উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-২+৩

0
1

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০২ ||

০২।
দু’একদিন অরুণিকার ভাবনায় বিচরণ করলো সেই আগন্তুক। এরপর বাস্তবতার চাপে সে তার ভাবনা থেকে জোর করে টেনে বের করলো সেই মানুষটিকে। বিকেলে সে ছাদে বসলো একটা কবিতার বই হাতে নিয়ে। বইয়ের নাম শতাব্দীব্যাপী শাসন। কৌতুহল থেকেই বইটি এ বছর মেলা থেকে কিনেছিল সে। কবিও ছদ্ম পুরুষ। মিষ্টিমশাই নাম তার। কবিতার সারমর্ম বুঝেই অরুণিকার মনে হয়েছে, কবি একজন পুরুষ। শতাব্দীব্যাপী শাসনের প্রথম কবিতাটি ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। কবিতাটির নাম ছিল, নিষিদ্ধ সাক্ষাৎ।

“যৌবন তো এলো সবে, তুমি আমাতে মিলবে আবার কবে?
প্রাণ ফিরিলো সবে, তুমি স্পর্শ করিবে আমায় কবে?
.
প্রেমের সব ফাঁদ,
মিষ্টি রাত,
তোমার আঁখিজলের বিষাদ,
আমারে করিলো ভীষণ আঘাত।
.
তোমাতে আমাতে একদিন হইলো সংসার,
পথে জ্বলিল আগুন, হিয়ায় এলো ফাগুন।
শান্তি-প্রশান্তিতে মোর অস্থিমজ্জাও যেন ডুবিয়াছে,
আগাম অশনী সংকেত শুনিবে কে পাছে?
.
ধরায় মিলিত হইলো শত প্রিয়-প্রেয়সী,
যৌবন-প্রাণ মিলিলো সেথায়
তোমারেও সেদিন দেখিলাম সেই ধরায়,
যেথায় ঘটিলো তোমাতে-আমাতে এক নিষিদ্ধ সাক্ষাৎ।”

কবিতাটি পড়তে পড়তে আনমনেই সেই আগন্তুকের কথা মনে পড়লো অরুণিকার। আর তার ভাবনায় ছেদ ঘটলো তার মামীর আগমনে। তিনি চেঁচিয়ে বললেন,
“সারাদিন বই আর বই। তোমার মামা কি যন্ত্র বিয়ে করে এনেছে না-কি?”

অরুণিকা মামীর চিৎকারে বই বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। মামী অরুণিকার দিকে এক নজর তাকিয়ে কোমড়ে হাত রেখে বললেন,
“তুমি কি সংসারে কিছু এগিয়ে দিতে পারো না? রুহানি ঘুমাচ্ছে, আর আমার মাথা ধরেছে। যাও, নিচে নেমে ফার্মেসি থেকে আমার ওষুধ নিয়ে আসো।”

অরুণিকা মুখ ছোট করে বলল,
“রাস্তা পার হয়েই যেতে হয় ওদিকে।”

মামী কপাল চাপড়ে বললেন,
“মেয়ে বলে কি? এইটুকু রাস্তাও কি তোমাকে পার করিয়ে দিতে হবে? এখন তো কলেজও পাশ করে ফেলেছো। এখন অন্তত একা চলার অভ্যাস করো।”

অরুণিকা চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো। রুহানি আর অরুণিকা সমবয়সী। অরুণিকা এ বছর ইন্টারে খুব ভালো জিপিএ পেয়েছে। এখন সে শহরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছে। কিন্তু রুহানি একাধারে পদার্থবিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, ইংরেজিতে ফেইল করে বসে আছে। অরুণিকার সামনে মেয়ের এমন অবনতি সহ্য করতে পারছেন না অরুণিকার মামী আতকিয়া জাহান। তাই ইদানীং তিনি রুহানির সব রাগ অরুণিকার উপর ঝাড়ছেন। অরুণিকাও নীরবে সহ্য করছে। মামা-মামী আশ্রয় না দিলে পথে থাকা ছাড়া উপায় ছিলো না তার। বাবা-মার মৃত্যুর পর একমাত্র তারাই অরুণিকার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে। রক্তের সম্পর্কগুলো তো সব অচেনা হয়ে গেছে অনেক আগেই।

অরুণিকা রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মুখোমুখি অন্য পারে দাঁড়িয়ে থাকা ফার্মেসির দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে লাগলো,
“ফার্মেসিটা রাস্তার ওপাড়ে কেন? এতোদূরে কেউ ফার্মেসি দেয়? এই এলাকার মানুষগুলো কি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তা পার হয়ে ওষুধ কিনবে না-কি? এপারের মানুষের সাথে ঘোর অন্যায় করেছে ফার্মেসির মালিক।”

একপাশে অরুণিকা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে, অন্যপাশে এক জোড়া চোখ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সামনের রাস্তায় পা বাড়ানোর আগ মুহূর্তেই হঠাৎ একটি কালো গ্লাভস পরা হাত তার দিকে এগিয়ে এলো। অরুণিকা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো সেই হাতের দিকে। পরক্ষণেই পাশ ফিরে তাকালো সে। দেখলো তার পাশে কালো হেলমেট পরা এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। হেলমেটের জন্য তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অরুণিকা ঠিক চিনেছে সেই যুবককে। এই সেই যুবক যে কয়েকদিন আগেই তাকে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েছিলো। অরুণিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আগন্তুকটির দিকে। এদিকে যুবকটি অরুণিকার নড়নচড়ন না দেখে নিজেই শক্ত করে ধরলো তার হাত। অরুণিকা কেঁপে উঠলো সেই মানুষটির স্পর্শে। কিন্তু মানুষটির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সামনের রাস্তায় পা বাড়ালো। অরুণিকা এখনো স্তব্ধ হয়ে আছে। মানুষটির দিকে তাকিয়েই যে সে রাস্তা পার করে ফেলেছে, সেটাই খেয়াল করলো না সে। এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে সে। রাস্তা পার হতেই যুবকটি অরুণিকার হাত ছেড়ে দিলো। অরুণিকা মিনিট খানিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আগন্তুক যুবকটি তার মুখের সামনে হাত নাড়াতেই অরুণিকা দ্রুত পায়ে হেঁটে ফার্মেসিতে ঢুকে গেলো। তাড়াতাড়ি ওষুধ কিনে রাস্তার মোড়ে এসে দেখলো আগন্তুকটি কোথাও নেই। এদিক-ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেই হেলমেট পরা যুবককে কোথাও পেলো না সে। মনে মনে ভাবলো,
“গেলো কোথায় সে!”

হঠাৎ অরুণিকা খেয়াল করলো, রাস্তা পুরোটাই খালি। অনেকক্ষণ ধরেই কোনো গাড়ি এদিকে আসছে না। অরুণিকা রাস্তা পার হয়ে আইল্যান্ডে উঠে দাঁড়াতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। রাস্তার দুই পাশে তিনটি করে মোটরসাইকেল আঁড়াআঁড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা আইল্যান্ড থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো। মোটর সাইকেল ছ’টি সাঁই সাঁই তার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আর সাথে সাথেই রাস্তায় আটকে থাকা গাড়িগুলো আবার যাওয়া-আসা শুরু করলো। আর অরুণিকা স্থির হয়ে মোটর সাইকেল ছ’টির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।

(***)

অরুণিকার মুখ থেকে এমন ঘটনা শুনে লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো রুহানি। অবাক কন্ঠে বলল,
“কি হচ্ছে অরু?”

অরুণিকা ভাবুক কন্ঠে বলল,
“আমিও বুঝতে পারছি না। এমন তো আগে কখনোই হয় নি। কিন্তু ইদানিং এমন কেন হচ্ছে? এই এলাকায় তো আমরা আজ অনেক বছর ধরে আছি।”

রুহানি কিছু একটা ভেবে বলল,
“কিন্তু একটা জিনিস পরিবর্তন হয়েছে।”

“কি?”

“তুই এতো বছর রুদবা আর আমার সাথেই স্কুলে গিয়েছিলি, আমরা না গেলে তুইও স্কুলে যাস নি। এমনকি আম্মু আর আমার সাথেই যে-কোনো কাজে বের হয়েছিলি বাসা থেকে। বাবাও তোকে ওই সময় একা বের হতে বারণ করেছিলো। কলেজে উঠার পর রুদবা ছাড়া বাসা থেকেই বের হতি না। কলেজ ছাড়াও খুব একটা বের হতি না। তোর গন্ডি তো বাড়ির ছাদ থেকে গলির মুখ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু সেদিন প্রথম তুই একা বের হলি। আজও একা গলির বাইরে গেলি। আমার কি মনে হয় জানিস?”

“কি?”

“কেউ একজন তোকে আগে থেকেই ফলো করতো। কিন্তু আমরা কেউ-না-কেউ ছিলাম, তাই তোর সামনে আসার সাহস পায় নি।”

অরুণিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রুহানির দিকে। রুহানি উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
“ও মাই গড, অরু। তোর এতো এতো হিরো! ভাবতেই সিনেমার ভাইভ আসছে।”

অরুণিকা রুহানির হাত চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল,
“রুহু, মামা-মামী জানলে আমাকে পড়তেও দেবে না।”

রুহানি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
“যাহ! কি যে বলিস?”

অরুণিকা ভীত কন্ঠে বললো,
“তুই আবার মামীকে এসব বলিস না কিন্তু।”

“আমাকে কি পাগল মনে হয়? আমি লেডি হিটলারকে উষ্কে দেবো না-কি? এতোটাও হিংসুটে না আমি।”

এরপর রুহানি দু’হাত মেলে বলল,
“যাহ, বোন। যি’লে আপনি জিন্দেগী।”

অরুণিকা জড়িয়ে ধরলো রুহানিকে। বলল,
“তুই না থাকলে আমি তো দমবন্ধ হয়েই ওপারে পাড়ি দিতাম।”

রুহানি অরুণিকার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“আমার বিয়েতে নাচা-নাচি কে করবে, হ্যাঁ? আমারও তো তোর বিয়েতে শাড়ি পরতে হবে। ওয়াও, কখন যে আমাদের বিয়ে হবে। অনেক মজা হবে, না?”

“বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে, বাদ দে এসব বিয়ের স্বপ্ন। এবার পাশ করার জন্য পড়। আজকাল ছেলেরা অনার্স পাশ বউ খুঁজে। ইন্টারে ফেইল শুনলে, উলটো হেঁটে পালাবে।”

“ধুর, মিয়া। খালি পড়ালেখা-টরালেখার কথা। ভাল্লাগে না এসব আজাইরা কথা। রোমান্টিক কথা বল। আচ্ছা, তুই যে একটা কবিতার বই কিনেছিস না? ওইটা পড়ে আমাকে অর্থ বুঝিয়ে দিস তো! আমি এসব কবিতা-টবিতা বুঝি না। এক লাইন পড়ে বুঝলাম, প্রেম-টেম নিয়ে লেখা। আমাকে একটু অর্থ বুঝিয়ে দিস, বোনু। তোকে ক্যান্ডি খাওয়াবো।”

অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বাঁকা চোখে তাকিয়ে রইলো রুহানির দিকে। পরক্ষণেই দুই বোনই হেসে উঠলো শব্দ করে।

০৩।

এক সপ্তাহ গড়াতেই সেই দিনটি চলে এলো, যেই দিনটির জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলো অরুণিকা। রুদবা আর অরুণিকা ভিন্ন সময়ে ভর্তি হওয়ায় তারা আলাদা গ্রুপে পড়েছে। আর দুই গ্রুপের অরিয়েন্টেশন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। দু’জনই ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছে। রুদবা এ গ্রুপে, অন্যদিকে অরুণিকা বি গ্রুপে। দুই গ্রুপের আলাদা এডভাইসর। এ গ্রুপের অরিয়েন্টেশন সকাল দশটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ছিল। বি গ্রুপের অরিয়েন্টেশন শুরু হবে সন্ধ্যা সাতটা থেকে। অরুণিকার মামা শাহবাজ খান রাতের অনুষ্ঠানে কোনোভাবেই অরুণিকাকে যেতে দিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু অরুণিকা এই দিনটির অপেক্ষায় বসে ছিল অনেক দিন। তার শখের ক্যাম্পাসের প্রথম অনুষ্ঠানেও কি সে উপস্থিত থাকবে না? শেষমেশ রুহানি ফোনে বাবাকে রাজি করিয়ে অরুণিকাকে পাঠালো। নিচে নেমে রুহানি অরুণিকাকে রিকশা ঠিক করে দিলো। যদিও রুহানি সাথে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু আতকিয়া জাহান মেয়েকে কোনোভাবেই অরুণিকার সাথে যেতে দেবেন না। উলটো তিনি বললেন,
“ওখানে গেলে পরের পরীক্ষায় আরো দুই সাব্জেক্ট যেগুলোতে টেনে টেনে পাশ করেছিস, সেগুলোতেও ফেইল করবি।”

রুহানি উত্তরে বলল,
“যেগুলো ফেইল করেছি, ওইগুলোই পরীক্ষা দিতে হবে। বাকীগুলো হবে না।”

“বেশি কথা না, রুহু। এতো রাত পর্যন্ত আমি আমার মেয়েকে বাইরে থাকতে দেবো না। বাপ-মা ছাড়া মেয়েদের জন্য এসব কোনো ব্যাপারই না। তোর তো বাপ-মা এখনো বেঁচে আছে।”

মামীর কথায় রুমে বসে অনেক কেঁদেছিলো অরুণিকা। এমনকি শেষ মুহূর্তে না যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু রুহানি জানতো, এই দিনটির জন্য অরুণিকা কতো অপেক্ষা করেছে। তাই সে বাবাকে রাজি করালো।

অরুণিকা মলিন মুখে বলল,
“রুহু, তুই তো মামা-মামীকে রাজি করিয়ে দিয়েছিস৷ এখন রিকশাও ঠিক করে দিচ্ছিস। কিন্তু আসার সময় কীভাবে আসবো?”

রুহানি হেসে বলল,
“বোনু, তুই যা। নিশ্চিন্তে আনন্দ কর, নতুন বন্ধু বানা। তোকে এসব ভাবতে হবে না। আমি তোকে আনার ব্যবস্থা করবো।”

অরুণিকা রুহানির হাত ধরে বলল,
“তুই আমার চেয়ে বেশি আবেগী, অথচ মাঝে মাঝে তোর কথা শুনলে মনে হয়, তুই আমার বড় ভাই।”

রুহানি হাসলো। এরপর অরুণিকাকে রিকশা ঠিক করে দিয়ে পাশের বাসার ফয়েজ আলমের বাসায় গেলো। তিনি এই মাসেই নতুন এসেছেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে রুহানির সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছিলো ফয়েজ আলমের। সালাম বিনিময়ে রুহানি এইটুকু বুঝেছে, ফয়েজ আলম যথেষ্ট ভদ্রলোক এবং বিনয়ী। রুহানি বাসায় গিয়ে জানলো, ফয়েজ সাহেব এই মুহূর্তে বাসায় নেই। তিনি অফিসে গেছেন। তার ছেলে রুহানিকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাই?”

রুহানি বলল,
“আংকেল না থাকলে কি আন্টির সাথে কথা বলতে পারবো?”

ভ্রূ কুঁচকে তাকালো সেই ছেলে। জোর গলায় ডাকলো,
“মা! কই তুমি? দেখো, কোথা থেকে কোন মেয়ে একটা এসেছে।”

রুহানি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ভেতর থেকে তাহেরা বেগম বেরিয়ে এলেন। মৃদু হেসে বললেন,
“কে তুমি মা?”

রুহানি সালাম দিয়ে বলল, “আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি।”

“আচ্ছা? আমরা মাত্র এসেছি তো, তাই দেখাও করতে পারি নি। এখনো সব গোছানো বাকী।”

“সমস্যা নেই আন্টি। আসলে, বিপদে পড়ে এসেছি। যদি একটু সাহায্য করতেন।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ বলো।”

“আমি গ্যারেজে দেখলাম, আংকেলের গাড়ি আছে।”

“হ্যাঁ। কেন?”

রুহানি এবার অরুণিকার ফোবিয়ার কথা, সাথে আজকে তার অরিয়েন্টেশনের কথা জানিয়ে বলল,
“গাড়িটা যদি আমার বোনকে নিয়ে আসতে যেতো! আমরা যাওয়া-আসার ভাড়া দিয়ে দেবো। কিন্তু বিশ্বস্ত কেউ তো লাগবে। ওর অনেক শখ ছিলো ওখানে যাওয়ার। আমি তো বাবা-মাকে রাজী করিয়েছি। কিন্তু ওকে আনতে যাওয়ার কেউ নেই।”

সব শুনে তাহেরা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ইমান, এটা তোর ইউনিভার্সিটি না?”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে মাথা নাড়লো। তাহেরা বেগম বললেন,
“আমার ছেলেও ওখানে পড়ে। সকালেই তো প্রোগ্রাম ছিল।”

ইমান বলল, “সন্ধ্যায় আরেক গ্রুপের অরিয়েন্টেশন।”

রুহানি বলল, “আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে?”

“আমিও সেইম ডিপার্টমেন্টে। থার্ড ইয়ারে। তোমার বোনের নাম কি যেন বললে?”

“অরুণিকা।”

“কি ণিকা?”

রুহানি চোখ ছোট করে বলল, “অরুণিকা। অ রু ণি কা।”

তাহেরা বেগম হেসে বললেন,
“ও তোমার সাথে দুষ্টুমি করছে। তুমি চিন্তা করো না। তোমার আংকেল আসলে আমি বলবো।”

ইমান বলল,
“না, মা। বাবাকে বলতে হবে না। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। আমারও যেতে হবে ক্যাম্পাসে।”

“তুই না চলে এলি!”

“হ্যাঁ, আবার গেলাম না হয়। রাতের প্রোগ্রামটাও দেখে এলাম। আফটার অল, আমি সিনিয়র। আমার ক্যাম্পাসের জুনিয়রকে দেখে রাখা আমারই তো দায়িত্ব।”

রুহানি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইমানের দিকে। ইমান রুহানির দিকে ঝুঁকে বলল,
“ণিকাকে কীভাবে চিনবো?”

রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অরুণিকা।”

“ওহ, ইয়েস অ রু ণি কা।”

তাহেরা বেগম ছেলের পিঠে হালকা চাপড় মেরে ভেতরে যেতে বললেন,
“রুহানি, তুমি বসো মা। আমি তোমার জন্য নাস্তা আনছি।”

“না, না আন্টি। আমি চলে যাবো। মাকে বলে আসি নি। আপনি সব গুছিয়ে না হয় আমাদের বাসায় আসবেন। এখন তো আমাদের ভালোই জমবে।”

ইমান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “জমবে তো ভালোই।”

“আপনার সাথে না। আন্টির সাথে।”

“তোমার বোনকে কীভাবে চিনবো, সেটা তো বলো?”

রুহানি ফোনের ওয়ালে অরুণিকার ছবিটা দেখিয়ে বলল,
“আমার বোন, অরুণিকা।”

ইমান অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুহানি স্ক্রিন বন্ধ করে বলল, “দেখেছেন?”

ইমান অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। রুহানি বলল,
“চিনবেন?”

ইমান বলল, “ভালোভাবেই চিনবো।”

রুহানি তার ফোন নম্বর টাইপ করে ফোনটা ইমানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার নম্বর। অরুকে দেখলেই আমার সাথে কথা বলিয়ে দেবেন।”

ইমান ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তোমার নম্বর দিয়ে আমি কি করবো? তুমি বরং ণিকার নম্বরটিই দাও। আমি নিজেই কল দিয়ে ওকে খুঁজে নেবো।”

রুহানি চোখ ছোট করে বলল, “অরুণিকা।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটা বললেই হলো।”

রুহানি অরুণিকার নম্বর এগিয়ে দিলো। ইমান খুব দ্রুত টাইপ করে সেইভ করে নিলো সেই নম্বর। এরপর আনমনেই হাসলো সে। রুহানি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,
“এই বেডা এতো হাসছে কেন? আমি কি একে অরুর নম্বর দিয়ে ভুল করেছি? অরু শুনলে নির্ঘাত আমার সাথে রাগ করবে। কিন্তু কি করার আছে! এই মুহূর্তে আমার কাছে এটাই ঠিক মনে হয়েছে।”

চলবে–

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০৩ ||

০৪।
কালো টি-শার্ট, সাদা সাটিন প্যান্ট, গলায় সাদা সিল্কের ওড়না, কাঁধে মিষ্টি রঙের ছোট একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে শখের ক্যাম্পাসে ঢুকলো অরুণিকা। মৃদুমন্দ হাওয়ায় তার চুলগুলো উড়ছে। ক্যাম্পাসের সামনের গেটটি ফুল দিয়ে সাজানো। রাতের অরিয়েন্টেশনের জন্য মরিচ বাতি ঝুলানো হয়েছে। ফোন হাতে নিয়ে ক্যাম্পাসের দৃশ্য ধারণ করতে ব্যস্ত অরুণিকা। হঠাৎ কারো গায়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে অরুণিকার হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পড়ে গেলো। তাড়াতাড়ি ফোনটা মাটি থেকে তুলে সামনে থাকা মানুষটিকে কিছু একটা বলার জন্য উঠে দাঁড়াতেই থমকে গেলো সে। চোখ জোড়া স্থির হয়ে গেলো তার। মৃদু গরম হাওয়ায়ও তার শরীর শিরশির করে উঠল। অরুণিকা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “আহনাফ!”

অরুণিকার মুখে নিজের নাম শুনে গম্ভীরমুখে তাকালো আহনাফ চৌধুরী। অরুণিকার গলা শুকিয়ে গেছে। হাত এগিয়ে আহনাফকে স্পর্শ করতে গিয়েও থেমে গেলো আহনাফের প্রতিত্তোরে।

“আমি কি তোমাকে চিনি?”

অরুণিকা মাথা নিচু করে মাথা নাড়লো। আহনাফ বলল,
“আমি যদি তোমাকে না চিনি, তুমি আমাকে কীভাবে চিনলে? আমার নাম ধরে ডেকেছো কেন? তুমি কি জানো আমি কে?”

অরুণিকা আবার মাথা নাড়লো। আহনাফ এবার অরুণিকার দিকে ঝুঁকে এসে বলল,
“আমি তোমার ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। হ্যাভ ইউ আন্ডারস্টুড, মিস অরুণিকা চৌধুরী?”

অরুণিকা চোখ তুলে তাকালো আহনাফের দিকে। টলটলে আঁখি দু’টি দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো আহনাফ। বলল,
“স্যার বলে ডাকবে। আমি যাকে-তাকে আমার নাম ধরে ডাকার অধিকার দেই না।”

অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। এরপর শক্ত কন্ঠে বলল,
“সরি স্যার। নেক্সট টাইম আমি আমার সীমার মধ্যেই থাকবো। আমিও অনেকটা আপনার মতোই। আমিও কাউকে বেশি অধিকার দেই না। কিন্তু জোরপূর্বক অধিকার দেখানোর মানুষ আশেপাশে অনেক আছে। আমরাও উচিত এসব মানুষ থেকে দূরে থাকা। যাকে-তাকে অধিকার দিয়ে নিজেকে নোংরা করতে কে চায়, বলুন?”

কথাটি বলেই অরুণিকা আহনাফকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অন্যদিকে আহনাফ হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে।

কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে আহনাফ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ইভান দাঁড়িয়ে আছে। ইভান অরুণিকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখিস, আহনাফ। অতীতে যা হওয়ার হয়েছে। ক্যাম্পাসে এসব নিয়ে ঝামেলা করিস না। ক্যাম্পাসের রেপুটেশন নষ্ট হবে। এখানে কেউ যাতে না জানে অরুণিকার সাথে তোর কি সম্পর্ক।”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ওর সাথে আমার কি সম্পর্ক, এটা আমি নিজেই মনে রাখি নি। অন্য কেউ জানার প্রশ্নই আসে না।”

(***)

অডিটোরিয়ামে ঢুকে পছন্দনীয় একটা সিটে বসে পড়লো অরুণিকা। আজকের সন্ধ্যাটা তার কাছে স্বপ্নের মতোই লাগছে। তার প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় ডিপার্টমেন্ট আবার একটু আগেই দেখা হয়ে গেলো প্রিয় মানুষটির সাথেও। অরুণিকা পরক্ষণেই নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বলল,
“সে মোটেও আমার প্রিয় মানুষ নয়। সে একজন অপ্রিয় মানুষ। আই হ্যাভ টু হেইট হিম।”

অনুষ্ঠান শেষ হতেই নতুন শিক্ষার্থীদের একটি ব্যাগ, একটি স্কার্ফ, রাতের খাবারের জন্য একটি প্যাকেট দিয়ে চলে গেলো সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। অরুণিকা তার জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই একটা মেয়ে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। অরুণিকা মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,
“কি নাম তোমার?”

অরুণিকা বিনয়ী কন্ঠে বলল, “অরুণিকা।”

মেয়েটি বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে ফিরে বলল,
“দেখলাম, আহনাফ স্যারের সাথে ওখানে দাঁড়িয়ে তুমি অনেকক্ষণ কথা বলছিলে। কি বলছিলে?”

অরুণিকা মৃদু হেসে বলল,
“ওরকম তো কিছু বলি নি। আমি ফ্রেশার কি-না সেটাই জিজ্ঞেস করেছে।”

মেয়েটি অরুণিকাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“আমি জয়িতা। তোমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র। আহনাফ স্যার এই ক্যাম্পাসের লেকচারার প্রায় এক বছর হচ্ছে। উনি এই ক্যাম্পাসেরই স্টুডেন্ট ছিলেন। বিএ, এমএ এখানেই করেছেন। সেই সূত্রে আমারও সিনিয়র ছিলেন। আর ক্যাম্পাসের পুরোনো স্টুডেন্টরা জানে, আহনাফ স্যার নিজ থেকে মেয়ে স্টুডেন্ট বা মেয়ে কলিগদের সাথে কথা বলেন না। তুমি যে নিজে যেচে কথা বলেছো, সেটা আমি বুঝেছি।”

অরুণিকা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “হয়তো আমিই বলেছি।”

“সেটাই তো। স্যার যখন স্টুডেন্ট ছিলেন, তখন আমি ফ্রেশার ছিলাম। আমি ছাড়া আর কারো সাথে তিনি কথা বলেন না। উনি আমাকে এই ডিপার্টমেন্টের ক্লাবের সেক্রেটারি বানিয়েছেন। আর এখনও আমি ছাড়া স্যার আর কারো সাথেই কথা বলেন না। তুমি বুঝতে পেরেছো, আমি কি বোঝাতে চেয়েছি?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “জি আপু।”

জয়িতা মৃদু হেসে বলল,
“তুমি যেহেতু বি গ্রুপে তাহলে তো আহনাফ স্যারই তোমার এডভাইসর। শুনো, যদি কোনো ব্যাপারে স্যারের সাথে কথা বলতে হয়, আমাকে বলবে। আমি স্যারকে জানিয়ে দেবো। আমি বি গ্রুপ, ফোর্থ ইয়ার।”

“আচ্ছা, আপু। ধন্যবাদ।”

তাদের কথার মাঝখানে ইমান এসে অরুণিকার পাশে দাঁড়ালো। জয়িতা ইমানকে দেখে বলল,
“তুই এখানে কেন? তোদের গ্রুপের প্রোগ্রাম তো শেষ।”

“আমি তো ণিকাকে নিতে এসেছি।”

জয়িতা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ণিকা আবার কে?”

ইমান অরুণিকার দিকে ইশারা করে বলল,
“এই তো। আমাদের সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছে।”

জয়িতা অরুণিকার দিকে তাকালো। আর অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এক্সকিউজ মি! আমি তো আপনাকে চিনি না।”

জয়িতা এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইমানের দিকে তাকালো। ইমান রুহানিকে কল দিয়ে অরুণিকাকে ধরিয়ে দিলো। রুহানি সবটা জানাতেই অরুণিকা কল কেটে ইমানকে বলল,
“আচ্ছা, আমি আপনাকে চিনতে পারি নি। রুহানির সাথে এই ব্যাপারে কথা হয় নি আমার।”

ইমান সামনে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন তাহলে যাওয়া যাক।”

“আচ্ছা।”

জয়িতা ইশারায় ইমানকে জিজ্ঞেস করলো, অরুণিকা কে? ইমান মৃদু হেসে বুঝালো, সামনে হবে হয়তো। এরপর ইমান অরুণিকাকে তার মোটরসাইকেল দেখিয়ে বলল,
“উঠে বসো।”

অরুণিকা মোটর সাইকেল দেখে বলল,
“আমার বাইকে বসার অভ্যাস নেই।”

“কেন?”

“ফোবিয়া আছে।”

“আরেহ, তোমার এতো ফোবিয়া কেন?”

অরুণিকা চুপ করে রইলো। ইমান অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“ডোন্ট ওয়ারি, আমি তোমার ফোবিয়া দূর করবো।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের হাতের দিকে। ইমান হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আমি প্লেন চালাতে পারলে প্লেন নিয়ে আসতাম। এখন তো এটাই আছে আমার। রাস্তা একদম ফাঁকা। তুমি চিন্তা করো না। আমি তবুও সাইড করে নিয়ে যাবো তোমাকে। চোখ বন্ধ করে আমাকে ধরে বসবে শুধু।”

অরুণিকা ক্ষীণ হেসে ইমানের মোটর সাইকেলে উঠতে যাবে, তখনই ইভান এসে ইমানের সামনে দাঁড়ালো। ইভানকে দেখে ইমান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“হ্যালো স্যার।”

ইভানকে দেখে অরুণিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইভান অরুণিকার দিকে এক নজর তাকিয়ে ইমানকে বলল,
“তুমি তো সকালে এসেছিলো। এখন এখানে কি?”

ইমান বলল,
“স্যার, ওর বোন আমাকে পাঠিয়েছে। আমরা প্রতিবেশি। একা এতো রাতে বাসায় যাওয়া সেইফ না তাই।”

ইভান বলল,
“ক্যাম্পাসের দুইজন ছেলে-মেয়ে বাইকে করে এতো রাতে ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়া আমাদের ক্যাম্পাসের রেপুটেশনের জন্য সমস্যা। তুমি ওর ভাই হলে, তোমাকে অনুমতি দেওয়া যেতো। কিন্তু তুমি প্রতিবেশি। তোমাকে এই ক্যাম্পাসের সবাই চিনে। আর এই মেয়েও ফ্রেশার। যা করার ক্যাম্পাস গেটের বাইরে করবে। ভেতরে এসব চলবে না। আজ অনেকের বাবা-মা এসেছে। তারা পরিবেশ দেখেই তাদের সন্তানদের এখানে পাঠিয়েছেন। তোমাদের দেখলে তাদের ইমপ্রেশন নষ্ট হবে। সবাই তো আর সবকিছু পজিটিভলি নেন না।”

“সরি স্যার।”

ইভান এবার অরুণিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার গার্ডিয়েন কোথায়?”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আমার গার্ডিয়েন নেই।”

ইভান এবার জয়িতাকে ডাকলো। জয়িতা আসতেই ইভান বলল,
“তুমি বাসায় যাওয়ার পথে এই মেয়েকে নামিয়ে দিও।”

জয়িতা বলল, “ওর বাসা কোথায়?”

ইভান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। অরুণিকা বলল,
“মুহাম্মদপুর।”

জয়িতা বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার বাসা বহদ্দারহাট।”

ইভান এবার ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“নেক্সট টাইম ক্যাম্পাসে বাইক এনে, তার পেছনে কোনো সিনিয়র, জুনিয়রকে বসানোর চিন্তা করবে না। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

ইমান মাথা নেড়ে বলল, “ওকে স্যার।”

এদিকে ক্যাম্পাস থেকে ফিরে ইমান মোটর সাইকেল নিয়ে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেলো, কিন্তু জয়িতা অরুণিকাকে নিয়ে এদিকে আসছে না। দূরে তাদের রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রুহানি একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে ইমানের নম্বরে। ইমান তা দেখে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“অথোরিটির মাথা খারাপ। এতো রাতে প্রোগ্রাম করতে কে বললো তাদের? সবার কি গার্ডিয়েন আশেপাশে থাকে না-কি? এখন ণিকার বোনকে কি বলবো আমি?”

০৫।

জয়িতা আর অরুণিকা যেই রিকশা করে বাসায় ফিরছিলো সেই রিকশাটি ঘিরে ধরেছে কয়েকজন বখাটে যুবক। তাদের হাতে ছুরি। রিকশাওয়ালা ছুরি দেখে মাঝ রাস্তায় জয়িতা আর অরুণিকাকে নামিয়ে রিকশা নিয়ে পালিয়ে গেছে। জয়িতা আর অরুণিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। জয়িতা অনেক সাহস নিয়ে ভীত কন্ঠে বলল,
“দেখুন, আমার কাছে কিছু নেই। আমাকে যেতে দিন।”

অরুণিকা জয়িতার হাত আঁকড়ে ধরে মিনমিনিয়ে বলল, “আপু, এখন কি হবে?”

জয়িতা অরুণিকার দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক অরুণিকার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার বাবা-মা কোথায়?”

এমন মুহূর্তে জয়িতার অদ্ভুত প্রশ্নে অরুণিকা কিছুটা অবাক হলো। সে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার বাবা-মা নেই।”

জয়িতা এবার বখাটে যুবকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাইয়া, আপনারা আমাদের কাছ থেকে যদি টাকা-পয়সা নিতে আসেন, তাহলে আমাদের কাছে কিছু নেই। আমরা স্টুডেন্ট। রিকশা ভাড়া ছাড়া এক্সট্রা কোনো টাকা নিয়েই বের হই নি।”

তাদের মধ্যে একজন মাতাল কন্ঠে বলল,
“ম্যাডাম, এতো লো স্ট্যান্ডার্ড না আমাদের। টাকা না থাকলে আমরা বড় জায়গায় হাত দেই। এখন দুইটা বড় বড় জায়গা থাকতে অন্য জায়গায় হাত দেওয়ার কি দরকার! চলেন, আমাদের সাথে চলেন।”

জয়িতা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আমার বাবা-মা জানলে তোমাদের অনেক ক্ষতি হবে।”

এরপর অরুণিকাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“ওর বাবা-মা নেই। ও এতো রাতে বাসায় না ফিরলেও তোমাদের ক্ষতি করার কেউ নেই। তোমরা যা করার ওর সাথে করো। দেখো, ও আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী। বয়সও কম।”

অরুণিকা চোখ বড় বড় করে জয়িতার দিকে তাকালো। জয়িতার হাত চেপে ধরে বলল,
“আপু, কি বলছো এসব?”

