#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৩ ||
ক্লাসে ঢুকলো অরুণিকা। আহনাফ ডেস্কের সামনে দাঁড়ানো। অরুণিকাকে দেখে থমকে গেল সে। গাঢ় তাম্রবর্ণের শর্ট টপসের সাথে শুভ্র জিন্স। ঠোঁটে মিষ্টি রঙা লিপস্টিক। চোখে গাঢ় লাল কাজল। আহনাফ অরুণিকার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, তখনই অরুণিকা মাথা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “স্যার আসবো?”
আহনাফের ঘোর কাটলো। ইশারায় ঢুকতে বলে চোখ সরিয়ে ডেস্কে রাখা বোতলটি হাতে নিয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো। অরুণিকার খোলা চুল কোমড় অব্ধি পৌঁছেছে। প্রায়ই চুল বেঁধে আসে সে। খোলা থাকলেও কিছু চুল ক্লিপ দিয়ে আটকানো থাকেই। কিন্তু আজ মাথায় কোনো ক্লিপ নেই। চুলগুলো পুরোপুরি উন্মুক্ত। অরুণিকা ক্লাসে ঢুকতেই ফ্যানের হাওয়া স্পর্শ করলো তার খোলা চুল। মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে গেল তার কেশগুচ্ছ। আহনাফ তা দেখে ডেস্কে হাত রাখলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিশোরী অরুণিকার মুখখানা।
“আহনাফ, আমার চুলে বেনী করে দেবে?”
আহনাফ অরুণিকার কাঁধ ধরে তাকে তার সামনে বসিয়ে দিল। বেশ ঘন বাদামি বর্ণের চুল অরুণিকার। এখনো বেনী করা শিখে নি সে। কিন্তু স্কুলে বেনী করেই যেতে হয়। তাই প্রতিদিন নিয়ম করে ছ’তলা থেকে চার তলা নেমে আসে অরুণিকা। আর আহনাফের হাতে বেনি করে নেয়। আহনাফও নিয়ম করে অরুণিকার চুলে হাত ডুবিয়ে দেয়। সেই কেশগুচ্ছের স্পর্শে অনুভূত হয় রেশমের! আহনাফ ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলল, “মেজ মা কোথায় রে? তুই প্রতিদিন আমার কাছেই কেন আসিস চুল বাঁধতে?”
“মা তো ব্যস্ত। বাবার মেডিকেলে যেতে হবে। মাও যাবে অফিসে। আমি আর বিরক্ত করি নি ওদের। আর তুমিই তো বললে, আমার চুল বেঁধে দিতে তোমার খুব ভালো লাগে।”
“আচ্ছা? সেই কথা মনে রেখে দিয়েছিস?”
“হ্যাঁ, মনে রাখবো না? তুমি তো আমার বর।”
আহনাফ চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “কি বললি?”
“বর বললাম তোমাকে।”
“তুই হঠাৎ আমাকে বর মানলি? অদ্ভুত ব্যাপার না? বেশ রহস্যময় লাগছে।”
“চাচীই তো বললো, তুমি আমার বর। এখন থেকে যাতে মেনে নেই এই সত্যটা। আর দাদী বললো মেয়েদের বিয়ে না-কি একবারই হয়। দু’বার হয় না। এখন আগে জানলে কি তোমাকে বিয়ে করতে চাইতাম বলো?”
আহনাফ অরুণিকার চুল টেনে ধরে বলল, “যা, তোর চুল তুই বেঁধে নে।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে ঘুরে শব্দ করে হাসলো। আহনাফের রাগ নিমেষেই পানি হয়ে গেল। অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তুই এমন মজা করিস না, অরু। তোকে ভালোবাসি আমি। হ্যাঁ, মানলাম আমাদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। এই যুগে এটা খুব উদ্ভট। আর ফ্যামিলির বাইরে কেউ জানেও না তুই আমার বউ। কিন্তু তোর পড়াশুনা শেষ হলেই আমাদের সম্পর্কটা সবাইকে জানানো হবে। আমি তোর বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছি কিন্তু।”
“আমি মজা করছি না, আহনাফ। আমিও এটা নিয়ে ভাবছি।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কালও তুই আমাকে আরাফের মতোই কাজিন মনে করতি। আজ হুট করেই বর বলে ফেললি? একদিনে দাদী তোকে কি অংক করিয়েছে, বল তো?”
“কেন তুমি খুশি হও নি?”
আহনাফ অরুণিকাকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “বাদ দে। সময় নে। তুই তো আমারই আছিস। পালানোর সুযোগ তো আর নেই। আরেকটু বড় হ, তারপর।”
“কিস করে জড়িয়ে ধরার সময় তো মনে ছিল না আমি ছোট!”
অরুণিকা এই বলে উঠে চলে যাওয়ার সময় আহনাফ তাকে পেছন থেকে টেনে তার পিঠে মাথা রেখে বলল, “সরি।”
অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তবে ভালোই হয়েছে। আমার এমন বাসার পাশে শ্বশুড়বাড়ি বেশ পছন্দ হয়েছে।”
আহনাফ চমকে উঠলো। অরুণিকা তার দু’হাত পেছনে রেখে শরীর হেলিয়ে আহনাফের বিছানায় বসে তার মোজা পরা পা দু’টি দুলিয়ে বলল, “আমি তাই তোমাকে আজ থেকে আমার বর মেনে নিলাম। এখন থেকে তুমি আর আমার কাজিন ব্রো নও। যা হয়েছে আমি ভুলে গেছি।”
“তুই আমাকে অবাক করে দিচ্ছিস, অরু!”
“অবাক হচ্ছো কেন? এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আমার বর ভাবতেই তাক ধিনা ধিন করতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে তাকিয়ে থাকি হাঁ করে। খুশিতে মরে যাই গাজী ট্যাংকের ভেতর ডুব দিয়ে।”
আহনাফ চোখ-মুখ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তেড়ে আসতে যাবে ওমনিই অরুণিকা গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো। আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো, “মজা করছিস?”
অরুণিকা মিষ্টি হেসে বলল, “মজা কেন করবো, ডিয়ার বর।”
“তুই এখনো ছোট।”
“বারেহ, আবার সেই ছোট! তোমার মুখে সয় না এই কথা।”
“ক্লাস নাইনে তুই। পড়ালেখা কর আগে।”
অরুণিকা ঠোঁট গোল করে বলল, “কি মিষ্টি উক্তি! ইচ্ছে করছে পানিতে গুলিয়ে খেয়ে ফেলি।”
আহনাফ অরুণিকার বেনী টেনে ধরে বলল, “তুই দিনদিন একটু বেশি কথা বলছিস। কার থেকে এসব কথা শিখছিস?”
“গার্লস স্কুলে পড়ি আমি।”
“কোন গার্ল শেখাচ্ছে?”
অরুণিকা আহনাফের কানের কাছে এসে বলল, “সিক্রেট।”
অরুণিকা এই বলে দরজার কাছে চলে গেল দৌঁড়ে। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তোর চুলগুলো আমিই বেঁধে দেবো এখন থেকে। তোর খোলা চুল বাঁধার আর সেই চুল স্পর্শ করার অধিকার যেন শুধু আমারই থাকে।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন?”
“সিক্রেট।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। আহনাফ স্মিত হেসে বলল, “কারণ তোর খোলা চুলগুলো আমার প্রশান্তি। তোর চুলে হাত ডুবিয়ে আমি শান্তি পাই। তোর চুলের ঘ্রাণ আমাকে মুগ্ধ করে। আমি হারিয়ে যাই তোমার চুলের স্পর্শ পেয়ে। কোথায় হারাই জানি না। তোকে ভালোবাসি, অরু। ভীষণ ভালোবাসি। তোর চুলগুলো আমার দুর্বলতা। এভাবে খোলা চুলে আসিস রোজ। আমি আমার মন বেঁধে রাখবো তোর খোলা চুলের ভাঁজে।”
(***)
আহনাফ ডেস্কে হাত রেখে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি ডেস্কে রাখা বইয়ের উপর। যতি জোর গলায় বলল, “স্যার, পরের পার্টটা পড়াচ্ছেন না যে!”
আহনাফের মনোযোগ ফিরলো ক্লাসে। অরুণিকার দিকে তাকালো সে আহত দৃষ্টিতে। অরুণিকার দৃষ্টিও আহনাফের দিকেই ছিল। চোখ সরিয়ে নিল সে সাথে সাথেই। আহনাফ আবার ক্লাস নেওয়া শুরু করলো। পুরো ক্লাসে আর একবারও অরুণিকার দিকে তাকালো না সে। অরুণিকা আহনাফের হাবভাব দেখে ক্ষীণ হেসে বইয়ের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল, “তুমি সত্যিই আমাকে ঘৃণা করো, আহনাফ? মাঝে মাঝে তোমাকে চিনতে পারি না আমি। তুমি নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করো, আর তোমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই তুমিটা একদম ভিন্ন। তবে আমি তোমার প্রকাশিত রূপটাই মেনে নিলাম। তোমার লুকায়িত সত্তা খোঁজার চেষ্টা আমি করবো না। কেন করবো? আমি জানি তোমার মধ্যে সেই আহনাফকে লুকিয়ে ফেলেছো, যেই আহনাফ তার অরুকে ভালোবাসতো। সেই সত্তা মিথ্যে ছিল না। কিন্তু সে হারিয়ে গেছে তোমার ঘৃণার সাগরে। আর যেই ঘৃণা মনে পুষে রেখেছো, সেই ঘৃণিত সত্তাকেই তো তুমি চিনতে পারলে না। তুমি কি খুঁজতে চেয়েছো, আমার আসল সত্তাকে? জানতে চেয়েছো তোমার অরুকে? জানতে চাইলে আমাকে বিশ্বাস করতে। তবে অন্ধ বিশ্বাস তো কাউকেই করা উচিত নয়। আমি তোমাকেও বা কি দোষ দেবো? সত্য তুমি জানো না। আর আমার সেই সত্য বলার ক্ষমতাও নেই। বললেও তুমি বিশ্বাস করবে না। আর বলার পর তোমার অবস্থা কি হবে তা তো ভাবতেই পারছি না। আহনাফ, আবরারের মৃত্যুর রহস্যটা আমি তোমাকে কখনোই জানাতে পারবো না। কখনোই না। আল্লাহ যদি কখনো সবার সামনে সেই সত্য প্রকাশ করতে চায়, তবেই সবাই জানবে। নয়তো সত্য প্রকাশকারী আর কেউ নেই।”
(***)
অরুণিকার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ইমান। অরুণিকা লাজুক হেসে বলল, “এভাবে কি দেখছেন?”
“তোমাকে কেউ বলে নি তোমাকে লাল রঙে মায়াবতী লাগে?”
ইমানের কথায় চমকে তাকালো অরুণিকা। মায়াবতী শব্দটার সাথে বেশ পরিচিত সে৷ সেকেন্ড খানিকের জন্য হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। ইমান অরুণিকার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “কি হলো? কি ভাবছো?”
অরুণিকা হালকা হেসে বলল, “না কিছু না।”
ইমান চোখ ছোট করে বলল, “কিছু তো ভাবছো? কেউ কি বলেছিল না-কি মায়াবতী?”
“না, তবে এই নামটা অনেকবার পড়েছি।”
ইমান ভ্রূ কুঁচকে বললো, “পড়েছো বলতে?”
“বইয়ে পড়েছি।”
ইমান হেসে বলল, “আরেহ, বইয়ে তো থাকেই।”
“কিন্তু বইটা আলাদা।”
“আলাদা কেন?”
“বইটা অদ্ভুত এক মানুষের বই।”
“অদ্ভুত মানুষ!”
“হ্যাঁ। হিমালয়ের নাম শুনেছেন?”
ইমান দাঁড়িয়ে গেল। অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “হিমালয়! লেখক হিমালয়ের কথা বলছো?”
“হ্যাঁ।”
ইমান হাসলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইমানকে জিজ্ঞেস করলো, “হাসছেন কেন?”
“না, তুমি তাকে না দেখেই অদ্ভুত মানুষ বলছো!”
“আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি তাকে দেখি নি?”
“তাকে এখনো কেউ দেখেছে না-কি?”
“দেখে নি?”
“না।”
“কেন?”
“সে আসেই না সামনে। তবে খুব পরিচিতি তার। এতোটুকু বোঝা যায় সে কোনো ছেলে মানুষ।”
“আচ্ছা, মিষ্টিমশাই নামের কাউকে চিনেন?”
“শুনেছি নাম। কি লিখে?”
“কবিতা লিখে।”
“কবিতা নিয়ে ওতো ঘাঁটাঘাঁটি করি না আমি। বই মেলায় যাই একটু-আধটু। ওখানেই হিমালয়ের নাম শুনেছি। তার তো অনেক ফ্যান-ফলোয়ারস।”
“কিন্তু কোনো পেইজ নেই। অনলাইন বা কোনো ওয়েবসাইটেও লিখে না।”
“কে বলেছে লিখে না?”
“আমি তো পাই নি।”
“আমি যতোটুকু জানি একটা একাউন্ট আছে ইন্সটাগ্রামে।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমি অনেক খুঁজেছি তাকে, অথচ আমি জানতামই না তার ইন্সটাগ্রামে একাউন্ট আছে। অথচ আপনি জানেন!”
“আমার কাজিন তার লেখা পড়ে। সেই সূত্রে জানা। আর তুমি হিমালয়ের কথা তুললে, তাই তোমাকে জানালাম। তুমিও কি তার ফ্যান?”
অরুণিকা স্মিত হেসে বলল, “অনেকটাই।”
ইমান হাসলো। অরুণিকা বলল, “আমাকে কি তার ইন্সটাগ্রাম একাউন্টটা দেওয়া যাবে।”
“আমি আমার কাজিনকে জিজ্ঞেস করে, তারপর বলবো। ওকে আমি ওখানে লেখা পড়তে দেখেছি। তবে আমি ফলো করি না।”
“আচ্ছা।”
ইমান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। তার খোলা চুলগুলো অবাধ্য হাওয়ায় উড়ছে। ইমান সেই চুলগুলোতে হাত দিতেই অরুণিকা চমকে উঠলো। ইমান চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “খোলা চুলে তোমাকে সুকেশিনী মনে হয়।”
অরুণিকা আবার ধাক্কা খেলো। এই শব্দটাও হিমালয়ের বইয়ে পড়েছে সে। মনে মনে ভাবছে, “ইমানও কি হিমালয়ের বই পড়েন? না-কি তিনিই হিমালয়? হিমালয়ের বইয়ের শব্দ তার ঠোঁটের আগায়! এমনকি হিমালয়ের বই আমার ঠিকানায় এসেছিল অজ্ঞাতনামে। ইমানও তো পারেন সেই বই পাঠাতে! তাছাড়া অন্য কেউ তো নেই, যে সেই বই পাঠাবে। আমার তো আর কোনো চেনা-জানাও নেই।”
(***)
অরুণিকার হাত ধরে টেনে একপাশে নিয়ে এলো আহনাফ। অরুণিকা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফ অরুণিকাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল, “ওই ইমানের সাহস কি করে হয় তোর চুলে হাত দেওয়ার?”
অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “তুমি কে সেই সাহস নিয়ে প্রশ্ন করার?”
“আই এম ইউর হাসবেন্ড।”
“না। এই সম্পর্কটা খুব বেশিদিন আর নেই৷ তাই বাক্যটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো, মিস্টার আহনাফ চৌধুরী।”
“তুই একটু আগে ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলি।”
“আর উনি একটু আমাকে কেন্টিনে বসিয়ে আমার জন্য আইসক্রিম আনতে গেলেন, ওমনি তুমি আমাকে টেনে আনলে এদিকে?”
“তুই ওর টাকার আইসক্রিম কেন খাবি? আমি কি মরে গেছি?”
“মরছো না কেন?”
আহনাফ অরুণিকার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “তুই চাস আমি মরে যাই?”
“বেঁচে থেকে তো শয়তানি করে বেড়াচ্ছো। মরলে বলতে পারবো, একটা শয়তান মরেছে।”
আহনাফ অরুণিকার হাত শক্ত করে ধরে তাকে টেনে ডিপার্টমেন্টের দিকে নিয়ে গেল। আহনাফকে এভাবে অরুণিকার হাত ধরে নিয়ে যেতে অন্য কেউ না দেখলেও যতি বিষয়টা খেয়াল করলো। সে নিজেও বেশ অবাক হলো। আর ঘটনা পুরোপুরি জানার জন্য তাদের পিছু নিলো। এদিকে আহনাফ অরুণিকাকে টেনে নিয়ে এলো তার কেবিন রুমে। দরজা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে শার্টের বোতম খুলতে লাগলো। অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “তোমার ভেতরের শয়তানটা কি আবার জেগে উঠেছে? কি করতে চাচ্ছো? ছিঁড়ে না খাওয়া অব্ধি শান্ত হবে না, তাই না?”
আহনাফ অরুণিকাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল, “তোকে বলেছি, তোর চুলে আমি ছাড়া আর কারো অধিকার নেই। তাহলে তোর চুল ওই ছেলেটা কীভাবে স্পর্শ করলো?”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল কথাটা। যতি কেঁপে উঠলো আহনাফের শেষ বাক্য শুনে। দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে সে। ওদিকে অরুণিকা বলল, “আমার চুল, আমি যাকে ইচ্ছে ধরতে দেবো।”
আহনাফ গায়ে হাত তুলতে গিয়েও থেমে গেল। অরুণিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সেই হাতের দিকে৷ আহনাফ অরুণিকার চুল টেনে ধরে বলল, “তুই যা ইচ্ছে কর, কিন্তু অন্য ছেলের সাথে আমি তোকে সহ্য করবো না। যা ইচ্ছে কর তুই, আমি মানা করছি না। কিন্তু তুই পারবি না অন্য কোনো ছেলেকে আমার অধিকার দিতে৷ তাহসিনের সাথে তোর বন্ধুত্বে আমি বাঁধা দেই নি। কিন্তু ইমান? ওই ছেলেটা তোকে পছন্দ করে। তোকে স্পর্শ করতে চাই। আর আমি এসব সহ্য করবো?”
“তুমি পারলে, ও কেন পারবে না?”
আহনাফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “আমি তোর বর।”
“সেই রাতে কি বর ছিলে? সেই শীতের রাত কি ভুলে গেছো?”
আহনাফ শান্ত স্বরে বলল, “আমি তোকে সেই রাতের জন্য অনেকবার সরি বলেছি।”
“তোমার সরি রাখো তোমার কাছে। আমি তো তখন অনেক কিছুই বুঝতাম না। তোমার ইন্টেনশনও বুঝি নি। তুমি সেই রাতে কি চেয়েছিলে বলবে? তনু আন্টি না এলে কি হতো সেই রাতে? আমার সাথে নোংরামি করার জন্য কতোটা নিচে নামতে তুমি? জ্বরের ঘোরে ছিলে! তাই সবাই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। তাই তো?”
আহনাফ অরুণিকার চোখের দিকে তাকাতে পারলো না। অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল, “তুমি একটা পারফ্যাক্ট অভিনেতা। জ্বরের ঘোরে কাছে আসা, এরপর বিয়ে! কি চমৎকার ছিল তোমার অভিনয়।”
আহনাফ চমকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “তুমি যেমন মিথ্যে, আমাদের বিয়েটাও মিথ্যে ছিল।”
“কি বলছিস তুই?”
“তুমি তখন ভেবেছিলে আমি তূর্যের সাথে বেশি কথা বলি, তোমার সাথে ঝগড়া করি, আর বড় হলে আমি তূর্যের প্রেমে পড়বো। তাই তুমি ইচ্ছে করে জ্বরের ঘোরে আমার সাথে ওমন করেছিলে। তুমি সেই রাতে কোনো ঘোরের মধ্যে ছিলে না। জ্বর হলেও সজ্ঞানে ছিলে তুমি। সেই রাতে তুমি আমার সাথে বাজে কিছুই করতে না। তুমি জানতে, কেউ এসে আমাদের ওই অবস্থায় দেখলে এর পরিণতি কি হবে। তাই ইচ্ছে করে ওমন করেছিলে। কারণ তুমি জানতে গ্রামের মানুষ কেমন!”
আহনাফ চোখ ছোট করে বলল, “তোকে কে বলেছে এসব?”
“ইভান বলেছে তূর্যকে।”
“আর তূর্য তোকে বলেছে এসব!”
“তূর্য আর ইভানকে এসব বলতে শুনেছে ইমন।”
“আচ্ছা! তাহলে ওই রেডিওটা এসে তোকে বলেছে? ছেলেটার আক্কেল আছে?”
“জি না। ইমন আমাকে বলে নি। ইমন আরাফ আর তাহমিদকে বলেছে।”
“কে কাকে বলেছে এর সিরিয়াল না লাগিয়ে তোকে কোন পাব্লিক এসে বলেছে, তার নাম বল!”
“আমাকে আমার কান বলেছে।”
“মানে?”
“আমি নিজ কানে শুনেছি ওদের কথা। ইমন কয়েকদিন আগেই ছাদে বসে এটা নিয়ে কথা বলছিল আরাফ আর তাহমিদের সাথে। আমি রুদবাকে খুঁজতে গিয়ে ছাদে উঠে ফরচুনেটলি এই কথা শুনে ফেলেছি।”
আহনাফ চুপ করে রইলো। অরুণিকা সরে দাঁড়ালো। এরপর হতাশ কন্ঠে বলল, “তুমি এরকম কূটনামি কেন করতে গেলে?”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “সরি।”
“সরি? গত আট বছর ধরে আমি এটাই ভেবেছি তুমি জ্বরের ঘোরে আমার কাছে আসতে চেয়েছিলে। আর বিয়েটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। তুমি বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করেছ। আর এখন জানলাম, তুমি প্ল্যান করে আমাকে বিয়ে করেছো। আচ্ছা, তোমার মাথায় এই ষড়যন্ত্র আসলো কীভাবে?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আমি কোনো ষড়যন্ত্র করি নি! আমি সজ্ঞানে ছিলাম না। ক’বার বলবো?”
অরুণিকা হেসে বলল, “এখনো মিথ্যে বলছো?”
আহনাফ এবার দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “হ্যাঁ করেছি। ভালোবাসতাম তোকে তাই। কিন্তু তুই যে একটা খুনী হবি, সেটা তো জানতাম না।”
অরুণিকা শক্ত স্বরে বলল, “আমি তোমার ভাইকে মারি নি, আহনাফ। ওকে আমি সেদিন ছাদ থেকে ধাক্কা দেই নি।”
“তাহলে রেলিঙ থেকে এমনি এমনি কেউ নিচে পড়ে যায়? এতো বড় রেলিঙ থেকে ও কীভাবে নিচে পড়লো?”
“আমাকে ফেলতে দেখেছো তুমি? আমি ওর হাত ধরে ওকে বাঁচাতে চেয়েছি, ধাক্কা দেই নি।”
“তাহলে বল, ও রেলিঙের ওপারে কীভাবে গেল?”
“আমি ফেলি নি, ব্যস আর কিছু বলার নেই আমার। আর কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”
“সেদিনের না হয় প্রমান নেই। কিন্তু সেই রুমে যা করেছিলি! আবরারকে টরচার করতি না তুই?”
অরুণিকা হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ করতাম। কিন্তু আমি বুঝি নি ও অটিস্টিক ছিল। আমাকে কেউ বলে নি ও আমাদের মতো স্বাভাবিক না। আমি ওর বিহেভিয়ার দেখে ভাবতাম, ও ইচ্ছে করে এমন করতো। আমি নিজেও তো ছোট ছিলাম তখন, আহনাফ।”
“ওকে রুম বন্ধ করে ভয় লাগাতি তুই। ওকে ইচ্ছে করে মারতি। ওর রুমে সিসি ক্যামেরা না লাগালে আমি জানতামই না, ও তোকে কেন এতো ভয় পেতো। ওর মৃত্যুর পর আমি সেই সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। আগে দেখলে আমি কখনোই তোকে আমার ঘরে ঢুকতে দিতাম না।”
অরুণিকা মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। আহনাফ অরুণিকার সামনে বসে বলল, “তুই ওকে শুধু খুন করিস নি। ওকে তিলে তিলে মেরেছিস। আমিও তোকে তিলে তিলে মারবো।”
অরুণিকার জামার গলা খামচে ধরে আহনাফ বলল, “ইমান যদি তোর কাছে আসে! আমি যদি দেখি ইমান বা অন্য কোনো ছেলে তোকে সেই অধিকারে ছুঁয়েছে, যেখানে আমার ছাড়া আর কারো অধিকার ছিল না, আমি কসম করে বলছি, স্বামীর অধিকার মুখে দেখিয়েছি এতোদিন, শারীরিক অধিকার কীভাবে আদায় করে নেবো, তুই বুঝতেই পারবি না। মনে রাখিস, এরপর আমি সবাইকে যদি বলি তুই বাধ্য করে আমাকে কাছে এনেছিস, আমার কথাই কিন্তু সবাই বিশ্বাস করবে।”
অরুণিকা চোখ মুছে বলল, “হ্যাঁ, তুমি তো ম্যানিপুলেশনের গড ফাদার।”
আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। অরুণিকা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই আহনাফ হুট করে তার চুলের মুঠি ধরে ড্রয়ার খুলে একটা কাচি বের করে সোজা চুলের গোড়া থেকে কেটে নিলো। অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আহনাফ চুলটা পাশে থাকা পলিথিন ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, “কোনো ছেলে তোকে স্পর্শ করলে, আমি যে কতোটা ভয়ংকর হতে পারি, তার ডেমো দেখালাম। পুরো ফিচার দেখতে চাইলে কন্টিনিউ কর। দেখতে না চাইলে ইমানের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চল।”
আহনাফ এই বলে রুমের দরজায় খুলতেই যতির মুখোমুখি হলো। যতি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা যতিকে দেখে তাড়াতাড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। যতিও দ্রুত মাথা নিচু করে চলে গেল। অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “মেয়েটা কি ভাবলো?”
আহনাফ বের হতে হতে বলল, “যাই ভাবুক, আমার কি!”
“আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফ এটা জেনে গেলে?”
“সমস্যা নেই। এতোদিন লুকিয়ে লুকিয়ে রোমান্স করেছি, এরপর চেয়ারম্যান স্যারের রুমের সামনে গিয়েও রোমান্স করতে আপত্তি নেই।”
“ইস! তুমি আসলে মারাত্মক শয়তান!”
“আর তুই শয়তানের বউ, খাবিস।”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৪ (১ম ভাগ) ||
কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলেই থতমত খেয়ে গেল রুহানি। গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল, “অরু, তোর চুল!”
অরুণিকা হনহনিয়ে বাসায় ঢুকে পড়ল। আতকিয়া জাহানের মুখোমুখি হতেই তিনি কপাল চাপড়ে বললেন, “একি! মেয়ে না-কি ছেলে ঢুকলো ঘরে?”
অরুণিকা কিছু না বলে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। রুহানি মেইন দরজা বেঁধে সোজা অরুণিকার পিছু পিছু তার রুমে এসে গেল। এরপর অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তোর এই অবস্থা কেন? চুল কেঁটে ফেলেছিস কেন?”
অরুণিকা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি তাকে হালকা ধাক্কা মেরে বলল, “বলবি? পাগল হয়ে গেছিস না-কি তুই?চুল কাঁটলি কেন?”
অরুণিকা কাঁধের ব্যাগটা মেঝেতে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে উঠলো। রুহানি ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। অরুণিকার চোখ দু’টি লাল হয়ে গেছে। সে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজের পিঠ অব্ধি লম্বা চুলের পরিবর্তে দেখলো ঘাড় অব্ধি এলোমেলো ভাবে কাঁটা চুল। অরুণিকা সেই চুলে হাত রেখে কাঁপা কন্ঠে বলল, “আহনাফ চৌধুরী, তুমি কী ভেবেছে আমাকে? আমি আবরারকে খুন করেছি এই মিথ্যেকে সত্য ভেবে তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে আমার সাথে? কখনো না। এখন আমি এই মিথ্যেটাই সত্য প্রমাণ করবো। খুন তো আমি এবার করবোই। তবে এবার মানুষ খুন হবে না। আত্মার খুন হবে।”
রুহানি ভীত কন্ঠে বললো, “ভয় পাচ্ছি আমি তোকে। কি হয়েছে, বল?”
“আহনাফ জোর করে আমার চুল কেঁটে দিয়েছে।”
রুহানি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। অরুণিকা বলল, “রিজন কি জানিস? ইমান আমার চুল ধরেছিল তাই।”
“পাগল না-কি!”
“হ্যাঁ, পাগল। আর একটা পাগলের সাথে এক মিনিটের বেশি সংসার করা যায় না। আমি ওয়েট করতে পারবো না। আমার ওর কাছ থেকে মুক্তি চাই।”
“ডিভোর্স নিতে চাচ্ছিস তুই?”
“হ্যাঁ। আমি তো মামাকে বলেই দিয়েছিলাম আগে।”
“কিন্তু বাবা তো ছুটি পাচ্ছে না। বাবা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। এমন ডিসিশন বড় কাউকে ছাড়া কীভাবে নিবি!”
“আমি পারবো না এতো অপেক্ষা-টপেক্ষা করতে। মামা ছুটি পাবে না এতো সহজে। আমি একাই এই ডিসিশন নিচ্ছি। এক্ষুনি যাবো আমি চৌধুরী ম্যানশন। আজই আমার ডিসিশন চৌধুরীদের জানিয়ে আসবো।”
অরুণিকা এই বলে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। রুহানি বিছানায় ধপ করে বসে আনমনে বলল, “এই আহনাফ এতো ডেঞ্জারাস! এমন ভিলেন তো মুভিতেও দেখি নি। ভিলেন তো তার নায়িকার চুল ধরার অপরাধে যে চুল ধরেছে তাকেই গুলি করে মারে। আর এদিকে এই সাইকো ভিলেন তো উলটো তার নায়িকাকেই টাক্কু বানিয়ে দিতে চাইছে। এ কেমন তাজ্জব ভিলেন রে বাবা!”
(***)
অরুণিকা গোসল সেরে ভালো কাপড় পরে ব্যাগ নিয়ে বেরুনোর আগেই রুহানি তার পথ আটকে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
অরুণিকা শীতল কণ্ঠে বলল, “চৌধুরী ম্যানশন।”
“তুই শিউর তো!”
“ডেফিনিটলি। হান্ড্রেড পারসেন্ট শিউর। আমি ওই সাইকোটার সাথে এক সেকেন্ডও থাকবো না।”
“তাহলে দাঁড়া। তুই একা যাবি না। আমিও যাচ্ছি। কি ভয়ংকর লোক! কেউ চুল ধরেছে, তাই চুল কেঁটে দিলো। যদি ডিভোর্স চাইতে গেলে, জিভ কেটে ফেলে? এ তো মারাত্মক বাড়াবাড়ি হবে।”
অরুণিকা চোখ ছোট করে তাকালো রুহানির দিকে। রুহানি বলল, “দশ মিনিট দাঁড়া! আমি রেডি হয়ে আসি।”
রুহানি দশ মিনিটের জায়গায় আধা ঘন্টা পর রুম থেকে বের হলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “দশ মিনিট!”
রুহানি আমতা আমতা করে বলল, “প্রথমবার তোদের চৌধুরী ম্যানশনে যাচ্ছি, একটু সাজগোজ তো করবোই।”
অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “ডিভোর্স নিতে যাচ্ছি, বিয়ে করতে না!”
“তোর জন্যই তো হ্যাপি আমি। একটা ছ্যাঁচোড় থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছিস। সেই খুশিতেও কি সাজবো না? উলটো তোরও সাজগোজ করা উচিত।”
অরুণিকা রুহানির হাত ধরে বলল, “এই সমাজে বিয়ে ভাঙার পর একটা মেয়ের জীবনে কি ঝড় আসে সেটা বুঝলে তুই এই কথা বলতি না।”
রুহানি মাথা নিচু করে নিলো। অরুণিকা ভেজা কন্ঠে বললো, “আমি শয়তানটার সাথে তবুও সংসার করতাম, এটা চিন্তা করে যে আমার দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। আমার ডিভোর্স হলে মামী আমার সাথে কেমন ব্যবহার করবে, আমি জানি না। কিন্তু আমি ভালো কিছু আর আশা করতে পারছি না। আমার দ্বিতীয় বার জীবন শুরু করার উপরই মামার সম্মান, তোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কিন্তু আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, রুহু। আহনাফের সাথে সংসার করা সম্ভব না। যেখানে সম্ভাবনা নেই, সেখানে দেরি করে কি লাভ? যা কয়েক বছর পর হবে, তা এখন কেন হবে না? আমি যদি এই স্টেপ না নেই, আমার ভবিষ্যৎ শেষ করে দেবে ওই শয়তানটা।”
রুহানি অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সরি, আমার কাজে তুই কষ্ট পেয়েছিস?”
অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “না!”
“কিন্তু তুই আমাদের কথা চিন্তা করিস না, অরু। ভবিষ্যতে কী হবে ভবিষ্যতে দেখা যাবে। এখন কি করবি সেটা আগে ভাব।”
(***)
চৌধুরী ম্যানশনের সামনে এসে দাঁড়ালো অরুণিকা। পাঁচ বছর পর এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। কত স্মৃতি এই বাড়ি জুড়ে! অথচ সেই স্মৃতি স্পর্শ করার, অনুভব করার কোনো অধিকার নেই তার। এই দশতলা ভবনটি শুরুতে তিনতলার বিলাসবহুল বাংলো বাড়ি ছিল, যেখানে চৌধুরীদের আবাস। কিন্তু ন’বছর আগে আহনাফ আর অরুণিকার বিয়ে নিয়ে চৌধুরী পরিবারে ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। আরাফের মায়ের আত্মহত্যার কিছু রহস্যও সেই ঝামেলার একটি অংশ ছিল। এক ছাদের নিচে থাকলেও একই সাথে খাওয়া-দাওয়া, এক রান্নাঘরে কাজ করা চৌধুরী পরিবারের পুত্রবধূদের মধ্যে রেষারেষি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বড় চৌধুরী তাই জায়গাটা এক বিল্ডার্স কোম্পানিকে দিয়ে দেন। আর সেই কোম্পানি তিন বছরের জায়গায় দুই বছরে সেই দশতলা ভবনটি নির্মাণ করে দেন। চৌধুরী ম্যানশন নামটি বড় চৌধুরীর ইচ্ছাতেই রাখা। অর্ধেক ফ্ল্যাটের মালিক বড় চৌধুরী সাহেব তার বড় ছেলের নামে দ্বিতীয় তলা, ছোট ছেলের নামে চতুর্থ তলা আর মেজ ছেলের নামে ষষ্ঠ তলা লিখে দেন। অষ্টম তলা নিজেদের জন্য রাখলেও তাদের সাথে ছোট ভাইয়ের পুত্র-পুত্রবধূও থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো বিল্ডার্সরাই বিক্রি করেছিলেন। যার মধ্যে তূর্যের বাবা পঞ্চম তলায় একটি ফ্ল্যাট আর ইভান-ইমনের বাবা সপ্তম তলায় পাশাপাশি দু’টি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। তারা এখন এক সাথেই থাকে, অথচ বিচ্ছিন্ন একটা সম্পর্ক।
এদিকে অরুণিকা গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই দারোয়ান তাকে থামালো। অরুণিকা কিছু সময়ের জন্য চমকালো। নিজের বাড়িতেও জিজ্ঞাসাবাদ? তবে করারই কথা। দারোয়ান তো তাকে চেনার কথা না। গত পাঁচ বছরে এই পথে পা রাখে নি সে। রাস্তাও হয়তো ভুলে গেছে তাকে। অরুণিকা তাই দাদার পরিচয় দিয়ে ঢুকলো বাড়িতে। এদিকে মিসেস চৌধুরী নাতনি আসার খবর পেয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। মিসেস তাওসিফ চাচী শাশুড়ীর হাত ধরে বললেন, “শিরিন জানলে নিশ্চয় তামাশা করবে!”
