মনে রবে কিনা রবে আমাক পর্ব-১৩

0
20

মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা

১৩

“মেয়েটি সুন্দর করে চিঠি লিখত।
গুটি গুটি অক্ষরে চিঠি লিখত মেয়েটি।
মেয়েটি প্রতিদিন একটি করে চিঠি পোস্ট করত।
মেয়েটি জানত না, এইভাবে চিঠির সাথে নিজেকেও
সে অল্প অল্প করে পাঠিয়ে দিত খামে ভরে। হঠাত
একদিন মেয়েটি বাড়ি থেকে হারিয়ে গেল। হঠাত
একদিন মেয়েটি খামের সাথে চলে গেল কোথাও।

——দুপুর মিত্র

অল্প অল্প তোমাকে কতদিনে গুছাবো, একবারেই চলে এসো হারিয়ে যাই। আসবে?

তটিনী কিভাবে এড়াবে তূর্যর এ আহবান কে? অথবা উপেক্ষা করবে? স্ট্যাটাসটা তূর্য দিয়েছে আজ চার দিন। তটিনী কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তখনই মোবাইলে রাফির ফোন আসলো, ভাইয়া তো কখনো ফোন করে না? আজ করল যে!

“আসসালামু আলাইকুম, মন দিয়ে শোনো আগেই প্যানিক করবে না। তূর্যের গত চার দিন ধরেই অনেক জ্বর, গতকাল টেস্ট করলে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। এখন হাসপাতালে ভর্তি, প্ল্যাটিলেটের অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার আশা করছে কাল থেকে বাড়বে। ”

ডেঙ্গু! তটিনী থমকে যায়। কি হবে তাহলে? পাগল পাগল লাগে ওর, “ ভাইয়া আমাকে প্লিজ আপডেট দিবেন।” কান্নার দমকে কথা শেষ করা হয় না আর।

দুই দিন পর, তূর্য হাসপাতালের বেডে আধশোয়া। শরীর একটু ভালো,প্ল্যাটিলেট বাড়ছে। বারবার রাফি কে জিজ্ঞেস করেছে কোন চিঠি এসেছে কি? কিন্তু না! ফোস করে একটা নি:শ্বাস ফেলে।ইশ! নোটপ্যাড টা আনলে অন্তত পুরান চিঠি গুলো পড়া যেত।

তটিনী হাসপাতালে যখন আসে ভিজিটিং আওয়ার চলছে, তটিণী কেবিনে চলে এলো সরাসরি, বাইরে রাফি ভাই ছিল।

তূর্য দেয়ালের দিকে মুখ করে চোখ মুদে ছিল, শরীর দুর্বল আছে। স্যালাইন চলছে। কালকে রিলিজ দিয়ে দিবে আরেকটা ব্লাড টেস্টের পরে। কি ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল! একদিন আই সি ইউ তে ছিল।তূর্যর শুধু মনে হচ্ছিল, দেখা হবে কি অনামিকার সাথে?

আস্তে করে বেডের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পরে তটিনী ওর ভ্রম হয় ভাবে তূর্য হয়ত ঘুমিয়ে।একটা ফিসফিসে গলায় বলে,

“জানতাম না তোমাকে দেখতে এসে… এতটা কাঁপবো আমি। খামে করে সমস্ত আমাকে আমি কবেই পাঠিয়েছি তুমি বুঝতে পার নি?” নিজে নিজে তটিনী তূর্য কে তুমি বলে। কোলের উপর ব্যাগটা সবে খুলেছে…

তূর্য চমকে ফিরে তাকায়, কে এসেছে?তটিনী কে দেখে অবাক হয়! খানিক কথা হারায় এরপর মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করে-

“কেমন আছেন?” কন্ঠ কাঁপা কাঁপা।

তটিণী এতটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় যে ব্যাগটা কোল থেকে নীচে পরে যায়। অনেক গুলো চিঠির খাম,পারফিউম এর শিশি, কতগুলো স্টিকার চিরুনী আর কিছু মেয়েদের টুকটাক জিনিস মেঝেতে ছডিয়ে পরে।

ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনে যেন জমে যায়। তূর্যের দু’চোখ মেঝেতে চিঠি, স্টিকার আর সুগন্ধি বোতলে আটকে যায়, চিরচেনা ঘ্রানটা নাকে ধাক্কা দেয়।

এদিকে তটিনী পুরাই হতভম্ব আর দিশেহারা। ও আজকে ধরা দিতে এসেছিল, কিন্তু তাই বলে এভাবে? দুটো হাতে সবকিছু ব্যাগে ঢুকালো, চিঠিগুলো গুছিয়ে বড় একটা খামে করে ব্যাগে রাখতে যাবে…… তখনই তূর্য মৃদু কন্ঠে বলল,

“ এগুলো সম্ভবত আমার জন্য….দিন!” একটা হাত বাড়িয়ে দিল, এখন আধশোয়া হয়ে আছে পিঠের নীচে বালিশ। চোখে মুখে অসম্ভব একটা প্রশান্তি খেলা করছে। সাদা চাদর, পোশাক আর তূর্যের মুখের হাসি সব কিছুই যেন অপার্থিব।

তটিনী ব্যাগ চেয়ারে রেখে, কাঁপা হাতে চিঠির খামটা তূর্যের হাতে তুলে দিল। শরীররে সমস্ত রক্ত যেন ওর মুখে উঠে এসেছে। তারপর ব্যাস্ত পায়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

খাম হাতে তূর্যের মুখে হালকা হাসি। সব সূত্র মিলে যাচ্ছে এবার। তূর্য চিঠির খাম গুলো হাতে নেয়, রক্তে যেন খুশির বান ডেকেছে। মোট পনেরো টা চিঠি। সব গুলোর উপর নাম্বার দেওয়া। কি মনে করে পনেরো নাম্বার চিঠিটা খোলে।

আস সালামু আলাইকুম তূর্য সাহেব,
চিঠি লিখি নিয়মিত, কিন্তু আপনাকে দেওয়া হয় না। কারণ আপনি চান না আমি আপনাকে চিঠি দেই। যাই হোক, আপনি কি কখনো আমাকে খুঁজে পাবেন?বা খুঁজবেন? জানেন কালকে একটা স্বপ্ন দেখেছি, সমুদ্রের ঢেউ আপনার আমার পায়ে আছড়ে পড়ছে, আমি জোরে জোরে হাসছি। আপনি শক্ত করে আমার হাত ধরে আছেন। এই যে লিখছি চোখে জল চলে এসেছে, সেদিন হয়তো আমার জীবনে কখনো আসবে না। আমার আসল পরিচয় জানলে আপনি কি আমাকে কখনো মেনে নিবেন? আমি এখন ই বলবো না। তবে একটা ক্লু দেই আমার কিশোরী বয়সে আপনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। সেই থেকেই অসুস্থ আমি, আনমনা এই মন। আমার অসুখ ভালো করে দিবেন?
আমি কে! কেউ না তো!

তূর্যের চোখ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে কাগজটার উপর। মনে জীবন্ত হয় সেই দিনটি যেদিন অরণ্যর সাথে তটিনীদের বাসায় গিয়েছিলো। খুট করে ওয়াশ রুমের দরজা খোলার শব্দ হয়। দ্রুত খাম টা পাশে নামিয়ে রাখে তূর্য পাছে মেয়েটা আরও বিব্রত হয়।

তটিণী ফিরে এলে তূর্য মাথা তুলে বলে,
“আপনার হাতের লেখা খুব সুন্দর, জানেন?” দৃষ্টি একদম তটিনীর চোখের দিকে।

তটিণী আস্তে বলে, “সব পড়ে ফেললেন?” চোখ নামিয়ে নিয়েছে। কি লজ্জাই না লাগছে।

“সব তো না… এগুলো আস্তে আস্তে পড়ব। আপনি কতদিন অভিমানে বা রাগে চিঠি দেন নাই জানেন কি কষ্ট হয়েছে আমার? আমার জন্য এগুলো অক্সিজেন। আর আপনার হাতের লেখা আমার মুখস্ত।”

তটিণী কিছু বলে না, কিছুক্ষণ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর আবার দৃষ্টি দেয় তূর্যের দিকে, তটিণী কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে। তূর্যের চোখে একটা দিপ্তী, যেন অনেকদিন পর কোনো উত্তর খুঁজে পেয়েছে।

“ আপনি তো চাননি আমি চিঠি দেই, তাই লিখে লিখে জমিয়ে ছিলাম।” কিছুটা অভিমান খেলে গেল সমস্ত মুখে।

তূর্য একটু কৌতুকের ভঙ্গিতে বলে,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”

তটিণী তাকায় না, আস্তে আস্তে বলে,
“জ্বি পারেন,আজ আপনার উত্তর পাবার দিন।”

“আমি কিন্তু মাঝে মাঝে উত্তরও দিয়ে দিই।তবে আজ নিজেই একটা উত্তর পেলাম, যেটা অনেকদিন ধরেই খুঁজছিলাম। আপনি আমাকে…. সেই দিন থেকেই….মানে ঐ যে আপনাদের বাসায় গেলাম?”

