উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৪+৫

0
1

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০৪ ||

০৬।
নিভু নিভু চোখ জোড়া মেলে মুখের সামনে আতকিয়া জাহান এবং রুহানিকে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো অরুণিকা। অরুণিকাকে উঠে বসতে দেখেই আতকিয়া জাহান বিরক্ত মুখে বললেন,
“তোমার মামার হাতে আমার খুন করাবে না-কি?”

অরুণিকা মলিন মুখে বসে আছে। আতকিয়া চেঁচিয়ে বললেন,
“চুপ করে আছো কেন?”

অরুণিকা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মামীর দিকে। তিনি বললেন,
“মান-সম্মান সব তো চলে গেছে এখন! কাল রাতে ওরা কারা ছিল?”

অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মামীর দিকে। রুহানি মাকে থামিয়ে বলল,
“আম্মু, বন্ধ করো তো তোমার খ্যাচখ্যাচ। অরুর কি হুঁশ ছিল না-কি? ওরা তো বললোই ও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সব তোমার দোষেই। তুমি ওকে টর্চার করো, তাই ও প্রেশার নিতে না পেরে যেখানে-সেখানে জ্ঞান হারাচ্ছে।”

আতকিয়া কিছু বলতে যাবেন, তখনই অরুণিকা রুহানিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আমি বাসায় কীভাবে এসেছি?”

আতকিয়া জাহান বললেন,
“বলে কি মেয়ে? একটা ছেলে তোমাকে কোলে তুলে বাইকে করে এখানে এনে দিলো, এমনকি তোমাকে এই রুমে এনেই শুইয়ে দিয়ে গেলো, আর তুমি বলছো আমি বাসায় কীভাবে এসেছি?”

রুহানি জিজ্ঞেস করলো, “অরু, তুই চিনিস ওদের?”

অরুণিকা চুপ করে রইলো। তার নীরব ভাব দেখে আতকিয়া জাহান বিড়বিড় করতে করতেই চলে গেলেন। এবার অরুণিকা বিছানা ছেড়ে উঠে তার রুমের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। বাইরে থেকে হঠাৎ অদ্ভুত সাইরেন ভেসে এলো। অরুণিকা চোখ বন্ধ করে রুহানিকে বলল,
“রুহু, তুই শব্দটা শুনতে পারছিস?”

রুহানি অরুণিকার পাশে এসে বলল, “কেমন শব্দ?”

“ওই যে শোনা যাচ্ছে।”

“ধুর, কি যা-তা বলছিস। গাড়ির হর্ণ ওটা।”

অরুণিকা মাথা নাড়লো। তার মনে খেলা করছিলো বিষ্ময়কর অনুভূতি। কাল রাতে সেই হেলমেট পরা মানুষটির চেহারা তো দেখা যায় নি। কিন্তু তার পারফিউম আর গায়ের ঘ্রাণ এখনো অরুণিকার শরীরে মিশে আছে।

“অরু!”

রুহানির ডাকে অরুণিকা বাস্তবে ফিরে এলো।

“কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। ঠিক আছি।”

“আচ্ছা, আগে বল, তুই কি চিনিস তাকে, যে তোকে কাল রাতে বাসায় নিয়ে এসেছিল?”

অরুণিকার হৃদস্পন্দন তীব্র হলো। মনে মনে ভাবতে লাগল,
“আহনাফ ছিল? কিন্তু কীভাবে সম্ভব? সে তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু সেই ঘ্রাণ!”

রুহানি কপালে চাপড় মেরে বলল,
“কিছু কি বলবি? না-কি সাইলেন্ট মুডেই থাকবি?”

“আমি চিনি না।”

রুহানি একটু অবাক হলো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই চিনিস না, অথচ ছেলেটা বাসা চিনলো! অদ্ভুত তো?”

অরুণিকা চুপ করে রইল। তাহলে কি হেলমেট পরা ছেলেটি সত্যিই আহনাফ। পরক্ষণেই ভাবলো,
“আহনাফ হলেও কি তার এই ঠিকানা জানার কথা?”

রুহানি জিজ্ঞেস করলো,
“তোর কি একটু সিনেম্যাটিক লাগছে না এসব?”

