#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১৮ ||
“তোমার তো দেখছি বই পড়ার নেশা!”
অরুণিকা চমকে উঠলো ইমানের গলার স্বর শুনে। ইমান সিঁড়ির হাতলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা ছাদের সিঁড়িতে বসে বই পড়ছিলো এতোক্ষণ। ইমানকে দেখে উঠে দাঁড়াল সে। রেলিঙের কাছে এসে ব্যস্ত হাতে চোখ মুছতে লাগল। ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কাঁদছো তুমি?”
অরুণিকা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইমান রেলিঙে হেলান দিয়ে অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বলল, “তুমি তো দেখছি আমার আম্মুর মতো। আম্মু সিনেমা দেখে কাঁদে। আর তুমি বই পড়ে কাঁদছো।”
অরুণিকা নিজেকে সামলে নিয়ে ইমানের দিকে ফিরে তাকাল। অরুণিকার চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। ইমান সেই চোখ দু’টির দিকে তাকাতেই হোঁচট খেলো। রেলিঙ শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলো সে। অরুণিকার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। ইতস্ততবোধ করছে ভীষণ। ইমান ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলল, “হৃদ মোহিনী।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকাল ইমানের দিকে। ইমান ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল, “বিনা কাজলে তোমার আঁখি জোড়া চমৎকার খাঁজ কেটেছে। তুমি কি জানতে তোমার চোখ দু’টি ভীষণ সুন্দর? কেউ কি আগে বলেছিল এই কথা?”
অরুণিকা এখনো ইমানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইমানের চোখ এবার অরুণিকার বিষ্ময়ে কুঁচকে থাকা ভ্রূযুগলের দিকে আটকাল। সে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “স্থির জলে হালকা স্পর্শেই যেমন তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, আমার আঁখির দর্শনে মোহিত হয়ে ছুঁড়ে দেওয়া কথার বাণে ঠিক তোমার ভ্রূযুগলেও এলোমেলো তরঙ্গ দেখা দিচ্ছে।”
ইমানের কথায় চোখ সরিয়ে নিল অরুণিকা। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই পাশের ছাদে চোখ পড়ল তার। সেই ছাদে আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। খুব একটা দূরত্ব নেই ছাদ দু’টির মাঝে। পাশের দশ হাতের গলির ওপাড়েই সেই ছাদ। আহনাফ কি রেগে আছে কি-না তা বুঝতে পারছে না। তবে এদিকে যে তাকিয়ে আছে সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। অরুণিকা নীরবে ইমানকে পাশ কেটে ছাদ থেকে নামতে লাগল। ইমানও তার পিছু পিছু এলো। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি বেশি বলে ফেলেছি? আই এম সরি, ণিকা। সত্যিই তোমার চোখ দু’টি দারুণ সুন্দর, তাই বলে ফেললাম। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখব এখন থেকে। তুমি এভাবে কিছু না বলে চলে যাচ্ছো, আমি তো রাতে ঘুমাতেই পারব না।”
অরুণিকা এক সিঁড়ি নেমেই থেমে গেল। ইমান নিজেও অরুণিকার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। হুড়োহুড়িতে নামতে গিয়ে এক্ষুনি ধাক্কা খেতো। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “আরেকটা অঘটন ঘটলে একদম নিশাচর পাখি হয়ে যেতে হতো আমাকে!”
অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি রাগ করি নি। ইটস ওকে।”
এইটুকু বলেই বাসায় ঢুকে পড়ল সে। ইমান মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়ির কাছে। এদিকে বাসায় এসেই সোজা নিজের ঘরে ঢুকে বইটা টেবিলের উপর রেখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল অরুণিকা। কিছুক্ষণ শক্ত হয়ে বসে কাঁপা হাতে একটু আগে পড়া বইটির শেষ পৃষ্ঠা উল্টাল। সেখানে লেখা-
“মায়াবতী, তোমার নেত্রদ্বয় আমার হৃদ হরণ করে নিয়েছে। তোমার আজ বিশ্বাস করতে হবে আমাকে। একমাত্র শুদ্ধ প্রেমিকই তার প্রেয়সীর চোখে ডুবে মরতে পারে। অন্য কেউ সেই গভীর চোখের জলটুকু ছুঁয়ে দেওয়ারও সাহস পায় নি কখনো। আমি ছাড়া আর কে আছে যে তোমার আঁখি জোড়ার অর্থান্তর করতে পেরেছে? তোমার প্রেমিকের চোখেই তোমার একমাত্র ব্যাখ্যা। আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, মায়াবতী। তোমার নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করলে, আমাকে জিজ্ঞেস করো। আমিই তোমার একমাত্র ব্যাখ্যা।”
অরুণিকা বই বন্ধ করলো। বইয়ের মলাটে হাত রাখলো সে। বইয়ের নাম, প্রিয় হৃদ মোহিনী। ইমানের মুখে হৃদ মোহিনী শব্দটা শুনেই পুরো শরীর শিউরে উঠেছিল তার। কেন, তার কোনো উত্তর নেই অরুণিকার কাছে। সে এবার মলাটের উপর মোটা অক্ষরে লেখা লেখকের নামের স্থানে আঙ্গুল রাখলো। আর অস্ফুটস্বরে বলল, “হিমালয়। কি সুন্দর নাম লেখকের! শুধু নামটা সুন্দর না, অদ্ভুত মায়া জড়ানো আছে এই লেখকের লেখায়৷”
হিমালয়ের চারটা বই কিনেছে অরুণিকা। প্রথমটি উপহার হিসেবে বাসার ঠিকানায় এসেছিল। তবে প্রেরককের কোনো পরিচয় ছিল না। সেই বইটি পড়ার পর থেকেই হিমালয় নামক লেখকটির লেখার মায়ায় পড়ে গিয়েছিল সে। ভীষণ ভালো লাগা নিয়েই সেই বছরের বইমেলা থেকে তার জমানো টাকা দিয়ে হিমালয়ের বই কিনেছিল। সেই বইটি পড়েও ভীষণ কেঁদেছিল অরুণিকা। মনে হয়েছিল, লেখক সাহেব যেন তারই মনের কথা বলছে। দ্বিতীয় বইটির নাম ছিল প্রণয়িনী। বেশ আক্ষেপ ছিল লেখকের প্রণয়িনীর প্রতি। খুব আঘাত করেছিল সেই মিষ্টি কন্যাকে। আঘাত করে বোধহয় নিজেই খুব কেঁদেছিল! অরুণিকার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল হিমালয় নামক লেখকটির প্রণয়িনীকে আঘাত করার সময় চোখে অশ্রু ভীড় করেছিল কি-না। তাই সে হিমালয়ের খোঁজে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গিয়েছিল পরের বছরের বইমেলায়। সে বছর ইন্টার পরীক্ষা ছিল তার। বইমেলার জন্য ঢাকা যাওয়া যেন শাহবাজ খানের কাছে তামাশা ছিল। রুহানিই রাজি করেছিল বাবাকে। রুদবার বই পড়ার খুব শখ। যদিও অরুণিকা উপন্যাস খুব একটা পড়তো না। পড়তো সব কবিতার বই। তাও আবার মিষ্টিমশাইয়ের কবিতা। তাহমিদ ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করে তাকে শুনিয়েছিল বিধায়, কবিতার প্রতি ঝোঁক ছিল তার। সেই থেকেই কবিতা পড়া। আর কবিতা পড়তে পড়তেই মিষ্টিমশাই নামক কবির বই হাতে পাওয়া। আর সেখান থেকেই সেই মিষ্টিমশাইয়ের ভক্ত হয়ে যাওয়া। আর উপন্যাসের ভক্ত হিমালয়ের লেখা পড়ার পর থেকেই হয়েছে। তার লেখার প্রতিটা বাক্যে শিহরিত হয় অরুণিকা। সেই আকর্ষণ থেকেই ঢাকার বইমেলায় গিয়ে অনেক খুঁজেছিল সে। প্রতিটি স্টলে হিমালয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু প্রকাশক নিজেও তাকে চেনে না। সেই বইমেলা থেকে আরো দু’টি বই কিনেছিল অরুণিকা। আর প্রিয় হৃদ মোহিনী সেই শেষ বইটি। বইটি শেষ হতেই শূন্য শূন্য লাগছে অরুণিকার। মনে হচ্ছে কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলেছে। বইয়ের প্রতিটি বাক্য পড়তেই মনে হচ্ছিলো কেউ ফিসফিসিয়ে তাকেই এসব বলছে। আর আজ সত্যিই এমনটা হলো! বইয়ের কাল্পনিক অনুভূতি আজ বাস্তবে ঘটলো। ইমান তার চোখের ব্যাখ্যা দিলো। প্রথম কোনো পুরুষ তার চোখ পড়েছে। আহনাফও তো অনেকবার সেই চোখ দেখেছিল। এমন করে তো ব্যাখ্যা দেয় নি। তবে কি আহনাফ কখনোই তার শুদ্ধ প্রেমিক ছিল না?
(***)
অরুণিকা শব্দ করে কাঁদছে। রুহানি কান্নার আওয়াজ পেয়ে অরুণিকার রুমে ঢুকে পড়ল। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “শয়তানটা আবার কি করেছে?”
অরুণিকা রুহানির হাত ধরে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো, “রুহু, আহনাফ কখনো আমাকে ভালোবাসে নি। আমার একটা ভুল মানুষের সাথে বিয়ে হয়েছিল। আমার প্রথম ভালোবাসা ভুল ছিল। মিষ্টিমশাই ঠিক বলেছে, কিশোর-কিশোরীর প্রথম প্রেম ব্যর্থ হয়। ভুল হয়। মিথ্যে হয়।”
“মিষ্টিমশাইটা কে আবার?”
“ওই যে, যার বই পড়ি! অনেক ভালো কবিতা লেখে।”
“ওরে আল্লাহ রে। ওইটা কবিতা। ধুর, এসব কবি-ফবিদের কথা কেউ বিশ্বাস করে না-কি, বোকা? একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লিখে দিলেই তো কবিতা হয়ে যায়! বই বিক্রি হওয়ার জন্য এসব আউল-ফাউল কথা লিখে দেয় এরা।”
“না, রুহু। এটা শুধুই লেখা না। কিছু তো আছে সেই লেখায়। একটা সত্যতা আছে।”
রুহানি কপাল চাপড়ে বলল, “পাগল হয়ে গেছিস তুই!”
অরুণিকা আপনমনে বলতে লাগলো, “আর সেই হিমালয়? তার লেখা আমাকে ভাবাচ্ছে।”
রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি ভাবাচ্ছে?”
“ভালোবাসতে ভুলে করেছি। ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। এটাই ভাবাচ্ছে।”
রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “ভালো একটা জিনিস ভাবিয়েছে তোকে। এটা কিন্তু ঠিক।”
“কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেওয়া কি এতো সহজ?”
“কেন সহজ না?”
“বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের।”
“বিয়েটা কি ওই শয়তানটা মানছে! ও যেহেতু মানছে না, তোকে কেন এতো ওয়াইফ মেটেরিয়াল হতে হচ্ছে?”
“আমিও আর চাই না সেই সংসার৷ যেখানে সম্মান নেই, বিশ্বাস নেই, ভালোবাসা নেই। আমি এক তরফা ভালোবেসেছি আহনাফকে। সেদিন আহনাফের ব্যবহার দেখে আমি বুঝে ফেলেছি, ও আমার জন্য কখনোই ভালো ছিল না। একটা বিশ্রী কান্ড বাঁধিয়ে আমাকে বিয়ে করেছে। তখনও যদি এই বুদ্ধিটা হতো, আমি কি ওর প্রেমে পড়তাম?”
“পড়লি কীভাবে প্রেমে?”
“স্বপ্ন দেখিয়েছে। আর আমি স্বপ্ন দেখে গেছি। ওটাই প্রেম ছিল।”
“ওটা প্রেম ছিল না, অরু। সিনেমায় এরকম প্রেম বেশিদিন চলে না। প্রেম তো সুন্দর হয়। তোর আর আহনাফের কোনো সুন্দর স্মৃতি নেই?”
“না, আমি তো অনেক ছোট ছিলাম। তেরো বছর বয়সে বিয়ে, আর সেই কয়েকটা বছরেই ওর সাথে কথা হতো, ঝগড়া হতো, মান-অভিমান হতো। ওটাকেই ভালোবাসা ভেবে ফেলেছিলাম আমি। কিন্তু আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে এখন। ওখানে কিছু ছিল না। মায়া বসে গিয়েছিল শুধু। যাই বলিস, সবাই তো আমার বর বানিয়ে দিয়েছিল ওকে।”
“কি করবি তাহলে?”
“ডিভোর্স নেবো! এই কয়েক দিনের মধ্যেই আমার ও বাড়ি যেতে হবে।”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-১৯ ||
“আসতে পারি, স্যার?”
কোনো উত্তর এলো না। অরুণিকা ভেতরে ঢুকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করল আহনাফের অফিস কক্ষে। আহনাফ উল্টোদিকে ফিরে অফিস চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। তার বাম পাশটা হালকা দৃশ্যমান। অরুণিকা বুঝতে পারছে, আহনাফ ইচ্ছে করেই তার দিকে ফিরছে না। তার হাতে একটা বই। সেটা খুলেই বসে আছে সে। অরুণিকা পুনরায় বলল, “স্যার, আমাকে ডেকেছেন?”
আহনাফ চেয়ার ঘোরাল। হাতের বইটা টেবিলের উপর রাখল শব্দ করে। অরুণিকা বইটির দিকে একনজর তাকিয়ে আহনাফের রাগে লাল হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকাল। জোরপূর্বক ঢুক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “কেন ডেকেছেন স্যার?”
আহনাফ টেবিলের উপর দু’হাত রেখে ইশারায় অরুণিকাকে বসতে বলল। অরুণিকা নিঃশব্দে বসে পড়ল। আহনাফ গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করল, “দু’দিন তুমি আমার ক্লাস করো নি। কেন জানতে পারি?”
“আমি এই কোর্সের ক্লাস করছি।”
“জানি, তুমি ইভানের ক্লাসে গিয়ে বসছো। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আমার ক্লাস কেন করছো না? আমি কি পড়া বোঝাতে পারছি না?”
“এই কোর্সে বোঝানোর কিছুই নেই। কিন্তু ইভান স্যারের ডেডিকেশন আমার ভালো লেগেছে, তাই আমি উনার ক্লাস করছি। আর ভার্সিটিতে ক্লাস করা না করা স্টুডেন্টদের পারসোনাল চয়েজ। আপনি আমার এটেনডেন্স কেটে রাখতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“তুমি ইচ্ছে করে আমার ক্লাস মিস দিচ্ছো। নেক্সট সেমিস্টারে আমি অন্য কোর্স পাবো, তখন কীভাবে পালাবে?”
“আপনি ইউনিভার্সিটির স্যার। নিজের পারসোনালিটি ধরে রাখবেন আশা করি।”
আহনাফ হাত মুঠো করে বলল, “তুমি আর বাকী স্টুডেন্ট আলাদা।”
“কেন স্যার?”
“আই এম ইউর হাসবেন্ড। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
“সেই হিসেবে তো আপনার দ্বিগুণ ভদ্র হওয়া উচিত ছিল। স্যারদের দায়িত্ব স্টুডেন্টদের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া, আর হাসবেন্ডের দায়িত্ব তার ওয়াইফের সম্মানের খেয়াল রাখা। যেই স্যার অনর্থক অন্য স্টুডেন্টদের সামনে তার ছাত্রীকে অপমান করে, তার চেয়ে জঘন্য তো সেই হাসবেন্ড যে তার বন্ধুদের সামনে তার ওয়াইফকে ছোট করে। আপনি শিক্ষক এবং স্বামী দু’টোতেই ব্যর্থ।”
আহনাফ উঠে দাঁড়াল। অরুণিকাও সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। আহনাফ তার সামনে এসে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “ইমানের সাথে তোমার এতো কীসের কথা!”
“ভার্সিটির সিনিয়র সেই হিসেবে একটু-আধটু কথা হয়। আর সে আমার প্রতিবেশি। আমি তাকে ইগ্নোর করতে পারবো না।”
“তুমি আমাকে ইগ্নোর করতে পারছো, আর ইমানকে পারছো না? ইন্টারেস্টিং!”
“ইয়েস, ভেরি ইন্টারেস্টিং, বিকজ হি ডিজার্ভস। বাট ইউ আর নট।”
“মিসেস অরুণিকা চৌধুরী, আমি তোমার সাথে অনেক কামলি বিহেভ করছি। ইফ, আই……”
অরুণিকা আহনাফের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ইউ ক্যান ডু এনিথিংগ হোয়াটেভার ইউ ওয়েন্ট, মিস্টার আহনাফ চৌধুরী। আই ডোন্ট কেয়া’র। ইউ হ্যাভ টোটালি ব্রোকেন মি, এন্ড হ্যাল্পড টু মেইক নিউ অরুণিকা চৌধুরী। এন্ড দিস অরুণিকা ইসেন্ট এফ্রেইড অব ইউর সো কল্ড থ্রেটস।”
আহনাফ অরুণিকার দিকে হাত এগিয়ে দিতেই অরুণিকা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “নিজের সীমাতেই থাকার চেষ্টা করবেন।”
আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। অরুণিকা চলে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতেই আহনাফ বলল, “তুমি জানো না, আমি কতোটা ভয়ংকর! আহনাফ চৌধুরী ভালোবাসায় যতোটা ডেডিকেটেড, তার চেয়ে বেশি ডেডিকেটেড সে তার শত্রুদের প্রতি। আমি যতো চমৎকার ভাবে ভালোবাসতে জানি, এর চেয়ে ভয়ংকরভাবে ঘৃণাও করতে পারি। তুমি তো সেই সৌভাগ্যবতী হলেই না যে আহনাফের ভালোবাসা পেয়েছে। পেলেই বোধহয় কষ্টটা আরো বেশি হতো। তুমি তো সেই ভালোবাসা ডিজার্ভই করো না। তাই তুমি আমার ভয়ংকর রূপটাই দেখেছো। আর ভবিষ্যতে সেটাই দেখবে।”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “যেই মানুষের ভালোবাসায় পবিত্রতা নেই, সেই ভালোবাসা পাওয়ার মতো সৌভাগ্য আমার না হোক অন্তত। তেরো বছর বয়সে তুমি আমার সাথে যা করেছো, সেটা আমি তখন বুঝি নি। সময়ের সাথেও বুঝি নি। বিয়ে হয়ে গেছে। তাই তোমাকে স্বামী মেনেই বড় হয়েছি। অনেক আপন ভেবে নিয়েছিলাম। তাই ওটাকে কখনো গুরুতরভাবে দেখি নি। কিন্তু তুমি তো সেই হিসেবে একটা ক্রিমিনাল। আর আমি সেই ক্রিমিনালের ওয়াইফ। ছি! এমন সো কল্ড সৌভাগ্যবতী আমার শত্রুও না হোক।”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে দরজার সাথে চেপে ধরে বলল, “তুই আজ এতো বছর পর এসব কথা কেন বলছিস? ওটা আমার ভুল ছিল। আমি না বুঝে ওই কাজ করেছি। আই এম সরি ফর দ্যাট।”
“রিয়েলি?”
“ইয়েস। তুই কি ভাবছিস, আমি রিগ্রেট করছি না?”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “রিগ্রেট! হাসালে আমাকে। রিগ্রেটের আর ও তোমার মধ্যে নেই। সেদিন যদি তনু আন্টি আমাদের না দেখতো, কি করতে তুমি? রেইপ করতে আমার?”
আহনাফের মুখ লাল হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে তার। অরুণিকা আহনাফের শার্ট খামচে ধরে বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসতাম না, আহনাফ। তুমি আমাকে বুঝিয়েছো ভালোবাসা। আমাকে শিখিয়েছো ভালোবাসা কি! দেখিয়েছো তোমার মহান আর চমৎকার সেই ভালোবাসার রূপ। আর সেটা কেমন ছিল? কাছে আসা, আর স্পর্শ করা। এতোটুকুই! কখনো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অনুভূতি জানতে চেয়েছো? কীভাবে সম্ভবও বা হবে সেটা? আমি তো মাত্র নাইনে পড়তাম। সেই বয়সে ভালোবাসা হয় না-কি? সেই বয়সে চোখের কোনো ভাষা থাকে না-কি? আমি এতোদিন যেটা ভালোবাসা ভাবছি, সেটা ভালোবাসা না। সেটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া একটা দায়িত্ব। আমি তোমাকে ভালোবাসি না, আহনাফ। আমি একটা দায়িত্ব থেকে তোমার সাথে ছিলাম। এখনো সেই দায়িত্ব আমাকে বেঁধে রেখেছে। আর আমি মুক্তি চাই এখন।”
আহনাফ সরে দাঁড়াল। অরুণিকার চোখের দিকে তাকাল না। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি তোর সাথে সেই রাতে যা করেছি, তার জন্য সরি। সরি বললেও কম হবে। সবাই ভাবছে, আমি তোকে ভালোবাসি, আর কেউ এই সম্পর্ক মানবে না, তাই এমন বিশ্রী একটা কাজ করেছি। কিন্তু আসল সত্য সেটা না। আমি সেই রাতে নিজের কন্ট্রোলে ছিলাম না। আমার হুঁশ-জ্ঞান ছিল না। প্রচন্ড জ্বর ছিল আমার। ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি। অরু, আমি কি করেছি, সেটা আমি নিজেই জানি না। আমার মাথা ঠিক ছিল না সেই রাতে। এর জন্য কতোবার মাফ চেয়েছি তোর কাছে। এরপর তো আর তোকে কখনোই বাজেভাবে স্পর্শ করি নি। তোর অনুমতি না নিয়ে তোর কাছেও আসি নি।”
“আর এখন যে বিনা অনুমতিতে আমাকে বিরক্ত করছো! যখন তখন আমাকে স্পর্শ করছো? এটার অনুমতি নিয়েছিলে আমার থেকে?”
