#ম্যাই_ক্যামেলিয়া
লেখনীতে:#ইশা_আহমেদ
#শেষ_পর্ব
দেখতে দেখতে আতিফের বিয়ে ঘনিয়ে আসে। আতিফ খুবই ব্যস্ত। আত্বিয়া, শাহরিয়ারও মোটামুটি ব্যস্ত। দু’দিন বাদেই বিয়ে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। রুদিতা মেয়েটা বাড়িতে যতগুলো ছেলে আছে সবার গায়ে পরছে। আত্বিয়া কিছু বলতেও পারছে না আবার সহ্যও করতে পারছে না। বিয়েতে সবাই এসেছে। আত্বিয়া ভয়ে ভয়ে বাইরে বের হয়। বাইরে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করে। ভয়ের কারণটা আগের দিনের পুলিশ অফিসার। আত্বিয়া পুলিশের চোখ দেখেই তার ভাষা বুঝতে পেরেছিলো। এরপরের বার পেলে আত্বিয়াকে নির্ঘাত খেয়ে ফেলবে। পিশাচ লোক।
আতিফের বিয়ের দিন আত্বিয়া সেজে ঘুরছিলো বাড়িতে। বরযাত্রী একটু পরেই রওনা হবে। আতিফের বিয়েতে গিয়ে হলো আরেক কাহীনি। আত্বিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেলো সেই পুলিশ ব্যাটার। আত্বিয়া তাকে দেখেই লেহেঙ্গার কোণা তুলে নিজেকে আড়াল করে অন্যদিকে চলে গেলো। বিয়ে বাড়িতে সারাটা সময় আত্বিয়া পুলিশের থেকে পালিয়ে পালিয়ে থেকেছে। পরে মাইরার থেকে জানতে পেরেছে পুলিশটা ইফার দূরসম্পর্কের ভাই হয়। এই তো এতেই আত্বিয়ার জান যায় যায় অবস্থা। বিয়ের পুরোটা সময় পালিয়ে বাঁচলেও শেষ রক্ষা হলো না আত্বিয়ার চেষ অব্দি মুখোমুখি পরে গেলো উদয়ের। উদয় রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“এই বেয়াদব অসভ্য এখানে কি করছো? নির্ঘাত বিনা দাওয়াতে খেতে এসেছো?”
আত্বিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সেও চেঁচিয়ে বলল,
-“বেশ করেছি এসেছি। সব সময় না জেনে উল্টাপাল্টা কিছু না কিছু বলেই দিবে। অসভ্য বদ লোক”
-“এই মেয়ে কি বললে তুমি?”
আত্বিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,“বয়রা নাকি? শুনেন না। জ্বালাবেন না তো। অসহ্য”
আত্বিয়ার যাওয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো উদয়। এই মেয়েটা বড্ড বেয়াদব। তার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কথা বলতে পারে না অথচ এই মেয়ে তর্ক করে যাচ্ছে রীতিমতো। আত্বিয়া উদয়ের মুখের উপর জবাব দিতে পেরে খুবই সন্তুষ্ট নিজের উপর। যাক পুলিশ ব্যাটাকে শায়েস্তা তো করতে পারলো। এই অনেক! ইফাকে নিয়ে বাড়িতে আসতে আরেক কান্ড রুদিতা নতুন বউকে শ্যামলা বলে আখ্যায়িত করেছে! এই শুনেই আত্বিয়া আতিফ সহ সবাই প্রচন্ড রেগে গিয়েছে। ইফার গায়ের বর্ণ ধবধবে সাদা নয় হলদেটে রঙ। রুদিতা ফর্সা, ধনধবে ফর্সা। কিন্তু চেহারায় মাধুর্য নেই। এ জন্যই অহংকার বেশি। আত্বিয়া শুনে রেগেমেগে কয়েক কথা শুনিয়েছে। এমনকি বাড়ির বড়রাও আজ ছাড় দেয় নি। আত্বিয়া মাইরা মিলে ইফাকে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে এসেছে। আত্বিয়া নিজের রুমে এসে দেখলো রাপিশা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।
-“ওই মাইয়া উঠ। এতো ঘুমাস ক্যান? ঘুম ছাড়া কি কোনো কাজ নেই তোর?”
রাপিশা ঘুমে টলতে টলতে বলল,
-“ভাই জ্বালাস কেনো? একটু ঘুমাতে দে। সারাটা দিন অনেক ধকল গিয়েছে”
আত্বিয়া শুনলো কোথায় রাপিশার কথা। জ্বালিয়ে মারলো রাপিশাকে। এরপর দুই বান্ধবী গলা ধরাধরি করে ঘুমিয়েছে।
–
ইফা বাড়িতে আসার পর বাড়িটা খুবই আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকে। রাপিশা তো প্রায় দিনই এ বাড়িতে আসে। আত্বিয়ার লাইফও খুব আনন্দে কাটছে। কিন্তু এই আনন্দ উল্লাসের মাঝে ভাটা পরলো সেদিন যেদিন আত্বিয়া জানলো তার জন্য পাত্র দেখা হয়েছে। পাত্র কে? পাত্র সেই পুলিশ ব্যাটা। আত্বিয়ার মাথায় যেনো বাজ পরলো। আত্বিয়া ইফাকে সরাসরি জানিয়ে দিলো সে বিয়ে করবে না। উদয়কে তার পছন্দ নয়। কে শুনে কার কথা। উদয় তার পরিবার সহ দেখতে আসে আত্বিয়াকে। আত্বিয়া না পারছিলো সইতে না পারছিলো কিছু করতে। অগত্যা তাকে শাড়ি চুড়ি পরে উদয়ের সামনে পাঠানো হলো। উদয় বোধ হয় জানতোই না আত্বিয়ার সাথে তার বিয়ে। উদয় আর আত্বিয়াকে যখন একা কথা বলতে দেওয়া হলো আত্বিয়া বলল,
-“আপনাকে আমার পছন্দ নয়। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না”
আত্বিয়ার এই একটা কথাই উদয়ের ইগোতে লেগে গেলো। উদয় এক প্রকার জোর জবরদস্তি করে বিয়ে করলো আত্বিয়াকে। আত্বিয়া বেচারি কিছু বলতেও পারলো না। মেয়েটা বুঝে উঠার আগেই বিয়ে হলো। দেখতে এসে কাবিন হলো। আত্বিয়া শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে ছিলো। শাহরিয়ার বাঁধা দিতে চাইলেও কেউ শুনলো না তার কথা। কাজী ডেকে বিয়ে পরিয়ে দেওয়া হলো। আত্বিয়া মুহূর্তেই বুঝে গেলো তার বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখকর হবে না। একদমই হবে না।
আত্বিয়াকে যখন দ্বিতীয় বারের মতো উদয়ের সাথে রাখা হলো, তখন তারা বিবাহিত। এক রুমে অবস্থান করছে। আত্বিয়া রাগে দুঃখে কলার চেপে ধরলো উদয়ের, কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“কেনো করলেন? আপনি নিজেও তো আমায় পছন্দ করেন না। তাহলে কেনো করলেন? আমার জীবনটা নষ্ট কেনো করলেন?”
-“আমাকে রিজেক্ট করেছো কোন সাহসে? ভালো করে বললেই আমি বিয়েটা করতাম না। কিন্তু তুমি চরম লেভের বেয়াদব, তোমাকে শিক্ষা দিতেই করেছি বিয়েটা”
-“উদয় আমি আপনাকে চিনিও না ঠিক মতো। মাঝে মাত্র দুদিন দেখা। আজ নিয়ে তিন দিন আর আজই আমি আপনার বউ। কেনো করলেন উদয়?”
-“কলার ছাড়ো। বউ যখন হয়েছো বেয়াদবি ছাড়তে হবে। এই উদয় ফাইয়াজ খান কখনোই নিজের বউয়ের এমন ব্যবহার মানবে না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও”
আত্বিয়া উদভ্রান্তের ন্যায় মেঝেতে বসে রইলো। কাজল লেপ্টে রয়েছে, গাল ভেজা! শাড়ির আঁচল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কি বাজে অবস্থায় রয়েছে আত্বিয়া। শাহরিয়ার রুমের ভেতরে ঢোকার সাহস পেলো না। দরজা থেকেই ফিরে গেলো। উদয় তখন বিছানায় বসে আছে। আত্বিয়ার হঠাৎই কি যেনো হলো। ঝাপিয়ে পরলো উদয়ের উপর। কিল, থাবা দিতে লাগলো। অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমনে উদয় হকচকিয়ে গিয়েছে। আত্বিয়াকে শান্ত করতে কোমর জড়িয়ে নিজের একদম কাছে টেনে নেয়।
-“আত্বিয়া লুক আমি কিন্তু এগুলো একদমই সহ্য করবো না।”
-“বিয়ে কেনো করলেন উদয়? বলুন না শুধু মাত্র ইগোতে লাগায় বিয়ে করেছেন? আমার জীবনটা শেষ করেছেন আপনি”
আত্বিয়া উদয়ের বুকে ঢলে পরলো। উদয় চমকালো কিছুটা। আত্বিয়াকে বুক থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। উদয় নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না সে আত্বিয়াকে কেনো বিয়ে করলো! শুধুই ইগো আর জেদের কারণে? নাকি অন্য কিছু? আত্বিয়ার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলো না উদয়।
পরদিনই উদয় চলে গেলো নিজ বাড়িতে। আত্বিয়া নিজেকে ঘর বন্দি বানিয়ে ফেলেছে। ঘর থেকেও বের হয় না কখনো। একদিন বিকালে হুট করে উদয় এসে হাজির। আত্বিয়ার মা তাকে জোর করে শাড়ি পরিয়ে উদয়ের সাথে পাঠালো। আত্বিয়া র্নিলিপ্ত চোখে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। উদয় আড়চোখে বেশ কয়েকবার দেখলো মেয়েটাকে। আত্বিয়ার গায়ে জড়ানো বেগুনি রঙের শাড়ি। খোলা চুলগুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। উদয়ের ভালোই লাগলো। আত্বিয়াকে নিয়ে উদয় এসেছে অরিত্রার কাছে।
আহানা উদয়কে দেখেই মামু বলে দৌড়ে কোলে উঠলো। আত্বিয়া স্বাভাবিক ভাবেই তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে। উদয় আত্বিয়াকে অরিত্রা আর আাহানার পরিচয় দিলো। অরিত্রা উদয়ের ক্লাসমেট। অরিত্রাদের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে উদয় আত্বিয়াকে নিয়ে নদীর পাশে গাড়ি দাঁড় করায়। আত্বিয়া নিজেই নেমে দাঁড়ায়। উদয় আত্বিয়ার কাছে এসে বলে,
-“অরিত্রা শুধু আমার ক্লাসমেট নয়! ওকে আমি পছন্দ করতাম, অবশ্য ওকে তা জানানোর আগেই ওর বিয়ে হয়। আমিও ধীরে ধীরে মুভ অন করে ফেলি। কিছু বছর আগেই ওর সাথে দেখা হয় আবার, ডিভোর্স হয়েছে মেয়েটার। আমি মাঝো মাঝে আহানাকে দেখতে যাই। আমাদের মাঝে তেমন কথাও হয় না আত্বিয়া”
আত্বিয়া চোখ তুলে চাইলো। আবার নামিয়ে নিয়ে বলল,“আমি জানতে চাইনি”
-“আত্বিয়া তাকাও আমার দিকে। আ’ম সরি। আমি রাগ ইগো দেখিয়ে তোমায় জোর করে হুট করে বিয়ে করে ফেলেছি। সরি জান।”
-“সব কিছু এতোটা সহজ উদয়?”
-“আমি জানি সহজ নয়। কিন্তু আমরা চাইলেই পারি। আমি তোমায় ভালোবাসতে চাই আত্বিয়া। আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায়?”
আত্বিয়া উত্তর দেয়নি। সেদিনের পর উদয় প্রায়শই আত্বিয়াকে নিয়ে বের হয়। আত্বিয়ার প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও ধীরে ধীরে ভালো লাগার সৃষ্টি হয়। বিয়ের আট মাস পেরিয়ে গেলেও আত্বিয়ার সংসার করা হয়নি। সে একা একাই প্রেম করছে, তাও কি না নিজের স্বামীর সাথে মনে মনে! উদয় আত্বিয়াকে নিয়ে বাইরে বের হলেও আত্বিয়া মলিন মুখে থাকতো, উদয়ের আড়ালে হাসতো। উদয় বেচারার বউয়ের মন জয় করতে করতে দিন যায়। আত্বিয়া আর উদয়ের বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার আগে উদয় আত্বিয়াকে নিয়ে সন্ধ্যেই বের হয়।
-“ক্যামেলিয়া, ম্যাই ক্যামেলিয়া!”
আত্বিয়া অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,“কিহ!”
-“তুমি আমার ক্যামেলিয়া”
-“কেনো? অন্য ফুল নই কেনো?”
-“কারণ আমার ক্যামেলিয়া ফুল বেশি পছন্দ”
আত্বিয়া লাজুক হাসলো। উদয় আত্বিয়াকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। আত্বিয়া ফিসফিস করে বললো,
-“আপনার ক্যামেলিয়া আপনায় খুব ভালোবাসে উদয়”
#সমাপ্ত