উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
15

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৭ ||

২০১৭ সাল। বাতাবরণে নিঃশব্দে প্রবেশ করলো পৌষ মাস। হিম সমীরণ বয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। অস্পষ্ট হয়ে আছে দূরের ছবি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শীতল হাওয়া গায়ে মাখছে অরুণিকা। হঠাৎ উষ্ণ স্পর্শ তার শরীর বেষ্টন করলো। অরুণিকা চমকালো না। এটা সেই চিরচেনা স্পর্শ। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো লাজুক হাসি। প্রতিদিনই এই মানুষটার উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে, অথচ প্রতিবারই লজ্জায় নুইয়ে পড়ে প্রথমবারের মতো।

আহনাফ অরুণিকার কাঁধে তার ঠোঁট ছোঁয়ালো। অরুণিকা শিউরে উঠলো। পেছন ফিরে আহনাফের বুকে মুখ লুকিয়ে খামচে ধরলো আহনাফের টি-শার্ট। আহনাফ মৃদু হেসে তাকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকলো। এরপর অরুণিকাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো অরুণিকার পাশে। দু’জনই একই কম্বলের নিচে শুয়ে আছে। আর আহনাফের উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠছে অরুণিকা।

আবরারের মৃত্যুর তিনমাস অতিক্রম করেছে। অথচ এখনও অরুণিকার সাথে কেউই কথা বলে না। আহনাফও সবার সম্মুখে বেশ রুক্ষ আচরণ করে। কিন্তু আড়ালে খুব যত্ন নেয় আর ভালোবাসে। আর সেই লুকোনো যত্ন ও ভালোবাসায় সিক্ত অরুণিকা। রাতে দরজা খোলা রেখেই ঘুমায় সে। সবাই ঘুমানোর পর যাতে আহনাফ তার ঘরে আসতে পারে সেই সুযোগটা সে নিজেই করে দিয়েছে৷ আহনাফ এলেই সে আহনাফের বাহুতে মাথা রেখে ঘুমায়।

অরুণিকা ও আহনাফের সম্পর্ক এখনও শারীরিক পরিণতির সেই চূড়ান্ত রেখা স্পর্শ করে নি, তবুও অরুণিকার সদ্য পরিণত দেহ আহনাফের অচেনা নয়। অরুণিকার দেহের প্রতিটি ভাঁজে আহনাফ তার স্পর্শ দিয়ে গেছে। কোনো হুড়োহুড়ি ছিল না সেই ভালোবাসায়, ছিল শুধু যত্ন আর মিষ্টি অনুভূতি। আর আহনাফের অবুঝ প্রেমিকার হৃদয়ে সেই মিষ্টি স্পর্শ চরম দাগ কেটেছে। সে শুধু আহনাফকে ধরে রাখতে চায়। আহনাফ একটু দূরে গেলেই কেমন অস্থির হয়ে পড়ে সে।

(***)

পৌষের কিছু সপ্তাহ কেটে যেতেই একটা দাওয়াতের আয়োজন হলো আহনাফদের ফ্ল্যাটে। সেই উপলক্ষে অরুণিকাকে ছ’তলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঠিয়ে দেওয়া নয়, বলা যায় শিরিন সুলতানা তাকে একপ্রকার তাড়িয়ে দিয়েছেন। জুবায়ের করিম চৌধুরী ও মিসেস নীহারিকার মৃত্যুর পর অরুণিকা একা ছ’তলায় থাকে নি। তার ভীষণ ভয় হতো এতো বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে। বাবা-মার মৃত্যুর পর আহনাফই তাকে চারতলায় নিয়ে গিয়েছিল। এমনকি আবরারের মৃত্যুর পরও কেউ তাকে বের করে দেয় নি। অথচ আজ এতো মাস পর তাকে উপরে উঠিয়ে দিলেন শিরিন সুলতানা! তাও আবার নতুন অতিথির আগমনে! ভীষণ মন খারাপ হলো তার। মনে জমলো এক রাশ অভিমান। আহনাফ কেন আটকালো না? কেন তাকে যেতে দিল?