আহনাফ চুপ হয়ে গেল। অরুণিকা বলল, “তুমি ঘৃণা করবে আমাকে? তোমাকে ঘৃণা করার সবচেয়ে বড় কারণ আমার কাছে আছে। কিন্তু আমি তো সেই কারণটা দেখিয়ে তোমাকে জেলের ভাতটাও খাওয়ায় নি। চাইলে তো আমার পক্ষে সম্ভব হতো। আর তুমি? তুমি আমাকে এমন কাজের শাস্তি দিচ্ছো, যেটা তোমার ভুলও হতে পারে।”
“আমি ভুল? আমি যা দেখেছি, সব ভুল? এখন এটা বল, তুই ক্লাস নাইনে পড়তি, তাই না বুঝে সেই কাজ করেছিস? বল না! সত্য বল। সেদিন বাবার দয়ায় তুই বেঁচে গেছিস। নয়তো তোর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস ছিল না।”
“এরপরের ছ’মাস আমার সাথে যা করেছিলে তুমি, এর চেয়ে ভালো ছিল চাচ্চু আমাকে সেদিনই শাস্তি দিয়ে দিতো।”
“যা করেছি, ভালো করেছি। আর ভবিষ্যতে তোর সাথে এমনিই হবে।”
“আহনাফ, তুমি আমার মুখ খুলতে বাধ্য করো না। আমি যেই অপরাধ করি নি, তুমি আমাকে সেই অপরাধের শাস্তি দিচ্ছো। আমি সত্যটা বলতে চাই না। শুধু আশা করেছি আমার চোখের ভাষা অন্তত কেউ বুঝবে। কেউ বুঝবে আমি সেই অপরাধ করি নি।”
“এসব গল্পে হয়, সিনেমায় হয়। বাস্তবে কারো চোখের ভাষা পড়া যায় না। তুই অপরাধ না করলে প্রমাণ কর। প্রমাণ দেখা আমাকে। আমিও তোর সাথে যা করেছি, তার জন্য নিজেকে শাস্তি দেবো।”
“প্রমাণ থাকলেই তো। যেই মানুষের চোখের ভাষাই বুঝো নি, তার মুখের কথা বিশ্বাস করবে, এটা তো নেহাতই একটা কৌতূক। আমি কিচ্ছু বলবো না। কিন্তু সত্য যদি কখনো সামনে আসে, তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারবে না।”
(***)
অরুণিকা আহনাফের অফিস কক্ষ থেকে বের হতেই জয়িতা তার সামনে এসে দাঁড়াল। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকাল তার দিকে। জয়িতা বলল, “স্যারের রুমে এতোক্ষণ কি করছিলে?”
অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “স্যার আমাকে সামার ফেস্টে সিনিয়রকে সাহায্য করতে বলেছেন।”
“এইটুকু বলতে এতোক্ষণ সময় লাগল?”
“জি। তবে মাঝে স্যারের একটা কল এসেছিল। মেইবি স্যারের প্রেমিকা সে।”
অরুণিকা এইটুকু বলে মুখ চেপে হাসলো। জয়িতা চোখ ছোট করে বলল, “স্যারের প্রেমিকা আছে?”
“মনে তো হলো! কি বকাটাই নেই খেলেন স্যার। অনেক অসহায় হয়ে গিয়েছিল তার মুখটা। স্যার তো ভুলেই গিয়েছিলেন সামনে তার স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। তাই একটু সময় লেগেছিল।”
জয়িতা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। অরুণিকা বলল, “আপু, আর কিছু বলবেন?”
“না! যাও তুমি।”
অরুণিকা চলে যেতেই জয়িতা ভাবতে লাগলো, “আহনাফ স্যারের গার্লফ্রেন্ড আছে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব! স্যারের মা তো বললো উনার কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড নেই। যদি গার্লফ্রেন্ড থেকেই থাকে, তাহলে শিরিন আন্টি আম্মুকে কেন মিথ্যে বললেন? কেন বললেন, আমার আর আহনাফ স্যারের বিয়ে দেবেন উনি। মিথ্যে আশা কেন দেখালেন আমাকে? আমার আম্মুর সাথে কথা বলতে হবে। আমিও জিজ্ঞেস করবো, কেন তার বান্ধবী আমাকে মিথ্যে আশা দিয়েছে।”
এদিকে অরুণিকা ক্যাম্পাস গেটের বাইরে এসে দাঁড়াতেই ইমানের সাথে দেখা হয়ে গেল। ইমান অরুণিকার কাছে এসে বলল, “রুদবা আসে নি আজ?”
“না। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”
“হ্যাঁ করো।”
“সামার ফেস্টিভ্যালে কি কি হয়?”
“মেলা হবে। আর একটা প্রোগ্রাম হবে। ওখানে অনেকে অংশ নেবে। গান, কবিতা, নাচ, অভিনয় এসব হবে।”
“আমি নাচে অংশ নিতে পারবো?”
ইমান চমকে উঠলো অরুণিকার কথায়। কৌতূহলি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “নাচ পারো তুমি?”
“হ্যাঁ, মা শিখিয়েছিল।”
“বাহ! তাহলে নাম দিয়ে দেই?”
“আচ্ছা, দিয়ে দেন।”
অরুণিকা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। চোখের সামনের মায়ের হাসি মাখা মুখটা ভেসে উঠল। ইমান তার মনোযোগ কেঁড়ে নিয়ে বলল, “তোমার এমন কোয়ালিটি আছে, আগে তো জানতাম না।”
অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “আমি নাচতে জানলেও কখনো স্টেজ পারফরম্যান্স করি নি। রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠা। আমার দাদা-দাদি পছন্দ করতেন না। আমি গান শিখতে চেয়েছি, আমাকে দেই নি। অথচ আমার চাচাতো ভাইরা ঠিকই গান করতো। গিটার বাজাতো বড়দের সামনে। কিন্তু কেউ কিছু বলতো না।”
এইটুকু বলে অরুণিকা হাসলো। অরুণিকার হাসিতে ভয়ংকর কষ্ট লুকিয়ে ছিল। ইমান বুঝতে পেরে অরুণিকার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “খুব অভিমান জমে আছে, তাই না?”
অরুণিকা ইমানের চোখাচোখি হলো। ইমান বলল, “তোমার লাল হাসি দেখেই বুঝেছি, তোমার মনে অনেক অভিমান জমে আছে।”
অরুণিকা ক্ষীণ স্বরে বলল, “কীভাবে?”
“লাল হাসি, অভিমানের রং। লাল হাসিতে চোখ দু’টি আবছা লাল হয়ে যায়। আর সেই অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরে। চোখ সব অভিমান শুষে নিয়ে বর্ণহীন জল দিয়ে যায়।”
অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “আপনার কথাগুলো বেশ অদ্ভুত। আপনি না-কি বই পড়েন না! তাহলে এতো কথা শিখলেন কোথায়?”
“তোমাকে দেখে!”
“হ্যাঁ?”
“হ্যাঁ।”
অরুণিকা চোখ সরিয়ে নিলো। তারা এবার একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। ওদিকে ক্যাম্পাস গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। অরুণিকা আর ইমানের দিকেই তার দৃষ্টি। তাদের দেখে তার হাত মুঠো হয়ে গেছে, চোখ দু’টিও ভীষণ লাল। ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তূর্য আর ইভান তার পাশেই দাঁড়ানো। তূর্য তার কাঁধে হাত রাখতেই আহনাফ জোর গলায় বলল, “কি আসে যায়! যার থাকার সে থাকবে, যার চলে যাওয়ার সে ঠকিয়ে, আঘাত করে হলেও চলে যাবে।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আহনাফের দিকে। তূর্য তার মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। তূর্য দূরে যেতেই ইভান বলল, “তুই বুঝি কাউকে ঠকাস নি! আঘাত করিস নি!”
“আমার তো কারণ আছে।”
“তোর কারণটা কারণ, ওরটা কারণ না?”
আহনাফ চোখ ছোট করে তাকালো ইভানের দিকে। ইভান আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “ওকে যেই অপরাধের শাস্তি দিচ্ছিস, সেই শাস্তির ফলাফল তোর জন্যই খারাপ হবে, আহনাফ। পস্তাবি তুই। তুই আমার বন্ধু, তাই তোর কথা শুনছি। এমনি তোকে একটা বলি, এখনো সুযোগ আছে। যা হয়েছে ভুলে যা। থাকতে না চাইলে আলাদা হয়ে যা। কিন্তু ওকে আঘাত করে ওর ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবি না তুই। তূর্য আর আমি জানি, তুই ওকে কি পরিমাণ ভালোবাসিস। অথচ যাকে ভালোবাসিস, সে নিজেই জানেই না। অদ্ভুত তোরা! একজন ভালোবেসে ঠকিয়েছে, আরেকজন ভালোবাসা না পেয়ে পাগল হয়ে গেছে, আর তুই পেয়েও হারাচ্ছিস।”
ইভান চলে গেল। আহনাফের চোখ এখনো লাল হয়ে আছে। চোখের সামনে সেই ভয়ংকর দৃশ্য, সেই আর্তনাদ, আর সেই নিথর দেহ। কপাল চেপে ধরলো আহনাফ। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “এতো সহজে ভুলে যাবো আমি? এতো সহজ না সব। ওরা সবাই ভুলে গেছে। কতো সহজে সব মেনে নিলো সবাই! আমিই মানতে পারছি না। আমার দিন-রাত এক করা স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন ভাঙা সেই গোধূলি আকাশ সাক্ষী, আমি ভুলবো না সেই কালচে বেলা, মায়াবতী। তোর কল্যাণে আজ আমার এই পরিণতি। মায়াবতীর জায়গা শুধু কল্পনায়। আর বাস্তবে তুই আমার স্বপ্ন ভাঙা সেই খুনী, যাকে ভালোবাসার মতো ভয়ংকর অপরাধ করে ফেলেছি আমি। নয়তো তোর নিঃশ্বাস ফেলতেও ভীষণ কষ্ট হতো। ছাড় পাচ্ছিস, সেটাই অনেক।”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২০ ||
জৈষ্ঠ্যের গরমে হাঁসফাঁস করছে প্রকৃতি। সেই সাথে ভ্যাপসা আবহ অস্থির করে তুলেছে রুহানিকে। সদ্য স্নান করে বেরিয়েছে সে। চুলটাও মুছে নি। বাথরুম থেকে বেরিয়েই পাতলা টি-শার্ট আর একটা ঢিলেঢালা সালোয়ার পরে নিয়েছে। ভেজা চুলের স্পর্শে টি-শার্টটিও ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। রুহানির এতেই শান্তি লাগছে। গ্রীষ্মের স্পর্শ সহ্য হয় না তার। একটু পর পর গা ভিজিয়ে নেয়। আতকিয়া জাহান মেয়ের কর্মকান্ডে বরাবরের মতোই বিরক্ত। এমন উদ্ভট কাজের জন্য প্রায়ই ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেলে সে। তবুও শিক্ষা হয় না। এমনকি একটা পানি ভর্তি ড্রাম রুমের ভেতর এনে রাখে। তার ধারণা পানি থাকলে রুম ঠান্ডা থাকবে। আতকিয়া জাহান তো বিরক্ত হয়ে একদিন তাকে বাথরুমেই আঁটকে রেখেছিলেন। নেহাতই ফোন ছিল না সাথে। নয়তো আঁটকে থাকতে তার বিশেষ কোনো অসুবিধা হয় নি। একটু পরপর শাওয়ার ছেড়ে, নিজেকে ভিজিয়ে গান গেয়ে আতকিয়া জাহানের রাগ আরো কয়েক গুণ বাড়িয়েছিল ব্যস। এদিকে তার আরেক গ্রীষ্মকালীন অভ্যাস, ঘুমানোর আগে পুরো রুমে পানি ছিটিয়ে দেওয়া। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলে, “এটা রুহানি’স বর্ষণ প্রক্রিয়া।”
সেই ছিটানো পানি টাইলসে জমে থাকে। আর সেই টাইলসে পা রাখতেই দু’বছর আগে পিছলে পড়ে কোমড় ভেঙেছিল আতকিয়া জাহানের। এরপর থেকেই মেয়ের রুমে ঢোকার আগে মেঝেতেই তার দৃষ্টি প্রথমে আঁটকায়।
এই মুহূর্তে লম্বাচওড়া ঘুমের পরিকল্পনা করছে রুহানি। এক গ্লাস পানি এনে সে রুমে ছিটানোর জন্য প্রস্তুত, তখনই বাড়ির বেল বেজে উঠলো। রুহানি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠলো। চেঁচিয়ে বলল, “এই গরমের মধ্যে বেক্কেলের মতো বিকেল তিনটায় কে এসেছে? এখন ওড়না পরে রংঢং করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। যার ইচ্ছে দরজা খুলুক। আমি তো গায়ে একটা টিস্যুও লাগাতে পারবো না।”
অনেকক্ষণ বেল বাজলো। আতকিয়া জাহান রেগেমেগে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজা না খুলে অরুণিকার রুমে কয়েকটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, “মরে গেলেও আমাকে কবর থেকে উঠে আসতে হবে দরজা খোলার জন্য। দরজাটাও কি তোমার মামা দেশে এসে খুলে দেবে। তোমার কি আক্কেল জ্ঞান নেই?”
অরুণিকা বাথরুম থেকে চেঁচিয়ে বলল, “মামী, আমি গোসলে।”
“এতোক্ষণ লাগে!”
“মাত্রই তো এলাম ভার্সিটি থেকে।”
আতকিয়া জাহান দাঁত কটমট করে বললেন, “যদি মেয়েটার পড়ালেখা ছুটাতে পারতাম, তবেই শান্তি পেতাম!”
আতকিয়া জাহান এবার নিজে এসেই দরজা খুলে দিলেন। দরজার ওপাশে আরাফকে দেখে মুহূর্তেই চেহারা পালটে গেল তার। এক গাল হেসে বললেন, “আসো, বাবা। আসো। তুমি আজই আসবে জানতাম না।”
আরাফ বাসায় ঢুকে সালাম দিল। আতকিয়া জাহান সালামের উত্তর নিয়ে আরাফকে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকায় গরমে লাল হয়ে গেছে আরাফের মুখখানা। ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। চশমার গ্লাসটাও ঝাপসা হয়ে গেছে। আতকিয়া জাহান ফ্যান চালু করে আরাফকে বসতে বললেন। আরাফও চুপচাপ বসে পড়লো। তিনি এবার একটু হতাশ গলায় বললেন, “উনাকে বলেছিলাম একটা এসি লাগিয়ে দিতে। কিন্তু উনি সেই সুযোগটা তো পাচ্ছেন না। তোমার বোনের খরচা দিতে দিতেই তার কোমড় ভেঙে যাচ্ছে।”
আরাফ গম্ভীরমুখে তাকালো আতকিয়া জাহানের দিকে। তিনি পুনরায় বললেন, “জানি, অরুণিকার কাজিন তুমি। তোমাকে প্রথম দেখেই আমার চেনা-জানা লেগেছিল। ভেবেছি এলাকায় দেখেছি। রুহানি বললো তোমরা পাশের বিল্ডিংয়ে ভাড়া নিয়েছো!”
আরাফ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আতকিয়া জাহান বললেন, “ক’জন থাকো?”
“ছ’জন।”
“বাব্বাহ! জায়গা হয়?”
“হ্যাঁ, চার বেডের বাসা।”
“হ্যাঁ, শুনেছি। অরুণিকার বান্ধবী একটা থাকে ওই বিল্ডিংয়ে।”
আতকিয়া জাহান কিছুক্ষণ চুপ করে আপাদমস্তক আরাফকে দেখে নিলেন। তারপর বললেন, “আর কারা কারা থাকে তোমার সাথে?”
“আমার দুই জন কাজিন, তিনজন বন্ধু।”
“কাজিন কারা?”
“আহনাফ আর তাহমিদ।”
“অরুণিকার সাথে বিয়ে হয়েছে সেই আহনাফ?”
“জি।”
“কি করে ছেলেটা?”
“ভার্সিটির লেকচারার।”
আতকিয়া জাহান কপাল চাপড়ে বললেন, “আরেহ হ্যাঁ, মনেই ছিল না। ওই তো সেদিন অরুণিকাকে পুকুর থেকে তুলে এনেছিল। বাজার করে আসার সময় ব্যাগ সুদ্ধ পানিতে পড়ে গিয়েছিল মেয়েটা। দুর্বল মেয়ে! একটু ধাক্কা লাগলেই পড়ে যায়। ছেলেটা আবার বেশ ভদ্র। বাজার-সদাইও করে এনেছিল। তার সাথে আরেকজন ছিল। কি যেন নাম তার!”
“তূর্য।”
“হ্যাঁ, তূর্য। গান-বাজনা করে না-কি!”
“জি।”
“সেও কি ভার্সিটিতে পড়ায়?”
“পড়ায় না, গান শেখায়।”
“ভার্সিটিতে আবার গানও শেখায়?”
“জি।”
“তাহমিদ কি করে?”
“ব্যবসা করে।”
“পড়াশুনা করে না?”
“করে।”
“কি নিয়ে?”
“সাইকোলজিতে।”
“আর বাকিরা কি তোমার মতো ডাক্তারি পড়ে?”
“না, ইভান ভার্সিটির স্যার। আর ইমন গ্রেজুয়েশন শেষে একটা কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে।”
“তা তোমরা ভাড়া বাসায় কেন উঠেছো? তোমাদের কতো বড় বাড়ি!”
আরাফ কিছু বললো না। সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। সে মনে মনে ভাবছে, “এই মহিলা এতো প্রশ্ন করছে কেন? যেই কাজে ডেকেছে, সেটা বললেই হয়!”
আতকিয়া জাহান বুঝলেন, আরাফ এই প্রশ্নের উত্তর দেবে না। তাই তিনি কথা না বাড়িয়ে বললেন, “তুমি তো ডাক্তার মানুষ। ব্রিলিয়ান্ট আছো, বোঝা যাচ্ছে। একটা সাহায্য করো না বাবা!”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আতকিয়া জাহান বললেন,
“আমার মেয়েটা একদম গাধা, ডামিশ মেয়ে। ইন্টারে ফেইল করে বসে আছে। পদার্থবিজ্ঞানে মাত্র বিশ পেয়েছে। আর উচ্চতর গণিতে মাত্র দশ। রসায়নে তো টেনেটুনে পাশ করেছে। জীববিজ্ঞান অপশনাল ছিল, তাই বেঁচে গেছে। নয়তো ওটাতেও অবস্থা ভালো না। ইংরেজিতে অল্পের জন্য ফেইল। কিন্তু বাংলায় সে সত্তর পেয়েছে।”
আরাফ অবাক হয়ে আতকিয়া জাহানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবছে, “মাথায় নাই একটুও গিলু, তাই তো এতো ন্যাকামি করে বেড়ায়।”
আতকিয়া জাহানের কথায় পুনরায় তার মনোযোগ আঁটকালো। তিনি অনুরোধের সুরে বললেন, “তুমি তো সায়েন্সে পড়ো। একটু গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানটা ওকে আগিয়ে দিতে পারবে?”
আরাফ অবাক হয়ে বলল, “আমি তো টিউশন করি না। আর পড়ালেও শুধু বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি পড়াই।”
“কেন? বাকিগুলো কেন পড়াও না? কঠিন না-কি!”
“আসলে চর্চা নেই আমার।”
“কি যে বলো, বাবা! সেই ক’বছর আগে পড়েছি। এখনো অংকের সূত্র মনে আছে। এ প্লাস বি হোল স্কয়ার সমান এ স্কয়ার প্লাস টু এ বি প্লাস বি স্কয়ার। হয়েছে না?”
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে বলল, “তাহলে আপনিই পড়ান আপনার গর্দভ মেয়েকে!”
আতকিয়া জাহান বললেন, “পড়াও না একটু। তোমার উপর বিশ্বাস করা যায়। অরুণিকার কাজিন তুমি।”
আরাফ জোরপূর্বক হেসে বলল, “আচ্ছা, আন্টি। পড়াবো।”
আতকিয়া জাহান এক গাল হেসে বললেন, “বেশ, তো। আরেকটা কথা। ইংরেজির জন্য একটা স্যার রাখবো। তোমার বাকী পাঁচজন বন্ধুদের মধ্যে কে ভালো ইংরেজি জানে?”
“ইভান আর আহনাফ ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের লেকচারার।”
“ওদের একটু বলে দেখো!”
“আন্টি, আমি আপনাকে ওদের ফোন নম্বর দিয়ে দেবো। আপনি নিজেই কথা বলে নেবেন।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। ঠিক আছে। এখন যাও। একটু কথা বলে এসো তোমার স্টুডেন্টের সাথে। ও রুমে আছে।”
আরাফ উঠে দাঁড়ালো। ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আজই পড়াতে হবে?”
“না, একটু কথা বলে আসবে। স্টুডেন্টের পড়ার অবস্থা বুঝে আসবে।”
আরাফ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আতকিয়া জাহান রুম দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওই ঘরটা রুহানির। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। তোমার জন্য এক কাপ চা দিচ্ছি।”
আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “না, না। এই সময়ে আমি চা খাই না।”
“আচ্ছা, তাহলে শরবত।”
“না, আন্টি। আমি কিছু খাবো না।”
“ধুর, কি যে বলো। এই গরমে এসেছো। শিক্ষক মানুষ তুমি! যাও আমি নিয়ে আসছি।”
আতকিয়া জাহান আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। এদিকে আরাফ ইতস্ততভাব নিয়ে রুহানির রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। রুহানি ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে ঘরে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। আরাফ রুমের দরজায় ঠোকা দিতেই রুহানি বলল, “কাম ইন।”
রুহানির উত্তরে চোখ-মুখ কুঁচকে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আরাফ। রুহানি পেছন ফিরলো না। ভেবেছে অরুণিকা এসেছে। সে ব্যস্ত হাতে পানি ছিটাচ্ছে। হঠাৎ পানি হাতে পেছন ফিরে আরাফকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো সে। কি বুঝে যে মগে থাকা অবশিষ্ট পানিগুলো আরাফের দিকে ছুঁড়ে দিলো সে নিজেও জানে না। আরাফ চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি ঠোঁট কামড়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, “এই লোকটা কোথা থেকে প্রকট হলো!”
আরাফ শার্টের হাতায় মুখের পানি মুছে রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি এখনো চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। আরাফকে হজম হচ্ছে না তার। স্বপ্ন-টপ্ন নয় তো! এই মানুষের এখানে আসা কি আদৌ সম্ভব? রুহানি গালে হাত দিয়ে ভাবলো, “প্রেমে পড়ি নি তো আবার! সিনেমায় যেমন দেখায়, প্রেমে পড়লেই সামনে চলে আসে! কিন্তু প্রেমে পড়ার মতো কিছুই তো হলো না।”
এদিকে আতকিয়া জাহান রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, “রুহানি, তোর জন্য স্যার এসেছে। বই-টই নিয়ে পড়তে বস। দেখা কি কি সমস্যা আছে।”
রুহানি মায়ের কন্ঠ শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো। ব্যস্ত হয়ে ওড়না খুঁজতে লাগলো। আরাফ বুঝতে পেরে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রুহানি তার ড্রয়ার ঘেঁটে ফেললো। কিন্তু একটা ওড়নাও পেলো না। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কোথায় রেখেছে আমার ওড়না!”
