শর্তসাপেক্ষে পর্ব-০২

0
2

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২

” চাকরি দিতে হবে আপনার বয়ফ্রেন্ডকে? তাতে আমার লাভ?” কুটিল হেসে প্রশ্নটা করে ঈশান। ঠোঁটের নিচে আঙুল দাবিয়ে এমনভাবে তাকায় যেন ঠাট্টা করছে।

দিবা মুখ শক্ত করে বলে,” আমিও তো আপনার মেয়েকে দেখা-শোনার দায়িত্ব নিচ্ছি। যে আদতে আমার সন্তানই নয়। স্যরি কথাটা শুনতে রুড হলেও এটাই সত্যি। আমি যেমন কোনো স্বার্থ ছাড়া এই পরিণতি মেনে নিচ্ছি তেমন আপনিও আমার একটা ছোট্ট উপকার করবেন। আমার বয়ফ্রেন্ডকে চাকরি দিবেন।”

” তাও পারমানেন্ট চাকরি! তাইতো?” ভ্রু উঁচু করে কেমন বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলে ঈশান।

দিবা অস্বস্তি নিয়ে মাথা নিচু করে রেখে বলে,” হুম।”

ঈশান পা দু’টো লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে আয়েশের ভঙ্গিতে বসতে বসতে বলে,” তা কি করে আপনার বয়ফ্রেন্ড? শুনি?”

” আপাতত কিছুই করে না। মাস্টার্স পাশ বেকার।”

” তো আপনি একটা বেকার যুবককে বিয়ে করবেন না। নিজের পাশাপাশি নিজের বয়ফ্রেন্ডের ফিউচার সিকিউর করার একটা দূর্দান্ত পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন দেখছি! বিয়ের পর যে আপনি ওই ছেলের সাথে পরকিয়া করবেন না তার গ্যারান্টি কি?”

দিবা থতমত খায় এমন প্রশ্নে। লোকটিকে ছবিতে দেখে যতটা ভদ্রলোক মনে হয়েছিল, সামনা-সামনি দেখে আর কথা শুনে ঠিক ততটাই অভদ্র আর ছ্যাচড় মনে হচ্ছে। এবার সে বুঝতে পারে কেন এই বেটার আগের বউ থাকেনি। ভালোমানুষ হলে কি আর বউ ছেড়ে চলে যেতো?

দিবা নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে জবাব দেয়,” দেখুন আপনি আমার সম্পর্কে যা ভাবছেন তা নয়। আমি আমাদের মধ্যে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে তবেই আপনার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছি। তাছাড়া আপনি এতো মিন মাইন্ডেড প্রশ্ন আমাকে কিভাবে করতে পারলেন?”

শেষ বাক্যটা মুখ কুঁচকে উচ্চারণ করে দিবা। ঈশান স্বাভাবিক স্বরে বলে,” যেমন করে আপনি স্পষ্টভাবে নিজের সমস্যার কথা বললেন, আমিও বললাম। অবশ্যই আমি কোনো চরিত্রহীন মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইবো না।”

দিবা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” তাহলে আমাদের আর না এগোনোই ভালো মিস্টার ঈশান৷ কারণ এখন তো আমি আর নিজের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট আপনাকে দিতে পারব না। যদি আমার অতীত মেনে নিতে আপনার কষ্ট হয় তাহলে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।”

কথা শেষ করে দিবা চলে যেতে নেয়। ঈশান পেছন থেকে বলে,” আপনার বয়ফ্রেন্ডের চাকরি কোন পোস্টে হবে? স্যালারি কেমন হবে? সেটাও কি ডিসকাস করে নিবেন? নাকি আমি নিজের ইচ্ছামতো সব করব?”

দিবা থামে। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে পেছনে ঘুরে বলে,” এই না বললেন চরিত্রহীন মেয়ে বিয়ে করবেন না? হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলানোর কারণ?”

” আপনাকে দেখে দয়া হলো। তাই ভাবলাম বিয়েটা না হলেও আপনার বয়ফ্রেন্ডকে চাকরি থেকে বঞ্চিত না করি।”

দিবা নরম হেসে বলে,” ধন্যবাদ ঈশান সাহেব, কিন্তু আপনার দয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”

রাত অনেক বেড়েছে৷ রেবা দুশ্চিন্তা বোধ করছে। দিবা এখনও ফেরেনি। এতো রাতেও মেয়েটা বাইরে কি করছে? আগামীকাল তার গায়ে হলুদ। বিয়ের আগে আবার কোনো বিপদ ঘটবে না তো?

রেবা অস্থিরতা নিয়ে ছুটে যায় বারান্দায়। তুহিন রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দোল খাচ্ছে। তার হাতে সিগারেট। দেখে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী মানুষ আর কেউ নেই। রেবাকে দেখেই বলে,

” তুমি এখনও ঘুমাওনি রেবু? শুয়ে পড়ো। নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করছো? আমার দেরি হবে। কাল তো অফিস ছুটি।”

রেবা রাগে গজগজ করে বলে,” আমার বোনটা এখনও বাড়ি ফিরেনি। আর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাবো? তুমি ভাবলে কি করে?”

সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ পড়ে তুহিনের কপালে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে প্রশ্ন করে,” দিবা এখনও ফিরেনি? গিয়েছে কোথায়?”

” আমি জানি না।”

” ফোন করো।”

” মোবাইল রেখে গেছে।”

” বাড়ি থেকে আবার পালিয়ে যায়নি তো?” প্রশ্নটা করেই তুহিন ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। দিবা পালিয়ে গেলে তার মান-সম্মানের বারোটা বেজে যাবে। সবার আগে যাবে তার চাকরি। এই অঘটন যেন কোনোমতেই না ঘটে। অন্যদিকে স্বামীর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থা দেখে রেবা হাসে। তাচ্ছিল্য করে বলে,” সেরকম হলে তো ভালোই ছিল।”

” ভালো ছিল মানে?”

” ওই ডিভোর্সি বেটাকে বিয়ে করার চেয়ে পালিয়ে যাওয়াই ভালো। দিবা যদি সত্যি পালায় তাহলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হবে না।”

” তুমি কি পাগল হয়ে গেলে রেবু? দিবা পালালে কি হবে জানো? তোমার স্বামী চাকরি হারাবে।”

রেবা দায়সারা কণ্ঠে বলে, ” হারালে হারাবে। একটা চাকরি গেলে দশটা আসবে। কিন্তু আমার বোনের জীবন নষ্ট হলে সেই জীবন আর ফিরে আসবে না।”

” জীবন নষ্ট হওয়ার কথা আসছে কেন? ঈশান স্যারের সাথে বিয়ে হলে দিবার জীবন নষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তুমি তো আমাদের স্যারকে চেনো না। সাক্ষাৎ ফেরেশতা। তার মতো ভালোমানুষ আমি আর কোথাও দেখিনি।”

” এতোই যদি ভালোমানুষ হবে তাহলে প্রথম বউ টিকল না কেন?”

” প্রথম বউ টিকেনি এটা তার গাফিলতি। স্যারের কোনো দোষ নেই।”

” স্যারের গুণগান করা শেষ হলে এবার তুমি একটু বাইরে যাও। দিবা কোথায় আছে খুঁজে আনো। আমি আর টেনশনে টিকতে পারছি না।”

” শান্ত হও। দিবা কি আমার বোন নয়? তোমার যেমন চিন্তা হচ্ছে, আমারও তো হচ্ছে।”

রেবা খানিক উত্তেজিত গলায় বলে, ” কিন্তু তোমাকে দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। তুমি শুধু ভাবছো তোমার চাকরি যাওয়া নিয়ে।”

ঠিক এই পর্যায় ‘সাঁই’ ধরণের একটা শব্দ হয়। রেবা ও তুহিন দু’জনেই একটু চমকে ওঠে। বারান্দার জানালা দিয়ে তারা নিচে তাকায়। বড় একটা গাড়ি এসে থেমেছে সদরের সামনে। তাদের এই বিল্ডিংয়ে এতোবড় গাড়ি কারো নেই। দু’জনেই কৌতুহল মেটাতে চেয়ে থাকে। গাড়ি থেকে কে নামছে সেটা দেখা দরকার। অতঃপর দু’জনে আরও একবার চমকায়। গাড়ি থেকে দিবাকে নামতে দেখা যাচ্ছে। তুহিন সঙ্গে সঙ্গে জমে যাওয়া কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে,” এটা তো আমার বসের গাড়ি।”

রেবা চোখ বড় বড় করে বরে,” তোমার বসের গাড়িতে এতোরাতে দিবা কি করছে?”

” সেটা দিবা এলে তাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে।”

দিবা চলে আসার সময় ঈশান প্রশ্ন করে” আমাকে ভেতরে যেতে বলবেন না?”

দিবা কঠিন মুখে বলে,” আসুন।”

গাড়ির স্টেয়ারিং-এ হাত রেখে হাসে ঈশান, বলে,” না থাক, এতোরাতে আমি উপরে গেলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না।”

দিবা একটু স্বস্তি পায় তবে মেজাজটাও খারাপ হয়। লোকটা ই’তরামি করছে তাকে ভ’য় দেখানোর জন্য। ঈশানকে এখন বাড়িতে নেওয়া সম্ভব না তার পক্ষে। সে যে এই রাতের বেলা ঈশানের কাছে গিয়েছিল এই কথাও বাড়ির কেউ জানে না। যদি আপা অথবা দুলাভাই জেগে থাকে তাহলে দিবার সাথে ঈশানকে দেখলে কেলেংকারী ঘটবে। দিবা ইতস্তত করে বলে,” বায়।”

ঈশান গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়। ডোরবেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে যায়। রেবা দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় রণচণ্ডী ভাব। দিবা একটু ভড়কায় আপার মুখ দেখে। সে রেবাকে মোটামুটি ভ*য়ই পায়। সব বিষয়ে অযথা চেঁচামেচি করা তার অভ্যাস। রেবা প্রশ্ন করে,” কোথায় গিয়েছিলি?”

দিবা মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,” আমার একটা ফ্রেন্ড আজ এব্রড চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই খবরটা পেলাম। তাকে সিঅফ করতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম।”

রেবা কি*ড়মি*ড় করে বলে,” এতো দারুণ মিথ্যা বলা কার কাছ থেকে রপ্ত করেছিস?”

দিবা থতমত খায়। পেছন থেকে তুহিন রসিকতার সুরে বলে,” এয়ারপোর্টে বুঝি বসও ছিলেন? তার সঙ্গে তোমার কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে গেল। তারপর তিনি হবু স্ত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। এজন্যই তুমি ঈশান স্যারের গাড়ি থেকে নেমেছো৷ তাই না?”

দিবার চেহারা র*ক্তশুন্য। রেবা কঠিন দৃষ্টিতে বলে,” এতোরাতে তুই ওই বেটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিস কোন আক্কেলে? ল*জ্জা-শ*রমের কি মাথা খেয়ে ফেলেছিস?”

দিবা মাথা নিচু করে বলে,” স্যরি।”

” কিসের স্যরি? কেন গেছিলি ওখানে বল?”

” ওটা আমাদের ব্যক্তিগত কথা। আমি তোমাদের বলতে পারবো না।”

এটুকু বলেই দিবা ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়৷ রেবা হাঁ করে চেয়ে থাকে৷ তুহিন হেসে ফেলে। ঠোঁট উল্টে বলে,” বিয়ের আগে বোঝাপড়া করে নেওয়াই ভালো কিন্তু। দিবা বুদ্ধিমতী মেয়ে। মনে হচ্ছে ওদের জুটি দারুণ মানাবে!”

রেবা আর কিছু বলে না। তার মেজাজ অনেকটাই ঠান্ডা হয়েছে আগের চেয়ে। কারণ বারান্দার জানালা থেকে সে ঈশানকে দেখেছে। যদিও ঈশান গাড়ি থেকে বের হয়নি। রেবা ভেতর থেকেই দেখেছে৷ এক বাচ্চার বাবা হিসেবে ঈশানকে সে যেমন ভেবেছিল, ঈশান মোটেও তেমন নয়। দেখতে খুব সুদর্শন। এর আগে রেবা ঈশানের পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি দেখেছিল। সেই ছবিতে ঈশানকে অতোটা ভালো লাগেনি। যে কারণে বিয়েতে রেবার এতো অসন্তুষ্টি কাজ করছে। কিন্তু আজ স্বচক্ষে দেখার পর তো ভালোই মনে হলো৷ বিয়েটা নিয়ে মোটামুটি আশাবাদীই হওয়া চলে। এক বাচ্চার বাপ হলেও যদি মানুষ হিসেবে ভালো হয় তাহলে সমস্যা কি?

ঘরে এসে দিবা চুপচাপ বসে থাকে। তার মনে পড়ে রাফিনের সাথে কাটানো দিনগুলোর কথা। যদিও সে ঈশান সাহেবকে বড় মুখ করে বলেছে, রাফিনের সাথে তার সম্পর্কের ইস্তফার কথা। কিন্তু আদৌ কি সেটা সত্যি ছিল?

ঈশান বাড়ি ফিরে দেখে রোজার খুব ভেঙে গেছে৷ আয়েশা রোজাকে কোলে নিয়ে জেগে আছেন। ঈশান ফেরা মাত্রই তিনি বলেন,” এতোরাতে কই গিয়েছিলি বাবা?”

” কাজ ছিল। রোজা কখন উঠেছে?”

” ওর মা ফোন করেছিল। ওর সাথে কথা বলতে চাইল।”

রোদেলার প্রসঙ্গ আসতেই কান গরম হয়ে ওঠে ঈশানের। রাগী কণ্ঠে বলে,” তুমি রোজাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কথা বলতে দিয়েছো?”

আয়েশা করুণ স্বরে বলেন,” কি করবো? মেয়েটা এতো কাঁদছিল! রোজা তো কথা বলতে পারে না৷ শুধু একটু মায়ের আওয়াজ শুনতো।”

” আর কখনও যদি রোদেলা ফোন করে তাহলে আমার অনুমতি ছাড়া রোজার কাছে ফোন দেবে না।”

আয়েশা বাধ্যের মতো মাথা নেড়ে বলেন,” আচ্ছা। কিন্তু রোদেলা বলছিল রোজার সাথে একবার দেখা করতে চায়। আমার কাছে খুব অনুরোধ করল।”

ঈশান অবহেলা ভরা কণ্ঠে বলে,” প্রশ্নই আসে না!”

তারপর বারান্দায় গিয়ে হোসেনকে একটা ফোন করে সে। হোসেন ঈশানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মধ্যে একজন। দিবার উপর চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি করতে বলে দেয় সে হোসেনকে। মেয়েটা কখন কোথায় যায়, কি করে, কার সাথে দেখা করে, সবকিছুর খবর পাই টু পাই যেন ঈশানকে জানানো হয়। জীবনে একবার ভুল করে সে ঠকেছে, দ্বিতীয়বার আর সেটা হবে না!

চলবে