উপরে উঠার পর থেকেই অরুণিকা শান্তি পাচ্ছে না। ছ’তলা থেকে চারতলা বেশ কয়েকবার নামলো সে। তবে তার নামা সার্থক হয়েছে। আজ আহনাফ কালো শার্ট পরেছে। কালো শার্টে বেশ মানায় তার বরকে। হাতা কনুই অব্ধি গুটিয়ে রেখেছে সে। সাদা জিন্সের সাথে বেশ লাগছে আহনাফকে। গোসল করেছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। অন্যান্য দিন আহনাফ গোসল সেরে তোয়ালে নিয়ে আসে অরুণিকার কাছে। অরুণিকা যত্নের সাথে আহনাফের মাথা মুছে দেয়। কিন্তু আজ আহনাফের মাথা ভেজা। ভেজা চুল কপালে, ঘাড়ে লেপ্টে আছে। এসব দেখে অরুণিকার মায়া বেড়ে গেল। মানুষটা তাকে ছাড়া একদম অচল, এই গর্বে বুক ফুলে উঠলো তার। সে একটু পরপর নিচে নেমে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে আহনাফকে। দূর থেকেই মিষ্টি একটা সুগন্ধ আসছে তার নাকে। আহনাফ বোধহয় আজ একটু কড়া সুগন্ধি মেখেছে। অরুণিকার সেই সুগন্ধি মাখা মানুষটির বুকে নাক ডুবিয়ে রাখার তীব্র শখ বাঁধলো। সে ইশারায় আহনাফকে ডাকলো বেশ কয়েকবার। কিন্তু আহনাফ যেন ইচ্ছে করেই তার দিকে তাকালো না। ভীষণ অভিমান হলো অরুণিকার। মুখ ভার করে নিজেও গোসল সেরে কালো ফ্রক পরে নিলো। আয়নায় নিজেকে দেখে বলল, “এবার আমিও ঢং করে তোমার সামনে যাবো, আর এরপর তোমার দিকে ফিরেও তাকাবো না।”

অরুণিকা উৎসাহ নিয়ে নিজেকে সাজালো। চুল শুকিয়ে বাঁধলো। এভাবেই বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে গেল। এরপর সে পরিপাটি হয়ে আবার চার তলায় নামলো। দেখলো আহনাফ একটা মেয়েকে নিয়ে লিফটে উঠছে। অরুণিকা সিঁড়ি বেয়ে নামায় আহনাফ ও মেয়েটি তাকে খেয়াল করে নি। তারা লিফটে উঠতেই অরুণিকা লিফট কোথায় যাচ্ছে তা দেখার জন্য লিফটের কাছে এসে দাঁড়ালো, আর তখনই শিরিন সুলতানা জাহানারা ইসলামকে নিয়ে বের হলেন। অরুণিকা তাকে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট। সে দ্রুত পদে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনই শিরিন সুলতানা তাকে দেখে ফেললো। চোখ-মুখ কুঁচকে তিনি বললেন, “এই তুমি এখানে কি করছো?”

অরুণিকা চোখ নামিয়ে বলল, “উপরে উঠছি।”

জাহানারা ইসলাম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “এই মেয়েটা কে, শিরিন?”

শিরিন সুলতানা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, “আমার ছেলের রক্ষিতা।”

অরুণিকা চমকে তাকালো শিরিন সুলতানার দিকে। কথাটার অর্থ বুঝে না সে। কিন্তু শিরিন সুলতানার কণ্ঠের স্বর শুনে বুঝলো খারাপ কিছু বুঝিয়েছেন তিনি। সে ধীর পায়ে তাদের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। আর তখনই কানে এলো জাহানারা ইসলামের কথা, “তাড়াতাড়ি ওদের তালাকের ব্যবস্থা কর। জয়িতার বাবা এখনও জানে না, আহনাফের আগে বিয়ে হয়েছে। আহনাফ আর জয়িতার বিয়ে নিয়ে আমি উনাকে অনেক বোঝানোর পর রাজি করিয়েছি। আহনাফ অনার্স পাশ করলেই আক্দ করিয়ে দেবো। ততোদিনে ওরা একে অপরকে চিনুক, জানুক, ভালোবাসুক।”

কথাগুলো শুনে অরুণিকার ছোট্ট মনে ভীষণ আঘাত লাগলো। সে উঠে সোজা তূর্যের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেকেন্ড খানিক কিছু একটা ভেবে বেল চাপলো। ভাগ্যক্রমে তূর্যেই দরজা খুললো। অরুণিকা এদিক-ওদিক না ঘুরিয়ে সোজা চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “তূর্য, রক্ষিতা মানে কি?”