আরাফ রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা তখনই রুম থেকে বেরিয়ে আরাফকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আবার রুমে ঢুকে পড়লো। আরাফ দেয়ালে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এদিকে অরুণিকা দরজা বন্ধ করে মিনমিনিয়ে বলল, “কে ছিল এটা? আরাফ? কিন্তু ও এখানে কেন আসবে?”
(***)
রুহানি অনেক ঘেঁটে একটা ওড়না বের করে মুখ কুঁচকে বলল, “সামার চলে গেলে স্যার রাখতো! একটু কৃত্রিম বৃষ্টিবিলাস করে ঘুমানোটাও হারাম করে দিলো। ধুর, ভাল্লাগে না।”
রুহানি ওড়না গায়ে দিয়ে বই খাতা শব্দ করে টেবিলের উপর রাখছে। আরাফ গলা খাঁকারি দিতেই রুহানি বলল, “আইসা পড়েন। ভদ্রলোক হইতে হবে না আর।”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে রুমের বাইরে। রুহানির কথা শুনে ঢুকার সাহসটাও আর হলো না। এদিকে আতকিয়া জাহান ট্রে হাতে নিয়ে রুহানির রুমের দিকে আসতেই আরাফকে রুমের বাইরে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কি করছো, বাবা?”
মামীর কন্ঠ শুনে রুমে আঁড়ি পেতে দাঁড়িয়ে থাকা অরুণিকা দরজাটা হালকাভাবে খুললো। দেখলো আরাফ সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। আরাফ অরুণিকাকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালো। আতকিয়া জাহান এবার রুহানির রুমে ঢুকে পড়লেন। দেখলেন, মেয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আরাফও এবার রুমে ঢুকলো। আতকিয়া জাহান তাকে চেয়ারে বসতে বললেন। এদিকে তারা রুহানির রুমে ঢুকতেই অরুণিকা রুম থেকে বেরিয়ে রুহানির রুমের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো, কি হচ্ছে! আতকিয়া জাহান নাস্তার ট্রে রুহানির পড়ার টেবিলে রেখে বললেন, “বাবা, ওকে একটু ঠিকমতো দেখো। কি বুঝে না! কোথায় সমস্যা!”
আরাফ মাথা নাড়ল। আতকিয়া জাহান মেয়ের ফুলে যাওয়া গাল চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, “ভালোই ভালোই, পড়ো। নয়তো জীবনে বিয়ে দেবো না।”
আরাফ অবাক হয়ে তাকালো আতকিয়া জাহানের দিকে। মানুষ পড়ালেখা না করলে বিয়ে দেওয়ার কথা শুনেছে। এমনকি রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দেওয়ার কথাও শুনেছে। কিন্তু বিয়ে না দেওয়ার হুমকি এই প্রথম শুনেছে সে। এই বাসায় তাজ্জব প্রাণির বসবাস! অরুণিকাও হয়তো এদের সাথে থাকতে থাকতেই পাগল হয়ে যাচ্ছে। আতকিয়া জাহান চলে যেতেই রুহানি রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আরাফের দিকে। আরাফ কলম হাতে নিয়ে রুহানির চোখের দিকে ইশারা করে বলল, “চোখ কাকে দেখাচ্ছো?”
“এখানে আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো জীব আছে?”
“আমি তোমার স্যার।”
“আমার পড়ালেখা ভালো লাগে না। স্যার হতে হবে না। মা’কে বলেন, আমার পড়ার ইচ্ছা নেই।”
“তো কি করার ইচ্ছা!”
রুহানি এক গাল হেসে বলল, “আপনার সাথে কীসের লুকোচুরি। আপনি আমার বোনুর গুনধর ভাই বলে কথা!”
রুহানি এবার ফিসফিস করে বলল, “আমার সায়েন্সে পড়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। স্কুলেও এ গ্রেট পেয়েছি টেনেটুনে। তাও অরুর দেখাদেখি মা আমাকে সায়েন্সে দিয়ে দিলো। আমি বুঝি না ওসব। অনেক কঠিন। ফিজিক্স তো মাথার উপর দিয়ে যায়। ম্যাথ, ও মাই গড! এতো ডেঞ্জারাস।”
“আর ইংলিশ?”
“একটু গ্রামারে দুর্বল আমি।”
“একটু দুর্বল আর সোজা ফেইল? মানুষ ইংরেজিতেও ফেইল করে?”
রুহানি চোখ ছোট করে বলল, “আমাকে কি অমানুষ মনে হচ্ছে?”
“গাধা মনে হচ্ছে।”
রুহানি কাঁদো কাঁদো মুখে তাকালো আরাফের দিকে। আরাফ রুহানির চেহারা দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, এসব বাদ দাও। আমি তোমাকে অন্তত পাশ করার টেকনিকটা শিখিয়ে দেবো।”
“নকল শেখাবেন?”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “নকল শেখাবো কখন বললাম?”
“পাশ করার টেকনিক!”
“পাশ করার টেকনিক মানে কি নকল শেখানো? কিছু সিলেক্টিভ পড়া দেখিয়ে দেবো।”
“ওহ, সেটাই বলেন, ঘুরেফিরে বইটা আমাকে ধরতেই হবে!”
আরাফ চোখ ছোট করে বলল, “তো! তোমার চেহারা দেখে তোমাকে পাশ করাবে ভেবেছিলে?”
রুহানি গাল ফুলিয়ে বই খুললো। অন্তত বিয়ে করার জন্য হলেও পাশ করতে হবে তাকে। নয়তো সুপাত্র জুটবে না তার কপালে। আজকাল ছেলেরা ইন্টার পাশ মেয়েই যেখানে বিয়ে করে না, সেখানে ইন্টারে ফেইল করে রাজপুত্র কোথা থেকে পাবে সে?
রুহানির মুখটা রাঙা হয়ে আছে। চুল থেকে এখনো টপটপ করে পানি ঝরছে। চোখের পাপড়িতেও পানি। আরাফের হঠাৎ চোখ আঁটকালো রুহানির ভেজা চুলে। ওড়নাটাও ভিজে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত মেয়ে! আরাফ চাপা স্বরে বলল, “তুমি মাথা মুছে এসো!”
রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”
“এভাবে ভেজা চুলে কেউ পড়তে বসে?”
“চুলে কি আগুন লাগিয়েছি? গোসল করলে চুল তো ভেজায় থাকে!”
আরাফ ধমকের সুরে বলল, “আমি তোমার স্যার। ভদ্র ভাষায় কথা বলো!”
রুহানি মুখ ছোট করে বলল, “সরি।”
আবার বইয়ের দিকে তাকালো সে। আরাফ নিজের চুল খামচে ধরে আনমনে বলল, “কেমন ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে রে বাবা! একে পড়ালে আমারই মান-সম্মান যাবে।”
রুহানি পড়ার মাঝে চুল সরাতেই আরাফের চোখে পানির ছিঁটে গিয়ে পড়লো। আরাফ সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করলো। কপালে ভাঁজ পড়লো তার। চোখ খুলে রুহানিকে শক্ত একটা কথা বলার জন্য মুখ খুলবে, এমন মুহূর্তেই থমকে গেল সে। রুহানি ঠোঁট উলটে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ভেজা চুলগুলো কপালে লেপ্টে গেছে। ফ্যান চলছে, তবুও নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দাদির মুখে শুনেছিল, মেয়েদের নাকের ডগায় ঘাম জমলে, না-কি স্বামীর ভালোবাসা পায়। আরাফ রুহানির চোখের দিকে তাকালো। আর ভাবতে লাগলো, “মেয়েটার স্বামীর ভালোবাসা পাওয়ার মতো কোনো যোগ্যতায় তো নেই!”
আরাফ নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো। সে রুহানিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে! কিন্তু কেন? সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো আরাফ। রুহানির দিকে আর অবাধ্য দৃষ্টি দিলো না। নিজেকে আঁটকে রাখলো অজানা কারণেই।
(***)
আরাফ রুহানিকে পড়িয়ে বের হওয়ার আগ মুহূর্তেই অরুণিকার সাথে দেখা হয়ে গেল। অরুণিকা আরাফকে দেখেই না দেখার ভান ধরে দরজা আঁটকে দেওয়ার জন্য দরজার কাছে এলো। আরাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছিস?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “ভালো।”
আরাফ মৃদু হেসে বলল, “তুই শুকিয়ে যাচ্ছিস!”
“তো!”
“এমনি বলছি। খাওয়া-দাওয়া করিস না?”
“তোমার এসব জিজ্ঞেস করতে হবে না।”
“এভাবে কথা বলছিস কেন?”
“আমার সাথে কথা বলো না। তোমার কাজ রুহুকে পড়ানো। তুমি ওর স্যার। আমার কেউ না।”
“আমি তোর ভাই!”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “আপন ভাই তো আর না!”
“কীভাবে কথা বলছিস?”
“তুমি তো আমার সাথে কথা বলতে না! তোমার না আমাকে মিথ্যেবাদী মনে হয়? আমাকে না ঘেন্না লাগে? এখন সেধে আসছো কথা বলতে! অদ্ভুত।”
আরাফ মলিন মুখে বলল, “তুই অনেক স্পেশাল। আমাদের ছ’জনের কাছে তুই এখনো সেই ছোট্ট…”
অরুণিকা আরাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি না, এই পৃথিবীতেই থাকো না। অন্য জগতে আছো। আমি কোনো স্পেশাল মানুষ না। একটা আপদ। যেটা মরছে না দেখেই এতো অস্থির হয়ে আছো তোমরা।”
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোর সাথে জরুরি কথা আছে। একদিন বাইরে বসবি?”
“না, বাবা। তোমাদের বিশ্বাস নেই৷ সেদিন তোমাদের ভদ্রবেশী আহনাফ চৌধুরী আমাকে নিজেই রুমে ডেকে এনে, আবার চাচীকে গিয়ে বলেছে আমিই না-কি তার কাছে ঘেঁষতে গেলাম। মুখের উপর তোমাদের বন্ধু ইভানও মিথ্যে বললো। আমি তোমাদের ছায়ার আশেপাশেও আর ঘেঁষবো না। তুমিও কখন কি অপবাদ দিয়ে বসো!”
আরাফ রাগী স্বরে বলল, “ফালতু কথা বললে চড় খাবি। তুই আমার বোন, অরু।”
“প্লিজ। আমার কোনো ভাই-টাই নেই। যাও তো।”
অরুণিকা আরাফের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। আরাফের নাক-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ রাগ উঠেছে। হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে, বাসায় চলে এলো সে। এদিকে বাসায় এসে বেল দিতেই তাহমিদ দরজা খুললো। কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগটাও দিলো না আরাফ। সোফায় গা এলিয়ে দেওয়া আহনাফের কলার ধরে টেনে তুললো সে। আহনাফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঘুষি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। মুহূর্তেই ছ’জনের ব্যাচেলর সংসারে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেলো। আহনাফ মাটিতে বসে আরাফের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। আরাফ আহনাফের পেটে লাথি মারতে যাবে, ইভান আর তাহমিদ তাকে টেনে একপাশে নিয়ে এলো। ইভানকে দেখে যেন আরো রাগ বাড়লো আরাফের। ইভানকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সে। ইভান টাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো। সে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে রাগী স্বরে বলল, “পাগল হয়ে গেছিস, আরাফ!”
আরাফ চিৎকার করে বলল, “অরুর নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছিস তোরা! আহনাফ ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল রুমে। বল, এটাই সত্য।”
ইভান হাঁপাতে হাঁপাতে আহনাফের দিকে তাকালো। তূর্য আহনাফকে ধরে উঠালো। ইমন অবাক হয়ে বলল, “তোকে এসব কে বলেছে আরাফ?”
আরাফ চেঁচিয়ে বলল, “অরুই বলেছে।”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আর তুই বিশ্বাস করলি?”
আরাফ আবার আহনাফের দিকে তেড়ে যাবে, তাহমিদ আর ইমন তাকে থামালো। ইভান বলল, “অরুণিকা মিথ্যে বলে নি। আহনাফ ওকে ইচ্ছে করে ফাঁসিয়েছে।”
তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কিন্তু কেন?”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “কারণ ও আবরারকে মেরে ফেলেছে। আমার ভাইকে মেরেছে ও। আই হেইট হার। আই হেইট হার।”
আরাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। আর আহনাফের হাত-পা কাঁপছে। সে আরাফের কাছে এসে বলল, “তোর মায়ের খুনীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তুই এখানে এসেছিস, তাই না? আমিও এখানে আমার ভাইয়ের খুনীকে শাস্তি দিতে এসেছি। অরুণিকা চৌধুরী আমার ভাইকে খুন করেছে।”
তাহমিদ আহনাফের বাহু চেপে ধরে বলল, “অরু তখন মাত্র নাইনে পড়তো। বাচ্চা মেয়ে ছিল!”
“তাই বলে মেরে ফেলবে আমার ভাইকে? ওই শান্ত মেয়েটা এখন শান্ত হয়েছে। ও যে কেমন জেদি ছিল, সেটা ভুলে গেছিস? ওর জেদের কারণে আমি আমার ভাই হারিয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল আমার ভাই। আই হেইট হার।”
আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তুই কি পাঁচ বছর আগেও অরুণিকাকে নিয়ে যেটা বলেছিলি, সেটা মিথ্যে ছিল?”
“হ্যাঁ ছিল। ইচ্ছে করে ফাঁসিয়েছি ওকে। ইচ্ছে করে।”
আহনাফ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে। শব্দ করে কাঁদছে সে। আহনাফকে এভাবে কখনোই কাঁদতে দেখে নি আরাফ, তাহমিদ আর ইমন। তারা তিনজনই বেশ অবাক। তূর্য আর ইভান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য যদিও পাঁচ বছর আগের ব্যাপারে কিছুই জানতো না। সে আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই ওকে ওভাবে শাস্তি না দিলেও পারতি। বউ তোর। বিয়ে করেছিস ওকে। পুরো পরিবারের সামনে একটা ফ্যামিলি ফাংশনে তুই ওমন জঘন্য কাজ কি করে করলি? আমি এতো বছর ভেবেছি, মেয়েটার মাথায় জং ধরেছিল। ইঁচড়েপাকা ভেবেছিলাম মেয়েটাকে। কিন্তু সমস্যা তো তার মাথায়।”
আহনাফ তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর আবরারের সাথে যা হলো!”
“তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর, কেইস করে নি কেন? জেলে পাঠিয়ে দিতি। তিলে তিলে না মেরে, একেবারেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দে। মেরেছে তো মেরেছে। ও বাচ্চা ছিল। এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।”
আহনাফ হাসলো। শব্দ করে হাসলো। হাসতে হাসতে বলল, “আমার ভাই মরেছে, আমার কষ্ট হচ্ছে। তোর ভাই মরলে তুই বুঝতি। আর তুই আমাকে কেন এই কথা বলছিস? কোন মুখে প্রশ্ন করছিস? তোর কী ক্ষতি করেছিল উপমা? ওকে কেন ঠকালি তুই? আর ওকে ঠকানোর পর আমি কি কখনো প্রশ্ন করেছি তোকে? উপমা তোর কেউ হয় না। কিন্তু অরুণিকা আমার বউ। তোদের কারো অধিকার নেই আমাকে প্রশ্ন করার। আমার অরু, আমার বউ, আমি যা ইচ্ছে করবো। মারবো, শাস্তি দেবো, কাঁদাবো, ইচ্ছে করলে ভালোবাসবো। তোদের এতো মাথা ব্যথা কেন? ওর লিগ্যাল গার্জিয়ান আমি।”
তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “বন্ধ কর এসব! তোরা সবাই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিস। তোদের সাথে থাকলে আমার মাথাটাও খারাপ হয়ে যাবে।”
আরাফ বলল, “মাথা তো সবারই খারাপ হয়ে আছে। থাক, ও করুক যা করার। মেরে ফেলুক ওর বউকে। আমিও দেখবো! আরাফ চৌধুরীর ফুলে কেউ একটা ঠোকা লাগিয়ে দেখাক, আমি তার পুরো বাগানটাই ধ্বংস করে দেবো।”
আহনাফ হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে লেগে থাকা রক্ত মুছে সে বাঁকা হেসে বলল, “সেই বাগান ধ্বংস করার আগে দেখে নিস ফুলগুলোতে কার নাম আছে! মনে রাখিস, বাগানও আমার, ফুলও আমার, ধ্বংসও আমিই হবো। যেই গল্পের নায়ক আর খলনায়ক একজনই হয়, সেখানে কেউ হারে না, কেউ জিতে না। আবার যে হারে, সেই জিতে। খেলা আমার, মাঠ আমার, হারবো আমি, জিতবোও আমি। মাইন্ড ইট!”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২১ ||
রুদবা ও অরুণিকা পাশাপাশি বসে আছে। জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে দুই বান্ধবী। আড্ডার বিষয়ে স্থান পাচ্ছে কখনো রহস্য ব্যান্ডের নতুন গানের ভিউস, কখনো বা নতুন বই নিয়ে, আবার কখনো ভার্সিটির কোনো এক মেয়ে-ছেলের প্রেম নিয়ে। কথার ফাঁকে অরুণিকা রুদবাদের ভাড়া বাসার ছাদটিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “খুব শৌখিন তো তোদের বাড়ির মালিক! দেখ কি সুন্দর সুন্দর ফুল গাছ লাগিয়েছে।”
রুদবা ফুল বাগানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওটা বাড়ির মালিক লাগায় নি। আহনাফ স্যার লাগিয়েছেন।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো রুদবার দিকে। হোঁচট খেলো কথাটি শুনে। হালকা হেসে বলল,”তোকে বলেছে তো!”
“আরেহ সত্যি বলছি।”
অরুণিকা অবাক হলো। রুদবা জিজ্ঞেস করল, “তুই অবাক হচ্ছিস কেন?”
“অবাক হওয়ার বিষয়, তাই অবাক হচ্ছি। আমি যখন ও বাড়ি থাকতাম, আমারও ফুল বাগানের শখ ছিল। ছাদে অনেক গাছ লাগিয়েছিলাম। আর ওই আহনাফ সব গাছ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। আমার বাগানের জন্য তার না-কি হাঁটা-চলায় সমস্যা হচ্ছিল।”
“যাহ! কি যে বলিস।”
“আমি কি তোকে শুধু শুধু মিথ্যে বলবো?”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“তো, এখন যে নিজেই লাগালো?”
“সেটাই তো। এখন কারো হাঁটা-চলায় সমস্যা হচ্ছে না?”
রুদবা অরুণিকার কাঁধ থাপিয়ে সান্ত্বনার সুরে বলল, “তোকে ভালো লাগতো না, তাই হয়তো জ্বালানোর জন্য এমন করতো।”
ভালো লাগতো না, কথাটা অরুণিকার বুকে তীরের মতো বিঁধলো। সে নিচের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। রুদবা সেই হাসির অর্থ বুঝলো না। সে নিজের মনেই অরুণিকার সাথে কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু অরুণিকার চোখে-মুখে স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিশোধস্পৃহা। সে বাঁকা হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে রুদবাকে বলল, “তুই আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। গলা শুকিয়ে গেছে। এমনিতেই যা গরম পড়ছে! বরফ দেওয়া পানি আনিস।”
“আচ্ছা, চল তাহলে। একসাথে নামি।”
“আচ্ছা, তুই নাম। আমি আসছি।”
“আচ্ছা।”
রুদবা নেমে পড়তেই অরুণিকা তাড়াতাড়ি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত বাগানের সামনে এসে বসলো। ফুলগুলো দেখে বেশ মায়া হলো তার। কিন্তু শয়তানি হাসি হেসে বলল, “সরি, প্রিয় পুষ্পমালা, তোমাদের আমি এমন মালিকের মালিকানায় বড় হতে দিতে চাইছি না। সে কখনোই ফুল ভালোবাসে নি। তার সত্যিই যদি বাগানের প্রতি ভালোবাসা থাকতো, সে অন্তত আমার গাছ ডাস্টবিনে ফেলে দিতে পারতো না। এমন মানুষের ফুল বাগানের শৌখিনতা আমার দৃষ্টিতে ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই না। তার জন্য আমি এতো কষ্ট পেয়েছিলাম যে সেদিনের পর ভুলেও আমি একটা ফুলের চারা কিনে আনি নি। অনেক কেঁদেছিলাম আমি আমার ছোট্ট ছোট্ট ছোট্ট চারাগুলোর জন্য। আজ আহনাফ চৌধুরীকেও আমি বোঝাবো, শখের জিনিস নষ্ট করলে কেমন কষ্ট হয়।”
অরুণিকা ফুলের চারাগুলো সব গোড়া থেকেই উঠিয়ে নিলো। মিনিটের মধ্যেই সব টব খালি। যেই টবে একটু আগেও ছোট ছোট ফুল ফুটেছিল, সেখানে এখন শুধু মাটিই অবশিষ্ট আছে। অরুণিকা সব ক’টা চারা হাতে নিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলো। রুদবা অরুণিকার জন্য দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। অরুণিকার হাতে চারাগুলো দেখে আঁতকে উঠলো সে। তাকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে বলল, “মেরে ফেলবে স্যার। কি করলি তুই এটা?”
“বেশি কথা না বলে আমাকে একটা পলিথিন দে।”
“এত্তোগুলো চারা ফেলে দিবি তুই?”
“না, অন্য কোথাও লাগাবো। তুই দে আমাকে।”
রুদবা পলিথিন এগিয়ে দিতেই অরুণিকা চারাগুলো সব পলিথিনে ঢুকিয়ে বলল, “আমি ভালো জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে আসবো।”
“ভাই, কি যে হবে এখন? তুই তো দেখছি এক নম্বরের ফাজিল। এতো ইনোসেন্ট সাজিস কিভাবে তুই? এভাবে কেউ রিভিঞ্জ নেয়? স্যার জানতে পারলে তোর সাথে কি যে করবে!”
“তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? এখন মুখটা বন্ধ রাখ।”
রুদবা ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল, “হুম।”
অরুণিকা পলিথিন নিয়ে নিচে নেমে পড়লো। এরপর রাস্তায় ইমানকে দেখে থেমে গেল। ইমান অরুণিকার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “ণিকা, তুমি কোথায় পালাচ্ছো?”
ইমানের প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি পালাচ্ছি?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই মনে হচ্ছে।”
“ধুর। কি যে বলেন! আচ্ছা, একটা হ্যাল্প করবেন?”
ইমান এক গাল হেসে বলল, “আমি তোমার হ্যাল্প করবো না, সেটা কি হয়?”
“আমি নতুন চারা কিনেছি। ভাবছি, লাগাবো। কোথায় লাগাবো?”
ইমান ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ছাদে লাগাবে!”
“না, না। ওই বাসায় না। বাইরে লাগাতে চাচ্ছি।”
“কেন? বাইরে তো যত্ন নিতে পারবে না।”
“এমন কোনো জায়গা যেখানে গাছগুলোও সেইফ, আর আমি এসে পানিও দিতে পারবো।”
ইমান সেকেন্ড খানিক ভেবে বলল, “একটা মাঠ আছে। ওখানে গাছ লাগানো যাবে। তুমি যত্নও নিতে পারবে।”
“তাহলে চলুন না আমার সাথে। আমাকে চারাগুলো লাগাতেও একটু সাহায্য করবেন!”
ইমান চমকে উঠলো অরুণিকার কথায়। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। সে সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল। এরপর রিকশা নিয়ে তারা সোজা সেই মাঠে চলে এলো। ভার্সিটির কাছেই সেই মাঠ। ভার্সিটি আসলে চারাগুলোর যত্ন নিতে অসুবিধে হবে না।
মাঠটা বিশাল। এখানে অনেকবার তাদের ভার্সিটির ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বিভিন্ন মেলার আয়োজনও এখানে করা হয়। যদিও এই মুহূর্তে মাঠ শূন্য। এই জৈষ্ঠ্যের বিকেলে কেউ বাইরে এসে খেলছে না। সবাই পাখার নিচে আরাম খুঁজে নিতেই ব্যস্ত। কিন্তু এমন মুহূর্তেই মাঠের এক কোণায় বসে ইমান আর অরুণিকা চারা লাগাচ্ছে। দু’জনের মধ্যে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। নীরব প্রকৃতিতে শোনা যাচ্ছে দু’জন তরুণ-তরুনীর কন্ঠস্বর। মাঝে মাঝে নারী কন্ঠের হাসির ঝংকারে প্রকৃতির সাথে সাথে মুগ্ধ হচ্ছে এক জোড়া পুরুষ চক্ষু। মৃদুমন্দ সমীরণ যেন সেই পুরুষের মনের তোলপাড়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। পরবর্তীতে দৃশ্যপট পালটে গেল। দেখা যাচ্ছে দুই হাতে কাঁদা মাটি নিয়ে এক তরুণের পেছন পেছন ছুটছে উচ্ছ্বাসিত তরুণী। তার হাসি যেন আজ থামছেই না। জমে থাকা রাগ-অভিমান নেমে যাওয়ায় তার ঠোঁটের হাসি ঠিকরে পড়ছে প্রকৃতির বুকে। কি চমৎকার সেই হাসি! কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হলো না সেই হাসিটা। বলিষ্ঠ বক্ষের সাথে ধাক্কা লাগায় সেই হাসি থমকে গেল মুহূর্তেই। চোখ দু’টিতে ভীড় করলো এক রাশ ভীতি। অরুণিকার হাতে কাঁদা মাটি লেগে আছে। ইমানের হাতেও তাই। একটু আগেই দু’জন গাছ লাগিয়েছিল। গাছ লাগাতে লাগাতে কিছু সময়ের মধ্যেই দু’জনের ভালোই ভাব জমে উঠেছিল। অরুণিকার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই প্রাণোচ্ছল মেয়েটি বেরিয়ে এসেছিলো একটু আগেই। ইমান হুট করে অরুণিকার নাকের ডগায় বিনা অনুমতিতেই লাগিয়ে দিয়েছিল কাঁদা। ব্যস, অরুণিকাও ইমানকে পাকড়াও করবে। তারা ছোটাছুটি করছিল সেই মাঠে। ভুলেই গিয়েছিল, এখন তারা আর কিশোর-কিশোরী নয়। কুড়ি অতিক্রম করা দু’জন তরুণ-তরুণী।
অরুণিকা সামনে অপরিচিত মানুষটিকে দেখে ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ইমান অরুণিকাকে আড়াল করে সেই আগন্তুকটির সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকটির পেছনে আরো চার-পাঁচজন দাঁড়ানো। অরুণিকা উলটো দিকে ফিরে গায়ের ওড়না ঠিক করে নিলো। মনে মনে ভাবতে লাগল, “বড়-সড় বিপদে পড়ি নি তো আবার!”
লোকগুলোর মধ্যে একজন ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এটা কি পার্ক যে তোমরা খেলতে এসেছো?”
ইমানের কথাটা বেশ গায়ে লাগলো। শক্ত স্বরে বলল, “গাছ লাগাতে এসেছি।”
“তা তো দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম।”
অরুণিকা কিছু একটা বলতে যাবে, ইমান তাকে বাঁধা দিল। অরুণিকার হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেল। আগন্তুকটি ইমানের এমন আচরণে অপমানবোধ করলো। ইমান মাঠে লাগানো কলের পানিতে হাত ধুয়ে নিল। অরুণিকাও হাত পরিষ্কার করে ফেলল। আগন্তুকটি এবার তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। অরুণিকা ইমানের শার্ট খামচে ধরে ইমানের পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। ইমান বুকে হাত গুঁজে বলল, “বললাম তো আমরা গাছ লাগাতে এসেছি।”
আগন্তুকটি ইমানকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, “আমার নাম মতিন। এখানকার স্থানীয় আমি। সবাই আমাকে মতিন শেখ বলে। বস আমি। এই জায়গার বস। আমার এলাকায় এমন নষ্টামি আমি সহ্য করতে পারবো না। খেলার আর জায়গা পাও না।”
অরুণিকার চোখ-মুখ লাল হয়ে এলো। লজ্জায় যেন মাটিতেই ঢুকে পড়বে সে। অরুণিকার ভয়ার্ত চেহারা দেখে মতিন দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তার লোকেদের ইশারা করতেই তারা ঘিরে ধরলো ইমান ও অরুণিকাকে। অরুণিকা এসব দেখে আরো শক্ত করে খামচে ধরলো ইমানের শার্ট। ইমান নিজেকে শান্ত করে বলল, “আপনি ইচ্ছে করে ঝামেলা করছেন। ও আমার ফ্রেন্ড।”
মতিন ইমানের মুখের কাছে এসে বলল, “কি কি কি?”
“আমরা ফ্রেন্ড, এখানে গাছ লাগাতে এসেছি।”
“আচ্ছা, গার্লফ্রেন্ড?”
মতিনের কথায় তার লোকগুলো হৈ-হৈ করে উঠলো। তারা ঠাট্টার হাসি হাসছে। মতিন এবার ইমানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অরুণিকার দিকে ঝুঁকে আসতেই ইমান কলার চেপে ধরলো তার। ইমানের স্পর্ধা দেখেই চোখ বড় বড় করে তাকালো মতিন। তার লোকগুলোও যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ইমান দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “আমাদের ভালোই ভালোই যেতে দিন। নয়তো…”
“ধমকাচ্ছিস আমাকে? এইটুকুন ছোকড়াটা না-কি আবার মতিনকে ধমকায়।”
মতিনও শক্ত করে ইমানের কলার টেনে ধরলো। অরুণিকা তা দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “প্লিজ আমাদের যেতে দিন।”
ইমান চোখ গরম করে অরুণিকার দিকে তাকালো। ইমানের চোখের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলো সে। মতিন ইমানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল, “তোদের বাবা-মার নম্বর দে। এখনি তোদের নষ্টামি বের করছি।”
ইমান ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মতিন অরুণিকার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল, “কানে যায় নি কি বলেছি?”
অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বললো, “আমার বাবা-মা নেই।”
অরুণিকার কথায় মতিন শব্দ করে হাসলো। ইমান অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। ওদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার।”
মতিন ইমানকে এবার হালকা ধাক্কা মেরে বলল, “এক্কেবারে উঠিয়ে নিয়ে যাবো। মেয়ে মানুষ নিয়ে ঘুরিস, একটু সামলে থাকবি না? এই মেয়ের যদি কিছু হয়, পরে তো আর ফিরেও তাকাবি না।”
অরুণিকার দম আঁটকে গেল এই কথা শুনে। পুরো মাঠে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। আশেপাশে কোথাও কোনো মানুষ নেই। এখানে তার কোনো বিপদ হলে কেউ বাঁচাতে আসবে না তাকে। আর ইমান একা এতোগুলো লোকের সাথে কীভাবে পারবে? তবে ইমান এবার একটু নরম হলো। অরুণিকার দিকে একনজর তাকিয়ে মতিনকে বলল, “প্লিজ, আমাদের যেতে দিন। আমরা গাছ লাগাতে এসেছি। ওখানেই কথার ফাঁকে হাসাহাসি করছিলাম। দেটস ইট।”
মতিন ইমানের পরিবর্তিত ব্যবহারে আরো সুযোগ পেলো। সে ইমানের হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভালোই ভালোই ফোন নম্বরটা দিয়ে দে।”
ইমান মাথা নেড়ে তার বাসার টেলিফোন নম্বরটা দিলো। মতিন ইমানের দিকে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এতো সহজে নম্বর দিয়ে দেবে সেই আশা করে নি মতিন। ফোনের স্ক্রিন থেকে নম্বরটি কেটে সে অরুণিকাকে বলল, “তোমার বাবা-মার নম্বর দাও।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আমার বাবা-মা নেই।”
“নাটক করো? মিথ্যে বলো আমাকে?”
ইমান বলল, “ও সত্য বলছে।”
“তুই চুপ কর।”
মতিন পুনরায় অরুণিকাকে জিজ্ঞেস করলো, “থাকো কোথায়? এই ছোকড়াটার সাথে থাকো না-কি?”
অরুণিকা না সূচক মাথা নাড়লো। মতিন বলল, “দাও তোমার গার্জিয়েনের নম্বর, দাও।”
অরুণিকা আনমনে ভাবতে লাগলো, আতকিয়া জাহান তো কখনোই এখানে আসবেন না। রুহানিকে বললে, সে এসে উলটো ফেঁসে যাবে। তাই সে আরাফের নম্বরটিই দিয়ে দিলো। এদিকে মতিন ফোন বের করে আরাফের নম্বরে ডায়াল করলো। ওই মুহূর্তে ছ’জনই একসাথে বাসায় বসে টিভিতে বাংলাদেশ আর ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল। টান টান উত্তেজনা চলছে। এমন মুহূর্তে ফোন বেজে উঠতেই আরাফের কপালে ভাঁজ পড়লো। বিরক্ত মুখে কল রিসিভ করতেই মতিন ওপাশ থেকে বলল, “আপনাদের বাড়ির মেয়ে যে রাস্তায় রংঢং করে বেড়াচ্ছে, সেই খেয়াল কি আছে আপনাদের? মেয়েদের এতো ছুট দেন আপনারা!”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার কানের কাছে এনে বলল, “আপনি কে বলছেন?”
“আমি মতিন। আপনাদের মেয়ে একটা ছেলের সাথে হাতেনাতে ধরা পড়েছে।”
আরাফ ইশারায় টিভির ভলিউম কমাতে বলল। তূর্য ভলিউম কমাতেই সবাই আরাফের দিকে তাকালো। তাহমিদ জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
আরাফ মাথা নেড়ে বলল, “জানি না।”
ওপাশে মতিন ফোন নামিয়ে অরুণিকাকে জিজ্ঞেস করলো, “কি নাম তোমার?”
“অরুণিকা।”
মতিন এবার ফোন কানের এনে আরাফকে বলল, “অরুণিকা নাম। কি হয় আপনার?”
আরাফ চমকে উঠলো অরুণিকার নাম শুনে। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “আপনি কে? অরু কোথায়?”
