শর্তসাপেক্ষে পর্ব-১৭+১৮

0
13

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১৭
Sidratul Muntaz

আমেরিকা যাওয়ার জন্য খুব জমিয়ে গোছ-গাছ শুরু করেছে দিবা। লস এঞ্জেলসের আবহাওয়া এখন গরমের দিকে। তবে বাংলাদেশের মতো এতো গরম কি সেখানে পড়ে? ঈশান বলছিল প্রচুর রোদ হয়। তারা বীচেও যেতে পারে, সুতরাং ভালো ব্র্যান্ডের সানস্ক্রিন নিতে হবে।

এছাড়া গরমের কিছু নতুন জামাও তো কিনতে হবে। ঈশানকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। বিয়ের পর থেকে একটা ব্যাপার হয়েছে। আগে দিবা নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরিধান করতে পারতো। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ঈশানের পছন্দে সব পরতে হচ্ছে। লম্বা জামা ছাড়া পরা যাবে না, ড্রেসের লেন্থ যেন কোনো অবস্থাতেই হাঁটুর উপরে না যায়। সালোয়ার অবশ্যই ঢোলা হতে হবে। স্ক্রিন ফিটেড জিন্স তো হারাম! অবশ্যই সবসময় হিজাব পরতে হবে। অবশ্য দিবা আগে থেকেই হিজাব পরে। তাই বিষয়টা নিয়ে খুব অসুবিধা হচ্ছে না। সে সবসময় ঈশানের কথা মানার চেষ্টা করে। অবশ্য দিবার ভালোই লাগে ঈশানের কথা মেনে চলতে। কিন্তু ঈশান কি তার কথা মানবে?

ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য সেদিন দিবা একটা কান্ড করে ফেলে। সকালে উঠে সে প্রথমেই বলে,“ শুনুন আপনার দাড়িগুলো না বেশিই রাফ দেখায়। এই লুকটা আমার পছন্দ হচ্ছে না।”

” তো এখন কি করব?”

” দাড়ি ট্রিম করুন।”

ঈশান তখন ল্যাপটপে কাজ করছে, চোখ না সরিয়েই বলে,“আমার তো মনে হয় এই লুকেই আমাকে সবচেয়ে মানায়। দাঁড়ি ট্রিম করলে স্টুপিডের মতো দেখাবে।”

তখন দিবা সামান্য মনোক্ষুণ্ণ হয় বৈকি! ঈশান তার পছন্দকে এভাবে অবমূল্যায়ন করবে জানলে সে বলতই না। তার রুক্ষ জবাবের মুখে দিবা আর কিছুই বলতে পারেনি। মুখ ভার করে উঠে চলে যায়। সে যা বলে দিবা তো তাই করে। তাহলে ঈশান কেনো দিবার একটা অনুরোধ রাখতে পারবে না?

ঈশান তার মনখারাপের বিষয়টা লক্ষ্য করেছিল। সেদিন জিম থেকে ফিরে সত্যি গ্রুমিং লাউঞ্জে গিয়ে সে ট্রিম করে আসে। হেয়ার স্টাইলও বদলায়। সন্ধ্যায় ঈশান ফেরার পর তার চেহারার নতুন লুক দেখে তো দিবা থ! আগে তো একটা রাফ এন্ড টাফ পুরুষের মতো দেখাতো, আর এখন যেন একদম পচিশ বছরের অবুঝ বালক লাগছে! দিবা তো হেসেই খু’ন। ঈশান টাই খুলতে খুলতে গম্ভীরমুখে বলে,” ডন্ট লাফ দিবা, আমি আগেই বলেছিলাম। আমার ওই স্টাবল লুকটাই পারফেক্ট। এখন বেশি সফট লাগছে দেখো। অফিসের সবাই কিভাবে যেন তাকাচ্ছিল। মিজান সাহেব তো বলেই ফেললেন, স্যার আপনাকে এতো কিউট লাগছে আজ, এই ক্রেডিটটা কি ম্যাডামের?”

দিবা এই কথা শুনে আরও জোরে হাসতে থাকে। ঈশান বলে,” সবাই বুঝে গেছে তোমার পছন্দে আমি এটা করেছি। নয়তো আমার দ্বারা এসব পসিবল না। ফার্স্ট টাইম এমপ্লয়িজদের সামনে এতোটা বিব্রত হয়েছি। দিবা, তুমি যে আর কি কি করাবে আমাকে দিয়ে!”

কথা বলতে বলতে ঈশান ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। দিবা তখনও হাসতে থাকে। ঈশান যে তার কথা শুনে সত্যি নিজের পছন্দের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তবে অদ্ভুত একটা শান্তি বিরাজ করে মনে। না, ঈশান শুধু তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। তার পছন্দকেও সমান গুরুত্ব দেয়। এর চেয়ে শান্তির বিষয় আর কি হতে পারে?

রোজা স্কুল থেকে ফিরে গোসল সেরে খেয়ে নিয়েছে। এখন বেবি সিটার তাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। দিবার রান্না-বান্না শেষ, লাঞ্চ শেষ। দুপুরের রোদটা একটু কমে এলেই সে ভাবছিল বের হবে। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করেন ইলোরা। তিনি বেশ কয়েকদিন পর দিবার বেডরুমে এসেছেন। লকারের চাবি নিয়ে ওই ঝামেলার পর তো ঠিক করে কথাই হয়নি তাদের মাঝে। আজ অবশ্য ইলোরার মুখ হাসি হাসি।

দিবাও হাসার চেষ্টা করে বলে,” কিছু বলবেন আন্টি?”

” তুমি না আগে আমাকে মা বলে ডাকতে?”

