#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১২ ||
কেন্টিনে বসে আছে অরুণিকা। তার হাতে একটি বই। অরুণিকার মনোযোগ সেই বইয়ের পাতায় স্থির। মৃদুমন্দ সমীরণ ছুঁয়ে দিচ্ছে অরুণিকার খোলা চুল। তার ঠোঁটে উজ্জ্বল হাসি। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো সে। কিন্তু পাশ ফিরে তাকালো না। এখনো বইয়েই তার পুরো মনোযোগ আটকে আছে। পাশের মানুষটি অরুণিকার দিকে ঘুরে বসলো। অরুণিকা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ দূরত্ব রেখে বসলো। তবুও পাশ ফিরে তাকালো না। তখনই পাশের মানুষটি বলে উঠলো, “তোমাকে লাল রঙে বেশ মানায়!”
অরুণিকা চমকে উঠলো। পাশ ফিরে দেখলো ইমান বসে আছে। ইমানের ঠোঁটে স্মিত হাসি। অরুণিকার খোলা চুলের নৃত্য উপভোগ করছে সে। দু’একটা চুল অরুণিকার নাকের ডগায় আশ্রয় নিতে যাবে, ইমান তখনই তা হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো। অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তাকালো ইমানের দিকে। চার চোখের মিলন ঘটলো শুধু। কেউ উচ্চারণ করলো না এক বাক্যও। ইমান অনেকক্ষণ ধরে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা এবার ইতস্ততবোধ করলো। সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো ইভান ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইভানকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে। ইমানও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। অরুণিকা ইমানকে উঠে আসতে দেখে বলল, “আপনি বসুন। আমার ক্লাস আছে।”
ইমান হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্লাস টাইম তো শুরু হয়েছে অনেক আগে। মাঝখানে গেলে তো বকা খাবে।”
অরুণিকা পাল্টা জিজ্ঞেস করলো, “আপনার ক্লাস নেই?”
“না, ফার্স্ট ক্লাস হচ্ছে না আজ। তোমাদের ফার্স্ট ক্লাস নেই?”
“আছে।”
“তো এখানে কি করছো?”
“বই পড়ছিলাম।”
“আমি কি বিরক্ত করলাম?”
“না, বই পড়তে পড়তেই সময় কখন চলে গেলো খেয়াল করি নি!”
“একটা গুড নিউজ আছে। জানো?”
“কেমন গুড নিউজ?”
ইমান অরুণিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ক্যাম্পাসে স্টুডেন্টদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করছে।”
“কবে থেকে?”
“এই কিছুদিনের মধ্যেই।”
“ভালো তো!”
ইমান মৃদু হেসে বলল, “এখন থেকে আমরা একসাথে যেতে পারছি।”
অরুণিকা ইমানের দিকে তাকাতেই ইমান চোখ সরিয়ে নিলো। অরুণিকা হঠাৎ আতংকিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “স্যারদের বাস আলাদা হবে তো?”
ইমান ভাবুক কন্ঠে বললো, “হয়তো শুরুতে সবাই একসাথেই যাবে। বাস কি এতোগুলো দেওয়া সম্ভব? রুট অনুসারে কয়েকটা দেবে। স্যার-ম্যামরা হয়তো সামনে, স্টুডেন্টরা পেছনে বসবে।”
অরুণিকা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “পেছনে বসলে তো ভালোই।”
“আমি কিন্তু তোমার জন্য খুশি হয়েছি।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “আমার জন্য কেন?”
“রুদবার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না তোমার।”
অরুণিকা মৃদু হাসলো। ইমান বইটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বইটা কি নিয়ে?”
অরুণিকা লাজুক হেসে বলল, “প্রেমের।”
ইমান বুকে হাত গুঁজে বলল, “তুমি প্রেমের গল্প পড়ো!”
“হ্যাঁ, সবই পড়ি।”
তাদের কথা মাঝ পথেই থেমে গেলো ইভানের আগমনে। ইভানকে দেখে ইমান সালাম দিলো। অরুণিকাও ইমানের দেখাদেখি সালাম দিলো। ইভান অরুণিকার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এখানে কি করছো?”
ইমান অবাক হয়ে তাকালো ইভানের দিকে। অরুণিকা ভীত কন্ঠে বললো, “নাস্তা করার জন্য বসেছি।”
“তোমার ক্লাস নেই?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “না।”
ইভান চোখ ছোট করে বলল, “আহনাফ কোন ব্যাচের ক্লাস নিচ্ছে তাহলে?”
অরুণিকা চমকে তাকালো ইভানের দিকে। ইমান একটু বিরক্ত হলো। মনে মনে ভাবলো, “এই স্যারের এতো মাথা ব্যথা কেন? তার কি কোনো অধিকার আছে স্টুডেন্টদের ক্লাস আছে কি-না জিজ্ঞেস করার? আমরা স্কুলে পড়ছি না-কি? অরুণিকাকে নিয়ে দেখছি খুব মাথা ব্যথা ইভান স্যারের! অরিয়েন্টেশনের দিন আমার সাথে যেতে দেয় নি, আর আজও!”
অরুণিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ। মাথা তুলে ইভানের ভয়ংকর চাহনি দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না সে। দ্রুত পায়ে চলে গেলো। এবার ইমানের দিকে আঁড়চোখে তাকালো ইভান। ইমান বিরক্ত মুখে অরুণিকার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ইমানের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “কিছু মেয়েদের কাছ থেকে দূরত্ব রাখা নিজের জন্য ভালো। হ্যাভ ইউ আন্ডারস্টুড?”
ইমান অবাক দৃষ্টিতে তাকালো ইভানের দিকে। ইভান চলে যেতেই আনমনে বিড়বিড় করতে লাগলো সে।
এদিকে ক্লাস শেষ করে এটেনডেন্স শিট হাতে নিয়ে অরুণিকার নামের পাশে শূন্য ঘর দেখে দাঁতে দাঁত পিষে বেরিয়ে পড়লো আহনাফ। ক্লাস থেকে বেরুতেই অরুণিকার মুখোমুখি হলো সে। ভ্রূ কুঁচকে আপাদমস্তক অরুণিকাকে দেখে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই হনহনিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লো অরুণিকা। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো আহনাফের। ওদিকে অরুণিকা ক্লাসে ঢুকতেই তাহসিন জিজ্ঞেস করলো, “কি রে তুমি কোথায় ছিলে?”
“কেন্টিনে।”
“ক্লাস করলে না যে?”
“ভালো লাগছিলো না।”
“আহনাফ স্যার আজ কতো কিছু পড়িয়েছেন।”
অরুণিকা মিনমিনিয়ে বলল, “ভালো হয়েছে, আমার কোনো শখ নেই ওই বেদ্দব স্যারের ক্লাস করার।”
(***)
তূর্য দাঁড়িয়ে আছে ডিপার্টমেন্টের সামনে। কোথা থেকে রুদবা এসে তূর্যের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। টাল সামলাতে না পেরে পেছনের দেয়ালে আশ্রয় খুঁজে নিলো তূর্যের পিঠ। রুদবা ভীত চোখে তাকিয়ে আছে তূর্যের দিকে। তূর্য ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রুদবাকে। রুদবা আমতা-আমতা করে বলল, “সরি, সরি। আমার কোনো দোষ নেই। আমি আপনাকে খেয়াল করি নি।”
তূর্য চোখ ছোট করে রুদবার দিকে তাকিয়ে বলল, “না-কি আমাকে খেয়াল করতে গিয়ে সিঁড়ির ধাপ মিস করেছো?”
রুদবা মাথা নামিয়ে বলল, “না স্যার, এমন কিছু না।”
তূর্য দুষ্টু হেসে বলল, “ইটস নরমাল।”
রুদবা তূর্যের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। তূর্য কিছু না বলেই চলে গেলো। রুদবা ঠোঁট কামড়ে হাসলো। আনমনে বলল, “ঠিক ধরেছেন, আপনাকে খেয়াল করতে গিয়েই তো সিঁড়ির ধাপ মিস করে ফেলেছি। প্রথম কাউকে ভালো লেগেছে, আর মানুষটা আমার সামনে! ইশ।”
রুদবা নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে হাসতে লাগলো। ওদিকে ক্লাস শেষ হতেই ব্যাগে বই ঢুকাতে লাগলো অরুণিকা। সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছে। শুধু অরুণিকা বাকি। সে বেরুনোর আগ মুহূর্তেই আহনাফ ক্লাসে ঢুকে পড়লো। আহনাফের বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো সে। এদিকে আহনাফ ক্লাসে ঢুকেই দরজা আটকে দিলো। অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। আহনাফ এবার বুকে হাত গুঁজে অরুণিকার দিকে এক পা এক পা করে এগুতে লাগলো। অরুণিকা আঙ্গুল তাক করে জোর গলায় বলল, “খবরদার, আমার সামনে আসবেন না।”
আহনাফ দাঁত চেপে বলল, “ক্লাস করিস নি কেন?”
অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “ভার্সিটিতে এমন প্রশ্ন করা মানায় না। ক্লাস করা না করা আমার চয়েজ।”
আহনাফ অরুণিকার গাল চেপে ধরে তাকে দেয়ালের সাথে সেঁটে ধরে বলল, “তোকে আমার ক্লাসও করতে হবে, আমার কথামতো চলতেও হবে। এটা আমার চয়েজ। যতোদিন আমার আছিস, ততোদিন আমার চয়েজেই তোর চয়েজ।”
অরুণিকা আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল, “সবখানে বল দেখাবেন না, আহনাফ চৌধুরী। একদম সোজা করে দেবো।”
আহনাফ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “একটুখানি মেয়ে আমাকে হুমকি দিচ্ছে?”
“হুমকি হলে হুমকি। আপনাকে ভয় পাই না আমি।”
“কেন ভয় পাস না? তোর আমাকে ভয় পাওয়া উচিত। তুই জানিস, আমি কি কি করতে পারি?”
“চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এবার আমার এক চুলও সরাতে পারবেন না। তখন বোকা ছিলাম, এখন শিক্ষা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি।”
আহনাফ অরুণিকার বাহু চেপে ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকা আহনাফের হাত সরানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। আহনাফ হুট করে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে শূন্যে উঠিয়ে নিলো। অরুণিকা শক্ত করে আহনাফের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, “কি করছো, আহনাফ?”
আহনাফ বাঁকা হেসে ছেড়ে দিলো অরুণিকাকে। হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ায় নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারলো না সে। উল্টে পড়তে গেলো মেঝেতে, তখনই আহনাফ তার হাত ধরে ফেললো। অরুণিকা ভীত চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। সেও শক্ত করে চেপে ধরলো আহনাফের হাত। আহনাফ ঠোঁট কামড়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচালো। অরুণিকা এবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে যাবে, তখনই আহনাফ আবার হাত আলগা করে দিলো। অরুণিকা শক্ত করে আহনাফের হাত ধরে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এমন করছো কেন, আহনাফ?”
আহনাফ হুট করে অরুণিকাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। অরুণিকার মুখটা আহনাফের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। আর সাথে সাথেই নাকে এসে লাগলো সেই পরিচিত ঘ্রাণ। অরুণিকা আবেশে চোখ বুজলো। আহনাফ অরুণিকার বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে অরুণিকার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “শিক্ষা নিয়েও লাভ হলো না। সোজা হয়ে এখনো দাঁড়াতে শিখলি না। দেখেছিস, আমি চাইলেই তোকে উল্টে দিতে পারবো।”
অরুণিকা চোখ খুলে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ রাগী স্বরে বলল, “ইমানের সাথে গল্প করা আমার ক্লাস করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল?”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। আহনাফ অরুণিকাকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসে বলল, “আজ তুই আমার ক্লাস করেই যাবি। এখানে তোকে কেউ দেখতে আসবে না। ক্লাস ছুটি। ক্যাম্পাস ফাঁকা। শুধু তুই আর আমি, আর এই ফাঁকা ক্লাসরুম। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাস আমার সামনে বসেই করবি তুই।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক দৃষ্টিতে। আহনাফের হাত কাঁপছে। সে কাঁপা হাতে মার্কার হাতে নিয়ে হোয়াইট বোর্ডে বড় বড় করে লিখলো, স্পিকিং ক্লাস। মারাত্মক রেগে গেলে আহনাফের হাত কাঁপে। এই মুহূর্তে ভয়ে অরুণিকার গলা শুকিয়ে গেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “এদিকে আয়।”
অরুণিকা আহনাফের এক ধমকে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ হুট করেই অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে কোলে উঠিয়ে টেবিলের উপর বসিয়ে দিলো। অরুণিকার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো তার। আহনাফ টেবিল টেনে আনলো হোয়াইট বোর্ডের কাছে। দু’জনের মাঝে দূরত্ব সামান্য। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “বোর্ডে কি লিখেছি?”
অরুণিকা ঢুক গিলে বলল, “স্পিকিং ক্লাস!”
“অন হোয়াট টপিক?”
“আই ডোন্ট নৌ।”
“হোয়াই?”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। আহনাফ বোর্ডে কিছু একটা লিখে বলল, “হোয়াট হ্যাভ আই রিটেন নাউ?”
অরুণিকা চোখ তুলে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। আহনাফ অরুণিকার দিকে ঝুঁকে দাঁড়াতেই অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বললো, “বলছি, বলছি।”
আহনাফ মৃদু হাসলো। অরুণিকা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, “উইন্টার নাইট।”
আহনাফ দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, “ইটস ইন্টারেস্টিং টপিক, ইসেন্ট?”
অরুণিকা চোখ ছোট করে মিনমিনিয়ে বলল, “কচুর ইন্টারেস্টিং! বজ্জাত বেটা, ইচ্ছা করে এই টপিক নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে।”
আহনাফ অরুণিকার ঠোঁটে হাত রাখতেই অরুণিকা কেঁপে উঠলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “মিনমিন করে কি বলছো? ক্লাসে মনোযোগ দাও।”
অরুণিকা আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “ওকে স্যার।”
আহনাফ বুকে হাতে গুঁজে বলল, “ওকে, হোয়াট কামস টু ইউর মাইন্ড হোয়েন ইউ থিংক অব এ উইন্টার নাইট?”
অরুণিকা থমথমে কন্ঠে বলল, “দা কোল্ড ওয়েভ এন্ড দা ক্রুয়েল নাইট ডেস্ট্রয় মাই লাইফ।”
“ইয়েট, ইটস স্পেশাল ফর ইউ।”
অরুণিকা জোর গলায় বলল, “নেভার।”
“ইউ মিস দ্যাট নাইট।”
অরুণিকা বিরক্তমুখে বলল, “তোমার উইন্টার এন্ড তোমার স্পিকিং ক্লাস তোমার কাছে রাখো। এই ফালতু ক্লাস করবো না আমি।”
আহনাফ শান্ত স্বরে বলল, “বলো, উইন্টার নাইট নিয়ে যদি কাল দশটা সেনটেন্স বলতে বলি, পারবে? আমি তোমাকে কী-ওয়ার্ড দিচ্ছি। ইটস কোয়াইটনেস। মানে নিস্তব্ধতা।”
অরুণিকার চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক নিস্তব্ধ বাড়ি, যেখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দু’টি মানুষ। এক জোড়া চোখের নিভু নিভু চাহনি মিলিত হচ্ছে আরেক জোড়া চোখের কৌতূহলের সাথে। আহনাফ ফিসফিস করে বলল, “সেকেন্ড কী-ওয়ার্ড..”
অরুণিকা আহনাফের মুখ চেপে ধরে জোর গলায় বলল, “প্লিজ, আহনাফ, প্লিজ। আমি এসব মনে করতে চাই না। কেন বারবার এসব মনে করিয়ে দিতে চাও আমাকে? তুমি যেই ভুল করেছো, সেটা তো তুমি মেনেই নিয়েছো। সেই ভুলের শাস্তি আমাকে আর কতো দেবে তুমি? কিছু ভুল ভুলে যাওয়া ভালো।”
আহনাফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা টেবিল থেকে নেমে পড়লো। আহনাফ তার হাত ধরে ঠান্ডা গলায় বলল, “পঁয়তাল্লিশ মিনিট এখনো শেষ হয় নি।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ আবার তাকে কোলে নিয়ে বসিয়ে দিলো টেবিলের উপর। এরপর ঝুঁকে দাঁড়ালো অরুণিকার দিকে। তার দু’হাত অরুণিকার দু’পাশে। অরুণিকা নড়াচড়া করার সুযোগটাও পাচ্ছে না। এদিকে টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অরুণিকার দিকে। আর এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট অস্বস্তি নিয়ে বসে ছিল অরুণিকা। থেমে থেমে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। আহনাফের গায়ের ঘ্রাণটা বারবার নাকে এসে ঠেকছে। ভীষণ এলোমেলো লাগছে অরুণিকার। ওদিকে আহনাফ একটু পরপর হাত এগিয়ে দিয়ে তার চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিচ্ছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পার হতেই আহনাফ সরে দাঁড়ালো। অরুণিকা দ্রুত নেমে ব্যাগ নিয়ে দরজার কাছে যেতেই আহনাফ বলল, “কাল থেকে চুল বেঁধে আসিস।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে ফিরে তাকালো। আহনাফ মৃদু হেসে বলল, “আমি ছাড়া অন্য কেউ তোর চুল সরাবে এটা আমি সহ্য করবো না। আর ক্লাস মিস দিলে এভাবেই বসিয়ে রাখবো আমার সামনে। সহ্য করতে পারবি তো আমাকে বেশিক্ষণ? মরে যাবি না তো আবার?”
অরুণিকা কোনো উত্তর দিলো না। দরজা খুলে দৌঁড়ে বেরিয়ে পড়লো ক্লাস থেকে। এরপর করিডর পার করে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো, যেন এক্ষুণি আহনাফ তাকে ধরে ফেলবে। এদিকে আহনাফ বোর্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শব্দ করে হাসলো। এরপর বোর্ডে লেখা উইন্টার নাইট শব্দ দুইটি হাত দিয়ে মুছে বলল, “তোকে এই ভুল কখনোই ভুলতে দেবো না আমি।”
ঠোঁট কামড়ে এটেনডেন্স শিট হাতে নিয়ে অরুণিকার নামের পাশের খালি ঘরটিতে দাগ দিয়ে বলল, “এক সেকেন্ডের অনুপস্থিতি তোকে এক যুগ আমার কাছে ধরে রাখবে। ইটস মাই প্রমিজ।”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১৩ ||
“অরু, কোথায় ছিলি তুই?”
রুদবার প্রশ্নে ঘাবড়ে গেলো অরুণিকা। রুদবা পুনরায় জিজ্ঞেস করতেই অরুণিকা আমতা-আমতা করে বলল, “ওয়াশরুমে আটকে ছিলাম।”
“কি বলছিস? তোকে প্রত্যেকটা ওয়াশরুমে খুঁজে এসেছি আমি।”
অরুণিকা কি বলবে বুঝতে পারছে না। রুদবা এখনো আহনাফের ব্যাপারে কিছুই জানে না। জেনে গেলে কি মনে করবে রুদবা? তখনই আহনাফ অরুণিকার পেছনে এসে দাঁড়ালো। রুদবা আহনাফকে দেখেই সালাম দিলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে রুদবার দিকে তাকালো। এরপর রুদবার চোখ অনুসরণ করে পিছু ফিরে দেখলো আহনাফ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা চোখ ছোট করে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ পকেটে হাত গুঁজে বাঁকা হেসে বলল, “অরুণিকা আমার সাথে ছিল!”
আহনাফের কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালো অরুণিকা। রুদবাও অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। অরুণিকা রুদবার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, তখনই আহনাফ বলল, “এক্সট্রা ক্লাস করছিল।”
কথাটা বলেই ভ্রূঁ নাচিয়ে চলে গেলো আহনাফ। রুদবা অরুণিকার হাত টেনে ধরে বলল, “স্যার কি বললো এটা?”
অরুণিকা চোখ নামিয়ে বলল, “মিথ্যুক লোক।”
“অরু, স্যারটা কি তোকে বিরক্ত করছে?”
অরুণিকা রুদবার হাত ধরে বলল, “তুই যা ভাবছিস তা না।”
“কিন্তু এভাবে কেউ কথা বলে? তাও আবার স্যার হয়ে? আমাকে বল, কি হয়েছে।”
“আহনাফ আমার কাজিন।”
রুদবা অবাক কন্ঠে বলে উঠলো, “কি?”
“হ্যাঁ, এজন্য মজা করে বলেছে এ কথা।”
“তুই আমাকে একবারও বললি না স্যার তোর কাজিন!”
“তুই তো জানিস, আমার ওদের সাথে যোগাযোগ নেই।”
“তাহলে? স্যার তোকে জ্বালাচ্ছে না তো?”
অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “না, না। ওরকম কিছু না।”
“দেখ, আমাকে সত্য কথা বল। যদি বিরক্ত করে ডিন স্যারকে বলে দেবো। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে?”
অরুণিকা রুদবার হাত ধরে মৃদু হেসে বলল, “এমন কিছুই না। জাস্ট ফাজলামো করেছে। চল, বাসায়।”
“এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্য। চল তাড়াতাড়ি। ক্ষিধে লেগেছে আমার অনেক।”
(***)
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির ছাঁট চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে রুহানি। বৃষ্টির সাথে যোগ হয়েছে দমকা হাওয়া। দু’হাত প্রসারিত করে বৃষ্টি উপভোগ করছে সে। হঠাৎ হাতে কারো স্পর্শ পেতেই চোখ খুললো রুহানি। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে লজ্জায় নুইয়ে পড়লো সে। হঠাৎ খেয়াল করলো তার হাতে একটি কাঠগোলাপ। রুহানি কাঠগোলাপটি দেখে লাজুক হেসে সামনে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমাদের ছাদে?”
তূর্য বুকে হাত গুঁজে বলল, “দূরে দাঁড়িয়ে এমন চমৎকার দৃশ্য দেখার চেয়ে কাছে এসে দেখা ভালো।”
রুহানি চকিত দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুম?”
তূর্য মুচকি হেসে বলল, “হুম। একটা মেয়ে কি চমৎকার ভাবে বৃষ্টি বিলাস করছিল! আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে পারলাম না।”
ইমন তূর্যের পেছনে দাঁড়িয়ে তার বাহুতে ঘুষি মেরে চাপা স্বরে বলল, “সব জায়গায় ফ্লার্ট করতে হয় তোর?”
এদিকে রুহানি লজ্জা পেয়ে ছাদ থেকে নামতে যাবে তখনই আরাফকে দেখে থমকে গেলো। আরাফ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “অরু কোথায়?”
“মানে?”
“অরু এখনো বাসায় ফিরে নি?”
রুহানি বুকে হাত গুঁজে বলল, “আমার সিস্টারকে নিয়ে আপনি এতো ভাবছেন কেন? আমি এখনো জীবিত আছি।”
আরাফ কিছু বলতে যাবে, তাহমিদ তার বাহু চেপে ধরে বলল, “শান্ত হ।”
রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “উনি আর শান্ত? দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেমন জালিম!”
আরাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “শাট আপ।”
রুহানি আরাফকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে হনহনিয়ে নামতে যাবে তখনই আরাফ তার হাত ধরে বলল, “অরু এখনো বাসায় ফিরে নি।”
রুহানি আরাফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো আর বিরক্ত মুখে বলল, “আপনার কি আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই?”
আরাফ হুট করে ছেড়ে দিতেই রুহানি টাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নেবে তখনই তূর্য তাকে ধরে ফেললো। তূর্যের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো রুহানি। তূর্য তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছো?”
রুহানি তূর্যের দিকে তাকিয়ে আবার লাজুক হাসলো। তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “অরু ভার্সিটি থেকে এখনো আসে নি, তুমি জানো?”
রুহানি তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কথা হয়েছে আমার সাথে। ওই শয়তানটা ওকে আটকে রেখেছিল না-কি।”
“মানে?”
রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আহনাফ স্যার!”
আরাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত পিষে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাকে বলিস নি কেন?”
তূর্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আমি তো অনেক আগেই ক্যাম্পাস থেকে চলে এসেছি। ইভানকে জিজ্ঞেস কর।”
রুহানি বলল, “আমি বুঝলাম না, অরুকে নিয়ে হুট করে এতো ভাবছেন কেন আপনারা?”
আরাফ রুহানির দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “তুমি জানো কি হচ্ছে রাস্তায়?”
রুহানি বুকে হাত গুঁজে বলল, “হ্যাঁ, বৃষ্টি হচ্ছে। একটু ভিজবে আর কি? তো?”
“বোকা মেয়ে, মারামারি হচ্ছে।”
রুহানি চমকে উঠলো। গালে হাত দিয়ে বলল, “এজন্যই আমি যখন ফোন করেছিলাম, তখন এতো চেঁচামেচির শব্দ হচ্ছিলো?”
রুহানির কথা শুনে তাহমিদ, তূর্য, ইমন আর আরাফ একসাথেই বলে উঠলো, “কি? তার মানে ওদের গাড়ি গন্ডগোলে আটকা পড়েছে?”
তারা চারজনই রুহানিকে পাশ কেটে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো। রুহানি নিজের গালে নিজেই চড় মেরে বলল, “অরু বিপদে আছে, আর আমি এখানে বৃষ্টিতে রংঢং করছিলাম?”
রুহানি তাড়াতাড়ি বাসায় এসে কাপড় পাল্টে পাশের বাসায় বেল বাজালো। অনেকক্ষণ বেল দেওয়ার পর ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুললো ইমান। রুহানির কান্নাভেজা চাহনি দেখে ঘুম উড়ে গেলো তার। সে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
“আপনি এখানে? আপনি ক্লাসে যান নি?”
“হ্যাঁ, চলে এসেছি অনেক আগে।”
“অরু আসে নি এখনো।”
“কি বলছো? ফোন করো নি?”
“কথা হয়েছিলো একবার। কিন্তু এখন ফোন বন্ধ।”
“রুদবাকে কল করো।”
“ওর ফোনও বন্ধ।”
“কি বলছো? হঠাৎ কি হয়েছে!”
“রাস্তায় মারামারি হচ্ছে না-কি?”
এমন মুহূর্তে ফয়েজ আলম ঘরে ঢুকলেন। দরজার কাছে রুহানিকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “মা, তুমি এখানে?”
রুহানি ভেজা কন্ঠে বললো, “আংকেল, আমার বোন এখনো আসে নি তাই উনাকে জিজ্ঞেস করছি, ক্লাসে গিয়েছে কি-না!”
“কি বলো? রাস্তায় তো অনেক ঝামেলা হচ্ছে।”
ইমান ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হচ্ছে? আমি যখন এলাম সব তো ঠিক ছিল।”
“এখন হচ্ছে। দলে দলে মারামারি। রাস্তায় অনেক জ্যাম। আমি তো গাড়ি একপাশে রেখে চলে এসেছি। পুলিশ টিয়ার শেল ছুঁড়ছে।”
রুহানি মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফয়েজ আলম রুহানিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা কি করছে?”
“ঘুমাচ্ছে।”
“একদম চিন্তা নেই দেখছি। প্রতিবারই তুমি তোমার বোনের চিন্তায় অস্থির হয়ে যাও।”
রুহানি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইমান বলল, “আমি যাচ্ছি ণিকাকে খুঁজতে।”
ফয়েজ আলম ছেলেকে থামিয়ে বললেন, “একদম না। এই অবস্থায় তোমাকে আমি বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি না। যাও, নিজের ঘরে যাও।”
ফয়েজ আলম রুহানির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। রুহানির চোখ ছলছল করে উঠলো। ভীষণ অভিমান হলো তার। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “আমি তো আংকেলটাকে ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু কেমন বেয়াদ্দব! এভাবে মুখের উপর দরজা বেঁধে দিলো? লাগবে না কারো হ্যাল্প। আমি একাই যাবো। ঘুমাক আমার মা নাকে তেল দিয়ে। ঘুমকাতুরে একটা।”
রুহানি বাসায় এসে কিছু টাকা হাতে নিয়ে দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে চলে গেলো।
(***)
রুদবা আর অরুণিকা রিকশায় বসে আছে। আশেপাশে মানুষ ছোটাছুটি করছে। রুদবা মাথায় হাত দিয়ে বলল, “কেন দেরী করলি অরু? বাসায় কীভাবে যাবো এখন?”
অরুণিকা বিরক্তমুখে বলল, “আর এই লোকগুলোর বৃষ্টির মধ্যেও শান্তি নেই? ঝড়-ঝাপটা দেখে মানুষ বাসায় বসে খিচুড়ি খায়। আর এরা রামদা নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে?”
“বেশি কথা বলিস না। আমাকে মা নিষেধ করেছিল আজ বের হতে। কাল থেকেই এরকম কিছু একটা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।”
“ধুর, এমন ফালতু পলিটিক্স মানুষ করে কেন?”
“এসব বলে লাভ নেই। আগে বাসায় যাই।”
তাদের কথার মাঝখানে কিছু মানুষদের তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে রিকশাওয়ালা তাদের বললেন, “আপনারা নাইমা যান। সামনে যাইতে পারমু না আর। অন্য জায়গায় চইলা যান। রাস্তাঘাট ঠান্ডা হইলে বের হইয়েন।”
রিকশাওয়ালা তাদের নামিয়ে দিতেই রুদবা বলল, “একটা ছাতাও নেই। এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবো?”
বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য রুদবা অরুণিকাকে নিয়ে পাশের দোকানের ছাউনির দিকে যেতে লাগলো, তখনই বিক্ষোভকারীদের একটা দল তাদের দিকেই আসতে লাগলো। তাদের দেখে পথে থাকা পথচারীরা দৌঁড়াতে লাগলো। রুদবা খেয়াল করলো বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠি, ধারালো অস্ত্র। তারা যেদিকেই যাচ্ছে গাড়ি ভাংচুর করছে, আর আশেপাশের মানুষদের পেটাচ্ছে। রুদবা আর অরুণিকা তাদের দেখে এবার বাকিদের মতো ছুটতে লাগলো। কিছুদূর গিয়ে মানুষের ধাক্কায় তারা আলাদা হয়ে গেলো। রুদবা দ্রুত তার ব্যাগ নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়লো। এদিকে অরুণিকা আশেপাশে রুদবাকে খুঁজতে লাগলো। মাথা কাজ করছে না তার। কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশের দৌঁড়ানি খেয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে আসছিলো। তাদের হাতে পিস্তল দেখে অরুণিকা ঘাবড়ে গেলো। সে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে শূন্য পথে দৌঁড়াতে লাগলো। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে। পিচঢালা রাস্তার সাথে ঘষা লাগায় তার কনুই থেঁতলে গেলো। অরুণিকা কাঁপা হাতে নিজেকে উঠিয়ে পেছন ফিরে দেখলো লোকগুলো তার দিকেই আসছে। বৃষ্টির তেজ বাড়লো। অরুণিকা বৃষ্টির ঝাপটায় একদম নুইয়ে পড়ছিলো। সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই হঠাৎ কেউ একজন এসে পাঁজা কোলা করে তুলে নিলো তাকে। আর দৌঁড়াতে লাগলো অন্য রাস্তা ধরে। অরুণিকা বৃষ্টির ছাঁটের জন্য চোখ খুলতে পারছে না। কোলে থাকায় বৃষ্টি একদম তার মুখের উপর এসে পড়ছে। কিছুদূর গিয়ে মানুষটা তাকে কোল থেকে নামিয়ে কোমড়ে হাত রেখে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগলো। অরুণিকা ঝাপসা চোখে মানুষটির দিকে তাকিয়ে নিজেও জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই হাঁপাচ্ছিস কেন? তোর মতো হাতিকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াতেই জান বের হয়ে গেছে আমার।”
অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “তোমার জন্যই আমি এখানে আটকে গেছি, মিস্টার আহনাফ চৌধুরী। আমাকে এক ঘন্টা বসিয়ে না রাখলে আমি আরো আগে বাসায় পৌঁছাতাম।”
আহনাফ নিজের চুল নিজেই খামচে ধরে পাশ ফিরে তাকালো। দেখলো কিছু লোক এদিকে আসছে। আহনাফ অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে একপাশে নিয়ে এলো। অরুণিকার মাথা আহনাফের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। তার হৃদস্পন্দন শুনেই হাত পা শিউরে উঠছে অরুণিকার। সে খামচে ধরলো আহনাফের ভেজা শার্ট। আহনাফ অরুণিকার স্পর্শ পেতেই তার থুতনি অরুণিকার মাথায় ঘষে বলল, “ভয় পাচ্ছিস?”
অরুণিকা মাথা উঠিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। লেখকের লেখনীতে বৃষ্টিভেজা নারীর সৌন্দর্য পড়েছে সে৷ কিন্তু আজ বৃষ্টিস্নাত পুরুষকে দেখছে। এই অনুভূতি কোনো বইয়ের পাতায় পড়ে নি সে। কিন্তু নিজেকেই এই মুহূর্তে লেখক মনে হচ্ছে তার। নিজের মনের ডায়েরিতে লিখে ফেলছে বৃষ্টিস্নাত প্রেমিকের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। বৃষ্টির শব্দের সাথে যুক্ত হওয়া হৃদস্পন্দন। বৃষ্টিস্নাত প্রেমিকের ভেজা চুল, নাকের ডগায় জমে থাকা জলের কণা, ভেজা চোখের পাপড়ি, ঠোঁট চেপে পানির প্রবাহ রোধ করা। আহনাফ অরুণিকার কোমড় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “গিলে খাচ্ছিস আমাকে রাক্ষসীর মতো!”
অরুণিকা চোখ সরিয়ে নিতেই আহনাফ মৃদু হেসে বলল, “এখনো ভালোবাসিস আমাকে।”
অরুণিকা আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আহনাফ পেছন থেকে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে তার থুতনি অরুণিকার কাঁধে রেখে বলল, “সত্য অনেক কড়া আর তিতে হয়। এই যেমন তুই আমাকে এখনো ভালোবাসিস, এটা অনেক কড়া সত্য। আর এটা শুনতেও তোর তিতে লাগবে যে আমি তোকে ভালোবাসি না।”
অরুণিকা আহনাফের কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার মোটেও তিতে লাগছে না। বরং আমার শুনে অনেক শান্তি লাগছে। ফাইনালি আমাদের পথ ভিন্ন হবে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা বলল, “চাচ্চু বলেছিল, আমার পঁচিশ হলেই তোমার সাথে আমার ডিভোর্সের কথাবার্তা শুরু হবে। আর মাত্র চার বছর।”
“আঠারো হয়েই গেছে। রাষ্ট্রীয় বিধানে তুই এখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবি। পঁচিশে কি আসে যায়! বাবা ভেবেছিল ম্যাচিউওর বয়সে সিদ্ধান্ত নিলে কোনো রিগ্রেট থাকবে না। তোকে দেখে মনে হচ্ছে এখনি যথেষ্ট ম্যাচিউওর হয়ে গেছিস।”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “আচ্ছা? বাল্যবিবাহের সময় সেই বিধান তো কারোই মনে ছিল না।”
“মরার পর তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করিস। আমি তো কাউকে বলি নি তোকে বিয়ে করবো? একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে আর কি! তাই বলে সেই এক্সিডেন্টের ভার আর কতোদিন?”
অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “খুব অস্থির হয়ে যাচ্ছো দেখছি? ঠিক আছে, সমস্যা নেই। এখুনি চাইলে এখুনি হবে। আমি বাসায় ফিরেই মামার সাথে কথা বলবো। এই সম্পর্ক ভেঙে গেলেই তোমার অত্যাচার থেকে মুক্ত হবো আমি।”
আহনাফ অরুণিকার হাত মুড়ে দাঁত চেপে বলল, “তোকে এতো সহজে ছাড়ছি না আমি। একটু বললাম, ব্যস মামাকে বলার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিস? তোকে আমি ছাড়বো সেই সৌভাগ্য এখনো তোর হয় নি।”
“একটা মানুষ, অথচ দু’ধরণের কথা। তুমি কি সুস্থ না-কি পাগল?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “বলো, কি করতে চাও তুমি আমার সাথে?”
আহনাফ বাঁকা হেসে অরুণিকার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমার ভাইয়ের সাথে তুই যা যা করেছিস, এর শাস্তি এখনো পাওয়া বাকি।”
অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বললো, “তুমি আমাকে কখনো ভালোইবাসো নি, আহনাফ। সব তোমার স্বার্থ ছিল। আমার কাছে আসাও সেই স্বার্থের অংশ। মানুষ কতোটা জঘন্য হয়, সেটা তোমাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।”
“আজিব, তুই ইঁচড়েপাকা হলে আমার কি দোষ?”
অরুণিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। বৃষ্টির পানির সাথে মিশে গেলো সেই জল। অরুণিকা মনে মনে ভাবতে লাগলো, “তোমার মধ্যে এতোটুকু মনুষ্যত্ববোধ নেই আহনাফ? আমার অনুভূতি নিয়ে আর কতো তামাশা করবে তুমি? সত্যিই যদি আমি তোমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দেই, কি করবে তখন?”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১৪ ||
রাস্তায় এলোমেলো ভাবে হাঁটছে রুদবা। সে শূন্য দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অরুণিকাকে খুঁজতে লাগলো। হুড়োহুড়িতে অরুণিকাকে হারিয়ে ফেলেছে সে। মেয়েটা তো গাড়ি ভয় পায়। এখন কোথায় গেলো কে জানে? হঠাৎ রুদবার সামনে একটা মোটরসাইকেল এসে থামলো। মোটর সাইকেল দেখে ভয়ে রুদবার হাত থেকে তার ব্যাগটা পড়ে গেলো। সে সাথে সাথেই তার ব্যাগটা কুঁড়িয়ে নিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। হেলমেট পরা যুবকটি তার হেলমেট খুলে রুদবার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। রুদবা হুমড়ি খেয়ে পড়লো তার বুকের উপর। অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টি স্বস্তির আশ্রয় পেলো যেন। বিনা অনুমতিতে রুদবা জড়িয়ে ধরলো সেই মানুষটিকে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। মানুষটি রুদবার পিঠে হাত রাখতে গিয়ে থেমে গেলো। রুদবা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “অরুকে হারিয়ে ফেলেছি আমি।”
কথাটি শুনেই তূর্যের হাত মুঠো হয়ে এলো। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রুদবাকে। রুদবা আচমকা ধাক্কা খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে অবাক চোখে তাকালো তূর্যের দিকে। তূর্য মোটর সাইকেল থেকে নেমে চেঁচিয়ে বলল, “ওকে হারিয়ে ফেলেছো মানে কি? তুমি এতোটা ইরেস্পন্সিবল!”
রুদবা এখনো অবাক হয়ে তূর্যকে দেখছে। আর মনে মনে ভাবছে, “আমি আমার ফ্রেন্ডকে খুঁজে পাচ্ছি না, অথচ আমার চেয়ে তার মাথা ব্যথা বেশি! কেন?”
তূর্য রুদবার হাত মুড়ে ধরতেই ইমন আর আরাফ মোটরসাইকেল নিয়ে তাদের সামনে এসে থামলো। ইমন মোটর সাইকেল থেকে নেমে তূর্যকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “পাগলামো করছিস কেন তূর্য?”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর বেস্ট ফ্রেন্ডকে বল, অরুকে খুঁজে এনে দিতে।”
তূর্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সব কিছুতে আহনাফকে কেন টেনে আনিস?”
“ওর জন্য অরু এখনো বাসায় পৌঁছে নি।”
রুদবা ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “হ্যাঁ, আহনাফ স্যারই তো ওকে আটকে রেখেছিল।”
রুদবার কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো তূর্য। ইমন বলল, “দেখছিস কি বলছে? তোদের প্রফেশনালিজমই নেই। স্যার স্যারের মতো থাকবি। ওখানেও তোর বন্ধুর রেষারেষির শেষ হচ্ছে না।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তোদের অরু কোনো বাচ্চা মেয়ে না। আহনাফ যা বলবে তা করতে হবে কেন ওর?”
“আচ্ছা? তুই পারিস আহনাফ যা বলে তা না করে থাকতে? ওর কথা শুনে রেষারেষি তো তুইও কম করছিস না। তাহলে ওই বাচ্চা মেয়েটা কীভাবে তোর ফাজিল বেস্ট ফ্রেন্ডকে সামলাবে?”
রুদবা অবাক হয়ে ইমন আর তূর্যের বাগবিতণ্ডা দেখছে আর মনে মনে ভাবছে, “অরুকে নিয়ে ওরা এতো ঝগড়া করছে কেন?”
এদিকে অরুণিকা ভেজা কাপড়ে হেঁটে হেঁটেই সামনে চলে যাচ্ছে। আহনাফ তার পিছু হাঁটছে আর তাকে ডাকছে। অরুণিকা শুনেও না শোনার ভান ধরে আছে। আহনাফের এবার রাগ বাড়লো। সে চেঁচিয়ে বলল, “অরু দাঁড়া।”
অরুণিকা কানে নিলো না। সে নিজের মতোই হাঁটতে লাগলো। আহনাফ এবার দ্রুত হেঁটে অরুণিকার কাছে আসতে লাগলো। অরুণিকা বুঝতে পেরে দ্রুত হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু আহনাফের সাথে পেরে উঠলো না। আহনাফ শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে রাগী স্বরে বলল, “ধিনধিনিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
অরুণিকা বিরক্তির সুরে বলল, “অন্ধ তুমি? দেখছো না?”
“আমাকে ভালোবাসতে ভালোবাসতে একদম বেহায়া হয়ে গেছিস দেখছি।”
আহনাফের কথায় একটু কষ্ট পেলো অরুণিকা। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তোমাকে ভালোবাসার সময় নেই আমার।”
“নিজের দিকে তাকানোর সময় আছে?”
“মানে?”
আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে বলল, “না-কি আমাকে কাছে পেয়ে নিজেকেই ভুলে গেছিস!”
“হেঁয়ালি না করে কি বলবে বলেই ফেলো।”
“বোকা, নিজের দিকে তাকা একবার। ভেজা কাপড়ে রাস্তায় হাঁটছিস কেন? নায়িকা না-কি তুই?”
অরুণিকা নিজের ভেজা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে ওড়না গলা থেকে নামিয়ে নিজেকে সেই ভেজা ওড়না দিয়ে ঢাকতে যাবে, তখনই আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বাদ দে। এই পাতলা ওড়না দিয়ে আরো হাইলাইট করিস না নিজেকে।”
অরুণিকা আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “কথাটা ভদ্র ভাষায়ও বলা যায়।”
“তোর মতো মেয়েদের সাথে এই ভাষাটায় যায়।”
অরুণিকা চমকে তাকালো আহনাফের দিকে। সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো। এরপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আর কতো ইনসাল্ট করবে আমাকে?”
“তোর ইনসাল্টও হয়?”
“শাট আপ, আহনাফ। আমার তোমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। তুমি আমাকে যেভাবে পয়েন্ট করছো, মনে হচ্ছে আমি কোনো রাস্তার মেয়ে। খবরদার, আমাকে আর একটাও বাজে কথা বলবে না।”
আহনাফ বুকে হাত গুঁজে বলল, “কি করবি বললে?”
অরুণিকা বাঁকা হেসে বলল, “এখনো বিয়ে করা বউ তোমার। এমন ফাঁসানো ফাঁসাবো তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী জেলের ভাত খাবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
আহনাফ অট্টহাসি হেসে বলল, “একটুখানি মেয়ে আমাকে ধমকাচ্ছে? ইন্টারেস্টিং।”
অরুণিকা আহনাফকে উপেক্ষা করে সামনে হাঁটতে লাগলো। আহনাফ তার পথ রোধ করে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
অরুণিকা থমথমে কণ্ঠে বলল, “বাসায় যাচ্ছি।”
“দাঁড়া, আমি রিক্সা দেখছি।”
“ওহ, এক্সকিউজ মি, তোমার হ্যাল্প লাগবে না আমার।”
আহনাফ অরুণিকাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “এবার একদম সেইফ তুই।”
অরুণিকা আহনাফের গালে খামচি দিয়ে বলল, “লোকজন দেখলে কি বলবে?”
“বলবে, স্বামী তার অবাধ্য বউকে শায়েস্তা করছে।”
“আমি তোমার বউ না।”
“ইন ইউর ইমেজিনেশন।”
আহনাফ একটা রিকশা ঠিক করে অরুণিকাকে সেই রিকশায় বসিয়ে নিজেও উঠে বসলো। এরপর রিকশার হুড তুলে অরুণিকার সামনে হাত রাখলো। অরুণিকা তার হাতটা চেপে ধরে বলল, “আমার সামনে হাত দিয়ে রেখেছো কেন? অস্বস্তি লাগছে। হাত সরাও।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “সুতির ওড়না পরে বের হতে পারিস না?”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “এতো কনসার্ন দেখাতে হবে না তোমার।”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “আমার হক নষ্ট করবি না, বেয়াদব মেয়ে।”
অরুণিকা বিষ্মিত হলো আহনাফের কথায়। আহনাফ এবার শীতল কন্ঠে বলল, “তোকে এমন অবস্থায় দেখলে যে-কেউ বাজে কমেন্ট করবে।”
অরুণিকা ভ্রূ নাচিয়ে বলল, “আর তুমি যে করো ওটা? হুম?”
“আমারটা কমপ্লিমেন্ট ভেবে নিস।”
অরুণিকা হেসে বলল, “তোমার মাথায় নিশ্চিত সমস্যা আছে।”
“ভালো।”
অরুণিকা আহনাফের শুকনো উত্তরে আরো অবাক হলো। ভাবতে লাগলো, “হঠাৎ এতো শান্ত হয়ে গেলো কেন এই জালিমটা?”
(***)
রিকশাটা বাসার সামনে এসে থামলো। অরুণিকা রিকশা থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে, তখনই ইমান বেরিয়ে এলো। অরুণিকাকে দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “তুমি এখানে? রুহানি কোথায়?”
অরুণিকা বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল, “ও তো বাসায়!”
“তোমাকে খুঁজতে বের হয়েছে ও। আন্টিকে ঘরে আটকে রেখে চলে গেছে। উনি দরজার ওপাশে বসে কান্নাকাটি করছেন।”
অরুণিকা মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ওকে কোথায় খুঁজবো এখন?”
আহনাফ রিকশার ভাড়া মিটিয়ে অরুণিকার পাশে দাঁড়াতেই ইমান বলল, “স্যার, আসসালামু আলাইকুম। আপনি ণিকার সাথে?”
আহনাফ সালামের উত্তর নিয়ে বলল, “ও গন্ডগোলে আটকা পড়েছিলো। তাই ওকে সাথে নিয়ে এলাম।”
ইমান অরুণিকার ভেজা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি তো ভিজে গেছো, ণিকা।”
অরুণিকা নিজের ওড়না ঠিক করে বলল, “রাস্তায় বৃষ্টি ছিল তো ওইসময়, তাই।”
“চাবি তো রুহানির কাছে। আরবতোমার তো এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। চলো, আমাদের বাসায় চলো। কাপড় পালটে নেবে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। সে অরুণিকার হাত ধরে বলল, “আমি তোমাকে শপিংয়ে নিয়ে যাচ্ছি, চলো?”
অরুণিকা ও ইমান দু’জনই আহনাফের কথায় বেশ অবাক হলো। আহনাফ বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? চলো!”
ইমান ভ্রূ কুঁচকে আহনাফের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, অরুণিকার বাসা এখানে। আমাদের বাসা….”
আহনাফ ইমানকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে জানাতে হবে না।”
এরপর অরুণিকাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো আহনাফ। ইমানের রাগ উঠে গেলো। সে আহনাফের সামনে এসে বলল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন অরুণিকাকে?”
আহনাফ চোখ ছোট করে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “স্যার, আপনি ওকে এভাবে কেন নিয়ে যাচ্ছেন?”
অরুণিকা আহনাফের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “স্যার, আপনি….”
আহনাফ অরুণিকাকে কিছু বলতে না দিয়ে ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অরুণিকা চৌধুরী আমার চাচার মেয়ে। তোমার কি হয় ও?”
ইমান আহনাফের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলো। অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার তোমার কাজিন?”
অরুণিকা কিছু বলতে যাবে, আহনাফ তার হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। ইমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আই হৌপ ওরা জাস্ট কাজিনই।”
(***)
বেল বেজে উঠতেই দরজা খুললো ইভান। আহনাফের সাথে অরুণিকাকে দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো তার। কিন্তু কিছু বলার আগেই অরুণিকাকে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো আহনাফ। ইভান নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে অরুণিকাকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা বেঁধে দিলো আহনাফ। অরুণিকা ভীত কন্ঠে বললো, “আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো কেন?”
আহনাফ শীতল কণ্ঠে বলল, “কাপড় পালটে নে।”
“তোমার সামনে কাপড় পাল্টাবো আমি?”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “ওই ছেলের সামনে পাল্টাতে পারলে আমার সামনে কেন পারবি না?”
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি কি উল্টোপাল্টা বলছো!”
আহনাফ অরুণিকাকে ধাক্কা দিতেই আহনাফের বিছানায় বসে পড়লো সে। আহনাফ এবার অরুণিকার পাশে বসে তাকে দ্বিতীয়বার ধাক্কা দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আহনাফের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে অরুণিকা। গলা শুকিয়ে গেছে তার। আহনাফ অরুণিকার গালে তার অধর ছুঁইয়ে বলল, “জানিস, আমি তোকে অনেক মিস করেছি, অরু।”
আহনাফের স্পর্শে অরুণিকা চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আহনাফ এবার অরুণিকার গলায় তার অধর ছোঁয়ালো। অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “কি করছো তুমি?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফ?”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “মজা করছো আমার সাথে?”
“মজা কেন করবো? তুই সত্যটা মানিস না?”
“আহনাফ, আমাদের বিয়ের কোনো ভিত্তিই নেই। খুব শীঘ্রই আমরা আলাদা হয়ে যাবো।”
“তুই পারবি আমাকে ফেলে থাকতে?”
অরুণিকা উঠে বসে বলল, “তুমি কি মাঝে মাঝে পাগল-টাগল হয়ে যাও না-কি!”
“হোয়াট?”
“রাস্তায় আমাকে যাচ্ছেতাই বলে, এখন এতো ঢং করছো কেন?”
আহনাফ অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে এনে বলল, “একটু জ্বালায় আর কি তোকে। কিন্তু ভালো তো এখনো বাসি।”
অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকালো। মুহূর্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো তার চোখ জোড়া। আহনাফ মৃদু হেসে অরুণিকার ওড়না টেনে ফেলে দিলো। অরুণিকা আহনাফকে থামিয়ে বলল, “কি করছো, আহনাফ?”
আহনাফ অরুণিকার ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল, “কথা বলিস না তো। আমি আমার বউকে ভালোবাসতে চাই।”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো না, আহনাফ।”
“কে বলেছে তোকে?”
“তুমিই বলেছো।”
“আমি তোর উপর রাগ করে কতো কিছু বলবো, তুই বিশ্বাস করবি কেন?”
“হয়েছে, হয়েছে। আমার বিশ্বাস নেই তোমার উপর। এখন আমাকে যেতে দাও।”
“কাপড় পাল্টাবি না? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
“তোমাদের বাসায় মেয়েদের কাপড় আছে?”
“নেই তো কি হয়েছে? আমার টি-শার্ট পরবি। আগেও তো পরতি।”
অরুণিকা মলিন হেসে বলল, “তোমার এসবও মনে আছে?”
“কেন থাকবে না?”
অরুণিকা আহনাফের দিকে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে আমি চিনতে পারি না একদম।”
আহনাফ অরুণিকার হাতে চুমু খেয়ে বলল, “এতো ভাবতে হবে না। আগে কাপড় পালটে নে। তারপর না হয় ঠান্ডা মাথায় ভাবিস।”
অরুণিকা আহনাফের টি-শার্ট হাতে ওয়াশরুমের দিকে যেতে নেবে, তখনই আহনাফ তার হাত ধরে বলল, “আমার সামনে পাল্টা।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আমি পারবো না।”
“আমাদের সম্পর্ক এখনো শেষ হয় নি। আর আমি শেষ করবোও না।”
“আমি তোমার সাথে আর কম্ফোর্ট জোনে নেই, আহনাফ।”
আহনাফ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “তুমি বরং অন্য রুমে চলে যাও।”
“আচ্ছা, আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখছি।”
অরুণিকা কিছু বলার আগেই আহনাফ মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অরুণিকা কাঁপা হাতে আহনাফের দিকে তাকাতে তাকাতেই কাপড় পাল্টে নিলো। আহনাফ ভুলেও পেছন ফিরলো না। অরুণিকা কাপড় পাল্টে গলা খাঁকারি দিতেই, আহনাফের ফোনে একটা মেসেজ এলো। মেসেজটি পড়ে আহনাফ বাঁকা হেসে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা ইতস্ততভাব নিয়ে বলল, “তুমি রুহানিকে একটা কল করে দেখবে?”
“তূর্যকে মেসেজ দিয়েছি। ও বলেছে ওকে রাস্তায় দেখেছে। রুদবাও ওদের সাথে আছে। রাস্তায় না-কি প্রচুর জ্যাম।”
“কেন? আমরা যেই রাস্তা দিয়ে এসেছি ওখানে তো জ্যাম ছিল না!”
“ওরা মেইন রোড দিয়ে আসছে। আমরা তো অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছি।”
“মামী হয়তো অনেক চিন্তা করবে। আমি একটা কল দিতে পারবো?”
“একটু পর তো এমনিতেই চলে যাবি। একটু দাঁড়া।”
আহনাফ হুট করে নিজের ভেজা শার্টটি খুলে ফেললো। অরুণিকা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে এবার অরুণিকার হাতে থাকা ভেজা জামাটি টেনে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি করছো তুমি?”
আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ অরুণিকাকে শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “প্লিজ, একটু সহ্য কর। এরপর তো তোকে এখান থেকে বের হতেই হবে। আমার মানসিক শান্তির জন্য আমাকে একটু ছুঁয়ে দে।”
“তুমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো? খুব অদ্ভুত বিহেইভ করছো তুমি।”
“প্লিজ, অরু। একটু আমাকে ছুঁয়ে দে। আর এই আবদার করবো না। প্রমিজ।”
অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন এমন আবদার করছো?”
“ভালোবাসি তাই। তুই ভালোবাসিস না আমাকে?”
“তুমি মিথ্যে বলছো। ভালোবাসলে পাঁচ বছর আগে আমার সাথে ওমন করতে না।”
“একটা কারণ ছিল।”
“কোনো কারণ ছিলো না। উলটো এখন মজা করছো, তাই না?”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সত্যিই তোর মনে হচ্ছে আমি তোর সাথে মজা করছি? বরং তুই এখন আমার অনুভূতি নিয়ে মজা করছিস। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারছিস না? কেমন বউ তুই! অরু, আমি চাই আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাক।”
অরুণিকা আহনাফের বুকে হাত রেখে বলল, “তুমি চাও সব ঠিক হয়ে যাক?”
আহনাফ চোখের ইশারায় বলল, “হ্যাঁ।”
অরুণিকার চোখ ভিজে উঠলো আহনাফের কথা শুনে। সে মৃদু হেসে আহনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমাকে আর ঠকাবে না তো?”
আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে দরজার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে অরুণিকাকে ছেড়ে দিতেই দরজাটা খুলে গেলো। দরজা খোলার শব্দ শুনে অরুণিকা আহনাফকে ছেড়ে উঠে বসতেই দেখলো মিসেস শিরিন সুলতানা দাঁড়িয়ে আছেন। চাচীকে দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো অরুণিকা। শিরিন সুলতানা ছেলের সাথে অরুণিকাকে এমন অবস্থায় দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অরুণিকা কয়েক পা পেছাতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো তার। শিরিন সুলতানাকে দেখে গলা শুকিয়ে গেছে। ঢুক গিলতেই যেন কিছু একটা গলায় বিঁধে যাচ্ছে। আহনাফ উঠে দাঁড়াতেই শিরিন সুলতানা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন, “এই মেয়ে এখানে কি করছে, আহু?”
আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর বাসা এখানেই, পাশে। দরজায় তালা দিয়ে ওর কাজিন কোথায় যেন চলে গেছে, তাই এখানে এসেছে।”
“তাহলে তোর রুমে কি করছে ও?”
“আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছো? ওকে জিজ্ঞেস করো? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমার ঘুম ভাঙলো।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। শিরিন সুলতানা অরুণিকার কাছে এসে সশব্দে তার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। অরুণিকা চড় খেয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। শিরিন সুলতানা অরুণিকার চুল টেনে ধরে বললেন, “বেহায়ামির একটা সীমা আছে। তুই জানিস আহনাফের সাথে তোর ডিভোর্স হয়ে যাবে, তবুও আমার ছেলের সাথে চিপকে আছিস। কি চাস তুই? এতো বেহায়া কেন তুই? ছেলে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না তোর?”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল, “আহনাফ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। ইভানও দেখেছে। এবার আমি মিথ্যে বলছি না। তুমি ইভানকে জিজ্ঞেস করো।”
শিরিন সুলতানা অরুণিকার চুল ধরে তাকে টেনে আহনাফের রুম থেকে বের করে ইভানের সামনে এনে ধাক্কা দিলো। অরুণিকা হুমড়ি খেয়ে ইভানের সামনে বসে পড়লো। তিনি এবার ইভানকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই মেয়েকে কি আহনাফ এখানে নিয়ে এসেছে?”
ইভান আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ চোখের ইশারায় কিছু একটা বলতেই ইভান বলল, “না। ও নিজেই এসেছে। আহনাফ তো ভার্সিটি থেকে এসেই রুমে ঢুকে ঘুমাচ্ছিলো।”
অরুণিকা অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। শিরিন সুলতানা টেনে উঠালেন অরুণিকাকে। কর্কশ কন্ঠে বললেন, “পাঁচ বছর আগেও আমার ছেলেকে ফাঁসাতে চেয়েছিলি। আজও ফাঁসাতে চাচ্ছিস! আমার ছেলে ঘুমিয়ে ছিল, আর তুই সুযোগ নিচ্ছিলি?”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। শিরিন সুলতানা আবার অরুণিকার গালে চড় মারতেই আহনাফ মাকে শান্ত করিয়ে বলল, “ওকে মেরে কি হবে? আমাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে। এখন ও যেহেতু বিয়েটা শেষ করতে চায় না, আমাদের কি করার আছে?”
“কেন শেষ করতে চাইবে না? ওকে আমি আমার ছেলের বউ মেনে নেবো, ভাবলো কি করে মেয়েটা? শয়তানি সব ওর মধ্যে। একটা নষ্টা মেয়ে ও।”
অরুণিকার ভীষণ কান্না পেলো। মুখে হাত চেপে ধরতেই শিরিন সুলতানা তার হাত ধরে বললেন, “মুখ লুকাচ্ছিস কেন? আজও কি আমার আহনাফের উপর দোষ চাপিয়ে দিবি?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আমি চলে যাচ্ছি, চাচী।”
“চুপ। তুই চলে যাবি মানে? তোকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো আমি।”
শিরিন সুলতানা অরুণিকার হাত ধরে তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেই আরাফের সাথে ধাক্কা খেলো সে। আরাফ শক্ত করে অরুণিকাকে আঁকড়ে ধরলো। রুদবা অরুণিকাকে এই অবস্থায় দেখে বলল, “তুই এখানে?”
শিরিন সুলতানা চেঁচিয়ে বললেন, “আমার ছেলেকে ফাঁসাতে এসেছে এই নষ্টা মেয়ে।”
আরাফ রাগী দৃষ্টিতে চাচীর দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচী, কি বলছেন এসব?”
তূর্য রুদবাকে বলল, “তুমি প্লিজ তোমার ঘরে যাও। এটা ফ্যামিলি মেটার।”
অরুণিকা রুদবার দিকে তাকালো না। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। নিজের ভুলের মাশুলই তো দিচ্ছে সে। আহনাফকে জড়িয়ে ধরতে গেল কেন সে? মানুষটা তাকে ভালোবাসে না। প্রতিবারই তাকে ঠকায়। তবুও তার বেহায়া দুর্বল মনটা সেই প্রতারকের ফাঁদেই পড়ে যায়। অরুণিকা আরাফকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। ইমন তার পিছু পিছু এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কি হয়েছে অরু?”
অরুণিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “আবার সেই ভুল করে ফেলেছি। তবে এবার কারো উপর দোষ দিচ্ছি না আমি। ভুল আমার হয়েছে। আহনাফ তো আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়েছিল। উলটো আমিই জেদ করে তোমাদের বাসায় চলে গেলাম। আহনাফ রুমে রেস্ট নিচ্ছিলো, উলটো আমিই ওর রুমে ঢুকে ওর টি-শার্ট পরে ফেললাম। এরপর ওর কাছাকাছি যেতে নিলাম, ওমনি চাচী আমাকে হাতেনাতে ধরে ফেললো। আমি অনেক ফালতু একটা মেয়ে। অনেক ফালতু।”
অরুণিকা এইটুকু বলে দ্রুত বাসার দিকে যেতে লাগলো। আহনাফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে অরুণিকার যাওয়া দেখছে। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই আমাকে কেন করতে বললি এই কাজ? তুই জানতি আজ আন্টি আসবে। অরুণিকাকে বাসায় এনে অপদস্ত করে কি মজা পেলি তুই?”
“পুরোনো শোধ তুলেছি ব্যস।”
“আরাফ আর তাহমিদ যদি জানতে পারে, আমি তোর অন্যায় আবদার মানছি, মেরে ফেলবে আমাকে। তূর্যও জানে না কিছু। ও তোকে বিশ্বাস করে, তুই যা বলছিস করছে। তুই বন্ধ কর এই রেষারেষি। এমন না হয়, প্রতিশোধ নিতে নিতেই ওকেই হারিয়ে ফেলেছিস।”
আহনাফ বাঁকা হেসে বলল, “বিয়ে করা বউ আমার! হারাবো কেন?”
“তুই সত্যিই অন্ধ হয়ে গেছিস। তোর জন্য আজ আমি নিজেই অরুণিকার চোখে ছোট হয়ে গেছি। ও কি মনে করবে আমাকে? আমি তো ওর চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলেছি।”
আহনাফ ইভানের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমি যেই আঘাত পেয়েছি, ওটা আমাকে কাটাকাটি করতে হবে না? ও আমাকে যেই আঘাতটা দিয়েছে, আমি সেটাই ফিরিয়ে দিচ্ছি ওকে।”
“কেউ জানে না, তুই এভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছিস।”
“তুই কাউকে না বললে, কেউ জানবেও না।”
“অরুণিকা কি কাউকে বলবে না?”
“ও ভালোবাসে আমাকে। দেখিস, দিনশেষে আমার কাছেই ফিরে আসবে।”
(***)
অরুণিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। পুরো পৃথিবীটা ঘোলাটে লাগছে তার। বেঁচে থাকাটাই ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে। সে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো, “মা, আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে যাও নি কেন তুমি? বাবা, আমার আর সহ্য হচ্ছে না এসব। আমাকে এই জঘন্য পৃথিবীতে একা রেখে কেন চলে গেলে তোমরা?”
অরুণিকা সিঁড়িতে উঠতে উঠতেই বসে পড়লো। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। ইমান সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো অরুণিকার অপেক্ষায়। ফোঁপানির শব্দ শুনে নিচে তাকিয়ে দেখলো অরুণিকা। দ্রুত নিচে নেমে এলো সে। অরুণিকার হাত ধরতে যাবে, তখনই অরুণিকা হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, “না, না, প্লিজ। আমাকে ধরবে না।”
ইমান হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “ওকে, ওকে, ধরছি না। তুমি ঠিক আছো তো?”
অরুণিকা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইমান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে তোমার? তোমাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। এই ণিকা!”
ইমান অরুণিকার অনুমতি ছাড়াই তার হাত ধরে বলল, “আমি আছি। তুমি কাঁদছো কেন, আমাকে বলো? আমাকে তোমার বন্ধু ভেবে বলো। তোমাকে তো তোমার কাজিন নিয়ে গিয়েছিল, তাহলে এই অবস্থা কেন তোমার!”
অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বললো, “রুহানিকে ডেকে দেবেন, প্লিজ!”
ইমান দ্রুত উঠে রুহানিকে ডাকলো। রুহানি ইমানের কথা শুনে নিচে নেমে অরুণিকার কাছে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কি হয়েছে, অরু?”
অরুণিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “আবার ঠকেছি আমি। আবার ঠকেছি। মানুষটা আমাকে আবার ঠকিয়েছে রে রুহু। আবার ঠকিয়েছে। আমি বোকা কেমন রে। একদম বোকা আমি। একদম বোকা।”
ইমান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। রুহানি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অরুণিকা নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। জমানো কষ্টগুলো যেন বেরিয়ে আসতে লাগলো অনেক বছর পর। অরুণিকার মুখে হাত চেপে ধরে তাকে বাসায় নিয়ে এলো রুহানি। আতকিয়া জাহান অরুণিকাকে এই অবস্থায় দেখে থমকে গেলেন। রুহানি অরুণিকাকে রুমে নিয়ে যেতেই অরুণিকা চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রুহানি দরজা বেঁধে সাউন্ডবক্সে জোরে গান চালিয়ে নিজেও অরুণিকার হাত ধরে তার পাশে শুয়ে পড়লো। অরুণিকা শব্দ করে কাঁদছে। রুহানি তার দিকে তাকিয়ে নীরবে জল ফেলছে। অরুণিকার কান্নার শব্দ বাইরে যাচ্ছে না। শুধু গানের শব্দই বাইরে বেরুচ্ছে। এই অশ্রু জল আর হাহাকারের সাক্ষী হয়ে রইলো শুধু চার দেয়াল আর রুহানি।
চলবে-