তূর্য চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “তুমি এই কথা কোথায় শুনেছো?”

অরুণিকা মনে মনে ভাবলো, “যদি খারাপ কিছু হয়? না, চাচী তো আমাকে নিয়ে ভালো কিছু বলবেন না। খারাপই হবে। তূর্যকে অন্য কিছু বলতে হবে।”

তূর্য আবার জিজ্ঞেস করতেই অরুণিকা বলল, “টিভিতে।”

“ছি! তুমি এসব কি দেখো টিভিতে?”

অরুণিকা মলিন মুখে বলল, “আর দেখবো না। খুব খারাপ কিছু কি? এটা কি গালি?”

“এতো বড় হয়েছো, ক্লাস টেনে উঠেছো আর জানো না এটার অর্থ?”

অরুণিকা মাথা নাড়লো। তূর্য অরুণিকার গাল টেনে দিয়ে বলল, “যেসব মেয়ের মধ্যে শয়তানি, ছেলেদের সাথে পেঁচাপেঁচি করে, আর ছেলেরা ওই মেয়েদের সাথে টাইম পাস করে ওইসব মেয়েদের রক্ষিতা বলে। ছেলেরা এসব মেয়েদের খেয়ে-দেয়ে ছেড়ে দেয়।”

অরুণিকার চোখ টলমল করে উঠলো এই কথা শুনে। সে দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে এলো। অনেকক্ষণ কাঁদলো সে। কাঁদতে কাঁদতে ঢেঁকুর উঠে গেল তার। আহনাফের রক্ষিতা সে? তার মানে আহনাফ তাকে ছেড়ে দেবে?

(***)

রাতে ছ’তলায় বেল বাজালো আহনাফ। অরুণিকা দরজা খুলতেই নিঃশব্দে ঢুকে পড়লো সে। অরুণিকার কান্নায় ফুলে থাকা মুখটা দেখেও কোনো প্রশ্ন করলো না। সোজা অরুণিকার ঘরে চলে গেল। অরুণিকাও পিছু পিছু গেল। এদিকে আহনাফ তার শার্ট খুলে হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অরুণিকা অভিমানী মুখে আহনাফের শার্ট হাতে নিয়ে একপাশে বসলো। বেশ কিছুক্ষণ আহনাফকে পরখ করে নাক ডুবালো তার শার্টে। আহনাফ চোখ বন্ধ করে রেখেছে। অরুণিকা ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি আমাকে খেয়ে-দেয়ে ছেড়ে দেবে?”

আহনাফ চমকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকার চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে হুট করে আহনাফের বুকের উপর উঠে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি ছাড়া কি আর কেউ আছে আমার? বাবা-মাও আমাকে ফেলে চলে গেছে। কেউ আমাকে ভালোবাসে না, আহনাফ। সবাই মনে করে আমি আবরারকে মেরেছি। কিন্তু তোমাকে তো সব বলেছি আমি। তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো। আমাকে অনেক ভালোবাসো। তুমি ছাড়া কেউই আমাকে ভালোবাসে না। এখন তুমিও যদি আমাকে ফেলে চলে যাও, আমার অনেক কষ্ট হবে।”

আহনাফ মুখে কিছু বললো না। সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। আলতো করে তার অধর ছুঁয়ে দিল। দু’জনই ডুবে গেল আবার সেই কোমল স্পর্শের অনুভূতিতে। আহনাফকে আজ নিয়ন্ত্রণ হারা মনে হচ্ছে। তার স্পর্শে একটু কাঠিন্যভাব। অরুণিকা ভয় পেল। একটু পরপর সরে যেতে লাগলো আহনাফের কাছ থেকে। এদিকে আহনাফ ধীরে ধীরে উগ্র হয়ে উঠছে। অরুণিকাকে আজ সে অন্যভাবে চাইছে। অরুণিকা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। সে আহনাফকে সরিয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো।

অরুণিকা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার উন্মুক্ত শরীরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফ। আহনাফের চাহনিতে বেশ লজ্জা পেল অরুণিকা। দ্রুত নিজেকে ঢেকে অন্য রুমে চলে গেল। বাকি রাত সেই রুমের মেঝেতে বসে কাটিয়েছে সে। তবে পরবর্তীতে আহনাফ ক্ষমা চেয়েছিল তার কাছে। অরুণিকাও ক্ষমা করে দিয়েছিল। এরপর আবার আগের ন্যায় স্বাভাবিক দিন কাটতে লাগলো তাদের।