” কিন্তু এখন মনে হয় আন্টি ডাকটাই আপনার সাথে বেশি যায়। মা ডাকটা ঠিক আসছে না আমার, স্যরি ডন্ট মাইন্ড।”

ইলোরা কপট হেসে বলেন,” ইটস ওকে। শুনলাম তুমি নাকি ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার জন্য আজকে শপিং করবে? হাফসা জানালো আমাকে।”

মাথা নাড়ে দিবা। হেসে বলে,” জ্বী, এইতো একটু পর যাবো।”

” তুমি একাই যাচ্ছো?”

” সঙ্গী আর কোথায় পাবো বলুন? আর রোজার বাবা এতো ব্যস্ত, তার কি সময় আছে আমার সাথে শপিংয়ে ঘোরার? তাছাড়া একা একা শপিং করতে আমার মন্দ লাগে না, ভালোই লাগে।”

ইলোরা নরম গলায় বলেন,” আজ ভাবছিলাম আমিও তোমার সাথে যাবো।”

দিবা একটু অবাক হয়। ইলোরা সহজ ভঙ্গিতে বলেন,” আসলে আমারও কিছু কেনা-কাটা ছিল৷ তুমি কোথায় যাবে বলো? বনানীর দিকে চলো, ওখানে আমি খুব ভালো কয়েকটা আউটলেট চিনি।”

দিবা ভাবে, মিসেস ইলোরাকে সাথে নিলে বিষয়টা খারাপ হয় না। তাছাড়া ভদ্রমহিলার পছন্দও নিশ্চয়ই ভালো হবে। তার সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা দরকার। নয়তো কখন আবার বাড়িতে রোদেলা নামের কালসাপটাকে ডেকে আনে, সেই ভ’য় দিবা এখনও মন থেকে তাড়াতে পারেনি। ঈশান জীবনেও রোদেলার প্রতি দূর্বল হবে না তা সে জানে! তবু তার রোদেলাকে সহ্য হয় না।

বিকেলে ইলোরা আর দিবা গাড়ি করে বনানী ইক্সটেসি ফ্ল্যাগশিপের দিকে চলে আসে। ইলোরা ইচ্ছাকৃতই দিবাকে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট শপে ঢোকে। মডেলকে দিয়ে লাইভ করানো হচ্ছিল সেখানে। দিবা ভেতরে ঢুকেই দেখে তিন স্তরবিশিষ্ট মেকাপ মুখে ঠেসে, ঠোঁটে রঙচটা লিপস্টিক মিশিয়ে রঙিন চুলের একটা মেয়ে ঠিক যেন আইটেম গার্ল সেজে ক্যামেরার সামনে বকবক করছে। তার চিকন কণ্ঠের আওয়াজে মাথা ধরে আসে।

দিবা বিরক্ত গলায় বলে,” এখানে যাবো না আন্টি, চলুন অন্য শপে যাই।”

” আরে, এখানে তোমাকে কেনো এনেছি দেখো আগে। ভেতরে চলো।”

ভেতরে একটা বড় টেবিলে রোদেলা বসে আছে। স্টাফদের সাথে উঁচু আওয়াজে কথা বলছে সে। মিসেস ইলোরাকে দেখেই থেমে যায়। হাসি মুখে এগিয়ে আসে,” আরে ইলোরা আন্টি! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

কাছে এসে রীতিমতো সে জড়িয়ে ধরে ইলোরাকে। দিবার মুখ ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। এবার সে বুঝতে পারে কেনো তাকে এতো তেল মেখে এখানে আনা হলো! রাগে গা জ্বলে যায়। ইলোরা একটু নাটকীয় স্বরে বলেন,” সাথে কাকে এনেছি দেখো! স্পেশাল গেস্ট!”

” আরে… দিবা? তুমি এখানে আসবে আমি ভাবতেও পারিনি। বসো, বসো, কি খাবে বলো।”

দিবা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে থাকে। ইশ, এমন ভাব করছে যেন সে জানতোই না দিবা আসবে! অথচ এটা যে দু’জনের প্ল্যান সেটা বুঝতে তো আর দিবার অসুবিধা হয় না।

রোদেলা অর্ডার করে অনেক কিছু আনিয়েছে। বার্গার, স্যান্ডউইচ, কোক, পেস্ট্রি৷ দিবা মুখ ভার করে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে কোনো কথা বলবে না এদের সাথে। আর কিছু খাবেও না। বলা তো যায় না, যদি আবার খাবারে কিছু মিশিয়ে দেয়!

ইলোরা আর রোদেলা খুব গল্প করছে আর হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে একজন-অন্যজনের গায়ের উপর। দিবা বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে কঠিন মুখে দেখছে। ইলোরা বলেন,” তুমি কিছু বলছো না কেনো দিবা? আমাদের সঙ্গ কি তোমার ভালো লাগছে না?”

দিবা ত্যক্ত স্বরে বলে,” আমার একটু মাথা ধরেছে।”

রোদেলা জিজ্ঞেস করে,” কফি আনতে বলব?”

ইলোরা আন্তরিক হয়ে বলেন,” হ্যাঁ কফি খেলে মাথা ধরা সেরে যাবে।”

দিবা কিছু বলে না। হঠাৎ ইলোরার একটা ফোন আসায় তিনি বলেন,” এক্সকিউজ মি, আমার বিদেশী ফ্রেন্ড ফোন করেছে। একটু আসছি।”

তিনি উঠে চলে যেতেই রোদেলা হাসিমুখে তাকায় দিবার দিকে। দিবার চেহারা আরও কঠিন হয়ে আসে। রোদেলা গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,” তারপর বলো দিবা, কেমন কাটছে তোমার দিন? শুনলাম নাকি আমেরিকা যাচ্ছো? ঈশান তো যাচ্ছে বিজনেসের কাজে। তাহলে হঠাৎ তোমাকে সাথে নিচ্ছে যে?”