তটিণী এবার একটু মুখ ঘোরায়, চোখে চোখ পড়ে যায় হঠাৎ, চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর ধীরে বলে,
“জ্বি, তখন থেকেই…তবে চিঠি লিখা শুরু করেছিলাম আপনাকে একটু সাহায্য করতে,কারণ আপনার কষ্ট আমাকেও কষ্ট দেয়। ”

তূর্য এবার সোজা তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
“আপনার চিঠিগুলো আমার খুব পছন্দ… শুধু চিঠি না চিঠি যে লিখে তাকেও। আপনার অসুখ আমি সারাতে চাই, যেমন আপনি আমার হৃদয়ের ক্ষত সারিয়েছেন। আমি আপনাকে….” ইতস্তত করে কথাটা শেষ করতে পারে না।

তটিণী ব্যাগটা কাঁধে তোলে, মুখে একটা অন্য রকম দীপ্তি লাল আভা, “আমার যাওয়া দরকার এখন, ভালো থাকবেন দরজার দিকে এগোয়।”

তূর্য মৃদু ডাক দেয়, “অনামিকা? হাতটা একটু ধরবে?”

তটিনী ফিরে তাকায়…দুইজনের মুখেই হাসি…তটিনী এক প্রকার দৌড়ে বের হয়ে যায়।

_____________________

একটা ক্লান্ত বিকেল। লাবণ্য কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অরণ্যের সাথে আলোচনা করা যাবে না কিছুতেই। ভুল বুঝবে, কথা বাড়াবে, ওকেই দোষ দিবে। লাবণ্যকে নিয়ে অতিরিক্ত পজেসিভ এই ছেলে। পাত্রপক্ষ এই সপ্তাহে আসতে চেয়েছিল, সেটা পরীক্ষার দোহাই দিয়ে পিছিয়েছে। কিন্তু এরপর কি? ভাবনায় ছেদ পড়ল অরণ্যের ফোনে।

“আসসালামু আলাইকুম, আজ বিকেল দেখ কি সুন্দর, দেখা করবে?”

“না, আজ না…” এড়িয়ে যায় লাবণ্য।

“কোন সমস্যা হয়েছে? বেশ কদিন ধরেই আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ! আচ্ছা শুন, মজার কথা, আমাদের তটিনী যে তূর্যকে পছন্দ করে আমি মাত্র কাল জানলাম। তুমি জানতে?!”

“হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে বলা নিষেধ ছিল।”

“যাক! ভালো ছেলে পছন্দ করেছে, আমার খালা আর খালু খুব ভাল মানুষ। বিয়ে দিয়ে দিবে বিনা আপত্তিতে।” অরণ্যের কণ্ঠ খুশি খুশি।

“বাহ!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, সবার ভাগ্য এত ভালো হয় না। একটা কান্না হৃদয় নিংড়ে যেন বের হয়ে আসবে… “মা ডাকে, রাখি তবে।” দ্রুত ফোন রেখে দেয়। দমবন্ধ লাগছে। রিয়ার বাসায় যাবে।

অরণ্য আজ ধানমন্ডি বিশেষ কাজে এসেছিল। এত সুন্দর লাগছিল বিকেলটা, তাই লাবণ্যকে ফোন করেছিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রিয়াকে দেখলো। এখন অরণ্য রিয়ার বাসার ঠিক নিচেই।

অরণ্যকে দেখে রিয়া ভ্রু কুঁচকে নিল। এদিকে চিন্তায় ওর বান্ধবী লাবণ্য পাগলপারা, এই লোক সুন্দর গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উনারও জানা উচিত। লাবণ্য নিজে না বললে রিয়া বলবে।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন? লাবণ্য কিন্তু আমার বাসায়। মন খারাপ বেচারার।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেন? পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?”

“আরে নাহ। আপনাকে কেন বলে না, আমি বুঝি না। কিন্তু একাই কষ্ট পাচ্ছে, চিন্তা করছে। ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। পাত্র বিসিএস ক্যাডার।”

অরণ্যের সমস্ত দুনিয়া যেন দুলে উঠলো। বিয়ে বাড়ির সেই লোক! মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। এত বড় কথাটা লাবণ্য লুকিয়ে গেল! কেন? এইজন্য ওকে এড়াচ্ছে…! মুহূর্তে মাথায় রক্ত উঠে যায়, হাত মুঠো হয়ে আসে। বাবার কথা মেনে নিবে?

“ভাইয়া, ও ছাদেই আছে। আপনি যান, আমি হালকা শপিং করে আসছি।” আস্তে করে বলল রিয়া, “দুইজন মিলে একটা বুদ্ধি করেন। সম্পর্ক দুইজনের, একা লাবণ্য কেন কষ্ট পাবে?”

রিয়াদের ছাদে প্রচুর গাছ, তাই বাতাসে যেন আর্দ্রতা, কিন্তু অরণ্যর শরীরের তাপ যেন আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। আধার নেমেছে, ছাদ ছয় তলার উপরে, তাই আলোর আনাগোনা কম। এদিকটায় গাছে ভরপুর। বেশ অন্ধকার জায়গাটা।

লাবণ্য তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, আজ সম্ভবত অমাবস্যা। লাবণ্যর মনের মত আকাশেও আধার যেন। মনে মনে কথা বলছে, তাই অরণ্যের উপস্থিতি টের পায়নি। গালে কান্নার দাগ স্পষ্ট।

অরণ্য আস্তে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, কোনো ভূমিকা না করেই যেন গর্জে ওঠে,
“তোমার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে, তাই না? আমাকে এতদিন বলনি কেন? রিয়ার মুখে শুনলাম!
বিসিএস ক্যাডার, সেই পাত্র তাই না? খুব মানাবে তোমার সঙ্গে… ভালোই তো! মাঝখানে আমি কি? কোনো পাপেট?”

লাবণ্য চমকে ফিরে তাকায়, সত্যি অরণ্য এখানে। ঠোঁট দুইটা তিরতির করে কাঁপতে থাকে… কিছু বলার আগেই অরণ্য এগিয়ে আসে দু’পা।
“বলো না? বাড়ির লোকের স্বপ্ন পূরণ করবে, তাই না? সুখী সংসার হবে তোমার? আমি কোথায় আছি এর মধ্যে? আমাকে তো বলারও প্রয়োজন বোধ করলে না।” হিংস্র দেখাচ্ছে কেমন অরণ্যকে। “এ জন্যই কিছুদিন ধরে এড়িয়ে যাচ্ছ বুঝি?”

লাবণ্য ঠোঁট শক্ত করে, কান্না আটকে নেয় ভেতরে। বুকটা কাঁপছে অসম্ভব জোরে, এই পাগলটাকে কিভাবে সামলাবে এখন?

“আমার ইচ্ছেতে কিছু হয়নি। কিন্তু তুমি এভাবে রিঅ্যাক্ট করবে বলেই তোমাকে বলিনি। বিশ্বাস করো, অন্য কিছু না… ভরসা রাখ, আমি একটা কিছু করব… প্লিজ আমাকে কথার আঘাত দিও না। আমি এমনিতেই ক্ষত-বিক্ষত।”
লাবণ্য অঝোরে কান্না করে দেয়।

অরণ্য এক ধাক্কায় লাবণ্যর একদম সামনে এসে দাঁড়ায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“তুমি কি করতে পারবে? ওরা তোমার কথা শুনবে? পালিয়ে যাবে আমার সাথে?”

লাবণ্য কাঁপে, কিছু বলতে পারে না।
লাবণ্যর নিরবতা অরণ্যের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পারে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে লাবণ্যকে ওর পরিবার। মাথায় কিছু জ্বলে উঠে,
“তুমি আমার লাবণ্য।” হঠাৎই হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধে চেপে ধরে, চোখে আগুন। “তুমিও কি তন্দ্রার মত আমাকে ছেড়ে দেবে? আমি কিছু বলব না ভেবেছো? আমি এ বিয়ে ভেঙে দিব। তোমার নামে বদনাম দেব, লোকে যা ইচ্ছে ভাবুক তোমাকে। আমি জানি তুমি কি। আমি বলব তুমি আর আমি বিয়ের আগেই…”

লাবণ্য হতবাক হয়ে তাকায়… রাগে-ভয়ে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিল, অরণ্য ওর মুখ চেপে ধরে, ওর অধরে নিজের আধিপত্যের জানান দেয় অকস্মাৎ ভাবেই। সমস্ত রাগ যেন উগরে দিচ্ছে… যেন লাবণ্য ওর মালিকানা শুধু।

লাবণ্য হাত দিয়ে ঠেকাতে চায়… লাবণ্য হাত দিয়ে ঠেলে দিতে চায়, অরণ্য ওকে আরো কাছে টেনে নেয়, শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়।
লাবণ্য না চাইতেও নিজেও আঁকড়ে ধরে অরণ্যকে… শরীর জুড়ে যেন দাবানল ছড়িয়ে পড়ে।