(***)

সাল ২০১৮। জানুয়ারি মাস। আহনাফদের বাসায় আজ উৎসবের আমেজ। আমির চৌধুরী পেশায় ডাক্তার হলেও বাবা আর বড় ভাইয়ের মতো তিনিও নতুন ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন। আর ব্যবসায় বেশ লাভও হয়েছে তার। সেই উপলক্ষে আত্মীয় আর বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছেন তিনি।

অতিথিদের ভিড়ে চৌধুরী ম্যানশনের চারতলা মুখরিত আজ। কিন্তু আহনাফকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অরুণিকা অস্থির হয়ে তাকে খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে সে আহনাফের ঘরে উঁকি দিল। দেখলো আহনাফ বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে। অরুণিকা কাছে যেতেই আহনাফ চোখ খুললো। অরুণিকাকে দেখে সে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “ভীষণ মাথা ধরেছে। একটু মাথাটা টিপে দে।”

অরুণিকা উচ্চবাচ্য করলো না। সে বাধ্য বউয়ের মতো বসে পড়ল আহনাফের পাশে। ধীরে ধীরে কপালে আঙ্গুল চালালো। মুহূর্তেই ঘরের চিত্র পালটে গেল। আহনাফ হুট করে অরুণিকাকে কাছে টেনে নিলো। অরুণিকা শঙ্কিত কন্ঠে বলল, “আহনাফ, দরজা বন্ধ করি নি। কেউ চলে এলে?”

“আসলে আসুক। তুই তো আমার বউ। কি আর হবে!”

অরুণিকা মলিন মুখে বলল, “চাচীতো আমাকে পছন্দ করেনি না।”

“আমি করলেই হলো।”

এই বলে আহনাফ অরুণিকার অধর ছুঁয়ে দিল। অরুণিকা স্নিগ্ধ হাসি ফেরত দিল সেই স্পর্শে। তাগাদা দিল আহনাফকে। বলল, “চলো, সবাই তোমাকে দেখবে বলে বসে আছে। আর তুমি ওই সাদা শার্টটা পরে আসো। ওটাতে তোমাকে অনেক ভালো লাগে।”

অরুণিকার কথার কোনো উত্তর এলো না। আহনাফ ব্যস্ত অরুণিকার উন্মুক্ত বক্ষ ছুঁয়ে দেওয়ায়। আবারও সেই কাঠিন্য স্পর্শ। অরুণিকা সরে যেতে নেবে, আহনাফ খামচে ধরলো তার কোমল দেহ। এদিকে সেই স্পর্শে কুঁকড়ে উঠলো অরুণিকা। কাতর কন্ঠে বললো, “আহনাফ, প্লিজ।”

আহনাফ বাঁকা হেসে বলল, “তোকে আজ একটা সারপ্রাইজ দেবো। সারাজীবন মনে রাখবি সেই সারপ্রাইজ।”

অরুণিকার কাতর মুখখানা মুহূর্তেই আলোকিত হয়ে গেল। ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। হঠাৎই আহনাফ তার শার্টের বোতাম খুলে ফেললো। ধপ করে বালিশে মাথা রেখে অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে তাকে নিজের বুকের উপর টেনে নিল। অরুণিকার টপস কাঁধ বেয়ে নিচে নেমে গেল বেশ খানিকটা। বুকখানা উন্মুক্ত। এদিকে হুট করে আহনাফ অরুণিকাকে ছেড়ে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। অরুণিকা আহনাফের পরিবর্তন বুঝলো না। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। হঠাৎ চুলে টান অনুভব করলো অরুণিকা। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে। পেছনে শিরিন সুলতানাকে দেখে ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে সে। দ্রুত হাতে গায়ের কাপড় ঠিক করল সে। রুমে শিরিন সুলতানা ছাড়া মিসেস চৌধুরী ও মিসেস তাওসিফের আগমন ঘটেছিল। অরুণিকা তাদের দেখে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শিরিন সুলতানা সশব্দে চড় বসিয়ে দিলেন অরুণিকার গালে। অরুণিকা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার শিরিন সুলতানা আহনাফকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন। আহনাফ এমন ভান করলো যেন সে সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। তখনও অরুণিকা জানে না তার জন্য কি বিভৎস প্রত্যাখ্যান অপেক্ষা করছে। সে তো শিরিন সুলতানার বকুনির ভয়ে আড়ষ্ট। এদিকে শিরিন সুলতানা বাজখাঁই কন্ঠে চেঁচাচ্ছেন। আহনাফ উঠে বসে বলল, “এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন, মা? মাথা ব্যথা করছে আমার।”

মিসেস চৌধুরী শিরিন সুলতানার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “চেঁচামেচির কিছু হয় নি, বউমা। অরুণিকা ও আহনাফ এখনও বৈবাহিক সম্পর্কে আছে।”

“কিন্তু আমার ছেলে ওকে স্ত্রীর অধিকার দেয় নি। আর কখনো দেবেও না।”

অরুণিকা নিঃশব্দে অশ্রু ফেলছে। মিসেস তাওসিফ তা দেখে বললেন, “এভাবে চেঁচামেচি করো না, শিরিন। বাইরে অনেক অতিথি এসেছে। বিশ্রী একটা অবস্থা হবে।”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হয়েছে কি, বলবে?”

শিরিন সুলতানা বললেন, “মেয়েটা তোর ঘরে ঢুকে তোর সাথে, ছি! বলতেই লজ্জা করছে আমার।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “অরু, তুই আমার ঘরে এসেছিস কেন?”

অরুণিকা আহনাফের প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ শিরিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আমি তো কিছুই জানি না। তোমার চিৎকারেই আমার ঘুম ভাঙলো।”

অরুণিকা এখনও বিষ্ময় নিয়ে আহনাফকে দেখছে। শিরিন সুলতানা আহনাফের কথা শুনে অরুণিকার চুল ধরে তাকে রুম থেকে বের করে আনলেন। অতিথিদের সামনে এভাবে টেনে-হিঁচড়ে আনায় বেশ অপমানিত হলো অরুণিকা। সে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু যেতে যেতেই শুনে গেল তার গায়ে লাগা অপবাদ।

“ওই নষ্টা, বদমাশ, চরিত্রহীন মেয়েটা আমার ছেলের রুমে ঢুকে ওকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে, যাতে সারাজীবন এই বাড়িতেই থাকতে পারে।”

শিরিন সুলতানার কথাগুলো তীরের মতো বিঁধেছে অরুণিকার ছোট্ট হৃদয়ে। সে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়েই হুমড়ি খেয়ে দু’বার পড়লো। অনেক কষ্টে ছ’তলায় উঠে দরজা আঁটকে দিলো। অনেকক্ষণ কাঁদলো সে। মাথাটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। আহনাফ কেন বললো, সে ঘুমাচ্ছে, এই প্রশ্নই বারংবার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছিল তার।

রাতে মিসেস তাওসিফ অরুণিকাকে ডেকে নিয়ে গেলেন চার তলায়। বসার ঘরে চৌধুরী পরিবার গোল হয়ে বসে আছে। অরুণিকাকে দেখেই মিসেস চৌধুরী কঠোর সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “আহনাফের রুমে কেন গিয়েছিলে?”

অরুণিকা মাথা নিচু করে বলল, “ওকে ডাকতে গিয়েছিলাম।”

“তোমাকে কে বলেছে ওকে ডাকতে? আর তুমি এমন বিশ্রি একটা কাজ কেন করলে? মানছি তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু আহনাফ তো আর সম্পর্কটা রাখতে চায় না।”

অরুণিকার হাত পা শিউরে উঠলো এই কথা শুনে। গলা শুকিয়ে গেল মুহূর্তেই। আহনাফের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সে। দেখলো আহনাফের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। অরুণিকার নিরুত্তরে আবার প্রশ্নের ঝড় উঠলো। অরুণিকা সাদা মনে উত্তর দিল। বলতে লাগলো, “আহনাফই তো আমার কাছে আসতে চেয়েছে, আমি তো শুধু ডাকতে গিয়েছি। আহনাফ তো প্রতিদিন রাতে আমার ঘরে আসে। ও নিজেই বলেছে, ও আমাকে ভালোবাসে। ওতো আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়। জিজ্ঞেস করো আহনাফকে।”