দিবা হাসার ভঙ্গি করে বলে,” কারণ আমি যেতে চেয়েছি। আর আমি যা চাই, ঈশান সেটাই করে। এসব তো আপনার জানার কথা!”

রোদেলা বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে,” হুম জানি। আসলে দিবা, তোমার বয়সটা খুব কম তো। তাই এসব আবেগের জগতে ভাসছো৷ ঈশানকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ও যে কেনো তোমাকে আমেরিকা নিচ্ছে তা আমার চেয়ে ভালো কেউ বলতে পারবে না।”

দিবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রোদেলা শীতল হেসে বলে,” আসলে কি বলোতো, গতবার সে যখন আমেরিকা গেছিল তখন আমি আমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করেছিলাম। এসব নিয়েই তো কত ঝামেলা তারপর আমাদের ডিভোর্স। তোমারও তো বয়ফ্রেন্ড আছে! এখন যেনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হয়, তাই ঈশান তার মেল ইগো স্যাটিসফাই করতে আর নিজের নোংরা সন্দেহের বশে তোমাকে সাথে নিচ্ছে। এই টক্সিক ব্যাপারটা না বুঝেই তুমি কত হ্যাপি আছো। আসলে কি বলবো, ইউ আর সাচ আ ডাম্ব গার্ল!”

কথাগুলো শেষ করে রোদেলা হাসতে থাকে। এদিকে দিবার মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। ইলোরা মনে হয় কফির অর্ডার দিয়েছেন। একটা পিচ্চি ছেলে এসে গরম কফি টেবিলে রেখে যায়। দিবার তখন ইচ্ছে হয় ওই গরম কফিটা যদি রোদেলার শয়তানি বুদ্ধিওয়ালা মাথায় একটু ঢেলে দেওয়া যেতো!

রোদেলা এবার একটু ঢং করে বলে,” বাই দ্যা ওয়ে, আমি আরও একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা শুনলাম। ঈশান নাকি ইদানিং রাত-বিরাতে তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে! তোমার জন্য ও তো নিজের শখের দাড়িও ট্রিম করে ফেলেছে। সো সুইট, আপাতদৃষ্টিতে এসব শুনতে খুবই সুইট লাগে। কিন্তু আসল ব্যাপার কি জানো? ও এসব করছে তোমাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।

এসব ছোটখাটো কাজ ও তোমার কথায় করবে। কিন্তু বিনিময়ে তোমার থেকে অনেক বড় মাশুল চেয়ে নিবে। শুধু একবার গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করো, তারপর ক্যারিয়ারের জন্য কিছু করতে যাও, তখন দেখো ঈশান কিভাবে তোমার সব বিষয়ে নাক গলায়।

এখন ও এসব ছোট ছোট জেশ্চার দেখাচ্ছে শুধুই তোমাকে হাতে রাখার জন্য। কিন্তু তুমি বোকা মেয়ে বুঝতে পারছো না। আফসোস!”

দিবা এবার হেসে উঠে হলে,” তাহলে আমার কি সৌভাগ্য দেখুন, আমার হাজব্যান্ড আমাকে হাতে রাখার জন্য কত কলা- কৌশল খাটায়। মানে সে আমাকে নিজের কাছে রাখতে চায়। কারণ আমাকে ছাড়া তার চলবেই না! অথচ আশেপাশে কত ডিভোর্সী মেয়ে আছে যারা অনেক চেষ্টা করেও সংসার টিকিয়ে রাখতে পারল না। তাদের কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হয়।”

রোদেলার হাসি মাখা মুখ ম্লান হয়ে যায়। আচমকা এমন কথা শুনে সে যেন একদম হতভম্ব। হয়তো প্রত্যাশাও করেনি দিবা এই মুহূর্তে এমনকিছু বলবে। দিবা একটু ঝুঁকে এসে রোদেলার হাতের উপর হাত রেখে বলে,” আই ক্যান ফিল ইউর পেইন আপু৷ বাট আপনি এখনও যথেষ্ট ইয়াং আর সুন্দরী। প্লিজ দয়া করে অন্যের স্বামীর পিছু ছেড়ে এবার নিজেকে নিয়ে একটু ভাবুন। গেট আ লাইফ সিস! এভাবে তো চলে না।”

দিবা আলতো করে হেসে হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রোদেলা যেন পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ইলোরা এসে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন,” কি ব্যাপার? আমাকে রেখে তোমরা কি এতো গল্প করছিলে?”

দিবা বলে,” আমার আর গল্প করার ইচ্ছে নেই আন্টি। আপনি চাইলে রোদেলা আপুর সাথে আড্ডা দিতে পারেন। আমি চললাম।”

দিবা গটগটিয়ে বের হয়ে যায় শো-রুম থেকে। রোদেলা হঠাৎ ভীষণ রাগে টেবিলের সবকিছু এক ধাক্কায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার এমন আচরণে চমকে উঠেন ইলোরা। স্টাফরা ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত ছুটে আসে। ভ’য়ে ভ’য়ে সব পরিষ্কার করতে থাকে। রোদেলা তখন হিংস্র বাঘিনীর মতো ফুঁসছে।

বনানীর সুপার মার্কেটে কিছু কেনা-কাটার জন্য আজ এসেছে রাফিন৷ রিতু আপা বলেছিল ইক্সটেসির পাশে একটা শো-রুমে ভালো কসমেটিক্স পাওয়া যায়। সেখানে একবার ঢু মারার কথাই ভাবছিল সে৷ তার আগে গরমে একটু প্রাণ জুরানোর জন্য রাস্তার পাশে আখের রস খেতে দাঁড়ায়৷ তখনি শপিংমলের এস্কেলেটরে চোখটা আটকে যায় রাফিনের। দীর্ঘ পাঁচমাস ষোল দিন পর প্রেয়সীর অতি প্রতীক্ষিত মুখটি দেখে হৃদস্পন্দন ত্বরান্বিত হয়। রাফিন আখের শরবত সবটুকু আর খায় না৷ রাস্তার কোণে ফেলে দিয়ে, টাকা দিয়ে দৌড়ে সেদিকে যেতে থাকে।

দিবা ততক্ষণে বের হয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। শপিংয়ের মুড নেই এখন আর। সে এখান থেকে বাসায় যাবে সরাসরি। হোসেন ভাই গাড়ি কোথায় পার্ক করেছে? দিবা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই রাফিনের বেচাল মুখটি দেখে ভ’য়ে চিত্ত অস্থির হয়। বুক ধড়াস করে উঠে। এক ঝটকায় তিন কদম পিছিয়ে যায় দিবা। যেন এখনি পালাবে সে।

রাফিন বড় বড় শ্বাস ছেড়ে একনাগাড়ে বলতে থাকে,” দিবা প্লিজ শোনো আমার কথা, অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। জানো কতবার তোমার ভার্সিটিতে গিয়েছি? একবারও দেখা করার সুযোগ পাইনি। ”

” তুমি এখানে কি করছো? আজ কি তোমার অফিস নেই?” হঠাৎ মাথায় প্রশ্নটা আসতেই দিবা করে ফেলে।

” অফিস থেকে দুইদিনের ছুটি নিয়েছি। রিতু আপার বিয়ে কাল।” এটুকু বলে থামে রাফিন। তারপর হঠাৎ মলিন হেসে বলে,” আমি যে চাকরি করছি এটা তুমি জানো তাহলে? এটাও নিশ্চয়ই জানো যে কোথায় চাকরি করছি? আচ্ছা এখানে কোনোভাবে তোমার হাত নেই তো? ঈশান আহসানকে তুমি আমার কথা বলেছিলে, তাই সে দয়া করে আমার মতো গোবেচারা দেবদাসকে একটা চাকরি দিয়েছে। এরকম কিছু?”

দিবা কোনো কথা বলে না। সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। রাফিন তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে,” যদি সত্যিই এরকম কিছু হয় তাহলে এই চাকরির কপালে আমি লাথি মারি। করব না এই দয়ার চাকরি।”

” তুমি দয়া করে আমার পিছু ছাড়ো। খুব বাড়াবাড়ি করছো।”

” বাড়াবাড়ির দেখেছো কি তুমি? এখনও তো কিছু শুরুই করিনি।”

দিবা চোখ বড় করে তাকায়। বুকের খাচায় বন্দি হৃৎপিন্ডটা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।

রাফিন গর্জে উঠে বলে,” আমাকে দেখলেই তো তুমি পালাও। এটাকে আমি কি ভাববো? বিয়ের পর তোমার ম্যাচিউরিটি নাকি অপরাধবোধ?”

শেষ কথাটা শুনে দিবার পিলে চমকে উঠে। হতবাক স্বরে আওড়ায়,” অপরাধবোধ মানে? কিসের অপরাধ? ”

” আমার সাথে প্রতারণা করার অপরাধ!”

এই কথা বলে চোয়াল শক্ত করে রাফিন। অস্থিরতা, ক্ষোভ আর আবেগের মিশেলে তার চেহারা কেমন অন্যরকম হয়ে উঠেছে। সে এগিয়ে আসে খানিকটা। চোখে রাগের ফুলকি নিয়ে বলে,” এই বেইমানিটা আমার সাথে কেনো করলে দিবা?”

মুহুর্তেই তার কণ্ঠস্বর বদলে যায় আকুতিতে। দিবা রাফিনের সাথে লাগতে যায় না, তার মাথায় এই মুহূর্তে যে বিষয়টা ঘুরছে তা হলো ঈশান। হোসেন ভাই যদি একবার তাদের দেখে ফেলে তাহলে ঈশানের কাছে খবর পৌঁছাতে একসেকেন্ডও লাগবে না! সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,” যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আমাদের পথ আলাদা রাফিন। সব ভুলে যাও আগের কথা।”

দ্রুত পা ফেলে সে হাঁটতে নিলেই রাফিন এগিয়ে আসে। খামচে ধরে তার হাত। হঠাৎ আক্রমণে দিবা তাল হারিয়ে পড়ে যেতে নেয়৷ রাফিন আগলে ধরে তাকে। কটমট করে বলে, ” ভুলে যাওয়া এতো সহজ? তুই না হয় স্বামীর টাকা আর সোহাগ পেয়ে সব ভুলে গেছিস কিন্তু আমি কিভাবে ভুলবো? ”

দিবা থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর কোনমতে রাফিনের হাত নিজের কবজি থেকে ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। আর এমন ভাণ করে যেন সে এখনি চিৎকার করবে। কঠিন গলায় বলে,” বিহেভ ইউরসেল্ফ। আমি এখন অন্যকারো ওয়াইফ। তোমার সাহস কি করে হয়…”

রাফিনের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। গজগজ করে চেঁচিয়ে ওঠে,”এই বেইমানীর কি জবাব দিবি তুই? কেনো করলি আমার সাথে এসব? আমার লাইফটা কেনো হেল করলি? কি যেনো বলেছিলি একবার? আমাকে ছাড়া কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে পারবি না। এখন তাহলে কিভাবে মেনেছিস? ঈশান আহসান বড়লোক বলে?”

দিবা চাইলে এখন অনেক কিছুই বলতে পারে। অসহায় হয়ে সে যতবার রাফিনের দুয়ারে ঠাই চেয়েছিল, ততবার রাফিন তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বিয়ে করে নিতে বলেছে। তখন দিবা আবেগতাড়িত হয়ে কথাটা বলেছিল, যে রাফিন ছাড়া আর কাউকে স্বামী হিসেবে কিভাবে মেনে নিবে? তবু রাফিন মুখ ফিরে তাকায়নি। দিবাকে অবজ্ঞা করেছে। দিনের পর দিন যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। কষ্ট পেতে পেতে পাথর হয়ে দিবা যখন সত্যি বিয়েটা করল, তখন রাফিন এমন করছে কেনো? আর দিবা তার জীবন কোথায় শেষ করেছে? উল্টা নিজের সংসারে আগুন লাগবে জেনেও সে রাফিনের ভাঙাচোরা জীবন গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ সে একসময় রাফিনকে ভালোবাসতো।

ঠিক এমন সময় দিবার ফোন বেজে উঠে। মিসেস ইলোরা! রাফিন কিছু বলতে নিলেই দিবা জরুরী ভঙ্গিতে তাকে থামিয়ে ফোনটা রিসিভ করে।

” দিবা, কোথায় তুমি?”

দিবা চারপাশে তাকিয়ে বলে,” এইতো, শপিংমলের বাইরে। হোসেন ভাইকে খুঁজছি। আপনি কোথায়?”

” আরে আমি তো হোসেনের সাথেই আছি, এইযে রাস্তার এইপাশে পার্কিং সাইড। আমি তো ভাবলাম তুমি আরও আগেই চলে এসেছো।অন্য কোনো শপে ঢুকেছো নাকি?”

” হ্যাঁ। ”

” কোথায়? বলো আমি আসি তাহলে।”

” না, আপনার আসতে হবে না। আমিই আসছি।”

” ঠিকাছে।”

দিবা ফোন রাখতেই রাফিন কঠিন গলায় বলে,” কোথাও যাচ্ছো না তুমি। এখন আমার সাথে ওই কফিশপে যাবে।”

” আমি তোমার সাথে কফিশপে কেনো যাবো?”

” কথা আছে তাই।”

” আমার কোনো কথা নেই।”

দিবা দ্রুত হাঁটতে থাকে তারপর একবারও পেছনে না তাকিয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে যায়। রাফিন স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে ফুটপাতে। কত বদলে গেছে দিবা। মনে হচ্ছিল যেন অন্য মানুষ! তার চোখে কষ্টের লেশমাত্র নেই। যেন রাফিন কখনোই তার জীবনে ছিল না। এভাবে বুঝি পর হয়ে যায় মানুষ? এসব ভাবতে ভাবতে রাফিন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় অজস্র মানুষ। কিন্তু সে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে আগের ভঙ্গিতে।

দিবা তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে বসেই বলে,” দ্রুত বাসায় চলুন হোসেন ভাই।”

ইলোরা দিবার এমন অবস্থা দেখে প্রশ্ন করেন,” তোমার কি হয়েছে দিবা? এতো ঘামছো কেনো? রোদেলা কি তোমাকে কিছু বলেছিল তখন?”

দিবা কটাক্ষ স্বরে বলে,” গরমে তো ঘামবোই, আশ্চর্য! রোদেলা আপু আমাকে কি বলবে? হোসেন ভাই এসিটা বাড়িয়ে দিন।”

দিবা একহাতে মুখ ঢেকে সিটে মাথা ঠেকায়। তার এতো মেজাজ দেখে ইলোরা আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পায় না। চুপ মেরে যায়৷ ভুলটা তারই ছিল৷ এভাবে দিবাকে রোদেলার সাথে দেখা করাতে আনাই উচিৎ হয়নি। এখন সে বাসায় গিয়ে এটা ঈশান জানালেই হলো। ইলোরা ভ’য়ে কিছুটা চুপসে যায়৷ দিবাকে আর একদম বিরক্ত করে না। এদিকে দিবা বাসায় ফিরেও সারাদিন কেমন একটা আ’তঙ্কে অস্থির হয়ে থাকে। এই বুঝি ঈশান ফোন করবে, রাফিনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে।

সন্ধ্যা ঈশানের ফোন আসে। দিবা একটু অবাক হয়। কারণ আজ সে ফিরতেও দেরি করছে আবার ফোন দিচ্ছে। সে ফোন রিসিভ করে খুব উৎকণ্ঠিত হয়ে।

” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে শোনা যায় ঈশানের গম্ভীর গলা,” মিস দিবা, নিচে নামুন। আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

দিবা রোজার সাথে সময় কাটাচ্ছিল তখন। রোজা তার খেলনা গাড়িটা চালাচ্ছে মহা আনন্দ নিয়ে। দিবা দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। কিন্তু ঈশানের কথাগুলো শোনা মাত্রই মনে হয় ওই মুহূর্তে মনে হয় সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে৷ কোনমতে দেয়াল ধরে দাঁড়ায়।

ঈশানের সম্বোধন ‘অবুঝ বালিকা’ থেকে আবার ‘মিস দিবা’ তে বদলে গেল কি করে? সে ‘তুমি’ থেকে দিবাকে আবার ‘আপনি’ ডাকতে শুরু করেছে। এর মানে কি আজ বিকালের পুরো ঘটনাটা সে জেনে গেছে?

*সবাই অন্তত একটা করে কমেন্ট রেখে যান৷ রিচ খুব কম।*

চলবে

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ১৮
Sidratul Muntaz

ফোনটা রেখে রোজার দায়িত্ব বেবি সিটার তৃষার কাছে হস্তান্তর করে নিচে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় দিবা৷ বেডরুমে এসে সে আগে নিজের মুখটা ভালো করে ধোঁয়। যেন তাকে একদমই অদ্ভুত না দেখায়। চুল আঁচড়ে নেয়, মুখে আলতো করে পাউডার ব্রাশ করে। চোখে আলতো করে কাজলের ছোঁয়া দেয়। তার গায়ে এখন সালোয়ার কামিজ। ওরনাটা দিয়ে ভালো করে মাথায় ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে নিচে নামে। ঈশান তাকে কি বলার জন্য ডেকেছে? তার গম্ভীর কণ্ঠ বার-বার কানে বাজছে আর দিবা হেঁটে শক্তি হারিয়ে ফেলছে, কেমন মাথাটা ঘুরে আসছে। যেন নিচ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সে বেহুশ হয়ে যাবে!

দিবা নিচে আসতেই দারোয়ান বাইরে ইশারা করে৷ ঈশান গাড়ি গ্যারেজে তোলেনি তখনও। বাইরে তার সাদা রঙের টয়োটা থেমে আছে৷এশ রঙের ফরমাল শার্ট, কালো টাই আর কালো ফরমাল প্যান্ট গায়ে লম্বাটে দীর্ঘ অবয়বটা কেমন ঝাপসা দেখতে পায় দিবা। বুঝতে পারে তার চোখে কত সহজেই অশ্রু এসে গেছে।

আগে কখনও দিবার কান্না পেতো না। কেউ কঠিন চোখে তাকালে, অপমান করলে, খোঁটা দিলেও কষ্ট হতো না। কিন্তু এখন, সে যেনো ছিঁচকাদুনে হয়ে গেছে৷ মাত্র কয়েকমাসের ভালোবাসা তার আবেগ, অনুভূতির জোয়ার এতোটা বেসামাল করে তুলেছে যে এখন ঈশান আদর করে মাথায় হাত রাখলেও তার কান্না পায়।

এখন দিবা কেনো কাঁদছে তা সে নিজেও জানে না। চোখের জল ওরনা দিয়ে মুছে সে ঈশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঈশান ফট করে গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে ধারালো কণ্ঠে বলে,” উঠুন।”

দিবার নিঃশ্বাস থেমে আসার উপক্রম হয়। সে ঈশানের এমন রুক্ষ কণ্ঠ মেনে নিতে পারছে না, পারছে না তার এমন শক্ত আচরণ সহ্য করতে। মাত্র কয়েক মাসেই আহ্লাদে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, এখন এই আচরণ বড় নিষ্ঠুর লাগছে।

দিবা প্রশ্ন করে না, চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে। ঈশান তার পাশে বসে ড্রাইভ শুরু করে। গন্তব্য কোথায় তা দু’জনের কেউই জানে না। দিবা যখন হালকা স্বরে বলতে যায়,” আমি কিছু কথা বলব আপনাকে…”

ঠিক তখনি ঈশান তাকে থামিয়ে খুব নির্মম কণ্ঠে বলে,” আমি আর কিছু শুনতে চাই না। ”

দিবার হৃদয় ভেঙে আসে। কোনো প্রশ্ন আর করে না সে, যেন এটাই হওয়ার ছিল আর সে নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছে এমনভাবেই গাঁট হয়ে বসে থাকে। ধীরে ধীরে বাতাসে প্রবেশ করে বিষাক্ততা।

হঠাৎ খুব নিরিবিলি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশান। অতঃপর গ্লোভ বক্স থেকে রিপোর্ট বের করে দিবার দিকে বাড়িয়ে দেয়। তখনি মেয়েটার চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। সে বুঝতে পারে, রাফিন কোনো বিষয় না৷ ঈশানের এই নিষ্ঠুর আচরণের পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য আরেকটি সত্য। যা দিবা কখনও কাউকে জানানোর সাহস করেনি। মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলে সে।

ঈশান স্টেয়ারিং-এ বামহাত ঠেকিয়ে প্রচন্ড হতাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করে,” আমি কি এই প্রতারণা ডিজার্ব করেছিলাম? এইভাবে ঠকালেন কেনো আমাকে?”

তারপর রিপোর্টটা দিবার সামনে রেখে দেয় অবহেলায়। নিজেকে সামলে আস্তে-ধীরে দিবা মুখ তোলে। রিপোর্টটা হাতে নেয়। ভেতরের বোল্ড করা ছোট ছোট লেখাগুলোতে চোখ বুলায় একরাশ বুকভরা আর্তনাদ নিয়ে,”Absent uterus, likely congenital agenesis or post-surgical removal.”

দিবা কাঁদতে থাকে৷ ঈশান চুপচাপ শোনে তার কান্না, মুখ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। একটু পর দিবা প্রশ্ন করে,” শুধুমাত্র এই কারণে আমি বুঝি আপনার পর হয়ে গেলাম? এখন থেকে আর ভালোবাসবেন না আমাকে?”

ঈশান ঘুরে চোখ বড় করে প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে বলে,” কিসের ভালোবাসা? বেইমানি করেছেন আপনি। আর আপনাকে চিনতে ভুল করেছি আমি মিস দিবা। ইট ওয়াজ আ গ্রেইট মিস্টেক!”

দিবার কান্নার বেগ বাড়ে। আর্তনাদের স্বরে বলে,” আমার কি দোষ এতে? এটা একটা দূর্ঘটনা! এক্সিডেন্ট!”

ঈশান তাচ্ছিল্য হাসে। শান্ত তবে নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে,” আমি সেই প্রসঙ্গে যেতে চাচ্ছি না। আপনি মা হতে পারবেন কি-না এই বিষয়ে আমি লেস বদারড। আমি শুধু একটা কথাই জানতে চাই, বিয়ের আগে এতোবড় বিষয়টা কেনো গোপন করলেন?”

দিবা জবাব দিতে পারে না। নিশ্চুপ হয়ে থাকে। ঈশান ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করে,” এজন্যই রাফিনকে ছেড়ে আমার কাছে এসেছিলেন তাই না? আমি আপনার কাছে একটা অপশনের মতো ছিলাম, এখনও তাই আছি।”

” না, না… প্লিজ এরকম ভাববেন না..” দিবা খুব আকুল হয়ে ঈশানের হাতের বাহু জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু ঈশান ঠিক ততটাই নিষ্ঠুর হয়ে ঝারি মেরে সরিয়ে দেয়। স্টেয়ারিং-এ একটা শক্ত আঘাত করে বলে,” এই পর্যন্ত যতবার বিশ্বাস করেছি সবসময় ঠকেছি। শা’লা মেয়ে মানুষ মানেই বিশ্বাসের অযোগ্য এটা বুঝতে আমার এতো সময় লেগে গেল।”

দিবা করুণ কণ্ঠে বলে,” আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন প্লিজ। আমি আপনাকে ভালোবাসি…”

” আরেকবার এই কথা উচ্চারণ করবেন না মুখ দিয়ে। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব না। ভ’য়ংকর কিছু করে ফেলবো। তাই সাইলেন্ট প্লিজ!”

ঈশানের চোখ দু’টো এতো লাল, দিবা মিইয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না ভ’য়ে। ঈশান খ্যাক করে বলে উঠে,” আজ রাফিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন?”

দিবা চোখ বড় করে তাকায়। মাথা নেড়ে কিছু বলার আগেই ঈশান বলে ফেলে,” জানতাম, ও বোনের বিয়ের কথা বলে ছুটি নিয়েছিল দুইদিনের। এর মধ্যে একদিন যে আপনার সাথে দেখা করবে তা আমি ভালো করেই বুঝেছিলাম। কি যেন বললেন? আপনাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। তাহলে রাস্তার মাঝে হাতাহাতি, ঢলাঢলি, ওসব কি ছিল?”

দিবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ খুব ঘৃণা নিয়ে বলে উঠে,” রোদেলা আপু আপনার ব্যাপারে যা বলেছিল সব সত্যি! টক্সিক মানুষ আপনি। কখনও কারো অবস্থা বুঝতে পারেন না।”

” বাহ! এখন রোদেলা আপু হয়ে গেল? তাকে কি আপনি গুরু মেনেছেন? তার শিষ্য হয়েছেন? তার পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করছেন?”

” ছি!”

” ঠিকাছে আপনি বলুন কেনো এতোবড় বিষয়টা গোপন করলেন? এটলিস্ট একটা ভ্যালিড রিজন, তারপর আমি মেনে নিবো সব।”

দিবা কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একটু পর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,” আমি ভেবেছিলাম… রোজা আপনার একমাত্র মেয়ে। ওর মধ্যে একটা ত্রুটি আছে.. ”

ঈশান চোখ গরম করে তাকাতেই দিবা নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে,” মানে আমি ভেবেছিলাম…”

ঈশান আঙুল তুলে কাটা কাটা স্পষ্ট গলায় বলে,” রোজা আমার জন্য ব্লেসিং। আল্লাহর তরফ থেকে দেওয়া সেরা উপহার! ওকে নিয়ে বিন্দুমাত্র রিগ্রেশন নেই আমার। বরং আমার মেয়ে কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না। নিজের মায়ের মৃত্যুর পর একমাত্র নিজের মেয়েকেই আমি এতোটা ভালোবেসেছি। ও আমার কাছে আমার অস্তিত্ব।”

দিবা কাঁদতে কাঁদতে বলে,” তবুও আমি ভেবেছিলাম আপনি নিশ্চয়ই আরও বেবি চাইবেন আমার কাছে। তখন আমি তো আপনাকে সেটা দিতে পারব না। আর আমি শুধু আমার বিষাক্ত জীবন থেকে মুক্তি চাইছিলাম। আপনিই প্রথম মানুষ যে আমাকে বিশ্বাস করে আমার হাত ধরেছিলেন। আমাকে আমার দুঃস্বপ্নের জীবন থেকে উদ্ধার করে এই স্বপ্নের জীবন দিয়েছেন। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন।”

ঈশান বিষাদময় হেসে বলে,” আর সেই বিশ্বাস আর মর্যাদার কি প্রতিদান পেলাম আমি? ধোঁকা, বেইমানি, বিশ্বাসঘাতকতা! আপনারা মেয়ে মানুষ শুধু ভাঙতে জানেন। গড়তে জানেন না।”

” এভাবে বলবেন না ঈশান…”

” একদম চুপ, আমার কথা শুনুন! রোজা আমার চোখের মণি। ওর পরে দ্বিতীয় সন্তানের কথা আমি কখনও চিন্তা করতাম না। আমি আমার একমাত্র মেয়েকেই জান-প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতে চাই। আপনি যদি প্রথম দিন আমাকে সত্যিটা জানাতেন, বিয়েটা আমি তখনও আপনাকেই করতাম। কিন্তু আপনি সেই সৎসাহস দেখাতে পারেননি। মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের এই ত্রুটি ঢাকতেই আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। অথচ সেটা আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।

এতো অসৎ মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”

” এখন কি তাহলে আমাকেও ডিভোর্স দেবেন?” নিশ্চল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে দিবা।

ঈশান দুই পাশে মাথা নেড়ে বলে,” নো ওয়ে, এতো সহজে আপনাকে ছেড়ে দিবো না। তাছাড়া রোজার সাথে খুব ভালো একটা এটাচমেন্ট তৈরী হয়ে গেছে আপনার। এখন আপনি চলে গেলে ও মানসিকভাবে আঘাত পাবে খুব। আমি আমার মেয়েকে দ্বিতীয়বার স্যাড দেখতে চাই না। নিজেকে আমি সামলে নিতে পারব খুব সহজে। কিন্তু আমার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারব না৷ তাই আপনি আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। ঠিক আগের মতো। না চাইলেও আপনাকে থাকতে হবে কারণ আপনি বাধ্য। ফেরার কোনো জায়গা নেই আপনার।”

দিবা আঙুল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সামান্য হেসে বলে,” খোটা দিচ্ছেন?”

” হ্যাঁ দিচ্ছি! সুযোগ পেলে কেনো দিবো না? শুধু আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা আর আগের মতো থাকবে না। এখন থেকে আপনি শুধুই রোজার মা। আর আমি রোজার বাবা। এটাই আমাদের সামাজিক পরিচয়। এছাড়া কোনো ব্যক্তিগত বিষয় থাকবে না৷ আশা করি ফরমালিটি গুলো আপনি মেনে চলবেন।”

দিবা যন্ত্রের মতো বলে,” আপনার যদি এটাই ইচ্ছে হয়, তাহলে ঠিকাছে! আমি আপনার সাথে শর্তসাপেক্ষে সংসার করতে রাজি।”

” দ্যাটস গুড।”

এক্সিলেটর চেপে ঈশান গাড়ির গতি বাড়ায়। তারা খুব দ্রুত বাড়ির দিকে ফিরছে। ঈশান স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,” আমাদের এই সিকরেট কেউ না জানলেই ভালো। বুঝতেই পারছেন আমার রেপুটেশনের প্রশ্ন। তাই আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে এই নির্জন রাস্তায় কথাগুলো বললাম।”

দিবা উত্তর দেয় না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জানালায়। ঈশান পাথরের মতো মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছে। কয়েকদিন আগের স্মৃতিগুলো ভাসছে মস্তিষ্কে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিড়ে।

তাদের প্রথম অন্তরঙ্গতার সম্পর্কটা হয়েছিল খুব হঠাৎ। তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে ঈশান দিবার জন্য সুন্দর একটা প্যাকেটে গিফটের মতো করে চকলেট আর পিল নিয়ে এসেছিল। হিসেব মতে পিলগুলো মাত্র একসপ্তাহেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ঈশান এই সকল বিষয়ে খুব সিনসিয়ার হওয়ায় সাতদিন পরেই আরও পিল নিয়ে আসে। তখন দিবা জানায়, আগের গুলোই শেষ হয়নি। এতে ঈশানের একটু অবাক লাগে। কারণ তার হিসাব নির্ভুল ছিল। সে ভাবে হয়তো কোথাও গড়মিল হয়েছে। প্রথম প্রথম এসব নিয়ে খুব একটা গা করেনি সে।

কিন্তু তিনমাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন দিবার সাইকেল মিস হয়, তখন ঈশান সত্যিই একটু ভাবনায় পড়ে যায়। সে ভাবে দিবা হয়তো কনসিভ করেছে। কিন্তু দিবা নিশ্চিত যে সেরকম কিছু হয়নি। তার এতো আত্মবিশ্বাস দেখেই ঈশানের মনে খটকা লাগে। কিন্তু দিবাকে সে অবিশ্বাস করতে পারছিল না৷ কে জানতো এতো সরল একটা মেয়ের মধ্যে যে এমন গরল লুকিয়ে থাকবে! এসব ভেবে ঈশান হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সে একদিন সকালে শেভিং কিট খুঁজতে গিয়ে দিবার ব্যক্তিগত প্রসাধনীর ড্রয়ারে ছোট্ট একটা চকলেটের প্যাকেট পায়। এটাই সেই প্যাকেট যেটা প্রথম দিন ঈশান দিয়েছিল দিবাকে। প্যাকেটটা পুরো অক্ষত ছিল। অর্থাৎ খোলাই হয়নি। এর মানে দিবা প্রথম দিন পিল খায়নি। তারপর ঈশানের মনে পড়ে আরও কিছু ঘটনা, সেদিন হাফসা বলছিল ডাস্টবিনে ঔষধ পেয়েছে৷ এখন সেই সূত্র মেলাতে পারে সে৷

ঈশানের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দিবা আসলে পিল খেতোই না। সব ফেলে দিতো। কিন্তু গিফটের প্যাকেটের এটা ফেলেনি। ব্যস, সন্দেহের অবকাশ তখন থেকেই। ঈশান নিশ্চিত হতে দিবাকে মেডিকেলে নিয়ে চেকাপ করায়। বলে হরমোনাল টেস্ট করাবে, অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্য৷ আর দিবা এসবে বাঁধা দেয় না কারণ সে জানে ঈশান সবসময় খুব কেয়ারিং। নিষেধ করলেও শুনবে না। তবে ভয়ও থাকে তার মনে। ঈশান যে তার সব লুকোচুরি এভাবে ধরে ফেলবে সেটা বুঝতে পারেনি বেচারি।

আর তারপর ঈশানের সন্দেহই সত্যি হয় আর দিবা হাতে-নাতে ধরা পড়ে যায়। আঁড়চোখে একবার দিবার দিকে তাকায় ঈশান। এখনও কাঁদছে! চোখের পানি যেন ফুরায় না। নাটক, মেয়ে মানুষ এতো নাটক জানে!

চলবে