#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪৩
সৃজার ধরে রাখা হাতটা আলতো করে রেখে, চুলে হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু বসিয়ে ইহসান লাগোয়া বারান্দায় চলে আসে৷ যথাসম্ভব মেজাজ সামলে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়, “তোর শত্রু।”
ইজহান চমকে উঠলেও বুঝতে না দিয়ে বলে, “ও ভেড়া!
তো সকাল সকাল কী?”
“প্রয়োজনে।”
“ফাজলামো হচ্ছে? আমার কাছে তোর আবার কী প্রয়োজন?”
“ইস্মিতাকে।”
ক্ষ্যাপাটে কণ্ঠস্বরের চেঁচানো শোনা গেল, “কীহ? আমার বউকে তোর দরকার? কু* বাচ্চা তোর ভাইয়ের বউ লাগে।”
জানা কথা, ইস্মিতার কথা শুনলে ইজহান ফালতু বকবক ঝাড়বে! তাই ওকে সে সুযোগ না দিয়েই ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমার শ্বশুরমশাই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেল বাদ ফজর। এই মুহূর্তে পরিবারটার অবস্থা খুবই করুণ! সবাই শোকের ঘোরে আছে। এতগুলো মেয়েমানুষকে আমি কীভাবে সামলাব ভেবে কূল পাচ্ছি না, আর তো কেউ নেই, আমি তাই ইস্মিতার হেল্প চাচ্ছি…উনি এলে সামলাতে পারলে কিছুটা অন্তত সাহায্য হবে।”
ইজহান কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থেকে এরপর জোর গলায় বলে উঠল, “ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মুর্দা জান্নাতবাসী হোক। কিন্তু তুই ভাবলি কী করে, ইস্মিতার এ অবস্থায় আমি ওকে জার্নি করতে দেব?”
ধীর স্বরে বলল ইহসান, “তুই জাস্ট গাড়ি করে নিয়ে আসবি, রাস্তা ভালো। আধঘন্টা লাগবে বড়জোর!”
ইজহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর ক্যাটকেটে গলায় বলল, “তোর মতলব বুঝি না আমি? হেল্পের নাম করে ওকে খাটানোর ধান্ধা! এই, আমার বউকে কী বান্দি মনে হয় তোর যে…”
ইহসান কথাগুলো হজম করল অতিকষ্টে। ফেটে পড়া রাগ না দেখিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “দেখ, অহেতুক ঝগড়া করবি না। আমি এখন ঝগড়ার মুড়ে নেই।”
ইজহান থামলো ঠিকই, কিন্তু একটু পরেই বলল, “না না ওকে দেব না, মরা বাড়ি সামলানো ওর কাজ না।”
কথাটা কর্ণপাত হতেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল ইহসানের। বেজায় ক্ষেপে গেল সে। স্থান, কাল-পাত্র বিবেচনা না করেই মুখের লাগাম ছুটে গেল ওর, “আসলেই তুই একটা বাই*, শালা কু*, নূন্যতম কমনসেন্স নাই তোর, কোথায়, কখন, কী বলতে হয় এখনো শিখিস নাই? রিকশা দিয়ে আসতে বলেছি তোকে? হারামি! তোর এত্তবড় প্রাডো, রাস্তা দাপিয়ে বেড়াস ওটা কীসের জন্য? আমাকে জেলাস ফিল করাবি তারজন্য? কচু জেলাস হই আমি! শালা ডাস্টবিনের গন্ধময়লা, উজবুক, তোর কুকীর্তি, তোর যে প্রেমিকা, তাকে যে তুই চুমা*ইছিলি, তার হিস্ট্রি আমি যদি তোর বউকে না বলছি, মনে রাখিস…”
ইজহান হতভম্ব হয়ে গেল। সেই কবে, কোন বছর এক্স গার্লফ্রেন্ডকে চু’মু খেয়েছিল সে, এটা ইস্মিতাকে বলার কী আছে? না না। তার বউ জানে না, তার একটা এক্স আছে। ও যদি জানে তাহলে ইজহান জীবনে চোখ তুলে তাকাতেই পারবে না ওর দিকে। তাছাড়া এই অবস্থায় যদি এসব শুনে বাইচান্স মেয়েটার কিছু হয়ে যায়, যদি স্ট্রোক করে বসে? না না এ হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই ভেড়া যদি বলে দেয় ইস্মিতাকে? ভেড়াটাকে খুব বিশ্বাস করে আবার ওর বউটা। ইজহান কোনো সমাধান খুঁজে না পেয়ে আমতাআমতা করে বলে, “খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু, হুমকি… ”
“চুপ শালা! অজ্ঞান হস দিনে দশবার, তোকে হুমকি দেওয়ার কী আছে? তোকে তো আমি বাঁশ দেব!”
“ইস্মিতার এটা সেনসেটিভ সময়…”
ভাইয়ের কাঁচুমাচু কণ্ঠস্বর শোনে একটু থামে ইহসান। বড় করে শ্বাস নিয়ে চুল টেনে ধরে একহাতে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে এরপর রাশভারি গলায় যতটুকু সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে, “আমি খাটানোর জন্য আনতে বলছি? শুধু বলেছি ইস্মিতাকে পাঠা এখানে, আসবে শুধু মেয়েগুলোকে একটু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য! তাছাড়া পরিস্থিতি এখনো সেই স্টেজে পৌঁছায়নি যাতে পাশের এলাকায়ও আসতে পারবে না, তেমন হলে আমি নিজেই কখনোই বলতাম না। এটা সেনসেটিভ
সময় আমি জানি, সৃজারও সেনসেটিভ সময়,
এ সময় এমন একটা মানসিক ধাক্কা…সামলানোর জন্য কাউকে দরকার…”
শেষ কথাটা শুনে ইজহান বিস্ময়ে ফেটে পড়ল ফোনের ওপাশে। চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই বাপ হবি নাকি?”
“কেন, তুই শুধু একলা বাপ হবি? বাপ হওয়ার অধিকার পৃথিবীতে একমাত্র তোরই?”
কর্কশ শোনাল এবার ইহসানের গলা। শুনে চরম বিস্ময়ে ইজহান হা হয়ে গেল, ভেড়াটা তলে তলে এত্তবড় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেই ফেলল? যে-ই দেখল ইজহান বাবা হবে, ব্যস! নিজেরও হতে হবে। ইহসান শেখ ধান্ধাবাজি ভালোই শিখেছে! বিস্মিত ইজহানের হঠাৎ মনে পড়তেই সে হালকা কেশে সন্দেহ নিয়ে
জিজ্ঞেস করল, “তোর পাওয়ার প্ল্যান্ট আদৌ ঠিকঠাক কাজ করল?”
পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন? চরম অবমাননা! কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক পুরুষ এমন প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকতে পারে না। ইহসান চরম রেগে গেল। ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “করলই না, ডাবল করল!”
