উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৬+৭+৮

0
1

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০৬ ||

হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো অরুণিকার৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। অরুণিকার দৃষ্টি আহনাফের বুক পকেটে। সেই পকেটে একটা নীল কাগজ। অরুণিকা অনর্থক তাকিয়ে আছে সেই কাগজটির দিকে, কারণ তার আহনাফের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই। অনেক বছর আগেই সেই সাহস করতে গিয়েই তো সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিলো তার। অরুণিকা একপা একপা পেছাতে লাগলো আর আহনাফ ধীর পায়ে সামনে আগাচ্ছে। হঠাৎ থেমে গেলো অরুণিকা। পেছনে দেয়াল। চোখ বড় বড় করে আহনাফের দিকে তাকালো সে। আহনাফের দৃষ্টি প্রখর। আর অরুণিকার বুক ধকধক করছে। সে বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। আহনাফ দেয়ালের দু’পাশে হাত রেখে অরুণিকার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো। অরুণিকার নাকে এসে ঠেকলো সেই পরিচিত ঘ্রাণ। আর মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই শীতের রাত। অরুণিকা সাথে সাথেই আহনাফের বুকে হাত রেখে বলল, “আপনার ক্যাম্পাসের রেপুটেশন এখন নষ্ট হচ্ছে না?”

আহনাফ থেমে গেলো। অরুণিকা আহনাফের চোখে চোখ রেখে বলল, “সেদিন ইভান স্যার তো বলেছিলো সিনিয়ররা জুনিয়রকে বাইকে বসালে ক্যাম্পাসের রেপুটেশন নষ্ট হয়। কিন্তু স্যার যদি স্টুডেন্টকে তার রুমে ঢেকে এনে তার কাছে ঘেঁষতে চায়, তখন কি রেপুটেশন ঠিক থাকে?”

আহনাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে অরুণিকার গাল চেপে ধরে বলল, “কার সাথে কার তুলনা করছো, তুমি জানো?”

“তো। আমি কি আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি?”

আহনাফ অরুণিকাকে ছেড়ে দিলো। এরপর চেয়ারে বসে বলল, “তোমার মুখটা যাতে আমি আর না দেখি।”

অরুণিকা এবার আহনাফের টেবিলের উপর দুই হাত রেখে আহনাফের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, “টিউশন ফি দিয়ে পড়তে আসি ক্লাসে। বাইক্কা ক্লাস করতে আসি না। তাই আমি তো মুখটা ভালোভাবেই দেখাবো। আপনি নিজের চোখ সামলে রাখা শিখবেন, মিস্টার আহনাফ চৌধুরী।”

অরুণিকা কথাটা বলেই বেরিয়ে পড়লো। অরুণিকা বেরুতেই জয়িতা তার কাছে এসে বলল, “এই মেয়ে, তুমি স্যারের রুমে এতোক্ষণ কি করছো?”

অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল, “আপনি কি স্যারের পিয়ন? কে স্যারের সাথে কথা বলতে আসে সেটাই চৌকিদারী করতে আসেন, না-কি পড়াশুনা কর‍তে!”

“শাট আপ!”

“ইউ শাট আপ। এটা ইউনিভার্সিটি। আপনার বাবার বাড়ি না। তাই এখানে আমাকে হুমকি দিতে আসবেন না।”

জয়িতা ভড়কে গেলো অরুণিকার কথায়। সে কিছু বলতে যাবে অরুণিকা তার আগেই চলে গেলো।

(***)

কানে হেডফোন গুঁজে বসে আছে অরুণিকা। রুদবার ক্লাস এখনো শেষ হয় নি। আজ গোলাপী টপস পরেছে সে৷ টপসের গলা একটু বড়। চুলে খোঁপা করা, তাই ফর্সা পিঠ দৃশ্যমান। হঠাৎ চুলে টান অনুভব করতেই পেছন ফিরে তাকালো অরুণিকা। সামনের মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলো সে। সামনের মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচালো। অরুণিকার ঠোঁটে ফুটে উঠলো হাসি, আর চোখে ভীড় করতে লাগলো জল। মানুষটি তার পাশে এসে বসলো। অরুণিকার চুল বাতাসে উড়ছে। সে খোঁপা করতে করতেই বসে পড়লো মানুষটির পাশে। মানুষটি বলল, “চুল খোলা রাখ, তোর পিঠ দেখা যাচ্ছে। সবাই কি ইমন রহমানের মতো ভদ্র হয় না-কি?”

অরুণিকা চুল খোলা রেখে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলো, “তুমিও কি এখানের স্যার?”

শব্দ করে হাসলো ইমন। ব্যাঙ্গ করে বলল, “এতো মেধাবী না আমি। তূর্য বললো তুই না-কি নতুন ভর্তি হয়েছিস এখানে!”

অরুণিকা তূর্যের নাম শুনে মুখ ছোট করে ফেললো। ইমন বলল, “কি-রে গাল ফুলিয়ে ফেলেছিস কেন?”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আরাফ আর তাহমিদ কেমন আছে?”

ইমন হাসল আর বলল, “সবাই ভালো আছে।”

“তুমি কি শুধু আমার সাথে দেখা করতে এসেছো এখানে?”

“হ্যাঁ!”

অরুণিকা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো ইমন। অরুণিকা ইমনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখলো ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে তূর্য, আহনাফ আর ইভান এসে বসেছে। অরুণিকা আর কিছু বললো না। মাথা নিচু করে চলে গেলো সে। ইমন অরুণিকাকে আর থামালো না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার যাওয়ার দিকে।

(***)

দখিনা হাওয়ায় ভেজা চুল ছড়িয়ে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরুণিকা। দ্বিপ্রহরের প্রখর রোদ তার সদ্যস্নাত ভেজা চোখের পল্লব স্পর্শ করে দিচ্ছে। অরুণিকা তাই চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সামনে কারো উপস্থিতি অনুভব করতেই অরুণিকা চোখ খুলে দেখলো ইমান। বুকে হাত গুঁজে অরুণিকার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। অরুণিকা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “আপনি?”

ইমান অরুণিকার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি।”

অরুণিকা ঘুরে রেলিঙের উপর দুই হাত রেখে দাঁড়ালো। কোনো কথা বলছে না সে। ইমান এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা বুঝতে পারছে ইমানের অভিপ্রায়। সে আঁড়চোখে তাকালো ইমানের দিকে। ছাদের রেলিঙের উপর একটা বই। ইমানের চোখ গেলো বইটির দিকে। কৌতুহলি কন্ঠে বলল, “শতাব্দীব্যাপী শাসন!”

অরুণিকার দৃষ্টিও এবার বইয়ের দিকে আটকালো। আর সাথে সাথেই বইটি হাতে নিয়ে নিলো। ইমান অরুণিকার দিকে ফিরে বলল, “বই পড়ো তুমি?”

অরুণিকা মাথা নাড়লো। ইমান আগ্রহী স্বরে বলল, “কি আছে এখানে?”

“কবিতা।”

“ওয়াও, কবিতা পড়ো?”

বলেই হাসলো ইমান। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হাসার কি আছে?”

“আমার কবিতা-টবিতা ভালো লাগে না।”

“তাহলে লিটারেচার পড়ার কি দরকার ছিল? অন্য ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হতে পারতেন।”

ইমান ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। অরুণিকার নাক লাল হয়ে গেছে। ইমান তার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, “রাগ করেছো?”

অরুণিকা মাথা নাড়লো। ইমান এবার ক্ষীণ হেসে বলল, “আমি মেডিক্যালের প্রিপারেশন নিয়েছিলাম। হয় নি, তাই আমার কাছে এটাই অপশন ছিল। সাব্জেক্ট চয়েজে ইংলিশই চলে আসে।”

“এতো ইউনিট থাকার পরও এখানে?”

“আসলে বাবার দয়ায় এখানে। আমার নিজের কোনো মতামত নেই। আমার ইচ্ছার মূল্যও কেউ দেয় না। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চেয়েছি। বাবা ডাক্তার ছেলে চেয়েছে। ওটা হতে পারি নি, তাই এক বাক্যে বলেছে আর খরচাপাতি দেবে না। সবচেয়ে কম খরচে আর্টস থেকে পড়াশুনা করে বের হওয়া যায়। দেটস ইট। আমার কাছে আর্টসের সবচেয়ে কুল সাব্জেক্ট ইংলিশ মনে হয়েছে।”

ইমানের কথায় অরুণিকা অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। ইমান তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “ভাবছো কি?”

অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “সবার গল্পটা এরকমই হয়।”

“আমার সাথে কি কারো মিল হয়ে গেলো না-কি?”

অরুণিকা এবার রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বলল,
“আমার কাজিন। ওরও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু চাচ্চু ওকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিল। তাই ও জেদ করে একদম আর্টসে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল পড়াশুনা শেষে এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। কারো সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবে না। আসলে আমার দাদা ডাক্তার, বাবাও ডাক্তার ছিল। চাচ্চুরাও সবাই ডাক্তার। অদ্ভুত ফ্যামিলি আমার! ওদের দৃষ্টিতে ছেলে হলেই ডাক্তার হতে হবে।”

“আর মেয়ে হলে?”

“পড়াশুনা শেষে বিয়ে দিলেই হলো।”

“তোমাকেও বিয়ে দিয়ে দেবে না-কি?”

“না। ওদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।”

“কেন?”

“বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ আমাকে রাখতে চায় নি।”

কথাটি বলতে বলতেই অরুণিকার চোখ ছলছল করে উঠলো। ইমান অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তুমি ঠিক আছো?”

অরুণিকা চোখ মুছে বলল, “আমি ঠিক আছি।”

এরপর ইমানের হাতের দিকে তাকিয়ে হাত সরিয়ে নিলো। ইমান দাঁত খিচিয়ে বলল, “সরি।”

“ইটস ওকে।”

“যদি কিছু মনে না করো, একটা প্রশ্ন করি?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার ফ্যামিলির কেউ তোমাকে রাখতে চায় নি, তাহলে এরা কারা, যাদের সাথে তুমি থাকছো?”

“আমার মামী, আমার একমাত্র মামাতো বোন।”

“আচ্ছা, তোমার মামা কোথায়?”

“বাইরের দেশে।”

“রুহানি তোমার মামাতো বোন?”

“হ্যাঁ।”

“ভালো তো। কিন্তু মেয়েটা খুব চঞ্চল।”

“হ্যাঁ ও ওরকমই। কিন্তু খুব মিষ্টি। আমার অনেক কেয়ার করে।”

“তোমার ফোবিয়া নিয়েও খুব চিন্তিত থাকে।”

অরুণিকা হাসলো। বলল, “হ্যাঁ।”

“তোমার এমন ফোবিয়া কখন থেকে? এটা তো মারাত্মক সমস্যা!”

অরুণিকা ইমানের প্রশ্ন শুনে তার দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর সেকেন্ড খানিক ইমানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আপনাকে আমি প্রথম দেখেছি ভর্তি হয়ে বের হওয়ার সময়।”

ইমান এক গাল হাসলো। কপাল চুলকে বলল, “আমিও।”

এরপর মনে মনে ভাবলো, “এন্ড লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়ে গেলো।”

কিন্তু অরুণিকার কথায় মুহূর্তেই তার মুখে গ্রহণ লাগলো। অরুণিকা বলল, “কিন্তু প্রথম দিন আপনাকে দেখে বখাটে ভেবেছিলাম আমি। হাতে বেল্ট, গলায় চেইন, চোখে সানগ্লাস!”

অরুণিকা এই বলে বই হাতে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। ইমান নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মারলো। সে অরুণিকার পাশে হাঁটতে যাবে, তখনই রুহানি হনহনিয়ে ছাদে এসে বলল, “অরু!”

ইমানকে দেখে থেমে গেলো সে। বুকে হাত গুঁজে এগিয়ে এসে বলল, “আমার বোনের সাথে কি?”

অরুণিকা আর ইমান দু’জনই চোখ বড় বড় করে তাকালো। রুহানি অরুণিকাকে টেনে একপাশে এনে ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দূরে গিয়ে দাঁড়ান। একদিন সাহায্য কেন চাইলাম, ওমনি গলায় ঝুলে পড়েছেন? আপনার দ্বারা সাহায্যের দন্ত সও তো হয় নি। আসছে খেজুরে গল্প করতে!”

অরুণিকা মুচকি হেসে ইমানের দিকে তাকালো। ইমানের চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “কি করলে খেজুরে গল্প করার অনুমতি পাবো?”

“নো নেভার। আমি অনুমতি দিচ্ছি না।”

“কেন?”

“এমনিতেই। আমার খেজুরে গল্পের জন্য আপনাকে যোগ্য মনে হচ্ছে না।”

এই বলে রুহানি অরুণিকার হাত ধরে তাকে নিয়ে চলে গেলো। ইমান শুকনো মুখে বলল, “এতো দেখছি মামাতো বোন নয়, স্বয়ং মা।”

এদিকে পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ছ’জন যুবক। সবার মুখেই মাস্ক। একজনের হাতে গিটার। এতোক্ষণ তাদের দৃষ্টি অরুণিকা আর ইমানের দিকেই স্থির ছিল। তাদের মধ্যে তিন জনের হাত মুঠো হয়ে আছে। কিন্তু রুহানি ছাদে আসতেই তাদের তিন জনের হাতই আলগা হয়ে এলো। তারা এবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছাদের অন্য পাশে চলে গেলো।

(***)

অরুণিকা ভার্সিটির জন্য বাসা থেকে বের হতেই গলির মুখে এসে থমকে দাঁড়ালো। রুদবা তার বাসা থেকে বেরিয়ে অরুণিকার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “চল, রিকশা দেখি।”

কিন্তু অরুণিকাকে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“কি হলো?”

এরপর অরুণিকার চোখ অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আরেহ, উনি তো আমাদের এডভাইসর, ইভান স্যার। ক্লাস পেয়েছিস উনার?”

অরুণিকা চুপ করে আছে। রুদবা আবার বলল, “আরেহ, আহনাফ স্যারও তো আছে দেখছি। উনি তো তোদের এডভাইসর।”

অরুণিকা এখনো চুপ করে আছে। রুদবা এবার ভ্রূ কুঁচকে বললো, “অরু, দ্যাখ দ্যাখ, রহস্য ব্যান্ডের ভোকালিস্ট তূর্য শেখও এখানে! এরা এখানে থাকে না-কি? আর তাদের সাথে বাকিরা কারা? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না তূর্য শেখ গলির চায়ের দোকানে বসে আছে। কতো বড় সেলিব্রিটি! আর টংয়ের দোকানে বসেছে! ভাবা যায়?”

রুদবা কি ভেবে নিজের বাসার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে যেই ছ’জন ব্যাচেলর এসেছে, এরাই কি তারা?”

অরুণিকা অবাক হয়ে তাকালো রুদবার দিকে। মনে মনে ভাবলো, “এই শহরে নিজস্ব বাড়ি থাকার পরও এরা বাসা ভাড়া নিয়ে কেন থাকবে?”

পরক্ষণেই অরুণিকার সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো, “সেদিন রাতে আমাকে সেই বখাটেদের হাত থেকে কি আহনাফই বাঁচিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছিল? না-কি অন্য কেউ। না, না, আহনাফ কখনোই হবে না। এটা আমার ভ্রম। আহনাফ চৌধুরী আমাকে কেন বাঁচাবে? হি হেইটস মি। আই অলসো হেইট হিম। সে তো চায়, আমি আরো কলঙ্কিত হই। আমাকে সে কখনোই বাঁচাবে না।”

রুদবা অরুণিকাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন?”

অরুণিকা বলল, “কতো মানুষ চা খেতে বসে। আর তোর মনে হচ্ছে এরাই সেই ব্যাচেলর।”

“আরেহ, গিটারের শব্দ পেয়েছি। আর চশমা পরা ভাইয়াটাকে অনেক বার ছাদে দেখেছিলাম। আবার এখানেও একসাথে বসে আছে। তাই বললাম আর কি। আমাদের ব্যাচেলরও ছ’জন এসেছে শুনেছি। এখানেও ছ’জন। আচ্ছা, এসব বাদ দে। চল সামনে যাই।”

এই বলে রুদবা অরুণিকার হাত ধরে সামনের চায়ের দোকান পার করার সময় দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে সালাম দিয়ে বলল, “স্যার আপনারা এখানে থাকেন?”

রুদবার কন্ঠে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সবাই। উপস্থিত ছ’জনেরই চোখ আটকে গেলো অরুণিকার দিকে। ইমন রুদবাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি?”

“আমি রুদবা। ইভান স্যারের স্টুডেন্ট।”

ইভান শক্ত স্বরে বলল, “ক্যাম্পাসে যাও। এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো?”

রুদবা ইভানের ঝাঁঝালো কথায় লজ্জা পেয়ে গেলো। মাথা নেড়ে অরুণিকাকে না নিয়েই সামনে চলে গেলো। অরুণিকা নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। রুদবাকে চলে যেতে দেখে সে একনজর পাশে তাকাতেই আহনাফের সাথে চোখাচোখি হলো। এরপর এক দৌঁড়ে রুদবার পাশে চলে গেলো। অরুণিকা চলে যেতেই তূর্য বলল, “ঝাটকা।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো তূর্যের দিকে। ইমন বলল,
“ওই দেখা যায় তেঁতুল গাছ, ওই আমাদের বাসা,
ওই খানেতে বাস করে ছ’টি ব্যাঙের ছানা।”

তাহমিদ শাহরিয়ার ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমনের দিকে। তাহমিদ শান্ত মেজাজের যুবক। ভাবুক আর নিজের মধ্যেই ব্যস্ত থাকে সবসময়। সে গম্ভীরমুখে বলল,
“তুই এসব বেফাঁস ছড়া বলে অন্তত ছড়াকে অপমান করিস না।”

“রাইট। তুই তো অনেক বড় ছড়া লেখক। কিন্তু আমি এসব ছড়া-টড়া বুঝি না। আমার যেমন ইচ্ছা, তেমনি ছড়া বলবো।”

তূর্য ইশারায় ইমনকে চুপ হতে বলল। ইমন চুপ হয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কি?”

তূর্য কিছু একটা ইশারা করলো। ইমন ভ্রূ কুঁচকে মাথা ঝুঁকিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো, আরাফ চৌধুরী শক্ত মুখে বসে আছে। আরাফ, আহনাফের চাচাতো ভাই। সে অনেক শান্ত, আবার রাগীও বটে। এই মুহূর্তে তার শক্ত মুখখানায় ফুটে উঠেছে ভয়ংকর রাগ। আর তার মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ আর টুঁ শব্দও করার সাহস পেলো না। নীরবে চা শেষ করে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লো তারা।

চলবে–

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০৭ ||

আহনাফ ক্লাসে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। আহনাফ একনজর পুরো ক্লাসে চোখ বুলিয়ে নিতেই দেখলো অরুণিকা পেছনে বসে আছে। আহনাফ হাতের ফাইলটা টেবিলে রাখতেই জোরে শব্দ হলো। আর অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো অরুণিকা। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে বলল, “কাল এই ক্লাসের একজন আমার রুমে এসেছিল। কে ছিল যেন সে?”

সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। কিন্তু কেউ দাঁড়ালো না। আহনাফ শক্ত মুখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এবারও দু’জনের চোখাচোখি হলো। অরুণিকা সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। আহনাফ এটেনডেন্স শিট হাতে নিয়ে বলল, “গত ক্লাসে কারো সাথে পরিচয় হতে পারি না। আমি যেহেতু আগামী চার বছর তোমাদের ব্যাচের এডভাইসর, তাহলে সবার পরিচয় জেনে রাখা ভালো। যদিও আজ সবার পরিচয় বললেও আমি কাল ভুলে যাবো। তাই তোমরা তোমাদের সম্পর্কে এমন কিছু বলো, যেটা আমার মনে রাখা সম্ভব। যেমন তোমাদের নাম, আর তোমাদের সম্পর্কে স্পেশাল কিছু। আর গত ক্লাসে যাদের যেই গ্রুপ ভাগ করে দিয়েছি, তারা আশেপাশে বসলে আমার ক্লাসে সুবিধে হবে।”

আহনাফের কথায় সবাই তাদের স্থান পরিবর্তন করলো। শুধু অরুণিকা আর আরেকটা ছেলে এখনো তাদের জায়গায় বসে আছে। আহনাফ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার গ্রুপ কোনটা!”

ছেলেটি দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার আমি আসি নি গত ক্লাসে। আমি কোনো গ্রুপে নেই।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ছেলেটির দিকে। এরপর এটেনডেন্স শিট হাতে নিয়ে সেই নামে চোখ বুলিয়ে নিলো, যাকে অরুণিকার সাথে একটা গ্রুপে দিয়েছিলো। আহনাফ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি তাহসিন কাউসার?”

ছেলেটি মাথা নাড়লো। ক্লাসের একটা মেয়ে বলল, “স্যার এই ছেলের সাথে পেছনের মেয়েটা আলাদা একটা গ্রুপে।”

তাহসিন পেছনে ফিরে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা এবার ব্যাগ নিয়ে সামনে এসে তাহসিনের পাশে বসে পড়লো। তাহসিনও অরুণিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, “স্যার বসবো?”

আহনাফ দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। এরপর ভ্রূ কুঁচকে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে বললো, “তাহসিন কাউসার, তোমার এই নামটা কে রেখেছে?”

তাহসিন মুখ ছোট করে বলল, “মা!”

“তোমার নাম শুনলে যে-কেউ মনে করবে, তুমি মেয়ে। এটা তো সমস্যা। আচ্ছা, ঠিক আছে, বসো।”

অরুণিকা আহনাফের কথায় মৃদু হাসলো। মনে মনে বলল, “ভালোই হয়েছে, মিস্টার আহনাফ চৌধুরী। আমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলে তুমি, তাই না? এখন তোমাকে কীভাবে ম্যান্টালি টরচার করি, জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

এদিকে তাহসিন নিজের সিটে বসে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকাও তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হাই তাহসিন, আমি অরুণিকা।”

তাহসিন মৃদু হেসে বলল, “হাই।”

আহনাফ গম্ভীরমুখে মিনিট খানিক অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর বলল, “স্টুডেন্ডস, ইন্ট্রুডিউস ইউরসেল্ফ।”

সবাই যার যার নাম বলে তাদের কিছু হাস্যকর বৈশিষ্ট্য বলতে লাগলো। আহনাফ এটেনডেন্স শিটের দিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎ একজন দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যালো স্যার, আই এম যতি এন্ড আই লাইক মুডি ম্যান।”

যতির কথায় আহনাফ তার দিকে তাকালো। এতোক্ষণ কারো পরিচয় শুনে আহনাফ চোখ তুলে তাকায় নি, শুধুমাত্র যতির পরিচয় শুনে সে যতির দিকে তাকিয়েছে। যতি আহনাফকে তার দিকে তাকাতে দেখে মুচকি হেসে বসে পড়লো। যতির পাশে বসা একটি মেয়ে তাকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো। আহনাফ এবার অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আই এম অরুণিকা এন্ড আই ডোন্ট লাইক উইন্টার সিজন।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকার কথা শুনে প্রায় সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার তাহসিন দাঁড়িয়ে বলল, “আই এম তাহসিন কাউসার। এন্ড এভ্রিওয়ান ট্রলস মি, বিকজ অব মাই নেইম।”

তাহসিন তার পরিচয় বলেই বসে পড়লো। ক্লাসের সবার পরিচয় দেওয়া শেষ। কিন্তু আহনাফের সেদিকে খেয়াল নেই। সে এখনো অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা আঁড়চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর পর হাত ঢলতে লাগলো। তার কানে বার বার ধ্বনিত হতে লাগলো অরুণিকার একটি বাক্য, “আই ডোন্ট লাইক উইন্টার সিজন।”

একজন আহনাফকে ডেকে বলল, “স্যার আজ কি পড়াবেন না?”

আহনাফ দাঁড়িয়ে বলল, “না। আজ এতোটুকুই। আর তোমাদের এটেনডেন্স নেওয়া হয়ে গেছে। কাল থেকে শিট তোমাদের বেঞ্চে চলে যাবে, আর তোমরা সাইন করে দেবে নিজেদের নামের পাশে। প্রক্সি পাওয়া গেলে, আমি কি শাস্তি দিতে পারি, সেটা কেউ আন্দাজও করতে পারবে না। সো নো প্রক্সি। আর গতকাল ক্লাসের একজন আমার রুমে এসেছিল। আমি শুরুতে তাকে ডেকেছি, কিন্তু সে দাঁড়ায় নি। কেন?”

অরুণিকা চুপচাপ বসে আছে। আহনাফ এবার টেবিলে জোরে ঘুষি মারতেই অরুণিকা সবার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আহনাফ রাগী স্বরে বলল, “ম্যানারলেস গার্ল, কতোবার ডাকলে তুমি রেসপন্স করবে? কোনো ভিআইপি স্টুডেন্ট তুমি? না-কি তোমার বাবার ডোনেশন আছে এই ক্যাম্পাসে?”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সরি স্যার। আমি কনফিউজড ছিলাম।”

“কেন কাল কি তুমি আসো নি আমার রুমে?”

“ইয়েস স্যার।”

“তাহলে কনফিউশান কেন?”

“সরি স্যার।”

“তোমাকে কাল আমি সিআরের দায়িত্ব দিয়েছিলাম।”

অরুণিকা মাথা নাড়লো। আহনাফ বলল, “সামনে এসে দাঁড়াও।”

অরুণিকা বেঞ্চ থেকে বের হয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ বলল, “এই মেয়েকে সিআর কেন বানিয়েছি আমি, জানো?”

সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “কারণ এই ক্লাসে ওর মতো ইরেসপন্সিবাল কেউ নেই। আর এই দায়িত্ব হয়তো এই মেয়েকে রেসপন্সিবাল বানাতে পারবে।”

অরুণিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ এবার তাহসিনকে সবার সামনে ডেকে বলল, “সেকেন্ড সিআর এই ছেলে হবে। ক্লাসে রেগুলার প্রেজেন্ট থেকে ক্লাস মনিটরিং করা তার দায়িত্ব। এখন আমি দেখতে চাই, বিশ মিনিট ক্লাসের বাইরে ঘুরাঘুরি করে, ক্লাসে প্রেজেন্ট না থেকে কীভাবে কিছু ইডিয়টস আমার কোর্সে পাশ করতে পারে।”

আহনাফের কথায় অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। আহনাফও একনজর অরুণিকাকে দেখে ফাইল হাতে নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লো। আহনাফ বের হতেই অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেঞ্চে এসে বসলো। তাহসিনও তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার একটু খিটখিটে স্বভাবের, তাই না?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”

“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”

“হ্যাঁ, করো।”

“তোমার উইন্টার অপছন্দ কেন? আই মিন সবারই উইন্টার অনেক পছন্দের। এই প্রথম কেউ বললো, তার ভালো লাগে না।”

“হ্যাঁ, ভালো লাগে না। আমার কোনো ঋতুই ভালো লাগে। সব দিন, সব মাস আমার কাছে একই মনে হয়।”

“কেন?”

“জানি না। এমনিতেই।”

“সিক্রেট কিছু?”

“হয়তো।”

“তাহলে তো আগ্রহ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।”

“আগ্রহ রাখা ভালো। আগ্রহ থাকলেই জীবনে রসবোধ থাকে। আগ্রহ ছাড়া কোনো কাজ, কোনো দিন, কোনো মুহূর্তই উপভোগ করা যায় না।”

তাহসিন হাসলো। বলল, “তুমি অনেক গুছিয়ে কথা বলো।”

অরুণিকা হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কেন মনে হলো?”

