#ভয়_এবং_জয় (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
বারো বছর বয়সে দুঃসম্পর্কের এক কাকার নোংরা স্পর্শের সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু আজও সাহস করে সেই কথা নিজের মাকে বলতে পারিনি। সেই সময়ে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়ে না জানলেও তার স্পর্শ যে খারাপ ছিলো সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। আমি জানি না, কিভাবে পারলাম ঐদিন বুঝতে। আজ মনে হয় আল্লাহর অশেষ রহমত ছিলো বলেই বোধহয় সেদিন আমার মাঝে ভালো, খারাপের অনুভব জন্ম নিয়েছিলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ বুঝতে পারি সেদিন কাকা আমার সাথে কি করতে চেয়েছিলেন। আজও ঐদিন ঘটনা মনে পড়লে আতকে উঠে। সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা হয় তখন যখন ভাবি, আমি এই ঘটনার কথা আমার মাকেও বলতে পারিনি। এসব বলতে বলতে সেদিনের স্মৃতিতে ভেসে যায় পারুল। সেদিন ছিলো শুক্রবার, ছুটির দিন। বিকাল বেলা পাশের বাড়ির মুন্নির সঙ্গে খেলার উদ্দেশ্য বের হয় পারুল। মুন্নি বাড়িতে না থাকায় ফেরত চলে আসে পারুল। বাড়ির রাস্তা আসতে পশ্চিম দিকে থাকা এক বাড়ি থেকে কাকা ডাক দেয়। পারুল তার কথায় সাড়া দিলে কাকা বলে,“মা তোকে ডাকছে। এদিকে আয়।”
এই কথা শুনে পারুল কোনকিছু না ভেবে সেই বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে কাকা অবিবাহিত। তার মা ভীষণ বৃদ্ধ। সব কাজ করতে পারে না। সেজন্য মাঝে মাঝে পারুল বা তার মা তাকে নানা কাজে সাহায্য করে। প্রতিবেশী হিসাবে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় পারুলের মা নিজ ইচ্ছায় সাহায্য করে। মায়ের সঙ্গে পারুলও সাহায্য করে। তাই কোন প্রশ্ন ছাড়াই দাদীর কাছে যায় পারুল। ঘরে প্রবেশ করে পারুল বুঝতে পারে দাদী বাড়ি নাই। সে চলে আসতে যাবে তখনই সেই কাকা তার হাত ধরে। পারুল আতকে উঠে। অজানা ভয়ে তার ঘা শিউরে উঠে। পারুলের গায়ে একটি কামিজ ছিলো। মাথায় ওড়না দিয়ে সবসময় পারুল চলাফেরা করতো। কাকা যখন তার মাথার ওড়না ছাড়াতে নেয় তখন পারুল কোনকিছু না ভেবে ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে কান্না করে দেয়। তার চিৎকার শুনে মুখ চেপে ধরে কাকা। পারুল হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। অতঃপর পারুলের চিৎকার হার মেনে কাকা তাকে ছেড়ে দেয়। সুযোগ পেয়ে পারুল ঐ বাড়ি থেকে দৌঁড়ে চলে আসে। সে আসছিলো পিছনে কাকা বলে,“মজা করছিলাম পারুল। আরে পাগল কান্না করিস না। মজা করছিলাম।”
পারুল কোন কথা না ভেবে কান্না করতে করতে চলে আসে। তবে সেই ঘটনার কথা সাহস করে তার পরিবারকে বলতে পারে না। কারণ সে এমন এক পরিবারে জন্ম নিয়েছে, যেখানে সম্মানই বড়। এতটুকু বয়সেই সে শিখেছে, মেয়েদের গায়ে কেউ হাত দিলে তার সম্মান চলে যায়। আশেপাশের মানুষ মেয়েটাকে তার পরিবারকে নিয়ে নানা কটুক্তি করে। এসব নানা কারণে পারুল এই ঘটনার কথা সাহস করে কাউকে বলতে পারে না।
