর?তাও আবার এত হাঙ্গামা করে?
ফেক আইডি দিয়ে একটা মেসেজ দিলেই তো চলত!”
তূর্য সেটা ভেবে দেখেও মাথা নাড়ে না।
তারপর ধীরে বলে,”এটা যদি তন্দ্রা না হয়…
যদি অন্য কেউ হয়ে থাকে…তবে কি আমি ভুল করলাম না, অন্যায় করিলাম না?”
রাফি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
“অবশ্যই অন্যায় করেছিস।কিন্তু কি করবি…?”
তূর্য উত্তর দেয় না।ওর দৃষ্টি চলে যায় জানালার ফাঁক দিয়ে দূর আকাশের দিকে।কালো মেঘের পেছনে চাঁদটা যেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে…ঠিক সেই মেয়েটার মতো। কিভাবে খুঁজে পাবে তাকে?কিভাবে জানাবে—
‘আমার মন খারাপের দিনে, তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ।’
_____________
বিয়েবাড়িতে খুব হইচই।লাবণ্য জামদানি শাড়ি পরে, খোপায় কাঠগোলাপ গুঁজেছে। আয়নায় নিজেকে দেখছিল। মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। মনে হলো, পেছনে অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে।
রুমের দরজাটা বন্ধ, লক করা। দ্রুত হাতে মোবাইল তুলে ভিডিও কল করল অরণ্যকে।
কলটা ধরেই অরণ্য একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল লাবণ্যর দিকে।
“কি সুন্দর লাগছে তোমায়…” অরণ্যের গলায় একটু ব্যথা যেন, “বুকের ভেতরটা কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠছে। এত সেজেছো কেন?”
“এই যে! আবার শুরু করলে?”
খিলখিল করে হেসে ওঠে লাবণ্য। ঠোঁট গোল করে বলে, “কোথায় এত সাজলাম, বলো? শাড়ি পরলে একটু সাজতেই হয়, জনাব!”
“আমার কিছুই ভালো লাগছে না।” সত্যি সত্যি অরণ্যের মুখটা শুকিয়ে এলো, “ তুমি কিছুই বুঝ না, নির্ঘাত ভালো বিয়ের প্রস্তাব পাবে আজ!”
লাবণ্যর খুব মায়া লাগলো অরণ্যর ম্রিয়মাণ মুখের দিকে তাকিয়ে….
“এত কি চিন্তা কর, বুঝি না ছাই..আমি তোমাকে ছাড়া, কাউকে কবুল বলবো না। কবুল বলব জনাব খোকন তালুকদারকে।” বলেই বাধ ভাঙা স্রোতের মত হাসে।
সেদিকে তাকিয়ে অরণ্যর বুকে ঝড় বয়ে যায়…. “বিয়ে বাড়িতে এভাবে হেসো না… তোমার প্রথম পুরুষ মানে বাবাকে তোমার দ্বিতীয় পুরুষ বড্ড ভয় পায়!”
“ভয় নাই আমি দুই পুরুষদের দুই হাত শক্ত করে ধরব। কাউকে হারতে দিব না।” লাবণ্যর সমস্ত মুখে অসম্ভব দীপ্তি খেলা করে। মুখে হাসি।
“এই শাড়ি পরে বিয়ের আগে কখনো আর এসো না আমার সামনে… সীমানা পেরিয়ে যেতে পারি।” চোখ মটকে দিল অরণ্য।
“উফ! বাজে লোক একটা!”
লাল হয়ে যায় লাবণ্য। তখনই দরজায় টোকা।
“আচ্ছা, রাখছি…”
“উঁহু! আগে বলো…”
“কি বলব… উফ! খুলছি!”একটা হালকা চিৎকার করে লাবণ্য । তারপর থেমে বলে,
“আই লাভ ইউ।”
______________
তটিনী একটা বই পড়ছিল, হুমায়ূন আহমেদের। হুমায়ূন আহমেদের গল্প যেমন হয়, শেষ হয়েও যেন ঠিক শেষ হয় না, মিল হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তটিনীর জীবনটাও যেন সেরকমই। অথচ এবার সে আশা করেছিল, গল্পটা পূর্ণ হবে।
জানালার দিকে ঠোঁট কামড়ে তাকালো। আকাশে আজ কালো, ধূসর মেঘের খেলা। চাঁদটা লুকোচুরি খেলছে। চাঁদটাকে ওর তূর্য মনে হলো, যে মানুষটা আছে আবার নেই, সামনে থেকেও যেন অনেক দূরে।
এইবার তটিনী আশাবাদী ছিল, তূর্য বুঝবে, বুঝবে ওর ভালোবাসা। কিন্তু না। বারবার একটিই প্রশ্ন তটিনীর মনে, মনটা এত লোভী কেন? এত বেহায়া কেন?
এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে ওর চুল উড়িয়ে দিল। মনে হলো, বাতাসটাই যেন কিছু বলছে।
“আচ্ছা, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা যায়… বাতাসের কাছে কি বার্তা পাঠানো যায় না? বলা যায় না, আমার মন খারাপের দিনে তুমি আমার পাশে থেকো?”
