শর্তসাপেক্ষে পর্ব-২৪+২৫

0
11

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৪
Sidratul Muntaz

“পঞ্চাশতলার ফ্লোর-টু সিলিং কাঁচ ঘেরা বারান্দায় দাঁড়ালে, শহরটাকে যেন পায়ের নিচে অবদমিত মনে হয়। বিস্তৃত ডাউনটাউন এলএ, দূরে হলিউড হিলস, কখনও আকাশে হেলিকপ্টারের নীল আলো, কত মোহময় সবকিছু। দিবা কি কখনও ভেবেছিল এমন একটি জায়গায় সে কখনও আসবে? এই এতো ঐশ্বর্য্য আর প্রাচুর্যের মাঝেও তার মনে কোনো শান্তি নেই আজ। মনে হচ্ছে, যদি এই কাঁচের দেয়াল না থাকতো সে বুঝি ঝাঁপ দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করতো না।

তার জীবনে কঠিন সময় তো কম আসেনি। অপমান, অবহেলা, দুঃখ- কষ্ট, এসব তো তার চিরসঙ্গী হয়েই ছিল সবসময়। তাহলে এখন কেনো সে ন্যূনতম অবহেলাও সহ্য করতে পারছে না? ঈশান বেলবয়ের হাতে করে তার জন্য উপহার পাঠিয়েছে। এটাও সে সহ্য করতে পারছে না। কেনো সে নিজে আসেনি? কেনো বলেনি যে দিবা, আমি ভালোবাসি তোমাকে। তোমার পছন্দ আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান! অভিমানে ভেতরটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে।

” মাম্মা, কি করছো? দেখো বাবা কি এনেছি!”

ঈশান ফিরেছে, দূর থেকেও তার রাশভারী কণ্ঠের আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। দিবা চোখের অশ্রু মুছে নেয়। রুমে এসে বিছানায় পড়ে থাকা উপহারের বাক্সটা তুলে নেয়।

রোজা কিছু বলার চেষ্টা করছে। চোখে হাত দিয়ে, ইশারায়। ঈশান ভ্রু কুঁচকে বলে,” হোয়াট হ্যাপেন্ড মাম্মা? তুমি কান্না করেছো? কেন?”

রোজা নিজের দিকে ইশারা করে বোঝায়, সে কাঁদেনি। কেঁদেছে দিবা। সে দিবার ঘরের দিকেই ইশারা করে। ঈশান আরও একটু অবাক হয়৷ দিবা কেনো কাঁদবে? আবার কি হয়েছে? কৌতুহলে হাসফাঁস লাগলেও জিজ্ঞেস করতে যায় না সে। নিজেকে দমন করে রোজাকে কোলে তুলে বলে,” চলো বাবা আগে ফ্রেশ হই। তারপর আমরা ভিডিও গেমস খেলবো। ওকে? ডান!”

রোজাকে এনে নিজের প্রাইভেট সুইটের বিছানায় বসিয়ে দেয় ঈশান৷ তারপর হাতের ঘড়ি খুলে, গলা থেকে টাই খুলতে নিতেই দিবা এসে দরজায় দাঁড়ায়। সিরিয়াস মুখে অনুমতি চায়,” আসতে পারি?”

ঈশান ঘাড় ঘুরিয়ে দিবাকে দেখে। নরম স্বরে বলে,” হুম, এসো।”

দিবার হাতে গিফটের বড় বাক্সটা, চোখ-মুখ কঠিন। বাক্সটা ফট করে মার্বেল পাথরের মেঝেতে রেখেই জিজ্ঞেস করে,” কি এগুলো? ”

ঈশান ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দৃষ্টি রাখে। দায়সারা ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,” কেনো? পছন্দ হয়নি?”

দিবা কটমট করে বলে,” আমার পছন্দ হয়েছে কি হয়নি সেটা বড় কথা না৷ কথা হচ্ছে আপনি এরকম নাটক শুরু করেছেন কেন?”

” মানে? কিসের নাটক?”

” এইসব উপহার পাঠানোর নাটক।”

দিবা বাক্সের ভেতর থেকে Dior এর ব্যাগটা তুলে বলে,” এটা আমার পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু আমি রেখে এসেছি। আর এই হিলস, এটা তো আমি জাস্ট ছুঁয়ে দেখেছিলাম। নেওয়ার কথা ভাবিওনি। তারপর এই ড্রেস, এগুলো তো আমার সাথে যায় না! যে নিজের বউকে হিজাব ছাড়া ঘর থেকে বের হতে দেয় না সে এমন টাইট ফিটিং ড্রেস উপহার দিয়েছে বিষয়টা খুব হাস্যকর হয়ে গেল না মিস্টার ঈশান আহসান? এই ড্রেস আমি কোথায় পরবো বলতে পারেন? তাছাড়া এতো এতো দামী জুয়েলারি দিয়ে আমি কি করবো?”

” তুমি কি করবে সেটা তোমার ইচ্ছা৷ আমি শুধু আমার কাজ করেছি। ”

ঈশান এটুকু বলে রোজার দিকে তাকায় একবার৷ দিবা এতো রেগে রেগে কথা বলছে যে রোজা কেমন ভ’য় পেয়ে তাকিয়ে আছে। ঈশান বলে,” মাম্মা, তুমি তোমার খেলার জায়গায় যাও। বাবা একটু পর আসছি। ওকে?”

রোজা শান্ত ভঙ্গিতে বিছানা থেকে বার্গারের বাক্সটা তুলে নেয়। দিবার জন্যেও আইসক্রিম এনেছে ঈশান। রোজা সেটা দিবার দিকে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দিবা নেয় না। ঈশান বলে,” রেখে যাও। পরে নিবে।”

রোজা রেখে চুপচাপ চলে যায়। যেনো খুবই বুঝেছে বিষয়টা। ঈশান তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” সিমি আমাকে বলছিল তুমি সবার জন্য শপিং করেছো, শুধু নিজের জন্যই কিছু কেনোনি। পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও রেখে এসেছো। তাই আমার মনে হলো তোমার পছন্দের জিনিসগুলো একসাথে করি।”

” এসব করে আপনি কি প্রমাণ করতে চান?”

ঈশান ঠান্ডা গলায় বলে,” কিছুই প্রমাণ করতে চাই না।”

” কিন্তু আমি জানি। কালই তো বললেন আমি আমাদের সম্পর্কে শর্ত বেঁধেছি। আর আপনার সাথে প্রতারণা করেছি। আমার সত্য লুকিয়েছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারছেন না! এর মানে কি? আমি অপরাধী। আপনি আমাকে শাস্তি কেনো দিচ্ছেন না? উপহার কেনো পাঠাচ্ছেন? নিজেকে খুব মহৎ স্বামী প্রমাণ করতে চান?”

ঈশান একটু হাসে। তার চোখে ছলকে ওঠা বিদ্রুপ দিবার গায়ে জ্বলতে থাকা আগুনে ঘি ঢালে যেন। ঈশান বলে শান্তভাবে,” আমার নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার ইচ্ছা নেই। আমি স্বভাবতই এরকম। আশেপাশের সবাইকে সর্বোচ্চ দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করি।”

” আপনার ধারণা এসবে আমি অনেক খুশি হবো?”

” সেটা তোমার উপর। খুশি না হলে তো আমি জোর করে কিছু করতে পারি না৷ তবে আমি আমার চেষ্টায় কমতি রাখবো না।”

” কিন্তু কেনো করবেন আপনি এটা? আমি তো অপরাধী! আমাকে তো আপনি ঘৃণা করেন৷ আবার রোজার জন্যেও আমাকে আপনার প্রয়োজন নেই। মেয়েকে যখন নিজেই সামলাতে পারবেন, তাহলে আমাকে কেনো ধরে রেখেছেন? অবহেলাই যখন করবেন, তখন ডিভোর্স কেনো দিচ্ছেন না? দয়া দেখাচ্ছেন আমার উপর? এতো দয়া আপনার!”

ঈশান দৃঢ় কণ্ঠে বলে,” এটা দয়া না। অপরাধ যে কেউ করতে পারে। তোমার জায়গায় রোজাও অপরাধ করতে পারতো। যদিও আমি আমার মেয়েকে সুশিক্ষা দিয়ে বড় করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তবুও ও যদি কোনো ক্রাইম করে ফেলে তখন তো আমি ওকে ছেড়ে দিবো না। ওর দায়িত্ব নেওয়া বন্ধ করে দিবো না। কিংবা ওকে সন্তান হিসেবে ত্যায্য করে দিবো না৷ তাহলে তুমি ডিভোর্সের কথা ভাবছো কেনো যেখানে আমি এই কথা একবারও উচ্চারণ করিনি?”

” রোদেলাকে তো ঠিকই ডিভোর্স দিয়েছিলেন। তাহলে আমার বেলায় কেনো এতো নাটক? আমি অসহায় বলে? আমাকে নিজের আঙুলে নাচাতে পারবেন বলে?”

ঈশান এবার খুব গম্ভীর হয়ে বলে,” দিবা ভেবে-চিন্তে কথা বলো। তোমার অপরাধ আর রোদেলার অপরাধ এক না।”

দিবা হাতের জিনিসগুলো ছুড়ে ফেলে বলে,” আমার এসব দমবন্ধ লাগছে। আমি সহ্য করতে পারছি না আপনার এই ব্যবহার। প্রতি মুহূর্তে আপনার এসব দয়ার দান আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে নিজের অবস্থান।”

ঈশান কঠিন হয়ে বলে,” তাহলে সেটা তোমার মনের প্রবলেম। আমার এখানে কিছু করার নেই।”

কথা শেষ করে ভাবলেশহীন মুখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয় ঈশান। সে গা থেকে শার্ট খুলে নিতেই দিবা স্তব্ধ হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। তার কোনো ইচ্ছে নেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঈশানের নগ্ন সুঠাম শরীর দেখার।

দিবা বের হয়ে যাওয়ার পর ঈশান তার ঘরের দরজা আটকে দেয়। বাথরুমে ঢুকে জ্যাকুজিতে গিয়ে গা ডুবিয়ে বসে। মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা। শীতল পানির স্প্রে পিঠে এসে লাগছে, মনে হয় যেন ক্লান্ত শরীরে কেউ মায়াবী স্পর্শ এঁকে দিচ্ছে। ঈশান চোখ বন্ধ করতেই অনুভব করে দিবাকে। দ্রুত চোখ খুলে ফেলে। না, ভাববে না সে এসব। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আরও কঠিনভাবে।

ঘরে এসে দিবা আবারও বারান্দায় বসে৷ সে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর একদম কাঁদবে না। কিন্তু চোখের পানি তার কথা শুনছে না। অনুভূতিগুলো বাঁধন ছাড়া বেহায়া! এভাবে কেনো বার-বার দিবা তার দূর্বলতা প্রকাশ করছে? তার তো একসময় ঈশানের সামনে মুখ দেখানোর জো থাকবে না!

ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়৷ দিবা ডিনারেও যায় না। ক্ষুধা, তৃষ্ণার অনুভবটুকুও যেন সে ভুলে গেছে৷ ওভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় বসে থাকে৷ হঠাৎ গায়ে কারো স্পর্শ পেতেই দিবা চমকে তাকায়৷ ঈশান শক্ত করে চেপে ধরেছে তার হাত। দিবা আগ্নেয়গিরির মতো ফুসে উঠে বলে,” ছাড়ুন আমাকে, ধরবেন না। খবরদার!”

ঈশান তার সাথে জোরাজুরি না করে সরাসরি তাকে পাজাকোলায় নেয়। দিবা তার এতোটুকু শরীর দিয়ে কতক্ষণ আর লড়াই করবে? তবুও যেন হার মানবে না। ছটফট করতেই থাকে। ঈশান আছাড় মেরে তাকে বিছানায় ফেলে দেয়। দিবার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। মাথা ঝিমঝিম করে। ঈশান খুব রাগান্বিত ভঙ্গিতে টেবিল থেকে হোয়াইট সস পাস্তার প্লেট নিয়ে বলে,” চুপচাপ হা করবে। আমি কোনো তামাশা দেখতে চাই না।”

দিবা মুখ সরিয়ে বলে,” খাবো না। ক্ষিদে নেই আমার।”

ঈশান দাঁতে দাঁত পিষে,” প্রতিদিন খাওয়া নিয়ে তোমার ঝামেলা দেখতে আমার ভালো লাগছে না। দিবা হা করো নয়তো আমি কি করব নিজেও জানি না।”

” আপনার যা ইচ্ছা করেন, আমি খাবো না ”

মুখ ঘুরিয়ে রেখে একইভাবে ত্যাড়া ভঙ্গিতে উত্তর দেয় দিবা। ঈশানের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যায়। পাস্তার প্লেটটা রেখে শক্ত করে চেপে ধরে দিবার চোয়াল। তারপর খুব, খুব অপ্রত্যাশিতভাবে টেনে নিয়ে ঠোঁটে চুমু দিতে থাকে। ভীষণ তৃষ্ণাভরা সেই স্পর্শ! দিবা থরথর করে কাঁপে পুরোটা সময়। বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে হৃদযন্ত্রটা যেন তীব্র কম্পনে বিকলই হয়ে গেছে। ঈশান একটু পর তাকে ছেড়ে লম্বা শ্বাস নেয়। দিবা স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। সে কিছু অনুভব করতে পারে না, এই কিছুক্ষণে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা অবিশ্বাস্য মনে হয়।

ঈশান জেদি কণ্ঠে বলে,” এখন খাবে? নাহলে কিন্তু আরও ভ’য়ংকর কিছু করব। কারণ তুমিই বলেছো আমার যা ইচ্ছা! অনুমতিটা তুমিই দিয়েছো।”

দিবা থতমত খাওয়া দৃষ্টিতে কতক্ষণ চেয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,” আমি কিভাবে বুঝবো যে আপনি এতো অ’সভ্য!”

কথাটা সে বিরক্ত হয়ে বললেও তার কণ্ঠ কাঁপছে। একটু আগে সে নিজেও ঘোরে চলে গেছিল। ইশানের চোখ দু’টোয় খেলে যায় একটা সুক্ষ্ম হাসির ঝিলিক। সে শান্ত স্বরে বলে,” হাঁ করো।”

দিবা বাধ্য হয়ে খাবার মুখে নেয়। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও জোর করে চিবিয়ে খেতে থাকে। প্রতিদিন ঈশানের খাবার নিয়ে এসে জোর করে খাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা দিবাকে আরও দ্বিধায় ফেলে। এইযে তার একুশ বছরের জীবনে কত-শত রাত সে না খেয়ে পার করেছে। কেউ খেয়াল রাখেনি৷ রেবা আপা তো নিজের সংসারের ব্যস্ততা নিয়েই ডুবেছিল। দিবার দিকে খেয়াল রাখার তার সময় কই?