এতক্ষণ ডাক্তার মাইশা জামান(পারুল) তার জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি তার পেসেন্ট নদীকে বলছিলো। পারুলের ঘটনা শুনে প্রথমবারের মতো নদী তার দিকে তাকায়। এটা দেখে পারুল কিছুটা খুশি হয়। অন্তত নদী কিছুটা হলেও রেসপন্স করেছে। পারুল খুব সুন্দরভাবে নদীর উদ্দেশ্য বলে,“শুধুমাত্র সম্মানের জন্য যে আমি আমার পরিবারের কাছে কথাটি বলতে পারিনি বিষয়টি এমন নয়। আমি তখন খুব ছোট, সম্মান সম্পর্ক তত গভীরে ভাবার মতো বয়স আমার ছিলো না। তাই শুধুমাত্র সেজন্য চুপ ছিলাম এটা ভুল। বরং আমি চুপ ছিলাম ভয়ে। আমার বাবা, মায়ের সঙ্গে আমার তেমন সম্পর্ক তৈরি হয়নি যে সাহস করে তাদের এসব বলবো। আমার মনে হয়েছিলো, আমি তাদের এসব বললে তাদের সম্মান নষ্ট হবে যেটার জন্য তারা আমাকে দ্বায়ী করবে। আমাকে বকবে। আমাকে মারবে। সেই ভয়ে চুপ ছিলাম। অথচ তখন কিন্তু আমি জানতামও না, কাকা আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছিলো।”
একটু থেমে পারুল পুনরায় বলে,“আমার এই কথাগুলো বলার কারণ হলো, মেয়েরা এমনই। তারা এভাবে পরিবারের কথা ভেবে , সম্মানের কথা ভেবে , নিজের ভয় থেকে চুপ থাকে। চুপ থেকে একটি অন্যায় মেনে নেয়। অন্যায়কারী চোখের সামনে সুখে দিন কাটাচ্ছে সেটা দেখেও সে চুপ থাকে। এখানেই আমরা নিজেরা নিজেদের কাছেই হেরে যাই।”
অতঃপর পারুল কিছুটা আবেগী হয়েই বলে,“আমার সাথে যে এতবড় অন্যায় করতে যাচ্ছিলো, আমি তাকে আমার ঘরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাসি মুখে খেতে দেখেছি। আমার বাবা, মায়ের সঙ্গে হাসি মুখে গল্প করতে দেখেছি। তুমি জানো, এটা কত যন্ত্রণার? হয়তো জানো না। কিন্তু আমি জানি, আজও সেই লোকটা যখন আমাদের বাড়িতে এসে গল্প করে তখন আমার মনের ভেতর এক চাপা কষ্ট অনুভব হয়। সেদিন যদি আমি কোনভাবে তার শিকার হতাম তাহলে আমার কী হতো? এই কথাটি ভেবে আজও আমি ভয় পাই। তাকে দেখলে তীব্র এক ঘৃণার জন্ম হয়। আমার পরিবার তার সাথে গল্প করছে, এটা আমি মেনে নিতে পারি না। তাই আমি বলবো, তোমার সঙ্গে যাই হোক না কেন তুমি চুপ থেকো না। আমি চুপ থেকে যেভাবে একজন দোষীকে মুক্ত বাতাসে বাঁচার সুযোগ দিয়েছি তেমন ভুল তুমি করো না। এটা অনেক বেশি যন্ত্রণার।”
এতকিছুর পরও নদী চুপ। সে নিজের মুখ দিয়ে একটি শব্দ বের করে না। পারুল হতাশ হয়ে পড়ে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাইশা জামান তার জীবনের তার গ্রামে পারুল নামক পরিচিতি পাওয়া অতি সাধারণ মেয়েটির সাথে ঘটে যাওয়া এতবড় ঘটনার কথা বলেও নদীর মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারলো না। এক্ষেত্রে মাইশা অর্থাৎ পারুল চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে মনেমনে ভাবে,“তবে আমার ভাবনা কি ভুল? নদীর সাথে এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি?”
পারুল যখন মনেমনে এসব ভাবছিলো ঠিক সেই মূহুর্তে নদী প্রশ্ন করে,“আপনি আমাকে আপনার জীবনের এই তিক্ত গল্পটা কেন শোনালেন ডাক্তার ম্যাডাম?”
