মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
১৭.
ভোরের আকাশে কেবল একটু আলো ফুঁটে উঠছে। হাসপাতালের মসজিদের ভেতর ঠান্ডা পাথরের ওপর অরণ্য সেজদায় নত হয়ে আছে। দীর্ঘ মোনাজাত করছে। চোখে পানি, ঠোঁট নড়ছে, বুঝা যাচ্ছে দোয়া পড়ছে।লাবণ্যের বাবা একটু দূরেই বসে ছিলেন। উনিও সেজদায় পড়ে ছিলেন অনেকক্ষন।যুবকের ভেজা চোখ আর মোনাজাত দেখেছেন।
নামাজ শেষে দুজনে বের হয়ে এলো। লাবণ্যর বাবা একবার তাকালেন, কিছু বললেন না।
অরণ্য মাথা নিচু করে সালাম দিল।
সালামের জবাব দিয়ে লাবণ্যর বাবা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি নিয়মিত নামাজ পড়? আর হাসপাতালে পরে আছ কেন?”
অরণ্য জবাব দিল “জ্বি, তবে আগে নামাজ দ্রুত পড়তাম, এখন একটু বেশি সময় নিয়ে দোয়া করি। জীবনের একটা কঠিন পরিক্ষা দিচ্ছি,একটা মানুষকে খুব চাইছি আল্লাহ যেন সুস্থ করে দেন। তার পরিবারের চোখে আমাকে যোগ্য করে দেন। দুয়া করবেন।”
লাবণ্যর বাবার ঠোঁটে সামান্য কাঁপুনি। কিছু বললেন না, “এই ছেলে দুয়ার কথা বলে উনার কাছে লাবণ্য কে চেয়ে গেল!”
ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলেন। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন, এই ছেলেটা কি ভুল মানুষ না সঠিক?
ডা:বেলালের চেম্বারে লাবণ্যের বাবা ও ডা. বেলাল বসে আছে। সব রিপোর্ট দেখে, ডাক্তার বেলাল নিজের বন্ধুকে আশ্বস্ত করলেন।
“আসলে এত ভয় কিছু নেই, ছেলেবেলা থেকেই আমি লাবন্যকে দেখছি।আমি সাইক্রিয়াটিস্ট নই, কিন্তু ওর মনের দ্বন্দ্ব অনেকটাই বুঝি। ছেলেবেলা থেকে একটা ট্রমার মধ্যে আছে।, ডাক্তারি ভাষায় আমরা যেটাকে বলি-‘Post-Traumatic Stress Disorder (PTSD)’। এর সাথে আছে না খাওয়া, টেনশন, এবং ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন-এর উপসর্গ।”
রিপোর্ট টেবিলে রেখে গভীর দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকালেন।
“ওর শরীর দুর্বল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভঙ্গুর ওর ভিতরের মানুষটা। তুই তো জানিস, ছোটবেলার ট্রমা কোনো ওষুধে সারেনা। দরকার ভালোবাসা আর পরিচর্চা, নতুন করে কি হল?”
“ ভালোবাসা সেই পুরানো অভিশপ্ত জিনিস, তুই তো আমাদের পরিবারের সবকিছুই জানিস।”
বেলাল গভীর গলায় বললেন
“জানি। আর জানি তোর নিজের বোন, জুবাইদা… আর সেই প্রতারণার গল্প।”
লাবণ্যর কঠিন গলায় বললেন,
“সেই থেকেই আমি জানি, ভালোবাসা একটা লোভের নাম, এক ধরণের ফাঁদ। সেই ফাঁদেই আমার লাবণ্য পা দিল। এত করে বলার পরেও।”
বেলাল এবার একটু ঝুঁকে এলেন—
“তবে সব গল্প কি একরকম হয় দোস্ত? মন কি কারো শেখানো বুলি শোনে? মেয়ের ভালোবাসা যাঁচাই করতে পারতি অন্তত। আচ্ছা দেখেশুনে বিয়ে দিলেও বুঝি ভুল হয় না। সে উদাহরণ তো আমাদের বন্ধু সালামের পরিবারেই আছে, কি নেই?”
চাচা মাথা নোয়ালেন। মনে পরে গেল সালামের বোন সাথিকে কিভাবে পরকিয়ার বলি হতে হয়েছিলো। “এখন আমার কি করা উচিৎ?”
তক্ষুনি বেয়ারা চা দিয়ে গেল।
“ছেলেটার ব্যাপারে খোজ খবর নে জীদ পুষে রাখিস না।”
“হ্যাঁ, খোঁজ নিয়েছি। মা-বাবা নেই, বাড়িতে বড় এক ভাই আছে, বড় বোন বিদেশ। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে।চাকরি পেয়েছে একটা পাওয়ার প্ল্যান্টে, পোস্টিং সিলেটে। ছেলেটার চরিত্রে তেমন কিছু নেই না বলার মতো, অন্তত আপত্তিকর কিছু পাইনি। যতটা খোঁজ নিয়েছি ভালো মনে হয়েছে। লাবণ্যর বান্ধবীর খালাতো ভাই।”
বেলাল একটু জোরে বললেন, “ ভাবী বলছিল, রাস্তায় লাবণ্যকে কিছু ছেলে বাজে কথা বললে, ছেলেটা একা গায়ে পড়ে মার খেয়েছে।ওর মুখে এখনো সেই আঘাতের দাগ, কিন্তু ও তখনও সরে দাঁড়ায়নি। বিষয়টা আমার ভালো লেগেছে। আর,তুই সত্যি বল, জোর করে অন্য কোথাও লাবণ্যকে বিয়ে দিলে, সে কি সুখী হবে?”
লাবণ্যর বাবা চোখ বন্ধ করলেন।
“আমি ভালোবাসা ভয় পাই বেলাল।মনে হয় কি জানিস, ভালোবাসা মানেই আমি বুঝি প্রতারণা, বিসর্জন, হারিয়ে যাওয়া। আমি আবার হারাতে চাই না।”
বেলাল এবার শান্ত গলায় বললেন,
“মনের ভয় দূর কর, চাইলে কাউন্সিলিং করা। মেয়েটাকে শাস্তি দিস না।”
লাবণ্যর বাবার গলা ভারী হয়ে আসে,
“আমি ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি। আমি ভাবছি, অরণ্যের সাথে একদিন খোলাখুলি কথা বলবো। যদি তাতে সন্তুষ্ট হই, তাহলে বাকিটা আল্লাহর হাতে।”
“সেটাই দোস্ত দেখেশুনে বিয়ে দিতে চাইলে দে, অরণ্যকে দেখ। তুই নিজে যাচাই কর। কথা বল। তবে মনে জীদ বা ভয় রাখিস না।”
“তুই পাশে থাকিস, দুয়া করিস।”
_________
তূর্য আর রাফি খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেছে। অরণ্য কিছু খায়নি কাল থেকে চা আর পানি ছাড়া।বেচারার নিজের অবস্থাই খারাপ। তার উপর লাবণ্যর সাথে দেখাও করতে দেয় নি ওর বাবা। তটিনী খুব কান্নাকাটি করছিল নিজের ভাইয়ের জন্য!ছুটে এসেছে। কেবিনে এখন লাবণ্যর সাথে।
লাবণ্যও কিছু খাচ্ছে না স্যালাইন চলছে…
“মুখে কিছু খাচ্ছিস না কেন? কি অবস্থা করেছিস নিজের।” তটিনী মৃদু বকে দেয়।
“অরণ্য নাকি এখানেই, আমার তো মোবাইল নেই।এরা খালি ঘুমের ঔষধ দেয়, আজ বাসায় চলে যাব।”
তটিনী ফোন ধরিয়ে দেয়। অরণ্য লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে থাকে লাবণ্য নিজেও, অথচ ওরা কত কাছাকাছি।
“চেহারার এই অবস্থা কেন?” ফিসফিস করে লাবণ্য, “ তুমি নাকি খাচ্ছ না কিছু? পাগল হইলা?”
“আগে বল, যে হৃদয়ে আমি তা এত দূর্বল কেন?” হাসে অরণ্য, “ নিজে আগে কিছু খাও।”
“তুমি হৃদয়ে আছ বলেই এটা এখনো নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আর খাব না, সেটা বাবার উপর রাগ।”
“তোমরা দুইজন বাপ-বেটি মিলে আমাকেই মেরে ফেল। ল্যাঠা চুকে যায়।” বিরক্ত হয় অরণ্য।
লাবণ্য খিলখিল করে হাসে, তক্ষুনি কেবিনে ওর বাবা প্রবেশ করে। বাবাকে দেখে লাবণ্য ফোন কেটে দেয়। মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তটিনী ফোন হাতে বের হয়ে যায় দ্রুত।
_____
দুপুরের দিকে রেস্টুরেন্টের এক কোণার টেবিলে জানালার পাশে দুটি চেয়ার। বাইরের আলো পড়ছে টেবিলের ওপর। জানালার ধারে বসেছে অরণ্য, ওর মুখোমুখি লাবণ্যের বাবা। লাবণ্যর বাবা ওর জন্য ভাতের অর্ডার দিয়েছেন।অরণ্য বুঝতে পারছে না কিভাবে বিনয়ের সঙ্গে তা ফিরিয়ে দেবে।কিছু খাবার মন নেই ওর।
টেবিল জুড়ে একটা নিঃশব্দ অস্বস্তি, দু’জনেই যেন ভয় পাচ্ছে নিরবতা কিভাবে ভাঙবে।
হঠাৎ লাবণ্যর বাবা মুখ খোলেন, গলা ভারী হয়ে এসেছে,
“আমি তোমাকে কিছু কথা বলব, মন দিয়ে শুনবে… হয়তো তুমি আমাকে অপছন্দ কর…।”
অরণ্য চমকে উঠল। ঝট করে উনারচোখের দিকে তাকাল।
“কিন্তু স্মৃতির যে জ্বালা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি, তা কাউকে বোঝাবার সাধ্য আমার নেই,”
উনি গভীর নিঃশ্বাস নেন, “লাবণ্য আমার নিজের মেয়ে না—এই জায়গাটায় আমি বারবার আটকে যাই…” উনার গলা ধরে আসে।
অরণ্য অস্বস্তিতে পড়ে যায়, খারাপ লাগতে থাকে বুকের ভিতরটা। কি বলবেন উনি?
“আমার ছোট ভাইয়ের রেখে যাওয়া আমানত ও। কিন্তু এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মুখ, সবচেয়ে দামী সম্পদ,লাবণ্য। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না ও আমার কী… ও আমার নিঃশ্বাসের মতো…”
অরণ্য ধীরে ধীরে পানি দিয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়। কিছু বলার সাহস পায় না।
ভদ্রলোক আবার বলতে শুরু করেন, “তোমার ব্যাপারে আমি অনেক খোঁজ নিয়েছি…আমি আলহামদুলিল্লাহ আমি সন্তুষ্ট…” এই প্রথম হাসলেন।
“আমার আর কোনো আপত্তি নেই, আলহামদুলিল্লাহ। শুধু একটা অনুরোধ—বিয়ের আগে দেখা-সাক্ষাৎ আর না করলেই ভালো। আমার ভয় লাগে… আমি বুঝাতে পারছি না, বাবা…” উনি মাথা নীচু করলেন। ” একটা মেয়ের সম্মান অতি ভঙ্গুর।”
অরণ্য যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না কানকে। এতদিনের সংশয়, শঙ্কা, অবহেলা যেন মুহূর্তে গলে গেল।নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না যেন। ও আচমকা টেবিলে রাখা লাবণ্যর বাবার হাতে হাত রাখে। গলার কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলে,
“আমাকে বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনাকে একটুও আশাহত করব না, ইন শা আল্লাহ। আমার চাকরি হয়ে গেছে, হয়তো আগামী মাসেই জয়েনিং। তারপর… সবকিছু আপনার কথামতো হবে।”
ভদ্রলোক ওর হাতের উপর হাত রাখেন। চেহারায় একটা ভরসা,
“তুমি জয়েনিং করে নাও, তারপর বিয়ের কথা হবে ইন শা আল্লাহ।” এই বলে তিনি হঠাৎ বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করেন। হাত কাঁপে। গলাটা যেন ভেঙে যাচ্ছে,
“বাবা, আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জিনিস, প্রিয় আদরের মেয়েটাকে তোমার হাতে বৈধভাবে তুলে দেব ইন শা আল্লাহ। তুমি ওর কখনো অযত্ন কোরো না। ওর চোখে যদি একফোঁটা অশ্রু দেখি, আমি বাঁচতে পারব না…”
তারপর চোখ মুছে একটু হাসার চেষ্টা করলেন, “নাও, খাও।”
অরণ্য গলার কাছে একটা দলা অনুভব করে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হাসিমুখে বলে,
“আপনিও খান।”
ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে কাঁপা গলায় বলেন,
“আমার মেয়েটা আজ দুই দিন ধরে আমার ওপর রাগ করে কিছু খায় না… আমি কিভাবে খাই বলো তো?”
অরণ্যর চোখ নামিয়ে ফেলে, “লাবণ্য আসলেই ভাগ্যবান…”
_________
রিলিজের প্রস্তুতি চলছে…লাবণ্যর মা ভাত মাখিয়ে চেষ্টা করছেন মেয়েকে খাওয়াতে। তক্ষুনি কেবিনে লাবণ্যর বাবা অরণ্যকে নিয়ে প্রবেশ করলো। অরণ্য লাবণ্যর দিকে তাকালো, হাসপাতালের স্কাই ড্রেস, দুইটা বেনি করা চোখের নিচে কালি। হঠাৎ করে অনেকগুলো করুনা ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়লো যেন। লাবণ্য বাবাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। কিছুটা ভয় পেল সাথে অরণ্যকে দেখে।
ওর বাবা এসে ওর মাকে বললো, “ তুমি উঠ আমি খাওয়াই সেই ছেলেবেলার মত। আমি বুড়া হয়ে গেলাম।কিন্তু আমার মায়ের ছেলের প্রতি এখনো মায়া হল না।”
লাবণ্য চোখ ফিরিয়ে নিল। বাবার প্রতি অভিমান ওর আকাশ ছোয়া, বাবার কিছু মন ভুলানো কথায় গলতে চায় না একদম।
“দেখি মুখ হা কর, বাবার কাছে আর কয়দিন থাকবে? তোমার বিয়ের কথা বললাম আজ।”
লাবণ্য চমকে গেল, চোখে জিজ্ঞাসা।
“এই ছেলেটার সাথে।” হাত দিয়ে অরণ্যকে দেখালো। “হাসপাতালের করিডরে বসে ছিল দুইদিন, মসজিদে ও দেখলাম। খোজ নিলাম। মেয়ের বাপ তো, ভালো পাত্র দেখলেই খোজ নিতে মন চায়। শুনলাম তোমার মত এই ছেলেও দুইদিন খায় না। তাই দুপুরে খাওয়ালাম আর বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। পাত্র রাজি এখন তোমার সম্মতি প্রয়োজন মা!” লাবণ্যর মুখে এক গাল ভাত দিয়ে দিলেন। খেতে খেতেই লাবণ্য বিষয়টা উপলব্ধি করল। গাল লাল হয়ে গেল।
“আপনিও তো দুইদিন কিছু খান নাই আঙ্কেল।” আস্তে কন্ঠে বলল অরণ্য।
“আমার মায়ের কি সে সব খেয়াল আছে? এখন অন্য কাউকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে, তাই তাকেই খাওয়ালাম।” মুচকি হাসলেন।
লাবণ্য চোখ বড় করল, খাবার গিলেই হরবর করে বললো, “ তুমি না খেয়ে আছ কেন?” মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ ভাত দাও বাবাকে। বাবা না খেলে আমিও অনশন শুরু করব আবার।”
লাবণ্যর মায়ের চোখে জল দ্রুত হাতে ভাত বাড়ছেন। এদিকে লাবণ্য বাবার বুকে আশ্রয় নিয়ে আহ্লাদী হয়ে কি সব বলছে। অরণ্য ভাবলো ওর যাওয়া উচিৎ। যেতে যেতে দুইজনের দৃষ্টি বিনিময় হল, লাবন্য যেন বললো, “ দেখেছো বলেছিলাম না, আমার বাবা পৃথিবীর বেস্ট বাবা।”
অরণ্য মাথা ঝাকিয়ে তাতে সায় দিয়েছে, “ কোন সন্দেহ নাই তাতে।”
চলবে..
১৮.
তটিনী মুখ ভার করে বসে আছে সাধারণত এরকম হয় না। মেয়েটা খুবই বুঝদার। কিন্তু আজকে মেয়েটা একটু যেন বেশি অভিমানী। তূর্য পাশে বসে বসে বউর অভিমান দেখছে। চাকরিতে জয়েন করেছে মাত্র। তূর্যের ইচ্ছে অন্তত ছয় মাস চাকরি করবে, তারপর নিজেরা একটা ফ্ল্যাট গুছিয়ে তাতে উঠে যাবে। চাকরির পাশাপাশি তূর্য যে টিউশনিও করছে। নতুন একটা সংসার গুছাতে অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তু তটিনী এখনই নিজের সংসার চায়।
তূর্য ধীরে ধীরে তটিনীর গালে আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছে। তটিনী অসহ্য হয়ে মশা মারার মত একটা ঝাড়া দিল আঙুল। “ সরেন তো, আপনার আহ্লাদ এখন বিষ লাগছে, আমার থেকে দূরে থাকাই আপনার মতলব।”
“তাই?” তূর্য এবার ওর চুল গুছিয়ে দিয়ে মাথায় আদর দিয়ে দেয়। “ আমার তাতে লাভ?”
“কে জানে! লস হলে তো নিয়েই যেতেন নিজের সাথে।” আরেক দিকে তাকালো তটিনী।
তূর্য এবার আলতো করে তটিনীর হাতটা ধরল, “সংসার শুরু করলেই হবে?গুছাতে হবে না? একটা খাট একটা আলমিরা, আমার সাজুনি বউর জন্য একটা ড্রেসিং টেবিল, আরও কি সব লাগে…”
“ওসব তো বাবা দিবে…!” ছটফট করে বলে তটিনী।
কথা শেষ করার আগেই তূর্য ওর ঠোঁট দুইটা বন্ধ করে দেয়।তটিনী বেচারা চোখ বড় করে।
তটিনীকে ছেড়ে খানিক পরে তূর্য বলে, “ তোমার বাবা কেন দিবে? বিয়েতে উনি সব করেছেন আমি ওয়ালিমা পর্যন্ত করতে পারি নি। এখন সংসার উনি গুছিয়ে দিবেন, এ কেমন জুলুমের কথা।”
তটিনী রেগেই যায় এবার, “ বারে, আমার আত্মীয়রা দিবে না আমাকে গিফট!”
“আচ্ছা বাবা তোমার গিফট তুমি নিও, জামা জুতো, গয়না। আচ্ছা?”
তটিনী গম্ভীর হয়ে বলে, “সে দেখা যাবে। এটা প্রমানিত আমারে আপনার লাগবে না।”
তূর্য ফট করে তটিনীকে নিজের কোলে বসিয়ে নেয়, তারপর আবৃত্তি করে,
“ব্রেকফাস্টে তোমারে লাগবে
লাঞ্চে-ডিনারে
অহেতুক বিকালের জলখাবারে
তোমারে লাগবে
কিচেনে তোমারে লাগবে
বেডরুমে তোমারে লাগবে
উঠানে তোমারে লাগবে
সিথানে তোমারে লাগবে
শাওয়ারে আর আওয়ারে আওয়ারে
তোমারে লাগবে”
এটুকু শুনে তটিনী খিলখিল করে হাসে, “এ অসভ্য কবিতা কে লিখল হু? আপনি?” বলে উঠে দাঁড়ালো।
“আমি না, উদয়ন রাজীব বলে একজন। আর অসভ্য কোথায়?”
“ঐ যে শাওয়ারে লাগবে!!” বলেই আবার হাসলো শব্দ করে।
তূর্য সেদিক তাকিয়ে আবার আবৃত্তি করল,
“তোমারে লাগবে মিছিলে
কলহ-ক্যাচালে
দৈনন্দিন হ্যাসেলে তোমারে লাগবে
আলাপে তোমারে লাগবে
গোলাপে তোমারে লাগবে
জ্বর আর তার প্রলাপে
তোমারে লাগবে
এই নাগরিক জীবনের সব যানজটে
প্রতিটা গসিপ
আর পাসিং থটে
কোল্ড কফির কাপে”
তটিনী এবার পাশে বসে তূর্যের কাধে মাথা রাখলো, “ বাপরে খুব রোমান্টিক কবিতা তো। সেম টু ইউ।” বলে তূর্যের গালে শব্দ করে একটা আদর দেয়।
তূর্য এবার বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দেয় একটানে তটিনীকে বুকে জড়িয়ে আবার আবৃত্তি করে,
“ধাপে ধাপে
এলোমেলো মাপে
তোমারে লাগবে
শপথে লাগবে
বিপথে লাগবে
অযথা শুয়ে থাকায়
দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাসে
এপাশে-ওপাশে তোমারে লাগবে”
তটিনী শব্দ করে হাসতে থাকে, অভিমান সব ধুয়ে যায় হাসির তোড়ে।
_______________
খুব সুন্দর আজকের দিনটা, পুরো প্রেমে পড়ার মতো। সকাল থেকেই আকাশটা নীল, হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।বিকেলের সোনা রোদটা ঠিক যেন গায়ে মেখে নেওয়ার মতো উষ্ণ। লাবণ্য একটা নীল জামদানী পরে এসেছে। অরণ্য পরেছে নীল পাঞ্জাবি।
ওরা আজ আবার এসেছে সেই পুরনো রেস্টুরেন্টে, যেখানে প্রথম দেখা করেছিলো। চারপাশে শীতল বাতাস, বাজছে মৃদু রবীন্দ্রসঙ্গীত।
অরণ্য এবার সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে লাবণ্যকে দেখছে, লাবণ্যর চোখেমুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, যেন কোনো ব্যথার ছায়া নেই আর।
মেয়েটার মুখ পুরা ঝলমল করছে। দুইবার এর মধ্যে ডাক্তার দেখিয়েছে ওকে। সব কিছু ঠিকঠাক। ছোটবেলার ট্রমা, মানসিক দ্বন্দ্ব, সব যেন পেরিয়ে এসেছে লাবণ্য ।
লাবণ্য অরণ্যর দিকে তাকায়, চোখে একরাশ প্রশান্তি।
“জানো, আমি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষগুলো আমার আশেপাশে।”
অরণ্য খেয়াল করে লাবণ্যের হাত খালি। আনমনে হেসে ওঠে। পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দেয়।
“হুম, আমি জানি। তবে বলো তো, ভালোবাসার প্রতিযোগিতায় কে এগিয়ে? তোমার হিটলার বাবা না আমি?”
লাবণ্য ঝট করে আঙুল তোলে,
“দেখ!”
অরণ্য হেসে ফেলে, “জানি জানি, তোমার বাবা হিটলার না। অনেক ভালো মানুষ।” বলতে বলতে ওর হাত ধরে তাতে দুইটা রুপার চুড়ি পরিয়ে দেয়। “ পছন্দ হল?”
লাবণ্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, এত্ত সুন্দর! “অসাধারণ তো।”
অরণ্য হাসে, তারপর একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “জানো, তোমার বাবা বলেছিলেন তোমার সাথে যেন আর দেখা-সাক্ষাৎ না করি। ভয় পান, বুঝো না? তার রসগোল্লার মতো একটা মেয়ে যদি আমি খেয়ে ফেলি?”
লাবণ্য রাগে চোখ গোল করে, “সব কিছুই মজা না! আমি রসগোল্লা হলে তুমি কালোজাম।”
এবার অরণ্য হেসে ফেলে জোরে, “ভাই, আমি এত কালো না!”
তারপর মুহূর্তেই একটু গম্ভীর হয়, গলার স্বর নরম হয়, “তোমার বাবা যদি জানতে পারেন, খুব কষ্ট পাবেন না তো?”
লাবণ্য ধীরে টেবিলের উপর রাখা অরণ্যের হাত ধরে,
“না, মা বলেছে উনিই বুঝিয়ে বলবে। আমরা এতদিন দেখা করিনি, আর কাল তুমি চলে যাচ্ছ তাই…”
লাবণ্যের বুকটা হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগে—এই শহরে অরণ্য থাকবে না!
“লাবণ্য!” অরণ্য ডাকে, গলায় কেমন একটা কম্পন। “তোমার চোখে কি আনন্দের অশ্রু?”
লাবণ্য কষ্ট চেপে হাসে, “হ্যাঁ, ঝগড়াটে ছেলেটা দূরে যাচ্ছে, আমি আনন্দে মরে যাচ্ছি।”
“বোকা মেয়ে একটা!”
অরণ্য এবার একটু সামনে ঝুঁকে বলে, “এই যাওয়া আমাদের একসাথে থাকার জন্য। ছয় মাস সময় দাও, তারপর আমরা মিয়া-বিবি হয়েই দেখা করব ইন শা আল্লাহ। অপেক্ষা করবে তো আমার?”
লাবণ্যের ঠোঁটে কাঁপা হাসি,
“অনন্তকাল করব! এরকম করে বল কেন?”
পেছনে বাজছে রবীন্দ্রনাথের গলা—“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখিনি তোমায়… দেখিনি…”
গানের সুরটা যেন লাবণ্যের চোখের ভেতর কথা বলে উঠছে।
অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“তোমাকে প্রথম যখন দেখি, জানো লাবণ্য, তুমিই ছিলে আমার জীবনের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়। শুরুটাই তো ঝগড়া দিয়ে হয়েছিল।”
লাবণ্য হেসে বলে, “হুম আর ছাতাটা ছিল আবার কাছে যাবার ছুতো। এরপর তো ভালোবাসার শুরু! কিভাবে জড়ালাম, সে রহস্য আজও বুঝি না।”
অরণ্য ধীরে বলে, “হ্যা, কিভাবে বল তো বাবার রাজকন্যার মন চুরি করলাম।”
লাবণ্য চোখ ফিরিয়ে বলে, “ চুরি না একে বলে ডাকাতি।”
অরণ্য লাবণ্যের চোখের দিকে চেয়ে বলে,
“আমি তো এদিকে লুটপাট করতে চাই,…তিন কবুলে।”
লাবণ্য লজ্জা পেয়ে বলে, “কথার কি ছিরি।”
এখন গান বাজছে…“এই মিলনের পথে জেনেছি প্রিয়, তুমি আমারই…”
অরণ্য ধীরে বলে, “তোমার বাবার ভয়টা অমূলক না। আমি সত্যিই তোমাকে একটু একটু করে নিজের করে ফেলেছি। চোখ দিয়ে, মনে করে, স্বপ্নে বুনে… আর এখন, আমার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনে তুমি।”
লাবণ্য হাসে বিভোর হয় আগামীর স্বপ্নে।
__________________
তূর্য আর ওর শশুর বসে দাবা খেলছে, ভদ্রলোক পান খাচ্ছেন। তূর্যের উনাকে খুব ভাল লাগে, কে জানে কেন? একটা সারল্য আছে তাই হয়ত। সামনের সেন্টার টেবিলে নানা রকম নাস্তা। সেদিক তাকিয়ে হাসফাস লাগে কেমন। এই বাড়িতে এক মাস থাকলে ওজন অন্তত পাঁচ কেজি বেড়ে যাবে ওর।
“বুঝলা বাবা ফ্ল্যাট নিয়াই আমারে বলবা কি লাগে আমি বুঝমু।”
তূর্য সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ইতস্তত করে বলে, “,আপনি শুধু দুয়া করবেন। আমি ইন শা আল্লাহ যা প্রয়োজন নিজেই….!”
“আরে, বাবা মেয়ারে সবাই সামান্য উপহার দেবার চায়, ওর হক আছে না?”
“আচ্ছা ওকে যা ইচ্ছে দিতে পারে।” তারপর অল্প চুপ থেকে বলল, “ বাবা, আমি তো কোন অনুষ্ঠান করলাম না, আপনাদের ও হক আছে। তাই উপহার নিতে আমার আসলে ভালো লাগবে না। দুয়াটাই তো সবচেয়ে ভালো আর দামী উপহার।”
“আরে, খামু তো…খাওয়াই বা… নাতী নাতনি হইলে একবারে।” বলে উঠে যান পানের পিক ফেলতে।
তূর্য বসে বসে ভাবে, কি বিপদ এরা কিছুই বুঝতে চায় না। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তূর্য, লোভ কে ভয় পায় বড্ড। একবার লোভ পেয়ে বসলে?তাছাড়া তূর্যের যা আছে তাই দিয়েই তো সন্তুষ্ট থাকতে হবে তটিনীর, নইলে তো বিপদ।
_________________
সিলেটের সীমান্তঘেঁষা একটি ছোট্ট উপজেলায় নতুন করে চালু হওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে অরণ্যর প্রথম পোস্টিং। (কাল্পনিক) সিলেট এমনিতেই সৌন্দর্যে অতুলনীয়, পাহাড়, ঝর্না গাছ, চা বাগান। অরণ্য
আজ এক সপ্তাহ হলো জয়েন করেছে।
নতুন জায়গা, নতুন সহকর্মীরা, চারপাশে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা নিস্তব্ধতা, গাছ-গাছালি আর চায়ের ঘ্রান সব মিলিয়ে মনটা বেশ ভালো লাগে।একটাই শূন্যতা আর তার নাম লাবণ্য।
এখানে অরণ্যরা কোয়ার্টারে থাকে, আরও দুজন ইঞ্জিনিয়ার সঙ্গী। সবাই খুব অমায়িক।
সিলেটের খাবারও অরণ্যর ভালো লেগেছে, ঝাল ঝাল, ঠিক যেমন ও পছন্দ করে।
লাবণ্যকে একদিন ফোনে বলেছিল,
“খেতে বসলেই আমার তোমার কথা মনে হয়!”
লাবণ্য হেসে বলেছিল, “কেন?”
অরণ্যর উত্তর ছিল, “খাবারগুলো তোমার মতোই ঝাল ঝাল !”
লাবণ্য ফোনের ও পাশে হেসে ফেলেছিল, “একবার বল আমি রসগোল্লা একবার ঝাল, তোমার মাথা খারাপ আসলে।”
অরণ্যও হাসে,সুর করে গান করে, “পাগল হইলাম তোর কারনে।”
সত্যি বলতে, এখানে এসে অরণ্যের শুধু একটা আফসোস, লাবণ্য নেই পাশে।ওর খুব ইচ্ছে, এখানে সংসার পাতবে লাবণ্যর সঙ্গে।
এই পাহাড়, সবুজ, নীরবতা, সবকিছুতে হারিয়ে যাবে তারা একসাথে।
আসার আগে লাবণ্যদের বাসায় গিয়েছিল।
লাবণ্যের বাবা খুবই আপন ভঙ্গিতে বলেছিলেন,
“আর ছয়টা মাস পর, ইনশাল্লাহ তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেব।”
অরণ্যর মন জুড়ে তখন শুধুই লাবণ্য, ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর কাজের প্রতি দায়িত্ব। মাঝে মাঝে বন্ধুদের মিস করে, রাফির ও চাকরি হয়ে গেছে। ভাবে ছুটি পেলেই ঢাকায় যাবে। তবে সেটা যে এত দ্রুত অরণ্য কি জানতো?
একদিন রাতে রাতের শিফট ছিল টার্বাইনের চাপ কিছুটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বারবার ওয়ার্নিং সিগন্যাল ভেসে আসছিল।
সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার কিছুক্ষণ আগে বাইরে গিয়েছেন, ভেতরে ছিল শুধু অরণ্য আর ওর মত এক জুনিয়র।
“ভাই, প্রেসার লেভেল ৪৫ ছাড়িয়ে গেছে!” সাদ্দাম নামের সহযোগীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
অরণ্য তখনই নিজের হেলমেট পরে দৌড়ে যায় কন্ট্রোল রুম থেকে ইঞ্জিন রুমের দিকে। অন্য কিছু ভাবার অবকাশ নেই, চোখেমুখে একটাই অভিব্যক্তি আর তা হল দায়িত্ব।
কিন্তু ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা।একটা বড় বিস্ফোরণের শব্দ! টার্বাইনের পাশের একটি পাইপলাইন ফেটে যায়। চারদিকে ধোঁয়া, আগুন, আর গ্যাসের তীব্র গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসে।
এক মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে গিয়ে অরণ্য পড়ে যায় ইস্পাতের একটি বেঁকে যাওয়া সিঁড়ির নিচে।
মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে, শরীরের একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত।
চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস ক্ষীণ, কোনো সাড়া নেই।
কাছাকাছি যে হাসপাতাল সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় অরণ্যকে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সাদা আলোয় সবকিছু ঝলমল করছে, অথচ কারো জীবনে নেমে এল অন্ধকার।
চিকিৎসকরা অরণ্যকে স্ট্রেচারে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সহকর্মীদের প্রশ্নের উত্তরে একজন ডাক্তার বলেন,
“ উনার হার্টবিট ধীর, মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ নিশ্চিত। স্ট্যাবল না করলে কিছু বলা যাবে না। আল্লাহকে ডাকেন, বাড়িতে খবর দেন।”
ডিউটি চিকিৎসক অনেকক্ষন পরে এসে বলেন,
“আমরা যতটা সম্ভব করেছি, এখানে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে।ঢাকায় রেফার করছি। দ্রুত ব্যবস্থা নিন।”
সেদিন রাতটা ছিল অরণ্যর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার রাত, শুধু অরণ্যর না লাবণ্যও বটে।
________________
তখন দুপুর আকাশটা সুন্দর বরাবরের মত চকচকে, কিন্তু লাবণ্যর জীবনে কালো মেঘের আনাগোনা। গতকাল রাতেই অরণ্যের সহকর্মী ওকে ফোন করে বিস্তারিত বলে। এরপর থেকেই শুধু অপেক্ষা। আশ্চর্য লাবণ্য একদম যেন কান্নাহীন হয়ে গেছে। চুপচাপ অপেক্ষা করছে। তটিনীদের বাসায় চলে এসেছে খুব ভোরে বাবার সাথেই।
লাবণ্যর বাবা কি বলবেন বা করবেন বুঝতে পারছেন না। শুধু মেয়েটাকে বুকে আগলে আছেন। মনে মনে বললেন, “আমি জানতাম ভালোবাসা ভালো না। আমার মেয়ে কষ্ট পেয়েই গেল। অরণ্যের জন্য ও কি একটা মায়া লাগছিলো।”
হাসপাতালের সাদা আলোয় ধূসর দেয়ালগুলো সব সময়ের মত নিস্তেজ, বাতাসে কড়া জীবানুনাশকের গন্ধ ICU-র দরজার সামনে বসে আছেন অরণ্যের খালা, খালু ও তটিনী পাশে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য আর রাফি। কাল ভোর রাত থেকে কারো চোখে ঘুম নেই।
লাবণ্য আর ওর বাবাও আছে একপাশে। তটিনীর বাবা লাবণ্যর বাবার পাশে গিয়ে বসলেন, উনার চোখে জল, বিরবির করলেন, “ চিন্তা করবেন না আমি সব রকম চিকিৎসা করাব বড় ভালো আমাদের এই পোলাডা।”
লাবণ্যর বাবা আজ নির্বাক।
সেই মুহূর্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন সিনিয়র নিউরোসার্জন মধ্যবয়সী, গম্ভীর মুখের ভাব ডাক্তারের।
ডাক্তার চোখ তুলে সবার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আপনারা সবাই এখানে আছেন ভালো হলো। রোগীর বিষয়ে আপনাদের সবার সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল।”
চারপাশ নিস্তব্ধ। সবাই অপেক্ষায়।
ডাক্তার ধীরে ও স্পষ্ট গলায় বলেন:
“অরণ্য এখন গভীর কোমায় আছে। আমরা তাকে স্কেল অনুযায়ী মূল্যায়ন করেছি—Glasgow Coma Scale (GCS)-এ তার স্কোর মাত্র ৫। স্বাভাবিকভাবে একজন সুস্থ মানুষের স্কোর থাকে ১৫।
ওনার মাথায় ইন্টারনাল ইনজুরি হয়েছে,রক্ত ক্ষরন। এই ধরণের ইনজুরিতে ব্রেনের নিউরোনগুলো নিজেদের মধ্যে সংযোগ হারিয়ে ফেলে।”
সবার হতবিহ্বল চেহারার উপর একবার নজর বুলিয়ে নিলেন,
“তার মস্তিষ্ক এখন আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। যদি ব্রেনকে একটা সার্কিট বোর্ড ভাবেন, তাহলে বলা যায় অনেক সংযোগ ছিঁড়ে গেছে। সে চোখ খুলছে না, কথা বলছে না, এমনকি ব্যথা দিলেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই,মানে সে গভীর কোমায় আছে। এই অবস্থায় মানুষ সচেতন নয়, এবং কোনো উদ্দীপনায় সাড়া দেয় না।”
“ক কতদিন এরকম থাকবে?” প্রশ্ন করে রাফি।
“কখনও কেউ কয়েক দিনের মধ্যে জেগে ওঠে, আবার কেউ মাস বা বছরের পরও ফেরে না। অনেক সময় কোমা থেকে মানুষ আর ফিরে আসে না, ধীরে ধীরে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ বন্ধ করে দেয়—এবং মৃত্যু ঘটে।” একটু থেকে নরম গলায় বললেন,
আমরা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু সত্যি বলতে, নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব না। সামনে কী আছে৷ তা সময় আর সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আপনারা দুয়া করেন।”
এক নিঃশব্দ ধাক্কা লাগে কথাগুলো শুনে।
তূর্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। ওর শশুর পেছন ফিরে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল হঠাৎ চিৎকার করে উঠেন, “বিদ্যাশ নিয়া গেলে হইব কিছু? ট্যাকার চিন্তা করবেন না ডাক্তার সাব।”
ডাক্তার মাথা নাড়েন, “কোমার কোন চিকিৎসা নেই, আমি দু:খিত।’”
তটিনী নিজের মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ কাঁদছে।
আর ঠিক তখন…
লাবণ্যের ঠোঁট হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যায়। সেও কিছু বলছে না। মুখ শুকিয়ে গেছে, ঠোঁট সাদা। হঠাৎ তার দুই হাত কাঁপতে শুরু করে।শরীর ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
“লাবণ্য!” ওর বাবা হাহাকার করে উঠেন। উনি ধরতে যাবার আগেই লাবণ্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, হঠাৎ পিছন দিক থেকে মাথা লাগলো দেয়ালের নিচে থাকা স্টিলের কর্নারে।রক্ত ছুটে এল কপাল ফেটে।
তটিনী দৌড়ে আসে৷ চিৎকার করে ওঠে:
“ওকে ধরুন! নার্স! ডাক্তার! কেউ আসুন!”
“… সম্ভবত ট্রমা থেকে জ্ঞান হারিয়েছেন, সাথে মাথায় ইনজুরি ,” ডাক্তার একঝলকে বলেন।
তূর্য দাঁড়িয়ে এক কোণে, থরথর করে কাঁপছে। অরণ্য ICU-তে, আর লাবণ্য স্ট্রেচারে।
একসঙ্গে যেন দুজন মানুষের জীবন থেমে গেছে… একই দিনে, একই হাসপাতাল…
তটিনী ছুটে এসে তূর্য কে শক্ত করে জড়িয়ে নিল।শরীরের কাঁপুনি থামছে না ওর। এটা কি হল?
(পাওয়ার প্ল্যান্ট এর কার্যাবলী আর কোমা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য গুগুল আর চ্যাট জিপিটির সাহায্যে নেওয়া)
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা
চলবে……