অশ্রুবন্দি পর্ব-৬১+৬২

0
2

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬১

পুরো একটা রাত ছেলেকে ছাড়া কাটিয়ে সকালবেলা যখন বাচ্চাকে কোলে পেল, সৃজা বুকে নিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে ইহসানকে জ্বালাতে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, “আমার পুঁচকুকে কে বেশি যত্ন করেছে? বড়ো আব্বা? নাকি নিজের আব্বা? তোমার আব্বাজান তো আজকাল বউটারই যত্ন নেয় না, মেয়ে ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। নিশ্চয় বড়ো আব্বাই তোমার বেস্ট টেক কেয়ার করেছে? তাই না?”

ইহসান বাচ্চাদের খাবার প্রস্তুত করছিল, সৃজার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। তবে কিছু বলল না। আস্তেধীরে ফিডার তৈরি করে বাচ্চাদের মুখে দিয়ে সৃজার গা ঘেঁষে বসলো। এরপর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তো? মায়ের যত্ন কীভাবে নিলে সে খুশি হবে
জানতে পারি কী?”

কণ্ঠের শীতলতা বুঝে সৃজা বিস্মিত হলেও তড়িঘড়ি করে বলল, “এত জেনে কী কাজ?”

“অভিযোগ যখন এসেছেই তখন নিজেকে শুধরে নেওয়াটাই উত্তম কি না? আমি দিনদিন নিজেকে শুধরে নিচ্ছি, নেওয়ার চেষ্টা করছি। সবার আবদার, কথা রাখার চেষ্টা করছি। সবারটা যখন রাখছিই তোমারটা বাদ দেব কেন? আফটার অল, আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি, আমার বাচ্চাদের
মা তুমি! ”

‘তুমি’ সম্বোধন শুনে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকা সৃজা বিপদ বুঝে এ পর্যায়ে উঠে যেতে চাইলে ইহসান একটানে নিজের উরুর উপর বসিয়ে দিলো সৃজাকে। ছোটাছুটি করে ব্যর্থ হয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় মেয়েটা বলল, “আমাকে ছাড়ো। বাচ্চাদের খেয়াল রাখো গিয়ে। ওরা দেখছে…”

ইহসান ওর কথার পরোয়াই করল না। গম্ভীরমুখে বলল, “দেখুক ওরা, ওদের আব্বা কীভাবে ওদের আম্মাকে আদর করে। এখন তুমি নিজেরটা বলো, কী চাই তোমার? স্বামীর ক্রেডিট কার্ড না কি তার উদোম বুকের ঊষ্ণতা? যেটা চাও সেটাই পাবে।”

উত্তপ্ত গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ে পড়ছে সৃজার। ঠোঁটের ছোঁয়াও পড়ছে। ছোট্ট ছোট্ট আদুরে ছোঁয়ায় বেসামাল হয়ে উঠা সৃজা দূরে সরে যেতে চাইল কিন্তু দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যাওয়া ইহসানের সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠল না৷ বলিষ্ঠ পুরুষালি বক্ষের নিচে চাপা পড়ে গেল নিমিষেই। সৃজার যখন একেবারে নাজেহাল অবস্থা, তখনই ওকে ছেড়ে দিলো ইহসান। পরণের পোশাক ঝেড়ে ঠিকঠাক করে নিয়ে, চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে একদম সাধু পুরুষের মতো বাচ্চাদের যত্ন নিতে লাগল সে। সৃজা কটমট করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। অথচ ইহসান এমন একটা ভান করল যেন সে একজন সাধু পুরুষ, সৃজাকে কিছুই করেনি।
সৃজা রাগে-দুঃখে কাঁচি দিয়ে ওর শার্ট কুচি কুচি
করে ছিঁড়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আজিজ শেখ তপ্ত মেজাজে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছিলেন পুকুর পরিষ্কার করা নিয়ে। ক’দিন পর নাতিদের জন্য একটা গ্র‍্যান্ড পার্টির আয়োজন করবেন তিনি। এখন থেকেই তা-ই হরস্থুল শুরু করেছেন। দারোয়ানকে তিনি আগাছা কাটতে বলেছিলেন, কিন্তু দারোয়ান এখন অবধি
সেটা করেনি দেখে ঝাড়ছিলেন, ঠিক তখনি সফেদ রঙা কাপড়ের কতগুলো ছেঁড়া কাটা অংশ, সুতো তার মাথায় এসে পড়ল! আজিজ শেখ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন এ কাজে। দারোয়ান তো অবাক হয়ে বলেই ফেলল, চাঁদের বুড়িমা সুতা উড়াচ্ছেন। এই সুতা যখন একবার কারো গায়ে লাগে, তার অতিসত্ত্বর বিবাহ নিশ্চিত!

আজিজ শেখ বুঝে পেলেন না এটা কী হলো? কোথা থেকে এই সফেদ কাপড়ের আমদানি? আর তার মাথায়ই এসে কেন পড়ল? সকাল থেকেই যত্তসব বিরক্তিকর কাজকর্মে বাঁধা পড়ছেন তিনি। প্রথমে তো পটিভরা কাপড় নিজ হাতে তুলেছেন এখন আবার কোথা থেকে কীসব এসে মাথায় পড়ছে! মেজাজ খারাপ করে তিনি দারোয়ানকে প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বললেন, “অতিসত্বর তোর বিবাহ নিশ্চিত, আমি নিশ্চিত করমু হারামির পুত্! তোর তেত্রিশ হালি দাঁতের খিটখিটানি আমি তোর পেছনে ভরে দিমু।”

দারোয়ানের হাসি ওখানেই থেমে গেল এবং আজিজ শেখ তার মুখে সফেদ কাপড়টা ছুঁড়ে মেরে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।

°

বাচ্চাদের আগমন ও তাদের সুস্থ হয়ে উঠা উপলক্ষে ইহসান তার কাছের কিছু মানুষদের নিয়ে ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে ভেবেছে। যেখানে থাকবে একান্তই তার কাছের মানুষজন। কাকে কাকে ইনভাইট করা হবে সেই নিয়ে যখন আলোচনা চলছিল তখন সৃজা পুনমের নামটা বিশেষভাবে উল্লেখ করল। কারণ ও নিশ্চিত, ভাইয়েরা সালেহা বেগমকে যে চোখেই দেখুক না কেন; পুনমকে বোনের চোখেই দেখে। পুনমের প্রতি তাদের রুষ্টতা নেই, যেটা আছে সেটা স্নেহ। তাই বড়ো ভাই হিসেবে ইহসানের উচিৎ বোনের অভিমান ভাঙিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান হবে সেখানে পুনম না থাকলে সালেহা বেগমের নিশ্চয় ভালো লাগবে না। সে তো দেখে, সালেহা বেগম কতটা দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। স্বামীর সবকিছু মুখবুজে মেনে নিয়ে সংসার সামলাচ্ছেন একা হাতে। কখনো মুখফুটে নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথাও বলতে গেলেও পারে না। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে৷ বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনের মধ্যে আছেই একটা মাত্র মেয়ে তার, অথচ তাকে কাছে পাচ্ছে না, চোখের দেখা দেখতে পারছে না এটা যে কতোটা যন্ত্রণার মা হওয়ার পর থেকে প্রতি পদে পদে সৃজা সেটা টের পাচ্ছে। সৃজা এটা জেনেও অবাক হয়েছে যে, পুনমের ছোটো ছোটো দুটো ছেলে আছে অথচ সালেহা বেগম না কি এখনও নিজের নাতিদের দেখতেই পারেননি! তাই বাড়িতে যখন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছেই, সবাই যেহেতু আসবেই পুনম কেন বাদ থাকবে? তাছাড়া ননদের সঙ্গে ইস্মির পরিচিতি থাকলেও সৃজার সঙ্গে তো আলাপন হয়নি পুনমের! এলিজা যেমন ওর ছোটোবোন পুনমও তো ওর কাছে সেরকমই। তা-ই সৃজা ইহসানকে খুব করে অনুরোধ করল, পুনমকে যাতে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। ইহসান ওর আবদারে সায় জানালেও সে দ্বিধায় ছিল, পুনম আসবে কি না এ ভেবে! এর আগে অনেকবার সে পুনমকে বাড়িতে ফেরানোর চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু তাদেরই তো জেদী বোন! মেয়েটা আসেনি মানে আসেইনি। শত বলে-কয়ে, আবদার করেও এ বাড়িমুখো করতে পারেনি মেয়েটাকে।
পুনমের মেয়র শ্বশুর সৈয়দ আসাদউল্লাহ গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। পরপর মৃত্যুবরণ করেন শ্বাশুড়ি রাবিয়া সুলতানাও। এখন পুনম তার স্বামী-সন্তান, ছোট দেবর, তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যৌথভাবে বসবাস করছে সংসারের পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। এসব রেখে মেয়েটা যে আসতে চাইবে না সেটা জানতো ইহসান। তবুও পরদিন ইজহানকে টেনে-হিঁচড়ে পুনমের বাড়ি নিয়ে গেল সে। ভরদুপুরে দুই ভাইকে দেখে পুনম বিস্মিত হবার সুযোগ পেল না, কান্নাকাটি করে একাকার হলো। ইজহান বোনের
কান্না দেখে তাকে ন্যাকু বলে কতক্ষণ ক্ষেপাল। ইহসান ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বিয়ের পর রাগ করে নিজের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া বোনের রাগ ভাঙাতে বসল। তার সৃজার কথা, দুটো চাঁদপাখির কথা, আরেকটা চাঁদপাখির আগমনের কথা শুনে পুনমের খুব ইচ্ছে হলো সবাইকে দেখতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু ইজহান সাফ সাফ মানা করে দিলো, বাড়িতে গেলেই সে তার টনা-মনাকে দেখতে দেবে। বাইরে থেকে কাউকে সে এলাউ করবে না। বদনজরের একটা ব্যাপার আছে তো না কি? ইহসান ওর কথায় বিরক্ত হলেও ফোন বের করে বাচ্চাদের ছবি দেখাল, সৃজার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলো। ইস্মিও কথা বলল। বারবার করে পুনমকে বলল বাড়িতে ফেরার কথা! ফোনে সৃজা-ইস্মিতার সঙ্গে কথা বিনিময়ে ব্যস্ত ইহসান আর পুনম। এদিকে ইজহান একপাশে বসে গম্ভীরমুখে বসে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে পুনমের দুটো ছেলেকে। একজনের তিন বছর, আরেকজনের দেড় বছর। অথচ এতো কম কথা বলা, এতো শান্ত কোনো ছেলেবাচ্চা ইজহান আদৌ দেখেনি। আসার পর থেকেই ও দেখে যাচ্ছে, পুনমের ছেলেগুলো বুঝদার বাচ্চাদের মতো কোনো শব্দ না করে, চেঁচামেচি না করে খেলা করছে। অথচ তার টনা? ৭ সপ্তাহ বয়স অথচ কোলে উঠালেই গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, বমি করছে, হিসু করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাকে নয়, আজিজ শেখের কোলে উঠলেও টনাটা এরকম করছে। হাগুমুতু করে জামাকাপড় নষ্ট করে দিচ্ছে। ইজহান পুনমের বড়ো ছেলেটাকে কাছে ডেকে এনে উরুতে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর নাম কী রে?”

আধো আধো বুলিতে বাচ্চাটা নিজের নাম বলল, “শারাফ তাশফির।”

“কে রাখল এমন একটা নাম?”

“পাপা।”

“নামের মিনিং কী?”

“পজিটিভ প্রাইড।”

তিন বছরের একটা বাচ্চা নিশ্চয় তার নামের অর্থ জানবে না। বা জানলেও ঠিকঠাকমতো বলতে পারবে না এটাই ভেবেছিল ইজহান। কিন্তু শারাফের মুখে ইংরেজিতে ওর নামের অর্থ শুনে ইজহান পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে গেল। অবাক ভঙ্গিতেই সে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল, “তোর ভাইয়ের নাম কী?”

“শামির তাশফির, মানে শার্প স্টোন।”

তিন বছর বয়সে ইজহান নিশ্চয় নিজের নামটুকুও বলতে পারতো না অথচ শারাফের পরিণত কথা আর বিনয়ী ব্যবহার দেখে সে থমকে গেছে। তিন বছরের শিশুর মুখে এমন মধুর ভাষা, এমন স্মার্টনেস—কে বিশ্বাস করবে? তখন তো দেখল, একা একাই হিসু করে এসে প্যান্টের জিপার একা একাই টেনে লাগিয়েছে। পুনম ছেলেটাকে কীভাবে এতো বুদ্ধিমান বানাল? নাহ! টনাটাকেও এ বয়স থেকেই সব ট্রেনিং দিতে হবে। ম্যানার্স শেখাতে হবে, ঘটে বুদ্ধি ঢুকিয়ে পরিপক্ব বানাতে হবে। নয়তো লোকের কোলে হাগুমুতু করা ছাড়া আর কিছু শিখবে না। ইজহান শারাফের গাল টেনে দিলো, “বাহ! কে শিখিয়েছে রে এসব তোকে?”

“মাম্মা পাপা।”

“আমি কে হই বল তো!”

“মামা হও।”

ইজহান শারাফের গাল টেনে দিলো, “সব জেনে বসে আছিস ব্যাটা, গ্রেট গ্রেট!”

“হু, মাম্মা বলে আমি খুব ট্যালেন্টেড বাচ্চা।…”

“তোর মাম্মা ঠিকই বলে।”

বলে ইজহান ওর নাক টেনে দিয়ে ছোটোজনকে ডেকে ওকেও কোলে নিয়ে বসাল। ছোটটা যদিও ভালোভাবে কথা বলা শেখেনি তবুও এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে দু’জনের পছন্দ-অপছন্দ সব জেনে নিলো ইজহান। মিজুকে কল করে বলে দিলো সবকিছু নিয়ে আসতে। বাচ্চারাও মামার সাথে খুব মিশে গেল। কে, কোন সুপারহিরোকে নিজেদের আইডল মানে সেটা নিয়েও গল্প হলো। নিজের পালা এলে ইজহান বলল, ইস্মিতা নামক সুপারহিরোইন ছাড়া অন্য কোনো সুপার হিরোইনকে তার পছন্দ না। বাচ্চারা অবাক হয়ে মামার নিজস্ব সুপার হিরোইনকে দেখতে চাইলে ইজহান বলল, শেখ বাড়িতে চল। তখন দেখতে পাবি। নয়তো দেখা যাবে না। তোর সান মামা, আমারও দুটো চাঁদপাখি আছে। নানী বাড়ি গেলে ওদেরও দেখতে পাবি। জলদি জলদি যাবি কিন্তু!

শারাফ মাথা নাড়ল, সে জলদি জলদিই নানী বাড়ি গিয়ে মামার সুপার হিরোইন আর চাঁদপাখিদের দেখে আসবে। শামির কিছু না বুঝলেও সেও ভাইয়ের দেখাদেখি মাথা নেড়ে রাজি হলো।

এদিকে মামা-ভাগ্নের মিল-মহব্বত দেখে, ইজহানের কথা শুনে বিস্মিত পুনম ইহসানকে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া আসলেই এতো বদলে গেছে? বাচ্চাদের সঙ্গে এভাবে মিশে যেতে শিখেছে? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

ইহসান ভাইকে একপলক দেখে নিয়ে হাসলো, “না শিখলে বউ থাকবে? বউকে আটকে রাখার জন্যই তোর ভাইয়ের এমন বদল। বাড়িতে চল, আরো কত, কী দেখবি! আমার বাচ্চাদের তো আমিই কাছে পাই না এরজন্য। কোলে নিলেই এসে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাতে রেখে দিচ্ছে, ঘরভর্তি করে খাবারদাবার, খেলনাপাতি কিনে আনছে…”

পুনম অবিশ্বাস্য গলায় বলল, “আসলেই?”

“হুঁ, আসলেই। আমি এখনো দ্বিধাদ্বন্দে ভুগি, ও যদি এতোই ভালো বাবা হবে, তো সেবার কেন ওরকম একটা কান্ড করল? বাচ্চাটা এলে, ইস্মিতার সঙ্গে সম্পর্কটা আরো আগেই স্বাভাবিক হয়ে যেতো। এ নিজের দোষেই বাচ্চাটাকে হারিয়ে এখন দেখ, অন্যের বাচ্চাদের জন্য কতোটা পাগল! ট্রেনিং পর্যন্ত নিচ্ছে কীভাবে বাচ্চা সামলাতে হয়, বুঝলি! যাক, দেরিতে হলেও যখন বোধবুদ্ধি উদয় হয়েছে, ভালো থাকবে এটাই আশা করি।”

ইহসানের মুখে কথাগুলো শুনে পুনম সত্যিই পুলকিত হলো। মনে মনে সেও প্রার্থনা করল তার এই আধপাগল ভাইটা যাতে সবসময় এমনই থাকে, আজকের মতো। আগেরবারের মতো যাতে বদলে না যায়! ঐ ইন্সিডেন্টটা মনে আছে পুনমের, বাচ্চা হারানোর পর ইস্মি যখন বাপের বাড়ি চলে গেল…একটা ভাতের দানাও গলা দিয়ে নামাতো না ইজহান। ঘর অন্ধকার করে বসে থাকতো। বাইরে বেরুতো না। আজিজ শেখ জোর করেও ওকে চৌকাঠ মারাতে পারেননি। শেষে তো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো! পুরোনো কথাগুলো ভেবে পুনম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইহসান তাড়া দিলো চলে যাওয়ার জন্য। তাকে আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে, কাজ আছে। বাড়িও ফিরতে হবে দ্রুত। পুনম অবশ্য ছাড়ল না ভাইদের, দুই জা মিলে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিলো জোর করে। বিদায়ের পূর্বে ইহসান বারবার করে বলল, সে নিজে এসে ইনভাইট করেছে পুনম যাতে তার মান রেখে দু’দিন পর অবশ্যই অবশ্যই বাড়িতে যায়। নয়তো চড়িয়ে তার গাল লাল করে দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানই করা হবে না। ইজহান তো রীতিমতো হুমকি দিয়েছে, পুনম যদি স্বেচ্ছায় না আসে তার টনা-মনার অনুষ্ঠানে, তাহলে তাকে তার দুই ছেলেসহ তুলে নিয়ে যাবে। নিজের রগচটা ভাইদের হুমকিধমকি শুনে পুনম হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেল না। তবে সত্যিই ওর ইচ্ছে করল নতুন মানুষগুলোকে একপলক দেখার জন্য, যাদের জন্য তার ভাইয়েরা একটু হলেও সামাজিক আচরণ করতে শিখেছে। পুনম ফোন করল তার স্বামীকে। প্র‍য়াত মেয়র সৈয়দ আকবরউল্লাহের মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসায়ের দায়ভার এসে পড়েছে পুনমের স্বামী আর দেবরের কাঁধে। ব্যস্ততাও বেড়েছে তাদের। ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয় পুনমের স্বামী আহাদকে। বর্তমানেও সে ব্যবসার কাজে দুবাই থাকলেও ফোনে স্ত্রীকে সে অনুমতি দিয়েছে। খুশি মনেই বলেছে, যতদিন খুশি ততদিন বাপের বাড়িতে বেড়িয়ে আসুক! বিয়ের পর তো একদিনও যায়নি। সব জমা হয়ে আছে লিস্টে! এখন বাচ্চাসমেত গিয়ে সুদে-আসলে উসুল করে আসুক, কোনো সমস্যা নেই। তবে তার অধম স্বামীটাকে যাতে এই চক্করে ভুলে না যায়, এটা এনশিওর করলেই হবে। এনশিওর করার জন্য দিনে তিন’বার ফোন করলেই চলবে নিজে থেকে। স্বামীর অমায়িক আচরণে কৃতজ্ঞ পুনম ভেবে পায় না এই লোকটা এমন অদ্ভুত কেন, এতো ভালো কেন? সে যা বলে তা-ই কেন নিদ্বির্ধায় মেনে নেয়? একটুও না করতে পারে না কেন ওকে? এই ভালোবাসা কী আসলেই সে ডিজার্ভ করে? হু, করে। আর করে বলেই ডেসটিনি তাদের এক করে দিয়েছে সব অভিযোগ আর বিতৃষ্ণা দূর করে দিয়ে।