কি মনে করে মোবাইল হাতে নিল তূর্যের প্রোফাইলে গেল। এখন আর কোনো পোস্ট করে না ছেলেটা। আগের সেই একটা পোস্ট বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, “মেয়ে, তুমি আড়ালেই থাকো।”
কিন্তু আজ…
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল তটিনী। চোখে জল চলে এলো, হৃদপিণ্ডটা পাগলের মতো রক্ত পাম্প করছে। ঝাপসা চোখে স্ট্যাটাসটা আবার পড়লো:
“যদি আজ বিকেলের ডাকে
তার কোনো চিঠি পাই?
যদি সে নিজেই এসে থাকে?
যদি তার এতকাল পরে মনে হয়
দেরি হোক, যায়নি সময়?”
— (নরেশ গুহ)
একটি ছবি পোস্টের সাথে,যেখানে একটি চিঠির খাম, পাশে লেখা “I miss you.”
তটিনী থরথর করে কাঁপতে লাগলো। ঠিক তখনই রাফি ভাইয়ের মেসেজ:
“আসসালামু আলাইকুম, স্ট্যাটাস দেখছো তূর্যের?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া, একটা কবিতা তো শুধু।” — ইচ্ছে করেই এমন মেসেজ দিল ও, দেখা যাক ভাইয়া কি উত্তর দেয়।
“আরে না! এই গত কয় মাস ধরে প্রতিদিন ও আগের চিঠিগুলো পড়েছে… বিশ্বাস কর, ও তোমার চিঠির প্রতীক্ষায় থাকে।”
“কি জানি ভাইয়া… আমার ভয় লাগে। যদি আমার আড়ালটা ভেঙে গেলে উনার আমাকে পছন্দ না হয়?”
“আরে দূর, বোকা মেয়ে। চিঠি দিও তূর্যকে, প্লিজ।”
ফোন রেখে তটিনী নিজের ড্রয়ার খুলে একটা চারকোনা বাক্স বের করল। তাতে অন্তত পনেরোটা না–দেওয়া চিঠি, যত্ন করে আগলে রেখেছে। একদিন হয়তো সব একসাথে দেবে।
—
অরণ্যদের ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, ভয়াবহ ব্যস্ততা।
লাবণ্য এখনো ফেরেনি। ফেসবুকে কিছু ভিডিও পোস্ট করেছে বিয়ের, যেগুলো অরণ্যকে খুব বিরক্ত করছে। সামনা-সামনি আসুক খবর আছে, এত বেখেয়ালি এই মেয়ে।
আর মহারানী লাবণ্য, ইদানিং কথা বলার সময়ও পায় না। যেন ম্যারাথন বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে! কাল সকালেই ফেরার কথা। আসুক একটা ফাটাফাটি নিশ্চিত।
নিঃশব্দ ঘরে শুধু পাতা উল্টাবার খসখস শব্দ আর ফ্যানের শব্দ। শীত পড়া শুরু হয়েছে তাই তাই ফ্যানের গতি একটু কম।
তূর্য পড়ার টেবিলে বসে আছে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পাশে চায়ের কাপ। চা হল ওর ঘুম তাড়াবার টনিক। সামনে খোলা নোটবুক, তাতে সুন্দর হাতের লেখা। পাশে একটা বিশাল রেফারেন্স বই। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকে, মুখে কিছু বিরবির করে, যেন মনে মনে রিভিশন দিচ্ছে।
অরণ্য সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
সে বিছানার কোণে বসে, ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ গেঁথে রেখেছে। মাঝে মাঝে কীবোর্ডে শব্দ হয়।
ঘরে কোনো কথা নেই, তবু মনে হয় একটা নীরব শব্দ খেলা করছে তা হল পড়াশোনার শব্দ।
স্নাতক শেষ বর্ষের এই সময়টা যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। সবাই খুব সিরিয়াস।
তূর্য হঠাৎ চোখ ঘষতে ঘষতে বলে,
“ভাই, আমার চোখে কী বালি ঢুকেছে নাকি? না কি পাশের বইটাকেই মনে হচ্ছে বালির বস্তা?”
অরণ্য হাই তোলে, আড়মোড়া ভেঙে,
“তোর চোখে বালি, আর আমার তো মনে হচ্ছে মাথায় ঢুকছে বালি! কী পড়ছি, কিছুই বুঝছি না।”
তূর্য গুনগুন করে গেয়ে ওঠে,
“পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না,
পড়াশোনা মনে হচ্ছে আমায় ত্যাগ করছে!”
অরণ্য ফিচেল হাসে,
“ব্রেকআপ? নাকি সোজা ডিভোর্স?”
ঠিক তখনই তূর্যের ফোন বেজে ওঠে, পাঠাও কুরিয়ার!
তূর্য লাফ দিয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। ইশ, যদি সিঁড়ি না মেনে লাফ দিয়ে নামা যেত, দিতও হয়তো!
চলবে….
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা