মনে রবে কিনা রবে আমাক পর্ব-১৫

0
17

মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
১৫

তূর্য তটিনীদের বাসার বসার ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশেই অরণ্য।
স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ, কিছু মাসের মধ্যেই রেজাল্ট বেরোবে। স্নাতক পাশ করার পরেই তূর্য আর অরণ্য বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য আবেদন করেছে।দুই বন্ধু ভাড়া বাসায় উঠে গেছে, মোট ছয়জন ব্যাচেলর মিলে থাকে।

তটিনীর বাবা অনেক দিন ধরেই দেখা করতে চাইছিলেন। তূর্য বেকার বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গত পরশু এমন এক কাণ্ড ঘটল, যে আজ আর ফাঁকি দেওয়ার উপায় ছিল না। আল্লাহ জানেন, আজ তটিনীর বাবা কী বলবেন।

সেদিন তূর্য আর তটিনী গিয়েছিল লালবাগ কেল্লায়।তূর্যের মনে হচ্ছিল, মানুষ সেখানে শুধু প্রেম করতেই আসে। যদিও কিছু সত্যিকারের দর্শনার্থীও আছে। ছুটির দিন না হওয়ায় ভিড় কম ছিল।

লালবাগ কেল্লার পুরনো লাল ইটের দেয়ালের সৌন্দর্যই আলাদা। দুপুরের সোনালি রোদ মিনারের কিনারা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ভিতরটা একেবারে নীরব, যেন ইতিহাস নিজেই নীরব হয়ে গেছে বর্তমান অবলোকন করে।

তটিনী একটা মোটা গাছে হেলান দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টে। এরপর দুজনে ঝর্ণা, হাম্মামখানা সব দেখে একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসে। আশপাশে দু-একজন পর্যটক ঘুরছে, কিন্তু সবাই যেন নিজের জগতে গুটিয়ে আছে। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না।

তূর্য পাশের বসা তটিনীর দিকে একটু ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“দেয়া যাবে? হাতটা?”

তটিনী চমকে যায়। মুখ নিচু করে ফিসফিসিয়ে বলে,“এত তাড়াতাড়ি?” তবুও হাতে একটা শিহরণ খেলে যায়।

তূর্য হালকা হেসে বলে, “তাড়াতাড়ি কই!”
তবে মুখে একটা অস্বস্তি নিয়ে হাতটা গুটিয়ে নেয়।

হাওয়াটা হালকা বইছে, তটিনীর কপালে কিছু চুল এসে পড়েছে। মাথা নিচু করে সে হেসে ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে, একটু ইতস্তত করে, তূর্যের গুটিয়ে নেওয়া হাতের দিকে নিজের হাতটা বাড়ায়।

তূর্য শক্ত করে ধরে না, শুধু হালকা করে আঙুল ছুঁয়ে রাখে। যেন ভয় পায়, স্পর্শের অনুভূতিটা ভেঙে যাবে, অনুভূতিটা হারিয়ে যাবে।
এখন এই মুহূর্তে তটিনীর খুব ভালো লাগে। শুধুই একটা স্পর্শ এত অন্যরকম হতে পারে, আজ তা প্রথমবার উপলব্ধি করল।

চারপাশে পুরনো ইতিহাসের চিহ্ন, আর এদিকে দুজন মানুষ ব্যস্ত, পৃথিবীর প্রাচীন অনুভূতিকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে। সময় যেন থেমে গেছে।

তটিনী ফিসফিস করে বলে,
“এত পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ আপনার হাত ধরলাম… অদ্ভুত না?”

