মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
১৬.
দিন গড়িয়ে যায়। তূর্যের একটা চাকরি হয়ে গেছে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। সরকারের বিভিন্ন চাকরির দরখাস্ত করা আছে। ওর ইচ্ছে বুয়েট বা অন্য কোথাও শিক্ষকতা করার, আপাতত এখানে যোগদান করছে। কয়দিন পরেই স্নাতকোত্তর পরীক্ষার রেজাল্ট।
এদিকে অরণ্যর চাকরি হয়েছে একটি পাওয়ার প্ল্যান্টে, সিলেট পোস্টিং। দুই বন্ধুর জয়েনিং সামনের মাসে।
রাফি সারাদিন পড়ছে, টিউশনি আর কোচিং সেন্টারে পড়াবার ফাঁকে ফাঁকে। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরি হওয়ার কথা, ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে। তবে রাফির ইচ্ছা কোনো পাওয়ার প্ল্যান্টে চাকরি করার।
আজ শুক্রবার, তূর্য যাচ্ছে তটিনীদের বাসায়। পাঞ্জাবি পরে রেডি হয়ে বের হচ্ছে। অরণ্যকে জিজ্ঞেস করলো, “যাবি?”
অরণ্য হেসে ফেলল, “শালা, আমার খালার বাসা আমাকেই বলিস যেতে! তুই যা, আজ লাবণ্যের সাথে ডেটিং আছে।”
চাকরি হবার পর অরণ্য বেশ টেনশন ফ্রি।
তটিনীর সাথে তূর্যের বিয়ে হয়েছে আজ দুই মাস। তবুও যেন ওর গা থেকে নতুন বউয়ের গন্ধটা যায়নি। কারণ, এই দুই মাসে তূর্য ওদের বাসায় থেকেছে হাতে গুনে আট-নয় বার। বাইরে দেখা খুব একটা হয়নি। তূর্য এমন এক ভদ্রলোক, শ্বশুরবাড়ি আসতে লজ্জা পায়।
আজ জুমার নামাজ পড়েই চলে আসবে, তটিনী ঠিক করেছে—যেভাবেই হোক ব্যাটাকে এবার অন্তত তিন দিন বেঁধে রাখবে।
আয়নায় নিজের দিকে তাকালো।
“স্বামী বেঁধে রাখতে না পারলে তুমি কিসের স্ত্রী!”
তারপর আয়নায় দাঁড়িয়ে কিছু মোহনীয় ভঙ্গি করতে লাগলো। শাড়ির আঁচল একবার এদিকে নেয়, আরেকবার সেদিকে। পেটের দিকের কাপড় তুলে একটা ভঙ্গি করল। নিজে নিজে হেসে কুটি কুটি হয়ে যাচ্ছে।
তূর্যের সামনে এরকম জীবনেও করতে পারবে না, ভেবেই আরও হাসি আসছিলো।
তখনই কাশির আওয়াজ পেল। ওর হৃদপিণ্ডটা যেন এক লাফে গলা অব্দি উঠে এল।তূর্য! দেখে ফেলল না তো?হায় আল্লাহ! কখন আসলো?
পেছন থেকে তূর্য তটিনীকে জড়িয়ে ওর গালে গাল রাখল। তটিনীর তখন বিশ্বাস হল তূর্য সত্যি এসেছে। ঘড়ির দিকে চোখ গেল—ইশ, খেয়ালই করে নাই।আয়নার দিকে তাকাতে পারছে না।
“আপনি কখন আসলেন?” কন্ঠে রাগ।
“বেশিক্ষণ না। তুমি যখন আয়নায় দাঁড়িয়ে রিহার্সেল করছিলে, আমাকে কী কী করে দেখাবে তখন। জোস ছিল কিন্তু।”
ফিক করে হেসে ফেললো তূর্য, পেটের কাছে হাতের বাঁধন দৃঢ় হল।
তটিনী এক ঝটকায় ঘুরে তূর্যের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল,
“একদম না, আমি কিছুই করছিলাম না!”