পারুল এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নদীর চোখের দিকে গভীর নজরে তাকায়। সে নদীর চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে। নদী বুঝতে পেরে বলে,“আমার মা ভাবে আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠে। একা একা মাঝে মাঝে কথা বলি। অল্পতে ভয় পেয়ে যাই। ক্লাসের কারো সাথে মিশি না, একা ঘরে সারাদিন পড়ে থাকি। কারো কোন প্রশ্নের জবাব দেই না। এগুলো সব আমার পাগল হওয়ার লক্ষণ। সেটা ভেবে আমার মা আপনার কাছে নিয়ে আসলো। একজন পাগলের সাথে আপনার ঘটনার কোন মিল রয়েছে?”
নদীর এসব কথা শুনে অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বুঝতে পারে সে যা ভাবছে সেটাই সঠিক। নদীটর ঘাড়ের চিহ্ন, তার নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া, তার ভয়, হঠাৎ চিৎকার করে ওঠা সবই তার নির্যাতনের বহিঃপ্রকাশ। যেটা তাকে মানসিকভাবে ট্রমাটিক করে তুলেছে। পারুল এবার নদীর প্রশ্নের জবাবে সুন্দরভাবে বলে,“আমার গল্পটা তোমাকে এজন্য বললাম কারণ আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই এমন খারাপ সিচুয়েশন রয়েছে। যার নেই তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে বুঝতে পারবে, সে সরাসরি এসবের শিকার নাহলেও কারো নোংরা চোখের নোংরা ভাষার শিকার ঠিকই হয়েছে। তো আমি জানতে চাচ্ছি, তোমার জীবনে এরকম কোন ঘটনা নেই তো?”
নদী এই কথা শুনে আতংকিত চোখে পারুলের দিকে তাকায়। পারুল যথেষ্ট শান্তভাবে জিজ্ঞেস করে,“কেউ তোমার সাথে খারাপ করেছে?”
নদীর চোখের সামনে কিছু ভেসে উঠতে সে ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠে। মূহুর্তের মাঝে নদী উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে ‘না’ ‘না’ বলে চিৎকার করতে থাকে। নদীর স্মৃতিতে আবছা করে সবকিছু ভেসে তখন থেকেই উঠছিলো যখন সে পারুলের জীবনের ঘটনা শুনছিলো। সেই সময় থেকেই সে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলো। যা পারুল স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করে। তবে যখন নদীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয় তখনই তার চোখে আবছা নয় স্পষ্টভাবে তার সাথে ঘটা ঘটনা ভেসে উঠে। তাই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যা চিৎকার হিসাবে বাহিরে বের হয়। নদীর চিৎকার শুনে তার বাবা, মা ভেতরে প্রবেশ করে। নদী তার মাকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকের মাঝে মুখটা লুকিয়ে নেয়। আর বলে,“মা আমি এখানে থাকবো না। আমি পাগল নই। আমাকে ছোট আন্টির বাসায় দিয়ে আসো। আমি পাগল নই।”
পারুল কোন কথা না বলে সে নদীর হাবভাব গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে থাকে। নদীর মা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে বলে,“মা কান্না থামাও। কিছু হয়নি মা। আমি তোমাকে এখানে রাখবো। আমরা এখনই বাসায় যাবো।”
”না।”
বাসায় যাবার কথা শুনে নদী উচ্চশব্দে ‘না’ বলে উঠে। যার অর্থ সে বাসায় যাবে না। সেটা বুঝতে পেরে তার মা বলে,“আচ্ছা আমরা বাসায় যাবো না। আমরা আন্টির বাসায় যাবো।”
এই কথা বলে নদীর মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নানা কথা বলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিছু সময় পর নদী আবারও নিশ্চুপ হয়ে যায়। আগের মতো নির্বাক হয়ে থাকে। নদীর বাবা এসব দেখে বলে,“নদীকে নিয়ে চলো রিমি।”
নদীর মা পারুলের থেকে বিদায় নিয়ে আজকের মতো চলে যাওয়ার অনুমতি চায়। পারুল অনুমতি দিলে তারা চলে যায়। পারুল তারা দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে যাওয়ার আগ অব্দি নদীর দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর মনেমনে বলে,“সঠিক প্রমাণ ছাড়া কাউকে সন্দেহবসত জেরা করা ঠিক হবে না।”
’
’
চলবে,