তূর্য কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু ওর হাতটা একটু নিজের দিকে টেনে নেয়।

সেই দিনটা ছিল অসাধারণ,সব ঠিকঠাক চলছিল। একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। তটিনীর বাবার কাছে ধরা পড়ে যায় ওরা। তারপর আর কী?জরুরি ভিত্তিতে দেখা করার তাড়া আসে, অরণ্যের মারফত।

খানিক পরেই তটিনীর বাবা এসে বসেন সোফায়, পরনে গেঞ্জি আর সাদা লুঙ্গি।

তূর্য অবাক হয়। তটিনীর মা খুব গুছিয়ে থাকা ভদ্রমহিলা।এই অবস্থায় ওর বাবা ওদের সামনে লুঙ্গি পরে! নিশ্চয়ই অবস্থা ভালো না। বুকের মধ্যে ফট করে কিছু একটা ঢুকে যায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে তূর্য সালাম দেয়।

তটিনীর বাবা ভ্রু কুঁচকে তাকান। সালামের জবাব দেন ঠিকই, কিন্তু কণ্ঠে উষ্ণতা নেই।
একটু নড়ে বসে ঠান্ডা গলায় বলেন,

“আমার মেয়ারে বিয়া করবার ইচ্ছা, না কি শুধু ঘুরাফিরার শখ?” তটিনীর বাবা ঢাকার স্থানীয় মানুষ, কথাবার্তাতে এখনো বুঝা যায়। তবে উনি চেষ্টা করেন শুদ্ধ করেই বলতে।

তূর্য একটা শুকনো ঢোক গিলে, মাথা নিচু করেই উত্তর দেয়,

“বিয়ে করতে চাই।”

তটিনীর বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন,
“তাইলে এতদিনেও বিয়ের প্রস্তাব লইয়া আস নাই কেন?”

তূর্য গলা পরিষ্কার করে ধীরে বলে,

“এই মুহূর্তে আয় নেই। তবে কয়েকটা জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, একটার রেজাল্ট ভালো হয়েছে, ইন্টারভিউ কল এসেছে। বেকার অবস্থায় আসাটা লজ্জার মনে হয়েছে।”

তটিনীর বাবা ঠাণ্ডা গলায় আবার প্রশ্ন করেন,
“ভালোবাসো আমার মেয়াকে?”

তূর্য এবার মুখ তুলে চোখে চোখ রেখে উত্তর দেয়,

“আমি তটিনীকে সম্মান করি, ভালোবাসি, দায়িত্ব নিতেও প্রস্তুত। যদি একটুখানি সময় আর ভরসা দেন, বিশ্বাস ভাঙবো না।”

তটিনীর বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ একটু মাথা নাড়িয়ে বলেন,
“যদি তোমারে সময় না দেই?বলি এ সপ্তাহে বিয়া করতে হবে?”

তূর্য চমকে যায়, “আমি তাতেও রাজি।”

“তুমি কিন্তু বেকার।”

“দায়িত্ব নিলে ইন শা আল্লাহ পালনের রাস্তাও পাব। পুরুষ মানুষ, পেটে বিদ্যা আছে কিছু একটা করে….!

এবার তটিনীর বাবার গাম্ভীর্যের মুখোশ খুলে যায় হঠাৎ যেন, ঠোঁটের কোণায় একটা লুকোনো হাসি। হেসে নিজের উরুতে চাপড় দিয়ে বললেন,

“বাঘের বাচ্চা! এইটাই চাইছিলাম শোনতে। সাহস থাকতে হয়, ভালোবাসলে কলিজা বড় থাকতে হয়। যেটা তোমার আছে। আর চাকরির কি?রিজিকে যা আছে পাইবাই। তোমার বিষয়ে আমার খোঁজ নেওয়া শেষ। তোমারে আমার পছন্দ হইছে।”

তূর্য কিছুটা অবাক, কিছুটা লজ্জিত। নিচু গলায় বলে,
“আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি বুঝেছেন আমার অবস্থাটা…”

তটিনীর বাবা এবার হেসে ওঠেন খোলামনে,
“বুঝব না কেন? এরকম ইন্টারভিউ আমিও দিছিলাম।” ঘর ফাটিয়ে হাসে, “ তটিনীর নানাকে। ফেল করছিলাম প্রত্থম বার। তাই তোমারে জিতায় দিলাম।”
তূর্য হেসে ফেলে। অরণ্য পাশ থেকে ফিসফিস করে বলে,
“বলেছিলাম না! খালু অন্য রকম একদম।”