এই প্রথম দিবা কাউকে পেয়েছে, যা তার সব বিষয়ের খুটিনাটি পর্যন্ত খেয়াল রাখে। সে কিভাবে ঈশানের প্রতি দূর্বলতা কাটাবে? এ যেন অসম্ভব! তার নিয়ন্ত্রণশীল মনোভাব দিবাকে আকৃষ্ট করে, যত্নশীলতা মনকে আবেশিত করে আর তার ভালোবাসা মাখা স্পর্শে দিবা হারিয়ে যায় স্বর্গীয় স্বপ্নে।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সে ভুলতে পারছে না ঈশানের অবহেলা, তার অপূর্ণতা নিয়ে ঈশানের প্রতিটি কটূবাক্য বিষের মতো বিঁধে গায়ে। ধ্বংসাত্মক লাগে সবকিছু, দুঃস্বপ্ন মনে হয়।

দিবা কান্নার একটা ঢোক গিলে বলে,” তখন আমার বয়স বারো ছিল, ব্যাপারটা আমি প্রথম বুঝতে পারি।”

” কোন ব্যাপার?” ঈশান প্রশ্ন করে একটু অবাক হয়ে।

দিবা ভঙ্গুর হয়ে আসা কণ্ঠে বলে,” আমার অপূর্ণতা, যার জন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করতে পারছেন না ”

ছলছল চোখে তীব্র অভিমান নিয়ে তাকায় দিবা। ঈশান আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখে, অতঃপর তাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে এসে বলে,” আমি এই জন্য তোমাকে ক্ষমা করতে পারছি না এটা ভুল বললে। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই৷ পৃথিবীতে সবারই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আমারও আছে৷ তাই বলে এজন্য কেউ শাস্তির যোগ্য হতে পারে না। আমার রাগটা শুধু এখানেই যে তুমি এই কথা আমাকে আগে কেনো জানালে না? কেনো টেস্ট করেই আমাকে সব জানতে হলো?”

দিবা কাঁদতে কাঁদতে বলে,” ছোট থেকে এই ব্যাপারটা নিয়ে মানুষের এতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করেছি যে আমি ভেবেছিলাম, আপনিও এর জন্য আমাকে দূরে সরিয়ে দিবেন।”

” আমাকে তাহলে এই চিনলে এতোদিনে? হ্যাঁ আমার কথা-বার্তা আর আচরণ খুব রুড হতে পারে। কিন্তু আমি নির্দয় না দিবা। তুমি অন্তত একবার চেষ্টা করতে, আমাকে বলতে।”

” আমি প্রথমেই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে আপনার সাথে কথা বলে মনে হলো আপনি শুধু আমাকে সামাজিকতার খাতিরে বিয়ে করছেন। হয়তো রোজার জন্য আপনার ভালো মা দরকার। আর আমার রোজার মা হতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা ছিল না। বরং এই ব্যাপারটা তো আমার কাছে ব্লেসিংয়ের মতো। ”

” তাই বলে তুমি এটা কেনো বলবে না?”

” নিজের জন্যই বলিনি৷ নিজের ভালো থাকার জন্য। আমি আমার স্বার্থপর মনোভাব স্বীকার করছি। কিন্তু একদিন না একদিন তো আপনি এই কথা জানবেন। তখন আমাকে দূরে সরিয়ে দিলেও আমার কিছু যায়-আসবে না৷ এটা ভেবেই আরও চুপ ছিলাম। কারণ, আমি স্বার্থপর! শুধু নিজেরটাই বুঝি।”

ঈশান দিবার মুখটা উপরে তুলে চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,” সত্যি কিছু যায়-আসবে না তোমার?”

দিবা অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। সে ভুল ছিল, ঈশান যখন তাকে দূরে সরিয়ে দিল, তার পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এসেছিল। সে ধ্বংস হয়ে গেছে এক নিমেষে! মুখ ফুটে সেটুকু বলতে পারে না আর।

ঈশান দিবার গাল থেকে সরলরেখার মতো গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে দেয়। দিবা ঈশানের বুকে পুনরায় মাথা ঠেকিয়ে বলতে থাকে,” একবার আমাদের এলাকায় খুব বিরাট একটা বিয়ের আয়োজন হয়েছিল৷ কি সুন্দর! ঝিকমিক আলো, জমকালো প্যান্ডেল, ফুলের গাড়ি করে বরের আসা, তিনদিন তিনরাত ধরে গান বেজে যাচ্ছিল। বউটা এতো সুন্দর করে সেজেছিল, যেন রূপকথার রাজ্যের রাজকুমারী। আমার এতো ভালো লাগল! আপাকে বলেছিলাম, বিয়ে বিষয়টা কি চমৎকার! আমি আমার বিয়েতে এর চেয়েও বেশি আনন্দ করব।

রেবা আপা তখন প্রথমবারের মতো আমাকে বুঝিয়েছিল যে আমার কখনও বিয়ে হবে না। আর যদি হয়, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই বড় কোনো শর্তের মাধ্যমে হবে। কারণ আমি অন্যদের মতো স্বাভাবিক না। আমার বিয়ের বিষয়টাও স্বাভাবিক হবে না। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, আল্লাহর উপর খুব অভিমান হয়েছিল৷ কেনো আমাকেই এতোবড় শাস্তি দেওয়া হলো?

আমি তো কখনও কারো সাথে অন্যায় করিনি, কারো মনে কষ্ট দেইনি। তাহলে কেনো আমার জীবনে এতো কষ্ট? প্রথমে বাবা-মা চলে গেল, ভবিষ্যতেও আমাকে যদি কেউ ভালো না বাসে, যদি আমার কোনো সন্তান না হয়, তাহলে গোটা জীবন কি আমি এভাবেই একা কাটাবো? এসব ভাবতে গেলে আমার খুব দমবন্ধ লাগতো। তারপর যখন আমার আঠারো বছর বয়স, তখন আমার জীবনে রাফিন আসে।”

ঈশান অবাক হয়ে বলে,” এখন তোমার বয়স কত?”

” একুশ। কিন্তু সার্টিফিকেটে উনিশ।”

ঈশান হতবিস্মিত হয়ে বলে,” আমি ভেবেছিলাম, মিনিমাম তেইশ- চব্বিশ তো হবে! আমার এতো জুনিয়র তুমি?”

দিবা ভ্রু কুঁচকে বলে,” এখন কি আমার বয়স নিয়েও আপনার প্রবলেম হচ্ছে?”

” না, সেরকম কিছু না৷ আচ্ছা বলো।”

” কি আর বলবো? কিছুই বলার নেই। বাকিটা আপনি জানেন। রাফিনের সাথে আমার বিয়ে হয়নি। যদি হতো, তাহলে এরচেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হতো।”

” এখন কি তুমি খুব খারাপ পরিস্থিতিতে আছো?”

“জানি না, বুঝতে পারছি না। আগে বলুন আপনি কি আমার মতো স্বার্থপর মেয়েকে ক্ষমা করতে পেরেছেন?”

ঈশান তীব্র কণ্ঠে বলে,” ক্ষমা করতে না পারলে আমার এতো কাছে আসতে পারতে না তুমি।”

দিবার অবচেতন মন এতোক্ষণে খেয়াল করে, সে ঠিক ঈশানের বুকের উপর শুয়ে আছে৷ তার পুরো শরীর কি যত্নের সাথে আগলে ধরে আছে ঈশান! ঠিক আগের মতো। অদ্ভুত একটা মিষ্টি শীতল অনুভূতির ঢেউ আছড়ে পড়ে মনে।

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৫
Sidratul Muntaz

হঠাৎ করেই পুরো ঘরটা যেনো ফুলের সুবাসে ভরে উঠেছে। দিবার এতোক্ষণ কান্না পাচ্ছিল না, কিন্তু এই মুহূর্তে তার ভীষণ কান্না পায়। ঈশান যত্ন করে তার গায়ে কমফোর্টার টেনে দেয়। কপালে দেয় মৃদু চুমু। দিবা প্রবল আশ্লেষে জিজ্ঞেস করে,”আমাকে কি সত্যিই মন থেকে ক্ষমা করেছেন? সত্যিই!”

ঈশান ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,” তোমার কি মনে হয়?”

” জানি না, আমি বুঝতে পারছি না।” কান্নার দমকে তার কথা আটকে আসে। ব্যাপারটা যে তার জন্য অবিশ্বাস্য। ভেবেছিল আর কখনও বুঝি ঈশান তার দিকে মুখ ফিরেও তাকাবে না। সেখানে ক্ষমা তো অনেক দূরের কথা।

ঈশান আলতো করে দিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” আমার কাছে সব অপরাধের ক্ষমা আছে দিবা৷ শুধু একটা অপরাধ ছাড়া।”

দিবা তাকিয়ে থাকে অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টিতে। ঈশান মেঘের মতো গম্ভীর গলায় বলে,” বিট্রেয়াল! পৃথিবীর সব অপরাধ ক্ষমা করা গেলেও এই ব্যাপারে আমার কখনও কোনো সেকেন্ড থট নেই। তুমি যেটা করেছো সেটাকে আমি একটা অবুঝপনা ধরে নিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো, আমার কাছে লয়্যালিটি সবচেয়ে ইম্পোর্ট্যান্ট। এটা ব্রেক করলে জীবন থেকে তোমাকে মুছে ফেলতে দুইবার ভাববো না।”

কথাগুলো কেমন তীরের মতো আঘাত করে সারা শরীরে। দিবা মাথা নিচু করে বলে,” রাফিনকে নিয়ে সন্দেহ করছেন? ভাবছেন এখনও ওর প্রতি আমার ফিলিংস আছে কি-না? সেজন্য এসব বলছেন? বিশ্বাস করুন, আমার মনে এখন শুধু আপনি!”

দিবার লালচে ঠোঁট দু’টোয় আঙুল চেপে ধরে ঈশান। ঠান্ডা গলায় বলে,” আমি সন্দেহ করছি না, শুধু বোঝানোর জন্য বলছি। বিয়ের আগেই আমি নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলাম যে রাফিনের সাথে তোমার কোনো যোগাযোগ আছে কি-না। তারপর দেখি তুমি সত্যিই বলেছো। হোসেন তখন থেকেই তোমাকে ফলো করতো।”

দিবা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে তাকায়। ভ’য়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বিদ্যুৎবেগে প্রবাহিত হয় শরীরজুড়ে। সে বিয়ের আগে রাফিনের সাথে একবারও দেখা করেনি, এটা ঠিক। কিন্তু একবার ঠিকই গিয়েছিল শেষবার দেখা করতে। কিন্তু মনবদল হওয়ায় ফিরে এসেছিল৷ ভাগ্যিস সে দেখা করেনি!

দিবা জিজ্ঞেস করে,” যদি আপনার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও আমি রাফিনের সাথে দেখা করতাম, তাহলে কি হতো?”

” এই বিয়েটাই হতো না।”

দিবা আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাগ্যিস সে দেখা করেনি! ঈশান বলে,” এখনও হয়তো বিয়েটা ভেঙে যেতে পারে৷ যদি তুমি রাফিনের সাথে দেখা করো।”

দিবা চোখ বড় করে বলে,” আপনার আমাকে এরকম মনে হয়? রোদেলা আপুর মতো?”

ঈশান হেসে ফেলে বলে,” মজা করছি!তুমি কখনও রোদেলা হবে না। আমি জানি সেটা। তুমি আমার দিবা, ডিভা কুইন!”

দিবার মনটা শীতলতায় ভরে যায়। আবারও সবকিছু স্বপ্নের মতো স্বর্গীয় অনুভূত হয়। সে উতলা হয়ে বলে,”আচ্ছা, রোদেলা আপুর সাথে আপনার বিয়ে কিভাবে হয়েছিল তাহলে?”

” হঠাৎ এই কথা কেন?”

” এমনি শুনতে ইচ্ছে করছে। ওর পেছনেও কি স্পাই লাগিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন?” দিবা খুব সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করছে।

ঈশান হেসে ফেলে। নিরাসক্ত গলায় বলে,” সেটা করলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু তখন আমার মনে এতো সন্দেহ ছিল না। রোদেলাকে আমি ভালো করে চিনতামও না। তবে আমরা ব্যাচমেট ছিলাম। ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে। ও আমাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতো। ভার্সিটির ট্যুরে যাওয়ার জার্নিতে ও আমাকে বাসে প্রপোজ করেছিল।”

” তারপর আপনি কি করলেন?”

” ভাবার জন্য সময় চেয়েছিলাম তিনদিন। আর তিনদিন পর ভার্সিটি গিয়ে আমি ওকে একেবারে বিয়ের জন্য প্রপোজ করলাম। ”

” কিহ! সত্যি? আপনি বিয়ের সিদ্ধান্ত এতো দ্রুত নিয়ে নিলেন?” বিস্ময়ে চোখ দু’টো এতোবড় হয়ে গেছে দিবার।

ঈশান এক ভ্রু উঁচু করে বলে,” মনে হয়েছিল যেই মেয়ে সবার সামনে প্রপোজ করতে পারে সে নিশ্চয়ই খুব সিরিয়াস হবে। কিন্তু বিয়ের প্রপোজ্যাল হয়তো ও আশা করেনি। খুশি আর বিস্ময়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।”

দিবা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ঈশান মুচকি হেসে বলে,” সবাই ভাবল, আমি মনে হয় ওকে থাপ্পড় মেরেছি। তাই ভ’য়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।”

এবার একটু শব্দ করে হেসে উঠে দিবা। ঈশান শ্বাস ছেড়ে বলে,” খুবই ইমব্যারেসিং সিচুয়েশন হয়েছিল। জানি না কেন সবাই আমাকে এতো রুড ভাবতো৷ হয়তো আমার এই রাফ ফেসের জন্যই। ”

দিবা ফিসফিস করে বলে,” আমার তো আপনাকে একদমই রুড লাগে না৷ বরং কিউট লাগে, ভীষণ কিউট!”

তারপর সে শুকনো কণ্ঠে বলে,” হয়েছে থাক, বাদ দিন। আর শুনতে ইচ্ছা করছে না এই গল্প।”

” তুমিই তো শুনতে চাইলে।”

” হ্যাঁ, কিন্তু এখন আমার জেলাস হচ্ছে।”

ঈশান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলে,” তুমি তো রোজাকেও জেলাস করো তাই না?”

দিবা চমকে উঠে। হতবাক হয়ে বলে,” এটা কিভাবে বুঝলেন?”