এরপর কিছু একটা ভেবে রুহানি লাফিয়ে বলে উঠলো,
“আমার তো ভাবতেই ইন্টারেস্টিং লাগছে। তুই রাস্তায় জ্ঞান হারিয়েছিস, আর তোকে হিরো কোলে তুলে নিয়ে এসেছে। ওয়াও।”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমি জ্ঞান হারাই নি। মাথাটা কাজ করছিলো না আর।”

রুহানি গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

অরুণিকা রুহানিকে রাতের ঘটনাটি বলতেই রুহানি রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“ওই অজগরণীর এতো সাহস? আমার সামনে এলে তো ওই চান্দুর সবগুলো তেজ ফুটো করে বের করে দিতাম। তোকে শয়তানগুলোর হাতে তুলে দিয়ে কীভাবে পালিয়ে গেলো মেয়েটা?”

অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওর কথা অবশ্য ঠিক। আমার বাবা-মা নেই। আমার কিছু হলে আমার জন্য লড়াই করতো কে? আল্লাহর ভরসায় তো ওরা আমাকে রেখে চলে গেছে। আল্লাহ সাহায্য করেছে তাই আজ ঠিকঠাক আছি। নয়তো এই পৃথিবীতে আমাকে নিয়ে ভাবার কে আছে?”

রুহানি অরুণিকার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমি আছি। আমার বোনুকে আমি প্রটেক্ট করবো।”

কলিংবেল বেজে উঠতেই অরুণিকা আর রুহানির কথোপকথনে বাঁধা পড়লো। রুহানি রুম থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে?”

বাইরে থেকে ইমানের কন্ঠ শুনে দরজা খুলে দিলো রুহানি। ইমান রুহানিকে দেখে ক্ষীণ হেসে বলল,
“ণিকা এখন কেমন আছে?”

অরুণিকা রুম থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে আসতেই ইমান বলল,
“হাই, ণিকা!”

অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “অরুণিকা।”

ইমান বলল, “সরি, তোমাকে কাল নিয়ে আসা উচিত ছিল। স্যারের কথা শোনা উচিত হয় নি আমার।”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “ইটস ওকে। আল্লাহ আমাকে বাঁচানোর জন্য কাউকে না কাউকে তো পাঠাতেনই। আপনি পারেন নি। তাই অন্য কাউকে পাঠিয়েছেন।”

এবার রুহানি ইমানকে জিজ্ঞেস করলো,
“ওই ছেলেটাকে আপনি চেনেন?”

ইমান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“চেনা চেনা তো লেগেছিল। হেলমেট পরা তাই সঠিক ভাবে চিনতে পারছিলাম না। হয়তো এই এলাকায় থাকে।”

অরুণিকা রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি ভাবুক কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, সেটাই হবে। নয়তো আমরাও ভাবছি, অরুকে বাসায় এনে দিয়েছে, কিন্তু বাসার ঠিকানা কীভাবে জানলো!”

ইমান মাথা নাড়লো। বলল,
“আমিও গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জয়িতা আপুকে একা রিকশা নিয়ে চলে যেতে দেখলাম। আমি এতো ডাকলাম, কোনো রেসপন্স করলো না।”

রুহানি কোমড়ে হাত গুঁজে বলল,
“সেই নাগিনটাই তো আমার বোনকে ওদের সামনে ফেলে পালিয়ে এসেছিল।”

“মানে?”

অরুণিকা রুহানিকে থামাতেও চাইলেও পারে নি। রুহানি গরগর করে সবটা ইমানকে বলে দিলো। সব শুনে ইমানের হাত মুঠো হয়ে এলো। কিছু একটা ভেবে সে চলে গেলো।

(***)

গাঢ় নীল রঙের গাউন পরে ছাদে উঠেছে অরুণিকা। হাতে শতাব্দীব্যাপী শাসন বইটি। রৌদ্রস্নান করছে তার ঘন কেশগুচ্ছ। ঠোঁটে মৃদু কম্পন আর চোখ স্থির হয়ে আছে মিষ্টিমশাইয়ের লেখা অনিকেত হৃদয়ে। অরুণিকা পড়ছে আর মৃদু হাসছে।

“শূণ্য চিত্তের আর্তনাদ,
আর এক ছলনাময়ীর প্রস্থান ছায়া।
ধরাতলে সুরহীন সেই নথ, গুঞ্জনহীন নুপূরের আঘাত,
পুষ্পমালার আগলে রাখা মায়া।

দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর,
সেই সুরে খুঁজে পাওয়া প্রেয়সীর বিরক্ত মুখ।
বিষাদ বায়ু কাঁপন তুলেছে হিয়ায়,
আমি বারেবারে তাকেই বাঁধছি মায়ায়।

অনিকেত হৃদয়ে ফাঁকা কক্ষে আমি একা,
এই বিষাদেও মন জুড়ে শুধু তোমার সুখের কথা।”

অরুণিকাকে হাসতে দেখে রুহানি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“হাসছিস কি পড়ে?”

অরুণিকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অনিকেত হৃদয়ের আর্তনাদ শুনে হাসছি। প্রেমিকেরা তাদের প্রেয়সীর বিচ্ছেদে অনেক কষ্ট পায়৷ অথচ প্রকাশ করে না। শুধু মুখ ফুটে বেরিয়ে আসা তার প্রেয়সীর সুখ।”

রুহানি অরুণিকার হাত ধরে বলল, “প্রেমে পড়েছিস না-কি?”

অরুণিকা চমকে রুহানির দিকে তাকালো। মুহূর্তেই তার প্রসারিত ঠোঁট দু’টি মিলিয়ে গেলো। রুহানি হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে, অরু?”

অরুণিকা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“প্রেমের নাম কলঙ্ক। যাকে ছুঁয়ে দেয় সে কলঙ্কিত। কিন্তু যে ছুঁয়ে দেয় সে শিশির কণা।”

“শিশির কীভাবে?”

“নতুন সূর্যের আলোয় শিশির ঝরে যায়। এরপর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। কিন্তু কলঙ্ক কখনো ঝরে যায় না। আজীবন হৃদয়ে গেঁথে থাকে। শরীরেও সেই দাগ রয়ে যায়।”

অরুণিকার চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। রুহানি অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই কি এখনো সেই রাতের কথা মনে রেখে দিয়েছিস?”

অরুণিকা রুহানিকে ছেড়ে দিলো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কোন রাত?”

“সেই শীতের রাত? তুই কি ভালোবাসিস সেই মানুষটাকে?”

অরুণিকার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। দ্রুত চোখ মুছে বলল,
“না, একদম না। একদমই না, রুহু। বাবা-মার সাথে সাথে ওই বাড়ির সবাই আমার জন্য মরে গেছে। আমি ঘৃণা করি তাদের।”

অরুণিকা দ্রুত নেমে পড়লো ছাদ থেকে। রুহানি ছাদের রেলিঙের পাশে এসে দাঁড়াতেই খেয়াল করলো, পাশের ছাদ থেকে একটা চশমা পরা যুবক এক দৃষ্টিতে তাদের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহানি যুবকটির দিকে তাকাতেই সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রুহানির খুব চেনা চেনা লাগছিল সেই চেহারা। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। একটু পর যুবকটিও ছাদ থেকে নেমে পড়লো। রুহানি এটা নিয়ে বেশি কিছু ভাবলো না। সেও বাসায় চলে এলো।

০৭।

ভার্সিটির প্রথম ক্লাস আজ। অরুণিকা রুদবার সাথে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। গলির মুখে আসতেই ইমান মোটর সাইকেল থামালো তাদের সামনে। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ণিকা, চলো তোমাকে নামিয়ে দেই।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “নো থ্যাংক্স।”

“কেন?”

রুদবা বিরক্ত মুখে বলল,
“কেন, দেখছেন না যেতে চাচ্ছে না? জোর করছেন কেন? কে আপনি?”

ইমান মৃদু হেসে বলল,
“ণিকা, আপনার বান্ধবীর তো নাকের ডগায় রাগ। আপনি বলেন নি, আমি আপনাদের সিনিয়র?”

রুদবা অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা চাপা স্বরে বলল,
“তোকে যার কথা বলেছি, উনি।”

ইমান অরুণিকার চাপা কথাটিও শুনে ফেললো। হেসে বলল,
“আচ্ছা, আমার বিষয়ে তাহলে কথাও হয়েছে?”

অরুণিকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। রুদবা বলল,
“জি না, ভাইয়া। অরু জাস্ট এইটুকু বলেছে কতোটা ব্রেইনলেস হলে ভার্সিটির জুনিয়রকে বাইকে করে নিতে যায়! আপনার ইনটেনশন ঠিক থাকলে, আপনার বাবার গাড়িটাই অরুকে আনতে যেতে পারতো। রুহানি তো সেই গাড়িটাই চেয়েছিল। আর আপনি হিরোইজম দেখাতে গিয়ে স্বয়ং চলে গেছেন। গ্রেট!”