অরুণিকা আশা নিয়ে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, “মিথ্যে কথারও একটা লিমিট আছে, অরু। আমি তোকে ভালোবাসতাম, এটা ঠিক। কিন্তু আমার ভাইকে মারার পর থেকে তোর প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া কাজ করে না আমার। তোর বাবা-মা নেই, তাই তোকে বাসায় রেখেছি। আর তুই যে আমার উপর আঙ্গুল তুলবি, সেটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি রাতে তোর ঘরে যাই, এমন বিশ্রী কথা কীভাবে বলিস তুই? তাও আবার বড়দের সামনে! লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ফেলেছে এই মেয়ে।”

অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে তার বাহু খামচে ধরে ভয়ার্ত সুরে বলল, “আহনাফ, মিথ্যে বলছো কেন? সবাই আমাকে ভুল বুঝবে। সত্যটা বলে দাও, না প্লিজ।”

আহনাফ এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো অরুণিকার হাত। শিরিন সুলতানা অরুণিকার চুল টেনে ধরে মাটিতে বসিয়ে দিলেন। বললেন, “এইটুকুন মেয়ে, এতো নোংরা মানসিকতার?”

অরুণিকা এক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। শিরিন সুলতানা বেশ কয়েকবার চড় মারলেন। কিন্তু সে পাথর হয়ে গেছে। এদিকে আহনাফের কথায় সবাই বিশ্বাস করেছে। কারণ খুব চমৎকারভাবে নিজের মিথ্যেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল সে। উলটো অরুণিকার উপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আহনাফ,
“এতো ছোট বয়সে এসব নষ্টামি কীভাবে শিখলি, অরু? আমি তো তোর সাথে থাকবো না। তোর সাথে সংসার করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। এখন তোকে ছাড়ছি না কারণ তুই ছোট। তোর বয়স হলেই, তুই নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার মতো বড় হতে পারলেই, আমি তোকে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু তুই তো!”

অরুণিকা এখনো নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। এদিকে আমির চৌধুরী অরুণিকার উপর বেশ ক্ষীপ্ত। তিনি অরুণিকার হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিলেন। আহনাফই তাকে সেই বুদ্ধি দিয়েছে। আহনাফ নিজেই অরুণিকার ফোনে নোংরা কিছু ওয়েবসাইট চালু করে রেখেছিল, যা আমির চৌধুরী ফোন ঘেঁটে বের করে ফেললেন। সবাই ভাবলো, এসব অরুণিকার কাজ। অরুণিকা সবার চোখে বিগড়ে যাওয়া, নোংরা মানসিকতার মেয়ে উপাধি পেল। তূর্যও বাকি পাঁচ জনকে বলল, কিছুদিন আগে রক্ষিতা কি জিজ্ঞেস করার কথাটি। তারা ভাবলো, অরুণিকা এসব নোংরা ভিডিও দেখেই এমন প্রশ্ন করেছে।

অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে সবার অপবাদ শুনছে। ষোলো বছর বয়সে প্রথম নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে তার। অশ্রু শুকিয়ে গেছে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হঠাৎ শিরিন সুলতানা বললেন, “এই বাড়িতে সব ছেলে। আর এই মেয়ের চিন্তা-ভাবনা নোংরা। এ বাড়িতে থাকলে সব ছেলেদের চরিত্র নষ্ট করবে এই নষ্টা মেয়ে। একে বাড়ি থেকে বের করে দাও। ওর মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই ভালো হবে। ওখানে কোনো ছেলে নেই। ওর একটা মাত্র মামাতো বোন আছে।”

শিরিন সুলতানার কথায় বাকিরা সায় দিলো। সবার সায় দেওয়া মুখখানা চোখ তুলে একনজর দেখে নিলো অরুণিকা। আরাফ, তাহমিদ, তূর্য, ইভান ও ইমন এই পাঁচটা মানুষ নির্জীব দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তাদের চোখে নিজের প্রতি ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে অরুণিকা। সে চোখ সরিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। এই মানুষটাকে কীভাবে এতো আপন ভাবলো সে? এতো বড় ধোঁকা কীভাবে খেলো সে? মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে! এখনই ঘুম ভেঙে যাক। অরুণিকার শীতল দৃষ্টি আহনাফকে বেশ অস্থির করে তুললো। চোখ সরিয়ে নিলো সে। চোখাচোখি হওয়ার সাহস হলো না আর।