মিসেস চৌধুরী বললেন, “তা আমার দেখার বিষয় না। আমার জুবায়েরের মেয়ে এসেছে। আমার বাড়িতে এসেছে আমার দাদুমণি। ওদের তো আর দেখতে আসে নি। তার দাদা-দাদিকে দেখতে এসেছে।”
অরুণিকা লিফট থেকে নামতেই দরজার কাছে দাদীকে দেখে মাথা নিচু করে নিলো। দাদী দ্রুত বেরিয়ে এসে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলেন। অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “আমাকে জড়িয়ে ধরেছো কেন? তোমাদের আদরের নাতি দেখলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে।”
“কি বলিস অরু? এখনো এমন কথা বলবি?”
অরুণিকা মিসেস তাওসিফকে সালাম দিলো। মিসেস তাওসিফ মুচকি হেসে বললেন, “চাচী, অরুকে ভেতরে নিয়ে আসুন। বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন?”
অরুণিকার পাশে রুহানিকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মামার মেয়েকেও নিয়ে এসেছো?”
মিসেস চৌধুরী রুহানিকে দেখে ভড়কে গেলেন। এতোক্ষণ তিনি রুহানিকে খেয়ালই করেন নি। অরুণিকাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি রুহানিকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে অরুণিকাকে নিয়ে ঢুকে দরজা আঁটকে দিতে যাবেন, তখনই অরুণিকা দরজা ধরে ফেললো। বলল, “ও বাইরে থাকলে আমিও বাইরে দাঁড়িয়ে আমার কথাগুলো বলি। আমি একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। ভালো হবে যদি আপনারা আর চাচ্চুরা সবাই একসাথে বসেন।”
মিসেস চৌধুরী অরুণিকার কথায় অবাক হলেন। এদিকে মিসেস তাওসিফ রুহানিকে ভেতরে ঢুকতে বললেন। ভেতরে আসতেই বেশ লজ্জা করছিল রুহানির৷ কীভাবে অপমান করলো এরা! সে মনে মনে ভাবছে, “অদ্ভুত মানুষ! এদের মধ্যে তো আতিথেয়তাও নেই। বাড়িতে আসা মেহমানদের সাথে এমন ব্যবহার কেউ করে?”
এদিকে অরুণিকার কথামতো সবাই উপস্থিত হলো বড় চৌধুরী সাহেবের বসার ঘরে। শিরিন সুলতানা তো অরুণিকা এসেছে শুনার পর থেকেই রাগে হাঁসফাঁস করছেন। একটু পর পর বলছেন, “নিশ্চয় ফ্ল্যাটের হক নিতে এসেছে। লোভী মেয়ে একটা!”
অরুণিকাকে দেখে তিনি অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শ্বশুড়-শাশুড়ির সামনে বাধ্য হয়ে চুপ ছিলেন। এদিকে সবাই এসে বসতে অরুণিকা তার মাথার কাপড় সরালো। অরুণিকার ঘাড় অব্ধি চুল দেখে মিসেস তাওসিফ বললেন, “এতো কম চুল রেখেছো তুমি?”
অরুণিকা তার একদিন আগে তোলা সেলফি দাদাকে দেখিয়ে বলল, “আজ আমার চুলের এই অবস্থা করেছে তোমাদের নাতি আহনাফ চৌধুরী।”
শিরিন সুলতানা বললেন, “নিশ্চয় তুমি আমার ছেলের সাথে আবার ঘেঁষতে গিয়েছিলে?”
অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “আমি কারো ভাবনা পরিবর্তন করতে পারবো না, কিন্তু এটা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবো, আমি আহনাফের সাথে বিয়েটা ঠিকিয়ে রাখার পক্ষে না।”
“আমরাও কি পক্ষে? তোমার পঁচিশ হলেই…”
অরুণিকা শিরিন সুলতানাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি যথেষ্ট ম্যাচিউওর হয়েছি। আইন আমাকে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। আর আমি সেই সুযোগের জন্য পঁচিশ বছর হওয়ার অপেক্ষা করতে চাই না। আমি আহনাফের কাছ থেকে এখনই ডিভোর্স চাচ্ছি।”
অরুণিকার কথায় শিরিন সুলতানা ছাড়া সবাই অবাক হলেন। কিন্তু শিরিন সুলতানা কথাটি শুনে বিস্তর হেসে বললেন, “এতোদিনে তোমার আক্কেল হয়েছে! আমার ছেলে যে তোমার মতো মেয়েকে পাত্তা দেই না, তা বুঝেই গেছ তাহলে।”
রুহানি দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। শিরিন সুলতানার কথাগুলো তার হজম হচ্ছিল না। ইচ্ছে করছিল পাশে থাকা চেয়ারটা তুলে শিরিন সুলতানা মাথায় আঘাত করতে। কিন্তু পারছে না সে। এদিকে আরেফিন চৌধুরী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “তোমার দায়িত্ব তো এবার আমাদেরই নিতে হবে, যেই দায়িত্ব শুধু আহনাফ ও তার বাবার নেওয়ার কথা ছিল।”
মিসেস চৌধুরী ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “কি বলছো আরেফিন? তোমার ভাতিজির সংসার ভাঙছে, আর তুমি এমন কথা বলছো?”
শিরিন সুলতানা বললেন, “তালাক হলে আমাদের সাথে অরুণিকার সম্পর্ক শেষ। অরুণিকার দায়িত্ব আরেফিন ভাই আর আরাফকেই নিতে হবে। প্রাক্তনের পরিবারের সাথে তালাকের পর আর কোনো সম্পর্ক থাকে না, যতোই চাচা-চাচী হোক।”
তাওসিফ শাহরিয়ার হতাশ কন্ঠে বললেন, “মেয়েটার সামনে এমন কথা বলছো তোমরা! অরুণিকার দায়িত্ব তার মামা নিয়েছে। তিনি যদি না চান, আমি নিবো অরুণিকার দায়িত্ব। আমার অবর্তমানে তাহমিদ তার বোনের খেয়াল রাখবে।”
“ভাইজান এই মেয়ের নজর ভালো না। কাল আমার ছেলের মাথা খারাপ করেছে, সামনে আপনার ছেলের মাথা খারাপ করবে!”
আমির চৌধুরী স্ত্রীর কথায় রেগে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন, “কোথায় কি বলতে হয় এতোটুকু কমনসেন্স নেই তোমার। চুপ করো।”
রুহানি মাথা হেলিয়ে মনে মনে বলল, “বেশ হয়েছে। এই শয়তান মহিলাটার গালে একটা চড় লাগিয়ে দিলে আংকেলটাকে বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াতাম। ফাজিল মহিলা!”
অরুণিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার দায়িত্ব আমি নিতে পারবো। আর পরেরটা পরে দেখা যাবে৷ আগে আপনারা ডিভোর্সের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানান। আমি মোহরানা মাফ করে দিয়েছি।”
মিসেস চৌধুরী ঠোঁট প্রশস্ত করে বললেন, “কিছু মানুষ আমার নাতনির নামে কতো অপবাদ দিচ্ছিল। লোভী বলছিল! তারা হয়তো এবার উত্তর পেয়ে গেছে।”
অরুণিকা রুহানির হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো। রুহানি বের হতে হতে বলল, “ভাই অরু, এমন টক্সিক ফ্যামিলি হয় না-কি? আমার মা তো হাজার গুণ ভালো ওই শয়তানটার আম্মা থেকে।”
অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “সব মা তার সন্তানদের জন্যই ভালো। তবে কিছু মা তো আপন সন্তানদের জন্যও ভয়ংকর হয়।”
“কি যে বলিস! এমন মা হয় না। আপন সন্তানদের জন্য তো মা-বাবা জীবনটাই দিয়ে দেন৷ ফুফা-ফুফি তো তোর জন্যই…”
রুহানি থেমে গেল। অরুণিকা রুহানির হাত ধরে বলল, “ইটস ওকে। এটা আমার মানসিক শক্তি। আমার আত্মার সাথে আরো দু’টি আত্মা জড়িত। তারা আমার আত্মার সাথে মিশে আছে। তারা আমার সাথে আছে।”
রুহানি ক্ষীণ হাসলো। মনে মনে ভাবলো, “মেয়েটাকে মনের অজান্তেই হয়তো অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলি। কিন্তু আল্লাহর কাছে আমার সবসময়ের চাওয়া, আমার অরুর জীবনটা যাতে বেস্ট হয়।”
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৪ (২য় ভাগ) ||
রিকশা থামলো বাসার গেটের সামনে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে অরুণিকা ও রুহানি রিকশা থেকে নেমে গেটে ঢুকতে যাবে তখনই থমকে দাঁড়াল। আহনাফ গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। নাক-মুখও রক্তাভ। আহনাফের রাগ কতোটা ভয়ংকর সেই সম্পর্কে অবগত অরুণিকা। তবুও সে নিজেকে সহজ করে আহনাফের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “রাস্তা ছাড়ুন, মিস্টার আহনাফ চৌধুরী।”
আহনাফ অরুণিকার গাল চেপে ধরে বলল, “ডিভোর্স দিবি তুই আমাকে?”
রুহানি আহনাফের হাত ধরে বলল, “আমার বোনকে ছাড়ুন। নয়তো ইট দিয়ে মেরে মাথা ফাঁটিয়ে দেবো।”
আহনাফ এক ঝটকায় রুহানির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “হাসবেন্ড ওয়াইফের মাঝে তুমি কোন সাহসে আসছো?”
আহনাফের মনোযোগ কিছু সময়ের জন্য রুহানির দিকে ফিরতেই তার হাত আলগা হয়ে এলো। আর সেই সুযোগে অরুণিকা আহনাফের হাতের মুঠোয় নিজের হাত আবদ্ধ করে চমকে দিলো আহনাফকে। অরুণিকা এবার হাতের মুঠো শক্ত করলো। আহনাফ চোখ ছোট করে তাকালো তার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সে নিজের সব শক্তি দিয়ে আহনাফের হাত মুড়ে দিলো। আহনাফ সাথে সাথেই অরুণিকার হাত ছেড়ে দিল। অরুণিকা তার ঘাড় অব্ধি চুলগুলো ঠিকঠাক করে বলল, “মিস্টার আহনাফ চৌধুরী, এবার আপনি আমার সেই রূপ দেখবেন, যা আগে কখনোই দেখেন নি। যার হাত থেকে দশ বছরের আবরার বাঁচে নি, আপনি কি করে বাঁচবেন? ষোলো বছর বয়সে খুন করেছি আপনার ভাইকে। এখন এর চেয়ে ভয়ংকরভাবে খুন করবো আপনাকে।”
রুহানি ভীত চোখে তাকালো অরুণিকার দিকে। আহনাফ হেসে বলল, “তুই আমাকে মারবি?”
“হ্যাঁ।”
“কান্ট। তুই ভালোবাসিস আমাকে।”
অরুণিকা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল, “একদমই না। প্রমাণ কি এখনো পান নি?”
“ডিভোর্স চাইলেই কি প্রমাণ হয়ে যায়? আর আমি তোকে ডিভোর্স দেবোই না?”
“আপনি তো বাধ্য, মিস্টার। আপনাকে কীভাবে ফাঁসাবো আপনি টেরই পাবেন না। আজ ওয়ার্ন করলাম। এরপর সোজা একশন।”
আহনাফের বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে অরুণিকা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। রুহানিও তার পিছু পিছু ঢুকলো। অরুণিকা পেছন ফিরে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাই দা ওয়ে, থ্যাংকস, ডিয়ার উড বি এক্স হাসবেন্ড। এখন আমাকে আগের চেয়ে বেশি প্রিটি লাগছে। বানীতে তূর্য শেখ।”
অরুণিকা কথাটি বলেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। রুহানিও সেকেন্ড খানিক আহনাফের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়লো। এদিকে আহনাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে সোজা বাসায় এসে তূর্যের নাক বরাবর ঘুষি মারলো। তূর্য আহনাফের ঘুষির তোড়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। ইভান আর ইমন দুই বন্ধুর অবস্থা দেখে আহনাফকে শক্ত করে চেপে ধরলো। কিন্তু আহনাফের সাথে কেউ পারছে না। সে তূর্যের গলা চেপে ধরে বলল, “অরু আমার ওয়াইফ। তোর কোনো অধিকার নেই ওকে কেমন লাগছে বলার।”
তূর্য ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আহনাফকে। চেঁচিয়ে বলল, “ওকে আমি বোনের চোখে দেখি, আহনাফ। পাগল হয়ে গেছিস তুই?”
আহনাফ তূর্যের কাঁধ ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, “পাগল হয়ে গেছি, বিকজ আই লাভ হার।”
তাহমিদ শীতল কণ্ঠে বলল, “তুই ওকে ভালোবাসিস না। ওবসেসড হয়ে গেছিস তুই। হুঁশজ্ঞান আর নেই তোর মধ্যে।”
ইমন ইভানের কাঁধ ধরে বলল, “আমার তো মনে হয় আহনাফ নির্ঘাত নেশা করছে। দিনদিন এমন এগ্রেসিভ বিহেভিয়ার!”
আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো ইমনের দিকে। আরাফ এবার আহনাফের কাঁধ ধরে গম্ভীরমুখে বলল, “তুই অরুর চুল কেটে দিয়েছিস কার অনুমতি নিয়ে?”
“আমার বউ, আমার কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই।”
“ও তোর সম্পত্তি না। ও একটা রক্ত মাংসের মানুষ। তোর কোনো অধিকার নেই ওর সাথে এমন ব্যবহার করার।”
“আমার ভাইকে খুন করেছে ও।”
“তোর বাবাকে বলিস নি কেন কেইস চালু রাখতে? ওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন ছিল। তোর বাবা-মা মাফ করে দিয়েছিল ওকে। কেইস তুলে নিয়েছিল। তাহলে তুই কে ওকে শাস্তি দেওয়ার? আর ওর বয়স কম ছিল। এটা হয়তো একটা এক্সিডেন্ট। আর অরু নিজের মুখে কখনো স্বীকার করে নি ও আবরারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।”
“কিন্তু একটু আগে আমাকে বলেছে। ও স্বীকার করেছে, ওই আবরারকে খুন করেছে।”
“বিরক্ত হয়ে গেছে তোর উপর, তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে।”
“তাহলে আবরার নিচে পড়লো কীভাবে? এতো বড় রেলিঙের ওপাড়ে কীভাবে গেছে ও?”
“কেইস করলে বের হতো সেটা। কিন্তু কেইস তো তুলে নিলো চাচা-চাচী। তুই এভাবে ওর উপর জোরাজোরি করে ওর কাছ থেকে সত্য বের করতে পারবি না। অরু যদি সত্যিই আবরারকে খুন করতো, ও স্বীকার করে নিতো। এতো বছর স্বীকার করে নি, এখন কেন করবে? যদি খুন করেও থাকে, তুই এই সত্য পাল্টাতে পারবি না। ডিভোর্স দিয়ে দে ওকে। ওকে ওর মতো ছেড়ে দে।”
আহনাফ আরাফকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি আমার অরুকে ছেড়ে দেবো! কখনো না। আমি ভালোবাসি ওকে।”
“তাহলে কি করতে চাচ্ছিস তুই?”
“ওকে তিলে তিলে মারতে চাচ্ছি।”
“ভালোবাসার মানুষের সাথে কেউ এমন করতে পারে না।”
“তূর্য তো করতে পেরেছে।”
তূর্যের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে আহনাফের কাছে এসে বলল, “আমাকে নিজের লাইফের এক্সাম্পল বানাচ্ছিস কেন? আমি যেই কাজ করেছি, তার পরিণতি কেমন ছিল জানার পরও, তুই কি চাস অরুর সাথেও এমন হোক?”
আহনাফ তূর্যের দিকে তাকালো। নিজের চুল নিজে খামচে ধরলো সে। এরপর হুড়োহুড়ি করে নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। আহনাফ রুমে ঢুকতেই তূর্য বলল, “আহনাফকে আমি সত্যিই চিনতে পারছি না। মারাত্মক বাড়াবাড়ি করছে ও। আগে তো এমন ছিল না। আবরারের মৃত্যুর পর কেমন পালটে গেছে ছেলেটা।”
ইমন বলল, “অরুকে ও পাগলের মতো ভালোবাসতো। অরুর এটেনশন নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে যেতো আহনাফ। আর এখন!”
তাহমিদ বলল, “পাঁচ বছর আগে অরুর সাথে যা করেছিল, ওটা কি ঠিক হয়েছিল? আমরা তখন সবাই অরুকে ভুল বুঝেছি।”
আরাফ মাথা নিচু করে বলল, “আমিও তো ওকে প্রটেক্ট করতে পারি নি। এখনো সময় আছে। ইভান, তুই সত্যটা বাসার সবাইকে বলে দে। এরপর অরুকে নিয়ে সবার ভুল ধারণা পালটে যাবে। হয়তো ওকে আবার বাসায় নিয়ে আসবে দাদাজান।”
ইভান বলল, “আমি কিছু বলতে পারবো না। আমাকে খুন করে ফেলবে আহনাফ। ও আমার সাথেও ইদানীং উদ্ভট আচরণ করছে। আমি অরুণিকার পক্ষে কিছু বললে ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমাকে মারতে আসে। যখন-তখন ওর মেজাজ বিগড়ে যায়। আমি নিজেই ওকে চিনতে পারছি না।”
(***)
রুম বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে আছে আহনাফ। উষ্ণ মেঝেতে অস্থিরভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আহনাফ হামাগুড়ি দিয়ে তার টেবিলের কাছে গিয়ে টেবিল হাতড়ে একটা বই বের করলো। বইটা ঝাঁকাতেই ভেতর থেকে একটা চাবি মেঝেতে আছড়ে পড়লো। চাবিটা মেঝে থেকে তুলতে গিয়েও হাত কাঁপছে তার। অনেক কষ্টে চাবিটা হাতে নিয়ে সে হামাগুড়ি দিয়ে নিজের শরীরটা টেনে টেনে আলমারির কাছে আসলো। আলমারির ভেতরে একটা লকার। লকারটি খুললো চাবি দিয়ে। কিছু একটা বের করলো সে। মিনিট খানিক আহনাফের মুখ আলমারির দরজার আড়ালে ছিল। কি দেখলো, কি করলো, তা আহনাফ নিজেই ভালো জানে। মিনিট খানিক পর আলমারি বন্ধ করে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসলো সে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আহনাফ। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে। মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদলো বেশ খানিকক্ষণ। এরপর উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিলো। অনেকক্ষণ মাথা ভিজিয়ে ভেজা শরীরে বেরিয়ে এলো আহনাফ। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে শার্ট গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হলো। তার পঞ্চ রত্ন সোফায় বসে আছে গম্ভীরমুখে। তাকে বেরুতে দেখে তূর্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সরি, আমি তোর কষ্ট…”
আহনাফ জড়িয়ে ধরলো তূর্যকে। তূর্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বাকীরাও দাঁড়িয়ে গেল। আহনাফ কাঁপা কন্ঠে বললো, “আমি আর নিজেকে চেঞ্জ করতে পারবো না। আমাকে মাফ করে দিস। আমার জীবন এভাবেই যাবে। আমি অরুকে অনেক, অনেক বেশি কষ্ট দিবো। কারণ ওকে কষ্ট না দিলে আমি শান্তি পাবো না। আর আমার শান্তি প্রয়োজন। খুব বেশি প্রয়োজন। নয়তো আমি পাগল হয়ে যাবো।”
আহনাফ তূর্যকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি ওর চুল কেঁটে দিয়েছি, তাই আজ ও চৌধুরী ম্যানশন গিয়ে ডিভোর্স চেয়ে এসেছে। বাবা ফোন করে বলেছে আমি যাতে কাগজ রেডি করার জন্য তার সাথে দেখা করি। কিন্তু আমি ওকে ছাড়বো না। আমি অরুকে কখনো ছাড়বো না। ওকে ভালোবাসবো আমি। আমার মতো করে ভালোবাসবো। জানিস ও কি বলেছে? ও বলেছে, আমাকে আবরারের মতো খুন করবে। ঠিক আছে, করুক খুন। আমিও ওর হাতে খুন হতে চাই। এরপরই আমার শান্তি হবে।”
আহনাফ বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। তূর্য চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলো আহনাফের যাওয়ার দিকে।
(***)
শিরিন সুলতানা এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। স্বামীর মুখে হুট করেই মিষ্টি পুরে দিয়ে বললেন, “ওই মেয়ে থেকে পিছু ছুটছে আমাদের। এখনই তো মিষ্টিমুখ করার সময়।”
আমির চৌধুরী স্ত্রীর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তোমার ছেলের কি হবে ভেবেছো?”
“কি হবে? ওর জন্য তো আজ আনন্দের দিন। ডিভোর্স হলেই আমি জয়িতার সাথে আমার আহুর বিয়ে দেবো।”
এই বলে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে অষ্টম তলায় চলে এলেন। অষ্টম তলায় বেল দিতেই মিসেস তাওসিফ দরজা খুলে শিরিন সুলতানাকে দেখে অবাক হলেন। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই মিসেস শিরিন বাসায় ঢুকে তার মুখে মিষ্টি পুরে দিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “বলেছি না, ওই মেয়ের কাছ থেকে আমি আমার ছেলেকে মুক্ত করবো। করেছি তো!”
মিসেস তাওসিফ হতাশ কন্ঠে বললেন, “সংসার তো অরুণিকার ভাঙছে না। ভাঙছে আহনাফের মনও। আমি জানি না, তুমি কীভাবে এসব সহ্য করছো! আহনাফ অরুণিকার জন্য বাইরের দেশে না গিয়ে সেই ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে ঢুকেছে, যেখানে অরুণিকা পড়বে। অরুণিকা আহনাফের পিছু নিচ্ছে না। আহনাফ বারবার অরুণিকার পিছু আসছে। এর অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে, শিরিন?”
শিরিন সুলতানা বিরক্ত মুখে বললেন, “আমার জানতে হবে না এতোকিছু। আমি শুধু ওই মেয়েকে আমার ছেলের জীবনে চাই না, মানে চাই না।”
শিরিন সুলতানা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এরপর লিফটে উঠতেই মিসেস তাওসিফের চোখাচোখি হলেন। লিফট বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত মিসেস তাওসিফ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে শিরিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। লিফট বন্ধ হতেই শিরিন সুলতানা বাঁকা হাসলেন। আর মনে মনে বললেন, “অরুকে আহনাফের জীবন থেকে নয়, এই চৌধুরী ম্যানশন থেকেই সরিয়ে দেবো আমি। আমার অতীতের কোনো অংশ আমার বর্তমানে থাকতে পারবে না। আহনাফের ব্রেইন আমার ইচ্ছাতেই চলবে। আমি যা বলবো, ও তাই করবে। আমার ছেলে আহনাফ। মায়ের কথা ফেলতে পারবে না। ও অরুণিকাকে ডিভোর্স দিবেই।”
এদিকে মিসেস তাওসিফ ফোন হাতে নিয়ে সোফায় বসলেন। কল লিস্ট ঘেঁটে ছেলের নম্বরে ডায়াল করলেন। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে তাহমিদের কন্ঠ ভেসে এলো। মিসেস তাওসিফ বললেন, “অরুকে আহনাফের কাছ থেকে দূরে রাখিস। আমার কেন যেন ভয় হচ্ছে!”
তাহমিদ অবাক হয়ে বলল, “কি বলছো, মা?”
“আমি জানি না কি বলছি। তবে আমার মনে হচ্ছে, আহনাফ অরুণিকার সাথে অনেক খারাপ কিছু করবে।”
“ভালোবাসে ও অরুকে।”
“না, আহনাফ অরুণিকাকে ভালোবাসে, তবে শিরিনের ছেলে অরুণিকাকে ভালোবাসে না। আমি অনেকদিন ধরে তোকে একটা জরুরি কথা বলতে চাচ্ছি। তোকে বাসায় আসতে বলবো না। এখানে সেই কথা বলা ঠিক হবে না। কিন্তু তোকে একাও বলতে চাই না। তুই আর আরাফ একসাথে থাকলে ভালো হবে। আমাকে একটু বাইরে কোথাও সময় দে।”
“কি বিষয়ে, মা? আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছো তুমি!”
“আহনাফ ও শিরিনের বিষয়ে। কিন্তু তোকে এখানে বলা সম্ভব না। দেখা কর আমার সাথে। এখানে তোর দাদা-দাদু আছেন। উনারা শুনলে অনেক চিন্তা করবেন।”
তাহমিদের চিন্তা যেন আরো বেড়ে গেল। সে কল কেটে ধীর পায়ে হেঁটে আহনাফের রুমের কাছে এসে দাঁড়ালো। দরজায় তালা দেওয়া। আহনাফ বাইরে বের হলেই রুমের দরজায় তালা মেরে যায়। কিন্তু কেন? আগে তো এমন করতো না। এই রুমে এমন কি আছে, যেটা তালা দিয়ে রাখতে হবে? আর সে আলাদা রুমই বা কেন নিয়েছে? আগে তো আরাফ বা তূর্যের সাথে রুম শেয়ার করতো। কিন্তু এখন কেউ তার রুমে পাঁচ মিনিট এসে বসলেই সে চিড়চিড় করে উঠে। আহনাফের গত পাঁচ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনটা ভয়ংকর। আরাফও এই বাসায় এসেছে তার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু সে এতোটা ভয়ংকর রূপে নিজেকে প্রকাশ করছে না। অথচ আরাফের সাথে সেই খুনীর পরিবারের কোনো আত্মার সম্পর্ক নেই। কিন্তু আহনাফ তো ভালোবাসতো অরুণিকাকে। তাহলে এমন কাজ কীভাবে করতে পারে সে? চুল কাঁটা বেশ সামান্য মনে হচ্ছে তাহমিদের কাছে। এর চেয়ে ভয়াবহ তো অরুণিকার চরিত্রে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
চলবে–
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৫ ||
সকালে ক্যাম্পাসের জন্য বের হতে যাবে আতকিয়া জাহান অরুণিকার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। অরুণিকা অবাক চোখে তাকালো মামীর দিকে। আতকিয়া জাহান হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন, “টাকার ব্যাগটা দাও।”
অরুণিকা কপাল কুঁচকালো। রুহানিও ডায়নিং থেকে উঠে এলো। অরুণিকা জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
আতকিয়া জাহান রেগেমেগে বললেন, “তুমি আমাকে প্রশ্ন করবে? তাড়াতাড়ি টাকার ব্যাগটা দাও।”
অরুণিকা ধীর হাতে ব্যাগ থেকে টাকার ব্যাগটি বের করলো। রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তুমি অরুর কাছ থেকে টাকার ব্যাগ কেন খুঁজছো?”
“তুই চুপ কর। যাকে যেটা করতে বলেছি, সে আগে তার কাজটা করুক। তারপর না হয় বলছি।”
অরুণিকা টাকার ব্যাগ বের করে মামীর হাতে দিতেই তিনি ব্যাগ খুলে সব টাকা নিয়ে বললেন, “আজ থেকে তোমার পকেটমানি বন্ধ। ভার্সিটির টিউশন ফি, রিকশা ভাড়া, ক্যাম্পাসের খাওয়া-দাওয়ার খরচ এমনকি কোনো জিনিসপত্র কেনার টাকাও তুমি পাচ্ছো না।”
অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আতকিয়া জাহানের দিকে। রুহানি বলল, “মা, তুমি এ কেমন অমানবিক আচরণ করছো অরুর সাথে!”
আতকিয়া জাহান মেয়ের গালে চড় মেরে তাকে চুপ করিয়ে দিলেন। রুহানি গাল হাত দিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলো। অরুণিকা রুহানির কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোকে কিছু বলতে হবে না।”
মামীর দিকে তাকিয়ে অরুণিকা জিজ্ঞেস করলো, “হঠাৎ কেন এমন করছেন, মামী? আমি এখনো নিজের খরচ চালানোর মতো কিছুই করছি না। আমি কীভাবে চলবো এখন?”
আতকিয়া জাহান বিরক্ত মুখে বললেন, “সেটা আমার দেখার বিষয় না। তুমি পকেটমানি পাচ্ছো না, এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। এই বাসায় থাকা তোমার জন্য ফ্রি। কিন্তু খাবারে ভাত-ডাল ছাড়া কিছুই পাবে না। মাংস-সবজি খেতে ইচ্ছে করলে নিজে বাজার করবে, আর নিজেই রান্না করবে। তোমার আর আমাদের খাবার এখন থেকে আলাদা।”
রুহানি চেঁচিয়ে বলল, “আমি বাবাকে বলে দেবো সব। তুমি এমন হিটলারের মতো কথা বলছো কেন?”
“চুপ, বেয়াদব মেয়ে। তোর ফোন এখন আমার কাছে। তোর বাবার সাথে কথা বললেও আমার সামনেই বলতে হবে। আর অরুণিকা, তোমাকে বলছি। ফোন নেই নি তোমার। নিজে কিনেছো, তাই নিলাম না। আর বাইরেও যাচ্ছো, ফোনের তো প্রয়োজন আছেই। কিন্তু মনে রেখো, তোমার ফোনে যাতে তোমার মামার কোনো কল না আসে। আমি যদি শুনি তুমি এসব তোমার মামাকে বলেছো, তাহলে অনেক খারাপ হবে। উনি বাইরের দেশ থেকে আসতে আসতেই আমি এমন কিছু করে ফেলবো, তুমি আর নিজের ভুল শোধরাতে পারবে না। আর রুহানিকে যেন তোমার আশেপাশে না দেখি। আমার মেয়ে থেকে দূরে থাকবে। রুহানিকে যদি দেখি তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, এই বাসায় আর ঢুকতে পারবে না তুমি। রুহানিও নিশ্চয় চাইবে না অরুণিকা বাইরে রাত কাটাক। তাহলে দু’জনই এখন থেকে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রাখবে।”
রুহানি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, “আল্লাহ তোমাদের মাফ করবে না। তোমরা তো দেখছি একটার চেয়ে একটা। অরুর ওই শয়তান চাচীকে দেখে ভেবেছি, আমার মা অন্তত কিছুটা ভালো। কিন্তু তুমি তো দেখছি অ্যানাবেলা।”
আতকিয়া জাহান ভ্রূ কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “অ্যানাবেলা কে?”
“তুমি বুঝবে না। তুমি সিরিয়াল দেখতে দেখতে বাসাটাও সিরিয়াল বানিয়ে দিচ্ছো। এতো কাহিনী করো! ভাল্লাগে না আর।”
অরুণিকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আতকিয়া জাহানকে পাশ কেটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পড়লো। গেটের কাছে আসতেই ভাবতে লাগলো, “রিকশা না নিলে রাস্তা পার হবো কীভাবে?”
অরুণিকা রুদবাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ রুদবা যাবে না। প্রায়ই ক্লাস মিস দেয় মেয়েটা। কিন্তু অরুণিকার জরুরি ক্লাস আছে আজ। ক্লাসে না গেলে তারই ক্ষতি হবে। বাধ্য হয়ে সামনে পা বাড়ালো সে। গলির মুখে আসতেই পেছন থেকে একটা মোটর সাইকেল এসে থামলো তার সামনে। অরুণিকা চমকে উঠল। আহনাফ হেলমেট খুলে অরুণিকাকে আপাদমস্তক দেখে বলল, “সামনের মাসে রুহানিকে ইংরেজি পড়াতে আসবো। আমি এখন তোর বোনের নিউ ইংলিশ টিচার।”
অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল, “আর কিছু?”
আহনাফ মোটর সাইকেলের হাতলে দু’হাত রেখে বলল, “মামী পকেটমানি কেটে নিয়েছে, তাই না?”
অরুণিকা সন্দেহের দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“আমি এমন এক হাওয়া, যেই হাওয়া ফাঁক খুঁজে তার স্থান দখলের।
আমি এমন এক হাওয়া, চাইলেও যার স্পর্শ থেকে বাঁচা যায় না।
আমি এমন এক দুঃস্বপ্ন, যেই দুঃস্বপ্ন গেঁথে আছে তোমার খোলা চোখের মাঝে।
চোখ খুললেই যাকে দেখবে, বন্ধ চোখে তো দুঃস্বপ্ন হয়ে আসবো আমি।
আর চিরনিদ্রায় গেলে আমাকে পাবে তোমার পাশে- নরকে।
এই বন্ধন ততোদিন আহনাফ অরুণিকার যতোদিন।”
“ইন ইউর ড্রিমস। ভুলে যেও না, আমাদের বন্ধন ছিন্ন হতে যাচ্ছে।”
“আয়নিক বন্ধন আমাদের। তুই ত্যাগ করবি আর আমি খপ করে ধরে আবার মিশে যাবো তোর সাথে।”
“দেখা যাক, আয়নিক বন্ধন ঘটানোর জন্য তোমার আর কোন কোন প্রভাবকের প্রয়োজন হয়! আমার মামীকে তো নিজের দিকে করেই নিয়েছো। কিন্তু আমাকে তাও পাবে না। এমন না হয়ে যায়, আমি তোমাকেই প্রতিস্থাপন করে ফেলেছি।”
আহনাফ অরুণিকার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “তুই আমার থাকবি, অরু। লিখে রাখ।”
“যদি না থাকি।”
“সেদিন তোর এই পৃথিবীতে শেষ দিন হবে।”
অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। আহনাফ শব্দ করে হাসলো। হাসি থামিয়ে বলল, “অথবা আমার শেষদিন।”
এই বলে আহনাফ মোটর সাইকেল নিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে গেল। অরুণিকা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। আজ বোধহয় ঝড়ো হাওয়া প্রকৃতিকে উত্তাল করতে আসবে। অরুণিকা বুকে হাত রেখে শক্ত কন্ঠে বলল, “আমার জীবনে এমন ঝড় আমি চাই না। আহনাফ, তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছো। আমার এখন অন্য পথ ধরতে হবে। দেখো, কি করি আমি। টাকাও আসবে, সাথে তুমিও ভাগবে।”
(***)
দু’তিন দিন অরুণিকা শুধু ডাল-ভাত খেয়েই ছিল। আর ক্যাম্পাসে গেলে সে রুদবার সাথেই যায়। তবে প্রথম দিন ইমানই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিয়ে গিয়েছিল অরুণিকাকে। এদিকে সে ক্যাম্পাসে পানি খেয়েই পেট ভরায়। আর রুহানি ও অরুণিকা এক বাসায় থেকেও কথা বলে চিঠির মাধ্যমে। আতকিয়া জাহানের চোখের আড়ালে অরুণিকার দরজার নিচ দিয়ে চিঠি লিখে পাঠায় রুহানি। অরুণিকাও একই কাজ করে। আতকিয়া জাহান নিজেও অবাক দু’জনের একে অপরকে উপেক্ষা করে চলতে দেখে। কেউ কারো দিকে তাকায়ও না। এমন বাধ্য মেয়ের মতো রুহানি আর অরুণিকা তার কথা মেনে চলবে, এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না তার। কিন্তু তারা যে চিঠির যুগে পৌঁছে গেছে, সেটা আর মিসেস আতকিয়ার মাথায় আসলো না। এদিকে অরুণিকার ভার্সিটিতে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। প্রেজেন্টেশন দিতে হবে তাকে। যেই বিষয়ের উপর প্রেজেন্টেশন, সেখানে অবশ্যই কিছু টাকা খরচ করতে হবে তার। পরের সেমিস্টারেও টাকা দিতে হবে। অরুণিকা ক্যাম্পাসের কেন্টিনে রুদবার পাশে বসে আছে। দু’জনই এই বিষয়ে চিন্তিত। টিউশন খুঁজছে অরুণিকা, কিন্তু এলাকায় কাউকে পাচ্ছে না। ইংরেজি বিভাগে হওয়ায় অভিভাবকরা অন্য বিষয়ে পড়াতে আগ্রহী হচ্ছেন না। আর দূরে কোথাও হলে, রাস্তা পার হওয়া, গাড়ি ভাড়ার সংকটে সেটাও হচ্ছে না। রুদবা চিন্তিত কন্ঠে বললো, “মামীর পায়ে ধরে বসে থাক। এটাই এখন একমাত্র সমাধান।”
অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বললো, “তাও দেবে না। আহনাফ ঘুষ দিয়েছে মামীকে।”
“উনি তোর সাথে এমন ঘাড়ত্যাড়ামি করেন কেন বল তো? কাজিনদের মধ্যে এতো ঝামেলা হতে আমি আগে শুনি নি।”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। রুদবা বলল, “এতো সাসপেন্স রাখিস কেন? আচ্ছা, বাদ দে। বলিস না। এখন কি কাজ খুঁজবি, সেটাই বল।”
তাদের কথোপকথনের মাঝখানে তাহসিন ঢুকে পড়লো। সে অরুণিকা ও রুদবার সামনে বসে বলল, “কি কাজের কথা বলছো?”
অরুণিকা কিছু বলার আগেই রুদবা বলে উঠল, “গারিবস হয়ে গেছে তোমাদের সিআর আপা। চাকরি খুঁজছে এখন।”
তাহসিন উৎসাহ নিয়ে বলল, “পেয়েছ না-কি?”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আমাকে চাকরি দেওয়ার জন্য বসে আছে তো সবাই!”
“টিউশন করাও।”
“পাচ্ছি না।”
“আমি খুঁজে দেবো?”
“দিলে মোহাম্মদপুর, এসিসিয়ান সোসাইটির ওদিকে দিও।”
“মুরাদপুর পারবে না?”
“রাস্তা পার হওয়া নিয়ে অনেক ঝামেলা হবে। আমার ফোবিয়া আছে।”
“ওভার ব্রিজ দিয়ে পার হবে!”
অরুণিকা চমকে উঠলো। আনন্দিত কন্ঠে বললো, “আরেহ, হ্যাঁ। পারবো তো। কি গাধী আমরা! ওভার ব্রিজটা মাথা থেকেই সরে গেল।”
তাহসিন হেসে বলল, “আমার আন্টির মেয়ের জন্য ফিমেইল টিউটর খুঁজছিল। ওয়েট, আমি কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছি।”
তাহসিন একপাশে গিয়ে তার আন্টির সাথে কথা বলে আসলো। অরুণিকা উৎসুক কন্ঠে বলল, “কি বললো?”
“রেখে দিয়েছে।”
অরুণিকা হতাশ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “টিউশন করেও তেমন একটা লাভ হবে না। যা ভাটা এখানে। মাস শেষে দু-আড়াই হাজার টাকা ধরিয়ে দেবে। কিন্তু এখন তো আমার অনেক টাকা লাগবে। অন্তত সাত-আটটা টিউশন করতে হবে পুরো মাস চালানোর জন্য।”
“হঠাৎ তোমার এই সংকট এলো কেন?”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। রুদবা বলল, “ওর জল্লাদ মামীটা পকেটমানি বন্ধ করে দিয়েছে। এখন অরুণিকা গারিবস।”
তাহসিন কিছুক্ষণ হাঁ করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে উৎসুক কন্ঠে বলল, “আমার মামার শো-রুমে কাজ করবে? মাসে আট হাজার টাকা দেবে নিশ্চিত।”
অরুণিকা আর রুদবা দু’জনই ঠোঁট গোল করে বলল, “ওয়াও।”
“আমি মামাকে বলে একটু বাড়িয়ে দিলাম না হয়।”
অরুণিকা জিজ্ঞেস করলো, “কোয়ালিফাইড হতে হবে? আমি তো গ্রেজুয়েটও না।”
“আরেহ ধুর। কাপড় বিক্রি করবে তুমি। কাস্টমার আসবে শো-রুমে।”
“আর যদি বিক্রি না হয়?”
“এটা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি জাস্ট মামার শো-রুমে দাঁড়িয়ে কাস্টমারদের জামা দেখাবে, ওদের সাথেই ডিল করবে। আমি নিজেও ওখানে গিয়েছি। ওই শো-রুমে আগে শুধু ছেলেদের শার্ট বিক্রি করতো, এখন মেয়েদের জামা-কাপড়ও বিক্রি করছে। তাই এখন সেলসগার্ল রাখতে চাচ্ছেন মামা।”
“কোথায় এটা?”
“মুরাদপুরেই। তুমি জাস্ট ওভার ব্রিজ পার হয়ে যাবে। লোকেশন পাঠিয়ে দেবো আমি।”
“কিন্তু টাইমিং?”
“ওটা ক্লাসের সাথে ক্ল্যাশ করবে না। আমার মামা, তুমি এতো চিন্তা করছো কেন? তুমি জাস্ট কালকে থেকেই জয়েন করছো। আমি তোমাকে লোকেশন পাঠাবো। ক্লাস শেষে ওখানেই যাচ্ছি আমি। মামা দোকানেই থাকবে। আমি কথা বলে নেবো। তুমি ক্যাম্পাস থেকে ওখানেই যেও।”
রুদবা বলল, “আমি তাহলে অরুকে নিয়ে আসবো। সেই সুযোগে আমিও অরুর জব প্লেস দেখে গেলাম।”
(***)
অরুণিকার জীবন এক সপ্তাহেই পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গেছে। কারো রিজিক কেঁড়ে নিলে, আল্লাহ তার রিজিকের ব্যবস্থাও করে দেন। অরুণিকার জীবনে আসা ঝড় বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। তাহসিনের সাহায্যে অরুণিকা একটা শো-রুমে সেলস গার্লের কাজ পেয়ে যায়। মাসে দশ হাজার টাকা। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই তাকে এই কাজ করতে হবে। অরুণিকা এখন প্রতিদিনই ভার্সিটির ক্লাস করে বাসায় যায়, এরপর খেয়েদেয়ে তৈরী হয়ে বের হয় কাজের উদ্দেশ্যে। পাশাপাশি রুদবা তাকে দুইটা টিউশন খুঁজে দিয়েছে। একজন রুদবার চাচাতো ভাই। অন্যটা ফেইসবুক গ্রুপ থেকে খুঁজে পাওয়া। দু’টোই মুরাদপুরে। অরুণিকা প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত শো-রুমে ডিউটি করে। এরপর সপ্তাহে পাঁচদিন সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণির একটা ছেলেকে পড়াতে যায়। এরপর সাড়ে আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত রুদবার চাচাতো ভাইকে শুধু ইংরেজি পড়াতে যায়। দুইটা টিউশন করে মাসে তার পাঁচ হাজার টাকা আসে। সে ধরে নেয় পনেরো হাজার টাকায় তার মাস বেশ ভালোই চলবে।
এদিকে রুহানিকে রোজ সন্ধ্যায় পড়াতে আসে আহনাফ। কিন্তু অরুণিকার দেখা পায় না সে। আহনাফ এ নিয়ে মোটামুটি বিরক্ত। রুহানিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে সে। ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলে রুহানি গলা উঁচিয়ে বলে, “মা, স্যার না পড়িয়ে গল্প করছেন!”
বাধ্য হয়ে আহনাফ রুহানিকে প্রশ্ন করা বাদ দিল। রুহানিকে পড়াতে এলে রুহানির রুমে ঢুকতে যাওয়ার আগে আর বের হওয়ার পর অরুণিকার রুমে একবার উঁকিঝুঁকি মারে আহনাফ। আর সেখানেও রুহানির খোঁচা খেতে হয় তাকে। রুহানি কখনো বলে, “স্যার ওই ঘরে স্বর্ণ-টর্ণ নেই। চুরির ধান্ধা থাকলে আম্মুর রুমে উঁকিঝুঁকি দিতে পারেন।”
কখনো বা বলে, “স্যার, আপনি ওদিকে কেন তাকাচ্ছেন? রুম পছন্দ হলে ওখানে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। ওই রুমে আরাম অনেক।”
আহনাফ প্রতিত্তোরে শুধু চোখ ছোট করে তাকিয়ে থাকে রুহানির দিকে।
(***)
ভার্সিটিতে আগামীকাল থেকেই গ্রীষ্মকালীন মেলা শুরু হবে। টান এক সপ্তাহ ধরে সেই মেলা চলবে। এক সপ্তাহে সব ঋতুর সাজে সজ্জিত হবে ক্যাম্পাস। অরুণিকাদের ভার্সিটিতে বছরে দুইটা মেলা হয়। একটা গ্রীষ্মকালীন মেলা, যেখানে সব ঋতুর একটা আবহ দেখা যায়। অন্যটি শীতকালীন মেলা, যেখানে শুধু খাবারের স্টল বসে। এই এক সপ্তাহ ক্লাস বন্ধ থাকবে। এদিকে অরুণিকা টাকার অভাবে মেলায় যেতে পারছে না। এন্ট্রি ফি একশো টাকা। ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের এন্ট্রি ফি দিতে হবে শুনে রুহানি বিরক্ত হলো। সে অরুণিকাকে লিখলো,
“কোন গোল্ডের হার বিক্রি করবে, যার জন্য এন্ট্রি ফি দিতে হবে? তাও আবার একশো টাকা? ভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়েও! এসব ব্যবসা করার ধান্ধা। ওখানে কী এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আসবে আমারও জানার খুব ইচ্ছা!”
অরুণিকা রুহানির চিঠি পড়ে মলিন মুখে বলল,
“মাত্র একশো টাকা, তাও সাতদিনের জন্য! আমার কাছে সেই টাকাও নেই। কি গরিবস আমি? মাসও শেষ নি আমার। বেতনও পাবো না এখন।”
রুহানি ফিরতি চিঠি পেয়ে লিখলো,”মাকে রিকুয়েষ্ট করে দেখবো আমি। চিন্তা করিস না।”
অরুণিকা সেই চিরকুটের উত্তরে লিখলো,
“তোরও তো পকেটমানি বন্ধ। দেখিস, খুঁজলেও দেবে না। আমি তো অন্তত বাইরের হাওয়া খেতে পারছি। তোকে তো বাসার বাইরে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। ছাদেও উঠতে দেয় না। আর মোবাইল তো সেটা অন্য দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে বোধহয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি তোর সাথে প্রেম করছি। কি ভয় নিয়ে চিরকুট লিখে তোর দরজার নিচ দিয়ে পাঠাই! ধরা খেলে মনে হয়, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার আদেশ আসবে। ভাবতেই অবাক লাগছে, এই সেঞ্চুরিতেও কেমন পিকুলিয়ার মানুষজন এসেছে আমাদের জীবনে। এদের জন্য আমরা দুই বোন একটু শান্তিও পাচ্ছি না।”
রুহানি অরুণিকার সেই চিঠি পড়ে হতাশ কন্ঠে বলল, “কতোদিন একটা সেলফি উঠায় না। আপসোস তো আমার প্রিয় প্রেমিকের জন্যই হচ্ছে। আমার হাতের স্পর্শ না পেয়ে না জানি কতো অস্থির সে। না জানি আমার পাষাণী মা কোন আলমারির ড্রয়ারে বন্দি করেছে আমার প্রিয় প্রেমিককে। একটু চার্জও করে না হয়তো। বেচারা কতোদিন অনাহারে আছে আমার শোকে! আমি ঠিকই তার রক্ত চুষে দিনে এক বেলা চার্জে দিতাম। একদম পেট ভরে যেতো তার। এখন তো একবেলাও পেট ভরে না আমার প্রেমিকের। বেচারা একদম পাথর হয়ে পড়ে আছে, নিশ্চিত।”
(***)
অরুণিকা ছাদে বসে আছে আনমনে। হঠাৎ ইমানকে ছাদে উঠতে দেখে অরুণিকা দাঁড়িয়ে গেল। অরুণিকাকে দেখে ইমান বলল, “ইদানিং তো আকাশের চাঁদ হয়ে গেছো। খুঁজেই পাই না তোমাকে। ক্যাম্পাসে এই দেখলাম, এই হাওয়া।”
অরুণিকা শুকনো হাসলো। ইমান বলল, “তোমাকে অনেক কিউট লাগছে, জানো? চুল কাটলে মেয়েদের এতো কিউট লাগে তোমাকে না দেখলে জানতামই না।”
অরুণিকা ক্ষীণ হাসলো। ইমান আবার বলল, “তবে লম্বা চুলে তোমাকে সুকেশিনী লাগতো।”
অরুণিকার হাসি প্রসারিত হলো। কোনো উত্তর না পেয়ে ইমান পুনরায় বলল, “চুপ কেন?”
অরুণিকা ইমানের চোখের দিকে তাকালো। ইমানের ধূসর রঙা চোখ দু’টিতে বেশ মায়া ছিল। অরুণিকা তাকিয়ে ছিল অকারণেই। ইমান জিজ্ঞেস করলো, “মেলায় তো যাচ্ছো, তাই না? আগামীকাল মেলা।”
অরুণিকার মনটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেল। সে বিষন্ন মুখে বলল, “না, যাচ্ছি না।”
“কেন?”
“মামী অনুমতি দেন নি।”
ইমান মৃদু হেসে বলল, “আমি জানি, তোমার কাছে এন্ট্রি ফি নেই, তাই যেতে চাচ্ছো না।”
অরুণিকা তব্ধা খেলো। ইমান অরুণিকার কাছে এসে বলল, “রুদবা আমাকে সব বলে দিয়েছে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম তো তাই। আহনাফ স্যার তোমার চুল কেটে দিয়েছেন সেটাও শুনেছি। স্যারের সাথে তোমার তো দেখছি ঘোর শত্রুতা!”
অরুণিকা মাথা নিচু করে নিলো। ইমান বলল, “কোনো পারিবারিক গন্ডগোল তো আছেই।”
অরুণিকা ইমানের কথা উপেক্ষা করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গেলেই ইমান তার পথ রোধ করে বলল, “সরি, সরি। আর জিজ্ঞেস করবো না। আমি তো জাস্ট প্রতিবেশি। আমার রাইটও নেই এসব জিজ্ঞেস করার। তবে কাজিন হয়ে এতো স্পর্ধা আহনাফ স্যারের কীভাবে হলো?”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। ইমান বলল, “আচ্ছা, এসব বাদ দাও। তুমি কাল অবশ্যই যাবে। তোমার এন্ট্রি ফি আমি দিয়ে দেবো।”
অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “মানে?”
“আমিই দেবো এন্ট্রি ফি।”
“না, দিতে হবে না। আমার যাওয়ার ইচ্ছা নেই।”
“কিন্তু আমি দেবোই।”
“না, আমি নিবো না।”
“বেশ বাড়াবাড়ি করো তুমি। আমি ক্লাবের সেক্রেটারি। আমি দিয়ে দিলে কী হবে?”
“না, বললাম তো, লাগবে না।”
“এটা তোমার ট্রিট ভেবে নাও।”
“আমার ট্রিট লাগবে না।”
“বিনিময়ে যদি আমাকে গল্প শুনাতে বলি!”
“তাও আমি নিবো না।”
“ভারী কঠিন মেয়ে তো তুমি! থাক দিলাম না। কিন্তু ক্লাব সেক্রেটারি একজনকে ফ্রিতে এন্ট্রি দিতে পারে৷ আমি সেই সুযোগটা তোমাকে দিতে চাচ্ছি।”
অরুণিকা ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন?”
“কারণ এতো চমৎকার সাজসজ্জা করলাম, আর চমৎকার দু’টি চোখ যদি সেই সাজসজ্জার প্রশংসাই না করে আমার তো সব আয়োজন বৃথা যাবে।”
অরুণিকার দৃষ্টি স্থির হলো ইমানের দিকে। ইমান ক্ষীণ হেসে বলল, “প্রতিটা সাজের পেছনে তুমি আছো ণিকা। আমি তোমার পছন্দে সাজিয়েছি সব। আজ সারাদিন এসব ভেবে ভেবেই পুরো ক্যাম্পাস সাজালাম। কাল তুমি যদি না দেখো, খুব কষ্ট পাবো আমি। এন্ট্রি ফি ফ্রি। তবুও তো গল্প শোনানোর আবদার করলাম। তবুও যদি তুমি বিশ্বাস না করো, টিউশন তো করো শুনলাম। মাস শেষে একশো টাকা দিয়ে দিও।”
ভীষণ রাগ ছিল ইমানের শেষ বাক্যে। তা দেখে বেশ মায়া লাগলো অরুণিকার। সে বলল, “মাস শেষে একশো টাকাও দেবো। প্রতিদিন গল্পও শোনাবো।”
ইমান এক গাল হাসলো। অরুণিকাও প্রতিত্তোরে মিষ্টি হেসে নেমে পড়লো। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই আহনাফকে তাদের ঘরের দরজার সামনে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো সে। পরক্ষণেই মনে পড়লো রুহানিকে পড়াতে এসেছে বোধহয়। অরুণিকা বেল দেওয়ার আগেই আহনাফ তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। অরুণিকা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আহনাফ শক্ত করে তার কোমড় চেপে ধরে অরুণিকার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“ইমানের সাথে এতো কীসের পটর পটর?”
অরুণিকা দাঁত কটমট করে বলল, “আমার মুখ, আমি বলবো। তোমার কি? এখন কি জিভ কেঁটে ফেলবে?”
“দরকার হলে তাই করবো।”
অরুণিকা বাঁকা হেসে বলল, “তাহলে তো দুই হাত এগিয়ে ছুঁয়ে দেবো, জড়িয়ে ধরবো তাকে। এরপর আমার হাত কাঁটা আর বুকে ছুরিকাঘাতের দায়ে তুমি ফাঁসিতে ঝুলবে। খুব মজা হবে তখন।”
আহনাফ অরুণিকার বুকে হাত রাখলো। অরুণিকা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো আহনাফের দিকে। সে আহনাফের হাত সরিয়ে দিতে যাবে তখনই আহনাফ তার শরীরের কোমল অংশ জোরে চেপে ধরলো। অরুণিকার চোখ-মুখ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। সে কাঁপা কন্ঠে বললো, “তুই একটা জানোয়ার। তোকে ঘৃণা করা আমার উপর ফরজ।”
আহনাফ সাথে সাথেই অরুণিকাকে ছেড়ে দিল। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এদিকে অরুণিকা দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিলো। সেই ধাক্কার শব্দ শুনে ইমানও ছাদ থেকে নেমে পড়লো। আহনাফ ইমানকে দেখে আরো রেগে গেল। কিন্তু রুহানি শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে দিতেই সে আর কিছু বললো না ইমানকে। উলটো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো। আহনাফকে নিচে নেমে যেতে দেখে ইমান অরুণিকাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই অরুণিকা ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। এদিকে রুহানি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছে। কি হলো কিছুই বুঝলো না সে। ওদিকে আহনাফ গেট দিয়ে বেরিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন এলোমেলো লাগছে তার সবকিছু! মাথাটা ভারী হয়ে আসছে। অরুণিকার কন্ঠে প্রথম সে ঘৃণার আভাস পেয়েছে। এভাবে স্পর্শ করলো কেন সে? এমন তো করার ইচ্ছে ছিল না তার। আহনাফ দ্রুত বাসায় ফিরে এলো। ইমন আহনাফকে আবার ফিরে আসতে দেখে বলল, “তুই না রুহানিকে পড়াতে গেলি? আবার চলি এলি যে?”
আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। আহনাফের এমন উন্মাদ আচরণে বেশ অবাক হলো ইমন। বিড়বিড় করে বলল, “জিন-টিন ভর করলো না-কি ওর উপর!”
এদিকে আহনাফ নিজের ঘরে এসে নিজের হাত নিজেই কামড়াতে লাগলো। পাগলের মতো আচরণ করছে সে। আর বিড়বিড় করে বলছে, “আমি তো ওকে এভাবে আঘাত করতে চাই নি। আমি তো ভেবেছি ওর সাথে কথা বলবো। তাহলে এমন কেন করলাম? কেন করলাম আমি এমন? অরু তো আমাকে ঘৃণা করবে এখন। আমি তো ওর চোখে আমার প্রতি ভালোবাসা দেখতে চাই।”
আহনাফ আয়নায় নিজের চেহারা দেখে বলল, “আমি এমন কেন করছি? আমি তো অরুকে ভালোবাসি। আমি পারছি না কেন ওকে ভালোবাসতে?”
আহনাফ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো, যেন এখুনি সে অরুণিকাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে পারলেই শান্তি পাবে। পায়চারি করতে করতেই দমবন্ধ হয়ে আসছিল তার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। আবার টেবিল ঘেঁটে সেই বইটা বের করলো। বইটা খুঁজতে গিয়ে দু’একটা বই মাটিতেও পড়ে গেছে। শব্দ শুনে ইমন দরজার কাছে এসে ঠোকা দিয়ে বলল, “আহনাফ, কি করছিস তুই?”
আহনাফ মুখ চেপে ধরলো। বইয়ের ভেতর থেকে সেই লকারের চাবিটা বের করলো। এরপর আলমারি খুলে নিচে বসে লকারের তালা কাঁপা হাতে খুললো। লকারের ভেতরে এলোমেলো ভাবে হাতড়ে কিছু একটা হাতে নিলো। আবারও আহনাফের মুখটা আড়াল হয়ে গেলো আলমারির দরজার ওপাশে। কি করলো, কি দেখলো, কি শুনলো তা আহনাফই ভালো জানে। মিনিট খানিক পর আলমারি বন্ধ করে বিছানায় উঠে বসলো সে। চোখ লাল হয়ে গেছে তার। ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ছে সে। বালিশের নিচ থেকে দামি সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো আহনাফ। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ড্রয়ার খুলে লাইটারটা হাতে নিলো। এরপর সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়লো।
এই মুহূর্তে বাথরুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে আহনাফ। চোখ দু’টি ভীষণ লাল। সিগারেট শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।বলল, “অরু, আমার খুব ইচ্ছে করে তোকে ভালোবাসতে। কিন্তু পারছি না আমি। তুই ঠিক বলেছিস, আমি জানোয়ার। আমার ভেতরে একটা জানোয়ার লুকিয়ে আছে। আমি সেই জানোয়ারটাকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমি হিংস্র হয়ে যাচ্ছি। আমি আবার সেই সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে চাই, যেখানে তুই আমার মায়াবতী হয়ে আছিস। যেখানে আমি আর তুই ছাড়া কেউ থাকবে না আশেপাশে।”
চলবে-