°

বাচ্চাদের নাম রাখা অনুষ্ঠান নিয়ে ইহসান যদিও বাবার সঙ্গে কোনো আলোচনা বা একাত্মতা পোষণ করেনি, চায়ওনি বাবার সাহায্য বা তার কোনো মতামত, তবুও আজিজ শেখ ঠিক করলেন সেই একি দিনে তিনি তার
দিক থেকে সবাইকে ইনভাইট করে বিশাল আয়োজন করে নাতি-নাতনিদের আকিকা অনুষ্ঠান পালন করবেন। যাতে লোকে দেখে হা হয়ে যায়। আজিজ শেখের পরিকল্পনা জানতে পেরে ইহসান প্রচন্ড রাগ করল। মানে কী? এই লোকের জন্য কি সে তার বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে পারবে না শান্তিমতো? করবি তো নিজের মতো কর, তাই বলে তার ফিক্সড করে দেওয়া ডেইটেই? মানে এই লোক কি কখনো ওকে শান্তি দেবে না? ইহসান প্রচন্ড রাগে কাঁপতে লাগল। ইজহানই তখন বলল, আজিজ শেখের যা করতে ইচ্ছে করে করুক, নিজের টাকা খরচ করে সে যা খুশি করুক তাতে কারো তো কিছু যায় আসবে না। মানুষ যদি নিজ কর্মে সুখ খুঁজে পায়, তাকে সেভাবেই সুখী থাকতে দেওয়া উচিৎ। ইহসানের উচিৎ নয় নাক গলানো। কারণ এতে শুধু তিক্ততা বাড়বে, অনুষ্ঠানের আনন্দ পন্ড হবে। বাচ্চাদের সুন্দর একটা দিন তিক্তময় হয়ে উঠবে। তাই আজিজ শেখের কার্যক্রমে পাত্তা না দিয়ে সবকিছু যেভাবে আগাচ্ছিল সেভাবেই আগানো উচিৎ। অগত্যা ইহসান অনেক কষ্টে নিজের মনকে মানাল এই বলে যে, সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাছের মানুষদের নিয়েই আকিকা
অনুষ্ঠান করবে। তার বাপের যা খুশি করতে ইচ্ছে হয় করুক, সে চেয়েও দেখবে না।

°

একপ্রকার ভাইয়ের বৌদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল আর দুই ভাইয়ের অত্যাচারে বাড়িতে না আসার প্রতিজ্ঞা ভেঙে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাপের বাড়িতে এসেছে আজ পুনম। আর শারাফ, শামির এসেছে সান মামার ছোট্ট দুটি চাঁদপাখি আর ইজু মামার সুপার হিরোইনকে স্বচক্ষে দেখতে। ইহসান গিয়ে ওদের নিয়ে এসেছে। সালেহা বেগম জানতেন না পুনম আসবে, হুট করে বিকেলে ইহসানের সঙ্গে মেয়েকে বাড়িতে ফিরতে দেখে তিনি স্তব্ধ ও হতচকিত! বহুদিন পর দেখে গর্ভে ধরা একমাত্র মেয়েকে দেখে সালেহা বেগমের চোখের জল বাঁধ মানেনি। রান্নাঘরের দরজায় খুন্তি হাতে দাঁড়িয়েই তিনি কেঁদে ফেলেন। সহজসরল, ভীতু, অসহায় মাকে এতদিন পর দেখে পুনমও নিজেকে আটকাতে পারেনি। মাকে জড়িয়ে ধরে সেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল! সালেহা বেগম তো কান্নার মাঝেই মেয়েকে চড়-থাপ্পড় শুরু দিতে শুরু করলেন! পুনম মায়ের রাগ, অভিমান বোঝে, তাই বাঁধা দেয় না আর। মায়ের বুকে ছোট্ট পুনম যেভাবে লেপ্টে থাকতো, বিশ বছরের বড়ো পুনম সেভাবেই পড়ে রইল মায়ের বুকে। মান-অভিমানের পালা সেরে দুই মা-মেয়েতে মিলে এখন সাংসারিক গল্পে মনোযোগ দিয়েছে। শারাফ আর শামিরকে কাছ ছাড়াই করছেন না তিনি। মায়ের খুশি দেখে পুনম মনে হচ্ছে, সে যা করেছে তা ঠিক হয়নি। অন্তত নিজের মায়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ রাখা উচিৎ ছিল। সে ছাড়া আর কে আছে সালেহা বেগমের? ভাইয়েরা ওকে নিজের বোন মনে করলেও তার মাকে এখনো অবধি নিজের মায়ের আসনে বসাতে পারেনি। সেই হিসেবে সালেহা বেগম তার চেয়েও বেশি দুঃখী। অথচ বাবা নামক লোকটা কোনোদিনই তার মায়ের দুঃখ ঘোচানোর দায়িত্ব নেয়নি। এতবছর পর বাড়িতে ফিরলেও পুনম তাই আজিজ শেখের সাথে কথাবার্তা বলেনি। যদিও আজিজ শেখ আম্মাজান ডেকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল কয়েকবার, কিন্তু বাবার এই মেকি আদরের ডাক সে খুব কৌশলে এড়িয়ে গেছে। যেই লোক নিজের মেয়ের স্বপ্ন ভেঙে দেয়, নিজের মেয়েকে বিশ্বাস না করে একটা কুলাঙ্গারকে বিশ্বাস করতে পারে তার প্রতি আর যাইহোক সম্মান আসে না। ভালোর মধ্যে একটা কাজই ভালো করেছে আজিজ শেখ। একটা সঠিক পুরুষের হাতে তুলে দিয়েছে পুনমকে। যে লোকটা তাকে খুব ভালোবাসে, সম্মান করে, তার সব আবদার মেটানোর চেষ্টা করে। এমনকি পড়াশোনার আবদারটাও রেখেছে। সংসার সামলে, বাচ্চাদের সামলে গ্যাপ দিয়েও অনার্স প্রথম বর্ষের পড়াশোনাটা সে কন্টিনিউস করছে।

এদিকে পুনমকে প্রথমবারের মতো দেখে, কথা বলে সৃজার খুব ভাব হয়ে গেলেও সালেহা বেগমের সঙ্গে পুনমের মিল দেখে সৃজার খুব নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছিল! মা-বাবা থাকলে নিশ্চয় তার বাচ্চাদুটোকে নিয়ে এভাবেই আনন্দ করতো? ছোট্ট সৃজা বড়ো হয়েছে, বিয়ে হয়েছে,
সে দুইটা পাখির মা হয়ে গেছে, তার একটা স্বামী আছে, একটা সংসার হয়েছে। সৃজার কী মায়ের সামনে সংসারী রুপে যেতে খুব লজ্জা লাগতো? উফ! সৃজা এই আনন্দঘন পরিবেশগুলো কেন পায়নি? নিজের সবগুলো মানুষকে একসঙ্গে আনন্দে দেখার একটা আফসোস যে রয়েছে,
এটা কি কখনো মিটবে না? আসলেই কখনো মিটবে না। বেঁচে থাকলেই না আশা রাখা যেতো, মানুষগুলো তো এই পৃথিবীতেই নেই! হুট করেই মা-বাবাহীন পৃথিবীর সবকিছু কেন যেন বিষাদ ঠেকল সৃজার কাছে।

°

এই প্রথম বোধহয় শেখ বাড়িটাকে একটু প্রাণবন্ত লাগছে। আজিজ শেখ মনভরে দেখছেন তার মেয়ে আর ছেলেদের সুখী সুখী মুখ। তবুও সবকিছুর মধ্যে তিনি তার ছোটো ছেলেকে খুব মিস করছেন। ছেলেকে ছাড়া এ অনুষ্ঠানটা তার জমবেই না, এক লোকমা খাবারও তার গলা দিয়ে নামবে না যেখানে তিনি জানেন, তার ছোটো রাজপুত্রটা এখন দেশে আছে। আজিজ শেখের কী হলো কে জানে, ছেলের প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে তিনি রাত এগারোটায় ফোন
করে খুব করে ইনজানকে আবদার করলেন পরশু দিন বাচ্চাদের আকিকা অনুষ্ঠানে যেন সে আসে। তাহলেই তার পরিবারটা পূর্ণ হবে।

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬২ [ক]

‘আকিকা অনুষ্ঠানের যাবতীয় আয়োজনের ৫০% কন্ট্রিবিউশান যদি ইজহান শেখকে করতে না দেওয়া হয়, তার দেওয়া আইডিয়া যদি মেনে না নেওয়া হয় তাহলে কোনোরুপ আকিকা অনুষ্ঠান শেখ বাড়িতে করতে দেওয়া হবে না এবং ইজহান শেখ তার বউসহ, ইহসান কন্যাকে নিয়ে বাড়িছাড়া হবেন। কোনোদিন এ বাড়ি মুখো হওয়া তো দূরে থাক ইহসান শেখ তার কন্যাকে চোখের দেখা দেখতে পারবে কি না সেটাও তার বিবেচ্য বিষয়। তাই সবকিছু সুন্দর, স্বাভাবিক রাখতে হলে অবশ্যই অবশ্যই টনা-মনার আকিকা অনুষ্ঠানের ৫০% দায়িত্ব ইজহান শেখের উপর ছেড়ে দিলেই সকলের জন্য মঙ্গল।’

ত্রিশোর্ধ্ব একজন মানুষ যদি হুমকি দিয়ে এরকম বাচ্চামোপনা করে তাহলে তাকে ঠিক কী বলা যায়? ইহসান ভেবেছিল অনেক, কিন্তু সমাধান হিসেবে বলার মতো উপযুক্ত শব্দ, বাক্য কিছুই পায়নি। পাগলের পাগলামো দমিয়ে রাখতে সে নিদ্বির্ধায় অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত উল্লেখকৃত স্ট্যাম্পে সই করে ইজহান শেখের দাবিগুলো বিনা শর্তে মেনে নিয়েছে। শর্ত মেনে নেওয়ার ইজহান মহা খুশি তার ভেড়ার উপর। খুশি হয়ে সে কাস্টোমাইজড পাঞ্জাবি অর্ডার করেছে দেশের বিখ্যাত একটি পাঞ্জাবি ব্র‍্যান্ডে। অনুষ্ঠানে ভেড়াকেও তার মতো সেইম ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরতে হবে এটা সে আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে। বিনা বাক্য ব্যয়ে ইহসান এটাও মেনে নিয়েছে। কারণ সে তার বাচ্চাদের নিয়ে এতই ব্যস্ত যে অন্যকিছুতে মনোযোগ দেওয়াটাও তার পক্ষে কঠিন। সেখানে নিজের কাপড় চুজ করাটা তো বিলাসিতা।
তবুও অতি ব্যস্ততার মাঝে পরদিন একফাঁকে ইজহানকে অফিস থেকে ডেকে নিয়ে ওর পছন্দ মতোই সব কেনাকাটা সেরেছে ইহসান। ঘর সাজানোর সামগ্রী থেকে শুরু করে ডায়াপারটা পর্যন্ত নতুন করে নিয়েছে ইজহান। যেটা এই পাগলের চোখে লেগেছে সেটাই একবার দেখিয়ে পছন্দ হয় কি না জিজ্ঞেস করে সে তুলে নিয়েছে। ইহসানের মনে হচ্ছিল শুধু দোষ ফুরানোর জন্যই জিজ্ঞেস করেছে ইজহান। আদতে নিজের যেটা পছন্দ সেটাই নিচ্ছে। ওর ইচ্ছে করছিল ইজহান ছাগলটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। আজকাল তার মনে হয়, সে জন্ম দিয়েছে ঠিক কিন্তু বাচ্চাদুটোর উপর সব অধিকার এই ছাগলটার। আর সে শুধু এই ছাগলের ঘাস। যাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে শান্তি পাচ্ছে ছাগলটা।

°

ভার্সিটিতে পরীক্ষা চলছিল এলিজার। আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ইহসান আকিকার তারিখটা সেভাবেই ফেলেছে যাতে এলিজাও উপস্থিত থাকতে পারে। ওকে ছাড়া আকিকা অনুষ্ঠান করবে এটা সে ভাবতেও পারে না। এই ক’দিন টানা পরীক্ষা চলেছে বলে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর এলিজা শেখ বাড়িতে গিয়ে একবারও দেখতে পারেনি পুঁচকু দুটোকে। শেখ বাড়িতে এর আগে একবারও যাওয়া হয়নি এলিজার। সে এই প্রথম যাবে তার বোনের স্বামীর বাড়ি, তার পুঁচকু সোনাদের বাড়ি। ওদের জন্য তো তাই কিছু উপহার নিতেই হবে। এক্সাম শেষ করে কিছু উপহার নেওয়ার উদ্দেশ্যে মলে ঢুকল এলিজা। অষ্টম তলার কিডস জোন থেকে বাচ্চাদের জন্য কেনাকাটা সারতে একঘন্টা সময় নিলো সে। বিল মিটিয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে কিডস জোন থেকে বেরুতেই দেখা হয়ে গেল ইহসানদের সঙ্গে৷ এলিজাকে এখানে দেখে ইহসান সব ফেলে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল ও
এখানে কী করছে? এলিজা জানাল সে তার বোনের মণ্ডামিঠাইদের জন্য উপহার নিতে এসেছে। এলিজাকে এখানে দেখে ইজহানও এগিয়ে এলো। জানাল, সেও তার টনা-মনার জন্য কেনাকাটা করতে এসেছে। সাপে-নেউলে সম্পর্কের দুই ভাই একত্রে শপিং করতে এসেছে দেখে এলিজা বিস্মিত হলেও সেটা প্রকাশ করল না।
সৌজন্যতা বজায় রাখল।

দুপুরের শেষ আর বিকেলের শুরু তখন। খাওয়া হয়নি কারোরই। ইহসান ওদের নিয়ে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসল। কিন্তু এলিজা তার টিউশনির বেতনে নিজ উদ্যোগে, একপ্রকার জোরপূর্বক দুই ভাই এবং ইজহানের ধমকিতে মুখ কালো করে রাখা মিজুকে ট্রিট দিলো। বিল দেওয়ার সময় আড়চোখে এলিজার পার্সে পড়ে থাকা তিনটে হাজার টাকার নোট দেখে ইজহানের কেন যেন লজ্জা লাগল। এতকিছু কেনাকাটা করার পরে তার পকেটে এই মুহূর্তে তিনটে হাজার টাকা নোটের দশগুণ ক্যাশ আছে। কার্ডে আছে লাখের মতোন। গাড়ির সামনে এসে বিদায়ের পূর্বে
সে এলিজাকে বলল, “তুমি আমাদের বাড়িতে চলো! অনুষ্ঠান তো কালই…”

“না ভাইয়া, একেবারে আগামী কালই যাব।”

“আজ নয় কেন?”

“বাসায় ফুপি একা। আমি ফুপিকে একা রেখে এখন আপনাদের সঙ্গে চলে গেলে ফুপির খারাপ লাগবে৷ রাগ করে দু’দিন ভাত খাবে না কেন তাকে রেখে আমি চলে গেলাম এই দুঃখে…”

মজা করে কথাটা বলল এলিজা। কিন্তু ইজহানের মানসপটে ইস্মিতার চেহারা বেসে উঠল। ইস্মিতার উপর রাগ করে সেও এমন করে। ইস্মিতাও কী তারজন্য এভাবেই চিন্তা করে ভেতরে ভেতরে? আহারে! বউটাকে সে কতো যন্ত্রণা দেয়! টিকে আছে কীভাবে এতগুলো দিন তার মতো একটা মানুষের সঙ্গে? ইজহান কিছুটা আবেগী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কীভাবে জানো তোমার ফুপি ভাত খাবে না?”

“কারণ সে আমার ফুপি। আর আমি তাকে ভালোভাবেই চিনি।”

ঘটনা বহুল পরিচিত। কিছুদিন পূর্বের কাহিনীও। সৃজাদের বাড়ি গিয়েও এমন কান্ড করেছিল ইজহান। রাগ করে সে দু’দিন ভাত খায়নি। ইস্মিতা কত আদর করে জানপ্রাণ ডেকে রাগ ভাঙ্গিয়ে ওকে খাইয়ে দিয়েছিল! মনে পড়তেই ইজহান আবারও উদাস
হয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমিও আমার বউকে চিনি। আমি রাগ করে থাকলে সে-ও ভাত খায় না।’

বলামাত্রই মাথায় চাটি পড়ল ইজহানের। তীক্ষ্ণ ব্যথায় চোখমুখ খিঁচে মেজাজ হারাতে যাবে তখনি ইহসান ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “তুই রাগ করলে যে তোর বউ ভাত খায় না, সেটা এলিজকে জানানোর কী দরকার? মাথামোটা, হাঁদারাম, নষ্ট!”

হুঁশ ফিরতেই ইজহান নিজের অপ্রস্তুত ভাব এড়াতে গাড়ির ডোর খুলতে খুলতে তড়িঘড়ি কণ্ঠে বলল, “কালই যেও তাহলে। সকাল সকাল। হু? এবারে গেলে কিন্তু অনেকদিন থাকতে হবে তোমাকে। টনার হাগুমুতুও পরিষ্কার করতে হবে। ঐ ব্যাটার সারাদিন ডায়াপার চেঞ্জ করতে হয়! আমি নিশ্চিত ওর বাপ ছোটোবেলায় আমাশয়ের পেশেন্ট ছিল…”

বলে ইজহান সিটে বসে মিজুকে তাড়া দিলো গাড়ি স্টার্ট দিতে। এলিজার সামনে উদ্ভট কথাবার্তা বলে মান-সম্মানের বারোটা বাজিয়ে দেওয়ায় ইহসান ক্ষেপে বলল, “আর তুই যে বারোমাসি ডায়রিয়ার রোগী ছিলি, সেটাও বল! আফটার অল তুই আমাকে কপি-পেস্ট করে চলে আসা ভাই।”

মিজু ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ইহসানের কথায় অপমানিত বোধ করলেও ইজহান তৎক্ষণাৎ কথা গোছাতে পারল না। তাই জানালা দিয়ে পা বের করে ইহসানকে লাথি দেখাল। বেয়াদবি সহ্য করতে না পেরে রাস্তা থেকে ইট তুলে ইহসান সেটা ছুঁড়ে মারল ইজহানের মুক্তোর মতো সুন্দর ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডোটার গায়ে। হতভম্ব এলিজা ওদের কান্ড দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। হাসতে হাসতে বলল, “একটুও মিলেমিশে থাকতে পারো না দু’জনে! কীভাবে এক বাড়িতে থাকো তোমরা? আমি ভেবেছিলাম ইজহান ভাইয়া একটু পাগলামি করে কিন্তু এখন তো দেখছি তুমিও কম না। মাই গড! আমার আপু কীভাবে টলারেট করে তোমাকে?”

ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা ইহসান এলিজের হাসি দেখে আরো রেগে গেল, “মানে তুই আমাকে পাগল বললি এলিজ? আমাকে? দেখলি না ও আমাকে কীভাবে উগ্রে দিলো? চোখে ছানি পড়েছে তোর? যা! ছানি কাটানোর জন্য তোকে আমি পাগলের সাথেই বিয়ে দেব! এরপর দেখব, তোর আপুর মতো তুইও পাগল টলারেট করতে পারিস কি না!”

এলিজা ইহসানের রক্তিম চেহারার দিকে তাকিয়ে আবারো হাসিতে ফেটে পড়ল, “পাগল সামলানোর মতো আমার এতো ধৈর্য নেই। তাই আগে থেকেই বলে দিচ্ছি, এমন মানুষ আমি টলারেট করব না। নো, নেভার।”

“নেভার যখন এভার হয়ে যাবে তখন বুঝবি। চল এখন। তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

°

ভোরের দিকে রশিদের পরিচিত এক খামারির খামার থেকে গরু ও খাসি আনতে বেরিয়েছিল ইহসান। জবরদস্তি করে সঙ্গী হয়েছিল ইজহান আর মিজুও। ফিরতে ফিরতে ইহসানদের বেলা হয়ে গেছে। কিন্তু তীব্র গরমে বাড়ি ফিরে যখন দেখল ইভেন ম্যানেজমেন্টের লোকেরা টকটকে লাল গোলাপ দিয়ে পুরো বাড়িটাকে সাজাচ্ছে। আর বসার ঘরে কতজন অচেনা মহিলা তার দুটো অবুঝ শিশুকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে ; ইহসান রীতিমতো ‘থ’ বনে গেল। মকবুল এসে জানাল, এরা সকলেই আজিজ শেখের আত্মীয় গোষ্ঠী। আরো অনেকেই না কি পথিমধ্যে। সকলেই আজকের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত। এক-দু’জন বাদে এদের কাউকে ইহজনমে দেখেনি ইহসান, ইজহানও না।

মহিলাগুলো ‘টনা-মনাকে’ জোরপূর্বক এর কোল থেকে ওর কোলে নিয়ে নিয়ে কে দেখতে কার মতো, কার নাক খাড়া, কার গায়ের রঙ বেশি ভালো, দুটোই কেন ছেলে হলো না বা, দুটোই কেন মেয়ে না এসব নিয়ে আলোচনা করছে। এদিকে অপরিচিত মানুষের কোল থেকে কোলে যেতে অস্বস্তিতে, ভয়ে বাচ্চাদুটো গলা ফাটিয়ে কাঁদছে অথচ কারো কোনো হেলদোল নেই। পুনম চাওয়া স্বত্তেও বাচ্চাদেরকে ওর কোলে দেওয়া হচ্ছে না, ইহসান এসব পছন্দ করে না। এসে দেখলে খুব চটে যাবে, রাগারাগি করবে। এটা কেউ বুঝতেই চাইছে না। পুনম আর সালেহা বেগম অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে এসব কাহিনী দেখল ইহসান। ফুলের গন্ধে সারাবাড়ি ম ম করছে। বাইরে থেকে দেখলে এত সাজগোজ, এত মানুষ দেখে যে কেউ ভাববে এখানে আকিকা অনুষ্ঠান নয়, বরং কোনো বিবাহের অনুষ্ঠান হচ্ছে! বিরক্তিতে ইহসানের সবকিছু তেঁতো ঠেকল। পায়ের রক্ত তড়তড় করে মাথায় উঠতে লাগল। ইজহান ক্ষেপে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইহসান ওকে থামিয়ে দিয়ে ধীরপায়ে বসার ঘরে প্রবেশ করে চাপা, ক্রোধপূর্ণ স্বরে বলে উঠল, “দশ সেকেন্ডের মধ্যে ওদেরকে এখান থেকে না নিয়ে যেতে দিলে সবাইকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দেব!’’

ইহসানের ধমকিতে অপমানিত বোধ করলেন মহিলাগণ। ভয়ও পেলেন। তড়িঘড়ি করে পুনমের কোলে বাচ্চাদের তুলে দিয়ে আমতাআমতা করে বাচ্চারা যাদের কোলে ছিল তারা বলল, “দিয়া দিছি বাজান, দিয়া দিছি…”

মহিলাগুলো রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। একে-অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ইহসান একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। চোখদুটো বুজে নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে যথাসম্ভব শান্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি আপনাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে চাইনি, কিন্তু আপনারা ওদের তুলনা করছিলেন যেটা আমার পছন্দ হয়নি তাই ধমক দিয়ে ফেলেছি। আমি দুঃখিত। এবার শুনুন, আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে আমার বাচ্চাদের খারাপ চাইবেন না। ওরা ফেরেশতা তুল্য। কিছু বোঝে না। ওদেরকে দোয়া করে দিন।”

মহিলাগুলো ওর ব্যবহারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাল। কেউ ওকে বুঝল, কেউ আবার গাল ফুলিয়ে বসে রইল। কেউ কেউ এসে আবার নিজে থেকে পরিচিত হলো। তবে বাচ্চাদেরকে সবাইই দোয়া করে দিলো।
ইহসান অতো সামাজিকতার মধ্যে পড়েনি এর আগে। সে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল তবুও চেষ্টা করল ভালো ব্যবহার করার।

°

ইহসান চেয়েছিল দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে। ছেলে-মেয়ের সুন্দর অর্থপূর্ণ নাম রাখবে, দোয়াদুরুদ পড়াবে, অতিথিদের ভালোভাবে আপ্যায়ন করা হবে, বাড়িটাকেও একটু-আধটু সাজানো হবে যাতে হৈ-হুল্লোড় ছাড়াও বাড়িটাকে চোখে দেখে শান্তি লাগে। মোটকথা, আজিজ শেখের মতো এতো জাঁকজমক না হলেও কোনো অংশে কম আয়োজন করবে না ইহসান তার সন্তানদের জন্য! ভেবেছিল এই লোক যা খুশি করুক, সে তাতে মাথা ঘামাবে না। কিন্তু এখন এসব বাড়াবাড়ি নিতে পারছে না ইহসান। ছোটো ছোটো দুটো বাচ্চা, এই গরমে কাচা ফুলের সংস্পর্শে আসলে তাদের কী অবস্থা হবে ভেবে সে ম্যানেজমেন্টের লোকেদের মানা করল এসব দিয়ে বাড়ি সাজাতে। কিন্তু মূল হোতাই যদি পারমিশন না দেয়, তাহলে তারা কী করবে? যথাসম্ভব রাগ নিয়ন্ত্রণ করে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ইহসান আজিজ শেখকে খুঁজতে গিয়ে পেল পুকুর পাড়ে। গরু জবাই হচ্ছে সেখানে। সাদা-নীলের মিশ্রণে একটা নতুন লুঙ্গি আর অফ শোল্ডার স্যান্ডো গেঞ্জি পরে শারাফ, শামিরকে কাছে বসিয়ে একদিকে বাবুর্চিকে নির্দেশনা দিচ্ছেন রান্নাবান্নার বিষয়ে অন্যদিকে, গ্রামের দিক থেকে আসা পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতেছেন। আড্ডার মূল বিষয়ই তার চারপুত্র আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, নানা-দাদা হওয়ার আনন্দে, গর্বে আজিজ শেখের মধ্যে উৎফুল্লতার কমতি নেই। তিনি খুবই খুশি। বন্ধুরাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নিজেদের মধ্যে বলাবলিও করছে, নাতি-নাতনির জন্য এমন এলাহি আয়োজন আজকাল কয়জনে রাখে? তাও আবার পুরোনো দিনের বন্ধুবান্ধবদেরও দাওয়াত করতে ভুলেনি। আজিজ শেখ কতোটা দিলখোলা আর বড়ো মনের মানুষ ভাবা যায়? তাদের মতো ছা-পোষা মানুষদেরও সামান্য আকিকা অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতে ভোলেনি। আল্লাহ যাতে এই মানুষটার আব চাওয়া পূরণ করে এই দোয়াও করল তারা। ইহসান সেগুলো শুনে দাঁতে দাঁত চেপে একজনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের চোখে আপনাদের বন্ধু এতো বড়ো মাপের মানুষ? তা বন্ধুর কাহিনী জানেন তো? একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে তার জীবনটা যে শেষ করে দিয়েছিল তা জানেন তো?”

বিস্ময় নিয়ে লোকগুলো ইহসানের দিকে তাকালেও পরক্ষণেই একজন গলা খাকারি দিয়ে বলে, “যুবক বয়সে ঐরকম কমবেশি সবাইই করে। পরে তো বিয়াও করছে, তাই আর অভিযোগের সুযোগ নাই। আমরাও তো দাওয়াত খাইছিলাম বিয়াতে। ঐ আধা বিদেশি মাইয়াডা…”

কঠিন গলায় বলল ইহসান, “তুলে নেওয়ার সময়ও নিশ্চয় আপনারা ছিলেন? প্রাণপ্রিয় বন্ধু বলে কথা!”

“তুমি কেডা?”

“যার বিয়েতে গান্ডেপিন্ডে গিলেছেন আমি তাদের সেই সন্তান…জিজ্ঞেস করুন আপনাদের বন্ধুকে আমি কে…”

ইহসানের পরিচয় বুঝে লোকগুলো থতমত খেল। আজিজ শেখ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন ছেলের সঙ্গে পুরোনো বন্ধুদের কথোপকথন। এ পর্যায়ে বললেন, “আব্বাজান, চুপ কইরা যাও। আইজ একটা বিশেষ দিন। পুরোনো কথা টাইনা আইনা দিনটা নষ্ট কইরো না। কিছু লাগব তোমার?”

বাপের অতি আহ্লাদ দেখে ইহসান রাগান্বিত স্বরে বলল, “বাড়িটাকে গোলাপের বাগান যাতে না বানানো হয় তারজন্য দয়া করে আপনার মৌখিক অনুমতিপত্র লাগবে। দয়া করে অনুমতি প্রদান করে এসে আমার মাথাটা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করুন।”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে ইহসান তীব্র রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আজিজ শেখ দুই নাতিকে রেখে উঠে ওর কাছে এলেন। কাছাকাছি এসে ছেলের হাত ধরতে চাইলেন। কোনো নোংরা বস্তু গায়ে লাগলে মানুষ যেমন ঝেড়ে ফেলে ইহসান আজিজ শেখের হাতটা সেভাবেই ফেলে দিলো। আজিজ শেখ হাসলেন। তোয়াক্কা করলেন না ছেলের তাচ্ছিল্য। একবার, দু’বার বারবার চেষ্টা করে একসময় শক্ত করেই ছেলের হাতটা ধরলেন৷ ইহসান কঠিন দৃষ্টি ছুঁড়লেও এবার আর হাত সরাল না। বিষাক্ত অনুভূতি নিয়েও সে দেখতে চাইল এই কর্দয লোকটা ঠিক কীভাবে তাকে ভোলাতে চাইছে! আজিজ শেখ ধীরপায়ে পুকুরের পাড় ঘেঁষে ওকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ঠিক এইরকম একটা দিন আমার জীবনেও আসছিল, আব্বাজান! ঐদিন তোমরা আসছিলা আমার জীবনে। সাতাশ দিনের ছোট্ট ইহসান-ইজহান। এতটুকু ছিলা। আমি কোলে নিতে ভয় পাইতাম…আস্তেধীরে শিখেছি। শিখার পর আর কোল ছাড়া করি নাই তোমাদের। সবসময় কোলে কোলে রাখার চেষ্টা করতাম। পি, পটি সব নিজ হাতে সাফ করছি। তোমাদের মা তো ছুঁইতোই না তোমাদের। খাওয়াইতেও চাইতো না, জোরাজোরি করে দিতে হইতো৷ কী একেকটা দিন গেছে তোমার মায়ের সাথে আমার যুদ্ধের!”

বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আজিজ শেখ মন্থর কণ্ঠে বললেন, “তোমাদের প্রথম এ বাড়িতে নিয়া আসার স্মৃতিচারণ করতেই বাড়িটা সাজাইছি।”

তাচ্ছিল্য করে হাসলো ইহসান, “সাজিয়ে গুছিয়ে ঘরে তুলে আমাদের জীবনটা যেমন নরক করে দিয়েছেন, আমার বাচ্চাদেরও এমন অভিশপ্ত করার পায়তারা করছেন, তাই না?”

আজিজ শেখের ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। খ্যাঁকিয়ে উঠলেন তিনি, “ঘরে না তুললে বুঝি তোমাদের জীবনটা বেহেশতি হইয়া যাইতো? লোকে সমাজে টিকতে দিতো তোমার মা-রে? তোমাদের? উহু! তখন ঘরে না, রাস্তায় বড়ো হইতা!”

“অনেক দয়াবান তো আপনি! কত চিন্তা করেছেন আপনি আপনার পাপের ফলদের জন্য! আবার ঘরেও জায়গা দিয়েছেন! ব্যাপারটা এমন যে, যাকে পিষে মারলেন তাকেই ঠাঁই দিলেন। এরকমটা কেউ করে আদৌ? আপনাকে তো তিনবেলা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা উচিৎ!”

চোখ গরম করলেন আজিজ শেখ, “আমি তোমার বাপ হই। মজা করবা না আব্বাজান।”

“মজা করার অধিকার শুধু আজিজ শেখের, তাই না?”

ছেলের রাগের কথা আজিজ শেখ বেশিরভাগ সময়ই গায়ে লাগান না। এবারেও লাগালেন না। যথারীতি বিমোহিত স্মৃতিচারণে ডুবে ঠান্ডা কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “তোমাদের দাদা মানে আমার প্রয়াত বাবা, ঠিক এমনই গোলাপ দিয়ে এই বাড়িটা সাজিয়ে তুলছিল। আর আমি নিজে তোমাদের কোলে নিয়া গৃহপ্রবেশ করছিলাম, বুঝছ? এই টকটকে লাল গোলাপ পায়ে পিষে৷ আর তোমার মা—হু! ঐ পাষাণী মহিলারেও আমি নিজে কোলে নিয়া গৃহপ্রবেশ করছিলাম, সারাজীবন রানি বানায়া রাখার জন্য… অথচ সে বুঝলই না!”

“আসলেই তো! একটা রেপিস্টকে কেন ঐ মহিলা বুঝল না? তার তো উচিৎ ছিল রানি হওয়ার লোভে নিজের ধ র্ষ ণ কারীকে মেনে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া, তাই না? আমার মা এতো বোকা ছিল! আশ্চর্য!”

হাসলেন আজিজ শেখ, “সুন্দরী ছিলো তো দেমাগও বেশি ছিল। হাতটা ধরলেই এমন করতো মনে হইতো আমি যেন তার জান নিয়া যাইতেছি। আসলেই তোমার মা একটা বোকা মহিলা ছিল। আর এইজন্যই তারে বেশি ভালোবাসতাম।’’

উচ্চস্বরে হেসে উঠল ইহসান, “যাকে ভালোবাসলেন তাকে নিয়েই নোংরা খেলাটা খেললেন! আপনার প্রেমকাহিনী শুনে আমি ইম্প্রেসড!”

“আব্বাজান, আমার রক্ত বইছে তোমার শরীরে, আমার কোলেপিঠে চইড়া তুমি বড়ো হয়ছ, গলা ধইরা ঝুইলা থাকছ মায়ের বকুনি খাইয়া। দুইদিনের পোলা এখন তিনদিনে আইসা বাপের বাধ্য হইতে চাও না। যাক, পোলাপান তোমারও হইছে। বাচ্চাকাচ্চা এমন করলে কেমন লাগে হাড়ে হাড়ে টের পাইবা! তবে তুমি যেমন আমার অবাধ্য সন্তান, আমিও তেমন তোমার অবাধ্য জন্মদাতা। আমি ফুল খোলার অনুমতি দিবই না কাউরে। যেভাবে সাজানো হইছে সব এমনই থাকব। যতক্ষণ না ভদ্রভাবে আইসা কথা বলবা!”

“আমার পায়ের জুতাও আপনার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করবে না। আর আমার জুতা যেখানে ভদ্র ব্যবহার করবে না, সেখানে আমি ইহসান তো করবই না।”

গা জ্বালানো হাসি উপহার দিয়ে ইহসান সেখান থেক চলে এলো। আজিজ শেখ কঠিন এবং ব্যথিত চোখে ছেলের গমন পথে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বললেন, “অবাধ্য আব্বাজান, তুমি এমন করলে আমার বুকে ব্যথা লাগে কবে বুঝবা? না কি তোমার মায়ের মতো অবুঝই থাকবা সারাজীবন?”

°

নিজের জন্য ভাবনার সময় না পেলেও ইহসান তার আদরে অতি আহ্লাদী হয়ে দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া অর্ধাঙ্গিনীর জন্য পছন্দ করে আকাশী জমিনের নীল পাড়ের একটা জামদানি শাড়ি এনেছে। বিয়ে থেকে বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত লম্বা সময়টাতে একবারও সৃজাকে শাড়িতে দেখেনি সে। আলমারি ভরে শাড়ি কিনেছে ঠিকই কিন্তু সৃজা কখনো পরেনি। প্রথমদিকে লজ্জায় মেয়েটা পরতে চাইতো না বলে ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও ইহসান জোর করেনি ঠিক, কিন্তু ফিনফিনে শাড়ি পরে আকর্ষণীয় দেহভঙ্গিমা করে তাকে সিডিউস করতে আসা লিথুর ঐ কান্ডের পর শাড়ির প্রতি রুচিই হারিয়ে গিয়েছিল ইহসানের। কিন্তু ইদানীং সৃজাকে শাড়ি পরিহিতা অবস্থায় দেখতে তার অবাধ্য মনটা তাড়া দিচ্ছে। আর অবাধ্য মনটাকে প্রশান্তি দিতেই গত একঘন্টা যাবৎ ইউটিউব দেখে, বেশ কসরত করে আকাশনীল রঙের জামদানিটা সে নিজ হাতে পরিয়ে দিয়েছে তার বাচ্চার মা হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে! নিজেও পড়ে ইজহানের এনে দেওয়া সাদা পাঞ্জাবি।

প্রথমবার শাড়ি পরেছে, তাও আবার স্বামীর হাতে। লজ্জা লাগছে সৃজার। যদিও উচিৎ নয়। লোকটার বাচ্চাদের মা হয়ে গেছে সে, এখন এসে যদি সে লজ্জা পায় তাহলে সেটা ভীষণই নাটুকে ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সৃজা জানে, এরপরেও ওর লজ্জা লাগছে। এর অবশ্য কারণ আছে। শাড়ি পরানোর সময় অসংযত আচরণ করেছে ইহসান। একেবারে প্রথম দিনের কাছাকাছি আসার মতোন! সৃজা ওর বুকে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। এখন এই কামড় নিয়েই লোকটা ওকে জ্বালানোর উপায় খুঁজে পেয়েছে। শক্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে ইহসান; যতক্ষণ না কামড়ের জায়গাটা চুমু দিয়ে সারিয়ে না দেবে ততক্ষণ শোয়া থেকে উঠবে না বলে গোঁ ধরেছে। তার উপর সেই তখন থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কোনো মানে হয় এসবের? লজ্জার সাথে সাথে এ পর্যায়ে খানিকটা বিব্রত স্বরেই বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? অন্যদিকে তাকাও।”

“উহু, দেখতে দে। আগে এভাবে দেখিনি। খুব সুন্দর লাগছে তোকে। একেবারে পরীর মতোন।নাহ…তারচেয়ে বেশি চমৎকার! আমার শব্দ ভান্ডারে বলার মতো যুতসই কিছু পাচ্ছি না। তবে এটা বলা যায়, তোকে শাড়িতে দেখে আমি ফিদাটিদা হইনি, ডিরেক্ট ফ্রিজড হয়ে গেছি। আমাকে গলাতে হলে একটা চুমু ঠিক এইখানে…” বুকের মধ্যিখানে ইশারা করে বলল ইহসান, “এইখানে একটা চুমু খেতে হবে। গড প্রমিজ, আমি টু শব্দটিও করব না। না বেশিকিছু আবদার করব।”

ওর কথা তখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। সৃজা অস্বস্তি, জড়তা-সংকোচ নিয়েই ফট করে চুমু খেয়ে বসলো ওকে। ইহসান কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে এরপর ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “মাই হার্ট ইজ মেল্টেড, কমপ্লিটলি মেল্টেড! লুক, পুট ইয়োর হ্যান্ড হিয়ার রাইট নাও! ইউ ক্যান ফিল ইট…”

সৃজা ওর বুকে থুতনি ঠেকিয়ে হাতটা রাখল ওর মাথায়। চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে পেছনে ঠেলে দিয়ে তাকিয়ে রইল বাচ্চা সামলাতে সামলাতে নিজেও বাচ্চাদের মতো আচরণ করা স্বামীটির দিকে।
কেমন যেন চোখ ভিজে উঠল ওর। ভার গলায় বলল, “তুমি আসলেই একটা কাঙাল। ওদের মতো একটুখানি ভালোবাসা পেলেই হাওয়াই মিঠাই হয়ে যাও। আমার খুব রাগ হয়।”

ইহসান উঠে বসল। ভ্রু কুঁচকে ওর গালে হাত রেখে সন্দেহ এবং ঠাট্টাভরা কণ্ঠে বলল, “বুঝলাম আমি কাঙাল। একটুখানি ভালোবাসাতেই গলে যাই। কিন্তু তুই কাঁদছিস কেন? তোকে তো অনেকটা বেশি ভালোই দিয়ে বশে রাখার চেষ্টা করি।”

“বিকজ আই লাভ দ্যা বেগার দ্যাট ইজ ইউ!”

°

ইস্মির পরণে লাইট গ্রীন কালারের একটা কটন সিল্ক শাড়ি। ইজহান পরিয়ে দিয়েছে, সাজিয়েও দিয়েছে সে। যতটুকু পেরেছে বউকে সাজিয়েছে এরপর সে তার টনা-মনাকে সাজিয়েছে, শারাফ-শামিরকে নিয়ে নিজে তৈরি হয়েছে। এরপর ছয়জনের অনেকগুলো ছবি নিয়েছে সে। সবগুলো ছবি পুনম তুলে দিয়েছে। ওকে খুব উৎফুল্ল আর প্রাণবন্ত লাগছে। বুঝদার দেখাচ্ছে। ইস্মির ভালো লাগছে স্বামীকে এভাবে দেখে। আর তাই লোকটার আনন্দে ভরা মুখটাকে চিন্তাগ্রস্ত না দেখতেই চুপ করে বসে আছে। কেননা, সকাল থেকেই ওর পেটের নিচের অংশে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে ব্যথা আবার কখনো তা নয়। সেইসঙ্গে হাঁটতেও অস্বস্তি হচ্ছে ওর। পানির তেষ্টা পাচ্ছে একটু পরপর। সবগুলো লক্ষ্মণই সাময়িক, তেমন গুরুতর কিছু মনে হচ্ছে না। সেজন্যই এখন অবধি ইজহানকে কিছু বলেনি ইস্মি। ঠিক করেছে বলবেও না। যদি এটা লেবার পেইনের লক্ষ্মণ হয় তাহলে তো আরো বলবে না। ইস্মি নিশ্চিত, তার এই পাগল স্বামী এগুলো শুনলে ফিট খেয়ে যাবে!

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬২ [খ]

দোতলা বিশাল বাড়িটি পুরোনো আমলের নকশায় নির্মিত। একেকটা জানালা, বারান্দা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বিশাল। বাইরে থেকেই বোঝা যায় ঘরগুলো বড়ো বড়ো ঘর। ভেতরে স্যান্ডস্টোন রঙ হলেও বাইরের দেয়ালে হলদেটে রঙ ঘষা। গল্প-উপন্যাসে জমিদারদের বাড়ি যেমন থাকে ঠিক তেমনি আভিজাত্যপূর্ণ এই শেখ বাড়িটা। খুব বড়ো আর প্রশস্ত। লোহার গেইট, ঘাসে ঢাকা বিশাল উঠোন, সুড়কি বিছানো পথ। পথের দু’পাশে সাদা রঙের পাথর দিয়ে বর্ডার দেওয়া। একপাশে বিশাল একটা বাগান। তাতে বাহারি ধরনের ফুল, দেশি-বিদেশি সব রকমের। বাড়ির পেছনে একটা পুকুর। তার পাড়ে সারি সারি গাছ লাগানো। বেশিরভাগই নারকেল গাছ। পুকুরের পানি স্বচ্ছ। তাতে চড়ে বেড়াচ্ছে কয়েক জোড়া রাজহাঁস। বাড়ির ছাদে উড়ছে কবুতর। পুকুরে রাজহাঁস আর ছাদে কবুতরের উড়াউড়ি ব্যাপারটা খুব নান্দনিক। প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাছ-পালা। যেগুলোর বয়স তিন যুগেরও বেশি। বাড়িটির শেষ প্রান্তের প্রাচীরের পরই বোধহয় রেল লাইন। শেখ বাড়িতে পা রাখামাত্রই এলিজার কানে এসেছে ট্রেনের সেই ঝক…ঝকা…ঝক শব্দ। নীলু ফুপিও শুনেছে। তারা এসেছে একটু আগে। এই বারোটার পরে! এই নিয়ে সৃজা দু’জনের উপরই ভীষণ অভিমান করেছে। অবশ্য করবেই তো! যেখানে বারবার করে বলে দিয়েছে তারা যেন সকাল সকালই চলে আসে, সেখানে সারারাত পড়াশোনা গুছিয়ে, এলার্ম দিতে ভুলে যাওয়ার কারণে এলিজা সকালে ঘুম থেকেই উঠেছে নয়টার দিকে। উঠে তড়িঘড়ি করে গোছগাছ সেরে তৈরি হয়ে, বাড়ির দায়িত্ব ভাড়াটে আংকেলের উপর চাপিয়ে দিয়ে আসতে আসতেই এতোটা দেরি হয়েছে তাদের। বোনের রাগ দেখে এলিজার অসহায় লাগছে, বারবার সরি বলছে কিন্তু সৃজা ওর সঙ্গে ফর্মালিটি করে কথা বলা বন্ধ করছে না। ‘আপনি, আপনি’ সম্বোধনে কথা বলছে। যেটা শুনতে একটুও ভালো লাগছে না এলিজার। বোনের রাগ ভাঙানোর চক্করে সে বাচ্চাদুটোকে পর্যন্ত আদর দিতে পারছে না। একবার বোনের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার দুটো হাওয়াই মিঠাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে অসহায় নজরে। শেষমেশ আর না পেরে এলিজা উঠে গিয়ে বোনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অভিমানী কণ্ঠে বলল, “শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে আপু। একদম মায়ের মতোন। আমার তোমাকে মন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তুমি এরকম রাগ করে থাকলে আমি কীভাবে আমার মাতৃতুল্য আপুকে দেখি বলো তো?”

এলিজার কথা শুনে সৃজার রাগ কিছুটা কমলও।
কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “মায়ের মতোন দেখালেই তো আর মা হয়ে যায় না। তেমন আমিও হতে পারিনি তোর মা। নয়তো আমার কথাকে এভাবে হেলাফেলা করতে পারতি না। বলেছিলাম দু’দিন আগে আসতে, এলি না। বলেছিস তোর এক্সাম। মেনে নিলাম। তারপর বললি, আজ একদম ভোর ভোর চলে আসবি। কিন্তু তাও কথা রাখলি না, সারারাত পড়াশোনা করে এসেছিস বেলা করে। ওকে ফাইন। তুই থাক, তোর পড়াশোনা নিয়েই থাক। আমাকে আর আমার বাচ্চাদের দেখতে আসার প্রয়োজন নেই।”

ইহসান একপাশে বসে গালে হাত দিয়ে দুই বোনের মান-অভিমানের খেলা দেখছে। সে কিছুই বলছে না। এলিজার শুকনো মুখ দেখে হাসিও পাচ্ছে মাঝেমধ্যে। কিন্তু বাইরে সেসব কিছুই প্রকাশ করছে না। সিরিয়াস থাকার ভান করছে। কারণ এরকম একটা বিশেষ দিনে দেরি করে এসে এলিজ মোটেই ঠিক করেনি। কান্ড-জ্ঞানহীনের মতো আচরণ করেছে। যেটা ওর সঙ্গে যায় না। এটুকু বকাঝকা ওর প্রাপ্য। নীলু বেগম দুই নাতি-নাতনিকে নিয়ে ব্যস্ত। তার এদিকে খেয়াল নেই। কিন্তু সৃজার থেকে এমন নিষ্ঠুর আচরণে অনভ্যস্ত এলিজা ব্যগ্র স্বরে বলল, “একটা ভুল
করে ফেলেছি আমি অজান্তে। তারজন্য বারবার সরি বলছি এরপরেও তুমি দূরে ঠেলে দেবে আমাকে? আমার কারো কাছে যাবার নেই বলে? আপু তুমি এতো কঠিন?”

ইমোশনাল ফুল কথাবার্তা এলিজ বলে না কখনো। কিন্তু পারতপক্ষে যখন বলে তখন খুবই করুণ শোনায় সেটা। সৃজার বুকটা কেঁপে উঠল নিমিষেই। আসলেই তো, মেয়েটা এই প্রথমবার এখানে এসেছে। একটু দেরি না হয় করেই ফেলেছে। তাই বলে এতোটা কঠিন হওয়া ঠিক হয়নি। সৃজা একটু সময় স্থির থেকে পেছনে ফিরে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আর আমার বুঝি যাবার মতো অনেকেই আছে?”

“ফুপি আছে, ভাইয়া আছে, দুইটা হাওয়াই মিঠাই আছে। এলিজ তো তোমাকে দেওয়া ছোট্ট একটা কথাই রাখতে পারে না। তার না থাকলেও চলবে।”

“পুরো দুনিয়া থাকলেও এলিজকে লাগবে আমার। কোনো কথা না রাখতে পারলেও এই মেয়েটাকে দরকার আমার। এলিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য হলেও ওকে প্রয়োজন আমার।”

এলিজা ওর বুকের মধ্যে ঘাপটি মেরে বলল, “আমার সাথে ঠিকঠাক করে কথা বলো আপু। তুমি এমন করলে আমার একটুও ভালো লাগে না।”

অভিমানের পালা শেষ করে সৃজা ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আমারও ভালো লাগেনি এলিজের
সঙ্গে এভাবে কথা বলতে। কিন্তু আমার রাগ হচ্ছিল তোর উপর। আমি কতো এক্সাইটেড ছিলাম বল তো! এই প্রথম আমার আপনজনেরা এ বাড়িতে আসবে, আমার বাচ্চাদের একটা বিশেষ দিনে। সেখানে বারোটা অবধি আমার পরিবারের কেউ নেই, বিষয়টা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল!”

“আমি সত্যিই কান্ড-জ্ঞানহীনের মতো কাজ করেছি। যেটা করা উচিৎ হয়নি। সরি আপু।”

সৃজা ওর মুখটা আগলে নিয়ে কপালে ছিটকে এসে পড়া লম্বা কালচে-বাদামি চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে নরম গলায় বলল, “ওকেহ! সরি এক্সসেপ্টেড। আর কখনো এমন ভুল করবি না। এখন ঠিকঠাক করে দেখে বল শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে!”

বোনের অভিমান ভাঙাতে পেরে এলিজার ঠোঁটে
হাসি ফুটে উঠল। স্বস্তি পেল সে৷ জহুরি চোখে বোনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সরু গলায় বলল, পাহাড়ের পাদদেশে শাড়ির আঁচল ঘাসে বিছিয়ে বসে কাঁদতে থাকা, বৃষ্টিবিলাসে মগ্ন উপন্যাসের নায়িকার মতো লাগছে। ছোট ছোট মেঘকণাদের ছোঁয়ায় শাড়িতে অপরুপ রূপবতী হয়ে উঠা প্রেমিকাকে দূর থেকে দেখে ক্ষণে ক্ষণে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে প্রেমিক। আর প্রেমিকের সেই দৃষ্টি দেখে প্রেমিকা বিরহ জ্বালায় কাঁদছে। হ্যাঁ, এলিজের আপুকে সাদা-নীল জামদানিতে ঠিক সেরকমই দেখাচ্ছে। একদম বৃষ্টিভেজা আকাশনীলার মতোন। এলিজা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, সৃজা তো শাড়ি পরতে জানে না তাহলে এত সুন্দর করে কে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে? সৃজা মুখ ফসকে ইহসানের কথা বলতে গিয়েও আমতাআমতা করে বলল, ইউটিউব দেখে সে নিজে নিজে পরেছে। মিথ্যেটা বলেই সৃজা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, মেয়ের মুখে ফিডার ধরে তাকে খাওয়ানোর ভান করতে থাকা ইহসান মিটিমিটি হাসছে, শয়তানি হাসি। সৃজার গালদুটো কেমন লাল হয়ে উঠল ইহসানের ঠোঁটের কোণের অস্পষ্ট শয়তানি হাসিতে!

°

সিঁদুরে লাল সালোয়ার-কামিজে এলিজাকে দেখাচ্ছে ঠিক অভিমানী, নরম, তবু চোখ জুড়িয়ে দেওয়া একটা রক্তরঙ গোলাপ। ফুলস্লিভ জামায় হাতদুটো ঢাকা,
মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে, দু’পাশ থেকে সামান্য চুল তুলে টুইস্ট করে পেছনে আটকে দেওয়ায় খুব পরিপাটি দেখাচ্ছে ওকে। কোমড় ছাড়ানো কালচে-বাদামি অবশিষ্ট চুলগুলো খোলা, হালকা বাতাসে দুলছে নরম ভাঁজে ভাঁজে। চোখে নেই একফোঁটা কাজল, ঠোঁটেও কোনো রঙ নেই। তবু ওর মধ্যে এমন এক শুচিতা মেশানো যে ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, না সেজেও কাউকে যদি অবিশ্বাস্য সুন্দর লাগ, তাহলে সেটা এলিজা ছাড়া আর কেউ নয়। সাজগোজবিহীন এলিজার অনাড়ম্বর রূপটা ওকে সবার থেকে এতোটাই আলাদা করে তুলেছে যে, ওর অতিরিক্ত ফর্সা, মিষ্টি অথচ খুঁতওয়ালা মুখের দীপ্তি থেকে কেউই চোখ সরাতে পারছিল না। সকলের এমন দৃষ্টিতে এলিজা প্রচন্ড বিব্রতবোধ করে মাথায় ওড়না তুলে দিলেও ওর সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া কয়েকজন এসে তো তাদের ছেলে, ভাতিজার জন্য বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসল নীলু বেগমের কাছে। সরল-সোজা নীলু বেগম কোনোমতে এটা-সেটা বলে পরিস্থিতি সামলালেও রাগে-দুঃখে এলিজা ঠিক করল, সে ঘরেই বসে থাকবে। বেরুবে না। সৃজাও বোনের অস্বস্তি বুঝে ওকে আর জোর করেনি। তবে ইস্মির বাবা আর ভাই আকাশ যখন এলো, অল্পতেই মিশে গিয়ে আকাশ মামাকে লালপরী দেখানোর জন্য শারাফ এসে একপ্রকার জোর করে এলিজাকে সঙ্গে নিয়ে গেল। তবে ফর্মালিটি রক্ষার্থে আকাশের সঙ্গে পরিচয়ের পর জানা গেল, সে এলিজার ভার্সিটির একজন অ্যালামনাই—একসময়কার সিনিয়র। বহু আগেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এখন চার বছর ধরে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। তবুও ভার্সিটির সিনিয়র ভাই আকাশের সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে এলিজা অনেকখানি সহজ হয়ে গেল ওর সঙ্গে। দু’জনের মধ্যে বেশিরভাগ কথাই হলো ভার্সিটি আর পড়াশোনা রিলেটেড। দূর থেকে নিজের আঠাশোর্ধ্ব ছেলেকে একটা সুন্দরী, মিষ্টি দেখতে মেয়ের সঙ্গে দেখতে পেয়ে ইস্মির বাবা সিরাজুল ইসলাম মনে মনে একটা ব্যাপার ভাবলেন! সেই ভেবেই তিনি ইস্মিতাকে একফাঁকে নিজের মনে আসা ভাবনাটা খুলে বললেন। বাবার কথা শুনে পেটে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করতে থাকা ইস্মি তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারল না। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো। সিরাজুল ইসলামকে বলল, অনুষ্ঠান শেষ হোক। সে কথাটা বলে দেখবে।

°

আযরান শেহজীর শেখ,
আজওয়া শেহরিন শেখ।
সকলের সম্মতিতে নাম ঠিক করে দোয়া দুরুদ পাঠ করে, দান-খয়রাত করে বাচ্চাদের মঙ্গল কামনায় একটু আগেই আকিকা অনুষ্ঠানের মূল সৌন্দর্য সম্পন্ন হয়েছে। অতিথিরা যারা এসেছে সকলেই এতো এতো উপহার নিয়ে এসেছে বাচ্চাদের জন্য যে ঘরভর্তি হয়ে গেছে। ফকির-মিসকিন যারা এসেছে তারা সকলেই তৃপ্তিভরে খেয়ে বাচ্চাদের দোয়া দিয়ে যাচ্ছে। ভেতরে বেশি চেঁচামেচি নেই। হৈ-হুল্লোড় যা হচ্ছে বাড়ির বাইরের উঠোনে, যেখানে আজিজ শেখ তার নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করছে। ইহসান সেখানে যায়নি, যাওয়ার ইচ্ছেও ওর নেই। তবে যাদের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে, তাদেরকে সে যথাযথ আপ্যায়ন করার চেষ্টা করেছে। অনেকক্ষণ যাবৎ অনুষ্ঠান সামলে সে ক্লান্ত। তাছাড়া মেয়ে কান্নাকাটি করছিল বলে বেশিক্ষণ আর দূরে থাকতে পারেনি। সবকিছুর দায়িত্ব ঘ্যানঘ্যান করে মাথা খাওয়া ইজহানের উপর ছেড়ে দিয়ে তীব্র গরমে কান্নাকাটি করে অস্থির হওয়া মেয়েকে শান্ত করেছে সে। আপাতত টুকটুকে লাল ফ্রক পরনে ইহসান কন্যা আজওয়া শেহরিন শেখ বাবার বুকের কাছে পাঞ্জাবির অংশটা ছোট্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুমাচ্ছে। আর মেয়ের ঘুমের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ইহসান গত একঘন্টা যাবৎ একই ভাবে পিঠ সোজা করে বসে আছে। আর সৃজা ছেলেকে নিয়ে আছে পুনমের ঘরে। সেখানে ইস্মি, এলিজা, নীলু বেগম ছাড়াও, মিজুর স্ত্রী সায়মাসহ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসা অনেকেই আছেন। সকলে মিলে আড্ডার মতো আসর জমিয়েছে, যে আড্ডার মূল বিষয়ই কীভাবে বাচ্চা মানুষ করতে হয়, কীভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় সেসব। মেয়েলি আড্ডায় ইহসানের কোনো কাজ নেই, তাই সে মেয়ে নিয়ে বসার ঘরেই আছে। এখান থেকেই সে তদারকি করতে পারছে তার লোফার ভাইকে। যে যেচে পড়ে মেজবানদারির দায়িত্ব নিয়েছে ঠিক কিন্তু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ঘুমন্ত মেয়ে কোলে নিয়ে বসে থাকা ইহসান ভাইকে নাস্তানাবুদ হতে দেখে ক্রুর হাসছে। তার নাকে ইদানীং যেভাবে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছিল সবকিছু সামলাবে বলে, এখন সামলাক! দেখুক কী মজা! ইহসান যখন এসব ভেবে আনমনে হাসছিল, তখনি ওর ঘোর কাটে বাচ্চা ছেলের কণ্ঠ শুনে। ইহসান তাকিয়ে দেখল শারাফ তার কাছে দাঁড়িয়ে। খুব মনোযোগ দিয়ে তার ঘুমন্ত মেয়েকে দেখছে। দেখা শেষ করে শান্ত স্বরে ইহসানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ও কি ঘুমাচ্ছে মামা?”

ইহসান মেয়েকে একপলক দেখে নিয়ে ওর মাথায় আলতো হাত ছুঁইয়ে বলল, “হুম, ঘুমাচ্ছে। কেন বলো তো?”

“ওকে নিয়ে খেলা করতে চেয়েছিলাম।”

গোমড়া মুখে কথাটা একটু জোরেই বলেছিল শারাফ। যার ফলে ঘুমন্ত আজওয়ার কপাল কুঁচকে গেল খানিকটা৷ মেয়ের ঘুম হালকা হচ্ছে বুঝতে পেরে ইহসান ঠোঁটে আঙুল চেপে ‘হুঁশশশ’ শব্দ করে শারাফকে চুপ থাকার ইশারা করে ফিসফিস করে বলল, “ওর ঘুম ভাঙিয়ে খেলার অফার করাটা কী ঠিক হবে বাবা?”

শারাফ দু’পাশে মাথা নাড়ল। যার মানে কাউকে ঘুম থেকে তুলে খেলা করার অফার করাটা ঠিক হবে না। এটা ব্যাড ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে। বাবা শিখিয়েছে তাকে। আর বাবা যা শেখায় তা ভোলে না শারাফ। সে বুঝদার বাচ্চাদের মতো নিচু স্বরে বলল, “ঠিক আছে চাঁদপাখিকে পরে খেলতে ডাকব, যখন ওর ঘুম ভাঙবে। তুমি তখন পারমিশন দেবে তো?”

শারাফের মুখে ‘চাঁদপাখি’ সম্বোধন শুনে ইহসান মেয়ের দিকে তাকাল। আসলেই তার কন্যা একটা চাঁদপাখি। এত্তো আদর আদর একটা চেহারা, বাপ হয়েও মাঝেমাঝে চকলেটের মতো গিলে ফেলতে ইচ্ছে করে মেয়েকে। ইহসান হাসলো শারাফের দিকে তাকিয়ে, “অবশ্যই দেব। কেন দেব না? তুমি তো ভালো ছেলে, ভালো ছেলেদের কাছে বোন দেওয়াই যায়!”

“বোন, কে?”

শারাফের ভ্রু কুঁচকে গেল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল ইহসানের দিকে। এইটুকু বাচ্চার ভাবভঙ্গিমা দেখে বিস্মিত হলো ইহসান। সে মেয়েকে ইশারা করে দেখিয়ে শারাফকে বলল, “এইযে, এই পরীটা,
এটাই তোমার বোন। কেন, তুমি জানো না?”

“না, ও তো চাঁদপাখি। আমার বোন না।”

শারাফ বিস্মিত হয়ে গেল। ইহসান ওর পাকামো
কথা শুনে হেসে ফেলল, “চাঁদপাখি দেখেছ?”

শারাফ নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বলল, “ওকেই প্রথম দেখেছি। ইজু মামা বলেছে, তারও না কি আরেকটা চাঁদপাখি আসবে। আমার কোলে দেবে বলেছে…”

ইহসানের এতো হাসি পেল যে আরেকটু হলে মেয়ের ঘুমই ভাঙিয়ে ফেলতো। বহুকষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে শারাফকে বলল, “তুমি নিজেও তো একটা চাঁদ বাবা! আরো দু দুটো চাঁদপাখি কোলে নিতে পারবে?”

“খুব পারব। আমি তো পাপার সাথে জিমও করি। আমার অনেক শক্তি!”

শারাফ তার মাসল বের করে দেখাল। তার মধ্যে সুপারম্যানের শক্তি আছে সেটাও বলল। কীভাবে কীভাবে সে তার চাঁদপাখিদের প্রটেক্ট করবে সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনা করল ইহসানের সঙ্গে।
ওর সবগুলো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে চোখ
বড়ো বড়ো করে তাকাল ইহসান ওর দিকে। ভাবটা এমন যে, সে সত্যিই বিশ্বাস করেছে শারাফের গায়ে
অনেক শক্তি। সেই সঙ্গে কল্পনাও করল, তার আযরান কবে এতো বড়ো হবে আর তার সঙ্গে এভাবে মনখুলে কথা বলবে। সেই দিনটা আসতে ঠিক কতো দেরি? ইহসানের কি সৌভাগ্য হবে দিনগুলো দেখার? কেন যেন আচমকা ইহসানের বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো! যার কোনো মানেই সে বুঝল না।

°

মেহমানদারিতে অপটু ইজহান তার পরণের সাদা পাঞ্জাবিটাতে তরকারির ঝোল ফেলে পাঞ্জাবিটা একদম নষ্ট করে ফেলেছে। এরজন্য মেজাজ খারাপ ইজহানের। কারো সাথে রাগ দেখাতে না পেরে একটু পরপরই মিজুকে অহেতুক ধমক দিচ্ছে। বেচারা মিজু বউ নিয়ে এসেছিল অনুষ্ঠানে, ভেবেছিল আজ একটু নিস্তার পাবে এই আধপাগল স্যারের রোষানল থেকে। কিন্তু তা আর হলো কই? সে একবুক দুঃখ নিয়ে স্যারের প্রতিটা কথা মেনে চলার চেষ্টা করছে। এই একে ডাল এনে দিচ্ছে তো অন্যজনের প্লেটে মাংস তুলে দিচ্ছে। একবার এই টেবিলে ডাক পড়ছে তো অন্য টেবিলে ডাক পড়ছে। এদিকে পাঁচ নম্বর টেবিলের এক ব্যবসায়ী তার পনেরো বছরের বড়ো ছেলেকে নিয়ে খেতে বসেছে। কিন্তু একটু পরপরই ইজহানকে ডেকে বলছে, আমার ছেলে বড়ো মাছ খায় না, ওকে চিংড়ীর মালাইকারীটা দাও। দেশী মুরগী না ওকে সোনালী মুরগীর রোস্ট দাও। বোরহানিটা খেতে দারুণ, আরেকটু এনে দাও। পোলাওটা ঝরঝরে, লোকের মতো কাচ্চি করোনি ভালোই করেছ। ঐ একপদে কিছু হয়? টাকা বাঁচানোর জন্য লোকে আজকাল যত্তসব কিপটামি শিখেছে। খেয়ে আর উপহারের পয়সা উসুল করা যায় না। তবে তোমাদের আপ্যায়নটা ভালো হয়েছে। অনেকদিন পর পেটপুরে নানা পদের ভোজন সারলাম। দেখতে হবে তো, শেখ বাড়ির আপ্যায়ন বলে কথা!

তৈলাক্ত কথাবার্তা সহ্য হয় না ইজহানের। সঙ্গে সঙ্গেই ওর মেজাজ আবারও খারাপ হয়ে গেল। বাঁকা স্বরে কিছু একটা বলে উঠতে যাবে তখনি কোথা থেকে ইহসান এসে ওকে থামিয়ে দিলো৷ গগম্ভীর স্বরে বলল, “জামাকাপড় ময়লা হয়ে গেছে। ফ্রেশ হো গিয়ে। আমি এদিকটা দেখছি।”

ইজহান ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ নিয়ে বলল, “আমার মনা কোথায়? তোর কোলে না ছিলো? কোথায় ফেলে এসেছিস ওকে? রাখতে না পারলে নিলি কেন? বাপ হওয়ার দু-পয়সার যোগ্যতাও তো তোর নেই…”

যেভাবে ‘আমার মনা’ সম্বোধন করেছে, তাতে মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন ওরই। ইহসান কটমট করে বলল, “শোন, আমি ওর বাবা। মেয়ের ভালোমন্দের জন্য সব করতে পারি, জীবনও দিতে পারি। তাই পরেরবার অধিকারবোধ দেখাবি, কিন্তু আমার সামনে না। কৈফিয়ত চাইবি, আমার থেকে না। ওকে?”

বলে চলে গেল। গা জ্বলতে থাকা ইজহান তিতিবিরক্ত মুখে গালি ছুঁড়ল কয়েকটা। কিন্তু পাঞ্জাবি বদলাতে হবে বলে আর কোনো ঝামেলা না করে সে নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। বসার ঘরে আসতেই চোখাচোখি হয়ে গেল তার সমন্ধী আকাশের সঙ্গে। ইজহান সূঁচালো চোখে দেখল টুকটুকে লাল পরী এলিজা আকাশের সঙ্গে বসে আলাপে মজেছে। দেখেই গা-টা দ্বিতীয়বারের মতো জ্বলে গেল ইজহানের। আকাশকে সে ইহসানের মতোই দুচক্ষে সহ্য করতে পারে না। এও কম চেষ্টা করেনি, কম কানপড়া দেয়নি ইস্মিতাকে যেন তাকে ছেড়ে চলে যায়! তেমনিভাবে, আকাশও ইজহানকে সহ্য করতে পারে না। আদরের বোন ইস্মিকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে, বাচ্চা নষ্ট করেছে এসবের জন্য আজও সে ইজহানের উপর রাগ। কিন্তু কী আর করা, ইহসান নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে এসেছে। না এলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে, তাই বাবাকে নিয়ে শেখ বাড়িতে পা রেখেছে আকাশ। তবুও সম্পর্ক আছে একটা আকাশের সঙ্গে, স্ত্রীর ভাই হয় সে। তাই না চাইতেও ইজহান গিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল ওকে। আকাশ সেসবের উত্তর দিলো ঠিক, কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে। এলিজা ওদের মধ্যকার শীতলতা বুঝতে পেরে খুবই বিব্রতবোধ করল। হাতে একটা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল দিয়ে গিয়েছিল ইহসান, সেটা ইজহানকে দিয়ে উঠে পড়ল সে। এলিজা চলে যেতেই ইজহান আকাশকে উদ্দেশ্য করে বাঁকা স্বরে বলল, “শেখ বাড়িতে কখনো পা রাখব না বলে ঠাঁটবাট দেখানো আকাশ সাহেব আজ আমার বাড়িতে? বাহ! নিজের বাড়িতে হনুমানের ছায়া দেখে ধন্য হয়ে গেলাম। তবে খুব শ্রীঘ্রই আমার মেয়ের আকিকা খেতেও এ বাড়িতে আসতে হবে। প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে দ্বিতীয়বার এ বাড়িতে পা রাখতে লজ্জা করবে না আপনার হনুমান আকাশশশশ?”

কথার ধাঁচ গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়ার মতো হলেও যথাসম্ভব ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করে আকাশ মুচকি হেসে বলল, “যেখানে আমার বোন আছে, যাকে তুলে নিয়ে এসেছেন আপনি সেখানে ওরকম হাজারো প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে বোনের ভালোমন্দ দেখতে আসতেই হবে আমাকে। তাছাড়া মামা যখন হচ্ছিই তখন তো আরো বেশি করে আসব, আপনি না ডাকলেও আসব শেখ বাড়িতে। শুনছেন, বদমেজাজি ইজহান শেখখখখ?”

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬২ [গ]

মুচকি হাসির সহিত আকাশের মুখ থেকে বেরুনো কথাগুলো শুনে ইজহানের ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। তার সমন্ধী এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছে কেন তার সাথে? আগে তো এমন ভাবে কথা বলতো যে ইজহানের মাথায়ই রক্ত উঠিয়ে দিতো। কিন্তু আজ হাসিমুখে এসব বলে সে কি বোঝাতে চাচ্ছে? বেশ বিভ্রান্ত দেখাল ইজহানকে। পাঞ্জাবি বদল করতে
না যেয়ে গিয়ে বসলো সোফায়, ঠিক আকাশের মুখোমুখি যেটা। আরাম করে হেলে বসে হাতদুটো একটা অপরটার সাথে মিলিয়ে কণ্ঠস্বরে সন্দেহ ঢেলে বলল, “ব্যাপার কী, সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে যে আকাশ সাহেবের মুখে আজ এতো মধু?”

বোন জামাইয়ের প্রশ্ন শুনে আকাশ কিছুক্ষণ নিরুত্তর তাকিয়ে উত্তর দেয়, “মধুর চাকের খোঁজ পেয়েছি যে, তাই!”

বলেই হেসে ফেলল। আকাশের হাসিটা দেখতে ইস্মিতার মতোন। মানে কী? এই আকাশের মধ্যে তার বৌয়ের সৌন্দর্যের ছাপ কেন থাকবে? কেন? ইস্মিতার একটু হাসলেই যেখানে তার পৃথিবী বরফের মতো গলে যায় সেখানে এই হনুমানটাকে দেখলেই তো ওর থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা করে। দেয় না শুধুমাত্র ইস্মিতা ওর উপর রেগে যাবে বলে! ইজহান পলকহীন এবং বিরক্তির চোখে চেয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। সে সোজা হয়ে বসে পাঞ্জাবির হাতাদুটো গোটাতে গোটাতে গলা খাকারি দিয়ে বলল, “শেখ বাড়িতে
মধুর চাকের খোঁজ পেয়েছেন, এটাও আপনার মুখ থেকে শুনতে হলো? সত্যিই আজ সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে, নয়তো যে বাড়ির প্রতিটা জিনিসে বিষের ছোঁয়া আছে বলে আগে গজরাতেন সেখানে আজ মধুর খোঁজ পেতেন না। ভালো ভালো, এভাবেই নিজের চিন্তাধারাকে আপগ্রেড করতে থাকুন। লাইফটা আমার মতোই সুন্দর হয়ে যাবে। তখন চাইলেও কোনো হনুমানের নজর লাগবে না। এই আমাকেই দেখুন না, বেশ অনেকদিন ধরে হনুমানের নজরের আশেপাশে যাইনি বলে তিন সন্তানের বড়োআব্বা, আব্বা হয়ে গেছি।”

বারবার তাকে ‘হনুমান’ সম্বোধন করায় আকাশের প্রচন্ড রাগ হলেও প্রতুত্তরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সে, ইস্মির কথা ভেবে! কারণ মেয়েটা অনেক করে অনুরোধ করেছে ওকে, অনুষ্ঠান বাড়িতে বদমেজাজি ইজহানের সঙ্গে সে যেন বিবাদে না জড়ায়। দু’জনের মিলমিশ না করলেও ঝগড়া যেন না করে, সামনে পড়লে ফর্মালিটি রক্ষার্থে হলেও যেন দুটো ভালোমন্দ কথা জিজ্ঞেস করে। এটুকু ইস্মির চাওয়া, এটুকু করলে মেয়েটা কষ্ট পাবে না। বোনের মন রক্ষার্থে যদি তার বদমেজাজি স্বামীর কথাগুলো হজম করে বিবাদ আটকানো যায়, তাহলে সেখানে সমস্যা কোথায়? আকাশ তাই পূর্বের মতোই ঠোঁটে হাসি রেখে স্তিমিত স্বরে বলল, “তাহলে তো আমিও তিনজনের বড়ো মামা হয়ে গেছি, কী বলেন ইজহান শেখ?”

ঘাড়টা বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আকাশকে দেখল ইজহান। পরক্ষনেই তাচ্ছিল্যসরুপ বলল, “হনুমানেরাও মামা হয়? মামা হওয়ার যোগ্য? সরি টু সে, কোনো হনুমানকে অন্তত আমি আমার মেয়ের মামা হিসেবে মেনে নিতে পারব না।”

আকাশ স্থির ও রুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুখোমুখি বসা ইজহানের দিকে। মন থেকে যাকে সে, ডমিনেটিং ও ডাম্ব লোক হিসেবে জানে এবং মানে। যে নিজের স্বার্থ হাসিলে কথার জোরে, হাত-পায়ের জোরে জিততে চায়। যে তার বোনের জীবনটাকে একটা অদৃশ্য শেকলে বন্দী করে এর নাম দিয়েছে ভালোবাসা। যেখানে সে পাগলামো ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না, সেখানে তার বোন না কি এই লোককে ভালোবাসে। আকাশ বুঝে না একসময় যাকে চরম মাত্রায় ঘৃণা করতো, একসাথে থাকতে থাকতে কী এমন যাদু করল এই লোকটা তার বোনকে যে, দুটো দিনও ছেড়ে গিয়ে থাকতে পারে না? ওর করার কিছু থাকতো যদি ইস্মিতা চাইতো, যেখানে বোনই এই লোকের কাছে ফিরে আসে বারবার সেখানে সে আর কী করবে, মেনে নেওয়া ছাড়া? বুক চিঁড়ানো লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপমানটা যেন গায়ে মাখেনি এমন করে হাসলো আকাশ। এরপর একটুখানি এগিয়ে, ঝুঁকে, নিচু স্বরে বলল, “আপনার অপমানের বদৌলতে আমি যদি এখন অপমান করি তাহলে আপনার স্বভাবই এরকম যে, অনুষ্ঠান বাড়িতে এক্ষুণি একটা বিশ্রি ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলতে দু’বার ভাববেন না আমিও হয়তো নিজেকে থামাতে পারব না, সিনক্রিয়েট করে ফেলব। কিন্তু এতে কী হবে জানেন? আমার বোনটা কষ্ট পাবে, অপমানিত হবে। আপনি হয়তো আমার বোনের ভালোমন্দ, দুঃখ-কষ্ট বুঝেন না, কিন্তু আমি তো তার বড়ো ভাই? ছোটো থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে বড়ো করেছি ওকে। যাকে ছোটো থেকে আগলে আগলে বড়ো করেছি তাকে কষ্ট দিতে, তার চোখে জল আমার বিবেকে বাঁধবে। আর তা-ই কথায় কথায় আপনার অপমানগুলো হজম করে নিচ্ছি। রিয়েক্ট করছি না। কী বলুন তো, আপনি বোনের ভালো স্বামী হতে না পারলেও আমি তো ওর ভালো ভাই। তাই স্টিল
ভদ্র আছি আর থাকবও। কোনোভাবেই আমাকে ক্ষ্যাপাতে পারবেন না।” এক মুহূর্ত বিরক্তি নিয়ে আকাশ ঠান্ডা ও বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল,
“আরেকটা কথা, লোকে বলে মাহমুদুল হাসান আকাশ আর ইস্মিতা আর্শি দুই ভাইবোনের চেহারায় বেশ মিল। তাদের ব্যবহার থেকে শুরু করে নম্রতা, ভদ্রতা সবকিছুই চোখে পড়ার মতো। তারা পড়াশোনায় ভালো, দেখতে চমৎকার! উচ্চতা ভালো, গায়ের রঙ ভালো। চোখ এবং হাসি দুটোই ফিরে, চেয়ে দেখার মতোন। খুঁত হিসেবে একমাত্র তাদের কানদুটো বড়ো আর কিছুটা বাঁকানো। হনুমান না বললেও ছোটবেলায় খরগোশের কান বলেও মজা নিতো অনেকেই। আমি কাঁদতাম না কিন্তু আমার বোকা বোনটা ঠিকই কাঁদতো এসব টিটকারি শুনে। এখন আমার বোন যদি জানতে পারে, সে যারজন্য হাত পুড়িয়ে রান্না করে, মুখে তুলে তিনবেলা গিলিয়ে দেয় সেই স্বামী তার চেহারার আদলকে আড়ালে-আবডালে হনুমান বলে সম্বোধন করে তার কি খুব ভালো লাগবে ইজহান শেখ?”

আকাশের লম্বা লেকচার শুনে ততক্ষণে চোখমুখ দেখার মতো হয়েছে ইজহানের। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কালবৈশাখী ঝড়টা তার মুখের উপর দিয়ে বয়ে গেছে এই মুহূর্তে। হাত নিশপিশ করছে তার। আড়চোখে একবার বসার ঘরে নজর বুলিয়ে সে দেখে নিলো লোকজনের উপস্থিতি। এরপর উঠে এসে আকাশের কলার চেপে ধরল একহাতে। কটমট করে বলল, “মুখ দিয়ে ‘তুই’ বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, কিন্তু আমি ‘আপনি’ বলে সম্বোধনে সম্বোধন করতে হচ্ছে। কেননা, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করছি। বউ বলেছে আজ নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে। আমি বউয়ের বাধ্য স্বামী তাই বউয়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। আর ওকে মেনে চলি বলেই তার ভাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছি। তো টপিক যা ছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, জীবনে খরগোশের বাচ্চা কয়টা দেখেছেন সমন্ধী ভাইজান? যে টুপ করে বলে ফেললেন ইস্মিতার কান খরগোশের মতো বাঁকাত্যাড়া? হু? আবার নিজের সাথে মিলিয়ে বলছেনও, আমার বউয়ের সাথে আপনার চেহারার মিল আছে…’’এইটুকু বলে ইজহান আকাশের মুখটা ধরে এদিকওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে নাক সিঁটকে বলল, “কিন্তু আমি তো মিলের ‘ম’—ও দেখতে পাচ্ছি না, বিন্দুমাত্রও না। মনেই হচ্ছে না, আপনি ইস্মিতার বড়ো ভাই। বানিয়ে বানিয়ে একটা কথা কেন বলে ফেললেন সমন্ধী ভাইজান? আমার তো এক ঘুষিতে আপনার নাকের পাটা গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আমার ‘টনা’ বাবার পটি পরিষ্কার করাতে ইচ্ছে করছে! উফ! কীভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ডাহা একটা মিথ্যা কথা বলার মতো স্পর্ধা হলো আপনার? এতোবড়ো স্পর্ধাওয়ালা বুকের পাটা’টা আমি আজ দেখবই দেখব…”

“কী দেখবেন আপনি?”

চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকাল ইজহান। তিক্ত মুখে, কোমর ধরে ইস্মিকে দাঁড়ানো দেখে চট করে কলার থেকে হাতটা নামিয়ে নিলো সে। ঢোক গিলে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে অপ্রস্তুত স্বরে বলল, “দেখছিলাম সমন্ধী ভাইজানের শার্টটা কোন ফেব্রিকের, আমার গায়ে কেমন দেখাবে!” এই বলে ইজহান আকাশের দিকে তাকিয়ে কটমট করে ইশারা করল, সে যেন সহমত মিলিয়ে ইস্মির সামনে স্বীকারোক্তি দেয়। চট করে ভোল পালটে ফেলা ইজহান শেখের মুখভঙ্গি দেখে আকাশ বিস্মিত হলেও পরক্ষণেই ঠোঁটে একপ্রস্ত হাসি ঝুলিয়ে ইস্মিকে বুঝ দিলো৷ আসলেই ইজহান তার শার্টের ফেব্রিক দেখছিল! ইস্মির বিশ্বাস হতে চাইল না, সে নিশ্চিত; দু’জন ঝগড়াই করছিল। এখন তাকে দেখে ভং ধরছে! পায়ের ধারে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর, তবুও শক্ত কণ্ঠে বলল, “ঠিক তো? আমাকে মিথ্যা বলা হচ্ছে না তো?”

ইজহান এগিয়ে গিয়ে ওর হাতদুটো ধরে ফেলল,
কৌশল করে সত্যিটাকে এমনভাবে মিথ্যে বানাল যে, অবিশ্বাসের কিছু রইল না। ইস্মির তবু্ও দ্বিধা গ্রল না। ভাইয়ের টুকটাক কথা বলতে উদ্যত হচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ইজহান ওকে একপ্রকার ছিনিয়ে চলে এলো। নিজেদের ঘরের দিকে যেতে যেতে পথিমধ্যে গোমড়ামুখে বলল, “আজ খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করছ, পাখির মতো এদিক-ওদিক উড়ছ! একটু বিশ্রাম নিলে কী হয়? একটা দুর্ঘটনা ঘটলে কী করব আমি বলো তো? কতবার বারণ করেছি নিচে নামবেই না তুমি?”

ইস্মি নিজের অস্বস্তি বুঝতে না দিয়ে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে ধীরেধীরে কদম ফেলতে ফেলতে বলল, “আজ আযরান-আজওয়ার বিশেষ একটা দিন। আমি তাদের বড়ো আম্মা হয়ে কীভাবে ঘরে বসে থাকি বলুন তো? পাখি দুইটাকে দেখে চোখ জুড়াচ্ছিলাম বুঝলেন? ঘরে বসে থাকলে চোখ জুড়াতো? হু?”

অতীতের ইজহান এসব শুনে রাগে ভস্ম হয়ে গেলেও আজকের ইজহান এ পর্যায়ে গোমড়ামুখে বলল, “আমাকে দেখলে চোখ জুড়ায় না তোমার?”

সিঁড়িকোঠা পেরিয়ে প্যাসেজে উঠে এসেছে তারা। কেউ নেই আশেপাশে। লোকজন খাওয়াদাওয়া করে বিদায় নিচ্ছে। মিজুকে দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। ক্যামেরা হাতে ভিডিয়ো ক্যাপচারে ব্যস্ত সে। ইজহান
এ কাজ ধরিয়ে দিয়ে এসেছে তাকে। আকিকা অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই মূলত মিজুকে ভিডিয়ো ম্যানের কাজ দিয়েছে ইজহান। দোতলার প্যাসেজ থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত মিজুকে।
ইস্মি আশপাশটা আরো একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ইজহানের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, “সত্যি শোনাব?”

“এ নিয়ে ইস্মিতার মুখে মিথ্যে শুনলে আমি জগৎ ত্যাগ করব।”

ইস্মি ওকে নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।পাঞ্জাবির যে অংশটাতে ঝোলের দাগ বসে গেছিল সেখানটাতে খুব আলতো করে হাত রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এরপর ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাল। শান্ত স্বরে বলল, “আপনি জানেন, আপনি খারাপ একটা লোক?”

“জানি।”

“এটা জানেন, আপনি একটা মহা পাগল লোক?”

“উহু!”

“এটা জানেন, আপনি তার চেয়েও বেশি ভালো একটা লোক?”

ইজহান চোখ তুলে চাইল ওর দিকে। দৃঢ়স্বরে বলল, “এটাও জানি না।”

“আপনি জানেন, আপনি এমন একটা লোক যাকে ইস্মিতা খুব যত্ন নিয়ে, মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে? ইদানীং খুব বিশ্বাসও করে, নিজের থেকেও বেশি?”

ইজহান চুপ, উত্তর দিলো না৷ ইস্মিও আর কিছু বলল না ওকে। দেয়াল ঘেঁষে দু’জনেই দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। একে-অপরের দিকে তাকিয়ে। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ইজহানের উপলব্ধি হলো তার ইস্মিতার চোখদুটো পানিতে পূর্ণ। একদম টকটকে লাল। চোখ বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে। গাল-গলা ভিজে যাচ্ছে! ইজহান অকস্মাৎ মুখটা আগলে নেয় হাতের তালুতে। বলে, “কোনোভাবে কি ইস্মিতা কষ্ট পেয়েছে আমার থেকে? আমি কি তাকে লুকিয়ে কিছু করেছি? তাকে কষ্ট দেওয়ার মতো?” ইজহান যেন বিস্মিত ভঙ্গিতে মনে করার চেষ্টা করল সে কী করেছে; এবং সেকেন্ড গড়াতেই তার মনেও পড়ল। সহসা বলে উঠল, “হু করেছি। এক্ষুনি আমি ইস্মিতার অগোচরে তার ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। যেটা করব না বলে ইস্মিতাকে বলেছিলাম কিন্তু নিজেকে ঠিকঠাক কন্ট্রোল করতে পারিনি।”

বলেই সে ইস্মিকে ছেড়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বসার ঘরে শারাফকে কোলে নিয়ে আগ্রহভরে নিউজপেপারে এনিমেলের ছবি চেনাতে থাকা আকাশকে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল ইজহান, “মাহমুদুল হাসান আকাশ, আমার ইস্মিতার বড়ো ভাই। যাকে একটু আগেই আমি অপমানিত করার চেষ্টা করেছি তাকে মন থেকে আমি সরি বলছি। আমার মোটেও উচিৎ হয়নি, ইস্মিতার ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলার, তাকে এভাবে অপমান করার। যদিও ইন্টেশন ছিলো না, কিন্তু কীভাবে যেন ভুলটা হয়েই গেল আমার দ্বারা। তো মাহমুদুল হাসান আকাশ, আমার ইস্মিতার বড়ো ভাই। শুনছেন আপনি? অনুগ্রহ করে আমার দোষত্রুটি বিবেচনা করে একটু আগের অপমানটা কি আপনি ভুলে যাবেন? তাহলে আমি আমার ইস্মিতার চোখদুটো মুছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে পারতাম!”

লোকলজ্জা, সংকোচ বাদ দিলেও বাড়িভর্তি একগাদা মেহমান, একটা অনুষ্ঠান বাড়ি! কোনোকিছু বিবেচনায় না নিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে একজন পূর্ণবয়স্ক লোক ঘোষণা দিয়ে নিজের ভুল প্রকাশ করছে ছোটোদের মতো, অনুমতি প্রার্থনা করছে তার ইস্মিতার চোখের জল মুছে দেওয়ার। মাহমুদুল হাসান আকাশ কি পারে, বোনের চোখের জল মুছতে চাওয়া লোকটার অনুমতি নাকচ করার? সে মুচকি হেসে ভদ্র গলায় বলল, “ইজহান শেখ, আমার বোনের ভালোমন্দ হাজব্যান্ড! আমি ভুলে গেলাম একটু আগে আপনার করা দোষত্রুটি, অপমান সবকিছু। সব মানে সব। আগাগোড়া সব। আপনি আপনার ইস্মিতার চোখের জল মুছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে পারেন,
ক্যারি অন।”

কোলে বসা শারাফ সবকিছু দেখে প্রশ্নোক্ত গলায় আকাশকে জিজ্ঞেস করল, “মামার সুপার উইমেন কাঁদছে কেন?”

আকাশ হেসে ফিসফিসিয়ে বলল তাকে, “বেশি ভালোবাসা পাচ্ছে তো, তাই!”

ক্যামেরা হাতে ভিডিয়ো ক্যাপচার করতে থাকা মিজু পুরো ঘটনাটাই ক্যাপচার করে হাসলো। মনে মনে স্যারকে পাগল স্বামী হিসেবে আখ্যায়িত করল।

°

পুরোটা দিন তীব্র গরমে অতিষ্ঠতার সঙ্গে কাটাতে হয়েছে সকলকে। কিন্তু বিকেল চারটায় এই ঝড়ো, শীতল হাওয়া, তপ্ত সূর্যের প্রখরতা কমে গিয়ে মিষ্টি রোদকুচি ছড়ানো কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে জানে না ইস্মি। তবে প্রকৃতির শীতলতা দেখে মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি নামার দিন। বৃষ্টির সাথে সাথে প্রেমও নামার দিন। নয়তো ঠিক একটু আগে, একটুখানি আগে তার চোখের জল মোছার জন্য ব্যাকুল হয়ে নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করে নেওয়া স্বামীটির প্রেমে পিছলে গেল কেন ইস্মি? সারা শরীর ভেঙ্গে আসা তীব্র ব্যথা নিয়েও সে তাই স্বামীর উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে কাঁদতে ব্যস্ত। ওদিকে ইজহান বুঝতে পারছে না, তার ইস্মিতা এভাবে কাঁদছে কেন! সে তো মাফ চাইলই তার সমন্ধীর কাছে, এরপরেও কী চায় এই মহিলা? ভাইয়ের পায়ে ধরাতে চায় ইনিয়েবিনিয়ে? আচ্ছা সে না-হয় তা-ই করবে। কিন্তু মুখফুটে বলবে তো একবার, এনশিওর করার জন্য হলেও? সে অসহায় নজরে, রুক্ষ হাতদুটো দিয়ে জাপ্টে ধরে ইস্মিকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছ কেন? কাঁদবে না। আমার ভালো লাগে না তোমাকে এভাবে দেখলে। দুশ্চিন্তা লাগে, ভয় করে। বলো তো যাই, আকাশ সাহেবের পায়ে ধরে মাফ চা….”

কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না সে, তার আগেই অগণিত ঠোঁটের স্পর্শে ভিজে গেল তার পুরুষালি ঠোঁট, উন্মুক্ত রোমশ বুক। ইজহান পাথরের মতো জমে গেল হঠাৎ আক্রমণে। ঠিক জানে না সে, তবে অনুমান করল শ’য়ের নিচে হবে না ইস্মির এই কামুকীয় স্পর্শ। সে এক পৃথিবী দ্বিধা নিয়ে ইস্মিকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী হচ্ছে?”

“জমানো আদর বিলি।”

ভূমিকম্প ঘটিয়ে যেন থেমে গেছে ইস্মি, ওকে দেখে এই মুহূর্তে সেটাই মনে হলো ইজহানের। তবুও দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করল সে। ইস্মি এবারে ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে ডুকরে কেঁদে ফেলল, “তুমি একটা মহা পাগল লোক ইজহান শেখ! আর মহা বোকা। একটা ভীতুর ডিম। আর এই ভীতুর ডিমটাকে আজকে আমার খুব ভয় করছে, নিজের থেকেও বেশি।”

ইজহান বেমালুম কথা বলতে ভুলে গেল ইস্মির মুখে এসব শুনে। এই মহিলা কী পাগল হয়ে গেল না কি তাকে পাগল বানানোর পায়তারা করছে? এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? সে চুপচাপ ইস্মিকে পরখ করতে লাগল। কেন যেন, ইস্মির আচরণ দেখে ওর খটকা লাগছে। কিছু ঠিক নেই মনে হচ্ছে! কীসের জন্য, কেন হচ্ছে এসব জানা নেই তার। অস্ফুটস্বরে ঢোক গিলে বলল, “কী হয়েছে? এমন করছ কেন?”

পেটে চিনচিন ব্যথা সয়ে নিয়ে ইস্মি দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জল নিয়ে ওকে পরখ করতে করতে বলল, “কিছু হয়নি। আজ সারাদিন কাছেই তো পাইনি আপনাকে, তাই একটু দেখছিলাম। অনেক খাটুনি গেছে, না? নিন, এখন একটু বিশ্রাম করুন তো।”

“বাচ্চাদের দেখে আসি একবার!”

“ওরা ঘুমুচ্ছে। আমি জানি আপনি গেলে ওদের ঘুমাতে দেবেন না, তুলে নিয়ে আসবেন। এসব কিন্তু ভালো নয়। চুপচাপ আমি যা বলছি শুনুন!”

ঘরে এসে পাঞ্জাবি খুলে ফ্রেশ হওয়ার পর থেকেই উদোম গায়ে আছে ইজহান। পরণে নাইকের লোগো সম্বলিত নেভি ব্লু ট্রাউজার ওর। ওভাবেই ঘুমানোর জন্য ওকে একপ্রকার জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিলো ইস্মি। এরপর অতি সাবধানে, নিজের ব্যথার যন্ত্রণা সহ্য করে ড্রয়ার থেকে ঔষধের পাতা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “অনুষ্ঠান নিয়ে ভাবতে হবে না, অনুষ্ঠান শেষের পথে। মেহমানরাও চলে যাচ্ছে। বাকিসব ভাইয়ারা সামলে নেবে। আপনি এখন
কঠিন বিশ্রাম নেবেন।”

ইজহান ঘুমের ঔষধ হাতে নিয়ে বিস্মিত হতেই ইস্মি বলল, “এটা নিন, ভালো ঘুম হবে।”

বুঝতেই পারল না ইজহান তার ইস্মিতার অদ্ভুত আচরণের মানে। তবে তর্কে গেল না সে। ইস্মির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে পড়ে ঔষধটা মুখে নিলো ঠিক, কিন্তু গিলল না সেটা। অগোচরে ফেলে দিলো এবং ইস্মির কথামতো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। ওকে চুপচাপ শান্ত হয়ে শুয়ে পড়তে দেখে ইস্মি স্বস্তির শ্বাস ফেলল। শিয়রে বসে কপালে দুটো চুমু খেয়ে, অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ইজহানকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে চাদরটা টেনে ওর গায়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইস্মি। বসেই রইল চুপচাপ ওখানে।

অভাবনীয়ভাবে পেটের ব্যথাটা হঠাৎ বেড়ে গেল ইস্মির। অথচ সে ভাবতেও পারেনি সেটা। এমন বাড়ল যে, ইস্মির মনে হলো কেউ হাতুড়ি দ্বারা ওর শরীরের একেকটা হাড় পিষে দিচ্ছে। তক্ষুনি ক্ষীণ সন্দেহ হলো ইস্মির, ব্যথাটা কি সত্যিই লেবার পেইনের? তার সন্দেহ কি ঠিক? সালেহা বেগম আর পুনমের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে কেন তাহলে লক্ষ্মণগুলো? ইস্মির অবশ্য নিজের প্রতি একটু ও ভয় করছে না যতোটা না দুশ্চিন্তা হচ্ছে ইজহানকে নিয়ে। একদম পাগল একটা লোক, তার হাতে সূঁচ ফুটলেও যেখানে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে সে যদি এটা শুনে ওকে নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তাহলে ইস্মি নিজেকে সামলাবে কী, তার তো বুক পুড়ে যাবে এই মানুষটার জন্য! সন্দেহ আগেই হয়েছিল ওর, তাই অস্থির লোকটাকে
ঘুম পাড়িয়ে রাখার পদক্ষেপ নিয়েছে সে এই সময়টাতে। এটা কতটুকু কাজে দেবে জানা নেই ইস্মির, কিন্তু সে চায় মানুষটা একটুও দুশ্চিন্তা না করুক তার জন্য, তাদের বাচ্চার জন্য! কিন্তু আসলেই কী কাজটা সে ঠিক করেছে? মা হবে সে, কিন্তু বাবা তো ইজহান। সে কী কখনো মানবে, যে মায়ের অপেক্ষায় এতগুলো দিন কাটিয়েছে, তার জন্মের সময় তাকেই সেখানে রাখা হয়নি? নাহ! মানবে না লোকটা। মানবে না ইস্মির কপটচারীতাও। ব্যাপারগুলো মাথায় খেলতেই আতঙ্কে ইস্মির ফর্সা চোখমুখ নীল দেখাল। পেটের ব্যথাটা ঠিক তখনি আরো প্রকট হয়ে গেল। এতক্ষণ মুখ বুজে সহ্য করে নিলেও আর যেন দাঁড়ানোর মতো শক্তি পেল না ইস্মি। চেপে রাখা আতঙ্ক আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে এলো ওর। তীব্র ব্যথায় পেটে হাত চাপা দিয়ে অর্ধ অচেতনের মতো হয়ে কাউচে বসে পড়ল।

ইজহান তার ইস্মিতার অদ্ভুত আচরণের রহস্য উদঘাটন করতে ঘুমানোর ভান করছিল এতক্ষণ, চোখটা তাতে লেগেই এসেছিল। কিন্তু হুট করে নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর গোঙানি সরাসরি ওর মস্তিষ্কে আঘাত হানলো যেন! সে চট করে উঠে বসল বিছানায়। গা থেকে চাদর ফেলে তাকাতেই দেখল কাউচের উপর আধশোয়া হয়ে পেট চেপে ধরে গোঙাতে থাকা ইস্মিতাকে দেখে তার আত্মা উড়ে গেল। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কীভাবে যে খাট থেকে নেমে বউয়ের শিয়রে পৌঁছাল সে, জানে না। আলতো করে তুলে নিয়ে শক্ত করে বুকে চেপে আতঙ্কিত গলায় বলল, “কী হয়েছে? পড়ে গেছিলে? এভাবে বসে আছ কেন?”

ইজহান তৎক্ষনাৎ শাড়ি তুলে ওর পেট দেখল, ওখানে হাত বুলালো পাগলের মতো। ইস্মির চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছিল, তবে ইজহানকে এতটুকুতেই আতঙ্কিত দেখে ভীতি নিয়ে বলল, “আপনি উঠে এসেছেন কেন? আপনি ঘুমান গিয়ে…যান বলছি!”

ইজহান আগুন চোখে ওকে দেখল, গাল দুটো শক্ত করে ধরে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠতেই ইস্মি ওকে এমন করতে দেখে ভয়ে জমে গিয়ে নিজেই বলল, “কিছু উল্টাপাল্টা হচ্ছে, পেটে খুব ব্যথা করছে। আমি বুঝতে পারছি এটা কী! দেখুন, ওয়াটার ব্রেক হচ্ছে…”

পা গড়িয়ে তরল গড়াচ্ছে। ইজহান আতঙ্কিত নয়নে সেটা দেখল। আর দেখতেই তার মাথা ঘুরতে লাগল। এসব কী? এমন কেন হচ্ছে? তবে কী…তবে কী বাচ্চাটা ভূমিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে? এভাবে? তার ইস্মিতাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে? এভাবে ওর শরীরটাকে ব্যথা বানিয়ে দিয়ে? ইজহানের বুক কাঁপতে লাগল, শরীর টলতে লাগল। এদিকে ব্যথাটা ক্রমেই মাত্রা ছাড়াচ্ছে। ইস্মি সহ্য করতে পারছে না। শুধুমাত্র ইজহানের ভয়ে সে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি এতক্ষণ, কিন্তু এখন…আর সে পারছে না। ইস্মি আচমকা ইজহানের বুকে মাথা চেপে ওর পিঠে কিল-ঘুষি মেরে বাঁধ ভাঙা কান্নার জোয়ার বইয়ে দিলো , “বাপ হবেন আপনি, শুনছেন? একটু পর আপনার মা আপনার কোলে ঘাপটি মেরে থাকবে। শুনুন, উল্টাপাল্টা কিছু একটা হলে আমি যদি মরে যাই, আপনি কিন্তু কাঁদবেন না, শুনছেন? একদম কাঁদবেন না। ভেঙেও পড়বেন না। আপনার ভেঙে পড়া বারণ। আরেকটা বিয়েও করবেন না। পঁচাত্তর কেজির ইজহান শেখের ভার আমি সইতে পারলেও অন্য কেউ পারবে না…”

ইস্মিতার মুখে এ সময় মরার কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ইজহানের। চিৎকার করে বলল, “এই হা রা মি মহিলা, এসব বলছিস কেন? তুই না চেয়েছিলি বাচ্চা। নে, এখন ধর। পেট থেকে বের করে কোলে নিয়ে বসে থাক। নাচগান কর। আমার কী? পথের কাঙাল। আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিস, তোকে তো আমি…”

আরকিছু বলতে পারল না ইজহান। ইস্মির হাতের চাপে তার মুখবন্ধ হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখল ঘর্মাক্ত মুখে, চোখে অশ্রুজল নিয়ে ইস্মিতা ব্যথায় ছটফট করছে। নড়তে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা। রাগ কেটে হুঁশটুকু ফিরতেই ইজহান চট করে ইস্মিকে রেখে উঠে দাঁড়াল। তার ইস্মিতার ব্যথা কমাতে, পেটের ভেতর ঘাপটি মেরে তার বউকে কান্না করানোর অপরাধে অপরাধী শত্রুকে ভূমিষ্ঠ করানোর জন্য টলমল পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে কাউকে ডাকতে যাবে ; দরজার কাছে রাখা কাচের ফ্লাওয়ার ভাসটার সঙ্গে একটা ধাক্কা খেল সে। ভাসটা মেঝেতে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ফেটে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। ইজহান কদম ফেলল ভাঙা কাচের টুকরোর উপরই। একগাদা কাচ পায়ে বিঁধল তার, টেরই পেল না। দরজা খুলে বাইরে এসে একপ্রকার চিৎকার করে ডাকল সে তার ভেড়াকে, টনা-মনার মা’কে, পুনমকে, আকাশকে সবাইকে।

মেহমান বিদায় করে ডেকোরেটার্সদের বিল মেটাতে থাকা ইহসান তার লোফার ভাইয়ের চিৎকার আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এলো সিঁড়ি ভেঙে। পরপর এলো আজিজ শেখসহ ইস্মির বাবা সিরাজুল ইসলাম আর আকাশও। বাকিরা এলো তার পরেই। নীলু বেগম, সায়মার কাছে ঘুমন্ত বাচ্চাদের রেখে সৃজা, এলিজা আর পুনম যখন ছুটে এলো, ইস্মিকে দেখেই ওরা বুঝে গেল কাহিনী কী! একপ্রকার ছুটে গিয়ে ধরল ওকে। ব্যথায় নিজের হাত কামড়াতে থাকা ইস্মির অবস্থা দেখে সৃজা সালেহা বেগমকে বলে পুরুষদের গাড়ি এবং হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিলেও ইজহানকে বের করতে পারল না। সে ইস্মির পায়ের কাছে ঠাঁই বসে রইল। পুনম আর এলিজা ইস্মির হাতপায়ের তালু ম্যাসাজ করতে লাগল। নিজের পেইনের কথা মনে করে আতঙ্কে যদিও গলা শুকিয়ে আসছিল তবুও ইস্মিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ওকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করল সৃজা, “একটা পরীবাচ্চা আসবে তোমার, একদম ভয় করো না। বি ইজি। সহজ হও। ব্যথাটা কেমন? কথা বলো ইস্মি ভাবি, চোখ খোলা রাখো প্লিজ…”

অসহনীয় আর্তনাদের সহিত ইস্মি বারবার বলতে লাগল, “মরে যাওয়ার মতোন! আমি মরে যাচ্ছি, একদম মরে যাচ্ছি…ব্যথাটা মরে যাওয়ার মতোন! আল্লাহ, তুমি আমার বাচ্চাটাকে সুস্থ রাখো, ওর কিছু করো না, আল্লাহ!”

পায়ের কাছে বসে থাকা ইজহান উঠে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ইস্মির গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “পেট থেকে বের কর একবার তোর মেয়েকে, ওর কী হাল করি আমি দেখার জন্য হলেও বেঁচে থাকতে হবে তোকে। নয়তো আজ আমি বিষ খাব। নিম্নমানের বিষ। তুই তোর ছানা কোলে নিয়ে আমার কবরের সামনে বাড়ি বানিয়ে বসে থাকিস। আই সয়্যার আমি…আমি তোদের দুটোকেই কাঁচা খেয়ে ফেলব…” এরপর আরো কিছু বলতে উদ্যত হচ্ছিল, কিন্তু বলতে পারল না৷ ঢলে পড়ে গেল ইজহান সোফার উপর। মাথাটা বারি খেল শক্ত কাঠের পাটাতনে। বিকট একটা শব্দ হলো, এরপর সব চুপচাপ। ইস্মি নিজেও ব্যথা ভুলে বিস্ফোরিত চোখে দেখল নিজের স্বামীকে। পরক্ষণেই চেঁচিয়ে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল তার। ঘরের ভেতর শুরু
হলো চেঁচামেচি। পুনমের ডাকে ইহসান ছুটে এসে ভাইয়ের অবস্থা দেখে ওকে টেনেটুনে তুলে বিছানায় শুইয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিতে দিতে গালে চাপড় দিয়ে দু’বার ডাকল, “গাধারে! যাবি না তুই তোর মেয়েকে আনতে? তাহলে ঘুমিয়েই থাক, তোকে রেখে তোর বউকেই নিয়ে যাচ্ছি। রেডিমেড বাচ্চা কোলে নিস একেবারে। আমার ঝড়টা তো তুই সামলেছিলি, তোরটা এবার আমি সামলাই। এসবের বিনিময় তো শোধ করা যায় না, এবার আমার মতো তুইও থাক; আজীবন ঋণী থাক।”

ততক্ষণে আকাশ পাঁজাকোলে তুলে ইস্মিকে নিয়েছে গাড়ি অবধি নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ইস্মি তখনো ইজহানকে এভাবে রেখে যাবে না বলে বিলাপ করে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে, সে তার অসুস্থ স্বামীকে নিজে হাতে ভাত না খাইয়ে দিয়ে কোথাও যাবে না। মানে লেবার পেইনের ব্যথা নিয়ে কোনো মেয়ে তার সেন্সলেস হয়ে যাওয়া বরের জন্য এমন উতলা হতে পারে? আকাশ এদের স্বামী-স্ত্রীকে দেখে বুঝতে পারছে না সে পাগল, না কি মহা পাগলদের পাল্লায় এসে পড়েছে!

°
আকাশটা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। শীতল বাতাস জোরালোভাবে বইছে। রাস্তার ধুলো উড়ছে। বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস। পুরোপুরি সেন্স ফিরতে অনেকটা সময় নিলো ইজহান। হুঁশ ফিরতেই তার মাথায় প্রথমেই এলো ইস্মিতার কথা। চট করে উঠে বসে দেখল সে, তার ঘর শূন্য। কোথাও ইস্মি নেই। আছে জনা তিনেক চাকর। যারা তার সেবাযত্নে মশগুল। বিভ্রান্ত সে পায়ের তালু থেকে কাচের টুকরো বের করে ব্যান্ডেজ করতে থাকা মকবুলের দিকে তাকাতেই নিজে থেকেই মকবুল বলল, “ভাবীজানরে লইয়া সবাই হাসপাতালে যাইতেছে! আপনেরে রাইক্ষা যাইব না বলে ভাবীজান অনেক কান্নাকাটি করতেছিল, অনেক কষ্ট পাইছে ভাবীজান!”

ইজহান যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই, উদোম গায়ে ট্রাউজার পরিহিত অবস্থায়ই ফোনটা খুঁজে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতোন বেরিয়ে গেল সে। যেতে যেতে মিজুকে কল করতেই জানা গেল, তারা বেশিদূর যায়নি। চৌরাস্তার মোড়ে আছে। ইজহান তাকে বলল অপেক্ষা করতে, সে আসছে। ফোন কানে রেখেই ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেও ছুটতে লাগল মোড়ের উদ্দেশ্যে। মিজু গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, নিজের স্যারকে ওমন খালি গায়ে রাস্তা ধরে ছুটে আসতে দেখে সে আহাম্মক হয়ে গেল। ইহসানের দিকে বোকার মতো তাকাতেই ইহসান গম্ভীরমুখে বলল, “মাথার ঠিক নেই তোমার স্যারের, তাই এ অবস্থা! এক কাজ করো, তোমার শার্টটা খুলে দাও। পরুক।”

মিজু আমতাআমতা করে বলল, “কিন্তু ভাইজান, আমি কী পরব? ভেতরে তো একটা স্যান্ডো গেঞ্জি শুধু। আমার তো লাজশরম আছে…”

আজিজ শেখও ছিলেন সেখানে। তিনি ছেলেকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে রইলেন। মিজুকে ধমকে বললেন, “ফকিন্নির বাচ্চা লাজশরম মারাস? কী এমন শরীর রে তোর, লোকে নজর দেওয়ার মতোন? আমার পোলারে দেখ, লোকে গিল্লা খাইতেছে। দুইটা পান মুইছা না দিলে পোলাডার উপর বদনজরের আছড় লাগব! খোল তোর দুই টাকার শার্ট…”

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল মিজুর। চোখে পানিও চলে এলো হঠাৎ তার। সে ফকিন্নির বাচ্চা? তার শার্ট দুই টাকার? তার বাবার একজন স্কুল টিচার, শার্টটাও ইজি থেকে নেওয়া। ইজহান স্যার নিজে গিফট করেছে ওকে! মিজু চাপা শ্বাস ফেলল৷ এভাবে অপমান তো তার মাথাপাগলা স্যারও করেনি। অথচ আজিজ শেখ? কী অবলীলায় তাকে এতগুলো কথা বলে ফেলল! কিন্তু কী আর করার? স্যারের বাবা বলেছে, কথা না মানলে তার মতো ছা পোষা লোকের চাকরি থাকবে না। মিজু শার্টের বাটনে হাত রাখতেই পাশ থেকে ইহসান ওকে থামিয়ে দিলো। মানা করল ওকে খুলতে। আজিজ শেখের দিকে তাকিয়ে গমগমে, রুক্ষ স্বরে বলল, “ছেলের জন্য এতো দরদ থাকলে আপনার পোশাকটাই খুলে দিয়ে দিন, এমনিতেও আপনার ওখানে কোনো কাজ থাকবে না হাউকাউ করা ছাড়া। আপনি বরং, আপনার পাঞ্জাবিটা ইজহানকে দিয়ে বাড়ি গিয়ে হাউকাউ করুন, তাতে আপনার ছেলের মাথাটাই ঠান্ডা থাকবে।”

আজিজ শেখ কপালে ভাঁজ ফেলে ওকে কিছু বলতেই যাবে ইজহান হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়িতে উঠে বসলো। বসেই পুনমের পাশে বসা ব্যথায় কোঁকাতে থাকা ইস্মিতাকে একটানে নিজের বুকে নিয়ে কপালে চুমু খেতে খেতে বলল, “এই দেখো, আমি ভালো হয়ে গেছি। তোমার সঙ্গে যাবার মতো ভালো। এবার চলো, আমার শত্রুকে ভূমিষ্ঠ করাতে হবে তো, এই মিজু
দাঁড়িয়ে আছিস কেন? স্টার্ট দে না রে বাবা…”

মিজু হন্তদন্ত হয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসতেই ওপাশে গিয়ে ইহসান বসে পড়ল। পেছনে ইজহান-ইস্মি, সালেহা বেগম, পুনম। তারও পেছনের সিটে আকাশ আর সিরাজুল ইসলাম। তারা বসে বসে ইজহানের পাগলামো, বাড়াবাড়ি দেখছে চুপচাপ। এদিকে আজিজ শেখ গাড়িতে উঠে বসার প্রস্তুতি নিতেই ইজহান মিজুকে তাড়া দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

আজিজ শেখ ভ্রু কুঁচকে জবাবে বললেন, “কেন বাপজান? হাসপাতালে যাইতেছি তোমাদের সাথে।”

নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল ইজহান, “না, হাসপাতালে যাবে না। তুমি একটা স্বার্থপর লোক। যে গেলেই অশুভ কিছু হবে, উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবে। যেমনটা করেছিলে সৃজার বেলায়। উহু, আমি কোনো রিস্ক নেব না। তুমি আসবে না আমাদের সাথে৷ একদম না।”

অতঃপর থমকিত, চমকিত, স্তব্ধ, ভাষা হারানো আজিজ শেখকে চৌরাস্তার মোড়ে রেখেই গাড়িটা সাঁই করে সামনে আগাল। ঝড়ো হাওয়াসহ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল তখনই। ছেলের আচরণে বুকের ভেতর ধাক্কা অনুভব করা হতবাক আজিজ শেখ ধীরপায়ে বাড়ি ফিরলেন ভিজে ভিজে। কিন্তু বাড়ির ফেরার পর গেইটের সামনে যখন কালো রঙের চকচকে রুবিকন জীপটাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখলেন, খানিক আগের ইজহানের শক্তপোক্ত রেস্ট্রিকশনের দরুণ তৈরি হওয়ার উদাসীন ভাবটা মুহূর্তেই কেটে গেল তার। ঠোঁটজুড়ে বিচরণ করল হাসি। উৎফুল্ল মনে তিনি গেইটের কাছাকাছি পৌঁছাতেই দারোয়ান ভীতি নিয়ে তাকে খবরটা দিলো, “ছোটো ভাইজানে বাড়ি আইছে স্যার…”

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬২ ঘ (বোনাস)

হসপিটালে আসার পরপরই ইর্মাজেন্সিতে নেওয়া হয়েছে ইস্মিকে। গাইনী বিশেষজ্ঞ ওর পারচুরিশন পেইনের মাত্রা বিবেচনা ও চেকআপ শেষে জানিয়েছে চেষ্টা করলে নরমাল ডেলিভারিতেই বাচ্চা প্রসব করানো সম্ভব। তাতে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পেশেন্ট কো-অপারেট করলেই চলবে। ব্যথায় আর্তনাদ করতে করতে ইস্মি নিজেও সেটাতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে সবাইকে অগ্রাহ্য করে।
এদিকে ইস্মির সিদ্ধান্তে নারাজ ইজহান। সি-সেকশন থাকতে অহেতুক এতো কষ্ট নিতে চাচ্ছে কেন ইস্মিতা তারজন্য সে চোটপাট শুরু করল। পরে যখন সবাই বোঝাল, সি-সেকশনে তো বড়ো কাটাকাটি করতে হবে
তার থেকে নরমাল ডেলিভারিই ভালো না? এটার কষ্ট সাময়িক, দু-দিনেই ইস্মিতা স্টেবল হয়ে যাবে; তখনই মত দিয়েছে ইজহান। সে মত দেওয়ার পরই ইস্মিকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর সঙ্গে ইজহানও ডেলিভারি রুমে প্রবেশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইস্মিই ওকে নিতে চায়নি। দেখা যাবে, তাকে রেখে তার নার্ভ দুর্বল স্বামীকে নিয়েই ডাক্তারদের টানাহেঁচড়া করতে হবে। তাই অহেতুক
এই রিস্ক নেওয়ার কোনো মানেই হয় না। ইস্মির এমন নিষ্ঠুর আচরণে বুক ঝাঁঝড়া হয়ে গেছে ইজহানের। চুরমার হওয়া বুকে এতো চিন্তা, কষ্ট নিয়ে সে থাকতে পারছে না। আতঙ্কিত হয়ে উল্টাপাল্টা বকছে একটু পরপর। দাঁড়াতেও পারছিল না ঠিকঠাক, ঘেমে-নেয়ে একাকার হচ্ছিলো, দু’বার তো সেন্সলেসই হয়ে গেছিল। সেজন্য ওকে ডেলিভারি রুমের ওখানে থাকতে দেয়নি ইহসান, নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে ওয়েটিং লাউঞ্জে। ইজহান বসতে চাচ্ছিল না এখানে, কথা কাটাকাটি করছিল। শেষ পর্যন্ত চড় খেয়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে হসপিটালের পাশের মল থেকে একটা সাদা টি-শার্ট নিয়ে এসেছে আকাশ, সেটাই পরিয়ে দিয়েছে ওকে ইহসান। কিন্তু আগে একবার ডাইলেশন অ্যান্ড কারেটাজ হওয়ায় এবারে যদি কোনো সমস্যা হয় এই নিয়ে ভেবে ভেবে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে ইজহান। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও নার্ভাসনেসের কারণে তার প্রেশার ফল করেছে৷ দুর্বলচিত্তের ইজহানকে নিয়ে ইহসান পড়েছে বিপদে। এ সময়টা যে কতোটা কঠিন, নিজেও তো পার করে এসেছে। তাই ইহসান ধারণা করতে পারছে ইজহানের মানসিক অবস্থাটা এখন কেমন হতে পারে।
আর পারছে বলেই, ভাইয়ের জন্য তার মায়া হচ্ছে!

এদিকে ইস্মির বাবা সিরাজুল ইসলাম মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে তো আছেই, তার উপর আধপাগল মেয়ে জামাইকে নিয়েও তিনি চিন্তিত। ইজহানের উদ্বিগ্ন অবস্থা দেখে তার ভয় হচ্ছে এক্ষুনি না এই ছেলে আবার হার্ট-অ্যাটাক করে ফেলে। ডেলিভারি সেকশনের দরোজা থেকে সরে গিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে ইজহানকে নিয়ে বসে থাকা ইহসানকে তিনি একান্তে ডাকলেন কিছু কথা বলার জন্য। এদিকে ইহসানের হাত শক্ত করে ধরে আতঙ্কিত হয়ে একনাগাড়ে বিড়বিড় করে কিছু বলছে ইজহান, তাই সে বুঝতে পারল না এই মুহূর্তে ভাইয়ের হাত ছাড়াটা কী ঠিক হবে? না কি সিরাজুল ইসলামের ডাক শোনাটা ঠিক হবে! দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে সে অবশ্য ইজহানের পাশে থাকারই সিদ্ধান্ত নিলো। ইস্মির বাবাকে বলল, “চাচাজান, কোনো গুরুত্বপূর্ণ দরকার না থাকলে একটু পরে আসি? আপনার মেয়েজামাই তো আমার হাত ছাড়ছে না।”

সিরাজুল ইসলাম ম্লানমুখে হেসে নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, “না না তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। আমি জামাইরে নিয়াই বলতাম, ওর তো প্রেশারটা ঠিক নাই, যদি দুইটা খাওয়াইয়া ঘুমানোর ব্যবস্থা করতা তাইলে ভালো হইতো। আমি কী আকাশরে কমু ডাক্তারের সাথে কথা বলতো? তারা আইসা না হয় ইনজেকশন দিয়া যাইতো…”

শ্বশুরের কথা কানে আসছিল ইজহানের। তবে অতোটা মনোযোগ দিচ্ছিল না। কিন্তু ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে বুঝতে পেরে শতচিন্তার মধ্যেও সে একটু তাকিয়েছিল। তাকানোর ফলে যে, তাকে নিয়ে করা ষড়যন্ত্রটা সে ধরতে পেরে যাবে তা ভাবেনি। কী সুন্দর শ্বশুরমশাই তার ভাইকে পরামর্শ দিচ্ছে, ইস্মিকে রেখে তাকে যেন সেডেটিভের প্রভাবে রাখে! মানে ভাবা যায়? একটা মানুষ কতোটা বিবেকহীন হলে এসব কথা বলতে পারে? মেজাজটা চটে গেল তার। একটা চেয়ার উলটে ফেলে দিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে সে সিরাজুল সাহেবকে উদ্দেশ্য তিরিক্ষি স্বরে বলল,
“বাবা হওয়ার সংজ্ঞা জানেন? না কি নামেমাত্রই বাবা হয়েছেন? আপনার বউ যখন আপনার মেয়েকে জন্ম দিচ্ছিল, আপনি নিশ্চয় তখন ঘুমাচ্ছিলেন! সেজন্যই তো মেয়ের প্রতি মায়া-মহব্বত দেখি না। যেই দেখছেন ইস্মিতা একটা ক্রিটিকাল সিচুয়েশনে আছে ওমনি আমার ঘর ভাঙ্গার ধান্ধাবাজি শুরু করেছেন। এ সময় আমাকে ঘুম পাড়িয়ে পরে, ইস্মিতার কান ভাঙাবেন, উল্টাপাল্টা বোঝাবেন, ওর কাছে আমাকে কালার করে এটাকে ইস্যু বানিয়ে ওকে বোঝাবেন আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন, স্বার্থপর, ওকে ভালোবাসি না, ওকে মানসিক প্রেশার দেই, টর্চার করি। ও যাতে আমাকে ছেড়ে দেয়, আমার সংসার ছেড়ে দেয়! কী ভেবেছেন? আমি টের পাই না শ্বশুর আব্বা? আমি সব টের পাই। আমি বুঝতে পারছি না, এতো ভালোবাসি আমি ইস্মিতাকে, এরপরেও স্বার্থপরের মতো আমার থেকে কীভাবে কেড়ে নিতে চান ওকে? আপনি আমার ইস্মিতার বাবা হলো কীভাবে! আশ্চর্য!”

যার জন্য করি চুরি সে-ই বলে চোর? সিরাজুল ইসলাম পুরোপুরি হতভম্ব বনে গেলেন। লজ্জায় মাথা কাটা গেল তার যখন ইজহান খোঁচা মারল এ বলে যে, তিনি বাবা হয়ে মেয়েকে ভালোবাসেন না, মেয়েকে কান ভাঙানি দেন, ঘর ভাঙানোর চেষ্টা করেন! অথচ তিনি ইস্মিতা আর্শির মতো এমন একজনের বাবা, যাকে স্ত্রী বিয়োগের পর আটটা বছর বুকে আগলে বড়ো করেছেন। ফুলের টোকাও দেননি। মন খারাপ নিয়েও সিরাজুল সাহেব অপ্রস্তুত হেসে, বেঁফাস কথাবার্তা না শোনার আশায় সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। ওদিকে সহজসরল শ্বশুরের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করায় ইহসান ঝাড়ি মেরে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কটমট করে রুক্ষ স্বরে ইজহানকে বলল, “তুই কখনো মানুষ হবি না? শ্বশুরের সাথে এভাবে কথা বলে? তিনি কতোটা সহজসরল মানুষ তুই জানিস না? হারামি তোকে সাধে বলি?”

ব্যতিব্যস্ত ও মেজাজ হারানো গলায় ইজহান অতিষ্ঠ হয়ে খ্যাঁকিয়ে উঠল, “আমি আছি আমার জ্বালায়, একেকজন জ্ঞান দিতে আসছে। আরে আমি কী কারোর ধার ধারি নাকি যে জ্ঞানের পাহাড় সবাই আমার উপরই ঝাড়বে? মেয়ে নিতে এসেছি আমি এখানে। মেয়ে ফুটুক, বউ নিয়ে বাড়ি যাব আমি! আল্লাহ আমার বউ-বাচ্চা সুস্থ রাখুক। শালা, শ্বশুরের বদনজরের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করুক ওদের! আমিন…”

হাসবে না কাঁদবে ইহসান? এটা তার ভাই? উদোম গায়ে, ঢুলুঢুলু চোখে, টলমল পায়ে একবুক ভয় নিয়েও তেজ দেখিয়ে কথা বলছে৷ অথচ ভেতরটা পুরোটাই ফাঁকা। রক্তাভ চোখের কোণে স্পষ্ট পানি। হঠাৎ এতো মায়া ঠেকল বুকের ভেতরে, ইহসান নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে বাদ দিলি কেন? আমিও যদি নজর লাগিয়ে দেই?”

“পরিপূর্ণ মানুষ কখনো অপূর্ণদের নজর দেয় না—তাদের চোখ থাকে ওপরে, সমতলের ঊর্ধ্বে। অপূর্ণরাই চেয়ে থাকে পরিপূর্ণদের দিকে—তৃষ্ণার্ত চোখে, অপূর্ণতা ঢাকার আশায়, একটু আলো পাওয়ার আশায়। তোর কাছে আমার আযরান-আজওয়া আছে…আর যে হৃদয়ে তারা আশ্রয় নেয়, সে হৃদয় কোনোদিন অপূর্ণ থাকে না। তাই তুই চাইলেই পূর্ণতা—তুই তো তোর ভেতরেই আমার অসমাপ্তির শেষ শব্দটা বয়ে নিয়ে চলেছিস।”

ইহসানের ঠোঁটের কোণে হঠাৎ অস্পষ্ট হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এমন গুরুগম্ভীর কথাবার্তা তার ভাই কোথা থেকে শিখল? এসব কি বলে সে? পূর্ণতা, অপূর্ণতার মানে সে বোঝে? বোঝে ইহসান আজীবনেও পরিপূর্ণ হতে পারবে না একটা মানুষের জন্য, তার জন্মদাতা মায়ের জন্য? তার স্নেহের অভাবে? বোঝে না কেউ! ধীরপায়ে এগিয়ে ইজহানের একটা হাত নিজে থেকেই সে ধরল, যেন ভাইকে সে ভরসা দিলো। বউয়ের চিন্তায় দুনিয়া ভুলে যাওয়া ইজহান একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ভেড়াটার আচরণ সন্দেহজনক! এ এমন করছে কেন? আচ্ছা, যা খুশি করুক। সে এসব নিয়ে ভাবছে কেন? ডেলিভারি রুমে ইস্মি এখন কী করছে? বাচ্চাটা কী বেরিয়েছে, দুনিয়ার আলো দেখেছে? ইস্মিতার ব্যথা কী কমেছে? কেমন আছে মেয়েটা? ও কী যাবে একবার? স্টাফগুলো দরজা খুলবে? হাজারো প্রশ্নের ভারে ইজহানের মস্তিষ্কটা পাগল পাগল লাগল! শেষে এটাও মনে হলো, আচ্ছা মেয়েই হয়েছে তো? না কি আরেকটা আযরান? নাকি আজওয়ার আরেকটা বোন, তার মা? হু? ইজহানের দুর্বল মস্তিষ্ক আরো দুর্বল লাগল, চিন্তাধারার শক্তি হারিয়ে সে মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করতে লাগল, “একটা আজওয়া চাই আমার—আমার একটা মা। ভেড়াটার মায়ের মতো! ইহসান-ইজহানের মায়ের মতো। আল্লাহ ইস্মিতার পেটে আমার একটা মা’ই দিও, আমি খুব খেয়াল রাখব তার…”

পাশে বসা ইহসান ইজহানের বিড়বিড় করা কথাগুলো শুনে নির্বাক তাকিয়ে রইল। একটা মায়ের অভাবে তারা একেকটা ভাই স্বাভাবিক জীবন থেকে কতোটা বঞ্চিত হয়েছে এটা বাইরের কেউ বুঝতে পারবে না।তারা বড়ো হয়েছে বাবার সম্পদ উড়িয়ে, নিজেদের মতো, লক্ষ্যহীন। মা-হীন জীবন কেমন, তারা জানে। এটাও জানে, অঢেল সম্পদের পাহাড়ে থাকলেও, বাবার ছায়া থাকলেও একটা আপন মায়ের অভাব কেউ পূরণ করতে পারে না, কেউ না। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা এতো দামী আর দুর্লভ যে পুরো পৃথিবীর বিনিময়েও তা এনে দেওয়া সম্ভব হয় না। যদিও সম্ভব হয়, তার বেশিরভাগটাই হয় মেকি, লোক দেখানো। ইহসান চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাবে সে, এই দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে? দু-ভাই এভাবে পাশাপাশি বসে থেকে তাদের আর কোন মায়ের আগমনের আশায় একে-অন্যের ভরসা হবে? আচ্ছা, ইজহানের প্রার্থনাটা এবারের মতো সত্যিই হতে পারে না? আরেকটা মা এসে তাদের মাতৃহীন জীবনটা সুন্দর ফুলে ভরিয়ে দিতে পারে না?

অবশ্যই দিতে পারে এবং দিলোও। আধঘন্টা যাবৎ কঠোর চেষ্টার পর মা ডাক শোনার আশায় তৃষ্ণার্ত ইস্মিতাকে, বাচ্চা অপছন্দ করা একটা মহাপাগল ইজহানকে সৃষ্টিকর্তা একটা ‘মা’—ই দিলো। যাকে প্রথমবার কোলে নিয়ে ইজহান জ্ঞান হারিয়ে ফেলল!
_________

চলবে….