অশ্রুবন্দি পর্ব-২১+২২+২৩

0
25

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২১

সাত বছর আগে সৃজা যখন ইহসানকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল, ওর সেই অশ্রুবিন্দু দেখেই সে প্রেমানুভূতিতে ডুবেছিল। তবে আজকাল মনে হয় সেটা ভুল— বরং সৃজাকে প্রথম কাঁদতে দেখেছিল ওর মায়ের মৃত্যুর দিন, সে সেদিনই প্রেমে পড়েছিল এই কোমল, সরল মেয়েটির। কিন্তু বয়সের অপরিপক্বতা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির অবনতি আর দ্বিধান্বিত অনুভূতিদের জোয়ারে সে হয়তো ব্যাপারটা টের পায়নি! তবে যেটাই হোক না কেন, ঐ অপরিপক্ব বয়সে ওর কান্না ঐ ইহসানের হৃদয় ছিনিয়ে নেওয়ার কারণ। তাই ঐ দোষেই ওকে ইহসানের হৃদয়ে আমৃত্যু বন্দি হয়ে থাকতে হবে!

ইহসান অনেক ভেবেচিন্তে নিজের মনোস্থির করে ফেলল এভাবেই। নিজেকে আলাদা হতে হবে, সৃজার মনে এমনভাবে দখলে নিতে হবে যেন পৃথিবীর কোনো শক্তিই ওকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। এরজন্য মেয়েটাকে পুরোপুরি স্বাধীনতা না দিক, নূন্যতম ছাড় দিতেই হবে। সে বেশ ভালোভাবেই জানে, পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা যায়, কিন্তু তাকে পোষ মানানো যায় না। ফাঁক পেলেই সে উড়ে যায়। অথচ পাখিটাকে স্বাধীনতা দিয়ে, আদর দিয়ে, দানা-পানি খাইয়ে বেড়ে উঠতে দিলে পাখিটা খুব সহজেই পোষ মেনে যায়, ছেড়ে গেলেও ফিরে আসে, বারবার! আর অর্ধাঙ্গিনী যখন নিজ মুখে একবার স্বীকার করেছে, শিশির বিন্দুর ন্যায় টপটপ করে পড়ছে তার প্রেমে, পুরোপুরি ফেলতে তাই ছাড় দেওয়াই যায়। একচুল ভুলও সে করতে চায় না ইজহানের মতো, বাপ নামক কলঙ্কিত পুরুষটির মতো! ইহসান ঢকঢক করে আরো এক গ্লাস বরফ ঠাণ্ডা পানি গিলে। অর্থব মস্তিষ্কটাকে সান্ত্বনা দিতেই যেন বসে রয় চোখ বুজে। অন্যদের কাছে সৃজা কী জানে না সে— কিন্তু তার কাছে এই মেয়েটা তার একমাত্র গোপন চাওয়া, তার হাহাকার বুকের একবুক প্রশান্তি, তার দুঃখ চাপা মনের বেঁচে থাকার কারণ— তার হৃদয়ের প্রস্ফুটিত ফুল!

ইহসান ফোন করল সৃজাকে। অনুমতি দিয়ে দিলো। শুনে সৃজা প্রচণ্ড খুশি হলো। আদর আদর কথা বলল, ফোনেই চুমু বিনিময় হলো দু’জনের। ইহসান ওকে খুশি দেখে একফাঁকে তিরিক্ষি কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

“কিন্তু তুই চলে গেলে আমার কী হবে? তোকে ছাড়া আমি রাত কাটাব কীভাবে? ঘুম তো আসবে না…”

সৃজা শুনে চটপটে গলায় বলল,

“তোমাকে রেখে আমি যেতে চাইনি। এলিজা, ফুপি তো সেই কবে থেকে বলে আসছে, তুমিই তো মানা করো। তাই তো বলেছি সঙ্গে চলো। দুটো দিন থেকে আসো…”

ইহসান তীব্র গলায় চেঁচালো,

“ঐ, দুটো দিন আবার কী? আমার তো প্রতিরাতে তোকে চাই। তোদের বাড়িতে যেতে চাই না কারণ আমার অনেক কাজ, তারচেয়ে বড় কথা, নিজের ঘর ছাড়া আমার কোথাও ঘুম আসে না। সত্যি বলতে তোর চেয়েও বড্ড আপন আমার ঘরটা।”

ইহসান রুক্ষ কণ্ঠে বলল কথাগুলো। সৃজা চটে গেল।
উফ! এই মানুষটা কী শুরু করল এক বাড়ি যাওয়া নিয়ে, এইতো অনুমতি দিলো খুশিমনে। প্রেম প্রেম কথা বলল, তুই আমার সব বলল! এখন পল্টি নিয়ে বলছে সৃজার থেকে নিজের শোবার ঘরটাই তার বেশি আপন? এতই যখন আপন তাহলে থাকুক ঘর নিয়ে, ওর না থাকায় এত হাপ্যিতেশ করছে কেন? দু নম্বরি লোক! সৃজা অভিমান ভরা গলায় ঝাঁঝালো স্বরে শুধাল,

“আচ্ছা তাই, আমি তোমার কেউ না? ঘর আপন? ভালো তো, নিজের ঘর নিয়েই থাকো। আমি বাপের বাড়ি চলে যাব, রাতে কীভাবে ঘুমাবে সে তোমার ব্যাপার!”

ইহসান ঠোঁট কামড়ে বলল,

“আরে বউ রাগ করছিস সরি রাগ করছো কেন? কলিজা শুকিয়ে যায় তো…আমি তো কথার কথা উপমা দিলাম। জান, তুই সরি তুমি তো পুরোটাই আমার…”

“অত্যন্ত বিচ্ছিরি আর বোকা বোকা শোনাচ্ছে কথাগুলো ইহসান ভাই।”

মুখ ফসকে ‘ভাই’ ডেকে ফেলায় জিভ কাটলো সৃজা। তখনি ওপাশ থেকে টেবিলে চাপড় দেওয়ার শব্দ ভেসে আসলো, সঙ্গে তীক্ষ্ণ আর লাগামহীন কথার বাণী,

“কান লাল করে ফেলব বেয়াদ্দব, স্বামীকে ভাই ডাকিস? বুকের নিচে পড়ে রাতে যখন আঁচড়ে-কামড়ে একাকার করিস, সামলায় কে? যখন জান, কুত্তা বলিস তখন মনে থাকে না আমি তোর ভাই নাকি ভা…”

সৃজা ঠোঁটকাঁটা লোকটার কথা শুনে তীব্রভাবে চেঁচালো,

“হে আল্লাহ, রহম করো! এই অভদ্র লোককে কেন আমার কপালে জুড়ে দিয়েছ! ছিঃ ছিঃ কথাবার্তার কি ছিরি, নষ্ট লোক…”

ইহসান আক্রোশ নিয়ে বলল,

“যতবার ভাই ডাকবি…”

কথাটুকু সম্পূর্ণ করার আগেই সৃজা অসন্তোষ নিয়ে বলে উঠল,

“তোমার বাচ্চাকে মামু ডাকতে শিখাব।”

ইহসান সশব্দ প্রতিবাদ জানাল,

“তোর মতো চুনোপুঁটি নিবি প্রতিশোধ? তাহলেই হয়েছে! তোকে আর বাচ্চাকে মুখ বন্ধ করে, মমি বানিয়ে বসিয়ে রাখব।”

“নিষ্ঠুর একটা!”

“আসছে ভালোর মহারাণী…”

সৃজা মন খারাপ করে ফেলল,

“ভালো না হলে বিয়ে করেছ কেন জোর করে? যাও আমি খারাপ, মেনে নিলাম।”

“আসলেই তুই চূড়ান্ত খারাপ। কিন্তু আমি ভালো লোক, তাই মাফ করে দিলাম বেয়াদবির জন্য!”

সৃজা তেঁতে উঠল,

“ঝগড়া শুরু করেছ তুমি আবার মাফও করবে তুমি? আচ্ছা ভণ্ড আর পাগল!”

ইহসান বিরোধিতা করল না এবার৷ বরং বলল,

“তোর পাল্লায় পড়ে ভণ্ড হতে বাধ্য হয়েছি। তুই
পাগল করেছিস আমায়। তুই ছাড়া আমার জীবনটা ‘ব্যাটারি ছাড়া মোবাইল’-এর মতো হয়ে যাচ্ছে, অথচ
তুই আমার চার্জ না হয়ে আমায় গিলে খাচ্ছিস প্রতিনিয়ত। বউ হোস তাই কিছু বলি না…”

তর্কে না পেরে সৃজা ধৈর্য হারালো,

“ওহে পাগল আর ভণ্ড লোক! তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না। আমি ভালো মানুষের স্ত্রী হতে চাই,
কোনো পাগলের না।”

“কী চাস না চাস দেখার বিষয় না, দিনশেষে তুই আমার, আমার জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি স্বাদের এসপ্রেসো..”

কঠোর ভাবে বলে ফোন কেটে দিলো ইহসান। এরপর বড়বড় শ্বাস ফেলে আবারো গা এলিয়ে দিলো। বিড়বিড় করে বলল, তোর প্রতিটি কোষসহ তুই পুরোটাই, আপাদমস্তক ইহসানের। চাইলেও, না চাইলেও। ইহসান চোখ বুজে ভাবনার পাতায় এঁকে ফেলল সৃজার রাগান্বিত, অভিমানী মুখটা। টুংটাং
করে ফোন বাজলো, ইহসান হাতে নিয়ে দেখল
সৃজা লিখেছে,

‘তুমি আমার ক্যাচআপ ছাড়া ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’

— এসপ্রেসো

শব্দ করে হেসে ফেলল ইহসান। বিমোহিত হলো সে। মন শান্ত হলো কিছুটা। অবশেষে অধিকারসূচক কিছু একটা ভেবেছে তাকে। ইহসানের নিরানন্দ মনে পুলক খেলে গেল। এই এক নারী, যাকে মনে জায়গা দিয়েছে সে, বহু বছর আগে। বিয়ে নামক বন্ধনে জড়ানোর পরও নিজের শরীরী তৃষ্ণা সযতনে চেপে গিয়ে ওকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়ে গেছে। কারণ ভালোবাসা এক চিরন্তন বন্দিত্ব, যেখানে দুটো হৃদয় নিঃশব্দে একে অপরকে অধিকার করে নেয়। এটি এমন দামী এক আবেগ, যা স্বৈরাচারী মনোভাব দিয়ে কখনোই দখল করা যায় না। বরং যে ভালোবাসায় মুক্তির অনুভূতি থাকে, সেটাই নিজ গুণে চিরকাল বন্দি হয়ে থেকে যায়। আর সেজন্যই স্বামীর অধিকার আদায়ের জন্য জোরাজোরি না করে সে প্রেমিকরুপে ধরা দিয়েছে সৃজার কাছে, গোপন করেছে নিজের সরুপ। যেন সৃজা নিজেই বাধ্য হয় ওর কাছে হার মানতে! অবশেষে হয়েছেও তাই। ইহসান প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বাঁকা হাসল।

.

বাইরে বেরুনোর সময় ইহসান সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সৃজার কপালে, গালে চুমু দেয়। গদগদ প্রেম বিনিময় করার পর সৃজা ওকে হাসিমুখে বিদায় দেয়। যেটা ইজহানের চোখে পড়েছে। আর পড়ার পর থেকেই সে অস্থির, রাগান্বিত! ইতোমধ্যে মনে মনে হাজারটা গালি দিয়ে ফেলেছে ইহসানকে। ভেড়াটা কীভাবে এসব নাটকীয় সিন করে বেড়ায়? ওকে দেখানোর জন্যই বোধহয়! ক’দিন আগেও দেখেছে রিকশায় করে দু’জনে নদীরপাড়ের দিকে যাচ্ছে, হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে। আবার একটা বাইকও কিনেছে! বউকে পেছনে বসিয়ে ভার্সিটি নিয়ে যায়, হুহ!
যত্তসব কাপুরুষালি কর্মকাণ্ড! মনকে বোঝালেও ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরছে ইজহান, কারণ ইস্মি কখনোই ওকে হেসে বিদায় দেয় না আর সেও কখনোই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওকে আদর করে না, চুমু দেয় না। ভেড়াটা বোধহয় রোমান্টিক মুভি দেখে এসব শিখেছে, এটা ইজহানের বদ্ধমূল ধারণা। তবে মনে মনে একটুখানি হলেও
লোভ জন্মে তার, অকারণেই। ইচ্ছে করে ইস্মির ঠোঁটে হাসি দেখতে। ইস্মি যে হাসে না তা নয়, কিন্তু সেদিন সৃজার ঐটুকু কথা শোনার পর খেয়াল করে দেখেছে সে, ইস্মি জোর করে হাসে। তার মন রক্ষার্থে! এরপর থেকেই সে ভাবছে, ইস্মিকে কীভাবে একটু খুশি করা যায়! আজ এ নিয়ে পুরোটা দিন ভেবেছে সে। মনমতো কিছু না পেয়ে সে গুগল সার্চ করে দেখল মেয়েরা রেস্টুরেন্টে খেতে, শপিং করতে, আড্ডা দিতে, ঘুরাফেরা করতে, স্বাধীনভাবে থাকতে ভালোবাসে। যেহেতু স্বাধীনতা দেওয়া সম্ভব নয় ইজহানের পক্ষে, তাই সে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়াটাকেই সিলেক্ট করল। ইস্মিকে কথাটা বলতে সে বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছিল, কারণ ইতোপূর্বে কখনোই ইস্মিকে নিয়ে সময় কাটাতে কোত্থাও সে বেরুয়নি। বাড়িতে একপ্রকার কয়েদির মতোই রেখেছে সে। ইস্মি ঘর গোছাতে থাকাবস্থায় যখন কথাটা শুনল, চোখ
বড়বড় হয়ে গেল ওর। ইজহান অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“বোরকা পরে তৈরি হও।”

ইস্মি হাতের কাজ ফেলে ছুটে এসে ওর কপাল, বুকে হাত দিয়ে চেক করতে করতে বলল,

“আপনার শরীর ভালো তো?”

ইজহান নিজের অপ্রস্তুত ভাব লুকাতে ওর কোমড় জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজে বলল,

“রেডি হও!”

“সত্যি?”

“হুম।”

“বিয়ের এই পাঁচ বছরে?”

“বেশি বাহানা করলে বা কথা বললে আবার দশম বছরে যাওয়া হবে।”

ইস্মি নিজের বিস্ময় ভাব লুকাতে পারছিল না। কিন্তু ইজহানের মুড কখন বদলে যায় তারজন্য ওর কথার পিঠে আর বেশি কথা বাড়াল না। ইজহান ওকে চুজ করে দিলো সবকিছু। কোন বোরকা পরবে, কোন হিজাব, ব্যাগ নেবে, কোন জুতোটা পরবে সবকিছু! ইস্মি সেই মতো সব পরে তৈরি হলো। ইজহান ততক্ষণ বসে বসে ওর রেডি হওয়া দেখছিল, ওর ঠোঁটে হাসি ফুটছে কি-না তার দিকেই নজর ছিল!

ইস্মি তৈরি হওয়া শেষ করে দেখল ইজহান আয়নায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে, নিজে রেডি হয়নি। ও অপ্রস্তুত হয়ে ছোট করে জিজ্ঞেস করল,

“আপনি তৈরি হবেন না?”

“কী পরব, বের করো…”

ইস্মি ওকে পাঞ্জাবি-পাজামা বের করে দিলো।
ইজহান বিনাবাক্যে তৈরি হলো। ইস্মি আড়চোখে দেখল ওকে, পাঞ্জাবি গায়ে এত সুন্দর লাগছে মানুষটাকে! ইস্মি হাজারবার মাশাল্লাহ বলল যাতে নজর না লাগে কারোর। এই সুদর্শন পুরুষটার এই নিষ্পাপ, সুন্দর মুখখানি দেখে কে বলবে লোকটা ডমিনেটিং? অহেতুক কারণে ঝামেলা বাঁধায়, সন্দেহ করে, চড় দেয়? ভাইয়ের সাথে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝামেলা করে, মেরে, হেরে ভূত হয়ে আসে? ইস্মি দোয়া করল, যাতে মানুষটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাদের একটা সুন্দর সুখী সংসার হোক। যে সংসারের মূল ভিত্তি হবে ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাস। ইস্মির ঘোর কাটলো ইজহানের কাঁটা কাঁটা কথায়,

“বাইরে নিয়ে যাচ্ছি, ওখানে দুর্গন্ধময় মশা-মাছি চারপাশে সবসময় ঘুরাফেরা করে। ওসবে একদম তাকাবে না, প্রয়োজন নেই। শুধু আমাকে দেখবে, তাকাবে।ম তাই বে্‌শি খুশি হওয়ার দরকার নেই৷ আমাকে পাঞ্জাবিতে কেমন লাগছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে, চুলটা ওকে? দেখে
ঠিক করে বল… ”

ইস্মি বেশ বুঝল ওকে আগে থেকে ওয়ার্নিং দেওয়া হচ্ছে, যাতে পরপুরুষের দিকে না তাকায়। ওর হাসি পেল, অনেক কষ্টে লুকিয়ে বলল,

“সব ঠিকঠাক, মাশাল্লাহ!”

.

ইজহান মিজুকে গাড়ি বের করতে বলেছিল গ্যারেজ থেকে। কিন্তু গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করে উঠোনে আনার পর সে ভীষণ রেগে গেল। তার মুক্তোর মতো সুন্দর প্রাডোটা গায়ের এখানে-সেখানে লেগে আছে কাদা। কাচের জানালায় ধুলোবালি। হেড লাইটের উপর যেন কেউ ঝাঁমাঘষে দিয়েছে। আবার একটা টায়ারও পাংচার। বাড়ির অন্য গাড়িগুলোও নেই, আজিজ শেখ কোথাও গেছেন। ইজহান মিজুকে ঝড়েবকে জর্জরিত করে ফেলল! ইস্মি তাকে থামানোর জন্য বাহু চেপে ধরে বলল,

“আল্লাহ একটু থামুন আপনি। এত উত্তেজিত হবেন না, এরপর অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ঘরে চলুন, কোথাও যেতে হবে না।”

ইজহান ওর কথা শুনে মিজুর উপর আরো ক্ষ্যাপল,

“তোর জন্য এখন বউকে গাড়িতে নিয়ে বেরুতে পারব না। শালা তুই ইচ্ছে করে এমন করেছিস তাই না? যাতে আমি বউ নিয়ে বেরুতে না পারি! যা তোর চাকরি নট, হ্যাঁ যাওয়ার আগে অবশ্যই গাড়ি পরিষ্কার করে যাবি।”

মিজুর কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল এতক্ষণ, তবু সে বাধ্যগত লোকের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। মাথা নেড়ে যথা আজ্ঞাপন জানাল। ইজহান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইস্মির হাত ধরে টেনে গেইটের দিকে যেতে যেতে বলল,

“যাব যখন বলেছি তো যাব। দরকার হলে রিকশা
করে যাব, তবুও যাবই…”

ইস্মির মনে হলো সে ভুলভাল কিছু শুনেছে, বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কিছু বললেন?”

ইজহান ভোঁতা মুখে বলল,

“রিকশা করে যাব।”

ইস্মি বিষম খেল, ভান করে বলল,

“ওসবে তো গরিবরা চড়ে, যাদের টাকা নেই তারা…”

ইজহান ভস্মীভূত নজরে তাকাল মিজুর দিকে। সে বেচারা চাহনি দেখেই পগারপার। ইস্মি বেশিকিছু আর বলল না। দারোয়ান একটা রিকশা খুঁজে এনে দিলো। ইজহান নিজের লম্বা-চওড়া শরীরটা নিয়ে বসতে
গিয়ে মেজাজ খারাপ করে ফেলল, জীবনে রিকশায় চড়েনি সে। আর আজ ঐ মিজুর জন্য বেশ ভুগল। ইস্মির এত হাসি পেল যে দম বন্ধ করে বসে রইল গুটিশুটি মেরে। রিকশা চলতে শুরু করলে টাল সামলাতে না পেরে ইজহান সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। শিক ধরে ভীতু ও রাগান্বিত গলায় চেঁচিয়ে রিকশা থামাতে বলল চালককে। ইস্মি আঁৎকে উঠে দ্রুত হাত বাড়িয়ে ওকে সামলালো, এক হাত আড়াআড়ি করে ব্যারিকেডের মতোন করে বলল,

“ভয় নেই, আমি আছি!”

এরপর রিকশাওয়ালাকে বলল,

“আসলে চাচা, আমার স্বামী প্রথম রিকশায় উঠেছে তো তাই একটু সমস্যা হচ্ছে! আপনি সামনে বাড়ান, আস্তেধীরে নিয়ে চলুন আমাদের।”

নিকাবের উপর দিয়ে খেলে যাওয়া ঠোঁট আর চোখের কুঁচকানো চামড়া দেখে ইজহান আন্দাজ ফেলল তার বউটা মিষ্টি করে হেসেছে। সে মুগ্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে ইস্মির দিকে তাকিয়ে রইল। রিকশায় করে কোথাও গেলে যদি বউয়ের সত্যিকারের হাসি দেখা যায়, তাহলে সে অবশ্যই গাড়ি থেকে রিকশাতে যাওয়াটাকেই প্রেফার করবে। সে কোমড় জড়িয়ে
ধরে বসল ইস্মির,

“নিকাব সরাও, চুমু খাব।”

ইস্মি ফট করে তাকাল ওর দিকে,

“এটা রাস্তা…”

“আর তুই আমার বউ, সরা…”

জোরালো গলায় বলে নিজেই নিকাব তুলে ফটাফট চুমু খেয়ে বসল ইস্মির গালে। না করার সুযোগ পেল না মেয়েটা। রিকশাওয়ালা এহেম এহেম করে কেশে চেঁচিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,

“আপনে হুজুর হইয়া রাস্তাঘাডে এমুইন করেন
বউয়ের লগে, আস্তাগফিরুল্লাহ!”

লজ্জায় মাথা কাটা গেল ইস্মির, মুখ নামিয়ে বসে রইল। ইজহান বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,

“ঐ মিয়া, রিকশা টানো, এত কথা বলো কেন?”

“মানে হুজুর আপনে যা করলেন…!”

ইজহান এবারে রেগে গেল,

“হুজুর মানে? কে হুজুর? এই তুমি কী এলাকায় নতুন? আমায় চিনো, না চিনলে কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও ইজহান শেখ কে!”

____________

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২২

শহরের বিখ্যাত বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টই অরবিট টাওয়ারে অবস্থিত। যেখানে ইহসানের নিজস্ব রেস্তোরাঁ! ইজহান কিছুটা নাকউঁচু স্বভাবের লোক, বউকে নিয়ে মাঝারি, সস্তা কোনো রেস্টুরেন্টে কোনোকালেই যাবে না। তাই অরবিট টাওয়ারে অবস্থিত অথেন্টিক ফিউশন রেস্টুরেন্টে ইস্মিকে
নিয়ে যাবে বলে মনোস্থির করল। থাকুক ওখানে ইহসান শেখ! তার কী? সে কী ভয় পাবে নাকি? অরবিট টাওয়ারটা তো তার নিজস্ব সম্পত্তি না। তবে ইজহান অবশ্য ভেবে রেখেছে, কোনোভাবে সামনে পড়া যাবে না ভেড়াটার! কারণ ইতোপূর্বে বউ নিয়ে সে কোথাও বেরুয়নি, আজ বেরিয়েছে!
দেখলে হয়তো ওকে খোঁচা মেরে কথা বলবে, যেমনটা ও করে। তাই সামনে না পড়াটাই শ্রেয়! অরবিট টাওয়ারের সামনে রিকশা পৌঁছানোর পর রিকশাওয়ালাকে ভাড়া হিসেবে ধরিয়ে দিলো সে একটা হাজার টাকার নোট। রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল,

“আমার কাছে ভাঙতি নাই, ভাঙতি দেন।”

ইজহান ভ্রু কুঁচকে ফেলল,

“মানে? ভাঙতি দেব কেন? এটা তোমার ভাড়া।”

রিকশাওয়ালা, ইস্মি দু’জনেই চোখ কপালে তুলে তাকাল। বয়েসী রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে বলল,

“ভাড়া এইডা?”

“হুম, এতে অবাক হবার কী আছে?”

“হায়রে আল্লাহ! আপনে এইগুলা কি কইতাছুইন! ভাড়া হাজার ট্যাহা না, আশি ট্যাহা।”

ইজহান একটা ধাক্কা খেল যেন,

“আশি টাকা? আমাকে বোকা ভাবো মিয়া?”

গদগদ ও অবাক হয়ে বলল রিকশাওয়ালা,

“আরে হুজুর থুক্কু ভাইসাব আপনে জীবনে রিকশায় উডেন নাই মানলাম, তাই বইলা ভাড়ার আন্দাজও নাই? ও আম্মা আপনে কন দেহি!”

ইস্মি অপ্রস্তুত হয়ে যখন ইজহানকে বলল ভাড়া হাজার না, আশি টাকা৷ সে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। অতটুকু রিকশায়, বয়স্ক রিকশাওয়ালা এতদূর পথ ওদের নিয়ে পাড়ি দিলো অথচ ভাড়া মাত্র আশি টাকা? এত কম? কীভাবে সম্ভব? ব্যাপারটা তার বোধগম্য হলো না। সে অবশ্য টাকা ফিরিয়ে নিলো
না, পুরোটাই দিয়ে দিলো রিকশাওয়ালাকে। সে ইজহান শেখ, দরাদরি শেখেনি। আর বউ নিয়ে বেরিয়েছে, তার সামনে ওসব বার্গেনিং করা কাপুরুষের কাজ! হুহ!

অরবিট টাওয়ারের ছয়তলায় উঠার জন্য এলিভেটরে দুটো ভার্সিটি ছাত্র উঠল বলে ইজহান ইস্মিকে নিয়ে সেটাতে উঠল না, বরং বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। পরবর্তীতে যখন ওটা আবার খালি হয়ে এলো, তখন উঠল। ইস্মি রা করল না কোনো। তবে তিন তলা থেকে মাঝবয়েসী তিনজন লোক যখন উঠল, ইজহানের চোখ দিয়ে রক্ত ঝরল যেন, ইস্মিকে যথাসম্ভব আড়াল হয়ে দাঁড়াল, যাতে লোকগুলো ইস্মির আশেপাশেও দাঁড়াতে না পারে। ইজহান বিড়বিড় করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল। ইস্মি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে গেল লোকটার অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড! কিছুক্ষেত্রে হাসি পেল, তবে সেটা রইল অপ্রকাশিত!

রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আরো একবার মেজাজ খারাপ হলো ইজহানের, অনেক মানুষ দেখে! ইচ্ছে করল সব ক’টাকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে, কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে একপ্রকার বিপাকে পড়ে গেল সে। এতগুলো মানুষের মধ্যে বসে ইস্মিকে নিয়ে কোনোক্রমেই বসবে না, কোনোভাবেই না। কী করা যায় ভাবার আগেই একজন স্টাফ এগিয়ে এসে সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে প্রাইভেট জোন আছে কি-না জানতে চাইল। স্টাফ ছেলেটা বা-দিকের প্রাইভেট জোনে ওদের নিয়ে গেল। কাচ দিয়ে ঘেরা, বিভিন্ন অর্কিড দিয়ে সাজানো জোনটি হলদে আলোয় চকমক করছে। একপাশে একটা লোক তার বউ, বাচ্চা নিয়ে বসে গল্প করতে করতে খাচ্ছে। বাচ্চাটা অবশ্য খাচ্ছে কম, ছড়াচ্ছে বেশি। কিন্তু সেদিকে তার বাবা-মায়ের খেয়াল নেই। দু’জনে হাত ধরাধরি করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে প্রেমালাপে মগ্ন! বাইরের জন পঞ্চাশেক লোকের চেয়ে এখানে বসে খাওয়াটাই ভালো। ইজহান ভেবেচিন্তে ইস্মিকে নিয়ে এখানেই বসল। তার মুখে বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। অন্ধকার নামিয়ে রাখা মুখটা দেখে ইস্মি সাবধানী হাতে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ওর কপাল, মুখ মুছে দিলো৷ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,

“জায়গাটা খুব সুন্দর, তাই না?”

ইজহান প্রায় চিড়বিড় করে বলল,

“আর আমি কুৎসিত?”

“আমি তো পরিবেশটার কথা বলছিলাম…”

রুক্ষমূর্তি ধারণ করে ফেলল নিমিষেই,

“কেন? আমাকে চোখে লাগে না? চকমকে আলো দেখেই সব সুন্দর হয়ে গেল, আমার চেয়েও? মেয়ে জাতটাই তোরা এমন, নিজের বর ছাড়া পৃথিবীর সব সুন্দর!”

ইস্মি মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। ইজহান দুইগ্লাস পানি সাবাড় করে বুক জ্বালা অনুভূতি কমালো। ইস্মিকে বিপরীত দিকে সিট থেকে উঠিয়ে নিজের সাথে বসালো। এরপর বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করে মেন্যু কার্ডটা নেড়েচেড়ে দেখে ওয়েটার ডাকল—

“মিডিয়াম-রেয়ার গ্রিলড চিকেন স্টেক,
সঙ্গে মাশ পটাটো আর ব্রাউন সস। গ্রেভিটা যেন ঠিকঠাক থাকে। আর হ্যাঁ, গার্লিক বাটার দিয়ে সটেড ব্রকলি আর ক্যারট থাকলে ভালো হয়।”

ওয়েটার লিখে নিল। ইজহান আরো যোগ করল,

“আর দুটো ক্যাপুচিনো। হালকা ফ্রথ রাখবে।”

অর্ডার করা শেষে ইজহান ইস্মির দিকে তাকাল। দেখল মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ওর দিকে মনোযোগ নেই৷ ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে ইস্মির দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল তার বৌ ওপাশের কাপলদের সঙ্গে আসা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে, বাচ্চাটাও ওকে দেখে আঙ্গুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাসছে। ইজহানের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। ইস্মিকে ধমক দিয়ে বলল,

“ওদিকে কী?”

ইস্মি মৃদু কণ্ঠে বলল,

“বাচ্চাটা দেখুন কী সুন্দর করে হাসছে!”

ইজহান দেখল তো না-ই উল্টো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“বাইরে বেরুলেই আসল রুপ বেরিয়ে আসে তোর…”

ইস্মি আঁধার মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল। একটি কথাও বাড়াল না। কি বলবে সে? এই জঘন্য মানসিকতার লোকটা বাচ্চাটাকেও রুক্ষ চোখে, শত্রুর চোখে দেখছে! ওর বুকের ভেতরটা অদ্ভুত শূন্যতায় হাহাকার করে উঠে, নিত্যদিন লুকিয়ে রাখা চাপা যন্ত্রণাটা চোখ ছাপিয়ে জলধারা হয়ে হঠাৎ নামতে চাইল। দু’হাতের পিঠে চোখ মুছল কয়েকবার। কোণা চোখে তা দেখে ইজহান ফুঁসে উঠল। গলা চড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েও পাঞ্জাবিতে টান পড়ায় থেমে গেল। তাকিয়ে দেখল সেই বাচ্চাটা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে ওর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ইজহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে
বিরক্তি প্রকাশ করে,

“কী চাই?”

“আম্মামা আম্মাম…”

বলতে বলতে বাচ্চাটা ইস্মির দিকে হাত বাড়াল। কোলে উঠার পায়তারা আরকি! ইস্মি নরম চোখে তাকাল বাচ্চাটির কাণ্ড দেখে। এদিকে ইজহান
আকাশ থেকে পড়ল,

“ঐ তোর আম্মা কে? আমার বউ তোর আম্মা হতে যাবে কেন? যা ভাগ…”

বাচ্চাটা গেল তো না-ই উল্টো ইজহানের কোমড় জড়িয়ে ওর উপরে উঠার চেষ্টা করতে লাগল। ইস্মি এবার নড়েচড়ে বসল। দেখবে সে, এই পাথর লোকটা কী করে! ইজহান চেঁচিয়ে উঠতে চাইল, কিন্তু বাচ্চাটি ততক্ষণে ওর গলা অবধি উঠে ওর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে খামচি বসাচ্ছে। ইজহানের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, আছাড় মারবে এমন একটা ভাব। ইস্মি আঁৎকে উঠে বাচ্চাটিকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে ওকে বলল,

“ছোট্ট বাচ্চা ও, আমি সরিয়ে দিচ্ছি!”

বলল ঠিকই, কিন্তু বাচ্চাটিকে কোনোভাবেই কোল থেকে সরাতে পারল না। বাচ্চাটা ইস্মির বুকে ঘাপটি মেরে ওর বোরকা আঁকড়ে ধরে রইল। চোখেমুখে ভীতু আর কান্নার ভান, যেন ইস্মিই ওর মা— আর মাকে ছেড়ে সে যাবে না। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ইস্মি, তবে আগলে রাখে যত্ন করে। ইজহান তখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে! চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবে ভাব, ইস্মি অসহায় নয়নে তাকাল ওর দিকে। ওর হাত টেনে অনুরোধের স্বরে বলল,

“আল্লাহর দোহাই, আপনি সিনক্রিয়েট করবেন না। ও বাচ্চা, একটু আদর করে বুঝিয়ে বললেই চলে যাবে। একটু বুঝেন।”

ইজহান সিনক্রিয়েট করল না তবে গলা উঁচিয়ে বাচ্চাটির বাবা-মাকে ডাকল। ওদের বাচ্চাকে নিয়ে যেতে বলল৷ লোকটা উঠে এলো বাচ্চা নিতে, তবে ভীষণ বিরক্তি সহিত। কাছে এসে হাসার প্রচেষ্টা করে বলল,

“ওর মা এমন বোরকা পরতো তো, তাই আপনার স্ত্রীকে মা ভেবে এমন করেছে।”

ইজহানের বিরক্ত গলায় বলল,

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। বাচ্চা এদিকওদিক যায়, খেয়াল রাখুন। আমরা তো এখানে খেতে এসেছি নাকি! অযথাই ঝামেলা।”

বাঁকা গলার ধমক খেয়ে লোকটা নিজে থেকেই বলল,

“আসলে ওর মা মারা গেছে দিন বিশেক আগে। বাচ্চাকে একা সামলাতে পারব না তাই দু’সপ্তাহ হলো বিয়ে করলাম। নতুন বউ, বোঝেনই তো! খেতে এসেছি তো তাই ওর দিকে খেয়াল রাখতে পারিনি।”

লোকটা বাচ্চাটিকে নিজের কাছে ডাকল, কিন্তু ইস্মিকে ছেড়ে যাবে না বলে সে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল। ইস্মি পাথরের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ! এরপর ইজহানের দিকে এক পলক তাকিয়ে নজর সরালো। বাচ্চাটির মাথায় হাত রেখে আদুরে স্বরে বলল,

“বাবা ডাকছে, যাও সোনা।”

অদ্ভুতভাবে বাচ্চাটি কথা শুনল ওর। নিকাবের উপর দিয়ে ইস্মির মুখ ছুঁয়ে এরপর বাবার কোলে চলে গেল। লোকটা বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল টেবিলে। নতুন মা-টাকে ভীষণ বিরক্ত দেখালো। ইস্মি চুপটি করে বসে রইল। ইজহান ওকে আড়চোখে দেখে গম্ভীরমুখে বসে রইল। ওয়েটার ততক্ষণে খাবার নিয়ে পরিবেশন করে গেল। ইজহান ইস্মিকে খাবার বেড়ে দিলো, ওর হাতেই খেলো। পুরোটা সময় রোবটের ন্যায় আচরণ করে গেল মেয়েটা, মুখফুটে একটি শব্দও বিনিময় করল না। অদ্ভুত এক অনুভূতি উসকানি দিলো ইজহানের মস্তিষ্কে, রগে রগে। হাত মুঠোয় নিয়ে চিড়বিড়িয়ে সে বলল,

“মুখে কুলুপ এঁটেছিস কেন?”

“আমি বাড়ি যাব।”

ইজহান আরো জোরে হাত চেপে ধরল ওর। মুহূর্তেই ওর কব্জিতে দাগ বসে গেল৷ ইস্মি হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,

“দেখুন লোকটা তার নতুন বউয়ের সাথে কী সুখী! অথচ যার জন্য বিয়ে করল সেই বাচ্চাটির চোখভরা কত শূন্যতা, মায়ের অভাব! লোকটা তো বউ পেল, কিন্তু ও কী পেল? পুরুষ মানুষের ভালোবাসা, বিশটা দিনও পেরুয়নি।”

ইজহানের মুখটা দেখার মতো হলো। মাথায় ঠোক্কর খেল কথাগুলো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ ছড়াল লোকটির উপর। ব্যাটা কাপুরুষের কাজ দেখে তার বউয়ের মন খারাপ হয়েছে, কি ভেবেছে ইস্মির অনুপস্থিতিতে ইজহানও এমন করবে? দম থাকতে না। আচমকাই বউয়ের প্রতি ভালোবাসায় ইজহানের বুকে জোয়ার বইল। ইস্মির গাল ধরে, গম্ভীর গলায় সে বলল,

“কে কেমন জানি না, জানতেও চাই না। শুধু জানি, ইস্মিতা ছাড়া ইজহান শেখ শূন্য, মৃত!”

ইস্মি অশ্রুভেজা চোখে চাইল,

“এই একই কথা যদি আমি বলি, তাহলে বিশ্বাস করবেন?”

ইজহান জবাব দিলো না, চোখের ভাষায়ই বুঝিয়ে দিলো। এরপর ওয়েটার ডাকল বিল পরিশোধের
কথা বলতে!

.

এলিভেটরটা হঠাৎ থেমে গেল চারতলায় আসামাত্রই, দু’পাশের দুটো পাল্লা ধীরেধীরে খুলতেই বাইরে ফোন স্ক্রল করতে থাকা অপেক্ষমাণ ব্যক্তিটি ভেতরে প্রবেশ করবে বলে পা বাড়াল, তবে বাড়িয়েই থমকে গেল। বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল,

“তুই? এখানে কী করছিস?”

ইজহান যার সামনে পরতে চাচ্ছিল না, কাকতালীয়ভাবে তার সামনেই পড়ে গেল। সে মোটেও আশা করেনি এই অনাকাঙ্খিত মুহূর্তটির। বিরস ও শক্ত গলায় সে জবাব দিল,

“তোর কেনা নাকি এটা, যে কৈফিয়ত দেব?”

খুব সাধারণ একটা প্রশ্নের এমন ত্যাড়াব্যাকা জবাব শুনে ইহসান বিরক্ত হলো। তবে ইজহানের হাতের দিকে চোখ পড়তেই এবারে তার নজরে এলো ভাইয়ের পাশে বোরকায় আবৃত নারীটির দিকে৷ মেজাজটা বিগড়ে গেল ওর, কে এই মেয়ে? যাকে নিয়ে ইজহান এখানে এসেছে আবার হাত ধরে রেখেছে? ঘরে বউ রেখে তাহলে বাইরে বিরিয়ানি খাওয়া হচ্ছে? বাবার মতো চরিত্রহীন রুপটা ধারণ করেই ফেলল অবশেষে? ইহসান মুখ বিকৃত করে
প্রশ্ন ছুঁড়ল,

“কে এটা?”

বোরকা পরিহিত মানবী বলতেই যাচ্ছিল ‘আমি ইস্মিতা’ ; কিন্তু ইজহান সেই সুযোগটুকু দিলো না। ওকে থামিয়ে গা জ্বালানো স্বরে বলল,

“তোকে বলব কেন?”

“ঘরে বউ রেখে হোটেল ঘুরছ তাহলে? বাস্টার্ড…”

গালি বেরিয়ে এলো ইহসানের। রাগটা আর চাপা দিতেই পারল না। পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে দু’ঘা বসিয়ে দিলো নাকেমুখে। ইজহান কঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। বোরকা পরিহিত মানবী এবার চিৎকার করে নিজের পরিচয় দিলো,

“ভাইয়া এটা আমি…”

ইহসান দ্বিতীয় দফায় অবাক হয়ে তাকাল। ইজহানের কলার ছেড়ে সে বিস্ময় নিয়ে বলল,

“ইস্মিতা! ওহ গড! এই শুয়োর দেখেন কতটা ত্যাদড়,
বউ নিয়ে বেরিয়েছে বলতেও তা মুখে বাঁধে,
কুত্তার ছাও একেই বলে… ”

ততক্ষণে গ্রাউন্ডে নেমে এসেছে তারা। এলিভেটর থেমে গেছে, ইহসান বেরিয়ে পড়ল। ইজহান ব্যথাটুকু সহ্য করে নিয়ে ভাইকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার সময়ই পেল না। রেস্টুরেন্টে ছোট্ট বাচ্চাটার পরিণতি ভেবে ও ইজহানের সাথে হওয়া কথোপকথনের পর থেকেই ইস্মির এমনিতেই সবকিছু অর্থহীন লাগছিল। ওর যে কী হলো, রাগ দেখিয়ে ইজহানকে ধরল না, একাই বেরিয়ে গেল৷ বিস্মিত ইজহান একহাতে নাক চেপে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এসে ইস্মিকে বলল,

“আমাকে রেখে বেরিয়ে এলি কেন…”

“যে লোক ভাইকে বলতে পারে না আমি বউ নিয়ে বেরিয়েছি; তার এত অহংকার মানায় না।”

বলামাত্রই ঠাস করে একটা চড় পড়ল ইস্মির গালে। শক্ত হাতের চড় খেয়ে ইস্মি অশ্রুভেজা চোখ নিয়ে একপলক দেখল ইজহানকে। পরক্ষণেই ঘৃণা আর ক্ষোভ ভরা চোখ সরিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইজহানের সহ্য হলো না ওই দৃষ্টি, ভস্মীভূত নজরে
দেখল ইস্মিকে।

.

ইহসানের বড্ড মাথা ধরেছে। মাথা ধরায় সে সৃজার কোলে শুয়ে আছে। সৃজা ওর কপালে মালিশ করে দিলো, চুল টেনে দিলো। জিজ্ঞেস করল চা খাবে কি-না! ইহসান নিমরাজি হলো, কিন্তু সৃজা ওর কথা শুনল না। আদা দেওয়া চা বানাতে চলে এলো রান্নাঘরে। চা বানাতে এসে ইস্মিকে আনমনা হয়ে চুলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল৷ চুলায় তারকারি গরম হচ্ছে, আগুনের খুব কাছেই ইস্মি দাঁড়িয়ে অথচ মেয়েটার কোনো হেলদোল নেই। সৃজা তড়িঘড়ি করে চুলাটা কমিয়ে দিয়ে ইস্মিকে ডাকল ধীর গলায়,

“তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

ইস্মি চমকে উঠল সৃজার গলা শুনে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। চুলার দিকে ধ্যান দিতে
দিতে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলল,

“কই না তো!”

সৃজা ওর মুখের মিথ্যে হাসি দেখল তীক্ষ্ণ চোখে। বুঝতে না দিয়ে বলল,

“বলতে না চাইলে জানতে চাইব না, কিন্তু ছোট বোন ভেবে বলতেই পারো।”

“আরে তেমন কিছু না, তুমি তো কাল বাড়িতে যাচ্ছ, নিশ্চয় আনন্দ হচ্ছে?”

ইস্মি কথা ঘুরানোর চেষ্টা করল। সৃজা বুঝে আর জোরাজুরি করল না। যে না বলতে চায়, তাকে জোর করে বলানো উচিৎ নয়। প্রথম থেকেই সৃজা অনেককিছু দেখে আসছে এ বাড়িতে, তাই বোঝে!
সবাই সবকিছু বলতে চায় না। সৃজা নিজের
জবাবে বলল,

“আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু কান্নাও পাচ্ছে…”

ইস্মি হেসে বলল,

“কেন? ভাইয়াকে ছেড়ে থাকবে বলে?”

সৃজা গরম পানি বসাতে বসাতে কিঞ্চিৎ লাজুক
গলায় বলল,

“ধুর, তা না! সবাইকে অনেকদিন পর দেখব বলে৷ আসলে আগে কখনো পরিবারের থেকে এতদিন দূরে থাকিনি তো তাই খুশি যেমন লাগছে, তেমনি অদ্ভুত ভাবে কান্নাও পাচ্ছে…”

ইস্মির মনে পড়ল কতদিন সে বাবার বাড়ি যায় না, তিন…তিনটা বছর! ওর মুখটা মলিন হয়ে গেল তবে সেটা লুকানোর তীব্র প্রচেষ্টা করে বলল,

“বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা, একদম অন্যরকম। তাই না?”

“অন্যরকম…”

সৃজা ওর সঙ্গে একমত হয়ে মাথা নাড়লো, টুকটাক আরো কিছু কথাবার্তা হলো। ইস্মি ডিমের খোসা ছাড়াতে লাগল, আর সৃজা ফুটন্ত পানিতে চায়ের লিকার ছাড়ল। তখনি মিতু এলো, সৃজাকে দেখে
মুখ ভেঙচালো আড়ালে, কিন্তু কিছু বলল
না। ইস্মিকে ঠেস মেরে বলল,

“ইজহান ভাই নাকি তোমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছিল, তা কেমন সময় কাটালে? কই কই ঘুরে এলে? বলোনি তো আমাদের, নিয়েও যাওনি। আমরা কি এতই পর হয়ে
গেলাম ইস্মি?”

মিতু সবসময়ই ইস্মিকে ওর নাম ধরে ডাকে, সম্মান করে না। বেয়াদব মেয়েটার এসব আচরণ গা সওয়া হয়ে গেছে ইস্মির। ও হেসে বলল,

“সময় তো ভালোই কাটালাম। তোমরা তো কয়দিন পরপরই যাও, তাই আর বলিনি আরকি! জানোই
তো, স্বামী-স্ত্রীর একসাথে ঘুরতে বেরুলে তৃতীয়
কেউ যেতে নেই!”

“বাহ! বোবার মুখে কথা ফুটেছে, বড্ড ভালোই
কথা শিখছ তুমি।”

“ঐ আরকি, শিখলাম এক-আধটু।”

“শিক্ষাটা কে দিচ্ছে? উড়ে এসে জুড়ে বসা বউ?”

সৃজাকে ইঙ্গিত করায় ও বিরক্তি আর চরম রাগ নিয়ে তাকাল। ইস্মি ওকে ইশারায় কিছু বলতে বারণ করে মিতুকে প্রতুত্তরে বলল,

“না তো, ও কেন দেবে! দিলো তোমার ভাসুর,
এটাও বলল কেউ আমার সাথে বেয়াদবি করতে আসলে যেন তাকে বলি, সে তার ক্লাস নেবে। জানোই তো ওনাকে, মাথাগরম লোক!”

মিতু ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইল। তার মুখ থমথমে হয়ে গেছে। বলল,

“ইজহান ভাইকে তো দেখি সারাক্ষণই তোমার সাথে সার্ভেন্টের মতো আচরণ করে, বকা বাজি করে। দশপদ রান্না করে খাওয়াতে বলে…”

ইস্মি ওকে থামিয়ে দেয় মাঝপথে, হেসে বলে,

“দশপদ রান্না করে স্বামীকে খাওয়াতে আমার তো সমস্যা হয় না, তোমার হয় তাই হয়তো ইমরান ভাই আজ অবধি বউয়ের রান্না খাওয়ার সুযোগ পেল না…”

মিতুর গা জ্বলে উঠল। ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল কিছু না বলেই। সৃজা ঠোঁট টিপে হাসল। ইস্মিকে বলল,

“সবসময় চুপ থেকো না, কেউ টিজ করলে এভাবেই জবাব দিও। মাঝেমধ্যে ভাইয়াকেও তো দিতে পারো…”

ইস্মি শ্বাস ফেলে বলল,

“তাকে কিছু বলা আমার সাধ্য ভেবেছ? প্রথমে আমাকে মারবে এরপর নিজেকে।”

“সাধ্যমতো তাকে বোঝাও, এত এত রেস্ট্রিকশন একসময় তাকেই বিপদে ফেলবে।”

সৃজার কথা শুনে ইস্মি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল! এ কথাটা ইজহান বুঝলে তো হয়েই যেত! ও দুটো ডিমসেদ্ধ আর দুধের গ্লাস নিয়ে ঘরে চলে এলো সৃজাকে বিদায় জানিয়ে। ঘরে এসে দেখল ইজহান ফাইল ঘাঁটছে, সে ইজহানের সামনে ডিমের বাটিটা রেখে বিছানা ঝেড়েঝুড়ে নিলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা ওর, তাই শুয়ে পড়ল। ওকে শুয়ে পড়তে দেখেই ফাইল রেখে ইজহান ওকে ডাকল, ইস্মি
উঠে পড়ল সঙ্গে-সঙ্গেই। পা-জোড়া মেঝেতে নামাতে নামাতে জিজ্ঞেস করল,

“কিছু লাগবে?”

“না।”

ইস্মি রুষ্ট কণ্ঠে বলল,

“তাহলে অহেতুক ডাকলেন কেন?”

“বিরক্তি দেখাচ্ছিস আমায়?”

“এখন কী বিরক্তও হতে পারব না?”

ইজহান দুধের গ্লাসটা সজোরে মেঝেতে ফেলে দিলো। কাচের গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

“পরপুরুষ দেখেছিস আজ, তাই ত্যাড়েক দেখাচ্ছিস আমায়? মাথা ঘুরে গেছে, না? নষ…”

পুরোপুরি শেষ না করেই থেমে গেল এ পর্যায়ে। তবে বাকিটুকু বুঝে নিলো ইস্মি। বহুদিন পর একবার রক্তাভ চোখে একপলক চাইল, এরপর চুপচাপ বসে পড়ল কাচ পরিষ্কার করতে। ইজহান আবারো
কটমট স্বরে বলে উঠল,

“তোকে নিয়ে বেরুনোটাই আমার ভুল হয়েছে!”

ইস্মি রোবটের ন্যায় কাঠ কাঠ গলায় বলল,

“আপনার জীবনটাই ভুল ইজহান শেখ, একদিন বুঝবেন। আর যেদিন বুঝবেন সেদিন এই ইস্মিতা আপনার পাশে থাকবে না। আগেরবারের মতো
স্ট্রোক করেও ফিরে পাবেন না আমায়…”

ইজহান চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল ইস্মির গলার দৃঢ়তা বুঝে, ওর কথা শুনে। বুকের ভেতরটা বিষাদে ছেয়ে গেল৷ অশান্তিতে জ্বলে গেল শরীরের প্রতিটি শিরা। সে থমকিত চোখ জোড়া মেলে ইস্মির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোমল মুখখানা অচেনা ঠেকল ওর! একসময় মেঘস্বরে বলল,

“আমাকে ভালোবাসো না?”

“ছেড়ে গিয়েও বেহায়ার মতো ফিরে এসেছিলাম, ভালোবাসতাম বলেই।”

ইজহান চোখের পাতায় একটুখানি ঝাঁকুনি খেল। মুখটা আগের চেয়ে বেশি কঠিন দেখাল। তেড়ে এসে গাল চেপে ধরল ইস্মির,

“তো এখন কী বাসিস না?”

রুদ্ধ স্বরে বলা কথাটা শুনে ইস্মি উত্তর দিলো না, রুষ্ট চোখে তাকিয়েই রইল। ইজহানের সহ্য হলো না সেই দৃষ্টি, সে গাল ছেড়ে দিলো ওর। দু’হাতে কপাল থেকে চুল সরানোর ভঙ্গিতে মাথা চেপে ধরল। বেশ বুঝতে পারছে, রেস্টুরেন্টের বাচ্চাটিকে দেখার পর থেকেই তার বৌ এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে, পাল্টে গেছে, এসবের মানে কী? ইজহান বুঝে পেল না কী বলবে, অস্থির ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলল কয়েকবার এদিকওদিক তাকিয়ে। ইস্মির হাত টেনে ধরে বলল,

“বাচ্চা লাগবে তোর? চল দিব…”

ইস্মির ঘৃণা হলো প্রচণ্ড কথাটা শুনে। হাত ছাড়িয়ে নিলো এক ঝটকায়, কাষ্ঠ হাসলো৷ তিন বছর আগের করুণ স্মৃতিটুকু ভেসে উঠল। দুই মাসের একটা
ছোট্ট ভ্রুণ তার পেটে বড় হচ্ছে, এক সকালে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করে জানতে পেরে সে কতটাই না খুশি হয়েছিল! ভেবেছিল, নিজের সন্তান আসার খবরে লোকটা খুশি হবে, তার সব পাগলামো ছাড়বে।
কিন্তু সে ভুল ছিল! নিজের সন্তানকেও শত্রুচোখে দেখেছে এই লোক প্রথম থেকেই। নিত্যদিন ঝগড়া, ঝামেলা এবং রাগের বশত তাকে আঘাত করে তিন মাসের সেই ভ্রুণটাকে নষ্ট করে দেওয়া, পৃথিবীতে আসতে না দেওয়া! সব তো এই লোকটারই কাজ! এতদিন পর কোনমুখে আবার বাচ্চার কথা মুখে আনে? ইস্মির ধৈর্য চ্যুতি হলো। সে জ্বলন্ত শিখার
ন্যায় বলে উঠল,

“এই অসুস্থ সম্পর্কে একটা বাচ্চা এসে আপনার রোষানলের শিকার হোক, আমি মরে গেলেও তা চাই না। আপনার তো ইস্মিকে লাগবে, সে তো আছে। তাকে নিয়েই থাকুন না! আর যদি আমার মতামত জানার জন্যই প্রশ্নটা করে থাকেন তাহলে বলব, একটাই বাচ্চা আমার, যাকে তিনটা মাস গর্ভে ধারণ করেছিলাম, যাকে আপনি পৃথিবীর আলো দেখতে দেননি। ও-ই আলো না দেখা ভ্রুণটাই আমার বাচ্চা, যে আমার কোলে নেই ঠিক, কিন্তু আমার অস্তিত্বে মিশে আছে। আমার আর কোনো বাচ্চা লাগবে না। আর কখনোই আমি মা হতে চাই না, চাইবও না। না, না, না…”

_____

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৩

চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে যেন ইস্মির। বুক হাপড়ের ন্যায় উঠানামা করছে৷ সারা গা কাঁপছে। চোখ জলে চিকচিক করছে, গাল বেয়ে পড়ছে। দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে! ফর্সা, লালাভ গালে হাত বাড়িয়ে ইজহান ছুঁলো তার বউয়ের অশ্রুবিন্দু। আঙুলে একফোঁটা জল নিয়ে সে বিমূঢ় চোখে দেখে গেল তার ইস্মিতাকে। কোনো কথা বাড়াল না আর। দাঁড়িয়ে রইল। ইস্মি এক ঝটকায় ওর হাত ঝেড়ে ফেলে বারান্দায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ইজহান আটকাল না, নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। তার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত, বুকে আগ্নেয়গিরি আর দুটো চোখ মরুভূমির চেয়েও শুষ্ক! তবে বাইরে থেকে সে ঠাণ্ডা। কারণ— বিবাহিত জীবনের এই পাঁচটি বছরে ইতোপূর্বে তার ইস্মিতার এমন তেজদীপ্ত রুপ, এমন কণ্ঠস্বর সে শোনেনি৷ তাই সে আশ্চার্যান্বিত! বোধগম্য হচ্ছে না তার এ মুহূর্তে কি করা উচিৎ, তবে এটুকু আন্দাজ করতে পারছে ইস্মিতা
তাকে ভালোবাসার পাশাপাশি তার জন্য চরম ঘৃণাও মনে পুষে রেখেছে! আর সেই ঘৃণার একমাত্র কারণ— তাদের বাচ্চাটা! মনে মনে সে যা আন্দাজ করতো, তা-ই! এর মানে কী? ইস্মি ইজহানের থেকেও বেশি ভালোবাসে তাদের ঐ ছোট্ট ভ্রুণটিকে? যার শরীরের পূর্ণাঙ্গ গঠনই তখন হয়নি! সেই অগঠিত ভ্রুণ, বাচ্চাটার না থাকা স্বত্তেও ইস্মিতা ওকেই বেশি ভালোবাসে এবং এত বছর পরে এসেও? অথচ
ইস্মি ও-ই ভ্রুণটার ছিন্নভিন্ন অংশটা পর্যন্ত চোখে দেখেনি!

ইজহানের বুকের ভেতর যন্ত্রণার এক মিশ্রণ দোলা দেয়, সেই মৃত ভ্রূণের স্মৃতি ভাসতেই। হাসফাঁস লাগে ঐ মাংসপিণ্ডটার কথা মনে করে। গলা শুকনো লাগে তার। কয়েকবার পানি গিলে সে গ্লাস ভরে, কিন্তু তৃষ্ণা মেটে না। এমন যেন, একটা আস্ত সমুদ্র গিলে ফেললেও তার পিপাসা মিটবে না। ইজহানের ক্লান্ত লাগে, শরীর ভেঙ্গে আসতে চায় হুট করে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে বারান্দার দরজা ঘেঁষে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। কেমন যেন খালি, শূন্য মনে হয় ওর নিজেকে। সে হেসে ফেলে ঘর কাঁপিয়ে আচমকা। হাসতে হাসতে চোখে জল জমে ওর। তাচ্ছিল্য আর উচ্চস্বরে বলে,

“বাপ হয়ে সন্তানকে মে’রে ফেলেছি আমি, এরজন্য
এত ঘৃণা পুষিস আমার জন্য? কই, কখনো তো মুখফুটে বলিসনি আমায়! তার মানে কি ধরে নেব, তোর মনে এক, মুখে আরেক?”

অনেকক্ষণ কোনো জবাব আসে না বারান্দার দরজার ওপাশ থেকে। যেন আশেপাশে কেউ নেই। ইজহানের মোটেও এই অবাধ্যতা সহ্য হয় না। সে খ্যাঁকিয়ে উঠে।
ইস্মির জবাব আসে কয়েক মুহূর্ত পরে,

“আপনি কী ভেবে নেবেন, ধরে নেবেন সেটা একান্তই আপনার বিষয়। কারণ, আপনার নিজস্ব স্বাধীনতা আছে আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার, যা খুশি তাই ভাবার। এক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই৷ কিন্তু আমার যেহেতু স্বাধীনতা নেই,
তাই মনেমুখে কি আছে, তা বলতে পারছি না।”

আজ, একটা দিন শুধুমাত্র সে এই মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। কি কি হলো এরমধ্যে…একটা বাচ্চাকে দেখেছে, কোলে নিয়েছে তারপর থেকেই তার এই শান্তশিষ্ট বউটি এমন রুক্ষমূর্তি হয়ে গেছে, বুক চিঁড়ে ফেলা কথা বলছে। ইজহানের বিশ্বাস হয় না এই মেয়েকে। এ তার ইস্মিতা হতে পারে না! প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে ছুরি দিয়ে খোঁচানো হচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য সে স্থির হয়ে বসে থাকে, তারপর কঠিন কণ্ঠে বলে,

“এই তোকে আমি ভালোবাসি?”

“আপনার মুখে ভালোবাসার কথা মানায় না।”

ইজহান বড্ড বিস্মিত হয়ে পড়ে। হজম হয় না কথাগুলো৷ রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করে,

“তাহলে কী মানায়?”

“জোরজবরদস্তি, সন্দেহ, গালাগালি, স্বাধীনতা হরণ করা, কাঠপুতুল বানিয়ে রাখা। মর্জিমতো না হলে
গায়ে হাত তোলা। নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া।
হু, এসমস্ত কথাকাজেই আপনাকে মানায়…”

উগ্র কথার ভার সইতে বাধ্য হওয়া ইজহান আক্রোশপূর্ণ কণ্ঠে বলে,

“আমি এমনই, জানতিস তুই। সব জেনেও তাহলে ফিরে এসেছিলি কেন? আমি তো যাইনি তোকে আনতে, সুযোগ ছিলো তো; কাজে লাগাসনি কেন?”

“ভালোবাসতাম বলে।”

ঝরঝরে, দৃঢ় গলায় বলে ইস্মি। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে ইজহানের। সে তৎক্ষনাৎ এলোমেলো পায়ে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দার দরজা ঠেলে প্রবেশ করতে চায়। ইস্মি ভেতর থেকে খুলে না সেটা। ইজহান প্রথমে থাবা বসায় এরপর প্রচণ্ড লাথি, একেরপর এক। ইস্মি একসময় বাধ্য হয় দরজা খুলতে। রুক্ষমূর্তি ধারণ করা ইজহান চুলের মুঠি টেনে বিছানায় এনে ফেলে ওকে। গলা চেপে ধরে দু’হাতে৷ শীতল আর হিংসাত্মক স্বরে বলে,

“সেই থেকে বলে যাচ্ছিস— ‘ভালোবাসতাম, ভালোবাসতাম।’ কী হাস্যকর! ভালোবাসা কি কোনোদিন অতীতবাচক
হয়? যে ভালোবাসা সত্যি, তার শব্দ, সংজ্ঞা চিরকাল
একই থাকে, একটুও বদলায় না। ভালোবাসা মানে সজীবতা—যার অনুভূতি কখনো নষ্ট হয় না। অথচ তুই বলছিস ‘ভালোবাসতাম’? মূর্খ মহিলা, শোন, ভালোবাসা
যেমন কখনো নিঃশেষ হয় না, তেমনি এই শব্দটারও
কোনো অতীত – ভবিষ্যৎকাল হয় না। ‘ভালোবাসতাম’
বলার মানেই হলো— তুই কোনোদিনই ভালোবাসিসনি!”

ইস্মি দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করে উঠতে চায় দেহটা। কিন্তু সে নড়েচড়ে না, চিৎকার করে না। শুধু অস্পষ্ট দৃষ্টিতে দেখতে থাকে হিংস্র সত্তা ধারণ করা স্বামী নামক পুরুষটিকে। মনে মনে প্রার্থনা করে সে এই অবস্থায়— নিঃশ্বাসটুকু নিয়ে নিক লোকটা, মুক্তি দিক ওকে এই নরকযন্ত্রণা থেকে।

ইস্মিকে ওমন ধীরস্থির দেখে ইজহানের হাতজোড়া শিথিল হয়ে আসে। এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে এই মেয়েটির দিকে— আকুতিভরা কণ্ঠস্বর কোথায়, বাঁচার ছটফটানি কোথায়? ছাড়া পাওয়ার জন্য এতটুকু ইচ্ছেও কি নেই ওর? ইজহান চোখ বুজে ফেলে। কি ভেবেছে এই মেয়ে? এত সহজে মরে যাবে, এরপর ইজহানকে একাকিত্ব উপহার দিয়ে শাস্তি দিবে? মুক্তি চায় ও, ইজহানের থেকে মুক্তি? মস্তিষ্কের পোকাটা আবারো কিলবিল করে উঠে ওর। চোখ রক্তবর্ণ হয়ে যায়। রাগে শরীরের প্রতিটি কোষ ফুঁসে উঠে একসাথে। সামনে থাকা চেয়ারটা লাথি দিয়ে সে উলটে ফেলে। আছড়ে ভাঙে সবকিছু। ভাঙচুরের শব্দ পেয়েও ইস্মি উঠে না, আগের মতোই স্থির পড়ে থাকে বিছানায়, কোনো হেলদোল করে না। শুধু চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা! তা দেখে উদ্ভ্রান্ত ইজহানের সবকিছু এলোমেলো লাগে, মাথা চেপে ধরে সে। ইস্মি কেন ওকে থামাচ্ছে না, থামতে বলছে না? রাগে ওর কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইজহানের চোখে ক্ষোভের আগুন, আক্রোশ তার গলার গভীর থেকে বেরিয়ে আসে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে তীব্র ঘুষি বসিয়ে সে গর্জে ওঠে,

“পাঁচটা বছর! পাঁচটা বছর তুই আমার কাছে; অথচ আমি বুঝতেই পারিনি—তুই আর ছলনাময়ীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! তুইও ঠিক সবার মতো, ভালোবাসার নামে, যত্নের নামে আমাকে এতদিন ভুলিয়ে রেখেছিস। নিজে সাবিত্রীর মুখোশ পরে সবাইকে দেখিয়েছিস, তুই দেবী আর আমি এক অত্যাচারী স্বামী! যাতে সবাই ভাবে আমি খারাপ, আমি উগ্র, আমি তোর জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছি, নরকে পরিণত করেছি! প্রতিশোধ নিচ্ছিস তাই না, তোর সন্তানকে মে’রে ফেলেছি তাই?”

“ভুল, আপনি ইস্মিতাকে মেরে ফেলেছেন, আর মৃত মানুষ প্রতিশোধ নিতে পারে না।”

শুয়ে থাকা ইস্মির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে, চোখের কোণ টনটন করে, কিন্তু মুখের বিভীষিকাময় হাসিটা স্থির থাকে। ইজহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর শক্তি তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। সে
দেখে তার ইস্মিতার হাসি, বিধ্বংসী দৃষ্টিতে। তার আদরের ইস্মিতা কি জানে, তার ক্ষতবিক্ষত বুকের ভেতর রক্তবন্যা বয়ে যাচ্ছে?

.

ইহসান সৃজাদের শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে জামাই আদর খেতে চলে গেল। গেল বললে অবশ্য ভুল হয়। বলা যায়, সৃজার মনের দুঃখ কমাতে সে বাধ্য হয়েছে আসতে। কারণ বাইশ বছরের ধ্যাড়ি মেয়ে গতরাতে ঘুমানোর সময় তার আড়ালে কাঁথায় মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে ভীষণ, ওকে মিস করবে বলে! রাতে হুট করে নাক টানার শব্দ কর্ণপাত হতেই ঘুম থেকে ধরফড়িয়ে উঠে ইহসান, কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিল না সৃজা, চাপাচাপি করাতে স্বীকার করেছে অনেক পরে। তার সৃজা, তার বউ— তাকে মিস করবে বলে এমন বিব্রতকর পরিবেশ তৈরি করে ফেলছে দেখে ইহসানের মাথায় গণ্ডগোল লেগে গেল। তাই একটা দিন সৃজার সঙ্গে শ্যাওড়াপাড়ায় কাটিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলো! পরের দিন বিকেলের দিকে তাই চলে এলো ওদের বাড়ি। মাসখানেক পর নিজ বাড়িতে, সবাইকে পেয়ে আগের উৎফুল্লতা ফিরে এলো সৃজার মাঝে। বাবা, এলিজা, নীলু ফুপি সবাইকে যে কী মিস করতো এটা শুধু তার মন জানে। ইহসান ওকে হাসিখুশি দেখে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যদিও তার হিংসা লাগছিল। কারণ বাকি ছয়টা দিন সৃজাকে ছাড়া সে একা ঘরে, একা বিছনায় ঘুমাবে। কতটা কষ্ট হবে ওর, ভেবেছে কী এই পাষাণী?

________

চলবে…