জয়িতা অরুণিকার হাত সরিয়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। বখাটে যুবকগুলো এবার অরুণিকাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। অরুণিকা জয়িতার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কান্না করছে। সবকিছু অন্ধকার লাগছে তার। এদিকে জয়িতা সুযোগ বুঝে সামনে পালিয়ে গেলো। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে পেছনে তাকাচ্ছে। সে খেয়াল করলো বখাটে যুবকগুলো তার পিছু করছে না। তারা অরুণিকাকে বিরক্ত করতেই ব্যস্ত। সে এবার নিশ্চিন্ত মনে ধীরে ধীরে হেঁটে সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলো। যদিও তার মনটা খচখচ করছিল, কিন্তু নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে এই কাজটাই ঠিক মনে করলো।

এদিকে বখাটে যুবকগুলোর একজন অরুণিকার গলা থেকে উড়না নিয়ে কোমড়ে বেঁধে বিশ্রীভাবে অরুণিকার শরীরে চোখ বোলাতে লাগলো। আরেকজন অরুণিকার ঢিলেঢালা টি-শার্টটি পেছনের দিকে টেনে ধরায় শরীরের সামনের ভাঁজগুলো দৃশ্যমান হলো। অরুণিকা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা মাটিতে বসে নিজেকে মুক্ত করার জন্য তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলো। কিন্তু তাদের দয়া হলো না। একজন তার চুল মুঠো করে ধরে তাকে টেনে উঠালো মাটি থেকে। এরপর রুমাল ঢুকিয়ে দিলো অরুণিকার মুখে। অরুণিকা রুমাল নিয়ে ফেলতে যাবে তখনই আরেকজন যুবক তার দুই হাত শক্ত করে পেছনের দিকে টেনে ধরলো। হাতটা যেন ভেঙেই যাবে আজ। ব্যথায় শুধু দরদর করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। মিনিট খানিক পর হাত দু’টি ছেড়ে দিয়ে চুল ধরেই তাকে পাশের গলির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো আরেকজন। রাস্তার উপর একটা চায়ের দোকানই খোলা ছিল। বাকী পুরো রাস্তা ফাঁকা। দোকানদার নীরবে দেখছেন এসব। সামনে এগিয়ে গেলেই তার গলায় ছুরি চালিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না এই বখাটে যুবকগুলো। কারণ এই এলাকার বড়সড় সন্ত্রাস তাদের ভাই। সেই সন্ত্রাসের ক্ষমতার দাপটে তারা রাত বাড়লেই রাস্তায় বেরিয়ে ছিনতাই করে, এমনকি একা মেয়ে পেলেই তাদের উঠিয়ে নিয়ে যায় নিজেদের বস্তিতে। সেখানে গিয়েই মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ করলেও পার পেয়ে যায় এরা। কয়েক মাস পর কীভাবে যেন জেল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। দোকানদার তাই চুপচাপ এসব দেখছেন। প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসছেন না। কারণ তিনি একা কখনো এদের ঠেকাতে পারবেন না। এদিকে অরুণিকা ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। তবুও সে নিরুপায় হয়ে সামনে এগুচ্ছে। গলির ভেতরে ঢুকেই আরেকটা সরু গলি চোখে পড়লো। অরুণিকা শরীরের সব শক্তি দিয়ে যুবকগুলোকে সরাতে চাইলে তাদের মধ্যে একজন অরুণিকার স্পর্শ কাতর জায়গায় জোরে ঘুষি মারলো। অরুণিকা নিজের বুকে হাত রেখে মাটিতে বসে পড়লো। মাথা ভন ভন করছে তার। তার শরীরে কোনো শক্তিই আর অবশিষ্ট নেই। বখাটেদের একজন অরুণিকার সামনে বসে তার গালে, ঠোঁটে, গলায় হাত বুলাতে লাগলো। কিন্তু যখনই সে অরুণিকার বুকের উপর হাত রাখতে যাবে, তখনই একটা শক্ত লোহার গরাদ তার পিঠে উপর এসে পড়লো। ছেলেটি সাথে সাথেই অরুণিকার বুকের উপর ঢলে পড়লো। অরুণিকা সামনে তাকিয়ে দেখলো কালো হেলমেট পরা এক যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা কিছু বুঝে উঠার আগেই তার বুকের উপর লুটিয়ে পড়া সেই বখাটে ছেলেটিকে টেনে সরিয়ে তার পিঠে সমানে লোহার রড দিয়ে আঘাত করতে লাগলো হেলমেট পরা যুবকটি। অরুণিকা মাথা তুলে দেখলো, ছ’জন হেলমেট পরা যুবক একে একে শায়েস্তা করছে বখাটে যুবকগুলোকে। অরুণিকা নিজেকে টেনে উঠালো। কিন্তু শরীর অবশ হয়ে আসায় শরীরে ভার ছেড়ে দিলো সে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তেই একটি হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। অরুণিকা নিভু নিভু দৃষ্টিতে শুধু দেখলো কালো হেলমেট পরা একজন যুবক তাকে ধরে রেখেছে। তার চেহারা দেখলো না। কিন্তু ঠিকই তার নাকে এসে ঠেকলো এক পরিচিত ঘ্রাণ। অরুণিকা হুট করেই জড়িয়ে ধরলো মানুষটিকে। সেই মানুষটির শরীরের ঘ্রাণ আরো গভীরভাবে অনুভব করতে চাইলো অরুণিকা। কিন্তু মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো ক্ষণ সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিলো তাকে। শরীরের ভার ছেড়ে দিলো অরুণিকা। ভার ছেড়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তেই সে অস্ফুটস্বরে ডাকলো, “আহনাফ!”

চলবে–