অরুণিকা রুদবাকে চুপ করিয়ে দিয়ে সামনে থাকা একটা রিকশা ঠিক করে উঠে পড়লো। রুদবাও মুখ বাঁকিয়ে উঠে পড়লো সেই রিকশায়। রিকশা তাদের নিয়ে চলে যাওয়ার পর ইমান মৃদু হেসে বুকে হাত রেখে মিনমিনিয়ে বলল,
“নো থ্যাংক্স, আহা! কিলিং ভয়েস।”

(***)

ক্যাম্পাসে ঢুকতেই রুদবা আর অরুণিকার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো রহস্য ব্যান্ডের প্রধান গায়ক তূর্য শেখ। রুদবা তূর্যকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো। অরুণিকা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য অরুণিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর পাশ কাটিয়ে চলে যাবে তখনই রুদবা চেঁচিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আপনি কি সেই রহস্য ব্যান্ডের মেইন ভোকালিস্ট না?”

তূর্য চোখ ছোট করে তাকালো। রুদবা কিছু বলতে যাবে তখনই জয়িতা তাদের সামনে এসে বলল,
“হ্যাঁ, উনি আমাদের ভিআইপি স্যার। এ বছরই আমাদের ইউনিভার্সিটির মিউজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের লেকচারার মিস্টার ইভান রহমান এবং মিস্টার আহনাফ চৌধুরীর চাইল্ডহুড বেস্টফ্রেন্ড। এজন্যই তো স্যারকে মিউজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের জন্য এপ্রোচ করে পাওয়া গেছে। নয়তো এমন পরিচিত মুখের সাথে সাক্ষাৎ করতে মানুষের বছর লেগে যায়!”

তূর্য জয়িতার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। জয়িতা তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সরি স্যার, আপনাকে এভাবে মাঝপথে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো?”

তূর্য বাঁকা হেসে রুদবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি কি আমার গান শুনেছেন?”

রুদবা এক গাল হেসে বলল,
“হ্যাঁ, আগে শুনতাম না। অরুই আমার অভ্যাস বাঁধিয়ে দিয়েছে।”

তূর্য এবার অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রুদবা বলল,
“আমি শুধু আপনাদের ব্যান্ডের গানই শুনি। আপনাদের স্টাইলটা অনেক ইউনিক। আপনি ছাড়া সবার মুখে মাস্ক। এজন্যই কি ব্যান্ডের নাম রহস্য রেখেছেন?”

তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“জীবন রহস্যে ঘেরা। মানুষের মনেও রহস্য। আমাদের গান যেহেতু জীবনকে কেন্দ্র করে, জীবনের প্রতিটি অংশকে কেন্দ্র করে, তাই নামটাও তারই প্রতিফলন।”

জয়িতা বিরক্ত মুখে রুদবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তূর্য এবার জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আমার ভক্তদের জন্য যেকোনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেতে পারি, আর স্পেশাল ভক্তদের জন্য যেকোনো কিছু করতে পারি।”

অরুণিকা এবার তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে চলে গেলো। অরুণিকা মুহূর্তেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। হঠাৎ কেউ একজন জোরে এসে অরুণিকার পিঠে ধাক্কা খেতেই সে টাল সামলাতে না পেরে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। জয়িতা দ্রুত সরে দাঁড়ালো। রুদবা অরুণিকাকে ধরতে যাবে তার আগেই একটি পিঠ অরুণিকার সামনে চলে এলো। অরুণিকা নিজেকে বাঁচানোর জন্য শক্ত করে সামনের মানুষটির বাহু আঁকড়ে ধরলো। সেকেন্ড খানিক পর অরুণিকা নিজেকে সামলে স্বাভাবিক করে মাথা তুলে মানুষটির দিকে তাকালো। মানুষটি তার মুখোমুখি হতেই অরুণিকার চোখ জোড়া স্থির হয়ে গেলো। জয়িতা অরুণিকাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা কেমন অভদ্রতা? তুমি স্যারের গায়ে এসে পড়ছো!”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০৫ ||

অরুণিকা অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফের চোখ-মুখ শক্ত। জয়িতা পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে যা-তা শোনাচ্ছে অরুণিকাকে। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে জয়িতার দিকে। তখনই ইমান এসে জয়িতাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“না জেনে যা ইচ্ছে তাই বলছেন আপনি। ওই মেয়েটা ণিকাকে ধাক্কা দেওয়ায় সে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আর স্যার ওর সামনে চলে আসায় স্যারের সাথে ধাক্কা খেয়েছে।”

ইমানের কথায় সবাই এবার তার দিকে তাকালো। জয়িতা কিছু বলতে যাবে, তখনই ইমান বলল,
“আর আপনি সেই দিন রাতে ণিকাকে ফেলে যেভাবে পালিয়ে গেছেন, ওটার জন্য কি আপনাকে একটু কথা শোনানো উচিত না?”

আহনাফ এবার ভ্রূ কুঁচকে জয়িতার দিকে তাকালো। ইমান এবার আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“স্যার, আমি ণিকার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। অরিয়েন্টেশনের রাতে ইভান স্যার আমাকে বাইকে করে জুনিয়রদের বাসায় ড্রপ করতে নিষেধ করেছিলেন। স্যার নিজেই ণিকাকে জয়িতা আপুর সাথে যেতে বলেছেন। এরপর মাঝ রাস্তায় কিছু বখাটে ছেলে তাদের রিকশা আটকে ফেলায় জয়িতা আপু ণিকাকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। স্যার, আপনার কি মনে হয় এতো রাতে অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম রাখা সবার জন্য সেইফ ছিল?”

জয়িতা আমতা আমতা করে বলল,
“আমি ওকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ও-ই তো দৌঁড়ে পালাতে পারে নি।”

রুদবা বলল,
“জি না। আপনি বলেছিলেন ওর বাবা-মা নেই, তাই ওর ক্ষতি করলে বখাটেগুলোর কিছু হবে না। আর আপনার বাবা-মা জানলে বখাটেগুলোর উপর মামলা হতে পারে।”

জয়িতা ভীত চোখে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ এখনো ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে জয়িতার দিকে। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“স্যার, আই এম সরি। আমি আপনাকে খেয়াল করি নি। আর জয়িতা আপু উনার জায়গায় ঠিকই আছেন। নিজেকে বাঁচানো আমার কাছে অন্যায় কিছু মনে হচ্ছে না।”

কথাটি বলেই অরুণিকা রুদবার হাত ধরে ক্লাসে চলে গেলো। এদিকে জয়িতা কাঁচুমাঁচু মুখে আহনাফকে বলল,
“স্যার, আমি কি যাবো?”

আহনাফ শক্ত গলায় বলল,
“তোমাকে কি আমি দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি?”

জয়িতা আহনাফের কথা শুনে তার সামনে থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে গেলো।

(***)

আলাদা গ্রুপ হওয়ায় অরুণিকা আর রুদবার ক্লাসরুম ভিন্ন। তাই ক্লাসে এসেই অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে অরুণিকা। একটু পর ক্লাসে ঢুকলো বি গ্রুপের এডভাইসর এবং লেকচারার আহনাফ চৌধুরী। সবাইকে দাঁড়াতে দেখে অরুণিকাও উঠে দাঁড়ালো। আহনাফকে দেখে মিনিট খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। সবাই বসে যাওয়ার পরও দাঁড়িয়ে ছিল অরুণিকা। আহনাফ তার হাতে থাকা ডায়েরিটা টেবিলের উপর রেখে অরুণিকার দিকে এক নজর তাকিয়ে হোয়াইট বোর্ডের দিকে ফিরলো। বোর্ডে বড় বড় করে ইংরেজিতে লিখলো,
“স্পিকিং ক্লাস।”

মার্কার টেবিলে রেখে সামনে তাকিয়ে অরুণিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে সামনে এসে বলল,
“ওয়াশরুমে যেতে পারি, স্যার?”

আহনাফ চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল, “গৌ।”

অরুণিকা ক্লাস থেকে বেরিয়েই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মনে মনে বলল,
“যেই অতীতটা আমি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চাইছি, সেটি আমার পিছুই ছাড়ছে না!”

প্রায় বিশ মিনিট পুরো ডিপার্টমেন্ট ঘুরে অরুণিকা ক্লাস রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ অরুণিকার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এতোক্ষণ লাগে ক্লাসে আসতে? ওয়াশরুমে গিয়েছিলে না-কি বাসায় গিয়ে আবার ক্যাম্পাসে এসেছো?”