অবশেষে অরণ্য এই তাণ্ডব থামায়, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“তুমি আমার। মনে রেখো, তোমার মনে আমার দখলদারিত্ব ছিল। আজ এই শরীরে, এই মনে আমি নিজের নাম লিখে দিলাম।”

লাবণ্য কিছু বলে না, শুধু শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ওর। বুকের ভেতরে জোয়ার-ভাটা চলছে, মাথায় যন্ত্রণা। মুহূর্ত খানেক, শুধু নিঃশ্বাসের আওয়াজ। এখনো ও অরণ্যের বুকে আছে, পার্থক্য কেউ কাউকে জড়িয়ে নেই।
আচমকা অরণ্যকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয় লাবণ্য,
“তুমি কি ভাবছো আমি তোমার সম্পত্তি? অথচ আমি ভাবতাম আমি তোমার সম্পদ! মালিকানা, দখলদারিত্ব কেন? আমাকে অধিকার করে নাও! আমি মানুষ অরণ্য, কোনো বস্তু নই।”
চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে অবিরাম।

অরণ্য থমকে যায় হঠাৎ। লাবণ্যর ঠোঁটটা কাঁপছে, কান্নাগুলো গালে ছড়িয়ে পড়ছে। খুব মায়া লাগছিল অরণ্যের।

“তুমি আমার সাথে… কি করলে এটা অরণ্য? আমাদের প্রথম… তাও এত নিষ্ঠুর ভাবে, জোর করে?”

অরণ্য কাঁপা গলায় বলে,
“সরি… আমার ভুল হয়ে গেছে… আমি তোমায় হারাতে চাই না, লাবণ্য… আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি মনে হয়।”

“তাই বলে তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করবে? এটা তোমার ভালোবাসা? আমি গত কিছুদিন ধরে একা একা এ যুদ্ধ করে ক্লান্ত। আর তুমি আমাকে তন্দ্রার সাথে তুলনা দাও।” জ্বলে উঠে লাবণ্য, অরণ্যের কাছাকাছি দাঁড়ালো, ওর চোখে চোখ রাখলো,
“দেখ তো, আমার চোখে কি কোনো লোভ দেখ? নাকি আমার চোখে শুধুই তুমি? কত সহজ অপবাদ দেওয়া!”

অরণ্য চোখ নামিয়ে ফেলে। কি বলবে? ছি: কি কাণ্ড করে ফেললো রাগে আর জেদে!
সেই ভদ্রলোককে কবে থেকেই ওর অসহ্য। সে আবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে শুনে মাথায় কি যে হয়ে গেল!

লাবণ্য একটু থামে,
“হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি তোমাকে, আমার বাবাকেও। তোমাদের দুইজনের যত দাবি আমার উপর তো। দুইজনেই আমাকে ভালোবাসো, কিন্তু বুঝ না।
বেশ, আমি দুইজনকেই খুশি করব। আমিই থাকবো না। অপয়া মেয়ে আমি…!”
একবারও ফিরে না তাকিয়ে ছাদ ছেড়ে নেমে যায় লাবণ্য।

অরণ্য একা দাঁড়িয়ে থাকে।
হাত দুটো মুঠো হয়ে আছে, কিন্তু এবার আর রাগে নয়, লজ্জায় আর অনুতাপে। নিজের ঠোঁটে হাত স্পর্শ করলো, যেখানে জোর করে ছুঁয়ে নিয়েছিল লাবণ্যকে।
অরণ্য ফিসফিস করে, যেন নিজেকেই শোনায়,
“আমি ভুল করেছি… লাবণ্যকে কষ্ট দিয়েছি… এমনভাবে অপমান করলাম ওকে? ছি:”
অরণ্য মাথা নিচু করে বসে থাকে। “আমি তো ভালোবাসি ওকে… তাহলে ওকে এতটা আঘাত দিলাম কীভাবে? আর লাবণ্য এগুলো কি বললো শেষে!”
উপলব্ধি করেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে সে ছাদ থেকে নিচে নেমে যায়।
কিছুক্ষণ আগেও ওর বুকে ছিল আগুন, এখনো আছে… তবে সেটা ওকেই পোড়াচ্ছে…
রাস্তায় নেমে খুঁজতে লাগলো লাবণ্যকে… মেয়েটাও অসম্ভব রাগী, আল্লাহ কিছু করে ফেললে?

#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা