আমি এক ভাগ্যবতী পর্ব-০২

0
1

#আমি_এক_ভাগ্যবতী (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মিলা এবং বৃদ্ধা পাশাপাশি বসে আছে। মিলা বৃদ্ধার জীবনের গল্প জানতে আগ্রহ প্রকাশ করে। বৃদ্ধা প্রথমে বলতে চায়, তার মনে হয় তার গল্প মিলাকে কষ্ট দিবে। মিলা সেজন্য জোর করে বলে,“আপনি বলুন। আমি কষ্ট পাবো না। বরং আপনার গল্প শুনলে হয়তো আমার ভালো লাগবে। নিঃসন্তান হয়ে আমি যে কষ্টটা পাচ্ছি সেটা হয়তো কমবে। হতে পারে শাওন আর আমার তিক্ততার সময়গুলোও কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে যাবো।”

“নিঃসন্তান দাবি করো না নিজেকে। বিয়ের মাত্র পাঁচ বছর। তাছাড়া তুমিই তো বললে ডাক্তার জানিয়েছে তোমার কোন সমস্যা নেই। হতে পারে যেকোন মূহুর্তে তুমি সন্তানের মা হতে পারো। সৃষ্টিকর্তা চাইলে সব সম্ভব। তাই এত অল্পে ভেঙে পড়ো না।”
বৃদ্ধার এই কথায় মিলা মাথা নাড়ায়। মিলা আবারও তার গল্প বলার জন্য বলে। বৃদ্ধা শান্ত গলায় বলে,“বেশ শোনো তবে।”
বৃদ্ধা তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করে৷ মিলা মনোযোগ দিয়ে তার বলা কথাগুলো শুনতে থাকে।

অতীত,
আমার নাম মধুবালা। গায়ের গড়ন চাপা হওয়ার জন্য ছোট থেকে কম উপহাসের শিকার হইনি। এই গায়ের রং নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছে। এক পর্যায়ে তো আমার বাবা, মায়ও অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। আসলে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে হচ্ছিলো না। বিয়ের জন্য ভালো পাত্র না পেয়ে আমার বাবা, মা হতাশ হয়ে যায়। তখন তাদের কাছেও আমার গায়ের গড়ন অভিশাপের মতো লাগে। এসবকিছুর মাঝে আমার কষ্টটা কেউ অনুভব করতে পারতো না। আমার এক চাচাতো বোন ছিলো। তার নাম পারুল। সে দেখতে অনেক রূপবতী ছিলো। সবসময় তার উদাহরণ টেনে আমার ভবিষ্যত জীবন কত খারাপ হতে চলেছে এটা সবাই বলতো। পারুল কত ভালো আছে তার বর্ননা করতে অবশ্য ভুলতো না। এসব শুনে একটা সময় আমারও মনে হচ্ছিলো রূপই সব। রূপহীন এই জগতে সব মিছে। আমি খুবই কুৎসিত দেখতে। আমি যখন এই কথাগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, ঠিক সেই সময়ে আমার জীবনে এলো সে। তার নাম মাজেদ আলী। আমার চেয়ে দশ বছরের বড় ছিলো। একবার বিয়েও হয়েছিলো। তার প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। একটুকু জেনেই তার সাথে বিয়ের আসরে বসি আমি। সে আগে থেকে বিবাহিত এই বিষয়টি আমার মাথায় তখনও ঢোকেনি। কারণ আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার মতো কুৎসিত মানুষকে কেউ পছন্দ করতে পারে? আমাকে যে পছন্দ করবে তার তো কিছুটা খুঁত থাকবেই। সেজন্য তার এই খুঁতটা আমার চোখে পড়েনি। আমার চোখে এই খুঁত তখন পড়েছে যখন সে বাসর ঘরে বলে,“অবিবাহিত হয়ে একজন বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করতে আপনি রাজি হয়ে গেলেন?”

“আমার মতো কুৎসিত একটি মেয়েকে আপনি পছন্দ করেছেন এটাই তো অনেক….
আমাকে কথাটি শেষ করতে না দিয়ে মাঝেদ বলে,“আজ বলেছেন বলেন। আর কখনো বলবেন না। এই দুনিয়ায় কেউ অসুন্দর দেখতে নয়। সবাই সুন্দর। শুধুমাত্র তাদের সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্য মানুষের যে মনটা প্রয়োজন সেটা সবার থাকে না।”
মানুষটির এই একটি কথাই ছিলো আমার চোখে তার জন্য মুগ্ধতার জন্ম দিতে। অতঃপর সেই থেকে শুরু হলো তার প্রতি মুগ্ধ হওয়া। তার প্রতিটি কথায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তার ভালোবাসায় নিজেকে আবদ্ধ করেছি। প্রথম দিকে অবশ্য সে আমাকে বোঝাতো, তার আগে বিয়ে হয়েছিলো। এই কথা জেনে আমার ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিলো। বাবা, মায়ের পছন্দে বিনাবাক্যে বিয়ে করা উচিত হয়নি। তবে সেসব কথা আমি বিশেষ পাত্তা দেইনি। একটা সময় পর আমি তার প্রেমে যখন পুরো মাতোয়ারা তখন সে আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করে তার প্রথম বিয়ে নিয়ে আমাকে কখনো মন খারাপ করতে বারণ করে। সেদিনই আমি জানতে পারি, তার কোন দোষ ছিলো না। তার স্ত্রী অন্যত্র সম্পর্ক ছিলো তাই চলে গিয়েছে।

এভাবে দাম্পত্য জীবনের চার বছর কেটে যায়। আমরা বাচ্চার জন্য চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হচ্ছিলো না। গ্রামে তখন ওঝা, হুজুর দেখানোর বেশ চল ছিলো। আমরা সেটা দেখাই। তাতে কাজ নাহলে শহরে এসে ডাক্তার দেখাই। সেখানে জানতে পারি আমি বন্ধ্যা। এই কথাটি জেনে সেদিন আমি অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু আমার তিনি ভেঙে পড়েননি। আমার জন্য পড়েনি। সে ভেঙে না পড়ে উল্টো আমাকে বুঝিয়ে বলেন,“সন্তান জীবনে সবকিছু নয়। এই দুনিয়ায় সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাটাই আসল।আমাদের মধ্যে তো ভালোবাসার কোন কমতি নেই। আমরা একসাথে সারাজীবন ভালোভাবে কাটাতে পারবো। তাই তুমি এসব নিয়ে একদম ভেঙে পড়ো না।”
এক মাস পুরো সে আমাকে এই কথাগুলো বোঝায়। সে আমাকে বলে,“ধরো আমাদের একটি সন্তান হলো। সে বড় হয়ে আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলো, এটা ভালো হলো নাকি এখন আমরা একসাথে নিজেদের বাড়িতে আছি এটা ভালো?”
এভাবে নানা উদাহরণ দিয়ে আমাকে বোঝাতো। তার পরিবার এক মূহুর্তের জন্য কখনো আমাকে বাচ্চা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়নি। সে সুযোগ দেইনি। সবসময় সে প্রতিবাদ করেছে। তার এক কথা,“আমার স্ত্রী, আমার জীবন। আমি বুঝে নিবো।”

সেই থেকে আজ অব্দি আমার নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ভাগ্যবতী বলে মনে হয়েছে। সে আমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছে যে আমি কখনো নিজেকে আর অসুন্দর, অযোগ্য, বন্ধ্যা ভাবার সুযোগই পাইনি। এভাবেই আমরা হেসে-খেলে চল্লিশ বছর কাটিয়ে দেই। অতঃপর সে তার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই ফ্লাটটি আমার জন্য কিনে। যেদিন এই ফ্লাটে আমরা প্রথমবার উঠি সেদিন সে আমাকে বলেছিলো,“এটা তোমার ঘর। একান্তই তোমার। যেখানে অন্যকারো অস্তিত্ব নেই। শ্বশুড় বাড়ি, বাবার বাড়ি শুনতে তুমি অনেকটা কষ্ট পেতে। আমি দেখেছি তোমার সেই অজানা কষ্ট। এখন থেকে সেই কষ্টটা ভুলে যাও। এটা তোমার বাড়ি। তোমার ঘর। পুরো ফ্লাটটা তোমার। যেখানে আমি তোমার ভালোবাসা হয়ে তোমার বাড়িতে তোমার সঙ্গে থাকবো।”
সেদিন আমার এত ভালো লেগেছিলো যে আজও আমার কাছে সেই স্মৃতি জীবন্ত মনে হয়। সেদিন আমি শান্ত গলায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,“এর আগে আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে। কিন্তু তুমি উত্তর দাওনি। আজ দয়া করে উত্তর দাও। বলো না, আমার মাঝে কী পেয়েছিলে যে এতটা ভালোবেসেছো?”

“তোমাকে যেদিন প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম সেদিন আমার আত্মীয় স্বজন সবাই বলছিলো, এ তো কালো। একে বিয়ে করানো যাবে না। আরও কত কি। সবকিছু ছাড়িয়ে সেদিন আমি কালো তোমার মাঝে অদ্ভুত এক মায়া দেখেছিলাম। সেই মায়ায় জড়িয়ে গেছি। ভালো না বেসে উপায় আছে? যেদিন তুমি আমার স্ত্রী হয়ে আমার ঘরে আসলে সেদিন আমি নিজেকে নিজে শপথ করেছিলাম আমার অর্ধাঙ্গিনীকে কখনো কষ্ট দিবো না। তার হক কখনো নষ্ট করবো না। তোমার হক পালণ করতে হলে তো তোমাকে ভালোবাসতেই হতো।”
আমি কোনকিছু না ভেবে সেদিন তাকে শক্ত করে আকড়ে ধরেছিলাম। তার ঠিক সাত বছর পর সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তবে আমি তার শূন্যতা কখনো অনুভব করিনি। আমার জীবনে, এই ঘরে তার এত এত স্মৃতি রয়েছে যে সেগুলোর সাথে আমি নতুন এক আমিকে খুঁজে পেয়েছি। তাই তো এখনো তাকে ছাড়া দিব্যি বেঁচে আছি। কারণ আমার মনে হয় সে আমাকে ছেড়ে কখনো যায়নি৷ সে আমার পাশেই আছে। সে তার মায়াবতীকে ছেড়ে কোথাও যেতেই পারে না।

বর্তমান,
কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধা অর্থাৎ মধুবালার চোখে পানি চলে আসে। সে চোখের পানি মুছে নেয়। মিলা তার কথাগুলো শুনে মুগ্ধ গলায় বলে,“আপনি সত্যি ভাগ্যবতী।”

“হ্যাঁ। এজন্যই তো বললাম, রূপবতী হওয়ার চেয়ে ভাগ্যবতী হওয়া জরুরি। আমাকে সবাই বলতো আমি জীবনে কখনো সুখী হবো না। আমার পোড়া কপাল। অথচ সেই আমিই আমার সারাজীবন জীবন চমৎকার এক মানুষের সাথে কাটিয়েছি। নিঃসন্তান হয়েও আমি কখনো সন্তানের অভাব অনুভব করেনি। ঐ মানুষটা আমাকে কখনো অনুভব করতেই দেয়নি। সবটাই ভাগ্য। আমি এক ভাগ্যবতী বলেই এতটা সুখ জীবনে পেয়েছি।”
মধুবালার এই কথা শুনে মিলা মাথা নাড়ে। মধুবালা দরজার পাশে দাঁড়ানো শাওনকে অনেক আগেই দেখেছে। শাওন মিলাকে খুঁজতে বের হয়ে তার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিলা যদিও এখনো শাওনকে দেখেনি। মধুবালা শাওনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,“তোমাদের ঝগড়া যখন আমি শুনতাম তখন আমি আরও গভীরভাবে অনুভব করেছি আমি কত ভাগ্যবতী। আমি জীবনে কত সুখ পেয়েছি।”

“আপনাদের কাছে হয়তো সন্তান কোন বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের জন্য একটি সন্তান অনেককিছু।”
শাওন এই কথাটি বলে ঘরের ভেতরে আসে। তার কথা শুনে মধুবাল মুচকি হাসে। অতঃপর বলে….


চলবে।