তটিনীর বাবা আবার গম্ভীর মুখ করে বলেন,
“এখন এক কাজ কর, তোমার পরিবারের সম্মতি নাও,নিয়ে আমারে জানাও। আমি তটিনীর মাকে বলে দিচ্ছি, বিয়ের কেনাকাটার লিস্ট বানাক।
এই সপ্তাহেই বিয়ে, ইন শা আল্লাহ। ”

তূর্য উঠে দাঁড়িয়ে যায় মুহাসাফা করে
“আলহামদুলিল্লাহ… আপনি এতটা বুঝবেন ভাবিনি ।কিন্তু আমি বিয়েতে খরচ করতে….”

“কিচ্ছু না বাবা…শুধু কাবিন করায় দিব। দেনমোহর লাগে ধার নিবা। আমার বিয়ে ছাড়া ঘুরাঘুরি পছন্দ না।” বলে উনি হাঁক দেন, “পাত্রকে নাস্তা দাও কই গেলা সব মান ইজ্জত আর থাকলো না।”

তূর্য সোফার হাতলে হালকা ঠেস দিয়ে বসে থাকে। বুকের ধুকপুকানি একটু একটু করে থেমে আসছে। তারপর দুই বন্ধু একসাথে হালকা হাসে।

“মাশাল্লাহ একদম বিয়ে করে ফেলছিস রে দোস্ত।” অরণ্য পিঠ চাপড়ে দেয়, “রাফিকে ফোন দেই দাড়া।”

তূর্য ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
“বেচারা হবু শশুর কে দেখে মায়া লাগলো, বেচারা কন্যাদায় গ্রস্থ পিতা।

হঠাৎই সামনে কাশির শব্দ,তটিনী, খুব নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে, হাতে চা আর নাস্তার ট্রে। একটা লাল সালোয়ার পরা মাথায় ওড়না দেওয়া।

চোখাচোখি হতেই তূর্যের বুকের মাঝে যেন কিছুটা ঠাণ্ডা বাতাস বইল।মনে মনে বললো খুব জলদী বিবি হচ্ছ আমার।

অরণ্য খেয়াল করে ওদের দিকে তাকায়, তারপর বলল, “আচ্ছা লাবণ্য কই?”

তটিনী হাসে, “ আমার ঘরের বারান্দায়।”

অরণ্য বেরিয়ে যায় ওদের একটু একা থাকার সুযোগ দিতে। তটিনীর মা’ও রান্নাঘরেই ব্যাস্ত।

তটিনী আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। তারপর একটু নিচু গলায় বলে, “আমার বাবা কন্যাদায়গ্রস্ত?”

তূর্য হেসে ফেলে, “শুনে ফেলেছো। আরেহ নাহ! আমি বিবি পাবার আসায় রোগাক্রান্ত!”

তটিনী মুখ নামিয়ে হেসে ফেলে,
“ধুর!” মুখ লাল হয়ে যায়।

সেদিন তাকিয়ে তূর্য কি একটা কবিতা কিছুতেই মনে করতে পারে না।

________________

লাবণ্য তটিনীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর ফুল গাছ গুলো দেখছিলো আর গুন গুন করছিলো কিছু একটা। অরণ্য এক ফু দিল ওর কানের পিঠে। চমকে ফিরে তাকিয়েই, বুকে থু: দিল লাবণ্য।

“ফাজিল একটা, নিজের খালার বাড়ি তাই এরকম করছে।”

“আমার খালু তো দুই পায়েই খাড়া, আগামী সপ্তাহেই বিয়ে।” বলে খুব আলতো করে লাবণ্যর হাত ধরে, “ ইশ! জানো আমার কি বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।”

“কর না করল কে?” মুখ ভেঙায় লাবণ্য।

রেলিঙে ঠেস দেয় অরণ্য, একটা আঙুল দিয়ে লাবণ্যর গাল স্পর্শ করে, “ তোমার হিটলার বাবা। তারজন্যই তো চাকরি পেয়ে তারপর সম্বন্ধ পাঠাতে হবে।এমনভাবে যেন সে মনে করে তটিনী সম্বন্ধ নিয়ে গেছে তার খালাতো ভাইয়ের বাহ। কি স্ক্রিপ্ট।”

বাবাকে এভাবে বলা লাবণ্যর সহ্য হয় না, আঙুল উঁচু করে, “ দেখ আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ, আমার বাবাকে নিয়ে একটা কথাও বলবে না। আমি তাকে সবচেয়ে ভালোবাসি।”

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে অরণ্য, “দেখো কান্ড, আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা বলছ, আর আমি সহ্য করছি।”

“আরেকজন পুরুষকে ভালোবাসার কথাও বলব আমি, সেটাও সহ্য করবে।”

অরণ্য সোজা হয়ে দাঁড়ায়, “ সেটা আবার কোন গোলামের পুত?”

লাবণ্য খিলখিল করে হাসে, “ সেই গোলাম তো তুমি।”

অরণ্যের বুঝতে সময় লাগে, এরপর চোখ সরু করে হাসে, “ বিয়ে করার আগেই বাচ্চা নিয়ে ভাবছো, আর সারাক্ষণ আমাকে অসভ্য বল?”

লাবণ্য উত্তর দিল না। দ্রুত বের হয়ে গেল।

_______________

তূর্যের বিয়ে দিনটি শুক্রবার। তূর্যের পরিবারের কেউ এ বিয়েতে খুশিও না আবার অখুশিও না।, তূর্য বাড়ি গিয়ে কথা বলে এসেছে।বেকার ছেলের বিয়ে সবাই একটু আশাহত স্বাভাবিক। কিন্তু মা বাবা না থাকায় কেউ তত উচ্যবাচ্য করল না তেমন। বড় দুই ভাই গার্জিয়ান হিসেবে এসেছে শুধু। বোনেরা কেউ আসতে পারেনি।

তূর্য আজ খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেল। তূর্য আর অরণ্য এখন একটা ফ্ল্যাট বাসায় থাকে, এক রুমে দুইজন। এরকম তিনটা রুম আছে। দুই ভাইকে একটা রুম অন্য ছেড়ে দিয়ে আজ এক রুমে চারজন ঘুমিয়েছে। সবাই স্টুডেন্ট তূর্য আর অরণ্য শুধু এখন আর স্টুডেন্ট না। ওর চোখে এখনো খানিক ঘুম লেগে আছে কিন্তু বুকজুড়ে টানটান উত্তেজনা। আজ তটিনী ধর্মীয় আর সামাজিকভাবে ওর হবে।

সাদা পাঞ্জাবি পরে নিল, অনেক পেটানো কাজ। মসজিদে বিয়ে তবে তটিনীর বাবা হুলস্থুল করে ফেলেছেন। মেহেদী অনুষ্ঠান, হলুদ কিছু বাকি রাখেন নাই। আজ সেন্টারে ও হাজারের উপর মানুষ দাওয়াত দিয়েছেন। তূর্যদের পরিবারের সবার জন্য জামা-কাপড়।

তূর্যের লজ্জা লাগছিল, উনি মুখে বলছেন এটা কাবিন তুমি চাকরি পেয়ে সংসার গুছিয়ে আমার মেয়ে নিয়ে যেও। আয়নায় তাকিয়ে হাসলো আরও বলেছে, “ফ্ল্যাট কিন্তু আমি সাজাই দিব বাবা।” মনে মনে তূর্য বলল, তা কখনো হবে না ইন শা আল্লাহ।

সাদামাটা বিয়ে অন্তত তূর্যের কোন চাপ নেই তবুও খরচ হচ্ছে, কিছু জমানো টাকা ছিল কিছু ধার। কিন্তু এসব ভাবতে মন চায় না আজ।

মায়ের কথা মনে হচ্ছিলো খুব। মা ওর জন্য তার হাতের দুইটা বালা রেখে গিয়েছিলেন। বড় আপার প্রতি কৃতজ্ঞ তূর্য, বেচারি শত ঝড় ঝাপটাতেও সে দুটো আমানত আগলে রেখেছিলো।

আপা বলেছিল, “এটাই তোকে দিতে পারলাম রে। দেনমোহরের হিসেব হিসেব এটাই দিস বউ কে। সাথে মায়ের দোয়া জড়িয়ে থাকুক। মা তোর জন্য রেখেছিলেন।”

তটিনীর বাবার আয়োজন একদম নিখুঁত।
মসজিদের উপরের তলায় মেয়েদের নামাজের স্থানে মেয়েদের জন্য ব্যবস্থা।আর নিচ তলায় ছেলেদের বসার ব্যাবস্থা। ফুল দিয়ে সাজানো তোশকের আসন। ভেতরে সুন্দর খুতবার আয়োজন। খেজুর ছেলেপক্ষের আনার নিয়ম। অরণ্য আর রাফি সবচেয়ে ভালো খেজুর এনেছে। অরণ্য পাত্রপক্ষ হয়েই এসেছে। গতকাল হলুদে লাবণ্যকে মুখে হলুদ মাখিয়ে নাস্তানাবুদ করেছে, তা মনে করেই হেসে ফেললো।

খতিব সাহেব বিয়ের খুতবা শুরু করলেন,
আয়াত পড়লেন সূরা রূম (২১) আয়াত,

“অতঃপর হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: এবং তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম যে, তিনি তোমাদের থেকেই তোমাদের সঙ্গী-সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন পারস্পরিক ভালোবাসা ও দোয়া। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।”

তিনবার প্রশ্ন, তিনবার জবাব,
“কবুল করি।” বলেই তূর্যের কি এক অনুভূতি হল।অন্য রকম পাবার অনুভূতি।

ওদিকে কবুল বলতে গিয়ে তটিনীর গাল বেয়ে অল্প কান্না গড়িয়ে পড়ে, লাবণ্য পাশ থেকে ফিসফিস করে বলে, “আজ তোর কান্নার দিন শেষ তূর্য ভাইয়ের শুরু!”
তটিনী হেসে ফেলে। প্রত্যেকটা মেয়েই খিমার পরে এসেছে। চারপাশে হাসি আনন্দ খুরমা আর খেজুরের ছড়াছড়ি।


বিয়ের সেন্টারে লাবণ্য দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, হাতের মেহেদি দেখছে। অরণ্য হাতে জোর করে নিজের নামের আদ্যাক্ষর লিখে দিয়েছে মেহেদি দিয়ে। আর কাল তো ওর হাতে মুখে হলুদ দিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল- বউ বউ লাগছে তোমাকে।

“অসভ্য একটা,” বলে আনমনে হাতের তালুতে কাঁচা হাতের মেহেদিতে লেখা ‘এ’ লেখাটায় ঠোঁট স্পর্শ করে দিল।

“অধম এই দিকে, ম্যাডাম।” একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অরণ্য।

লাবণ্য চমকে যায়। ভাগ্যিস বাবা-মা আগেই চলে গেছে।

“কি চাই? পিছু পিছু ঘুরছ কেন?” আড়চোখে তাকায়, হাতে চুমু খেতে দেখে ফেলেছে, ইশ!

“তোমার হিটলার বাপ চলে যেতেই না, এলাম মাত্র।” লাবণ্যকে দেখছে, নেভি কাতান পড়েছে, চুলে খোঁপা, তাতে বেলি ফুল, হাতে চুড়ি।
“আমার হার্টবিট বন্ধ করার সমস্ত আয়োজন করেই এসেছ আজ, পাজি মেয়ে।”

লাবণ্য অবাক, “আমি কি করলাম আবার? আর সর তো, তটিনীর বাসায় যেতে হবে, ওদের বিয়ের খাট সাজাতে হবে।”

“আমার কপাল, বউ হয়ে নিজে খাটে বসে থাকার বদলে তুমি যাচ্ছ অন্যের খাট সাজাতে। আমার এত বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে, জানো!”

“কর! মানা করল কে?”

“তোমার খারুস বাপ রাজি হইলেই তো পারে।”

লাবণ্য আঙুল উঁচু করে, “আমার বাবা খারুস না। এখন আমি যাই।”

অরণ্য হাতটা টেনে নেয় হঠাৎ। খুব আস্তে বলল, “চলো বিয়ে করে ফেলি। তোমাকে জড়িয়ে ধরার মুহুর্ত গুলো খুব জ্বালায় ইদানিং তার উপর তুমি এমন শাড়ি পরে উস্কানী দাও।”

লাবণ্য এদিক সেদিক তাকায় বারান্দাটা পেছনের দিকে মানুষের আনাগোনা নেই, সবাই খেতে ব্যাস্ত। এক পা এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“একটা চাকরি জুটিয়ে চলে এসো না জনাব। আমারও তো বউ সাজতে ইচ্ছে করে।” বলে মুখ নামিয়ে ফেলে, রোদ গুলো ওর চুলে কপালে খেলা করে আপন মনে।

“ইন শা আল্লাহ অতি শীঘ্রই আমি তোমাকে আমার করব।সেদিন থেকেই তোমার শাস্তি শুরু।”

লাবণ্যের ঠোঁটের কোণে এক ফোঁটা হাসি ফুটে উঠে, তটিনীর বিয়ে যেন ওকেও অস্থির করছে অল্প।
________

তটিনীর ঘরটা আজ ফুলে ফুলে ভরা। সাদা, লাল গোলাপ শুধু। চারিদিকে ব্যাটারি চালিত ছোট ছোট প্রদীপের মত বাতি যা সমস্ত ঘরে ছড়াচ্ছে এক অপার্থিব আবহ। তটিনী আজ মেরুন শাড়িতেই।একটা কাতান যেটা তূর্য দিয়েছে, হাতে শাশুড়ীর দেওয়া পুরাতন ডিজাইনের দুইটা বালা। যেটা ওর দেনমোহর ও বটে।আরও গহনা সব বাবার দেওয়া।

ধীরে তূর্য যখন ঘরে প্রবেশ করে তখন তটিনীর বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড জমে বরফ সেই কিশোরী বেলার মত।
তূর্য অপ্রস্তুত খানিক, ঘোমটা টানা বউ এর পাশে বসে, আস্তে সালাম দেয়।তারপর তটিনীর ঘোমটা না তুলেই হাত চেপে ধরে, তটিনী হালকা কেঁপে উঠে অথচ এই স্পর্শ ওর চেনা। তূর্য গলা খাকাড়ি দেয় একটা কবিতা আবৃত্তি করে, কবি শামসুর রাহমানের “উত্তর” কবিতাটি-

“তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার
দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর
দেবেনা।

সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে
বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের
সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।

জ্যোত্স্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ
জ্যোত্স্না আমার’
কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।

মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’,
কী করে থাকবো নির্বাক ?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো,
‘আমি তোমার, তুমি আমার’।”

তূর্য এই কবিতাটা আবৃত্তি শেষ করে, ঘোমটা খুলে ধীরে। তটিনীর নত মুখ আঙুলের ডগায় উঁচু করে ধরে তারপর নিজের মাথা নামিয়ে নেয় তটিনীর কপালে। চোখ রাখে তটিনীর চোখে।

তটিনী গভীর আবেগে বলে, “এই কবিতার মত আমি এখন শুধুই আপনার একান্ত আপনার।”

তূর্য হাসে , “হ্যাঁ তুমি এখন তূর্যের বউ। আরে বউ আমার চিঠি কই? আর তুমি চেঞ্জ করে এসো।”

