শর্তসাপেক্ষে পর্ব-১৫+১৬

0
1

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১৫
Sidratul Muntaz

তিনটা বাজতে যাচ্ছে, এখন মধ্যরাত। অন্ধকার শহরটা নিস্তব্ধ একদম। ঘুমে তলিয়ে আছে প্রায় সবাই। ক্লান্তিতে দিবারও চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। ঘরে এসে দরজাটা আটকে দেয় সে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে আছে ঈশান। ভ্রু কুঁচকে কি যেন করছে খুব মন দিয়ে। বেডরুমের আনম্র আলোয় তার কঠিন মুখের আদলটাও খুব মায়াবী হয়ে উঠেছে।

দিবা কোমরে হাত রেখে তাকে দেখে কয়েক পলক। তারপর হঠাৎই ল্যাপটপটা ওর কোল থেকে সরিয়ে নিজেই বসে পড়ে সেখানে। ঈশান মৃদু চমকায় তবে অবাক হয় না। দিবার এসব পাগলামিতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই কয়েকদিনে। বরং ব্যাপারগুলো তার মজাই লাগে৷ সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দিবার কোমর। কপালে চুমু দিয়ে প্রশ্ন করে,” রোজা ঘুমিয়েছে?”

“উহুম৷ কিন্তু ঘুমিয়ে যাবে। আপার কাছে রেখে এসেছি।কিন্তু আপনি কি করছিলেন? এই মাঝরাতেও কাজ নিয়ে বসে আছেন? তাহলে আমাকে ডাকলেন কেনো শুনি?”

ঈশান ব্যস্ত হয়ে বলে,” আরে আমাদের রিসেপশনের ছবিগুলো আপ্লোড করেছে মিসেস ইলোরা। আমি নিষেধ করেছিলাম। পরে সিলেক্ট করে নিজে আপ্লোড কর‍তাম। এখানে সব আজে-বাজে ছবি। সুন্দর ছবি একটাও নেই।”

দিবা আগ্রহ নিয়ে ল্যাপটপটা কাছে এনে দেখে। তারপর হেসে বলে,” কই? আমাকে তো সুন্দরই লাগছে।”

” তোমার ছবি ভালো হয়েছে, কিন্তু আমারগুলো দেখো!”

” ছবি সুন্দর হওয়ার জন্য চেহারা সুন্দর হওয়া বেশি জরুরী ঈশান সাহেব।”

ঈশান ভ্রু কুঁচকে করে তাকায়, দিবা ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রেখেছে। ঈশান বলে,” এর মানে তুমি বলছো আমাকে দেখতে খারাপ তাই আমার ছবিও বাজে এসেছে?”

দিবা মাথা নাড়ে। পর পর হেসে উঠে ঈশানের রুক্ষ গাল টেনে দিয়ে বলে,” ফান করছিলাম রোজার বাবা। আপনি আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। তবে একটু হাসেন কম। ছবি সুন্দর হওয়ার জন্য হাসি জরুরী!”

ঈশান হাসে এই কথায়। দিবা সাথে সাথে মুখে হাত রেখে বলে,” ইশ, এইতো কি মিষ্টি দেখাচ্ছে! এইভাবে শুধু আমার সামনেই হাসবেন প্লিজ। অন্যকোথাও না।”

ঈশান ঝট করে দিবাকে ঘুরিয়ে বালিশে শুইয়ে দেয়। বিস্মিত হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় দিবা। ঈশান আলতো করে দিবার নাকে চুমু খেয়ে বলে,” তুমিও আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী, শুধু একটু অবুঝ!”

দিবা হেসে দেয় ফিক করে৷ আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,” সংসারে দু’জনেই মুরব্বি হলে ভালো লাগে না। একজন ম্যাচিউর হবে আর অন্যজন অবুঝ। এটাই ব্যালেন্স!”

বলেই বামচোখ টিপে সে। ঈশান ঘোরগ্রস্তের মতো তার চোখের পাতায় চুমু খায়। একটু পর তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয় না৷ শুধু শরীরী ভাষা বিনিময় আর কিছু মিষ্টি অনুভূতি। ধীরে ধীরে ভোরের আলো এসে থাই গ্লাসে উঁকি মারে। আবছা সোনালী কিরণ সাদা পর্দা ভেদ করে রুমে ঢুকে যাচ্ছে। দিবার চোখের ঘুম ছুটে গেছে তখন। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। পর্দার ফাঁক গলে প্রবেশ করছে মিষ্টি রোদ, মৃদু ঠান্ডা বাতাস। ঈশান ঘুমে কাবু। যদিও এখনও পুরোপুরি ঘুমায়নি, দিবা কনুইয়ের সাহায্যে তার বুকে ধাক্কা মেরে বলে,” শুনুন।”

” হুম?” ঘুমো ঘুমো স্বরেই আদুরে কণ্ঠে সাড়া দেয় ঈশান।

দিবা জিজ্ঞেস করে,” আপনি কিন্তু এখনও আমাকে বলেননি রোদেলা কিভাবে আমাদের রিসিপশনে এসেছিল।”

” আমি জানি না দিবা! কতবার বলবো?”

” আপনি না জানলে সে এলো কিভাবে?”

” মিসেস ইলোরা বলেছিলেন হয়তো। তার সাথে রোদেলার ভালো সম্পর্ক ছিল। অবশ্য এখনও আছে।”

দিবার মাথায় জমে থাকা রাগটা চিড়বিড় করে ওঠে৷ রোদেলার গা জ্বালানো হাসির ভঙ্গিটা মনে হতেই আরও বেশি মেজাজ খারাপ হয়। আর সে যখন ইচ্ছে করে ঈশানের গা ঘেঁষে ছবি তুলছিল, ওই দৃশ্য স্মৃতিপটে ভাসতেই ক্রোধে র’ক্ত উঠে যায় মাথায়।

” মিসেস ইলোরা এই কাজটা কেনো করলেন? আমাকে জ্বালানোর জন্য তাই না?”

“তুমি কেনো জ্বলবে?”

” কেনো জ্বলবো মানে? রোদেলা যে আপনার গা ঘেঁষে ছবি তুললো, ওসব কি আমি দেখিনি ভেবেছেন?”

” তাতে কি এমন হয়েছে? আমি তো কিছু করিনি।”

” তবুও ও কেনো আসবে?”

ঈশান চোখ বন্ধ রেখেই হাসে। দিবাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,” পজেসিভ হয়ে যাচ্ছো মিসেস ঈশান আহসান৷ আমার রোগটা তোমার উপর ট্রান্সফার হয়ে গেল নাকি?”

” হুম৷ জানেন না, সঙ্গদোষে লোহা ভাসে?”

” ঠিকাছে এই নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো। এখন একটু ঘুমাতে দাও প্লিজ। সকাল দশটার মধ্যে আমাকে অফিসে যেতে হবে।”

” অফিসে যাওয়া এতো জরুরী? কেনো সুন্দরী এমপ্লয়িরা ওয়েট করছে বুঝি?”

” না। আমার বিদেশী ক্লায়েন্টদের সাথে জরুরী মিটিং আছে, খুব জরুরী! এটেন্ড করতেই হবে। নয়তো ডিলারশিপ ক্যান্সেল হতে পারে।”

” তাই? তাহলে আমিও আপনার সাথে অফিসে যাবো। কতটা সত্যি বলছেন দেখে আসবো।”

ঈশান এবার চোখ খুলে সরাসরি দিবার দিকে তাকায়। হঠাৎ তার ধারালো দৃষ্টি দেখে একটু নিভে যায় দিবা। মনে হয় বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এতোটাও বলা উচিৎ হয়নি। ঈশান জিজ্ঞেস করে,” হঠাৎ অফিসে কেনো যেতে চাইছো? রাফিনকে দেখার ইচ্ছা?”

দিবার চোখ দু’টো বড় হয়ে যায়। জোরে দুইপাশে মাথা নেড়ে বলে,” একদম না৷ আরে আমি তো ভুলেই গেছি রাফিন যে আপনার অফিসে কাজ করে! আপনি না বললে মনেই পড়তো না।”

ঈশান কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে দিবাকে দেখতে থাকে। কথাটা বিশ্বাস করেছে কি-না বোঝা যায় না ঠিক। দিবা হাসার ভাণ করে বলে,” আচ্ছা বাদ দিন৷ যাবো না আপনার অফিসে৷ এখন ঘুমান৷ আমি সময়মতো ডেকে দিবো। দশটা না? আমি নয়টায় ডেকে দিবো আপনাকে।”

” ঘুম চলে গেছে।” গম্ভীর স্বরে এই কথা বলেই গা থেকে কমফোর্টার সরিয়ে উঠে যায় ঈশান৷ সরাসরি ওয়াশরুমে চলে যায়।

দিবা সোজা হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। হাই তুলে দুয়েকবার৷ তার মনে হচ্ছে সে ঈশানের মুড অফ করে দিয়েছে। কিন্তু তবুও তার মনটা শান্ত হচ্ছে না। ওই মিসেস ইলোরাকে তো একটা শিক্ষা দিতেই হবে। কাল সে রোদেলাকে রিসিপশনে ডেকেছে তাও ঈশানের অনুমতি ছাড়া। কত সাহস! পরশু যদি রোদেলাকে বাসায় ডাকে?

রোজা তো আগে থেকেই মায়ের প্রতি দূর্বল। রোদেলা এখানে ঘন ঘন আসতে শুরু করলে রোজার দূর্বলতা আরও বেড়ে যাবে। আর কোনোভাবে ঈশানও যদি মেয়ের আনন্দের কথা চিন্তা করে রোদেলাকে বাড়িতে আসার অনুমতি দেয় তাহলে? তাহলে তো দিবার কপাল পুড়বে৷ ওই মেয়ে যেই ধড়িবাজ! কাল সুযোগ পেয়েই ঈশানের গা ঘেঁষে ছবি তুলেছে। এরপর আরও কি কি করবে কে জানে? ওর চোখে-মুখে কেমন একটা প্রলয়ের আগুন দেখেছে দিবা। তার ভয় হয় খুব।

আজে-বাজে কল্পনা মাথায় কড়া নাড়ে। ঈশান যদি হঠাৎ রোদেলার উপর আকৃষ্ট হয় আবার? যদি দিবার অগোচরে তার সাথে মেলা-মেশা শুরু করে? কথাটা ভেবেই গলা শুকিয়ে যায় কেমন। খুব অস্থির লাগে। মাত্র অল্পদিনেই সে ঈশান আর রোজার সাথে এতোটা জড়িয়ে গেল কি করে তা নিজেও জানে না। কাল রোদেলা যখন স্টেজে রোজাকে কোলে নিয়ে আদর করছিল, তখন দিবার ঈর্ষা হয় খুব। ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে ছো মেরে ওর কাছ থেকে নিয়ে আসতে।

রোজা এই কয়েকদিনে দিবার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে একদম। তাকে ছাড়া ঘুমাতে চায় না, খেতে চায় না, এক কথায় দিবাকে ছাড়া তার এক মুহূর্তও চলে না। ঠিক তেমন ঈশানও। কি যত্নের সাথে খেয়াল রাখে দিবার। যখন যেটা প্রয়োজন হয় বলার আগেই এনে হাজির করে। এসব যত্ন পেয়ে অভ্যস্ত ছিল না দিবা।

দিবা সবসময় ছন্নছাড়ার মতো বড় অবহেলায় জীবন কাটিয়েছে। তাই কখনও পরিবারের গুরুত্ব বোঝেনি। হঠাৎ খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা পরিবার তাকে আঁকড়ে ধরেছে। তাদের কাছে দিবা এতোটা গুরুত্ব পেয়েছে যা কখনও স্বপ্নেও প্রত্যাশা করেনি সে। দিবা এই স্বপ্নটা থেকে জাগতে চায় না।

ঈশান ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দিবা গোমড়া মুখে বলে,” শুনুন, একটা কথা বলবো?”

” কি কথা?” তোয়ালেতে মুখ আর হাত মুছতে মুছতে দায়সারা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে ঈশান।

দিবা মাথা নিচু করে বলে,” আপনি ইলোরা আন্টিকে অন্যকোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। উনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

” হোয়াট?”

“হ্যাঁ, তাছাড়া আমার মনে হয় উনিও আমাকে খুব পছন্দ করছেন না৷ তাই আমার সাথে এক বাড়িতে না থাকাই উনার জন্য ভালো। আপনি উনাকে আর বাবাকে একটা নতুন বাড়িতে পাঠিয়ে দিন!”

ঈশান নির্বিকার কণ্ঠে বলে,” এতো ভাবতে হবে না এসব নিয়ে৷ ঘুমাও। সারারাত জেগে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ব্রেইনটাকে একটু রিল্যাক্স দাও এবার।”

দিবা ভ্রু কুঁচকে কটমট করে তাকায়। ঈশান কি তাকে অপমান করছে? রেগে বলে,” আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন? সারারাত তো আপনিও জেগে ছিলেন।”

” বললাম তো, আমার ঘুম চলে গেছে। তোমার আজে-বাজে কথা শুনে চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে।”

” চেষ্টা করুন, আবার আসবে।”

ঈশান দুম করে বিছানায় উঠে আসে। পুরো খাট যেন দুলে ওঠে তার শরীরের ভারে। দিবা আরেকটু হলে পড়েই যেতো। ঈশান বলে,” একটা উপায় আছে, ঘুম আসবে নিশ্চিত।”

দিবা প্রথমে বুঝতে পারে না। কিন্তু ঈশানের চোখের দিকে তাকিয়েই কেমন গা শিরশির করে উঠে। দরাজ গলায় বলে,” অসম্ভব। আমি আপনার উপর রেগে আছি।”

” কোন বিষয়ে রাগ?”

” রোদেলার বিষয়ে। ইলোরা আন্টি তাকে ইনভাইট করল অথচ আপনি কিছুই বললেন না।”

“রাতে তাহলে এই রাগ কোথায় ছিল?”

” তখন আমারও প্রয়োজন ছিল৷ এখন আর প্রয়োজন নেই। আপনার অতিরিক্ত আবদার মেটাতে পারব না।”

” এখন কি তাহলে অতিরিক্ত আবদার মেটানোর জন্য আরেকটা বিয়ে করতে হবে?”

দিবা ঘুরে শুয়ে পড়েছিল। এই কথা শোনা মাত্রই চোখ বড় বড় করে উঠে বসে। ঈশান মাথার পেছনে হাত রেখে আরাম করে শুয়ে আছে, ঠোঁটে চাপা হাসি। রাগে দিবা ঈশানের ডানহাত খামচে ধরে শক্ত করে। ব্যথায় হালকা ককিয়ে উঠে ঈশান। বিস্মিত হয়ে বলে,”বাচ্চাদের মতো খামচি দেওয়া কোথা থেকে শিখেছো? মাঝে মাঝে তো সত্যি মনে হয় বাল্যবিবাহ করেছি আমি।”

দিবাও পাল্টা উত্তর দেয়,” আর আপনাকে দেখে মনে হয় একটা মনস্টার বিয়ে করেছি আমি।”

ঈশান হেসে দিবাকে ঠেলে শুইয়ে দেয় বিছানায়। গর্জনের ভঙ্গি করে বলে,” তাহলে মনস্টারের ফেরোসিটি দেখবে?”

” না, আগে আমার একটা শর্ত আছে।”

” উল্টা-পাল্টা কোনো শর্ত আমি মানতে পারব না।”

” উল্টা-পাল্টা না, যথাযথ শর্ত এটা। ইলোরা আন্টিকে আপনি বলে দিবেন কখনও যেন রোদেলা এই বাড়ির আশেআশেও না আসে। আর কোনোদিন যদি উনি এভাবে রোদেলাকে কোথাও ইনভাইট করে তাহলে আমি আর উনার সাথে একই বাসায় থাকব না।”

ঈশান দৃঢ় গলায় বলে,” এই ভুল উনি আর দ্বিতীয়বার করার সুযোগ পাবে না, ট্রাস্ট মি।”

দিবা কিছুটা সন্তুষ্ট হয় ঈশানের উত্তরে। নরম হেসে বলে,” করলাম ট্রাস্ট!”

সকাল সকাল রাফিনের ঘরে এসে বিস্ময়ে প্রায় আৎকে উঠে রিতু। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে আছে ঘরটা। রাফিন মেঝেতে বসে আছে মাথায় হাত রেখে। অন্যহাতে সিগারেট। চোখ দু’টি কেমন টকটকে লাল। তাকে অতৃপ্ত আত্মার মতো দেখাচ্ছে।

রিতু আর্তনাদ করে বলে,” ভাই, তোর এই অবস্থা কেনো? কি হয়েছে?”

রাফিন হাসে অদ্ভুতভাবে। তার ওই হাসিটা দেখে গা শিরশির করে ওঠে রিতুর। মনে হয় যেন অসুস্থ মানুষের হাসি!

রিতু ভাইয়ের পাশে বসে। সিগারেটের ধোঁয়ার কাশি উঠে যাচ্ছে। মুখে ওরনা চেপে একটু কেশে নিয়ে বলে,” তুই কি পাগলামি শুরু করেছিস বলতো? একটা মেয়ের জন্য এইভাবে নিজের জীবন নষ্ট করবি? তোর কাছে আমাদের কোনো মূল্য নেই? যদি তোর কিছু হয়ে যায় তো আমরা কি নিয়ে থাকবো এইটা ভেবেছিস কখনও?”

রাফিন হেসে উঠে তীব্র ক্রোধ মাখা গলায় বলে,” জানো আপা, দিবা কি করেছে? আমার অফিসের বসকে বিয়ে করেছে! আমি যার আন্ডারে কাজ করি সে-ই দিবার হাজব্যান্ড!”

রিতু অবাক হয়ে বলে,” কি বলছিস এসব? তুই কিভাবে জানলি এটা?”

” রাতে নিউজফিডে তাদের ছবি দেখলাম, অফিসের কেউ শেয়ার করেছে। দিবার গায়ে সাদা লেহেঙ্গা। ও আমাকে একবার বলেছিল বিয়ের সময় সাদা শাড়ি পরবে। আর একদম রানীর মতো সাজবে। আমি ওর সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। অন্যকেউ করেছে! ছবিগুলো দেখবে তুমি আপা?”

রাফিন তার ফোন বের করে আগ্রহ নিয়ে রিতুকে ছবি দেখাতে শুরু করে। বরের সাথে দিবার হাসি মুখের ছবি দেখে ভাইয়ের মতোই কান্নায় ভেঙে পড়ে রিতু। না জানি রাফিনের কি অবস্থা হচ্ছে এসব দেখে!

“ওকে একদম রানীর মতোই লাগছে তাই না আপা? দেখো কেমন হাসছে, মনে হয় খুব সুখেই আছে। অবশ্য থাকবেই তো। ঈশান স্যারের অনেক টাকা। সে তো স্ত্রীকে রানী বানিয়েই রাখবে। আমি এভাবে পারতাম না কখনও। দিবা ভালো সিদ্ধান্তই নিয়েছে।”

রাফিন হাসতে থাকে কথাগুলো বলে। রিতু খুব মমতা নিয়ে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কাতর কণ্ঠে বলে, ” তুই শান্ত হ রাফিন, প্লিজ এভাবে নিজের জীবন শেষ করিস না।”

“আপা আমি এই চাকরিটা করব না। আজকেই রিজাইন করব ভাবছি।”

রিতু চোখ বড় করে বলে,” কি বলছিস তুই? মাথা ঠিকাছে? দিবার জন্য তুই এতোবড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস?”

” আমি এই লোকটাকে টলরেট করতে পারব না। প্রতিদিন সকালে গিয়ে আমি কিভাবে তার মুখোমুখি হবো? সে আমার দিবাকে স্পর্শ করে এসেছে, এই কথা ভেবেই তো আমার তাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করবে। আমি এই চাকরি করব না আপা। এতোটা সহ্য ক্ষমতা এখনও হয়নি আমার। পারব না আমি।”

বোনের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে রাফিন স্থির হয়ে বসে থাকে। অথচ তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। রিতু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, সে কি একবার দিবার সাথে দেখা করতে যাবে? মেয়েটা এমন প্রতারণা কেনো করল তার ভাইয়ের সাথে?

দিবা বোনের সাথে গল্প করতে করতে দুপুরের রান্না বসিয়েছে। রান্না ছাড়া এই বাড়ির অন্যকোনো কাজই তাকে করতে হয় না। আলিফ সাহেব আর ঈশান কাজের লোকের রান্না খায় না বলেই দিবা রান্নার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে। তবে সবজি কাটা, মাংস ধোঁয়া, এসব রোকসানা আর হাফসাই করে। দিবা তো শুধু এসে একটু খুন্তি নাড়ে। আজকে অবশ্য বোনের সাথে গল্প করতে করতে সে অনেক কিছু রেঁধে ফেলেছে।

রোকসানা রান্নাঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। হাফসা বাথরুম পরিষ্কার করতে ঢুকেছে, একদম গোসল সেরে বের হবে। বেবি সিটার তৃষা রহমান রোজাকে স্টোরি পড়ে শোনাচ্ছেন। রান্নাঘর থেকেই দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে দিবা। রেবা পাশে দাঁড়িয়েই নানান গল্প করছে। দিবা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,” ফ্রীজ থেকে একটু কাঁচামরিচ বের করে দাও তো আপা।”

রান্নাঘরে বিশাল আকৃতির দু’টো ফ্রীজ। কোনটায় কাঁচামরিচ আছে সে জানে না! দিবাই তাকে বলে দেয়,” ডানেরটা খোলো, উপরের থাকে পেয়ে যাবে।”

রেবা কাঁচামরিচ বের করে খুব বিস্ময় নিয়ে বলে,” তোদের ফ্রীজে এতো মিষ্টি কেন? এগুলো কি সব কাল রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরত এসেছে?”

দিবা হেসে বলে,” আরে না, রেস্টুরেন্টের খাবার তো বাসায় আনাই হয়নি। ওসব মিষ্টি রোজার বাবা এনেছে।”

” কার জন্য? রোজার জন্য?”

দিবা চমৎকার করে হেসে বলে,” না, আমার জন্য আপা। আমি মিষ্টি খেতে পছন্দ করি এটা জানে সে। তাই এনে রেখেছে। আর শুধু কি মিষ্টি? পাশের ফ্রীজ খুললে আইসক্রিমও দেখবে। সেটাও আমার জন্য। ”

কথাগুলো খুব গর্ব করে বলে দিবা। রেবা ঠোঁট উল্টে বলে,” বাহ, এলাহী ব্যাপার-স্যাপার!”

” অবশ্যই এলাহী ব্যাপার। এক বাচ্চার বাপ বিয়ে করে সাপে বর হয়েছে আপা। একদম ছোটো বাচ্চার মতোই আদর-যত্ন পাচ্ছি। এই ধরো এখন যদি ফোন করে বলি আমার শরীর খারাপ… অফিস-টফিস সব ফেলে ছুটে আসবে। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।”

রেবা হাসার ভঙ্গি করে বলে,” এটাই তো স্বাভাবিক।”

দিবা ভ্রু কুঁচকে বলে,” না, একদমই স্বাভাবিক না। এটা আমার জন্য খুবই অস্বাভাবিক৷ একবার জ্বরের ঘোরে বাথরুমে উল্টে পড়ে গেছিলাম না? তুমি এসে যে আমার মাথায় পানি ঢাললে, কেউ একবারও ডাক্তারের কাছে নেওয়ার কথা বলেনি কিন্তু। অথচ এখন, মুখে একটা ব্রণ উঠলেও স্ক্রিন স্পেশালিস্টের থেকে নাইট ক্রিম এনে দেয় সে। এগুলো কি অস্বাভাবিক না আমার জন্য? আমি তো এসবে অভ্যস্ত ছিলাম না। ”

” তুই কি আমাকে ব্লেইম করছিস দিবা? তোর সংসারটা যেমন তোর নিয়ন্ত্রণে আছে, আমার সংসার কিন্তু ওমন ছিল না।”

দিবা একটু হেসে সাবলীল ভঙ্গিতে বলে,” আমি মোটেও তোমাকে ব্লেইম করছি না আপা। আমি শুধু আমার কপালের কথা বলছি। ঈশান সাহেবকে বিয়ে করে যে আমি সুখী হতে পারব এটা কখনও ভাবিনি। তুমি ভেবেছিলে?”

রেবা মাথা নিচু করে থাকে। দিবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” এই বিয়ের সিদ্ধান্তটা আমি খুব ঝোঁকের মাথায় নিয়েছিলাম। সেটা তুমিও জানো আপা। কিন্তু একবারও আমাকে আটকানোর চেষ্টা করোনি। শুধু মাথা থেকে বোঝা নামাতে চেয়েছিলে। আমাকে একজনের গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলেই হলো। সে একবাচ্চার বাপ হোক কি দশবাচ্চার বাপ হোক, তাতে কি যায়-আসে?”

” আমি কিন্তু তোকে বার-বার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এই বিয়েতে তুই রাজি কি-না।”

” রাজি না হয়ে আর কি করতাম? রাফিন তো তার মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে এ জন্মে আমাকে বিয়ে করতে পারতো না। আর তোমাদেরও প্রেশার দিতে চাইনি। তাই এখান থেকে প্রস্তাবটা আসার পর ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস হয়নি। আমি জানি এই প্রস্তাব ফেরালে দুইদিনেই তোমাদের চোখের বিষ হয়ে উঠতাম। তাই শুধু ভাগ্যটাকে মেনে নিয়েছিলাম।”

দিবা চোখ মুছে এবার হাসি মুখে বলে,” এখন অবশ্য মনে হয় ভালোই করেছি। আমি তো সবসময় একটা ল্যাভিশ লাইফ লিড করতে চাইতাম। এখন নিজের সুখ দেখে নিজেই অবাক হচ্ছি! ”

” দিবা, তুই আমাকে মাফ করে দিস প্লিজ।”

” তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই আপা। আমি সবাইকে মাফ করে দিয়েছি। এমনকি রাফিনকেও।”

চলবে

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১৬
Sidratul Muntaz

রাফিন ভেবেছিল চাকরি ছাড়বে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই সে নিজের মর্জিমতো চলতে পারে না। নিয়তির কাছে বাঁধা জীবন। রিতু আপার জন্য হঠাৎই একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। লোকটা আগে প্রবাসে ছিল, বর্তমানে নিজস্ব মিলের ব্যবসা করে। পরিবারও ভালো। এমতাবস্থায় রাফিন চাকরি ছাড়লে বোনের বিয়ে আর দেওয়া হবে না।

সে প্রতিদিনই অফিসে আসে, ঈশানের সাথে তার দেখা হয়। প্রতিবার সাক্ষাতেই নিজের বসকে তার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। এই যেমন, এই মুহূর্তে কাঁচবদ্ধ একটা শীতল ঘরে তারা সমবেত হয়ে বসে আছে। অফিসের কনফারেন্সরুম, সামনে ঈশান গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকার প্রজেক্টের ব্যাপারে বলছে।

তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ছাড়া রাফিনের অন্যকোনো কাজ নেই। সে ঈশানের কথা শুনছে না, ভাবছে অন্যকিছু।

“আমাদের এই বড় ডিলারশিপের প্রজেক্টে মার্কেটিং থেকে মিজান সাহেব, পাবলিক রিলেশনস থেকে মিস তামান্না আর লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অফিসার আসিফ যাচ্ছেন। এ ছাড়া একজন ট্রেইনিও যাবে, তাকে আমি ফাইনাল করছি না। মিজান সাহেব আপনি তাকে হিউম্যান রিসোর্সের সাথে ফাইনাল করুন। কারা ফ্লাইটে থাকবে সেটা আমাকে আগেই জানাবেন। মিজান সাহেব এই দায়িত্বটা আমি আপনাকে দিচ্ছি।”

ঈশান ফোন হাতে নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,” এই প্রজেক্টটা আমাদের কোম্পানীর জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট হতে যাচ্ছে, সবার হান্ড্রেড পারসেন্ট সিন্সিয়ারিটি আশা করছি। ঠিকাছে, আজকের মতো মিটিং এখানেই শেষ হলো।”

সবাই ফাইল পত্র গুছিয়ে উঠে যেতে প্রস্তুত হয়। ঈশান তখনি গম্ভীর স্বরে বলে,” মিস্টার রাফিন, আপনি একটু বসুন।”

রাফিন হকচকিয়ে যায়৷ অন্যরা তার দিকে আঁড়চোখে তাকায়৷ তারপর ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে। কনফারেন্সরুম খালি হওয়া মাত্র ঈশান ঝুঁকে এসে বলে,” কি হয়েছে আপনার? কোনো পারসোনাল প্রবলেম? আজ-কাল প্রায়ই দেখি অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন। আপনার নামে রিপোর্ট আসছে অনেক। এভাবে চললে তো কাজ শিখতে পারবেন না। চাকরি করার ইচ্ছা আছে তো নাকি?”

হিমশীতল ঘরে বসেও রাফিন ঘামছে। ঈশান বড় ডেস্কটেবিলে দুইহাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ রাফিন ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে,” স্যরি স্যার, আসলে ব্যক্তিগত ভাবে একটু ঝামেলায় আছি। তবে আমি দ্রুত রিকভারের চেষ্টা করছি।”

” ওকে। উইশ ইউ গুডলাক।”

রাফিন মাথা নিচু করে বের হয়ে যায়। তার শরীরের অস্থিমজ্জা পর্যন্ত কাঁপছে। মিজান সাহেব হাসিমুখে বলেন,” কি অবস্থা রাফিন সাহেব? স্যারের কাছে ঝারি খেয়েছেন মনে হয়?”

রাফিনের মুখ মলিন। মনমরা কণ্ঠে বলে,” না, শুধু একটু সাবধান করলেন। মনে হয় আমাকে উনার পছন্দ হচ্ছে না।”

মিজান সাহেব কাঁধে হাত রেখে বলেন,” স্যার আপনাকে যথেষ্ট পছন্দ করেন। ”

” আপনি কিভাবে বুঝলন? “রাফিন হতবাক।

মিজান সাহেব কৌশলী হাসি দিয়ে বলেন,” বুঝেছি। নাহলে এই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে চাকরি টিকিয়ে রাখা এতো সহজ না। তারপর আপনি যথেষ্ট নিয়ম ভঙ্গ করেন। এতো আনসিরিয়াস এমপ্লয়ি আমি দেখিনি। তবে আপনার উপর আমার ভরসা আছে। চেষ্টা করলে অনেক দূর যেতে পারবেন। ট্রেইনি সিলেক্ট করার দায়িত্ব স্যার আমাকে দিয়েছে । আমি আপনাকে সিলেক্ট করলাম। আমাদের সাথে আমেরিকা যাচ্ছেন কিন্তু”

রাফিন বিস্ময়ে হোঁচট খায়। তার মুখের অবস্থা দেখার মতো হয়। মিজান সাহেব হেসে উঠে বলেন,” এই ট্রিপ আপনার জন্য একটা শিক্ষাসফর হতে যাচ্ছে মিস্টার রাফিন। কিছুতেই মিস করবেন না যেন৷ এইবার একটু ক্যারিয়াস নিয়ে সিরিয়াস হোন!”

রাফিন হতভম্ব চিত্তে তাকিয়ে থাকে। এইভাবে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ হবে সে কখনও ভাবেনি! কিন্তু ব্যাপারটায় তার একদমই খুশি লাগছে না।

ঘরে একরাশ নীরবতা। আকাশ জুড়ে চাঁদের নরম আলো ছড়িয়ে আছে। সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি এসিও চলছে। কাজের সময় ঈশানের গরম লাগে বেশি৷ টেবিলের উপর তার ল্যাপটপে খোলা, কিবোর্ডের কালো বোতাম টিপে টিপে টাইপ করছে কিছু একটা। দিবা বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে, তার গায়ে একটা মোটা চাদর। সে অভিমানী কণ্ঠে বলে,“এই তো আবার কাজ শুরু! আপনি এইরকম ব্যস্ত থাকলে তো আমাকে একা একাই কাটাতে হবে সারারাত।”

ঈশান হেসে তাকায় এক ঝলক। তারপর আবার ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখে বলে,” বেবি, এইতো আর পাঁচমিনিট। তারপর তোমার কাছেই আসছি।”

দিবা ঠোঁট উল্টে বলে,” আজ দুপুরে ফোনে কি বললেন ওটা? সত্যি কি আমেরিকা যাচ্ছেন?”

” হুম, সেটারই কাজ করছি। একটা বড় ডিল ফিক্সড হয়ে গেছে।”

” এর মানে পুরো তিনটা সপ্তাহ আপনি ছাড়া এই বাসায় আমি একা?”

দিবা চোখ উল্টে বেহুশ হয়ে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে। ঈশান মাথা নেড়ে বলে,“তিনটা না, চারটা। ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা সেমিনারও অ্যাড হয়েছে।”

দিবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গালে হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকে একদৃষ্টে। তারপর হঠাৎ বলে উঠে,“আমিও যাবো।”

ঈশান থেমে যায় টাইপ করতে করতে। অবাক হয়ে তাকায়। তারপর একটু হেসে বলে,“তুমি যাবে মানে? এটা অফিসিয়াল ট্রিপ। রিসোর্ট বা হানিমুন ট্রিপ না।”

দিবা আদুরে গলায় বলে,” তাতে কি? বিয়ের পর একবারও আমাদের ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আপনার কাজ আপনি করবেন। সারাদিন আপনার মিটিং নিয়ে থাকবেন আর আমি ঘুরে বেড়াবো। সন্ধ্যায় আমরা আবার একসাথে বের হবো। মানে যখন আপনার কাজ থাকবে না সেই সময়টা আমাকে দিবেন। সিম্পল!”

ঈশান গলার আওয়াজ সরু করে ভেঙায় দিবাকে,” হ্যাঁ অনেক সিম্পল!”

পরপর আবার আগের মতো রুক্ষ কঠিন গলায় বলে,” আমি তো মানুষ না, রোবট। সারাদিন কাজ করে আবার তোমাকে নিয়েও ঘুরবো। এতো শখ নেই।”

দিবা মুখ ভোঁতা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মিনমিন করে বলে,” ধ্যাত, কত শখ ছিল বিদেশ যাওয়ার।”

” এই তোমার পাসপোর্ট আছে?”

” উহুম?”

” তাহলে কিভাবে যাবে?”

দিবা মিষ্টি হেসে বলে,” আপনি তো আছেন! উচ্চ পর্যায়ের কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব, যার কাছে অসম্ভব বলে কিছুই নেই।”

“আচ্ছা? তোমাকে দেখাচ্ছি অসম্ভব বলে কিছুই নেই।”

ঈশান ফট করে ল্যাপটপ গুছিয়ে বিছানায় উঠে আসে। দিবার বুকে মুখ গুজে সুড়সুড়ি দেয়। খিলখিল করে হেসে উঠে দিবা।

সে ভেবেছিল ব্যাপারটা এখানেই শেষ হবে। কারণ আমেরিকা যাওয়ার কথাটা সে মজা করেই বলেছে।কিন্তু এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পর একরাতে ঈশান জানায়,” কাল ভিসার ইন্টারভিউয়ের জন্য যেতে হবে দিবা, রেডি থেকো।”

দিবা তখন রোজাকে পড়তে বসিয়েছে। এই কথা শুনে সে অবাক হয়ে তাকায়। চট করে ধরতে পারে না বিষয়টা। সে অবশ্য ভুলেই গেছে এটা। ঈশান তার কাজে ব্যস্ত৷ কিছু জরুরী ফাইলে সই করছে। দিবা থম মেরে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,” মানে? কিসের ভিসা?”

ঈশান ভাবলেশহীন চোখে তাকায় একবার। শান্ত কণ্ঠে বলে,” আমার সাথে না আমেরিকা যাবে?”

দিবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বিস্ময়ে পূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,” সত্যি নিয়ে যাবেন?”

” হুম। তোমার পাসপোর্টও এসে গেছে। এনআইডি, বিবাহসনদ, সব ছিল আমার কাছে, সাতদিনে হয়ে গেছে। প্রিমিয়াম প্রসেসিং। ”

তারপর একটু হেসে বলে,” আফটার অল একটা মাত্র বউ, তাও আবার অবুঝ। তার কোনো শখ অপূর্ণ রাখি না আমি।”

দিবার হঠাৎ কি হয় সে জানে না। ছুটে গিয়ে একেবারে ঈশানের কোলে চড়ে বসে। পুরো রকিং চেয়ারটা দুলে উঠে। ছোট্ট রোজা এসব কান্ড দেখে ভড়কে যায়৷ বড় বড় চোখে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। ছোট্ট জীভ নেড়ে ঘটনাপ্রবাহ বোঝার চেষ্টা করে তার অবুঝ মস্তিষ্ক দিয়ে।

দিবা পাগলের মতো ঈশানের সারামুখে চুমু খেয়ে বলে,” ইউ আর দ্যা বেস্ট হাজব্যান্ড! আপনি কি সেটা জানেন?”

ঈশান হেসে বলে,” না, মাত্র জানলাম। থ্যাংকস ফর কমপ্লিমেন্ট। এখন তোমার এই উইয়ার্ড আচরণ বন্ধ করো। আমার মেয়েটা ভ’য় পাচ্ছে। প্লিজ!”

দিবা ঝোঁকের মাথায় ভুলেই গেছিল রোজার কথা। একবার বিছানার দিকে তাকায় সে। রোজা ততক্ষণে নেমে এসেছে। ছোট ছোট হাত দু’টো কোমরে গুজে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দিবার দিকে। দিবা দুই পা তুলে ঈশানের কোলে বসে আছে, ব্যাপারটা রোজা ঠিক মানতে পারছে না। সে রাগান্বিত ভঙ্গিতে দিবার জামা মুঠ করে ধরে। তাকে নামার জন্য ইশারা করতে থাকে। চোখে যেন আগুন জ্বলছে একরত্তি মেয়েটার। এক্ষুণি কেঁদে ভাসাবে তার বাবার কোল থেকে না নামলে।

ঈশান বলে,” দ্রুত নামো দিবা। এখনি কেঁদে ফেলবে।”

দিবা কটমট করে বলে,” এতো হিংসুটে হয়েছে কেন এই মেয়ে? শুনুন, ও ঘুমিয়ে যাওয়ার পর কিন্তু আপনি আমাকে আবার কোলে নিবেন। নাহলে আমি নামবো না।”

ঈশান হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায়। একহাত মাথায় ঠেকিয়ে হতাশ স্বরে বলে,” মাঝে মাঝে আমি কনফিউজড হয়ে যাই যে কে বেশি অবুঝ? রোজা না তুমি?”

দিবা হেসে বলে,” দু’জনই।”

রোজা তখন চটে গিয়ে পুরো কেঁদেই ফেলেছে। বড় বড় চোখে পানি টইটম্বুর। ফরসা মুখ লাল হয়ে গেছে।দিবা দ্রুত নেমে যায়। আর ঈশান উঠে মেয়েকে কোলে নেয়। আলতো করে মেয়ের নাকে, গালে, কপালে চুমু দিয়ে বলে,” এইতো বাবা কোলে নিয়েছি, আর ইউ হ্যাপি নাউ?”

রোজা বাবার কাঁধে মাথা রেখে সরু চোখে তাকিয়ে থাকে দিবার দিকেই। দূর থেকেই দিবা মুখ ভেঙচায় তাকে। রোজা তাই দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সে এখন রাগ করেছে দিবার উপর। সে বাবার আদরের ভাগ কাউকে দিবে না। ঈশান এসব কান্ড দেখে হেসে ফেলে। রোজার কপালে চুমু দিয়ে বলে,” আমার লক্ষী মাম্মাটা!”

রোজা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মেয়েকে ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়িয়ে দেয় ঈশান। তারপর ঘরে এসে দেখে দিবাও শুয়ে পড়েছে। তার হাতে একটা বই। পড়তে পড়তে চোখ লেগে এসেছে মনে হয়। ঈশান মৃদু কণ্ঠে ডাকে,” দিবা, এই দিবা!”

আধো চোখ মেলে তাকায় দিবা। ভ্রু কুঁচকে বলে,” কি হয়েছে?”

” তেমন কিছু না। রোজা ঘুম। তুমি না কোলে উঠবে বলেছিলে?”

ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে কথাটা বলে ঈশান। দিবা লজ্জা পেয়ে নিজেও হেসে দেয়। ঈশান তার হাত ধরে টেনে বলে,” এসো!”

দিবা চোখ বড় করে বলে,” সত্যি নিবেন?”

” তো মিথ্যা নাকি? তোমার জন্য কত কষ্ট করে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে এলাম। এসো পাজাকোলায় নিচ্ছি।”

বলেই দিবাকে পাজাকোলায় নিয়ে নেয় ঈশান। চোখ বড় করে ঈশানের গলাটা জড়িয়ে ধরে রাখে দিবা। ঈশান হাঁটতে হাঁটতে বলে,” আফটার অল একটা মাত্র বউ, তাও আবার অবুঝ। তার কোনো শখ অপূর্ণ রাখি না আমি।”

বলেই দিবার কপালের সাথে কপাল ঠেকায় ঈশান। দিবা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। প্রায় ত্রিশমিনিট দিবাকে কোলে নিয়ে পুরো করিডোরটা চক্কর দেয় ঈশান। তখন গভীর রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কেউ দেখে ফেলার ভ’য় নেই।

ইলোরা তখন পানি খেতে রান্নাঘরে ঢুকেছে। হাফসা আর রোকসানা সেখানেই বসে একজন অন্যজনের মাথা থেকে উকুন এনে মা’রছে। ইলোরা এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে বলেন,” কি ব্যাপার, তোরা? এখনও ঘুমাসনি? এজন্যই তো সকালে উঠতে এতো দেরি হয়। সময়মতো নাস্তা টেবিলে পাওয়া যায় না। যা ঘুমা গিয়ে!”

রোকসানা আর হাফসা তটস্থ হয়ে যায় ধমক খেয়ে। হাফসা জিজ্ঞেস করে নিচু স্বরে,” এখনি যাইতাছি। আপনার কিছু লাগবো খালাম্মা?”

” কিছু লাগবে না। পানি খেতে এসেছিলাম৷”

তারপর হঠাৎ উপরে কারো ছায়া দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় ইলোরার। মাথা তুলে ভালো করে দেখে নিয়ে বলেন,” ওটা ঈশান না?”

রোকসানা আর হাফসা মুখ টিপে হাসে। ওরা আগেই খেয়াল করেছে এই দৃশ্য। ইলোরা বিভ্রান্ত হয়ে বলেন,” ওর কোলে এটা কে? রোজা? এখনও ঘুমায়নি রোজা?”

রোকসানা হাসি চেপে উত্তর দেয়,” ওইটা রোজা না, ওইটা ভাবী।”

হাফসা ফিক করে হেসে ফেলে। ইলোরার চোখ দু’টো গোল হয়ে যায়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলেন,” মানে? ঈশানের কোলে ওটা দিবা?”

রোকসানা হাসতে হাসতে মাথা নাড়ে। ইলোরা বাকরুদ্ধ হয়ে আবার তাকান উপরে। গজগজ করে বলেন,” আল্লাহ, আমাকে উঠিয়ে নাও। আরও কত আদিখ্যেতা যে দেখতে হবে বেঁচে থাকলে! তওবা, তওবা।”

ইলোরা গটগট করে হেঁটে চলে যান রুমে। রোকসানা আর হাফসা হাসিতে ভেঙে পড়ে এবার।

দিবা আর রোজাকে নিয়ে আমেরিকা ঘুরে আসার পরিকল্পনাটা ঈশান খুব ভেবেই করেছে। তাদের জন্য ভিআইপি লাউঞ্জ বুক করবে। ফ্যামিলি একদিকে আর অফিসের টিম মেম্বাররা অন্যদিকে। তবে টিমলিস্টে মেম্বারদের নামগুলো সে এখনও দেখেনি। ট্রেইনি হিসেবে রাফিনকেই যে সিলেক্ট করা হয়েছে এই ব্যাপারটা ঈশান জানেই না। জানলে অবশ্যই সে দিবাকে সাথে নেওয়ার কথা ভাবতো না।

চলবে