“এমনিই। অবশ্য মেয়ে বন্ধু নেই আমার। বয়েজ স্কুল, বয়েজ কলেজ, আর এই প্রথম কম্বাইন ইউনিভার্সিটি। এইজন্য বোধহয় তোমার কথা শুনে আমার অনেক গোছানো মনে হয়েছে।”

তাহসিন আর অরুণিকার গালগল্প চললো প্রতি ক্লাসের শেষে। ছুটির পর একসাথে ক্লাস থেকে বেরুতেই রুদবার সাথে দেখা হয়ে গেলো তাদের। অরুণিকা তাহসিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুদবার হাত ধরে ক্যাম্পাসের ইটের রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। রুদবা তাহসিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “অরু, নতুন বন্ধু বানিয়ে ফেলেছিস, দেখছি।”

অরুণিকা হেসে বলল, “আহনাফ স্যার ওর সাথে আমার পেয়ারিং করিয়েছেন।”

“মাত্র দু’জন?”

“হ্যাঁ, ওই যে বললাম, উনার ক্লাস না করে বাইরে ঘুরেছি, সেই শাস্তি দিতেই দু’জনের গ্রুপে আমাকে দিয়েছে।”

“এখন? দশ জনের গ্রুপ থেকে যেই পরিমাণ আইডিয়া আসবে, দু’জনের গ্রুপে অনেক পরিশ্রম করতে হবে।”

“তো, করলাম না হয়। তাহসিন অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আমিও কি ডামিশ না-কি? আমরা দু’জন মিলে বেস্ট গ্রুপ ওয়ার্ক করবো। আর তুই জানিস? ও একদম আমার মতোই। তাহসিনেরও সাহিত্য ভালো লাগে, তাই এই সাব্জেক্ট নিয়েছে। ওর না-কি প্রফেসর হওয়ার ইচ্ছা। ফেইসবুকে না-কি টুকটাক লেখালেখিও করে।”

এসব বলতে বলতেই অরুণিকা হাসছিলো। রুদবা অরুণিকাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, “এতো ইম্প্রেস হয়ে গেলি! আজ প্রথম তোকে কোনো ছেলের এতো প্রশংসা করতে দেখেছি। লাভ এট ফার্স্ট সাইট টাইট হয় নি তো আবার!”

অরুণিকা রুদবার পিঠে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, “লাভ টাভ আমার দ্বারা হবে না। ফ্রেন্ডশিপ করার জন্য তাহসিন বেস্ট একটা ছেলে। মনের মতো ফ্রেন্ড না পেলে, পুরো সেমিস্টার উল্লুকের মতো এক কোণায় বসে থাকতে হতো। আর ক্লাসের মেয়েগুলো একদম অদ্ভুত।”

রুদবা পিঠ ঢলতে ঢলতে বলল, “কেন, তারা আবার কি করলো?”

“স্যারদের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে। সব ক’টা ছ্যাঁচড় টাইপ।”

“আরেহ ভাই, এভাবে বলিস না। আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্যারগুলো আসলেই বেশি ইয়াং। ইভান স্যার, আহনাফ স্যার, মুশফি স্যার এরা তিনজনই অনেক স্মার্ট। আর বাকীগুলো বিবাহিত। এরা কিন্তু এখনো বিয়ে করে নি।”

“তুই কীভাবে জানলি?”

“ক্লাসের মেয়েরা এদের নিয়েই তো কথাবার্তা বলছে। বিশ্বাস কর অরু, ইভান স্যার ক্লাসে এলে আমার নিজের প্রতিই নিজের ঘেন্না হয়। ভাই, আমি যে স্যারের উপর ক্রাশ খাবো, এইটা আমার নিজেরই এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”

“তুই ইভান স্যারের উপর ক্রাশ খেয়েছিস?”

“হ্যাঁ। সুন্দর না অনেক?”

অরুণিকা মিনমিনিয়ে বলল, “কচুর মতো দেখতে!”

“কি বললি?”

“কিছু না। তোর রুচির অধঃপতন হচ্ছে ভেবে একটু মায়া লাগছে।”

রুদবা হতাশ কন্ঠে বললো, “বাদ দে এসব। স্যার তো স্যারই। এমনিতেই রাস্তা-ঘাটে কতো ক্রাশ খাই। খেয়ে-দেয়ে মন ভরে যাবে একদিন।”

অরুণিকা নাক সিঁটিয়ে বলল, “ইস!”

রুদবা মুখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা হেসে রুদবার কাঁধে হাত তুলে বলল, “এসব ক্রাশ-ট্রাশ খাইস না। স্যার যদি একবার বুঝতে পারে, জীবন তেজপাতা করে দেবে। ছেলেরা এরকমই হয়। একবার যদি মেয়েদের দুর্বলতা বুঝতে পারে, ইচ্ছে করেই ওই মেয়েকে তারা কাঁদাবে। ওদের জিনেটিক প্রবলেম আছে হয়তো। ওরা অতিরিক্ত ভালোবাসা হজম করতে পারে না। কাউকে সহজে দুর্বল করে, কাছে টেনে, আবার ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতে তাদের বেশি সময় লাগে না। মেয়েরা অনেক আবেগী হয়। একবার ছ্যাকা না খেলে, তাদের আক্কেল হয় না। ওই ক্রাশ-ট্রাশও চেনা যায়, ছ্যাকা খাওয়ার পরই। এখন যদি তোর ক্রাশ নিয়েই পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে, তাহলে এখন থেকেই একটা ধাক্কা খাওয়ার জন্য মেন্টালি প্রিপেয়ার হয়ে নে।”

“এতো ডিমোটিভেট করিস না তো। সবার ভাগ্য এক হয় না। সব ছেলেও খারাপ হয় না। ভাগ্য ভালো হলে, সব ভালো হয়।”

অরুণিকা হঠাৎ থেমে গেলো। আশপাশ কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে তার। মনে হচ্ছে কিছু মেয়েলী কন্ঠ তার কানের কাছে গুনগুন করছে। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট কন্ঠের স্বরসমূহ স্পষ্ট হয়ে এলো। তার কানের পর্দায় এসে ধাক্কা খেতে লাগলো এক একটি বাক্য।

-অপয়া, অলক্ষী মেয়ে
-এই মেয়ে অভাগী। এই অভাগী যেখানেই যাবে, যার বাড়ি যাবে, সব খেয়ে যাবে।

রুদবার ঝাঁকুনিতে অরুণিকার ঘোর কাটলো। রুদবা অরুণিকার কপালে হাত রেখে বলল, “অরু, কি হয়েছে?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “কিছু না। তুই ঠিক বলেছিস। ভাগ্য ভালো হলে, সব ভালো হয়। যাদের ভাগ্য নেই, তাদের সাথে কিছুই ভালো হয় না। তারা সব হারিয়ে ফেলে, ঠকে যায়। কারণ তারা অভাগী, অপয়া, অলক্ষী।”

“কি যা তা বলছিস?”

অরুণিকা প্রতিত্তোরে মাথা নেড়ে সামনে কয়েক পা এগুতেই থমকে গেলো। আপাদমস্তক সামনের মানুষটিকে দেখে বলল, “আপনি?”

চলবে–

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-০৮ ||

“কি অবস্থা? কেমন আছো ণিকা?”

অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “অরুণিকা।”

ইমান হেসে বলল, “ওই একই কথা।”

রুদবা অরুণিকার হাত ধরে তাকে সামনে টেনে নিয়ে গেলো। ইমান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কপাল চুলকে পেছন ফিরে অরুণিকার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুদবাও পেছন ফিরে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো ইমানের দিকে। দু’জনের চোখাচোখি হতেই ইমান হাতের ইশারায় বিদায় দিলো রুদবাকে। রুদবা মুখ বাঁকিয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই তো দু’দিনেই খুব পরিচিত হয়ে গেলি!”

“আরেহ না। উনি ইমান। তুই তো চিনিসই। আমাদের প্রতিবেশি উনি। তোকে তো বলেছিলাম।”

“হ্যাঁ, কিন্তু ছেলেটা খুব গায়ে পড়া স্বভাবের। আমার একদম ভালো লাগে না।”

অরুণিকা আর কিছু বললো না। রুদবা ক্যাম্পাস থেকে বেরুতেই ব্যস্ত হয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলো। অরুণিকাও রিকশা দেখছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা চ্যাংড়া ছেলে দৌঁড়ে এসে অরুণিকাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। অরুণিকা বুঝে উঠার আগেই তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে গেলো সেই ছেলে। ব্যাগ টেনে নিতেই অরুণিকার ওড়না তার গলা থেকে খুলে সেই ব্যাগের সাথেই চলে গেলো। হুটহাট এমন কিছু হয়ে যাবে, সেটা কেউই বুঝতে পারে নি। অরুণিকার ব্যাগ নিয়ে একটা ছেলে দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে, আর অরুণিকার সেকেন্ড খানিক লাগলো সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে। হুঁশ ফিরতেই তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো সে। রুদবা অরুণিকার দিকে ততোক্ষণে দৌঁড়ে এসেছে। কিন্তু সে কিছু বলবে, তার আগেই অরুণিকা সেই চ্যাংড়া ছেলেটির পেছনে ছুটতে লাগলো, আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, “চোর, চোর, আমার ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে।”

অরুণিকা দৌঁড়াচ্ছে, আর তার সামনে চ্যাংড়া ছেলেটি ব্যাগ হাতে পালানোর চেষ্টা করছে। রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই ব্যাগের চেইনের সাথে আটকে থাকা ওড়না। কেউ চোরটাকে আটকাচ্ছে না। সবাই শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। চোরটার পথ রোধ করার ইচ্ছেও যেন কারো মধ্যে নেই। উলটো পথচারীরা রাস্তা খালি করার জন্য সরে যাচ্ছে। অরুণিকা জামার হাতায় চোখ মুছছে আর দৌঁড়াচ্ছে। তার ফোন ওই ব্যাগেই। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে সেই ফোনটা কিনেছিলো সে। মায়া লাগছে ব্যাগে থাকা তার মায়ের দেওয়া আংটির কথা ভেবে। ব্যাগটাও সে ভ্যানগাড়ি থেকে কিনেছিলো তার জমানো টাকা দিয়ে। এসব হারালে, সে তো সহজে কিনতে পারবে না। তাকে কে টাকা দেবে? মামা টাকা দিলেও মামী কখনো অরুণিকার হাতে সেই টাকা তুলে দেন নি। উলটো টাকা পাঠাতে বললেই মামী অরুণিকাকে খোঁচাতে ভুলেন না। বার-বার বলতে থাকেন, তার দাদার বাড়ি থেকে যাতে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আসে। তাদের তো অভাব নেই। একটা মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার মতো ক্ষমতা তো তাদের আছেই। অরুণিকা এসব শুনতে চায় না। তার ফোনটা যে-কোনো মূল্যেই চায়। আর ব্যাগে থাকা আংটিটা হারালে, সে তো রাতে ঘুমাতে পারবে না। মায়ের আংটিটা সবসময় নিজের কাছে রাখে সে। আজ ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে আংটিটা খুলে ব্যাগে রেখেছিল, আর হাতে পরা হয় নি। অরুণিকার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে এসব ভেবে। চোরটা রাস্তা পার হবে হয়তো এখনি। অরুণিকার শরীরের শক্তি যেন হারিয়েই গেছে। রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে এমন মুহূর্তেই একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে পেছন দিক থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা চোরটির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, “আমার ব্যাগ!”

অরুণিকা এবার ভেজা চোখে সামনের মানুষটির দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে রইলো সে। এরপর অস্ফুটস্বরে বলল, “আরাফ!”

আরাফ অরুণিকা ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা আরাফকে সরিয়ে দিয়ে শূন্য পথের দিকে তাকিয়ে আছে। চোরটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। তবুও অরুণিকা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকেই। আরাফ তার কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে অরুণিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ধরে রাখ।”

অরুণিকা ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, “এটা আমাকে কেন দিচ্ছো?”

“তোর ওড়নাও চুরি করে নিয়ে গেছে, তাই এটা দিলাম। আমি তো ওড়না-টোরনা পরি না যে তোকে ধার দেবো।”

অরুণিকা ব্যাগটা সামনে ঝুলিয়ে বলল, “ওড়না তো ব্যাগের সাথেই চলে গেছে।”

মিনিট খানিক নীরবতা বিরাজ করলো দু’জনের মধ্যে। এবার অরুণিকা বলল, “তুমি তোমার ব্যাগটা রাখো। আমি ক্যাম্পাসে চলে যাই। আমার ফ্রেন্ড হয়তো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলতে যাবে তখনই আরাফ ব্যাগটা ধরে বলল, “যেখানে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছিস, ওভাবে দাঁড়িয়ে থাক। বেশি নড়াচড়া করলে ধাক্কা দিয়ে চোরটার মতো রাস্তায় ফেলে দেবো।”

আরাফের শীতল কণ্ঠের সাথে বহুদিনের পরিচয় তার। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তো শুনে আসছে সেই কন্ঠ। কন্ঠটা মুখস্থ হয়ে গেছে তার। আরাফ যে রেগে আছে তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে সে। আরাফের লাল হয়ে থাকা কানটার দিকে তাকিয়ে আছে অরুণিকা। রেগে গেলে কান লাল হয়ে যায় আরাফের। আহনাফেরই একই অবস্থা। দু’জনের রাগ যেন আকাশচুম্বী। আরাফ-আহনাফের স্বভাবের পাশাপাশি চেহারায়ও যথেষ্ট মিল। তারা যে চাচাতো ভাই, সেটা দেখলে কেউই বুঝবে না। মনে হবে আপন ভাই।

অরুণিকার বড় চাচার ছেলে আরাফ চৌধুরী। আর আহনাফ চৌধুরী তার সেজো চাচার ছেলে। দু’জনই অরুণিকার চাচাতো ভাই। অথচ পাঁচ বছর ধরে তাদের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন তার। অরুণিকা কখনোই চায় নি, তাদের সাথে যোগাযোগ না রাখতে, অথচ ও বাড়ির কেউই অরুণিকাকে পছন্দ করে না। যদিও অরুণিকা ভাবতো, কেউ তার পাশে না থাকলেও তার কাজিন ভাই আরাফ তার পাশে থাকবে, তার প্রিয় মানুষ আহনাফ তার হাত ছাড়বে না। কিন্তু তারা দু’জনই অরুণিকাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।

পরিচিত কন্ঠের স্বর কানে আসতেই অরুণিকার ঘোর কাটলো। সে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ অরুণিকার বাবা জুবায়ের করিম চৌধুরীর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। সেই সূত্রে তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। তাকে দেখেই অরুণিকা ক্ষীণ হাসলো। বয়সে পাঁচ বছরের বড় তাহমিদ। অথচ তাহমিদের সাথে কতোই না ভাব ছিলো তার। তাহমিদের কাছ থেকেই সাহিত্য আসক্তিটা তাকে স্পর্শ করেছে। বাড়ির লোকেদের আড়ালে বসে কবিতা লিখতো, আর অরুণিকাকে এসে শোনাতে তাহমিদ। কেউই মনোযোগ দিয়ে তার দু’চার লাইনের কবিতা শোনার আগ্রহ দেখাতো না। একমাত্র অরুণিকাই গালে হাত দিয়ে বসে শুনতো সেই কবিতা। আর আজ পাঁচ বছর হয়ে গেলো, সেই কবিতা শোনানোর জন্যও তাহমিদ কল দেয় না অরুণিকাকে। মানুষগুলো তাকে ভুলে গেলেও, অরুণিকা কাউকে ভুলে নি। তাহমিদের কন্ঠে অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাহমিদের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ব্যাগ!”

তাহমিদ ব্যাগটা অরুণিকার হাতে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অরুণিকা তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে, গলায় ওড়না ঝুলিয়ে আরাফের ব্যাগটা আরাফকেই ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ আপনাদের, আমাকে সাহায্য করার জন্য।”

অরুণিকার কণ্ঠে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো তাহমিদ। অরুণিকা আর পেছন ফিরে তাকালো না। সে রুদবাকে নিতেই ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটতে লাগলো। এদিকে অরুণিকাকে দেখে দৌঁড়ে এলো রুদবা। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় গিয়েছিলি?”

ইমান অরুণিকার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল,”ব্যাগটা কীভাবে পেলে?”

অরুণিকা পেছন ফিরে তাকালো। কিন্তু আরাফ, তাহমিদ কাউকেই দেখলো না। রুদবা অরুণিকার হাত ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ব্যাগ কীভাবে পেয়েছিস?”

“একটা ভাইয়া সাহায্য করেছিলো।”

রুদবা অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাগ্যিস! কিন্তু যেভাবে দৌঁড়াচ্ছিস, গাড়ির নিচে পড়লে কি হতো?”

“ফুটপাত দিয়েই গিয়েছিলাম।”

“কিন্তু এতোটা ডেস্পারেট? তোর ফোবিয়ার কথাও মাথায় ছিলো না?”

অরুণিকা ব্যাগটা শক্ত করে ধরে বলল, “সত্যিই মাথায় ছিলো না। পরিস্থিতি হয়তো মানুষকে অনেক শক্ত বানিয়ে দেয়। তখন আর অতীতের ভয়ংকর দৃশ্যও মনে থাকে না।”

অরুণিকা রিকশা ঠিক করে উঠে বসলো। রুদবাও সেই রিকশায় উঠে পড়লো। ইমান স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলো অরুণিকার চোখের দিকে। অরুণিকা চলে যেতেই সে মনে মনে ভাবলো, “এই প্রথম এমন চোখ দেখলাম, যেই চোখ জোড়ায় ভিন্ন কিছু আছে। একদম ভিন্ন। ণিকার সাথে কি খারাপ কিছু হয়েছে? এমন ফোবিয়ার পেছনে তো অবশ্যই কোনো কারণ থাকতে পারে!”

(***)

বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অরুণিকা। রুহানি বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে, অরু? ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকেই রুম বন্ধ করে বসে আছিস। কেউ কিছু বলেছে?”

অরুণিকা মাথা তুলে ভেজা কন্ঠে বললো, “ফর গড সেইক, আমাকে একা থাকতে দে, রুহু।”

রুহানি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অরুণিকা বালিশে মাথা দিয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার কানে ধ্বনিত হলো পরিচিত কন্ঠস্বর এবং ঝাপসা চোখ জোড়ায় ভেসে উঠলো অতীতের এলোমেলো স্মৃতি।

……….

“অরু, এভাবে দৌঁড়ালে নদীতে গিয়ে পড়বি। অরু, আমি কিন্তু তোকে বাঁচাবো না।”

আট বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে পেছন ফিরে তাকালো। তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। মেয়েটি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ধরতে পারবে না।”

“তুই আমার শান্ত রূপ দেখেছিস। একবার রেগে গেলে, আমি কিন্তু তোকে তুলে ওই নদীতেই আছাড় মারবো।”

মেয়েটি থেমে গেলো। মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায়। তার সামনে এসে দাঁড়ালো চৌদ্দ বছরের কিশোর। বাচ্চা মেয়েটি মুখ ফুলিয়ে বলল, “আরাফ, তুমি আমাকে সব সময় বকাবকি করো। তোমার সাথে আমি একটুও মজা করতে পারি না।”

আরাফ হাঁটু গেড়ে মেয়েটির সামনে বসে বলল, “তুই মজা কর, কিন্তু এমন মজা করিস না। সামনে নদী। তুই পড়ে গেলে তোকে কে তুলবে? আমি সাঁতার জানি না-কি? বাড়ি চল, ওখানে গিয়ে লাফালাফি করিস।”

“তুমি আমাকে বকেছো। আমি তোমার সাথে আর যাবো না।”

আরাফ কান ধরে বলল, “সরি, মিস অরুণিকা চৌধুরী। এবার তো চল।”

অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল, “ওকে ফাইন। কিন্তু তাহমিদের জন্য নদী থেকে একশো আটটি নীল পদ্ম নিতে হবে না? ও তো খুঁজতে বের হবে। বরুণা যদি রাগ করে চলে যায়?”

“বরুণাটা কে আবার? এ কথা ও কখন বললো?”

“ওই যে গতকাল বিকেলে। বাড়ির ছাদে বসে বললো, নীল পদ্মের কথা।”

“তুই নীল পদ্ম মানে বুঝিস?”

“হ্যাঁ, নীল রঙের পদ্মফুল। আমি কি ডামিশ না-কি?”

আরাফ মাথা নেড়ে অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলো বাড়িতে। এরপর তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই না-কি নীল পদ্ম আনতে যাবি?”

তাহমিদ বই থেকে মুখ তুলে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “নীল পদ্ম কেন আনতে যাবো আমি?”