রাতটা নিঃশব্দ যেন আকাশের লুকোচুরি মেঘেদের সাথে, আর তূর্যের মনে দারুন ঝড়। অনুভব করছে শব্দের বাইরে কিছু গভীর ব্যাখ্যাহীন ভালোবাসা।বিয়ে করে মনে হচ্ছে আরও যেন ভয় লাগছে। নিজে বেকার, তটিনী বড় ঘরের মেয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ইন শা আল্লাহ ওরা পারবে। হাতে চিঠি, যেটা তটিনী ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।

প্রিয় জামাই,
ভালোবাসা কি সংজ্ঞায় ধরা যায়? আপনি প্রশ্ন করেছিলেন।
আমি উত্তর খুঁজেছি আপনার প্রতিটা স্পর্শে, দৃষ্টিতে, নিঃশ্বাসে। আমি যখন চুপ করে বসে থাকি, তখন ও আপনি পাশে থাকেন শব্দহীন, আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি—এই মানুষটাই আমার ঘর, দুনিয়ার বুকে আমার এক টুকরো শান্তির নীড়।

আমি যখন রান্নাঘরে ব্যাস্ত থাকব, আর আপনি ঘোলা চশমা হাতে এদিক সেদিক হাঁটবেন।আর এসে শুধু আমার আঁচলের খোঁজ করবেন, আমি বুঝে নিব এই মানুষটাই আমার সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যা। আর আমার গোছানো চুল ইচ্ছে করেই এলোমেলো করব আপনার যত্ন পাবার আশায়।আপনি যখন চুল গুছিয়ে দিয়ে তাতে আপনার ঠোঁট ছোয়াবেন আমি বুঝে নিব, এই মানুষটাই আমার রাত।

আমি কোন গল্পের নায়িকা হব না৷ হব আপনার তটিনী৷ যাকে আপনি বলবেন দিনশেষে “তুমিই আমার চূড়ান্ত সত্য।” তখন আমিও বলব
“আপনিও আমার সমস্ত আলো।”

আপনি বলেছিলেন আপনার প্রেমে বিশ্বাস নেই।
আজ আমি বলি, আপনার বউ হয়ে, আমরা ভালোবাসায় বিশ্বাস করে গোটা জীবন কাটিয়ে দেব একসাথে। কি দিব না?
ইতি,
আপনার বউ।

চিঠি পড়া শেষ হতেই, তূর্য ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করে। তটিনীর পাশে বসে হাত বাড়িয়ে তটিনীর কপালের পাশ দিয়ে একগোছা চুল সরিয়ে দেয়। তারপর একমনে তাকিয়ে থাকে ওর চোখে।
কোনো কথা নেই, শুধু নীরবতা। তটিনীও তাকায় সরাসরি তূর্যের চোখে।

তূর্য ধীরে তটিনীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।অতি আদরে খুব সাবধানে, তটিনীর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। মন চায় আরও এরকম নরম স্পর্শ।
তূর্যের ঠোঁট আর আঙুল একে একে ছুঁয়ে যায় তটিনীর চুল, কপাল, ঠোঁটের কিনারা, ঠোঁট, গাল, গলা….তটিনী মাথা এলিয়ে দেয় তূর্যের কাঁধে।

তূর্য ফিসফিস করে ওর কানে বলে, “চিঠিতে যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার কথা লিখেছ তা কি চাই এখনি?”

তটিনী হঠাৎ চোখ খুলে ফেলে, ওর মাথাটা কেবলি তূর্যের কাধে এলিয়ে দিয়েছিল।মাথা উঁচু করে বলে, “না তো, কোন চিঠিতে এরকম লিখলাম?”

তুর্য শক্ত আলিঙ্গন করে তটিনীকে, নিজের মাথা নামিয়ে আনে ওর উন্মুক্ত ঘাড়ে, “ তোমার মনের চিঠিতে.. তাই না?”
তটিনীর হাত দুটোও জড়িয়ে নেয় তূর্য কে।

চলবে…

#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা