#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২২ ||
রুদবা ছাদে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। এমন সময় আহনাফকে ছাদে উঠতে দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল তার। ওভাবেই নেমে পড়লো ছাদ থেকে। আহনাফ রুদবাকে দৌঁড়ে নামতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো তার যাওয়ার দিকে। চোখ সরিয়ে পুরো ছাদে চোখ বুলিয়ে নিতেই বাগানে চোখ পড়লো তার। চেহারার রং পাল্টে গেল মুহূর্তেই। খালি টবগুলোর কাছে এসে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হাত মুঠো হয়ে এলো তার। নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে। কপালের রগ ভেসে উঠেছে। আহনাফ হনহনিয়ে নেমে পড়লো ছাদ থেকে। রুদবা পীপহোলের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফকে ছাদ থেকে নামতে দেখে কানে হাত দিয়ে চোখ-মুখ খিঁচে রাখল সে। যা ভাবলো তাই। মুহূর্তেই পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে এলো চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ। রুদবা তাদের ফ্ল্যাটের দরজা হালকা খুলে পা টিপে টিপে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে আহনাফ আর আরাফের বাগবিতণ্ডা চলছে। অরুণিকায় যে আহনাফের চারাগুলো চুরি করে ইমানের সাথে সেই মাঠে লাগিয়ে এসেছে, তা পুরোপুরি পরিষ্কার। এদিকে আরাফ তো বেশ খুশি। শব্দ করে হেসে বলছে, “উচিত কাজ করেছে অরুণিকা।”
এই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। আরাফের দল ভারী। কারণ তাহমিদও আরাফের পক্ষ নিয়েছে। অন্যদিকে ভেতরে আর কারো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। বাকীরা হয়তো চুপচাপ তামাশা দেখছে। রুদবা মনে মনে ভাবলো, “অরু তো বড় বাঁচা বেঁচে গেল। আরাফ ভাইয়া আর তাহমিদ ভাইয়া তো ওর সাপোর্টে আছেন। এখন আহনাফ স্যার আর ওকে বকাবকি করতে পারবেন না।”
রুদবা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পেছন ফিরতেই চমকে উঠলো সে। চিৎকার করতে যাবে তখনই তূর্য তার মুখ চেপে ধরলো। রুদবা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তূর্য আর তার পাশে দাঁড়ানো ইভানকে দেখে শুকনো ঢুক গিললো। মনে মনে ভাবলো, “হায় হায়! আহনাফ স্যারের টিম তো বাইরে। এজন্যই তো হেরে যাচ্ছিল স্যার। এখন ইভান আর তূর্য স্যার যদি জানতে পারেন, অরুণিকা চৌধুরী, তুই তো খাতাম।”
তূর্য রুদবাকে ছেড়ে দিতেই রুদবা মাথা নিচু করে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। ইভান শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “দরজার কাছে কি?”
রুদবা চোখ-মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য ভেতর থেকে চেঁচামেচির শব্দ শুনে বলল, “ঝগড়া দেখতে এসেছে বোধহয়। ভেতরে তো চৌধুরী-চৌধুরী মারামারি লেগেছে মনে হচ্ছে।”
ইভান আর তূর্য ভেতরে ঢুকে পড়লো। রুদবাও দ্রুত তার বাসায় ঢুকে ফোন করে অরুণিকাকে পাশের ফ্ল্যাটের গুরুত্বপূর্ণ শিরোনামটি দিয়ে দিলো। অরুণিকা সব শুনে হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়লো। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তুই হাসছিস? মেইন তিনটাই তো তোর ক্যাম্পাসে। তোর কপালে দুঃখ আছে সোনা!”
“তূর্য শেখ আর ইভান রাহমান আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আর ওই বোমটাকে তো আমি দেখে নেবো। এখন আর রিভিঞ্জ অব নেচারের ওয়েট করবো না। এখন রিভিঞ্জ অব অরুণিকা চলবে। দেখ তুই, ওই গ্রেনেডের সাথে আমি কি করি।”
“গ্রেনেড?”
“কারণ চাবি আমার কাছে। আমি চাবি ফেললেই সে ফাঁটবে। তুই জাস্ট আমাকে নিউজ দিস। বেচারা এই জন্মে আর গাছ লাগাবে না, দেখিস। তার হাজার টাকার গাছ দান করে মিসেস, ওপস সরি। স্লিপ অব ভাগ্য! ইটস মিস। মিস অরুণিকা চৌধুরী প্রকৃতিকে দান করে এসেছে আহনাফ চৌধুরীর হাজার টাকার গাছ। ইন্টারেস্টিং শিরোনাম, তাই না?”
রুদবা চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “তোর শিরোনাম তুই বুঝ। আমি তো আজ গন্ডগোল দেখতে গিয়ে তূর্য স্যার আর ইভান স্যারের হাতে ধরা খেয়ে ফেলেছি। ওরা আমাকে কি ভাববে এখন?”
“চিল বেইবি। পজিটিভ চিন্তা কর। জার্নালিস্ট ভাববে তোকে।”
“হয়েছে, তোর জার্নালিজম তোর কাছে রাখ।”
“আচ্ছা, রাখছি। ওকে বাই। আমি লাড্ডু বানাচ্ছি। এই গুড নিউজে একটু মিষ্টিমুখ করে নি। তোকেও মিষ্টি পাঠাবো। পাশের ফ্ল্যাটেও পাঁচটা দিয়ে আসিস। আর একটা বেশি দিবি কিন্তু। দানের নিয়তে।”
“দান!”
“দানেরটা আহনাফ চৌধুরীর নামে। বেচারা সর্বহারা এখন।”
(***)
চাঁদ রাত। দীঘি পাড়ে ভীড় জমেছে এক ঝাঁক কিশোর-কিশোরীর। দীঘির এপাড়ে একটি গ্রাম৷ নাম রানী গ্রাম। অন্যপাড়ে আরেকটি, যার নাম রাজা গ্রাম। নামগুলো স্থানীয়দের দেওয়া। গ্রাম দু’টির আসল নাম ভিন্ন। তবে এমন রাজা-রানী নাম রাখার বিশেষ কারণ হল, প্রায়ই ওই গ্রামের রানীদের সাথে এই গ্রামের রাজার সহিত প্রণয় ঘটে। তবে ধুমধাম করে বিয়ে কখনোই হয় না। রাজারা রানীদের উঠিয়ে নিয়ে আসে। এককথায় পালিয়ে বা অপহরণ করে বিয়ে। রাজা গ্রামটির বেশ দুর্নাম। রাজার মতোই যেন প্রতিটি পুরুষের স্বভাব। বিয়ে করবে একটার পর একটা। বউ আনবেও সেই রানী গ্রাম থেকে। আর এই দুই গ্রামকে আলাদা করে রেখেছে একটি দীঘি। দীঘিতে কোনো তরী বাঁধা নেই। সাঁতরে পার হতে হয়। প্রস্থও মোটামুটি বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের মতোই দূরত্ব। তবে দৈর্ঘ্য বেশ। লোকমুখে এই দীঘির নাম শুকুন্তলা। আসল নাম শকুনী তলা। তবে উচ্চারণ বিকৃতির ফলে মিষ্টি একটা নাম পেয়েছে সেই দীঘি। আর এই শুকুন্তলা দীঘির এপারের গ্রামবাসীদের সাথে ওপাড়ের গ্রামবাসীদের ঘোর বিরোধ।
এদিকে রাজা গ্রামের সেই কলঙ্কের ছাপ বয়ে বেড়াচ্ছে চৌধুরী, রাহমান ও শেখ বংশ। এই তিন বংশই ভিন্ন গ্রাম থেকে এসে রাজা গ্রামে জমি কিনে এখানকার স্থানীয় হয়েছে। বড় চৌধুরীর সাথে বড় রাহমানের ভালোই আঁতাত। সেই আঁতত থেকে তারা একসাথে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। যেই ব্যবসা থেকে মোটা অংকের লাভ আসে দুই বংশে। অন্যদিকে শেখ পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক দুই বংশেরই। এভাবেই এই তিন বংশ রাজা গ্রামের সভ্য বংশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই তিন বংশ বাদে বাকীরা যেন উঠেপড়ে লেগেছে গ্রামের সম্মান নষ্ট করতে৷
বড় চৌধুরী ও তার ভাই ছোট চৌধুরীর মোট চার সন্তান। সবাই সৃষ্টিকর্তার দয়ায় পুত্র সন্তান লাভ করেছেন। রাজা গ্রামটিকে তাই পুরুষ সন্তানদের ভূমি বলা হয়৷ এই গ্রামে ছেলে সন্তান বেশি হয়। এর বিশেষ কোনো কারণ আছে কি-না তা কেউ বের করতে পারে নি। তবে লোকেরা পুরুষ সন্তানের জন্মভূমির এই গ্রামটিকে শক্তিশালী গ্রাম মনে করেন৷ তাদের মতে নারীরা দুর্বল, অন্যদের উপর নির্ভরশীল। আর সেই ধারণা থেকেই তারা মনে করেন, নারী সন্তান হলেই যেন এই গ্রামে অশুভ কিছু হবে। এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামে তিনটি শিক্ষিত সভ্য বংশের বংশধরদেরও রয়েছে আলাদা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে।
প্রথমটি চৌধুরী বংশ। বড় চৌধুরী সাহেব বেশ রাগী স্বভাবের মানুষ। পেশা তার ডাক্তারি। বউ এনেছেন, অন্য অঞ্চল থেকে। তিনিও আবার স্কুল শিক্ষিকা। সেই গ্রামের প্রথম শিক্ষিত বউ তিনি। গ্রামের অন্যান্য নারীরা প্রায়ই তার কাছে এসে পরামর্শ চায়। বেশ নাম-ডাক মিসেস চৌধুরীর। অন্যদিকে ছোট চৌধুরী সাহেব বেশ শান্ত মানুষ ছিলেন। ডাক্তারি পড়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন আমেরিকান রমনীকে। তবে পারিবারিক ভাবেই সেই বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দু’জনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তবে রেখে যান তাদের একমাত্র পুত্র তাওসিফ শাহরিয়ারকে। বড় চৌধুরী সাহেব তার ভাইয়ের ছেলে তাওসিফ শাহরিয়ারকে আদর-যত্ন কম করেন নি। পরবর্তীতে তাওসিফ শাহরিয়ারও ডাক্তার হয়ে বের হোন। বিয়ে করেন তার বড় চাচার পছন্দে। তবে তার একমাত্র পুত্র তাহমিদ শাহরিয়ার সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনা করছে। পাশাপাশি টুকটাক কবিতা লেখে সে। তাহমিদ এই বংশের একমাত্র শান্ত ছেলে, যে পরিবারের সব নিয়ম মেনে চলে। বলা যায় দাদার চরিত্রের অধিকারী।
তবে বড় চৌধুরী সাহেব নিজেই তিন সন্তানের বাবা। তার সব সন্তানই ডাক্তার। বড় ছেলে আরেফিন চৌধুরী, যার একমাত্র সন্তান আরাফ চৌধুরী। আরাফ খুব তিরিক্ষি মেজাজের ছেলে। তবে সেও পরিবারের নিয়ম অমান্য করে নি কখনো। দাদা ভক্ত নাতি সে। আপতত সে চৌধুরী বংশের কনিষ্ঠ ডাক্তার হতে যাচ্ছে। তার মা মারা গিয়েছিল অনেক বছর হচ্ছে। আত্মহত্যায় মৃত্যু। কি কারণে যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন তা এখনো অজানা। স্ত্রীর মৃত্যুতে আরেফিন চৌধুরীর পেশাগত দিকে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। থানায় অনেক দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হয়েছিল তাকে। তবে ক্ষমতা ছিল দেখেই মামলা থেকে বেঁচে ফিরেছেন আরেফিন সাহেব। ওদিকে মায়ের মৃত্যুর পর আরাফ অভদ্র হয়ে উঠে। কারো কথা শুনে না সে। নিজের যা ইচ্ছে, তাই করে। দাদা তার নাতিকে বেশ ভালোবাসেন। তাই তাকে বাঁধা দেন নি কখনো। মা-মরা ছেলে আরাফের সব কথা মেনে নেওয়া শুরু করেন তিনি।
অন্যদিকে বড় চৌধুরীর মেজো ছেলে জুবায়ের করিম চৌধুরী। তবে তার স্ত্রী নীহারিকা সেই বংশের অপছন্দের পাত্রী। পারিবারিক নিয়ম ভেঙে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন জুবায়ের সাহেব। সেই বংশের একমাত্র কন্যা সন্তানের বাবা তিনি। অরুণিকা চৌধুরী তারই সন্তান। নীহারিকা বেশ মিষ্টি মেয়ে ছিলেন। অথচ শাশুড়ী আর স্বামী ছাড়া আর কারোই ভালোবাসা পান নি তিনি। উলটো রাজা গ্রামের প্রথম অভিশপ্ত নারীর খেতাব পেয়েছিলেন অরুণিকার জন্মের পর। তবে বড় চৌধুরী সাহেব শিক্ষিত মানুষ। তাই কন্যা সন্তান হওয়া নিয়ে তার খুব বেশি সমস্যা ছিল না। তবে অরুণিকা দাদার খুব একটা ভালোবাসা না পাওয়ার মূল কারণ তার বাবা প্রেম করে তার মাকে বিয়ে করেছিল।
ওদিকে বড় চৌধুরীর কনিষ্ঠ সন্তান আমির চৌধুরী ও তার স্ত্রী শিরিন সুলতানা সেই বংশের সকলের চক্ষুমণি। বর্তমানে আমির সাহেব ও শিরিন সুলতানার কথায় সবকিছু উঠেবসে। তাদের দুই সন্তান। আহনাফ চৌধুরী ও আবরার চৌধুরী। আবরার দশ বছর বয়সে দশতলা ভবন থেকে পড়ে মারা যায়। আর আহনাফ চৌধুরী সেই বংশের একমাত্র অভদ্র সন্তান। বাবা-মা, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী কাউকেই ভয় পায় না সে। নিজের ইচ্ছেমতো চলে। যা ইচ্ছে করে। বাকীদের কোনো সুপারিশ যদি পরিবারের বড়দের কাছে করতে হয়, একমাত্র আহনাফকে হাত করতে পারলেই সম্ভব। আহনাফ খুব চমৎকারভাবে বড়দের ম্যানিপুলেট করতে জানে। অরুণিকার জীবনের সব সিদ্ধান্তে সে-ই তার পরিবারকে ম্যানিপুলেট করেছিল, যার দরুন অরুণিকার ঠিকানা আজ তার মামার বাড়িতে।
রাজা গ্রামে চৌধুরী বংশের পর দ্বিতীয় শিক্ষিত বংশ রাহমান বংশ। যেই বংশের আপতত শেষ দুই বংশধর ইভান রাহমান আর ইমন রাহমান। তারা জমজ, অথচ দু’জনের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। একজন গম্ভীর, অন্যজন চঞ্চল। অন্যদিকে শেখ বংশের আপতত শেষ বংশধর তূর্য শেখ, যে পুরো গ্রাম আর বংশের একমাত্র পরিচিত মুখ রহস্য ব্যান্ডের প্রধান গায়ক হিসেবে। গ্রামের এমন কোনো মানুষ নেই, যে তূর্যকে ভালোবাসে না। গ্রাম আর পরিবারের একমাত্র আদরের সন্তান তূর্য শেখ, যে কি-না সবাইকে ধোঁকা দিয়ে সেই কাজটি করেছিল, যেই কাজের জন্য রাজা গ্রাম কলঙ্কিত ছিল।
(***)
চাঁদ রাতে দীঘির পাড়ে বসে থাকা কিশোর-কিশোরীদের ঝাঁক এখন আর দেখা যায় না। দীঘির দুই পাশে কাঁটাতারের বেড়া। বর্ষা এলেই এখন দীঘির দুই ধারে পানি উপচে পড়ে। অথচ সেই পানিতে সাঁতার কাঁটতে দেখা যায় না কাউকে। তবে সেই চাঁদ রাতে দীঘির পাড়ে ভীড় করা কিশোর-কিশোরীর ঝাঁকের মধ্যে এক জোড়াতে ছিল তীব্র প্রেম, অন্য জোড়াতে কি ছিল, তা এখনো রহস্য।
রানী গ্রামের দুই রাজকন্যা। একজনের নাম শতাব্দী, অন্যজন উপমা। ঘোর বিরোধের মাঝেও রাত হলে দীঘির এপাড়ে ছ’জন কিশোরের সাথে, ওপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন কিশোরীর আড্ডা জমতো প্রায়ই। সেই হাসি-ঠাট্টার শব্দ আকাশে-বাতাসে মিশে আলোড়ন সৃষ্টি করতো। মাঝে ছোট অরুণিকা গালে হাত দিয়ে বসে দুই পক্ষের গল্প শুনতো। দূরত্ব খুব বেশি না। তবে জোরে জোরে কথা বলায় বেশ ছড়িয়ে পড়তো তাদের কথোপকথন। বাচ্চা মানুষ, তাই বড়দের আপত্তিও ছিল না। তবে আপত্তি করা উচিত ছিল। করলে হয়তো এই কাঁটাতারের বেড়াটা আর লাগাতে হতো না। দীঘির জল উচ্ছ্বাস থাকতো এখনো।
একটা নতুন খেলা আবিষ্কার হলো। বুদ্ধি দিয়েছে রানী গ্রামের রাজকন্যা শতাব্দী। তার মাথায় একমাত্র ওমন অদ্ভুত সব খেলা আসে। তবে সবাই শুনে বেশ মজা পেল। খেলাটি ছিল, দীঘিতে এপাড়ের একজন নুড়ি পাথর ছুঁড়বে। যার পাথরটি অন্য পাড়ে গিয়ে পৌঁছাবে, সে-ই জয়ী হবে। আর যারটা পৌঁছাতে পারবে না, দীঘির জলে হারিয়ে যাবে, তাকে ওপাড় থেকে প্রশ্ন করা হবে। যেই সেই প্রশ্ন নয়! ভয়ংকর প্রশ্ন। যেমনটা সত্য-মিথ্যার খেলায় হয়, সেরকমই। ব্যস, খেলা শুরু হয়ে গেল। রানী গ্রাম শক্তিতে দুর্বল। প্রায়ই হেরে যায়। তবে রাজা গ্রামের ছ’জন কিশোর একবারো হারে নি। প্রশ্নটা তাই তারাই রানী গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়। কখনো আরাফের কৌতুহলি প্রশ্ন, “ওপাড়ে সাঁতরে এলে কি তোমরা আমাদের মেরে ফেলবে?”
শতাব্দীর উত্তর আসে প্রতিধ্বনিত হয়ে, “এসেই দেখো, কোনদিকে খুন হয়ে যাও, বলা তো যায় না।”
কখনো শোনা যায় আহনাফের বিদঘুটে শর্ত, “পানিতে চারবার ডুব দিয়ে এসো।”
আর তখনই কয়েকটা মেয়ে ডুব দিয়ে উঠে বলে, “আমরা যদি একবার পৌঁছাতে পারি, তোমরা তো শেষ।”
আর উত্তরে আহনাফ অট্টহাসি হেসে বলে, “ঘুম থেকে উঠে পড়ো। তোমাদের স্বপ্ন দীঘির জলেই ডুবে গেছে।”
এদিকে ইভানের জ্ঞানী প্রশ্ন, “রানী গ্রামের রানীরা এতো দুর্বল কেন হয়?”
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে না। শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি হতে থাকে। তূর্য সেই সুযোগে ছুঁড়ে দেয় তার শয়তানি প্রশ্ন, “রানী গ্রামের রানীদের বিয়েতে কাবিন কতো দিতে হয়?”
শতাব্দীর উত্তর আসে, “সামর্থ্য নেই তোমাদের৷ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া রাজারা সেই প্রশ্নের উত্তর জেনে কি করবে, হুম?”
“বলেই দেখো। আমরা শিক্ষিত রাজা। অনেক ধনী। উঠিয়ে এনে খরচায় ভাটা ফেলবো না।”
“তাহলে শোনো, হৃদয় দিতে হয় কাবিনে। ছেড়ে গেলে যেন দুঃখ পেয়ে ফিরে আসে।”
“ছেড়ে গেলে আবার কীসের দুঃখ!”
“রানী বিরহ যন্ত্রণা বুঝিবে না তুমি, হে রাজা!
রাজার মন বাঁধে না এক রানীতে, তাদের বহু বিবাহই অন্য রানীর সাজা।
কাবিনে যদি হিয়া করো দান, তবেই বুঝিবে রানী হীনা রাজা বেমানান।”
শতাব্দীর এমন ছন্দ মেলানো পদ্য বেশ পছন্দ তাহমিদের। সেও মিষ্টি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “কি ভালো লাগে, কবিতা না-কি গান!”
শতাব্দীর হাসির ঝংকার ফিরে আসে। জোর গলায় সে বলে,
“কেউ যদি হয় কবি হবো তার কবিতা,
যদি বাঁধে সুর, হয়ে যাবো তার গীতা।”
অন্ধকারে মিষ্টি হাসে তাহমিদ। বেশ মিষ্টি কন্ঠ মেয়েটার! তখনই ইমনের উদ্ভট প্রশ্ন শোনা যায়, “ওখানে কী এমন আছে, যা এখানে নেই?”
উপমা জোর গলায় বলে, “সম্মান আছে, ওখানে হয়তো নেই।”
“কীভাবে বুঝলে!”
“দেখলেই বোঝা যায়।”
এভাবেই চলতো তাদের কথোপকথন। আর রাতের অন্ধকারেই হারিয়ে যেতো। দিনে তাদের প্রায় আসা হতো এদিকটাই, তবে গ্রামের হাটের রাস্তাটি পাশেই। দিনে ওখানে বড়দের বেশ আনাগোনা। সাহস করে তাই কেউ কথা বলতো না। যার দরুণ কন্ঠের ওপাড়ে কে শতাব্দী, কে উপমা তা এপাড়ের রাজার পুত্রগণের কাছে ছিল রহস্য।
কেটে যেতে থাকে তাদের কৈশোরকাল। এরপর একদিন সেই কাঁটাতার লেগে যায় দুই দীঘির পাড়ে। কেন লাগানো হয়? কি হয়েছিল? সেসব অনেকেরই অজানা। সবাই প্রশ্ন করে এ নিয়ে। তবে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যায় রাজা গ্রামের তিন শিক্ষিত বংশ। সেই প্রশ্নের উত্তর কি আদৌ মিলবে কি-না সন্দেহ।
পুরোনো অতীত নিয়ে ভাবছিল তাহমিদ। তার পাশেই তূর্য বসে আছে। রাত অনেক হয়েছে। দু’জনের পাশাপাশি ছাদে বসে আছে। তূর্য তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার উপর তোর খুব রাগ, তাই না?”
তাহমিদ ক্ষীণ হাসলো। বলল, “কারো উপর কোনো রাগ নেই। প্রকৃতি তার নিয়ম মেনেই চলে। আর যা হয়েছে, সেটা নিয়মের বাইরে হয় নি। ভুলের শাস্তি পেতেই হয়। নিয়ম যে ভেঙেছে, সে-ই শাস্তি পাচ্ছে।”
“তাহমিদ! তুই সত্যটা চাপিয়ে রাখিস না।”
“অরুর জীবন আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে, নিয়ম ভাঙার শাস্তি কোনো না কোনো ভাবে পেতেই হয়। শাস্তিটা কেউ দেখে না। সেই শাস্তি ভয়ংকর!”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব ||
ক্যাম্পাসে এসেই কেন্টিনে চলে গেল অরুণিকা। কেন্টিনে গোল হয়ে বসে আছে জয়িতা ও তার ক্লাসমেটরা। টেবিলের উপর একটা বোতল রাখা। তারা একটু পরপর সেটা ঘোরাচ্ছে। যার দিকে বোতলটি থামছে তাকে একেক জন একেকটা ডেয়ার দিচ্ছে। অরুণিকা গালে হাত দিয়ে তাদের খেলা উপভোগ করছে আর আনমনে হাসছে। হঠাৎ অরুণিকার স্মৃতিতে ভেসে উঠলো অতীতের এক সন্ধ্যাবেলা। সেই সন্ধ্যায় এভাবেই গোল হয়ে বসেছিল সাতজন। ছ’জন কিশোরের মাঝে একটি কিশোরী। অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে বসে দেখছিল সেই খেলা। বোতলটি ঘুরছিল সাতজনের মাঝে। আহনাফের দিকে থামতেই তাকে ডেয়ার দিল তূর্য। ভয়ংকর ছিল সেই ডেয়ারটি। আহনাফের কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিল তূর্য। অরুণিকা তখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল আহনাফের দিকে।
আহনাফের বয়স তখন উনিশ। সদ্য কলেজ পাশ করেছিল সে। তাই বয়স হিসেবে কিশোরও বলা যায় না তাকে৷ কৈশোরের ধাপ পার করার মুহূর্তেই ছিল সময়টা। আর অরুণিকার বয়স হয়তো চৌদ্দ হবে। সদ্য অষ্টম শ্রেণি পাশ করা কিশোরী সে। গুনে গুনে পাঁচ বছরের ছোট সে আহনাফের।
সেই সন্ধ্যায় আহনাফের চোখ আটকালো অরুণিকাতে। অরুণিকাও কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আহনাফের দিকে। হঠাৎ আহনাফ টুপ করে তার গালে চুমু খেল। অরুণিকার কৌতুহলি চোখ দু’টিতে মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটলো। সে গাল ঘষতে ঘষতে বলল, “ইয়াক, কি করলে এটা?”
আহনাফ অরুণিকাকে গাল ঘষতে দেখে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তূর্য আর ইমন এমন দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে মাটিতে শুয়ে পড়লো। অন্যদিকে আরাফ আর তাহমিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “তূর্য আমাকে এই ডেয়ার দিয়েছে। আমার দিকে কেন তাকিয়ে আছিস তোরা? ওকে জিজ্ঞেস কর। ও বলেছে আমি যাতে অরুকে চুমু দেই।”
ইভান কানে হাত দিয়ে বলল, “একটু তো লজ্জা শরম রাখ। এইটা আবার উচ্চারণ করতে হয় না-কি৷ শুনতেই কেমন ক্ষ্যাত লাগছে। স্মার্টলি বল।”
তূর্য ইভানের পিঠ থাপিয়ে বলল, “রাইট ইভান, ইউ আর রাইট। একটু স্মার্টলি বলা যেতো, আহনাফ। এমনিতে জোস ছিল না ডেয়ারটা? বেচারা আহুনাফের প্রেস্টিজ!”
আহনাফ উঠে তূর্যের পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, “আহুনাফ কি আবার? নামটাও ঠিকমতো নিস না। আহুনাফ ডাকবি না আর।”
তূর্য তাড়াতাড়ি উঠে আরাফ আর তাহমিদের পাশে বসে পড়লো। আহনাফ তাই তূর্যকে আর কিছু করতে পারলো না। এদিকে আরাফ তূর্যকে বলল, “এমন ডেয়ার কেন দিলি?”
তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আরেহ, আমার টুইংকেল এখন আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বউ। ভাই, তোরা তো আমাকে এখন আর কিছু বলিসই না। তোরা আমাকে প্লে বয় বলিস, তাই না? কিন্তু যে এতো কাহিনী করে পিচ্ছি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে তাকে তো কিছুই বলিস না। আমি জ্বরের ঘোরে প্রেম করি নি বলে আজ কলঙ্কিত। আর এই মিসকা শয়তানটা জ্বরের ঘোরে বিশ্ব জয় করে বসে আছে। আর আমি তো ভাই ভদ্র মানুষ। রাস্তার কাউকে ধরে তো চুমু খেতে বলি নি। মিসকাটাকে তো আমি হালাল ডেয়ার দিলাম। বউ মানে বউ। এখানে দ্বিতীয় কিছু নাই।”
তাহমিদ রাগী স্বরে বলল, “চুপ। আসছে হালাল ডেয়ার দিতে। এসব বন্ধ কর। কেউ দেখলে তোর ডেয়ার তোকেই বুঝিয়ে দিতো।”
অরুণিকা তাদের কথার মাঝখানে উঠে চলে গেল। আহনাফ তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “বেইমানি করেছিস আমার সাথে।”
“তুই যে আমার টুইংকেলকে বিয়ে করে ফেললি, বিনা অনুমতিতে ওটা বেইমানি না?”
“ও তোর টুইংকেল না। ও আমার অরু। বুঝেছিস?”
“হ্যাঁ, তাই তো পালিয়েছে। যা গিয়ে পিচ্চি অরুকে মানিয়ে আয়। বিয়ে করেছিস, ভালো কথা। এখন গিয়ে পিচ্চি বউয়ের রাগ সামলা।”
আহনাফও এবার অরুণিকার পিছু পিছু গেল। এদিকে অরুণিকা জগ হাতে নিয়ে সেই পানি দিয়ে মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। আহনাফ তা দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো, “এমন করার কি আছে?”
“ইয়ু, যাও তো তুমি। এখন থেকে আমার কাছেও আসবে না আর। একশো হাত দূরে থাকবে। যখনই কাছে আসো, একটা না একটা ঝামেলা করো।”
“কি ঝামেলা করেছি?”
“গত বছর শীতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছো, ওমনি সবাই ধাক্কাধাক্কি করে বিয়ে করিয়ে দিলো। আর এখন….”
“ডেয়ার ছিল। আর তুই এখন আমার বউ।”
“বয়েই গেছে আমার বউ হতে। তুমি এখনো আমার কাজিন ব্রো।”
আহনাফ মাথায় চাপড় মেরে বলল, “ওই ফাজিল। তোর ব্রো কোন দিক দিয়ে হ্যাঁ? তোর বর এখন, নট ব্রো।”
“ওকে ব্রো, ওপস বর, তুমি এখন সর। নয়তো দূরে গিয়া মর।”
“হোয়াট!”
অরুণিকা হনহনিয়ে চলে গেল। আহনাফের নাক-মুখ লাল হয়ে গেল রাগে৷ এই পিচ্চিটা তাকে মুখের উপর অপমান করে। কোথায় বিয়ে করে বরকে সালাম করবে। না, উলটো আহনাফের এখন তার পায়ে ধরতে হয়।
অতীত স্মৃতি বেরিয়ে এলো অরুণিকা। মনে মনে ভাবলো, “সেই তখনও আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি নি। ভালোবাসা কি সেটাই বুঝি নি। অথচ এক বছরের মধ্যে কীভাবে যেন তুমি আমার মনে গেঁথে গেলে! সব বয়সের দোষ। এটাকে বলে আবেগের বয়স। আর আবেগের কোনো কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।”
অন্যদিকে আহনাফ অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে চেয়ারে। ইভান তার কাঁধে হাত রাখতেই তার মনোযোগ ভাঙলো। ইভান জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছিস?”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আমি সেই রাতে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে চিন্তা করি সেই অন্যায়টা না করলে কি আবরার বেঁচে থাকতো? অরু কি সেই শীতের রাতের শাস্তি দিয়েছিল আমাকে?”
“কেন ভাবছিস এই কথা?”
“ও তো আমাকে ভালোবাসতো না। হুট করে আমাকে ভালোবাসলো কীভাবে? ও তো আমাকে সহ্য করতে পারতো না। হুট করে আমাকে মেনে নিলো কীভাবে? আর একদিন হুট করেই আমার পুরো পৃথিবী রাঙিয়ে দিয়ে, আবার সেই রঙিন পৃথিবীটাই নিভিয়ে দিয়ে গেল।”
“ও বয়সে অনেক ছোট ছিল, আহনাফ। মাঝে মাঝে আমি ভাবতে বাধ্য হই, ও কি সত্যিই তোর উপর ক্ষোভ থেকেই আবরারের সাথে এমন করেছিল? না-কি অন্যকিছু?”
“সব প্রমাণ তো আছেই। বাসায় আবরারের সাথে যা যা হতো, তা কি দেখি নি? আর অন্য কিছু কি? আমি ওকে আঘাত করতে চাই নি। আমি অরুণিকাকে ভালোবাসি এখনো। কিন্তু যখনই দেখি একটা খুনী খুন করেও হাসছে, বড় হচ্ছে, আমার তখনই রক্ত গরম হয়ে যায়। আবরার বেঁচে থাকলে কি এভাবেই হাসতো না? পড়াশুনা করতো না? আমার চোখের সামনে বড় হতো ও। আমার ভাইটাকে মেরে ফেললো কীভাবে মেয়েটা? বাচ্চা ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার সময় কি একটুও বুক কাঁপে নি ওর?”
“হুম, তাও আবার সেই ছেলে যে অবুঝ। মানসিক প্রতিবন্ধী একটা বাচ্চা!”
আহনাফ চোখ গরম করে তাকালো ইভানের দিকে। ইভান চুপ হয়ে গেল। আহনাফ থমথমে কণ্ঠে বলল, “আমার ভাইকে প্রতিবন্ধী বলবি না। ও সুস্থ ছিল। একটু কম বুঝতো। কিন্তু আমি ঠিকই ওকে সব শিখিয়ে দিতাম। আমি বড় করতাম ওকে। আমি ওর শিক্ষক হতাম। আমি আমার ভাইকে সব শেখাতে পারতাম। কিন্তু অরু সেই সুযোগটা আর দেয় নি। সব শেষ করে দিয়েছে। সব।”
চলবে–