”ডাবল মানে…”
গর্জন করে উঠল ইহসান, “হারামি, একজনের মৃত্যু সংবাদ শুনেও বজ্জাতি করে যাচ্ছিস সেই থেকে! এদিকে আমি মহাসাগরে গলা অবধি ডুবে আছি,
আর তুই আছিস লুলামি নিয়ে… রাখ শালা হনুমান…”
ইহসান আচ্ছামত গালি ঝেড়ে ফোন রেখে দিলো। এই উজবুকটার সাথে কেন কথা বলতে গেল ও? এর যে ঘিলু নেই, এ যে পৃথিবীর বাইরের প্রাণী কেন ভুলে গেল সে? মেজাজটাই বিগড়ে গেল ওর! পকেটে ফোনটা ভরে কেবিনে এসে সৃজার মাথার কাছে বসলো কতক্ষণ। স্যালাইন চেক করল। শেষ হতে ঘন্টাখানিক লাগবে। ততক্ষণ কী এখানে বসে থাকবে? কিন্তু ওদিকে যে অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব! এখনি যেতে হবে, কিন্তু মেয়েটার কাছে কাকে বসিয়ে রেখে যাবে? ইহসান তৎক্ষনাৎ এলিজাকে গিয়ে নিয়ে এলো। ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অসহায় গলায় বলল, “এলিজ, তুই একটা শক্ত মেয়ে। যেকোনো পরিস্থিতিতে কষ্ট পেলেও ভেঙ্গে পড়িস না। তোকে আমি ওভাবেই পছন্দ করি। প্লিজ, এখনো ভেঙ্গে পড়িস না। আমি জানি এটা খুব কঠিন সময়, খুব। কিন্তু কঠিন সময়টাকে তো আর আঁকড়ে ধরে বসে থাকা যায় না। আমি তোর উপর আমার সৃজাকে দেখে রাখার দায়িত্বটা দিয়ে গেলাম। এই মুহূর্তে তোকে ছাড়া অন্য কাউকে ভরসা করতে পারছি না। ভাইয়া স্বার্থপর! কিন্তু কী করব বল…ওদিকটা তো সামলাতে হবে নাকি! আমাকে যেতে হবে। খুব বেশি সময় নেব না, নিজেকে একটু শক্ত রাখ, আমি ফিরলে তুই না-হয় আবার কাঁদিস! অবশ্য কান্না চোখের এলিজকে একদম মানায় না!”
এলিজার চোখগুলো মুছে দিলো ইহসান। মেয়েটা যে ভেতরে ভেতরে কতটুকু কষ্টে নিপতিত হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারল এক লহমায়। ও শুধু ব্যাকুল হয়ে একটু সাহায্য চাইল মেয়েটার কাছে। এলিজা মাথা নাড়ল, পরিস্থিতিটা ওর বোধগম্য! ভাইয়া একা একা সব করছে। ওর বাবার জন্য করছে, বোনের জন্য করছে, ওর পরিবারের জন্য করছে। শুরু থেকেই করছে। আর কত চাপিয়ে দেবে, একটু তো পাশে থাকা চাই! আব্বু চলে গেছে বলে আপু, ফুপি কতই না কষ্ট পাচ্ছে! এখন নিজেও যদি শোক নিয়ে বসে থাকে, তাহলে কীভাবে সামলাবে ওদেরকে? নাহ, এলিজাকে একটুর জন্য হলেও শোক ভুলতে হবে, সামলাতে হবে সবাইকে! মেয়েটা নিজের কান্না চাপলো বহুকষ্টে। ভেজা চোখ মুছে সৃজার শিয়রে বসে ইহসানকে আশ্বস্ত করল ওর পাশে থাকার। ইহসান মলিন মুখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, বেরিয়ে গেল!
.
ইজহান তোয়ালে পরে ঘরময় পায়চারি করছে। ওকে দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে, কপালে গাঢ় ভাঁজ। যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কী করবে! ভাইয়ের সাথে দা-কুমড়া সম্পর্ক হলেও ইজহানের এক মন বলছে, ভেড়াটা যখন একবার সাহায্য চেয়েছে, তখন খোঁচা দেওয়ার জন্য হলেও সাহায্যটা করা উচিৎ। আবার অন্য মন তা চাচ্ছে না। তবুও একটা শোকাগ্রস্ত পরিবারের কথা চিন্তা করে ইজহান আজিজ শেখকে বলেছিল সালেহা বেগমকে পাঠাতে, কিন্তু আজিজ শেখ রাজি হননি। বেশ বাঁকা বাঁকা কথাও বলেছেন। দেখে মনে হয়েছে তিনি এ খবরটাতে বেশ ভালো বোধ করেছেন। বাবার এ ব্যাপারটা ইজহানের ভালো লাগেনি মোটেও। ইমরানকেও বলেছিল মিতুকে নিয়ে একবার যেতে, কিন্তু না, মিতু সুন্দর করে সেজেগুজে ইমরান হাঁদাটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। সালেহা বেগম যদিও আড়ালে ইজহানের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে, কিন্তু বাবা যে আচরণ করে সালেহা বেগমের সাথে, সে কথা মনে করে আর তাতে সায় দেয়নি ইজহান। আর সেজন্যই মূলত ইজহান বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে, যাবে কি যাবে না! এদিকে ইস্মিতাও কান্নাকাটি করে একাকার, খুব করে যেতে চাইছিল, তার ধমক খেয়ে এখন চুপ! তবে ইজহান উঁকি দিয়ে দেখেছে, ইস্মি কাঁদছে! ভালো লাগে না তার ইস্মির কান্না। ইজহান ফুঁস করে শ্বাস ছাড়লো। বেশ বিপাকেই পড়েছে সে!
ইস্মি মলিন মুখে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, ওর চোখদুটোতে পানি, বালিশ ভেজা। কতক্ষণ আগে কান্নাকাটি করে নাকমুখ লাল করে ফেলেছে। তবুও রাজি করাতে পারল না ইজহানকে, সৃজাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষবার জোরাজোরি করে প্রকান্ড এক ধমক খেয়েছে, ইস্মি তাই আর কথাই বলছে না। ওর মনটা বড্ড ভার হয়ে আছে। সৃজা এ অবস্থায়, ওখানে কীভাবে আছে কে জানে! মেয়েটার মা নেই। ছোট একটা বোন আর ফুপিকে নিয়ে কীভাবে এই শোক কাটিয়ে উঠবে? নিজের খেয়াল রাখবে নাকি অন্যদের? ভেবে ভেবেই ইস্মির আগের কথা মনে পড়ছে, প্রথম বাচ্চা হারানোর অভিজ্ঞতা! কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে ওর দিনগুলো কেটেছিল! ভাবতেই বুক কাঁপে!
নির্দয় লোকটা কথাই শোনে না ওর। ইস্মি ফুঁপিয়ে উঠল। ইজহান পায়চারি থামিয়ে দিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, “কান্নাকাটি করা বারণ তোমার।”
ইস্মি সে অবস্থাতেই ফুঁসে উঠল, “নিষ্ঠুর লোক, মানুষের বিপদে পাশে থাকে না! কথা বলবেন না একদম আপনি আমার সাথে৷ অবিবেচক কোথাকার!”
ইজহান হা হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে ওর সাথে আবার এভাবে কথা বলছে!
.
শূন্য কক্ষ, মেঝেতে সকালের রোদ লুকোচুরি খেলছে। আবহাওয়া শীতল, কিন্তু আরামদায়ক নয়। ওড়নাটা গায়ে চাদরের মতো জড়িয়ে এলিজা একপলক সৃজার দিকে তাকাল। ফ্যাকাশে হয়ে আছে মুখটা, যেন রক্ত নেই! নরম, সিল্কি চুলগুলাও দেখো জট পাকিয়ে আছে! গালে অশ্রু শুকিয়ে লেগে আছে। সৃজা কাঁদে, তবে এভাবে না। এলিজার ভালো লাগে না আপুকে কাঁদতে দেখলে! আজ একটু জড়িয়েও ধরতে পারল না আপুকে, বলতে পারল না আপু এভাবে কেঁদো না! এলিজা সৃজার হাতে নিজের মাথায় ঠেকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখদুটো বন্ধ করে অভিযোগের স্বরে বলল, “তুমি খুব স্বার্থপর হচ্ছ দিনদিন! কেঁদেকুটে বেডে শুয়ে আছ, দুর্বল শরীরে। এদিকে দেখো, আমিও দুর্বল! অথচ কান্নার সুযোগ নেই। তোমার জন্য কাঁদার সুযোগ পাচ্ছি না, আম্মু চলে যাওয়ার সময়ও দু-ফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দেওয়ার সুযোগ হয়নি আমার, অবশ্য তখন তো জানতামই না! ভাগ্যটা বুঝলে, খুব জ্বালাচ্ছে আমাকে!”
কয়েক বছর আগের বীভৎস স্মৃতিপট! একটা গাড়ি, একটা ধাক্কা, একটা এক্সিডেন্ট, র’ক্তাক্ত দেহ, কালো পিচঢালা পথটা বড্ড লাল দেখাচ্ছিল! এরপর… বহুদিনের স্মৃতি এলিজার কাছে গচ্ছিত নেই। সে সময়টুকুতে মা হারিয়ে গেল ওর কাছ থেকে, জানতেই পারল না! মস্তিষ্ক যখন কাজ করা শুরু করল তখন মা হারানোর সাতাশ দিন! এলিজার কেন যেন রাগ হলো নিজের প্রতি। ধরে আসে গলা। সেভাবেই ভাঙা কণ্ঠে বলে, “কে আমাকে মায়ের গল্প শোনাবে, আমার রেজাল্ট শুনে কাঁদবে? কলেজ যাওয়ার সময় কে ডেকে বলবে ‘দুটো ভাত খেয়ে যা দোয়া, দশটা টাকা নিয়ে যা পকেট থেকে!’ জানো, আব্বু সেদিন ছানার পায়েস খেতে চেয়েছিল। ফুপি ওটা বানাতে পারে না, তাই আমিই ইউটিউব দেখে বানালাম, খেয়ে পায়েসের প্রশংসা না করে আমার প্রশংসা করল! কেন জানো, দোয়া রান্না শিখে গেছে বলে! আমাকে দোয়া বলে ডাকার মানুষটা চলে গেছে…কে আমাকে দোয়া বলে ডাকবে আপু…”
এলিজা টের পেল ও আবার কাঁদছে, চোখ থেকে নিশ্চুপে ঝরা জলের ফোটা সাদা বিছানাটা ভিজিয়ে ছাইরঙ ধারণ করেছে। ও দ্রুত চোখ মুছে নিলো৷ এরপর আবার সৃজার হাতটা শক্তভাবে মুঠোয় ধরে মাথাটা ঠেকিয়ে বসে রইল। রোদ তখন ওর বাদামি চুলে কুচি কুচি আভা ফেলছে!
.
জ্ঞান ফেরার পর সৃজা আবিষ্কার করলো ও শ্যাওড়াপাড়ার নিজেদের বাসায়, নিজ ঘরে শুয়ে আছে। ও একা। আর কেউ নেই ঘরে। গেল কোথায় সবাই? সৃজা উঠতে যাবে, সূক্ষ্ম আঘাত অনুভব করল হাতে। তাকিয়ে দেখল, ক্যানোলা সেট করা, স্যালাইন চলছে। সৃজা কিছুটা সময় চোখমুখ কুঁচকে স্থবির থেকে আচমকাই উঠে বসলো। অসচেতন ভাবে উঠে বসায় পেটে চাপ পড়ল ওর। আর্তনাদ বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। চোখ ছাপিয়ে জলধারা নামলো। তীব্র অবসাদে ওর শরীর ভেঙ্গে আসছে। পুরো পৃথিবীটা মনে হচ্ছে ঘুরছে। আচ্ছা আব্বু কী সত্যিই চলে গেছে? সৃজার বিশ্বাস হচ্ছে না। ওর মস্তিষ্ক কাজ করছে না। বিছানা থেকে নামতে গেল ও, আব্বুকে দেখবে!
হাতে টান পড়ল, ক্যানোলাটা সৃজা বিরক্তি নিয়ে একটানে খুলে ফেলল, কিছুটা রক্ত ছলকে বেরিয়ে এলো। ব্যথা অনুভব করল না সৃজা। গায়ে ওড়না দেওয়ার কথাও মনে রইল না। ও দরজা পর্যন্ত এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো, পর্দা সরিয়ে বেরুবে সেই মুহূর্তেই অনেক মানুষের শোরগোল শোনা গেল। এত মানুষের কণ্ঠ, কেন এসেছে ওরা? সৃজার খুব রাগ লাগল! ও একছুটে বেরিয়ে এলো বসার ঘরে। সেখানে কেউ নেই। সিঁড়িঘর থেকে পদশব্দ আসছে অনেক, ইহসান-এলিজার গলাও শোনা যাচ্ছে। সৃজা সেদিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ দেখলো, রান্নাঘরের ওখানে পাশের বাসার কুচুটে মালিকের স্ত্রী একপাশে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে পাশেরজনকে বলছে, “বুঝলা আপা, এদ্দিনে শান্তি হইছে, বেশ হইছে! পঙ্গু হইয়া সারাজীবন বিছানাতে পইড়া থাকনের চেয়ে মইরা যাওন ভালা। মাইয়া দুইডারে শান্তি দিয়া গেল…ন’টা বছর কী কম? আর কত টানব পঙ্গু ব্যাডারে, ওগো নিজেগো তো জীবন আছে! বড়ডার লাইগা কতবার প্রস্তাব দিলাম, দিলো না…”
রক্ত চড়ে গেল সৃজার মাথায়। ছুটে গিয়ে রুক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে ও, “তাতে আপনার কী? আপনি কেন আব্বুকে পঙ্গু বলবেন? তাও আমার বাসায় দাঁড়িয়ে, আমার আব্বুকে! নয়টা বছর তো কিছুই না, সারাজীবনও যদি বিছানায় পড়ে থাকে, আমরা সারাজীবনই তার দেখভাল করে যাব একটুও কষ্ট না রেখে। সারাজীবন টানব…আব্বুর জন্য আমরা সব করতে পারি। আপনি মাফ চান গিয়ে আমার আব্বুর কাছে…”
মহিলা ভড়কে গিয়ে প্রথমে আমতা-আমতা করে উঠলেও এবার কাঁৎ করে উঠলেন, “এই বেয়াদ্দব মাইয়া! কারে কী কও তুমি? আমার সাথে গলা উঁচাও! মাফ চাইতে কও কারে? সাহস তো কম না…কই বাপ মরছে সংযত হইব না গলা উঁচায়, অবশ্য আর কী আশা করব!” বলে একবার আপাদমস্তক সৃজাকে দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্যসূচক হেসে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করে বলল, “হিস্টোরি দেখন লাগব না…”
ক্রোধে চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেছে সৃজার, “হিস্টোরি মানে? কী বলতে চান আপনি… ”
“তোমার লাগি তোমার বাপের আযাব হইব।”
সৃজা বাকরুদ্ধ বনে গেল, আযাব হবে মানে? ওর জন্য আব্বুর আযাব হবে? ও যেন কিছু বলতে পারল না। বিস্ময়ে, হতাশায় নিমজ্জিত হলো। পা দু’টো জমে গেল। সৃজা ভারাক্রান্ত মুখে এদিকওদিক কাউকে খুঁজল, কেউ নেই। ঠিক তখনি মহিলাটা ওর চুপ থাকার সুযোগ নিয়ে আবার বলল, “গায়েগতরে ওড়না না দিয়া মুরুব্বির সামনে আইছ, আবার চেঁচাইতাছো! তোমার না বাপ মরল? বাপ মরা মাইয়ার অত গলার তেজ কেন! গলা নামাইয়া এরপর থেইক্কা কথা কইবা। তোমারে তো নিতে পারি নাই। একটা বইন আছে না তোমার, ওরে নিব আমরা! এখন তো আবার এতিম, বাপহারা তোমরা!”
সৃজা এসব শুনে ক্রোধপূর্ণ চোখে তাকাল, “আমরা বাপহারা না।”
“শোকে আছ তাই কইতাছ! যাইহোক, শোক কাটলে ভাইবা দেইখো, তোমার ছোট বোনটার জন্য প্রস্তাব দিলাম!”
মানুষের কী বিবেক বোধ! একটা মানুষের চলে যাওয়া, কারোও একেবারে সর্বস্ব হারানো, এতিম হয়ে যাওয়া অন্যদের কাছে কিছুই নয়। তারা সবসময় সুযোগ খুঁজে ফায়দা লুটার। সৃজা জ্বলন্ত চোখে তাইব্র গলায় বলল, “বের হোন আপনি, আর কখনো আমাদের বাসায় আসবেন না। বের করার আগে নিজে থেকে বেরিয়ে যান…”
মহিলাটা তৎক্ষনাৎ ফুঁসে উঠে ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে ও সৃজাকে কিছু একটা করতে, ঠিক তখনি কোথা থেকে ছুটে এসে সৃজাকে আগলে নিলো ইহসান। ওর মাথাটা বুকে চেপে রক্তবর্ণ চোখে মহিলার দিকে তাকিয়ে গর্জন করে বলল, “সাহস তো কম না আপনার? আমার শ্বশুরবাড়ি এসে, আমার বৌয়ের গায়ে হাত তুলছেন?”
ইহসান হাতটা মুচড়ে ধরল মহিলাটার। ভয়ে এবং ব্যথায় মহিলা চিৎকার করে উঠল৷ ইহসান ছাড়লো না, আরো কিছুক্ষণ ওভাবে ধরে রেখে মচকে দিয়ে তবেই ছাড়ল! তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“ছোঁকছোঁক করে নষ্ট
ছেলের জন্য মেয়ে না খুঁজে, ছেলেটাকে লবণ খাইয়ে মে’রে দিন। সব জ্বালা থেকে বেঁচে যাবেন!”
“এ আবার কোন নাটক? তোর বউকে মারতে চাইল কেন?”
পেছন থেকে ইজহানের রুক্ষভাষী কণ্ঠস্বর শোনা গেল! তার পাশেই ইস্মিতা বিচলিত মুখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে, তার পাশে শেফালি বুয়া। সেও অবাক! এ বাড়িতে এসেই এমন একটা দৃশ্যের সাক্ষী হতে হবে কল্পনাও করেনি। এদিকে ইজহানের কথায় ইহসান মহিলার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “ফকিন্নি খালাম্মা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলের জন্য বউ ভিক্ষে করে বেড়ায়! আজ মুর্দা বাড়িতেও ভিক্ষে চাইতে এসেছে, তাই না?”
ওদিকে একই চেহারার দু’জনকে দেখে মহিলা স্তম্ভিত! ভয়ে নিজের হাত চেপে ধরে আর্তনাদ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন পাশেরজনকে নিয়ে। ইজহান সেদিকে তাকিয়ে রুষ্ট গলায় বলল, “আসলেই ফকিন্নি।”
[মন্তব্য জানাবেন।]
__
চলবে
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪৪
নাইমুর সাহেবের তেমন কোনো আত্মীয় নেই, যারা আছে তারা সবাই দূরসম্পর্কের। বহুবছর তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। সৃজাদের নানা বাড়ির পরিবারের দিক থেকেও কেউ নেই, সৃজার মা অনিতা রহমানের একজন চাচাতো ভাই ছাড়া। তিনি বেঁচে থাকাকালীন মাঝেমধ্যে যাওয়া-আসা করতো। সৃজারা তখন ছোটো। সপরিবারে তিনি কানাডায় আছেন আজ বারো বছর। দুই ঈদে সৃজাদের জন্য ঈদি পাঠান। এতটুকুই শুধু সম্পর্ক! তাই নাইমুর সাহেবের মৃত্যুতে দেখা গেল দুটো মেয়ে আর একটা বোন ছাড়া তিনি আর কোনো পরিজনই রেখে যাননি, যারা তার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলবে। তবে কোথা থেকে খবর শুনে নাইমুর সাহেবের পুরাতন অফিস কলিগরা এসেছে, আরো এসেছে তাঁর গ্রামের কিছু মানুষ। যাদেরকে সৃজা-এলিজা চেনে না। নীলু বেগম জানালেন তারা গ্রামেরই চেনাজানা। এদের মধ্যে গ্রামের চেয়ারম্যান তার দুই পুত্র নিয়ে জানাজায় অংশ নিতে এসেছেন। অনকক্ষণ যাবৎ ব্যাপারগুলো পর্যবেক্ষণ করে ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিজুকে ফোন করে বলল,
“এই তুই, আমার ডিসেন্ট ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি চলে আয়। ওর শ্বশুরটা ইহলোক ত্যাগ করেছে। কিন্তু আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই। তুই এলে একজন বাড়বে, আয়, দেখে যা!”
ফোনের ওপাশে মিজু বিস্ময় নিয়ে বলল, “ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! কী বলেন স্যার! কখন, কেমনে হলো?”
“ডিটেইলস বলার জন্য ফোন দিয়েছি?”
“না মানে…”
“শোন, অত কথা বলার মতো মুডে নেই আমি। চাকরির ভয় থাকলে চলে আয়, নয়তো থালাবাটি নিয়ে কাল থেকে ভিক্ষে করিস।”
গমগমে স্বরে কথাগুলো বলেই ইজহান ফোন রেখে দিলো। আর স্যারের ফোন পেয়ে ঘন্টাখানিকের মধ্যেই ছুটে এলো মিজু।
.
চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলায় সৃজা শেষবারের মতো আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেও এলিজা এক বুক শূন্যতা আর অশ্রুভেজা চোখ নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল শুধু। বোনকে সামলেছিল নিজে না কেঁদে। তবে বলার মতো কিছুই ছিল না দু’জনের, ছেড়ে যাওয়ার মর্মান্তিক প্রশ্ন ছাড়া! তবে জবাব পায়নি তারা।
মসজিদ থেকে কাঠের খাটিয়া এসেছে। কয়েকজন হুজুর আর এলাকার গণ্যমান্য কিছু ব্যক্তিবর্গও এসেছে। নাইমুর সাহেবকে কাজ বাসার নিচে খোলা এক টুকরো জায়গায় রাখা হয়েছে। শেষ গোসলের পর দাফন-কাফন আর বিদায়ের ব্যপার নিয়ে কথা বলার জন্য ইমাম সাহেব ইহসানকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ইহসানের সুযোগ হচ্ছে না সেখানে যাওয়ার। বাবার নিথর দেহের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর থেকে সৃজা ওকে ধরে অসহায় শিশুর মতো কাঁদছে। এ কারণে ওর গলা বসে গেছে, মাথার তালু অসম্ভব গরম হয়ে উঠছে। কান্নাকাটি করে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ইহসান কোনোমতেই ওকে একটু স্থিতিশীল করতে পারছে না। আদর করে, বকে, ধমকে কিছুতেই না। মেয়েটার মুখে শুধু আব্বুকে নিয়েই কথা।
মর্মান্তিক দৃশ্য, মর্মান্তিক পরিবেশ! ইস্মির মুখ লাল। চোখদুটো ভারী হয়ে এসেছে। জল গড়িয়ে পড়ছে। বাবাহারা মেয়েটিকে কীভাবে সান্ত্বনা দেয়া যায়, সে বুঝে পেল না, তবুও সৃজাকে বোনের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করল। অনাগত বাচ্চাদের কথা ভেবে তাকে একটু স্বাভাবিক হতে বলল, কিন্তু সৃজার কানে কিছুই ঢুকলো না। শেফালি বুয়া পর্যন্ত সান্ত্বনা দিয়ে অনেক বোঝালো, তবে সেসবেও মনোযোগ নেই সৃজার। একপর্যায়ে মানসিক ধকল নিতে না পেরে আবারো অজ্ঞান হয়ে পড়ল। ইহসানের এত অসহায় লাগল যে, বাধ্য হয়ে ইজহান আর রশিদকে ডেকে বলল, সব কিছু সামলাতে। সৃজার দুরবস্থা দেখে ইজহান ভ্রু বাঁকিয়ে বলল, “মাস্টারি কম করে নিজের বউ সামলাও।” বলে এরপর সে নিজে মিজু, রশিদকে নিয়ে দাফন-কাফনের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কথা বলতে গেল। এদিকে ইজহানকে নিজে থেকেই সাহায্য করতে যেতে দেখে ইস্মি খানিকটা স্বস্তি পেল। যাক! মানুষটার বিবেকবোধ আছে তাহলে!
ইমাম সাহেবের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ইজহান উপরতলায় বউয়ের খোঁজ নিতে এলো। এসে দেখলো ইস্মি এখনো বসে আছে সৃজার কাছে, জ্ঞান ফিরেছে ওর। খাওয়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এই ত্যাদড় মেয়ে কিছুই মুখে তুলছে না। শোকে পাথর বনে গেছে। চেহারা এতটুকু হয়ে গেছে, যেন রক্ত নেই! গর্ভাবস্থায় এই বুদ্ধিমতি মেয়ে এখন অবোধ আচরণ করছে? ইজহান রেগে একটা ধমক দিলো সৃজাকে, সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে উঠল সৃজা। ইজহান তা দেখে ঝাঁঝালো স্বরে বলল ওকে, “পেটে টুনটুনির ডিম ছাড়া আরকিছু বড় হবে না। অসভ্য মেয়ে, না খেয়ে কান্নাকাটি জুড়াচ্ছে! এতে কি তোমার আব্বু ফিরে আসবে? মানুষটার এখনো বিদায়ই হয়নি, রুহটাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে শেষ করে ফেলছ তুমি!”
ওর এই আচানক ব্যবহারে সৃজা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এরপর আবারো ফুঁপিয়ে উঠল। ইহসান রাগে কাঁপতে কাঁপতে ইজহানকে ঘাড় ধরে বের করে বাইরে এনে বলল, “তোর কী মাথা গেছে হারামজাদা? ওকে এভাবে ধমক দেওয়ার সাহস পেলি কোথায়?”
“তো কী করব? এভাবে কান্নাকাটি করলে টুনটুনির ডিম ছাড়া আর কিছু দিতে পারবে না তোকে…”
“টুনটুনি মানে…”
ইজহান ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল, “তুই ফোনে বললি না, তোর ডাবল টুনটুনি আসছে…তো ওরা কি না খেয়ে থাকবে নাকি তোর বউয়ের জন্য! যত্তসব…বউকে শাসন কর, আমাকে না ধরে!”
ইহসান রক্তবর্ণ চোখে তাকাল, “নষ্ট কোথাকার!”
“তুই নষ্ট, ছাড় আমাকে! সাধু চেহারা নিয়ে ঘুরিস, ওদিকে বাপও হয়ে যাস! সবই কপি…”
“কার কপি?”
“আমার—আমি বাবা হচ্ছি শুনেই তো লোভে পড়ে গেলি!”
ইহসান ওর লাগামহীন কথায় রেগে গিয়ে চোয়ালে একটা ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বলল, “আমি চেয়েছি, আল্লাহ দিয়েছে৷ তোর থেকে দেখে আমার বাপ হতে হবে, এমন দুর্দিন আমার আসেনি। তাই লজিকলেস কথাবার্তা বলে সিনক্রিয়েট করবি না। ইস্মিতা অনেকক্ষণ যাবৎ না খেয়ে আছে, খেয়াল রাখ গিয়ে। ফালতু যত্তসব…”
বলে ইহসান ওকে ছেড়ে দিলো। ইস্মিতা এতক্ষণ না খেয়ে আছে! ওহ মাই গড! ইজহান শেফালি বুয়াকে ডেকে খাবার রেডি করে দিতে বলে, ইস্মিকে নিয়ে এলো। রুমে ঢুকে দরজা আটকে ফ্রুটসের বাটি সামনে রেখে রাগান্বিত স্বরে বলল, “একজন তো না খেয়ে শুকিয়ে মরছে, আপনিও কী তেমন হবার মতলব কষছেন নাকি?”
একজন বলতে যে ‘সৃজাকে’ বোঝাচ্ছে তা বুঝে বিষম খেল ইস্মি। ও মাথা নেড়ে না না করতেই ইজহান বলল, “একগ্লাস পানিও তো আসার পর থেকে খাওনি, আমি কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যাব, কথা না শুনলে।”
ইস্মি মিনমিন করে বলল, “খেতে ইচ্ছে করছে না।”
ইজহান চোখ লাল করল, “আমি কিন্তু টুনটুনির ডিম চাই না, হৃষ্টপুষ্ট বাচ্চা চাই!”
সৃজাকে এ অবস্থায় দেখে বা ওকে রেখে যদিও কিছুই খাওয়ার ইচ্ছে বা রুচি নেই ইস্মির তবুও হুমকি শুনে অবাধ্য হওয়ার সাহস করল না। কারণ ইজহানের কথা না শুনলে দেখা যাবে, লোকটা রেগে সিনক্রিয়েট শুরু করবে। যার কোনো মানেই হয় না। ইস্মি তাই অনিচ্ছা নিয়েই খাবার মুখে তুলল! ইজহান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, কিছুক্ষণ পর চিন্তিত মুখে ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই বউটার পেটে দুই বাচ্চা, খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক না করলে তো…”
ইস্মি বিরক্ত চোখে তাকাল, “ছিহ! আপনি ওর ভাসুর হোন। কথাবার্তা সংযত করুন!”
ইজহানের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, পরক্ষণেই মুখ কালো করে সে বলল, “আমি কী অসংযত কিছু বলেছি নাকি?”
“কোথায় কি বলতে হয়, এই সেন্স কাজ করে না আপনার?”
ক্ষোভ নিয়ে বলল ইস্মি। ইজহান রেগে গেল, “আশ্চর্য! তুমি এভাবে নিচ্ছ কেন ব্যাপারটা? আমি তো ভেড়ার বউ, পেটে দুইবাচ্চা নিয়ে এত কান্নাকাটি করছে তাই ভাবছি ওর কথা, শত হলেও আমার বিবেক আছে! তুমি আমাকে এখনো এত খারাপ ভাবো!”
রাগে-দুঃখে ইজহানের মাথা খারাপ হয়ে যেতে লাগল। ও এত চেষ্টা করছে, টুকটাক সবার কথাই ভাবছে আর ওর নিজের বউই কি-না ব্যপারটাকে খারাপভাবে নিচ্ছে? এইযে, সে ভেড়ার কথা শুনে, বউয়ের কান্নাকাটি নিতে না পেরে সৃজাদের বাড়িতে ওকে নিয়ে চলে এসেছে এর কোনো মূল্যই নেই? ভালো হয়ে লাভ কি তাহলে? হাত-পা গুটিয়ে ইজহান মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল খাটে। বিছানাটা খুব নরম আর আরামদায়ক। ইজহান চাদর টেনে নিলো গায়ে।
ইস্মি তা দেখে বিস্ময় নিয়ে বলল, “একী, শুয়ে পড়ছেন যে? জানাযায় যাবেন না?”
“কেন যাব? আমি খারাপ, খারাপের নামাজ কবুল হয় না। অহেতুক ভালো মানুষের জানাযায় গিয়ে আমি পাপিষ্ঠ আর তার আযাবের কারণ হতে চাই না।”
ক্ষোভ নিয়ে বলল ইজহান। ইস্মি বাকরুদ্ধ বনে গেল।
সে কী এমন বলেছে যে ফোঁসফোঁস করছে? তখনকার কথার প্রভাবই এটা নাকি? ইস্মি অস্বস্তি নিয়ে উঠে গিয়ে পাশ ঘেঁষে বসলো, আমতা-আমতা করে বলল, “এসব কী অযৌক্তিক কথাবার্তা! খারাপ হলে কি আপনি আমাকে এখানে নিয়ে আসতেন? এত কাজ করতেন আঙ্কেলের জন্য?”
ইজহান তবুও কথা বলল না। সে চোখবুঁজে লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। ইস্মি ভয়ে ভয়ে ওর পিঠ ঠেলে বলল, “উঠুন না।”
“ধাক্কাবে না।”
ইস্মি বিচলিত কণ্ঠে বলল, “মৃত বাড়ি এসে তার জন্য নামাজই পড়লেন না এটা কেমন বিশ্রি ব্যাপার! লোকে কী বলবে!”
গর্জে উঠল ইজহান, “যা বলার বলুক, আমার কারো কথায় কিছু যায়-আসে না। তোমার যায়-আসে, তুমিই ওসব নিয়ে পড়ে থাকো।”
এই লোক বুঝদার নয়, বোঝনোই বৃথা! ইস্মি হতাশ গলায় বলল, “আচ্ছা আমি ক্ষমাপ্রার্থী!”
তীক্ষ্ণ স্বরে বলল ইজহান, “নাটক করো না, তোমার মুখে এক মনে আরেক আজ পরিষ্কার হয়ে গেল।”
“নাটক করছি না, আমি সত্যিই ওভাবে বলতে চাইনি আপনাকে।”
গোমড়ামুখে বলল ইজহান, “ভালো।”
“উঠুন না।”
“সরো।”
ইস্মি এবার অসহায় গলায় বলল, “আপনি কিন্তু আমাকে আবার কষ্ট দিচ্ছেন।”
ইজহান তাও উঠল না, কিছুক্ষণ মূর্তির মতো শুয়ে রইল এরপর একটানে ইস্মিকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। ওভাবেই চুপচাপ শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে ইস্মির হাত টেনে নিয়ে বুকের বা-পাশে চেপে ধরে রেখে বলল, “তোমার ওসব কথা শুনলে আমার কেমন হয় দেখো!”
ওর হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক গতি অনুভব করে ইস্মি মুখ তুলে চাইল, “আপনি এমন কেন?”
“কেমন?”
“পাগল।”
“সত্যিই নাকি?”
“হুঁ।”
সিরিয়াস দেখাল ইজহানকে, “তাহলে তোমার পেটের ভেতরেরটাও তো পাগল বের হবে।”
“সেটা ভেবেই তো ভয় হচ্ছে, দুই পাগলকে আমি সামলাব কেমন করে!”
দ্রুত স্বরে বলল ইজহান, “ওটাকে পাবনায় পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়?”
“ছিহ! আপনি এত হিংসুটে!”
চোখ পাকিয়ে ফেলল ইস্মি, দেখে ইজহান কাঁচুমাচু করল, “হিংসার কী দেখলে এখানে? দুই পাগলকে সামলাতে কষ্ট হবে, তাই সমাধান দিলাম।”
“তাহলে আপনাকে রেখে আসলেই হবে৷”
ইজহান বিস্মিত ও রুষ্ট, “আমাকে কেন?”
“কারণ আপনি বড়ো। আর যে আসবে সে ছোটো!”
“আমি তাহলে ছোটো হয়ে যাই ইস্মিতা?”
“তাহলে তো আপনাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে হবে।”
“ছিহ!”
“একটা কাজ অবশ্য করা যায়, আপনি আর আপনার পাগল বাচ্চা, দু’জনকে দু’জনকে নিয়ে থাকবেন, আমি কোথাও চলে যাব। এত পাগল সামলানো আমার কাজ না।”
ইজহান মুখ গোঁজ করে ফেলল, “পা ভেঙ্গে রেখে দেব। কোথাও যাওয়া চলবে না।”
ইস্মি এবার হাসলো, “রাগ কমলো?”
“হুম।”
“ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসেও আপনার এমন করতে হয়? একটু বুঝদার হতে পারেন না? কীভাবে এতবড় অফিস সামলান আপনি?”
ভ্রু কুঁচকে ফেলল ইজহান, “ডাউট আছে নাকি তোমার?”
“থাকার কথা নয়?”
বৌয়ের বলার ধরণ দেখে ইজহান হুট করেই হেসে ফেলল। ইস্মি তাকিয়ে দেখল সেই হাসি–এত মনোমুগ্ধকর! এভাবে হাসে কেন লোকটা? জানে না, এভাবে হাসতে দেখলে ভয় হয় ইস্মির,
বড্ড বুক পুড়ে! ইস্মির হঠাৎ করেই চোখের কোণে পানি জমলো। ইজহানের বুকে মুখ ঢুকিয়ে লুকিয়েও ফেলল তা। বলল, “উঠুন এবার, দেরি হয়ে যাচ্ছে। নামাজে যেতে হবে।”
“জানাজা পড়তে যাওয়ার আগে একটা চুমু চাইলে কি পাপ হবে?”
ইস্মি ঠোঁটদুটো ওর কপালে চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলল, “এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে পাপ হবে না।”
.
জানাযা পড়াতে লা’শ নিয়ে বেরুতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ইহসান ইস্মি আর শেফালি বুয়াকে সৃজার ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেল। এলিজাকে ডাকতে গেল, কিন্তু মেয়েটা ফুপির কাছেই বসে রইল। বাবাকে বিদায় দিতে গেল না। নিচ তলার ভাড়াটিয়া মহিলাকে এলিজার কাছে থাকার অনুরোধ করে ইহসান হতাশ হয়ে চলে এলো। সিঁড়িঘর দিয়ে নামার সময় ইজহান খোঁচা দেওয়া কণ্ঠে বলল,“এই বাড়িতে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে!”
ইহসান ওর দিকে রক্তবর্ণ চোখ করে তাকাল,
“তাহলে চলে যা!”
মুখ ঝামটা দিয়ে ইহসান নেমে গেল। ইজহান সেদিকে কটমট করে তাকাল। ভেড়াটা এখানে এসেও তাকে অপমান করেই যাচ্ছে! এর শোধ সে সুযোগ পেলেই নেবে। সে রাগ সামলে পকেট থেকে টুপিটা মাথায় পরলো, জানাজার নামাজে গিয়ে সে দাঁড়ালো ইহসানের ঠিক পাশেই। আশেপাশে যারা ছিল তারা অবাক হয়ে কানাঘুষা শুরু করল, একই চেহারার দুটো ছেলে, এতক্ষণ তাহলে তারা কে, কার সাথে আলাপ করেছে? নাইমুরের মেয়ের জামাইয়ের সাথে, নাকি মেয়ের ভাসুরের সাথে? আশ্চর্য!
.
শেষ বিকেল! দাফনকাজ সম্পন্ন করে ইজহানের উপর একটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে রশিদকে নিয়ে ইহসান কোথায় একটা কাজে গেছে। আর খতিবের সাথে কথা বলতে ইজহান এসেছে মসজিদে। এখানে আরো কয়েকজন মুরুব্বি গোছের লোক, তারা বারবারই ওকে ইহসানের সাথে গুলিয়ে ফেলছে। জামাই ডাকছে। ইজহান কয়েকবার ভুল শুধরে দিয়েছে, তবুও কাজ হচ্ছে না। নাইমুর সাহেবের গ্রামের চেয়ারম্যান লোকটা তো এসে রীতিমতো ওকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেলেছে, “জামাই বাবাজি! নাইমুরের সব মেয়েদেরই কী বিয়ে হয়ে গেছে?”
“না। একজনের হয়েছে শুধু!”
“তো আর একজন বাকি?”
“জি।”
বিরক্তি নিয়ে কথাটুকুর উত্তর দিয়েই সে চলে এসেছিল ওখান থেকে। কিন্তু খতিবের সাথে কথা বলে মসজিদের বাইরে এসে জুতো পায়ে দেওয়ার সময় গাড়ির চেয়ারম্যানের একটা ছেলে এসে ওর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলো। এক কথা, দুই কথা বলার পর লাজুক হেসে বলল, “জানি এসময় কথাটা বলা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু আপনিই তো এখন ওদের অভিভাবক, তাই বলছি, আপনার ছোট শালির হাত যদি দিতেন…কথা দিচ্ছি খুব ভালো রাখব।”
“ছোট শালির হাত দেব মানে?”
“মানে বিয়ে!”
ইজহান তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে।
ছোট শালি বলতে যে, সৃজার বোন এলিজাকে বোঝাচ্ছে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো ইজহানের। সে ছেলেটার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে এরপর আগাগোড়া জহুরি চোখে পরখ করে জিজ্ঞেস করল, “যোগ্যতা?”
“লন্ডনে এমবি-এ করছি!”
“বউ নিয়ে রাখবে কোথায়?”
“লন্ডনে।”
ইজহান প্রশ্ন করল, “বয়স কতো?”
“আঠাশ।”
“সরি, হবে না।”
“কেন? আমার বয়স বেশি?”
ইজহান শক্ত গলায় বলল, “হু, সাথে বিবেক বুদ্ধিও কম, হাঁটুর নিচে।”
ছেলেটা থতমত খেয়ে বলল, “কেন এমন মনে হলো?”
তীক্ষ্ণ গলায় বলল ইজহান, “মুর্দা বাড়িতে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেয় না।”
“কিন্তু… ”
“তাছাড়া এ বাড়ির মেয়েরা খুব দামী, তোমার মতো যে, সে এসে ভিক্ষে চেয়ে বেড়ায়, কতক্ষণ আগেও একজন চেয়ে গেল। সেটাকেও রিজেক্ট করেছে আমার ভাই!”
“আপনার ভাই, সে কেন?”
ইজহান কিড়মিড় করে বলল, “কারণ শালিটা আমার না, আমার ভাইয়ের। তবে যেরই হোক না কেন, মেয়ে বিয়ে দেওয়া হবে না। আর এসব অবান্তর কথাবার্তা বলে পরিস্থিতিটাকে জলঘোলা করবে না। ওয়ার্ন করে দিলাম।”
ছেলেটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কতক্ষণ হা করে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর লজ্জিত ভঙ্গিতে চলে গেল। ইজহান সেদিকে তাকিয়ে গালি ছুঁড়ল কয়েকটা। সুযোগসন্ধানী গুলা সব জায়গায়ই স্বার্থ খুঁজে বেড়ায়, মরা বাড়িটাকেও ছাড়ল না, এখানে এসেও মেয়ে দেখাদেখি করছে ইতরের দল! ইজহান থু থু ফেলল ঘৃণায়! তবে সৃজাদের বাড়ি ফেরার পর, আবারো, সেই ছেলেটাই এদিকওদিক ঘুরঘুর করতে করতে এক পর্যায়ে ইজহানের কাছে এলো। ইজহান তখন গেইটের কাছে মিজুর সাথে দাঁড়িয়ে পরদিন লোক খাওয়ানোর কাজ নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত! ছেলেটা পেছন থেকে ডেকে বলল, “একটু কথা বলা যাবে ভাইয়া?”
ইজহান পেছনে ফিরে তখনকার সে চেংড়া টাকে
দেখে ভ্রু উঁচিয়ে চাইল। ভেতরের বিরক্তিটা বুঝতে দিলো না। বলল, “হুঁ।”
আগের মতোই গাঁইগুই করে বলল, “ইয়ে মানে কীভাবে যে বলি, মানে এ পরিস্থিতিতে… জানি এখন বলা ঠিক হবে না, কিন্তু না বললে পরে আর সুযোগ পাব না তাই এখনি বলছি…”
ইজহান রাগান্বিত গলায় বলল, “দেশ-বিদেশ না ঘুরিয়ে এনে সোজাসাপটা বলে ফেলো!”
ছেলেটা ভদ্রতাসূচক হেসে একটু আগে যা যা বলেছিল, সেগুলোই আবার বলল ইজহানকে। শুনে মাথাটা গরম হয়ে গেল ওর। মানে কী, একবার না করে দিলো এরপরেও এই ছোকরা শালি চাই, শালি চাই করছে? নষ্ট ছেলে কোথাকার! ইজহান ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলো ওর গালে। মিজু আঁৎকে উঠে বলল, “স্যার কী করেন? লোকজন আছে তো!”
ইজহান রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এই শালা ইতরটার মরা বাড়িতে এসে বিয়ে শখ জাগছে! একে গেইটের বাইরে বের করে দিয়ে আয়। তখন থেকে আমার মাথা খাচ্ছে! গরুবলদ কোথাকার!”
ছেলেটা আকস্মিক চড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল স্টাক হয়ে। ইজহানের তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনে, এবার সে অপমানিত বোধ করল! তেজদীপ্ত গলায় সে বলল, “আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন!”
“তোর অপমানবোধও আছে?”
ইজহান দ্বিগুণ তেজ নিয়ে তাকাল ছেলেটার দিকে। ওর চোখ দেখেই গলা শুকিয়ে গেল ছেলেটার, আমতাআমতা করতে করতে বলল, “আমি শুধু
বিয়ের প্রস্তাব দিব, তাই ফোন নাম্বারটা চাইতে এসেছিলাম…”
“শালা ইতর! সাহস তো কম না, আবার ফোন নাম্বার চাইছিস, একবার বলার পরেও কানে যায় না কথা? বাংলা বুঝিস না? তোকে রিজেক্ট করলাম তখনও, এখনও৷ এরজন্য আমার ভাইয়ের অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন নেই…”
ইজহান খ্যাঁকিয়ে উঠে ছেলেটার শার্টের কলার ধরে গেইটের বাইরে বেরিয়ে এলো, পরপর কয়েকটা ঘুষি বসালো পেটে। অশ্রাব্য গালিতে কান ঝালাপালা করে দিলো। কঁকিয়ে উঠে ছেলেটা বলল, “আর প্রস্তাব দিব না ভাই, আর বলছি না, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাচ্ছি…”
মিজু হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে। তার পল্টিবাজ স্যার নিজের কীর্তি ভুলে গেছে কী, যে এত নীতিবান মানুষের মতো কথা বলছে? নিজেই তো জোর করে ম্যাডামকে তুলে এনে বিয়ে করেছে, কত অত্যাচার করেছে, এখনো করছে…অথচ এখন দেখো, বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় কীভাবে মারল ছেলেটাকে! সে ছুটে এসে থামালো ইজহানকে, “স্যার, ছেড়ে দেন! অহেতুক একটা ঝামেলা হয়ে যাবে!”
ইজহান শেষমেশ ছেলেটার পশ্চাৎদেশে একটা লাথি মেরে সেখান থেকে চলে এলো রাগে গজগজ করতে। নাইমুর সাহেবের জানাজাতে যারা এসেছিল তারা তখন বিদায় নিচ্ছে, অনেকেই তাকে জিজ্ঞেস করল কেন সে এভাবে রেগে আছে। সব প্রশ্নের উত্তর মিজু কৌশলে সামাল দিলো।
.
মাগরিবের নামাজ শেষ করে এলিজা বসে আছে।
তার পাশেই ইস্মি বসা। বসে কথা বলছে। এলিজাও টুকটাক জবাব দিচ্ছে। তবে ইস্মি লক্ষ্য করল, এলিজা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তবে উপরে উপরে নিজেকে শক্ত দেখালেও, বাবার জন্য ভেতরে ভেতরে সে গলে যাচ্ছে, কিছু প্রকাশ করছে না সেটাও ধরতে পারল ইস্মি। ওর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো!
ফ্ল্যাটে এসে ইজহান ইস্মিকে খুঁজে পেল ভেতরের একটা ঘরে। ইজহানের রাগ শান্ত হলো ইস্মিতাকে দেখেই। কী সুন্দর, বুঝদারের মতো বুঝাচ্ছে ভেড়ার শালিটাকে! ইজহান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলো কিছুক্ষণ! বাঁকা চোখে দেখল এলিজাকে। মেয়েটা দেখতে সুন্দরী, মিষ্টি হলেও চোখদুটো খুব তীক্ষ্ণ। কপালের কাছে, গালের বা-দিকে দুটো কাটা দাগ, অথচ কী নিঁখুত! এই মেয়ের জন্যই আজ এত এত বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, এই মেয়ের জন্যই সে একটু আগে একটা বদমাইশকে পিটিয়ে এসেছে, অথচ আসার পর এলিজার সাথে তেমনভাবে কথা বলা হয়নি। সে আসলে তেমন সহজও নয় যে হুটহাট কোনো মেয়ের সাথে মিশে যাবে! এলিজাকে পরখ করে ছোটবোন পুনমের কথা মনে পড়লো ইজহানের, সালেহা বেগমের একমাত্র মেয়ে, তার সৎবোন! কিন্তু ভীষণ আদর করতো সে! অথচ বাবা এমন একটা কাজ করল—অল্প বয়সে মেয়রের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো! সবই ঐ ফুপুর ছেলে অনিক কুত্তাটার জন্য! আর পুনমও! বাবার উপর রাগ, অভিমান নিয়ে মেয়েটা এখন তাদের সাথে কথাই বলে না। ইজহান মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ এলিজার মুখটা বড্ড পরিচিত ঠেকল ইজহানের। কিন্তু মনে করতে পারল না এই মেয়েকে সে কোথায় দেখেছে! ইস্মির ডাকে ওর ঘোর কাটলো, “কখন ফিরলেন? এখানে আসুন! মিষ্টি মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
ইজহান বাধ্য স্বামীর মতো এগিয়ে গেল, অস্বস্তি নিয়ে টুকটাক কথা বলল, পরিচিত হলো এলিজার সাথে। কষ্টে থাকলেও বাড়ির মেহমান, হাজার হোক ইহসান ভাইয়ার ভাই-ভাবি! দুঃখে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে! ইস্মি ভাবি ওকে বোনের মতো বোঝাচ্ছে, এলিজা ইজহানের দিকে তাকিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, “আপনি আসলেই ঠিক দেখতে ভাইয়ার মতো, কিন্তু কথা বলার সময় বা-হাতটা বেশি নাড়ান। এটাই আপনাদেরকে আলাদা করার চিহ্ন, তাই না!”
ইস্মির সাথে সাথে ইজহানও আশ্চর্য হয়ে গেল৷ এটুকু সময়েই মেয়েটা পরখ করে ফেলল, বাহ! সে অপ্রস্তুত গলায় বলল, “তুমি..তুমিও দেখতে আমার এক পরিচিতজনের মতো… ”
“পরিচিত জনটা কী আপনাদের ম্যাম, অনিতা রহমানের মতো? তাহলে ঠিক আছে, আমি দেখতে আমার মায়ের মতোই অনেকটা!”
বলে এলিজা মিষ্টি করে হাসলো। ইজহান তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। অবাক, বিস্মিত সে। অনিতা মিস! হ্যাঁ, তাদের কলেজের ফিজিক্স টিচার অনিতা মিসের মতোই দেখতে এই এলিজা! কিন্তু… তার মানে? তার মানে ইহসান ভেড়াটার শ্বাশুড়ি অনিতা মিস! আর মিসের বড় মেয়ে সৃজা? ইজহানের কাছে সব গোলমেলে লাগল! ভেড়াটার এত সাহস! ঝামেলা কাঁধে নিয়ে ঘুরছে? আর বাবা— আজিজ শেখ জানে কী! অবশ্যই জানে! ইজহান ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অস্থির ভঙ্গিতে ইহসানের অপেক্ষা করতে লাগল! ফোনও করল কয়েকবার। আধঘন্টার মাথায় ইহসান ফিরতেই ইজহান শক্তমুখ করে ওর সামনে দাঁড়াল, “তুই অনিতা মিসের মেয়ের জামাই? অনিতা মিসের মেয়েকে বিয়ে করেছিস?”
ফিরেই ভাইয়ের অবান্তর প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হলো ইহসান, “তাতে তোর এত ফাটছে কেন?”
বলে ওকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল, ইজহান ওর পিছু পিছু এসে বলল, “ফাটবে না কেন? ঐ মহিলা আমাকে মেরেছিল, ক্লাস বাঙ্ক দিয়েছিলাম বলে। ভুলে গেছিস তুই?”
“বেশ করেছিল!”
“হারামি!”
মেজাজ খারাপ করে বলল ইহসান, “দেখ মাথা গরম করবি না, বাচ্চাদের মতোন বিহেভ করা বন্ধ কর!”
ইজহান ঠোঁট উল্টালো, “করলাম না হয়! কিন্তু ঐ ব্যাপারটা? এক্সিডেন্ট! তোর বউ যখন জানবে তোর ভাই এ কান্ডে জড়িত, আর তুই এটা জানিস, তোকে
ও ছেড়ে দেবে? তোর টনা-মনাকে নিয়ে, ডিভোর্স
দিয়ে চলে আসবে।”
কথাগুলো শুনে তৎক্ষনাৎ ইহসানের মাথা গরম হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে পেছনে ফিরে ওর পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে পাশের বারান্দায় নিয়ে এসে পেটে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে রক্তচক্ষু মেলে, গর্জে উঠল চাপা গলায়, “একজনের পা’পের শাস্তির ভাগীদার আমি কেন হব? আমি হব না।”
[মন্তব্য জানাবেন আজকে।]
______
[রি-চেইক বিহীন পর্ব! বড়ো করে দিলাম, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…