“ঠিকানা বলে দিচ্ছি, চলে আসেন।”
কল কেটে যেতেই আরাফ বেরিয়ে পড়লো। আরাফের পিছু পিছু বাকী পাঁচজনও বেরিয়ে গেল। ছ’জনই হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে উঠে বসলো। ছ’টা মোটর সাইকেল সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে পড়ল বিল্ডিংয়ের গ্যারেজ থেকে। একসাথে ছ’টা মোটর সাইকেল বের হতে দেখে এলাকার মানুষ কিছু সময়ের জন্য সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। রুদবাও বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে গালে হাত দিয়ে বলল, “এই ব্যাচেলরগুলো মাঝে মাঝে একশন মুভির ভাইব দেয়, যেন এক একটা হিরো। দেখতেও সব’কটা হিরোদের মতোই। দেখে লাগেই না এখানের দু’জন ভার্সিটির স্যার, আরেকজন ডাক্তার। মানে কোথা থেকে আসে তাদের এই ভাবসাব!”
(***)
শূন্য মাঠে একে একে ছ’টি মোটর সাইকেল ঢুকলো। মতিন ও তার সহকারীদের হাবভাব পালটে গেল। এক সহকারী তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভাইজান, কাকে ডাকলেন? এখানে তো দেখি পুরা বাহিনী চলে আসছে।”
ইমান আর অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে মোটর সাইকেল আরোহীদের দিকে। ছ’জনই মোটর সাইকেল থেকে নামলো। মতিন শেখ বুকে হাত গুঁজে ছ’জনের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “কি-রে মিয়া? এইখানে কি?”
আরাফ হেলমেট খুলে অরুণিকার দিকে একনজর তাকিয়ে মতিনকে বলল, “তুমিই তাহলে ফোন দিয়েছিলে আমাকে?”
“আচ্ছা, তুমিই এই মেয়ের গার্জিয়ান?”
“ইয়েস।”
“দেখে তো মনে হইতেছে না।”
“তাহলে কীভাবে মনে হওয়াতে পারি?”
মতিন ধমকের সুরে বলল, “এই মেয়ে এই ছোকড়ার সাথে হাতেনাতে ধরা খাইছে।”
ইমান দাঁত কটমট করে বলল, “শাট আপ। আমি ণিকার সাথে গাছ লাগাতে এসেছি এখানে।”
ইমন হেলমেট খুলে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “গাছ লাগানোর আর কোনো জায়গা ছিল না?”
অরুণিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা হেলমেট খুলতেই ইভান আর আহনাফকে দেখে চমকে উঠলো ইমান। সে অরুণিকার দিকে আঁড়চোখে তাকালো। তাহমিদ বলল, “বাসায় কি জায়গার অভাব ছিল?”
মতিন হাসলো। তার কথার মান তো রেখেছে এই ছ’যুবক। সে দাঁত কেলিয়ে বলল, “প্রেম করার নতুন অজুহাত।”
আহনাফ চোখ ছোট করে তাকালো অরুণিকার দিকে। আরাফ বলল, “ওরা জাস্ট ফ্রেন্ড। দেটস ইট!”
“ওরে বাবা! এগুলা তো দেখছি দেটস ইটের বংশধর।”
তূর্য অরুণিকাকে বলল, “বাইকে উঠে বসো তুমি।”
অরুণিকা তূর্যের কথামতো মোটর সাইকেলে ওঠার জন্য সামনে পা বাড়াতে যাবে, তখনই মতিন অরুণিকার হাত ধরে ফেললো। ছ’জনের চেহারা মুহূর্তেই পালটে গেল। ইমান তৎক্ষণাৎ ধাক্কা দিয়ে মতিনকে সরিয়ে দিতেই সে উল্টে পড়তে নিলে, তার সহকারী তাকে ধরে ফেললো। মতিন রাগান্বিত চোখে ইমানের দিকে তাকাতেই সে ধমকের সুরে বলল, “আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে গাছ লাগাচ্ছি, হাসছি তাতে মিয়া তোমার এতো সমস্যা! আর এখন যে তুমি বিনা অনুমতিতে ওর হাত ধরলে তোমার হাত ভেঙে দিলে কেমন লাগবে?”
মতিন চেঁচিয়ে বলল, “ওই, তোর এতো বড় সাহস আমাকে শাঁসাচ্ছিস?”
মতিন এবার তার লোকেদের অরুণিকাকে ধরার জন্য ইশারা করলো। তারা এগিয়ে আসবে, তখনই আহনাফ মতিনের বুকে জোরে একটা লাথি দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। মতিন বুকে হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মতিনের লোকেরা তাদের দিকে এগিয়ে আসতেই আরাফ তার হেলমেট দিয়ে সামনে আসা লোকটির কাঁধে জোরে আঘাত করতেই, বাকিরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। মতিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এই মেয়ে একটা ছেলের সাথে নষ্টামি করতে এসেছে, আর তাকে বাঁধা দেওয়া আমার দায়িত্ব। এটা আমার এলাকা।”
ইমান চিৎকার করে বলল, “দ্বিতীয় বার এক্সপ্লেইন করবো না আমি। এবার যা বলেছি, হাত দিয়ে বুঝাবো।”
মতিন উলটো চিৎকার করে বলল, “এই মেয়েকে গার্জিয়ান ছাড়া আমরা যেতে দেবো না। তোমরা কারা মিয়া? তোমরাও কি এর প্রেমিক না-কি? একটা মেয়ের ক’টা প্রেমিক!”
তাহমিদ মতিনের কলার ধরে বলল, “ভাই আমরা। ওর ভাই হই।”
“ভাই বলতে বহুত শুনছি। ভাই না। বাপ নিয়ে আসতে হবে।”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল, “আমি তোর বাপ। আর এই মেয়ে তোর মা। এবার বাধ্য সন্তানের মতো সরে যা। নয়তো আরেকটা লাথি খেয়ে সোজা তোর আসল বাপের কাছে চলে যাবি।”
মতিনকে টেনে নিয়ে এলো তার সহকারীরা। মতিন চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, “আমার এলাকায় আমার সাথে দাপট দেখায় এরা। এদের ছাড়বো না আমি।”
তূর্য বলল, “আয়, আয়। আমরা তোর অপেক্ষায় আছি।”
মতিনকে নিয়ে চলে গেল তার সহকারীরা। তারা চলে যেতেই ইমান অরুণিকার কাছে এসে বলল, “সরি, তোমাকে এখানে নিয়ে আসা উচিত হয় নি।”
অরুণিকা আহনাফের হাত ছেড়ে দিয়ে ইমানকে বলল, “সরি তো আমার বলা উচিত। আমার হ্যাল্প করতে এসেই তো আপনার এই অবস্থা হয়েছে। সরি। রিয়েলি ভেরি সরি।”
আহনাফ হাত মুঠো করে বলল, “সরির রচনা লিখবে এখন? বাসায় চলো!”
অরুণিকা আহনাফের দিকে একনজর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আরাফের দিকে তাকালো। এরপর মুখ নামিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ। তুমি না এলে অনেক বড় বিপদে পড়তাম আমি।”
আরাফ কিছু বললো না অরুণিকাকে। সে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাংকস। আমরা না আসা পর্যন্ত অরুর পাশে থাকার জন্য। আমার তোমাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। কি নাম তোমার?”
ইমান মৃদু হেসে বলল, “ইমান।”
আরাফ এবার ইমানের পিঠ থাপিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ অরুণিকাকে বলল, “ইমান অনেক ভালো ছেলে। তুই ওর সাথে এসেছিস, তাই আমি তোকে আজ বকাঝকা করছি না। কিন্তু এভাবে যেখানে সেখানে যাওয়া উচিত না।”
আরাফের কথা শুনে আহনাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। আর অরুণিকা এক গাল হেসে ইমানের দিকে তাকালো। ইমানও হাসলো। অরুণিকার ভাই তাকে পছন্দ করেছে, এর চেয়ে দ্বিতীয় কোনো ভালো লাগা এই মুহূর্তে তার জন্য হতে পারে না। আরাফ এবার মোটর সাইকেলে উঠে ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অরুকে বাসায় নিয়ে যাও। আমরাও আসছি।”
তাহমিদ আর ইমন আরাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তূর্য আর ইভান আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আহনাফের শীতল দৃষ্টি আরাফের দিকে নিবদ্ধ। আরাফ মোটর সাইকেলে উঠে হেলমেট পরার আগ।মুহূর্তেই ভ্রূ নাচিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিল। এরপর চাবি ঘুরিয়ে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিল। তাহমিদ আর ইমনও মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। ইমান অরুণিকাকে সামনে এগুতে ইশারা করতেই অরুণিকা আহনাফকে পাশ কেটে ইমানের সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগ মুহূর্তে সেও এক নজর আহনাফের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালো। আহনাফ তা দেখে তার মোটর সাইকেলে জোরে পদাঘাত করতেই নিজের পায়ে ব্যথা পেল। ইভান আহনাফকে ধরে বলল, “পাগল হয়ে গেলি না-কি?”
তূর্য মোটর সাইকেলে উঠে বসে বলল, “তোর বন্ধু যেই কাজ করেছে, করছে আর ভবিষতেও যেই কাজ করার পরিকল্পনা রেখেছে, খুব বেশি দেরী না, তাকে সেই খেতাবই দিতে হবে। আগে থেকেই পাবনায় সিট বুক করে রাখ আহনাফ চৌধুরীর নামে। নিজের পায়ে কুড়াল মারা কেউ তোর কলিগ বন্ধু থেকেই শিখে!”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “ও আমার বউ, আরাফের কোনো অধিকার নেই, ওকে ওই ইমানের সাথে যেতে দেওয়ার।”
তূর্য বলল, “শুধু মুখের বউ। কাজের কিছুই না। সেদিন রাতেও ইমানের সাথে যেতে না দিয়ে ইভানকে বলে জয়িতার সাথে পাঠিয়েছিলি, মনে আছে? তোর বউকে ফেলে এসেছিল তোর মায়ের বান্ধবীর মেয়ে। আর তুই কি করলি? মেয়েটাকে একটা শায়েস্তাও করতে পারলি না। জাস্ট সেক্রেটারির পদ থেকে সরালি।”
ইভান বলল, “আর সেই রাতে কি ইমান পারতো অরুণিকাকে বাঁচাতে? আমরা না এলে ও কিছুই করতে পারতো না। আজও পারে নি।”
“এখন বিকেল। এখন এমনিতেই কিছু করতে পারবে না। আর এরা কিছু করার মতো ছেলেও না। এরা জাস্ট হুমকি দেবে, টাকা নিবে, বাপ-মা ডেকে এনে হট্টগোল করবে। আর ওদিনের গুলো মাস্তান ছিল। ক্রিমিনাল ছিল।”
আহনাফ তূর্যের দিকে শক্ত মুখে তাকিয়ে আছে। তূর্য চলে যেতেই আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “তূর্য কী বোঝাতে চাইলো? আমি আমার ওয়াইফকে প্রটেক্ট করতে পারছি না? ওই ইমান ছেলেটা আমার সামনে আমার ওয়াইফকে নিয়ে গেল, শুধুমাত্র আরাফের জন্য।”
ইভান বলল, “তুই পরিস্থিতিই এমন করে দিলি, আজ তোর কোনো বন্ধুই তোর পাশে নেই, আহনাফ। সরি টু সে, বাট ইউ আর রং। ইউ আর নট পারফ্যাক্ট ফর অরুণিকা। চেঞ্জ ইউরসেল্ফ, আদারওয়াইজ লিভ হার। সি ডিজার্ভস বেটার দেন ইউ।”
চলবে–