অরুণিকা মাথা নিচু করে বলল, “সরি স্যার!”

আহনাফ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
“এখন বাকী পঁচিশ মিনিট বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো।”

এরপর বাকী ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলল,
“যাদের আমার ক্লাস ভালো লাগবে না, তারা বিশ মিনিট পর কেন একদম পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ক্লাসে ঢুকবে। নয়তো এভাবেই ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”

আহনাফ আবার ক্লাস নেওয়া শুরু করলো। প্রথম দিনই স্পিকিং ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের দশজন করে পাঁচটি গ্রুপে ভাগ করে দিলো। মোট ৫২জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে অরুণিকা আর বাকী একজন, যে আজ আসে নি তারাই শুধু গ্রুপে ঢুকতে পারলো না। ক্লাস শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে অরুণিকাকে ইশারায় ক্লাসে ঢুকতে বললো আহনাফ। অরুণিকা মলিন মুখে ক্লাসে ঢুকে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। আহনাফ অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই মেয়ে, তুমি আর আরেকজন যে আজ আসে নি, তোমরা দু’জন ষষ্ঠ গ্রুপে থাকবে। এই পুরো সেমিস্টার জুড়ে তোমাদের দু’জনকেই একসাথে সব প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। এমনকি বাকীদের সাথে ডিবেইট কম্পিটিশনও তোমরা দু’জনই করবে। এন্ড স্পিকিং টেস্টও তোমাদের আলাদা হবে। যেই কাজ এখন দশজন একসাথে করছে, সেই কাজ তোমরা দু’জন মিলে করবে, আর এটাই তোমাদের শাস্তি।”

কথাগুলো বলে আহনাফ ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লো। অরুণিকা এখনো চুপচাপ নিজের সিটে বসে আছে। তার হাতে কোর্স সিলেবাস, রুটিন আর লেকচারারদের নামের তালিকা। ছ’টা কোর্স এই সেমিস্টারে। আর প্রথম কোর্সটা আহনাফ নিবে। ‘ফোর স্কিল’ কোর্সে শিক্ষকদের উপর অনেকটাই নির্ভর কর‍তে হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। আর আহনাফ কতোটা কঠোর শিক্ষক তা প্রথম দিনেই ক্লাসের সব শিক্ষার্থীরা বুঝে ফেলেছে। পরবর্তী চারটা ক্লাসের স্যার-ম্যাডামদের শান্ত কথাবার্তায় তারা প্রথম ক্লাসের ভীতিটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও, অরুণিকা একদমই পারে নি। নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার। কেন শুধু শুধু এই ক্যাম্পাসেই আসলো সে? এমন তো না যে সে জানে না, আহনাফ এই ক্যাম্পাসে পড়তো। সে জেনেশুনেই ভর্তি হয়েছে। কিন্তু আহনাফ যে একদম ডিপার্টমেন্টের লেকচারার হয়ে যাবে, এটা ভাবে নি অরুণিকা। ভেবেছিল, এতোদিনে পড়ালেখা শেষ করে দেশের বাইরে চলে গেছে।

অরুণিকা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“খুব তো বলেছিল, এই দেশেই থাকবে না। তাহলে এখনো ভিটে কামড়ে পড়ে আছে কেন? কতোগুলো মানুষের বদদোয়া নিচ্ছে লোকটা! আজ সবাই কতোটাই না ভয় পেয়েছে তাকে। বাকী স্যাররা কতো সুইট! আর আহনাফ চৌধুরী তো একটা যম।”

(***)

কেন্টিনের সামনে বসে আছে অরুণিকা। হুট করে ইমান এসে তার পাশে বসলো। অরুণিকা ইমানকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি?”

“হ্যাঁ, আমি। কি অবস্থা? প্রথম ক্লাস কেমন গেলো?”

অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বললো,
“বাকীগুলো ঠিক ছিল, কিন্তু প্রথম ক্লাসটা ভালো যায় নি।”

“কেন?”

“আহনাফ স্যারের ক্লাস ছিল। আমি একটু বাইরে বেরিয়েছি, ওমনি আর ক্লাসে ঢুকতে দিলো না।”

ইমান হেসে বলল, “স্যার হিসেবে উনি খুব ডেঞ্জারাস।”

“আপনাদের ক্লাস পায়?”

“হ্যাঁ, সেকেন্ড ইয়ারের লাস্ট সেমিস্টারে ক্লাস পেয়েছিলাম। উনি ওই বছরই লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছিল। কিন্তু উনার চেয়ে ভয়ংকর ইভান স্যার। উনিও গত বছর জয়েন করেছিল।”

অরুণিকা মলিন মুখে বলল,
“এই সেমিস্টারটা যাক! পরের সেমিস্টারে না পড়লেই হলো।”

ইমান শব্দ করে হাসলো। বলল,
“স্যার কি বকেছে না-কি?”

“ওভাবে বকে নি। কিন্তু ক্লাসের প্রথম দিন, তাই একটু লজ্জা পেয়েছি।”

ইমান অরুণিকার চোখের দিকে তাকালো। তখনই জয়িতা এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আহনাফ স্যার তোমাদের দু’জনকে তার রুমে ডেকেছেন।”

ইমান আর অরুণিকা অবাক হলো। ইমান জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?”

“আমি কি জানি না-কি? অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।”

“অদ্ভুত, বাইকে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না, সেটা না হয় মানলাম। এখন কি কথাও বলা যাবে না?”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“হয়তো অন্য কারণেই ডাকছে। ক্যাম্পাসে তো এমন নিয়ম নেই।”

এরপর তারা দু’জনই আহনাফের কেবিনে ঢুকলো। আহনাফ চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। ইমান সালাম দিতেই অরুণিকাও তার দেখাদেখি সালাম দিলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। এরপর সালামের উত্তর নিয়ে মৃদু হাসলো। ইমান আহনাফকে হাসতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“স্যার ডেকেছিলেন?”

আহনাফ গম্ভীরমুখে বলল,
“এখন থেকে তোমাকেই ক্লাবের সেক্রেটারি বানাবো ভাবছি।”

ইমান অবাক হয়ে তাকালো। এরপর অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আহনাফ বলল,
“আর তুমি বি গ্রুপের সিআর হবে। আগামীকাল এটা আমি ক্লাসে এনাউন্স করবো। আজকে বাসায় গিয়ে ম্যান্টালি নিজেকে প্রিপেয়ার করে নিবে।”

বাইরে আড়ি পেতে জয়িতা আহনাফের কথাগুলো শুনছিল। সে হুট করে ভেতরে ঢুকে বলল,
“স্যার, আসতে পারি?”

আহনাফ ইশারায় মাথা নাড়লো। জয়িতা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“স্যার, আমিই তো ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলাম। ইমানকে এই দায়িত্ব কেন দিচ্ছেন?”

আহনাফ শক্ত কন্ঠে বলল,
“তুমিই ভালো জানো, আমি কেন এই দায়িত্ব তোমাকে আর দিচ্ছি না।”

“সরি, স্যার।”

“সরি আমাকে বলতে হবে না। সরি বলার আর প্রয়োজনও নেই। তোমাকে ইভান একটা দায়িত্ব দিয়েছে, আর তুমি ওটা ঠিকভাবে করতেই পারলে না? তোমার জন্য যদি আমাদের ক্যাম্পাসের রেপুটেশন নষ্ট হতো!”

“স্যার, সেই রাতে আমারও ক্ষতি হতে পারতো!”

“তুমি পালিয়ে গিয়ে কাউকে অন্তত জানাতে পারতে! এই মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে ক্যাম্পাসের ইমেজ নষ্ট হতো। তোমার কিচ্ছু হতো না। আর আগামী বছর থেকে অরিয়েন্টেশন সন্ধ্যায় হবে না।”

ইমান বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”

জয়িতা রাগী দৃষ্টিতে ইমানের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। ইমানও সালাম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে অরুণিকাও সুরসুর করে ইমানের পিছুপিছু বেরুতে যাবে তখনই আহনাফ বলল,
“তুমি কোথায় পালাচ্ছো?”

অরুণিকা থমকে গেলো। পেছন ফিরে আহনাফের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,
“আবার কি করলাম আমি?”

আহনাফ তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অরুণিকার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। অরুণিকার মনে পড়লো, ইমান যাওয়ার আগে আরেকবার সালাম দিয়েছিলো। অরুণিকা এবার জোর গলায় বলল,
“আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।”

আহনাফ থেমে গেলো। চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে।

চলবে-