অরুণিকা তাহমিদের হাতে থাকা বইটি দেখিয়ে বলল, “এই বইটাই তো ছিলো তোমার হাতে। তুমি এটা পড়তে পড়তে বলেছিলে না?”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকার দিকে। পাশে বসে আছে তূর্য। সে চেয়ারে পা তুলে বসে বলল, “সারাদিন তো বইয়ের সাথেই কথা বলে এই ছেলে। তোমার সাথে কখন কথা বলার সময় পেলো, টুইংকেল?”

তাহমিদ কিছু একটা ভেবে বলল, “ওহ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম অরুর সামনে। কেউ কথা রাখে নি, কবিতাটি। কিন্তু শুধু একশো আটটি নীল পদ্মের কথায় মনে রাখলি, অরু?”

অরুণিকা মুখ কুঁচকে বলল, “তুমিই তো বললে তোমার কথা কেউ রাখে না। তাই আমি খুঁজতে গেলাম নীল পদ্ম। বরুণা যদি রাগ করে চলে যায়?”

তাহমিদ বই হাত থেকে নামিয়ে অরুণিকার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে এনে বলল, “বরুণা চলে গেলে তোর কি?”

“তুমি যে কষ্ট পাবে!”

“আমি কষ্ট পেলে তোর খুব কষ্ট হবে?”

“হ্যাঁ, আমি বকা খেলে, ব্যথা পেলে তুমি আর আরাফও তো কষ্ট পাও। আমাকে কেউ বকলেই তোমরা কষ্ট পাও। তাহলে আমি কষ্ট পাবো না?”

আরাফ আর তাহমিদ হাসলো অরুণিকার কথায়। অরুণিকার মাথায় হাত রাখলো দু’জনই। বলল, “তোকে দুঃখ ছুঁয়ে দিতেই পারবে না। তোর দুই ভাই এখনো বেঁচে আছে।”

………

অরুণিকা চোখ বন্ধ করলো। গড়িয়ে পড়লো চোখের কোণায় ভীড় করা অশ্রুমালা। পুরোনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে উঠে বসলো সে। বুকে হাত রেখে কাঁপা কন্ঠে বললো, “বেঁচেই তো আছো তোমরা। কোথায় এখন? আমার মনে এতো দুঃখ, কেউ তো আমাকে হাসাতে আসছো না? কোথায় ছিলে সেদিন, যেদিন আমার সবচেয়ে বেশি তোমাদের প্রয়োজন ছিল? আমি তো অনাথ হয়ে গেলামই, তোমরা আমাকে আরো নিঃস্ব করে দিয়েছো। কথা দিয়ে কথা না রাখা কেউ তোমাদের কাছ থেকেই শেখে। কেন আরাফ? কেন আমাকে এতো কষ্ট দিলে? তাহমিদ? তুমি কেন আমাকে এতো কষ্ট পেতে দিলে? আমার মাথা ছুঁয়ে মিথ্যে ওয়াদা কেন করেছিলে তোমরা? আমার কী অপরাধ ছিল? উলটো আমার সাথে আহনাফ যে অন্যায় করলো, তার বিচার কেউ করলো না। আমাকে ঠকিয়ে সবাই আজ সুখী। তাহলে কি যতোদিন আমার বাবা বেঁচে ছিলো, ততোদিনের সম্পর্ক ছিলো তোমাদের সাথে? রক্তের সম্পর্ক কি এমনই হয়? বাবার মৃত্যুতে বাবার সাথে সংযুক্ত সব সম্পর্ক কি মিথ্যে হয়ে যায়? যদি এমন হয়, তাহলে ইভান, তূর্য ওরা আমাকে এতো ঘৃণা করে কেন? ইভান তো আমাকে ছোট বোন বলতো। তূর্যের টুইংকেল ছিলাম আমি। ওদের সাথে তো রক্তের সম্পর্ক ছিলো না। তাহলে ওরা কেন আমাকে অপমান করলো? ওরা কেন আমাকে কষ্ট দিলো? ও বাড়ির ইমন ছাড়া সবাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট তো আহনাফ দিয়েছে আমাকে। আই হেইট ইউ, আহনাফ। আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছো তুমি। তুমি একটা কাপুরুষ। আমি তো তখন অবুঝ ছিলাম। আজ আমার সব বোঝার বয়স হয়েছে। মানুষ চিনেছি আমি। তুমি কতোটা জঘন্য, সেটা আমি আজ বুঝতে পারছি। বাট আই প্রমিস, তোমাকে আমি এর চেয়ে বেশি কষ্ট দেবো। আমার উপর মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তুমি যে তোমার উদ্দেশ্য পূরণ করেছো, তা আমি আজ বুঝেছি। একবার অন্তত সত্যটা স্বীকার করতে, আমি তোমার দিকে ফিরেও তাকাতাম না। তোমার মতো মানুষকে ভালোবেসেই তো নিজের প্রতি ঘেন্না হয় আমার। তোমাকে ভালোবাসার কলঙ্ক আমার হৃদয়ে এমন ভাবে গেঁথে গেছে, হাজার বার স্নান করলেও সেই কলঙ্ক আমার হৃদয় ছাড়বে না।”

(***)

বন্ধ জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফ। আরাফ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ তার দিকে তাকাতেই আরাফ বলল,
“তুই অরুকে যতোটা না ঘৃণা করিস, তোকে এর চেয়ে বেশি ঘৃণা করি আমি।”

আহনাফ শুকনো হেসে বলল, “তাহলে এখানে কেন এসেছিস? আমার সাথে এক ছাদ কীভাবে শেয়ার করছিস?”

“আমার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে আমি শান্ত হবো না।”

“আমিও আমার ভাইয়ের হত্যাকারীকে কখনো ক্ষমা করবো না।”

আরাফ আহনাফ দু’জন দু’জনের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এরই মধ্যে তাহমিদ আর ইমন আরাফের পাশে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ তাদের দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। অন্যদিকে তূর্য আর ইভান আহনাফের পাশে এসে দাঁড়াতেই আরাফ আপসোসের সুরে বলল, “তোরা দু’জনই প্রতারক।”

তূর্য বলল, “আহনাফ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি ওর সাথে সব সময় আছি।”

ইভান বলল, “যে অন্যায় করেছে তাকে ক্ষমা করা এতো সহজ না। সহজ হলে তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাকতি না, আরাফ!”

আরাফ বলল, “আর কতো শাস্তি দেবে এই ছেলে? কতো বড় শাস্তি দিয়েছে ও নিজেও জানে না।”

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “এর চেয়ে বেশি শাস্তি দেবো। যাতে পরবর্তীতে এমন কোনো অস্তিত্বের জন্মও না হয়।”

“ইউ আ’র ক্রেজি, আহনাফ।”

“সেইম টু ইউ, আরাফ।”

দু’জনের চোখে রাগ। উভয়ের হাত মুঠো হয়ে আছে। লালচে ফর্সা মুখে ভেসে উঠেছে রগ। যেন একে অপরের অনেক বছরের শত্রু।

চলবে–