“সেটাই প্লিজ, কিছু করো না। তাহলে শেষমেষ আমাকে ঘরজামাই থাকতে হবে।
এই যেমন এখন খেতে ডাকছে, অথচ মন চায় তোমাকে আরও কতক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখি। তোমার আহ্লাদী ভঙ্গিগুলো দেখি।”
তটিনী ছেড়ে দিলো না তূর্যকে, জড়িয়েই থাকল।
“চলেন, খাবেন। আমি আজ স্পেশাল মাংস রান্না করেছি।”
“আচ্ছা, চল।,”
তটিনী তূর্যকে ছেড়ে কাপড় ঠিক করল, পেটের কাছে কাঁধে পিন লাগাতে লাগলো।
“তুমি যে এত রোমান্টিক তা আজ দেখে নিলাম। আমাকে কত কিছু দেখাও, আমাকে গোপন করে।” হাসতে লাগলো মাথা ঝাকিয়ে।
তটিনী এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে,
“এবার খেতে চলেন তো!”
“আচ্ছা, খাওয়ার পর যদি বলি, আবার একটু আগের মতো আয়নায় দাঁড়াও, দেখাও, তখন?”
তটিনী রীতিমতো কেঁপে ওঠে ভেতরে ভেতরে, মুখ লাল হয়ে যায়, নিচু কন্ঠে বলে,
“আপনার কোনো বেহায়া কথার জবাব দিতে পারি না আমি… একদম পারি না।”
তূর্য মুখটা একটু কাত করে তার কানের কাছে ফিসফিস করে,
“তুমি যদি জানতে, তোমার এই লজ্জা পাওয়া মুখ আমার কত প্রিয়।”
তটিনী চোখ বন্ধ করে এক দাঁতের নীচে ঠোঁট নিয়ে এক চিলতে হাসে, মুখ রাঙা হয়ে ওঠে।
“আপনি আর একটা কথা বললে আমি… আমি সত্যিই কিন্তু কান্না করে বসব!”
তূর্য এবার একটু পেছনে সরে গিয়ে বলে,
“আরে বাহ! বউ তো দেখি হুমকি দিতে শিখে গেছে!”
“উফ! চলেন…”
_______________
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পেছনের রাস্তা দিয়ে লাবণ্য আর অরণ্য হেঁটে আসছে। রাস্তাটা পুরনো, কিছুটা আঁধার, জায়গাটা চাঁদের আলোতেও খুব একটা কিছু দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে নিস্তব্ধতা। রাস্তায় কিছু কুকুর ঘুরাঘুরি করছে। খুব বেশি রাত না, কিন্তু জায়গাটা নিরব। দূরে কোথাও হালকা গানের শব্দ ভেসে আসছে। কিছু ছেলে বসে, হাতে তালি দিয়ে গান গাচ্ছে।
অরণ্য আর লাবণ্য ধীরে ধীরে হাঁটছে। অরণ্য নিজেকেই বকা দিল, এই রাস্তায় কেন এল! একটা রিকশা পেলেই উঠে যাবে।
ওরা ক্রস করবে, তখন ছেলেগুলো গান গাচ্ছে,
“উফ তেরি ইয়ে জাওয়ানি…”
একজন শুরু করলো “শীলা কি জাওয়ানি।”
লাবণ্য আতঙ্কিত বোধ করল। অরণ্যের মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের জন্য এগুলো নতুন না। ছেলেরা মেয়েদের দেখলে অশ্লীল গান গায়, শিস বাজায়, ডাবল মিনিং-এ কথা বলে। লাবণ্য চেষ্টা করল দ্রুত রাস্তা পার হতে।
হঠাৎ তিন-চারটা ছেলে অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করতে শুরু করে। ভাব, নিজেরা গল্প করছে—
“জোস মাল!”
“হ, ভাই জিতছে।”
“রেট কত! কে জানে!”
লাবণ্য থমকে যায়। চোখে রাগ, অপমান আর ভয়।
অরণ্য এক সেকেন্ড সময় নেয় না, লাবণ্যকে এক প্রকার টেনে এই নিরব রাস্তা থেকে সরিয়ে বড় রাস্তায় একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকিয়ে দেয়।
“তুমি একটু এখানে দাঁড়াও। কেনাকাটা কর, আমি আসছি।”
লাবণ্য কিছু বলার আগেই অরণ্য ঝড়ের বেগে বের হয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
লাবণ্য আতঙ্কিত বোধ করে। দোকান থেকে বের হয়ে যায়। কিছু মানুষ বলাবলি করে, “মারামারি লাগছে—একটা ছেলের সাথে চারটা ছেলে মারামারি করছে।”
লাবণ্য যা বুঝার বুঝে ফেলে। পাশেই থাকা একটি টহল পুলিশ টিম ওর নজরে আসে। দ্রুত গিয়ে সাহায্য চায়।পুলিশরা গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। ছেলেগুলোকে ধমকে সরিয়ে দেয়।
কিন্তু ততক্ষণে অরণ্যের মুখে আঘাত, কপালে কেটে রক্ত পড়ছে,ঠোঁট ফেটে গেছে মুখের কিছু স্থান ফুলে গেছে। হাপাচ্ছে।
লাবণ্য ফুপিয়ে উঠে,
“কি দরকার ছিল? কিছু বিবেচনা না করেই জড়িয়ে ধরে।”পুরাতন ট্রমা ফিরে এল যেন।
অরণ্য দ্রুত ছাড়িয়ে নেয়,
“দরকার ছিল, নইলে আমি কোনদিন আয়না মুখ দেখতে পারতাম না। এই জখম সামান্য। তোমার সেই মুখ আমি দেখেছি।”
লাবণ্য ওকে নিয়ে ছুটে আসে ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে।ডাক্তাররা দেখে, প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। তেমন মারাত্মক কিছু না। সেলাই লাগে না।
লাবণ্য অস্থির। ওর হাতে অরণ্যের রক্ত লেগে গেছে। ও চুপ করে বসে নেই,নার্স, কম্পাউন্ডার, কাউন্টার, সব জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু লাবণ্যদের অলক্ষ্যে আরও এক জোড়া চোখ ওদের দেখে নেয়।
__________
পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় লাবণ্যর এক চাচা আসে লাবণ্যদের বাসায়। একা আসেনা, সাথে ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে আসে, সাথে পুরাতন রাগ।
লাবণ্যর দাদারা দুই ভাই ছিল। লাবণ্যের বাবারা দুই ভাই, এক বোন। লাবণ্যর চাচা ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। তাই বলা যায়, ওর দাদার ভাগে সব সম্পত্তি লাবণ্যই পাবে।
এদিকে, তার দাদার আরেক ভাই ছিল, যার দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে আজ এসেছেন ওদের বাসায়, লাবণ্যের চাচাতো চাচা। ইসলামিক মতে লাবণ্যর বড় চাচা সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছেন। উনার দুইটা ছেলে। বড়টা ইতালি থাকে। ছোট ছেলে পড়াশোনা বেশি দূর করেনি, এলাকায় নেতাগিরি করে বেড়ায়।
তার সাথেই লাবণ্যর বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন তিনি অনেক দিন। কিন্তু লাবণ্যর বড় চাচা কিছুতেই রাজি হননি। এই নিয়ে মন কষাকষি দুই ভাইয়ের মধ্যে। দুজনই সমবয়সী, আগে সম্পর্কটা বন্ধুর মত ছিল। কিন্তু লাবণ্যকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পরে, এই সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে।
ড্রয়িং রুমে বসে ওর বাবা এবং চাচা গল্প করছেন। লাবণ্য গিয়ে সালাম দিল।
ও চাচা ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলেন,
“মা, কালকে তোমাকে ঢাকা মেডিকেলে দেখলাম?”
তারপর ওর বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বললেন,
“আমি তো ভাবলাম বিয়ে দিয়েই দিলে মেয়ে! আমাদের তো বললা না!”
সবাই মোটামুটি অবাক।
উনি সবার উপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে আবার হাসি দিয়ে বললেন,
“লাবণ্য যেভাবে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরেছিল, আমি তো ভাবছি ওরা জামাই-বউ! যাই হোক, দিন পাল্টাইছে। তারপর, আর কি খবর বল?”
উনি আর বিশেষ কিছুই বলেননি। এতোটুকুতেই সব বলে দিয়েছেন। উনি যাওয়ার পরে লাবণ্যর ডাক পড়ে।
লাবণ্য ওর বাবার মুখ এত কঠিন আগে কখনো দেখে নাই।
“আয়, আমার পাশে বস। আমি কি কোন ভুল করেছি, মা? তুমি আমাকে এত বড় অপমানের সম্মুখীন করলে?”
লাবণ্য কিছু বলতে পারেনা। ভাগ্যটা এত খারাপ!
অরণ্যর একটা জায়গায় চাকরি হয়ে গেছে, পাওয়ার প্ল্যান্টে। সিলেটে চলে যাবে আর এক মাসের মধ্যে।
কিন্তু, কী থেকে কী হয়ে গেল…চুপচাপ চোখের জল ছাড়তে লাগলো।
“তোমাকে কি আমি ছেলেবেলায় বলিনি তোমার জোবাইদা ফুপুর কথা? তোমার বাবা আমার ছোট ভাই। এত ভালোবাসতো বোনকে। আমাদের বোনটা মারা যাবার পরে পাগলের মত হয়ে যায়।
তোমার বাবা, তুমি হবার পর খুব খুশি হয়েছিল কারণ তুমি দেখতে তোমার ফুপুর মতো। তবে সে আতঙ্কেও থাকতো—ভাগ্যটা না তোমার সেরকম হয়।তুমি আমাকে এভাবে ছোট করলে কেন, মা? তুমি আমাকে হারিয়ে দিয়েছো।” একটানা বলে থামলেন।
অনেক কথা বলতে চেয়েছিল লাবণ্য। বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু কান্নার দমকে কথাগুলো হারিয়ে যায়।
লাবণ্যের মা লাবণ্যের পাশে এসে দাঁড়ায়।
“তুমি একটু বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছ। মানুষের মন কখনো বেঁধে রাখা যায় না, লাবণ্যের বাবা। তুমি বরং ছেলেটার খোঁজ খবর নাও। কারণ অনেক সময় খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ে দেওয়ার পরও তো ছেলে খারাপ হয় । আর কি প্রেম করলেই যে…!”
হাত উঁচু করে রেহানা বেগমকে থামিয়ে দিলেন লাবণ্যের বাবা।
“তুমি কোন মুখে এসব কথা বলছো? তুমি কি ওকে সাপোর্ট করছো?”
“হ্যাঁ, করছি!” দৃঢ় শোনায় লাবণ্যের মায়ের কণ্ঠটা।
“লাবণ্যের সমস্ত মোবাইল, ল্যাপটপ, সবকিছু রুম থেকে সরিয়ে আমার রুমে রেখে যাও। আর আমি ওর মামাকে ফোন করছি। বিয়েটা আশা না, লাবণ্য ভেঙেছে—এখন আমি বুঝতে পারছি…”
“কথাটা শোন…!”
“তুমি যে লাবণ্যের মা নও, আজকে প্রমাণ করলে। নাহলে ওর এই কান্ড তুমি মেনে নিতে না। যাই হোক, ওকে কোন প্রকার সাহায্য করলে আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে আমাকে হয়তো দুইবার ভাবতে হবে।”
লাবণ্য হতবুদ্ধি হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। এসব কি বলছে বাবা! তাদের এত বছরের সম্পর্ক, বাবা-মায়ের। তাদের সন্তান ছিল না, তবু একে অপরকে ভালোবেসে…
লাবণ্য ছুটে গিয়ে বাবার বুকে আছড়ে পড়ে,
“ও বাবা! বাবা, আমার দিকে তাকাও… আমাকে মাফ করে দাও বাবা! তুমি শুধু একবার ওকে দেখো, কথা বলো। তোমার যদি পছন্দ না হয় আমি ওকে বিয়ে করব না। কিন্তু তুমি আমাকে অন্য কোথাও দিয়ে দিও না বাবা! আমি না হয় তোমাদের সাথে থাকবো সারা জীবন…!”
ওর বাবার হাতটা ছাড়িয়ে দিলেন। ঘরে চলে গেলেন।লাবণ্য চুপচাপ দেখল, ওর মোবাইল, ল্যাপটপ—সবকিছুই বাবা নিজের ঘরে আলমারিতে তুলে রাখছেন। চেহারা থমথমে। চোখের কোনে জল।
______
অরণ্যর শরীর একটু ভালো, কিন্তু লাবণ্য যে একটা খবর নিল না আর! এটা কিভাবে সম্ভব!
লাবণ্যের ফোন বন্ধ। কি হতে পারে?
অস্থির লাগছিল অরণ্যর। তটিনীকে ফোন করল।
তটিনী ক্লাসেই ছিল।
ফোন কেটে মেসেজ করল
—“ভাইয়া, আমি ক্লাসে। কিছু বলবে?”
—“লাবণ্য আসছে?”
—“না ভাইয়া।”
—“প্লিজ, ওর বাসায় গিয়ে একটা খবর নিয়ে দিতে পারবি আমাকে?”
—“আচ্ছা।”
লাবণ্য কাল রাত থেকে কিছু খায়নি।
রেহানা বেগম চেষ্টা করেছেন খাওয়াতে, পারছেন না। তখন থেকেই কেঁদেই যাচ্ছে।
রেহানা বেগম সহ্য করতে না পেরে, নিজের ফোনটা দিয়ে বলেছিলেন, অরণ্যকে খবর দিতে।
লাবণ্য রাজি হয়নি, বলেছে,
“মা, আমার জন্য বাবা তোমাকে কালকে অনেক বড় একটা কথা বলেছে। তোমাদের দুজনের ভালোবাসা আমার অনুপ্রেরণা। আমার জন্য তোমাদের মধ্যে কিছু হোক আমি চাই না।”
লাবণ্যের বাবা সকালে নাস্তা খাচ্ছিলেন। খাচ্ছিলেন না বলা যায়, নাড়াচাড়া করছিলেন।
“লাবণ্য কই?”
“ও রুমে।”—কাটা কাটা উত্তর দিল লাবণ্যের মা।
“সকালে নাস্তা খেয়েছে?”
“না। কাল রাত থেকে না খাওয়া।”
লাবণ্যের বাবাও নাস্তা খেতে পারলেন না আর।
পেপারটা দূরে ছুড়ে ফেলে বললেন—
“তোমার মেয়েকে বলে দিও, না খেলে মানুষ মারা যায় না। কোন লাভ নেই এসব করে।”
লাবণ্যের মা কোন উত্তর দেয় না। চোখের পানি চোখে আটকে নেয়।
এদিকে, রুমে বসে লাবণ্য সমস্তটাই শুনে।
বাবা আজ কত নিষ্ঠুর! একটুও কি মাফ করা যায় না?
তটিনী আর রিয়া যখন লাবণ্যের বাসায় আসে তখন লাবণ্যের বাবা বাসায় নেই।ওদের দেখে লাবণ্যের মা খুশি হন।যাক, বান্ধবীদের পেলে মেয়েটা হয়ত একটু কিছু মুখে দেবে।
সংক্ষেপে উনি দুই বান্ধবীকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলেন এবং অনুনয় করেন, মেয়েটাকে যেন কিছু খাওয়ায়।এমনিতে অনেক সময় ফিট হয়ে যায়, কি যে ভয় লাগছে…
তটিনী আর রিয়া গিয়ে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে।
লাবণ্যের অবস্থা পুরনো বইয়ের ঝুরঝুরে পাতার মতো।
চেহারা ফ্যাকাসে, চোখ লাল।
“চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।” বলে তটিনী।
“না খেয়ে থাকা কোন সমাধান না।” বলে রিয়া।
লাবণ্য কাঁপা গলায় বলে,
“তোদের কারো ফোনটা দিবি? অরণ্যের সাথে একটু কথা বলতাম… কেমন আছে ও? ঐদিন এত ব্যথা পেল, একটা খবর নিতে পারিনি।”
বলেই কেঁদে ফেলল।
“ভাইয়াই পাঠালো।” বলে ফোনটা নিয়ে ভিডিও কল লাগিয়ে দিল তটিনী। ওকে একা কথা বলতে দিয়ে, লাবণ্যের মার কাছে চলে গেল। পুরো বিষয়টা আরো বিস্তারিত বুঝতে।
ভিডিও কলে লাবণ্যকে দেখে অরণ্যের হৃদপিণ্ডে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
“জান! কি হয়েছে তোমার? এ অবস্থা কেন!”
“অরণ্য, বাবা সব জেনে ফেলেছেন। আমাকে কোন প্রকার সাহায্য করলে, মা আর বাবার সম্পর্কটা ভেঙে যাবে। বাবা আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছেন। আমি কি করবো, কিছু বুঝতে পারছি না!”
হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো।
ওকে তীক্ষ্ণভাবে দেখতে দেখতে অরণ্য বলে উঠলো “তুমি কিছু খেয়েছো?”
“না। আমি যে কিছু খাইনি এটা শুনে বাবা কি বলেছে জানো?_‘কয়েকদিন না খেয়ে থাকলেও মানুষ বাঁচে।’
“আমিও বাবাকে দেখিয়ে দিব, আমি মরি না বাঁচি!”
অরণ্য বিরক্ত হলো, “এ সময় তুমি অভিমান করে আছো তোমার বাবার উপর? না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ? আমিও কষ্ট পাচ্ছি। প্লিজ কিছু খেয়ে নাও, কিচ্ছু হবে না। বেশি কিছু হলে আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব!”
এবার লাবণ্য হাসে
“অরণ্য, আমি পালিয়ে গেলে আমার বাবা মারা যাবে।আমার অন্য কারো সাথে বিয়ে হলে তুমি মারা যাবে।এদিকে, আমি আত্মহত্যাও করতে পারব না।আমি কোন পরীক্ষায় পড়লাম, একটু বলতো!” বলে লাবণ্যর মাথা চক্কর দিল।
অরণ্যর চোখের সামনে সে পড়ে গেল মাটিতে।
—
লাবণ্য হাসপাতালে ভর্তি।না খেয়ে থাকা এবং অতিরিক্ত টেনশনের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
ইসিজি রিপোর্ট খুব একটা ভালো আসেনি।
হাসপাতালের করিডরে বসে আছে অরণ্য। পুরো বিধ্বস্ত অবস্থা।এর আগে কখনো সামনাসামনি অরণ্যকে দেখেনি লাবণ্যের মা।আজকে দেখে খুব মায়া লাগছিল।কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অরণ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অরণ্য চমকে মুখ তুলে তাকালো।
“আমি লাবণ্যর মা।”
অরণ্য সালাম দিল, কিছু বলতে পারল না।
ওর বুকের ভিতর কিছু একটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
লাবণ্যের মা ওর চেহারাটা দেখলেন,ঠোঁট কাটা।
কালকের ঘটনা লাবণ্য বলেছে। যদি এই ছেলে যোগ্য না হয়, তাহলে যোগ্য কে?
এতক্ষণে হন্তদন্ত হয়ে লাবণ্যের বাবা আসলেন হাসপাতালে।এক মুহূর্ত তাকালেন স্ত্রীর দিকে।
হাসপাতালের চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটির দিকে দৃষ্টি দিলেন। কে হতে পারে? চেহারাটা শক্ত করলেন।
“জ্ঞান ফিরেছে?”
“হ্যাঁ। এখন ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে।
ডিউটি ডাক্তারের সাথে কথা বলো। আর তুমি তোমার বন্ধু ডাক্তার বেলালের সাথে কথা বলে নিও কাল। উনি আজ আসবেন, ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। রিপোর্টটা নাকি ভালো আসেনি।”
বলতে বলতে গলা ধরে এলো।
লাবণ্যের বাবা যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন।
অরণ্যের দিকে একটা আঙুল উঁচু করে বললেন,
“তুমি এখানে কি করছো? এক্ষুনি চলে যাবে!” আন্দাজ করলেন এই ছেলেই অরণ্য।
অরণ্য খুব শান্ত কণ্ঠে সালাম দিল, তারপর বলল,
“আমি কোথাও যাবো না আঙ্কেল, আমি এখানেই থাকবো।”
লাবণ্যের বাবা অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলেন।
আরেকটা দিন লাবণ্যকে হাসপাতালে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লাবণ্যের বাবা।
এখানে অন্তত স্যালাইন চলছে। কথা বলেননি মেয়ের সাথে।অভিমান লাগছে—বাবা এখন কিছু না, ঐ ছেলেটাই সব!
ছেলেটা বাসায় যায়নি। মুখে মারামারির দাগ।
কে জানে, কোন গুন্ডা কিনা!
আস্তে করে কেবিনে গেলেন।লাবণ্য ঘুমিয়ে আছে। ওর মা পাশের বেডে বসে আছেন, চেহারা বিবর্ণ।
“কত বেয়াদব একটা ছেলে বসেই আছে! তার উপর চেহারা দেখ, কি অবস্থা, মনে হয় গুন্ডা!”
লাবণ্যের মা শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“আধা সত্য সব সময় ভয়ংকর।”
“মানে?”
“ছেলেটা নামাজ আর ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া নড়েওনি। কিছু মুখে ও দেয়নি। ঠায় বসে আছে।
ছেলেটা গুন্ডামি করে মার খায়নি। তোমার মেয়েকে কিছু ছেলে বাজে কথা বলেছিল, তার প্রতিবাদ করতে গিয়েই…আর রাস্তার ছেলে ও না।বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ভালো চাকরিও পেয়েছে। তোমার তাতে কি? এতে তো তোমার জেদের উপশম নাই তাই না?”
একটানা কথা শেষ করে উঠে কেবিনের বাইরে চলে গেলেন।
লাবণ্যের বাবা ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ব্যাথা অনুভব করলেন।ডাক্তার বলেছে,ওর হার্ট দুর্বল।ছেলেবেলার ট্রমা আর এখন অতিরিক্ত টেনশনের জন্য।ছেলেটার বিষয় এ খোজ নিতে লোক লাগিয়েছেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না।
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা
চলবে ……