” বোঝা যায়। জেলাসি তোমার চোখে-মুখেই ফুটে উঠে যখন রোজা আমার কাছে অনেকক্ষণ ধরে থাকে।”

দিবা খুব লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বলে,” আ’ম স্যরি…আমিও রোজাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু মাঝে মাঝে…”

” হয়েছে চুপ। আর কথা না…”

ঈশানের কণ্ঠে একটা অদ্ভুত মাদকময় ঘোর। ওই কঠিন দৃষ্টি এখন এতো গভীর! দিবার শরীর শিরশির করে। ঈশান তার চিবুক উপরে তুলে গলায় ঠোঁট ছোয়ায়। সাথে সাথে দিবা কেঁপে উঠে বলে,” রোজা ঘুমিয়েছে?”

” না, এখনও গেইমস কর্ণারে।” ভারী গভীর কণ্ঠে বলে ঈশান।

দিবা অনুরোধ করে বলে,” তাহলে ছাড়ুন, প্লিজ। ও চলে আসবে।”

” সত্যি ছেড়ে দিবো?”

দিবা একটু সময় চুপ থেকে নিচু ও আড়ষ্ট গলায় বলে,” না, কিন্তু দরজাটা বন্ধ করে আসুন!”

ঈশান হাসে শব্দ করে। হাসিটাও ভীষণ নেশার মতো লাগে। দিবার মুখ লাল হয়ে যায়। গুটিশুটি মেরে বিছানায় শুয়ে থাকে৷ শরীর শক্ত হয়ে আসে ক্রমশ। ঈশান ফিরে এসে দিবাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার নাকের ডগায় চুমু দিয়ে বলে,” রোজা ঘুমিয়েছে অনেক আগেই৷ এতোরাত পর্যন্ত মেয়েকে জাগিয়ে রাখব না আমি৷ তবু দরজা লক করে এসেছি। কারণ বলা যায় না…”

দিবা লাজুক হাসে। ঈশান হঠাৎ বলে,” তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না রিফোরমেশন এর ড্রেসটা কোথায় পরবে? চাইলে এখনি পরতে পারো কিংবা সবসময়, তবে শুধু আমার সামনে।”

” কিন্তু ওটা তো আপনার প্রাইভেট স্পেসে ফেলে এসেছি। নিয়ে আসবো?”

ঈশান নরম গলায় বলে,” থাক লাগবে না। অন্যসময়। এখন প্রাইভেট টাইমে নো ডিস্টার্বেন্স।”

দিবা হেসে ফেলে খিলখিল করে। সেই স্বপ্নের মতো রাত আবার ফিরে আসে। হাজার হাজার ফুলেল সৌরভে ঘর ভরে যায়। একটা প্রশান্তি আর তৃপ্তিময় ভোর আসে, অনেকদিন পর। দিবা ঘুমোয়, যেন বহুবছর পর এক পশলা শীতল বৃষ্টির মতো শান্তিময় ঘুম!

কাঁচ থেকে পর্দাটা সরাতেই রোদ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ঘরে। চোখ বন্ধ রাখা মুশকিল হয়ে যায়। সাধের ঘুমে ব্যঘাত সৃষ্টি হওয়ায় দিবা খুব বিরক্ত হয়, চোখ মেলতেই একটা লম্বা-চওড়া আর ভীষণ আকর্ষণীয় অবয়ব ভেসে উঠে সামনে। সে মুখ কুঁচকে বলে,” উফ, আমার ঘুম আপনার সহ্য হচ্ছে না তাই না? সেজন্য এমন করছেন? রাতেও ঘুমাতে দেননি, আর এখন সকালেও…”

ঈশান মুখ চেপে ধরে দিবার, তার হাত হিমশীতল। কড়া মেনস শ্যাম্পুর গন্ধে কেমন শ্বাসরুদ্ধ লাগে। কপালে এলোমেলো চুল থেকে টপটপ পানি গড়িয়ে পড়ছে। দিবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তার ঘুম ছুটে গেছে। ঈশানের দিকে তাকিয়ে সে একটা ঘোরে চলে যায়। ওই কঠিন মুখ স্নিগ্ধতায় কি আশ্চর্য সুন্দর হয়ে উঠেছে!

ঈশান কটমট করে বলে,” এটা কি? হোয়াট ইজ দিজ?”

তার ভারী কণ্ঠের চাপা গর্জনে ঘোর কাটে দিবার। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলে,” জ্বী, কোনটা?”

” এটা! এই মেসেজ। নাও দেখো।”

ঈশানের হাতে দিবার ফোন ছিল৷ সে এটা দিবার হাতে দেয়। তারপর নিজে হাত ভাঁজ করে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। দিবা ঘুমো ঘুমো চোখ কচলে ভালো করে দেখে ফোনের ক্রিনে থাকা মেসেজটা। আসলে মেসেজ না, এটা একটা অফিসিয়ালয়াল মেইল।

Subject: Official Invitation to Present at the International Youth Science Innovation Summit 2024, Singapore

To: Ms. Diba Rahman
Department of Chemistry
University of Dhaka, Bangladesh

Dear Ms. Rahman,

We are delighted to inform you that your undergraduate research project…

বাকিটা আর পড়ে না সে। কারণ এটা অনেক আগের মেইল। সে তো ড্রাফট বক্সে ফেলে রেখেছিল। দিবা চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ঈশান প্রায় র’ক্তিম দৃষ্টি মেলে দেখছে তাকে। যেন এখুনি গিলে খাবে।

দিবা প্রায় নিভু নিভু স্বরে বলে,” আপনি এভাবে কেনো দেখছেন? এটা তো কয়েকমাস আগের মেইল।”

ঈশান নিচু হয়ে টেবিলে আঘাত করে বলে,” আমি জানি সেটা! কিন্তু তুমি এই মেইল আমাকে আগে দেখাওনি কেনো? তোমার এতো কষ্টের প্রজেক্ট, সিলেক্ট পর্যন্ত হয়েছিল। তুমি কেনো যাওনি ওখানে?”

দিবা থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে না। ঈশান মাথা নেড়ে বলে,” বুঝেছি, আমার জন্য সবকিছু। আমাকে অপরাধী, টক্সিক প্রমাণ করতে চাও। আমি তোমাকে সিংগাপুর যেতে দিতাম না ভেবেছো? আরে আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যেতাম! একবার শুধু বলে দেখতে…”

দিবা ফিসফিস করে বলে,” রোদেলা আপুর মতো যদি…”

ঈশান প্রচন্ড রাগে চোখ বন্ধ করে ফেলে। দিবা চুপ করে যায় ভ’য়ে। তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। ঈশান শান্ত ভঙ্গিতে দিবার পাশে বসে। ভারী খরখরে গলায় বলে,” আমি আবারও বলছি দিবা, রোদেলার সাথে তুমি নিজেকে কম্পেয়ার করবে না। ওর বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি যদি ভেবে থাকো আমার টক্সিসিটির জন্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙেছে তাহলে সেটা ভুল।

ও আসলে আমার কাছে ভাণ ধরেছিল। ও যেটা না, সেটা সেজে জাস্ট আমার মন জয় করার চেষ্টা করতো। আর বিয়ের ঠিক কয়েক বছর পর, আনফরচুনেটলি রোজা জন্মানোর পর আমি ওর আসল রূপ বুঝতে পারি। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছিল। যে কারণে আমি ওকে ডিভোর্স দিইনি। কিন্তু মেন্টাল প্রেশার কমাতে সেপারেশনে গেছিলাম। একসময় হয়তো আমি ওকে মাফ করতাম। যদি না ও ওই নোংরা কাজটা করতো।”

দিবা মিনমিন করে বলে,” ভাগ্যিস মাফ করেননি। তাহলে আমি আপনাকে কিভাবে পেতাম?”

মুখে অবশ্য অন্যকিছু বলে,” আরে আমি আপনাকে টক্সিক ভাবিনি বিশ্বাস করুন। আমি জানি আপনি নিশ্চয়ই আমাকে যেতে দিতেন। কিন্তু তবুও আমি এটা রিজেক্ট করেছি। কারণ সিংগাপুর গিয়ে আমি আপনাকে ছাড়া কিভাবে থাকতাম? আর রোজা? ওকে ছেড়ে থাকার কথাও আমি ভাবতে পারি না৷ এতোবছর পর, জীবনে প্রথম একটা পরিবার পেয়েছি। এটা আমার কাছে কতবড় স্বপ্ন সেটা আপনাকে কিভাবে বুঝাই? ক্যারিয়ারের থেকেও নিজের ‘হঠাৎ পাওয়া স্বপ্নের মতো’ ওই পরিবারের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশি। স্পেশালি আপনার গুরুত্ব অনেক বেশি। বুঝেছেন মিস্টার ঈশান আহসান? আপনার জন্য শুধু সিংগাপুর কেন? আমি পুরো দুনিয়াও হারাতে রাজি!”

ঈশান বোকার মতো তাকিয়ে থাকে হা করে। দিবা হেসে বলে,” বিশ্বাস করুন আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। আমি ইচ্ছে করেই ওখানে যাইনি। এটা আমার চয়েজ ছিল। নিজের মতো চয়েজ তো করতে পারবো তাই না? এটাই আমার চয়েজ ছিল যে আমি আমার স্বামীর কাছে থাকবো। যে আমাকে ভীষণ যত্ন করে। আমার কোনো শখ অপূর্ণ রাখে না! যে আকাশ হয়ে আমাকে চাঁদের মতো আগলে রাখে। এই আপনি শুনছেন তো আমার কথা?”

দিবা তুরি বাজাতেই ঈশানের ঘোর কাটে। মাথা নেড়ে বলে,” হুম।”

তারপর আর কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এতোদিন সে সত্যি ভাবতো দিবা হয়তো অসহায় বলেই তাকে বেছে নিয়েছে। নয়তো তার কাছে দিবা কখনোই থাকতো না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে ফীল করতে পারছে, সে দিবার বাধ্যবাধকতা নয়। বরং সে দিবার চয়েজ! ব্যাপারটা উপলব্ধি করে গর্বে কেমন বুক ফুলে উঠে ঈশান আহসানের।

ঈশান একটু আমতা-আমতা করে বলে,” আমি ভাবছি, এবার বাড়ি ফিরে আমাদের ছাদের ওই রুমটা তোমার জন্য ছেড়ে দিবো। ওখানে নিজের ল্যাবরুম করবে তুমি। যা যা লাগবে লিস্ট করে দিও। আমি আনিয়ে দিবো। তুমি নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবে।”

দিবা হেসে ফেলে বলে,” বুঝলাম, আপনি চাইছেন আপনার বউ একদম কেমিস্ট হয়ে যাক।”

ঈশান হেসে বলে,” কেমিস্ট্রি নিয়ে অনার্স কেনো করছো তাহলে? তোমার যা ইচ্ছা হয় বলবে শুধু। সেটা পূরণ করার দায়িত্ব আমার। ইউর উইশ ইজ মাই কমান্ড, ডিভা কুইন।”

দিবার হাতের উল্টোপিঠে একটা চুমু দেয় ঈশান, ভীষণ তৃপ্তি আর আহ্লাদ নিয়ে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। গায়ে টি-শার্ট চাপিয়ে বলে,” আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসবো। আর রোজাকে আমি ব্রেকফাস্ট করিয়েছি। তোমারটা টেবিলেই আছে। দুপুরে তুমি ওকে নিয়ে তুমি লাঞ্চ করে নিও৷ সন্ধ্যায় আমরা ডিনারে বের হবো ”

দিবা মাথা নেড়ে বলে,” ওকে।”

ঈশান আলতো করে দিবার কপালে আরেকটা চুমু দেয়। তারপর বের হয়ে যায়। দিবা ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। ঈশান একটু ঘুরে তাকাতেই সে মিষ্টি করে ‘বাই’ দেয়। ঈশানও ‘বাই’ দেয়। তারপর রোজার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় পেন্টহাউজ ছেড়ে। দিবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও শুয়ে পড়ে বিছানায়। খুব আলসেমি লাগছে৷ বিছানা ছাড়তেই মন চাইছে না একদম।

দিবার আন্ডারগ্র্যাজুয়েট রিসার্চ প্রজেক্ট একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সিলেক্ট হয়েছিল এবং তাকে ইনভাইট করা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে।সে বাংলাদেশের গ্রামে ব্যবহৃত পুকুরের দূষিত পানিকে স্বল্প খরচে পরিবেশ বান্ধব করে রাসায়নিক পরিশোধন পদ্ধতিতে ব্যবহার যোগ্য করার একটি অভিনব পন্থা বের করেছিল। এসব গবেষণায় তার আগ্রহ ছোট থেকেই। ইন্টারে উঠেই বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়েছিল।

কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার পর ল্যাবে পার্ট-টাইম কাজ করতো। কারণ বাসায় যেতে ভালো লাগতো না। নিজের ডিপ্রেশন কাটাতে সবসময় মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখার প্রয়োজন হতো। তখন যদি দিবা এই সুযোগটা পেতো, তাহলে চলে যেতো এই দেশ ছেড়ে৷ সে তখন সিংগাপুর গেলে ফুল ফ্রী স্টুডেন্টশীপে বিদেশেই গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ হয়ে যেতো।

কিন্তু যখন তাকে সিলেক্ট করা হয়, তখন তার বিয়ে হয়ে গেছে ঈশানের সাথে। আর সে ঈশানের সংসারের রানী হয়ে উঠেছে। রোদেলা তার ক্যারিয়ারের জন্য ঈশানের মন থেকে উঠেছিল। দিবা সেই ভুল করবে না। তাতে ক্যারিয়ার ভেসে যাবে, যাক! ক্যারিয়ার নিয়ে সে এমনিও কিছু ভাবতে চায় না। ঈশান তাকে এতো বেশি যত্ন আর গুরুত্ব দিয়েছে যে দিবা তার জন্য অনায়াসে ত্যাগ করতে পারে সবকিছু।

সে জানে, চেষ্টা করলে সে নিজের যোগ্যতায় হয়তো অনেক ভালো কিছু করতে পারতো। ছোট থেকেই সে একা একা স্ট্রাগল করে পাবলিকে চান্স পেয়েছে, কেমিস্ট্রিতে পড়াশুনা করছে, ভবিষ্যতে বিসিএস-এও বসবে হয়তো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার কাছে একটা ভরসাযোগ্য হাত অনেক মূল্যবান। একটা প্রশস্ত বুক, একটা নির্ভরতা, যে সবসময় তাকে ভালোবাসায় আগলে রাখবে! এই ভালোবাসা আর যত্নের লোভেই দিবা ত্যাগ করতে পারে সমস্ত সুযোগ। এতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে শুধুই ভালোবাসার পিয়াসী ছিল। আর সেটা পেয়েই সে এখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে!

চলবে

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৫( অতিরিক্ত)
Sidratul Muntaz

সকাল সকাল রিজ কার্লটনের করিডোরে এসে দাঁড়ায় রাফিন। টিমের সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা। আজকের দিনটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স মিটিংয়ে যেতে হবে। সবার মধ্যে উপচে পড়া ব্যস্ততা।

পিআর তামান্নার মেজাজ ভীষণ চড়ে আছে সকাল সকাল। একনাগাড়ে ধমকাচ্ছে জুনিয়রদের। মিজান সাহেব যথেষ্ট গুরুতর ভঙ্গিতে প্রেজেন্টেশন দেখছেন। একটু আগেই রাফিনকে ফাইলগুলো রেডি না করার জন্য ঝারি মারলেন। রাফিন অবশ্য একটুও বিচলিত বোধ করছে না৷ তার মাথায় ঘুরছে সম্পূর্ণ অন্য চিন্তা! সকাল থেকেই মনটা ভীষণ রিফ্রেশ।

আসিফ ম্যানেজার তৌহিদকে তাগাদা দিয়ে বলে,” এখনও এদিকে সব সেটাপ রেডি হয়নি? আরে দ্রুত করুন। গাড়ি চলে এসেছে। ঈশান স্যার যেকোনো সময় নামবেন।”

তৌহিদ ঘড়ি দেখে বলে,” এইতো পাঁচমিনিট!”

ঠিক তখনি লিফট থেকে বের হয় ঈশান। তাকে দেখে টিমের সবাই কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এভাবে প্রত্যেককে নিজের দিকে তাকানো দেখে ঈশান ভ্রু কুঁচকে রুক্ষ স্বরে বলে,” হোয়াটস রং?”

ম্যানেজার তৌহিদ জিজ্ঞেস করে অবাক হয়ে,” স্যার আপনি কি কনফারেন্সে যাবেন না?”

” এটা কেমন ইউজলেস কুয়েশ্চন? আমি কেনো যাবো না?” ঈশান বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়।

আসিফ আর তৌহিদ একে অন্যের দিকে তাকায়। আসিফ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,” না মানে স্যার… আমরা ভেবেছিলাম আপনি তৈরী হয়ে নামবেন। কনফারেন্সের ড্রেস কোড তো এটা না…”

ঈশান নিজের দিকে তাকায় একবার। ওহ শিট, দিবার সাথে কথা বলতে বলতে তার নিজের দিকে একদম খেয়ালই ছিল না! সামান্য একটা ক্যাজুয়াল টি-শার্ট পরেই চলে এসেছে। এতোবড় কনফারেন্সে সে একজন স্পিকার হয়ে স্যুট-বুট ছাড়া যাবে, বিষয়টা আসলেই বেমানান।

তবু ঈশান নিজের ঠাঁট বজায় রেখে বলে,” যাইহোক, আমি এভাবেই যাবো। কারো কোনো প্রবলেম?”

প্রত্যেকে দ্রুত মাথা নাড়ে। আসিফ একটু হাসার ভাণ করে বলে,” নো স্যার। ফ্রাংকলি স্পিকিং, আপনি যেটাই পরেন না কেনো সবকিছুতে আকর্ষণীয় লাগে। আর আপনাকে টি-শার্টেও দেখতে একদম পারফেক্ট লাগছে! মনেই হচ্ছে না এটা ক্যাজুয়াল।”

তৌহিদ সম্মতি প্রকাশ করে। শান্ত কণ্ঠে বলে,” জ্বী স্যার। তাছাড়া পোশাক কোনো ব্যাপার না। এটিটিউডই আসল। আর আপনি তো সেক্ষেত্রে অলওয়েজ বস!”

মেয়েরা মুখ টিপে অনেক কষ্টে হাসি সামলায়, তৌহিদ আর আসিফের মতো টিমের দুই রাঘব বোয়াল হঠাৎ স্যারের মেজাজের সামনে কেমন মেনি বিড়ালের মতো আচরণ করছে। ব্যাপারটা হাস্যকর! রাফিনের বিরক্ত লাগছে খুব। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত রাখে সে।

ঈশান মিজান সাহেবের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করে,” প্রেজেন্টেশন ফাইল চেক হয়েছে?

মিজান সাহেব সংক্ষেপে জবাব দেন,” জ্বী স্যার। ডেটা ভিজুয়ালাইজেশন রিফাইন করেছি। তামান্না পিআর স্লাইড ফিনিশ করেছে।”

ঈশান তাকায় তামান্নার দিকে। সে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে বলে,”স্যার, একটা ইনফো আপনাকে জানানো দরকার। বিজনেস ম্যাগ গ্লোবাল টেকলাইন আজকের কনফারেন্সে সবার প্রোফাইল কাভার করছে। আপনি মূল স্পিকার হিসেবে ফোকাস পেতে পারেন। ক্যামেরা ট্র্যাক করবে আপনার স্টেজ মুভমেন্ট। সেটা মিডিয়ায় প্রকাশ হবে।”

মিজান সাহেব মাথা নাড়েন। ঈশান ঠান্ডা গলায় বলে,” ঠিকাছে, ওরা ফোকাস চাইলে পাবে। আমার কোনো প্রবলেম নেই।”

ঈশান সবাইকে ইশারা করে সামনে এগোনোর জন্য। সে থাকে সবার পিছে। সাধারণত লিডার হিসেবে তার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু সে সবসময় এমপ্লয়িদের আগে যেতে বলে নিজে পেছনে আসে। সবাই তটস্থ হয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। কেউ কোনো ভুল করার সুযোগ পায় না। কারণ পেছনে স্যারের দৃষ্টি আছে, বিষয়টা সবার মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার করে।

লস এঞ্জেলসের কনভেনশন সেন্টারে তারা পৌঁছায় সকাল ১১টায়। বড় বড় গ্লাসের দরজা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চমৎকার পরিবেশ! এছাড়া সাংবাদিক, মিডিয়া টিমের ভীড়। অনেকে নামি ব্র্যান্ডের ব্যাজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঈশানের টিমের সবাই ঢোকে মাথা নিচু করে।রিসেপশন ডেস্ক থেকে আইডি কার্ড ও ফোল্ডার নেয়।তামান্না সাথে সাথে মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেটিভদের সঙ্গে কথা শুরু করে।

রাফিন অনেকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরছে।ট্রেইনি হিসেবে এসেছে সে, প্রথম থেকেই খুব দায়সারা আচরণ৷ তাই তার দিকে কারো তেমন নজরও নেই। কিছুক্ষণ পর সে করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বাইরে চলে যায়। তারপর মেইনরোড থেকে একটা উবার নিয়ে সরাসরি রওনা হয় হোটেল রিজ কার্ল্টনে। সিমির থেকে সে জেনে নিয়েছিল ঈশানের পেন্টহাউজের নাম্বার ফিফট বি।

দিবার মনটা হঠাৎই খুব উদাস লাগছে। এখন তিনটা বাজে। ঈশান বলেছিল সে ফিরবে সন্ধ্যায়। মানে এখনও আরও তিন থেকে চারঘণ্টা অপেক্ষায় কাটাতে হবে। কি মুশকিল! আচ্ছা, তার এতো অধৈর্য্য লাগছে কেন? রোজাও তো ঈশানের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু দিবার মতো অস্থিরতা দেখাচ্ছে না। ওইটুকু মেয়ে, নিজের কাজে যেন খুব ব্যস্ত। যত্ন করে রঙতুলি আর ক্যানভাস নিয়ে ছবি আঁকতে বসেছে। সে আঁকছে একটা পান্ডা। রংধনুর উপর বসে থাকা পান্ডা এঁকে সে কি যে এতো মজা পাচ্ছে! কে জানে?

দিবা এতোক্ষণ ওর কাছেই বসেছিল। এবার সে নিজের রুমে এসেছে। আজকে সন্ধ্যার ডিনারের জন্য খুব সুন্দর করে সাজবে ঠিক করেছে সে। ঈশানের জন্য এটা হবে একটা মিষ্টি সারপ্রাইজ! দিবা তার রুমের ডেস্কের কনসোলে রাখা সার্ভিস মেনুটা তুলে নেয়। পেন্টহাউজের গেস্টদের জন্য ইন-রুম স্পা খুবই সহজলভ্য সেবা। মাত্র একঘণ্টার মধ্যেই বিউটিশিয়ান সুইটে চলে আসে।

মেয়েটির গায়ে হোটেল স্টাফদের ইউনিফর্ম। হাতে টুল কীট। ভীষণ সুন্দর করে বলে,” হ্যালো মিসেস আহসান, আমি আজকের জন্য আপনার বিউটি থেরাপিস্ট। আপনি কেমন লুক চান? বোল্ড নাকি সফট রোমান্টিক?”

দিবা লাজুক মুখে বলে,” আমি তো সফট লুকই বেশি পছন্দ করি।”

” ঠিকাছে, আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি সব প্রিপেয়ার করছি।”

দিবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে ম্যাসাজ টেবিলে। মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘরটা ভরে যায় ল্যাভেন্ডার আর ভ্যানিলা ওয়েলের মিশ্র সুবাসে। দিবা মনে মনে ভাবে, ঈশান আজ খুব চমকে যাবে। সে ওই রিফরমেশনের ড্রেসটা পরে যখন সামনে দাঁড়াবে, তখন কেমন হবে ঈশানের প্রতিক্রিয়া? ভেবেই একটা উষ্ণ, লজ্জার স্রোত প্রবাহিত হয় শরীর জুড়ে।

পেন্টহাউজ ইউনিটে সরাসরি প্রবেশ করা যায় না, প্রথমে হোটেল রিসেপশন ও সিকিউরিটির অনুমতি নিতে হয়। রাফিনের কাছে নেই কোনো এক্সেস কার্ড। তবে সে নিজেকে গেস্ট বলে পরিচয় দেয়। হোটেলের রিসেপশনিস্ট প্রশ্ন করেন,” কেনো যাচ্ছেন?”

রাফিন চেহারায় প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,” ঈশান আহসান আমার বস। তার প্রাইভেট সুইট থেকে একটা ফাইল নিতে পাঠিয়েছেন। ইমারজেন্সী!”

রিসেপশনিস্ট তার পরিচয় কনফার্ম করে তাকে লিফট এক্সেস দিয়ে দেয়। রাফিন ফিফটি বি-এর সামনে গিয়ে স্মার্ট ডোরবেল চেপে ধরে। একটা ঝাকুনির মতো শব্দ হয়। বিউটিশিয়ান ততক্ষণে চলে গেছে। দিবা হালকা স্যাটিনের ঢলঢলে সেই কাপড়টা গায়ে জড়িয়েছে। ফেসিয়ালের পর স্কিন যেন হীরের মতো চকচক করছে! সে গলায় একটা হীরের নেকলেসও পরে। হাতের ভীষণ দামী ঘড়িটায় চোখ বুলায়, এইতো আর মাত্র কয়েকঘণ্টা! তখনি বেলের শব্দটা পায় সে। দিবা ভাবে বেলবয় এসেছে। সে না দেখেই দরজা খুলে দেয় আর হতভম্ব হয়।

রাফিন দিবাকে দেখে একরাশ তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে। মৃদু হেসে বলে,” অবশেষে তাহলে দেখা হলো আমাদের! কেমন আছেন, মিসেস ঈশান আহসান? ”

দিবা খেয়াল করে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বুকের ভেতরে উচাটনের শব্দ! রাফিন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,” এখন কি বলে সম্বোধন করব তোমাকে? ম্যাডাম?”

দিবা পিছিয়ে যায়। সে এতো হতবাক হয়েছে যে কথা বলার শক্তিটুকুও সঞ্চয় করতে পারে না। মাথা ঝিমঝিম করছে। কোনমতে একহাতে মাথায় মালিশ করে বলে,” কেনো এসেছো?”

” জবাব চাইতে।”

রাফিনের কণ্ঠ অত্যন্ত হিংস্র। দিবা বিস্ময় নিয়ে তাকায়।

” কিসের জবাব?”

রাফিন মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে দিবাকে। রসিয়ে রসিয়ে বলে,” যদি এমন গ্ল্যামারাস লাইফের এতোই শখ ছিল তাহলে আমার সাথে প্রেম করেছিলে কেনো? আমি কি তোমার টাইম পাস ছিলাম? যখন ইচ্ছে হলো আমার জীবন নিয়ে খেললে আর যখন মন ভরে গেল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পছন্দমতো বড়লোক একজনকে বিয়ে করে নিলে! এতো ইজি সবকিছু?”

রাফিন গর্জন করে উঠে। দিবা হাত বাড়িয়ে বলে,” চলে যাও এখান থেকে। নয়তো আমি কাউকে ডাকবো যে তোমাকে… ”

দিবা কথা শেষ করার আগেই রাফিন তার এতোদিনের জমানো সমস্ত ক্ষোভ আর ক্রোধ নিয়ে খট করে দরজাটা আটকে দেয়। দিবার হাত ধরে টেনে তাকে রুমে নিয়ে যেতে থাকে। আওয়াজ শুনে রোজা ছুটে আসে তখন। হাতে তার রঙতুলি। সে শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে পায় একটা অপরিচিত লোক কিভাবে তার বেস্টফ্রেন্ডকে টেনে নিয়ে রুমে ঢুকে যাচ্ছে। রোজার সামনেই রাফিন রুমের দরজা আটকে দেয়।

লস অ্যাঞ্জেলস কনভেনশন সেন্টারে ব্রেক টাইম চলছে। সবাই কফি বা স্ন্যাকস নিয়ে লাউঞ্জে বসেছে। ঈশান তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে ফোন চেক করে। সে ফোনে তার হোম সিকিউরিটি এপটা খুলে বেডরুমের লাইভ ফুটেজ দেখবে, রোজা কি করছে, দিবা ঠিকমতো খেয়েছে কিনা, কিভাবে সময় কাটাচ্ছে, এসব প্রতিদিনই চেক করা তার অভ্যাস। কিন্তু আজকের ফুটেজটি দেখে তার মুখ থমকে যায়। রোজা একটা দরজার লক খোলার চেষ্টা করছে। দিবা তার পাশে নেই। ঈশান অন্য ফিডে ঢুকে দিবার ঘরের ফুটেজ চেক করতেই বিস্ময়ে হকচকিয়ে যায়। রাফিন কাউচে বসে আছে একপা তুলে। তার পাশে দিবা, ভ’য়ংকর সাজগোজ করেছে। আবার মুখে হাত চেপে কাঁদছে খুব। ঈশানের মাথায় গরম র’ক্ত ছলাৎ করে উঠে। রাফিন ওখানে কিভাবে গেল? এসব কি হচ্ছে?

চলবে।