পরদিন অরুণিকার মামা শাহবাজ খানকে ফোন করলেন আমির চৌধুরী। শাহবাজ খানের সাথে চৌধুরী পরিবারের ভালো সম্পর্ক নেই। তবুও তারা বাধ্য হয়েই যোগাযোগ করলো। শাহবাজ খান দেশের বাইরে থাকেন। তাই এতো সহজে তিনি অরুণিকাকে আনতে পারলেন না। আতকিয়া জাহানকে কোনোভাবেই রাজি করানো যাচ্ছিলো না। এদিকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন আমির চৌধুরী। যদিও অরুণিকার দায়িত্ব নিতে শাহবাজ খানের কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু স্ত্রীকে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারছিলেন না তিনি। আতকিয়া জাহানের এক কথা, তিনি বাড়তি মানুষ চান না সংসারে।

ভয়ংকর লাঞ্ছনার সাথে এক সপ্তাহ কাটলো অরুণিকার। ছ’তলায় রুম বন্ধ করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো সে। কেউ তার খোঁজ নিতে আসতো না। নিজের হাতে রান্না করতে পারে না সে। তাই বাধ্য হয়ে ক্ষুধা লাগলে দরজা খুলতো। চারতলায় যাওয়ার কোনো সাহস তার নেই। অষ্টম তলায় গেলে মিসেস চৌধুরী বেশ বিরক্ত হতেন। দ্বিতীয় তলায় একবার গিয়েছিল, আরাফকে অরুণিকার সাথে কথা বলতে দেখে আরেফিন চৌধুরী বেশ রেগে গিয়েছিলেন। অরুণিকা পানি খেয়েই কাটালো দু’দিন। ক্ষিধে লাগলেও আর কাউকে বলার সাহস পেলো না। তৃতীয় দিন পুরো ঘরে পাগলের মতো টাকা খুঁজতে লাগলো। অন্তত কিছু টাকা পেলে নিজে গিয়ে দোকান থেকে কিছু কিনে আনবে। অনেক খুঁজে যা টাকা পেলো তাতে পাউরুটি কিনে আনলো সে৷ শুকনো পাউরুটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেলো। দু’দিনে পাউরুটির প্যাকেট শেষ করলো। ভয় হলো যদি শেষ হয়ে যায়, পরদিন কি খাবে? কেউ কি তাকে খেতে দেবে? পঞ্চম দিন না খেয়েই কাটালো। ষষ্ঠ দিন আবার গেল অষ্টম তলায়। মিসেস চৌধুরীর মায়া হলো অরুণিকার শুকনো মুখ দেখে৷ কিন্তু বড় চৌধুরী সাহেব হুংকার দিলেন। বললেন, “আরেকবার এলে খুন করে ফেলবেন।”

ভয়ে আর গেল না অরুণিকা। ছাদে উঠে বসে রইলো। ছাদে বাগান করেছে ইভান। কাঁচা টমেটো ধরেছে গাছে। অরুণিকা সাহস করে দু’টো ছিঁড়ে নিচে নেমে এলো। বাসায় ওটাই খেলো। গ্যাস্ট্রিক হয়ে গেছে তার। ক্ষিধায় বুকে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। সে কি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছিল? কেউ একটু খাবারও দিয়ে গেল না?

ক্ষিধে সহ্য করতে না পেরে আবার দ্বিতীয় তলায় গেল সে৷ আরেফিন চৌধুরী দরজা খুলতেই অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “অনেক ক্ষিধে পেয়েছে। একটুও খাবার নেই।”

তিনি অরুণিকাকে বাসায় ঢুকতে দিলেন না। দারোয়ানের দিয়ে খাবার পাঠালেন ছ’তলায়। এই এক সপ্তাহ অরুণিকার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গিয়েছিল, তা অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ছিল। শেষমেশ এক সপ্তাহ পর আমির চৌধুরী বাধ্য হয়ে নিজেই অরুণিকাকে তার মামার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ঘরের দরজা পর্যন্তও গেলেন না। অরুণিকা একাই রুহানিকে ফোন করে ফ্ল্যাট খুঁজে সেই বাসায় ঢুকেছিল। ঢুকতেও মামীর লাঞ্ছনা কম শুনে নি। মামী তো বেশ জোর গলায় বলছিলেন, “নষ্টামি করেছে বলেই তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন এসেছে আমার মেয়েকে নষ্টামি শেখাতে।”

তবে শাহবাজ খান অরুণিকার সাথে একটুও বাজে আচরণ করেন নি। তিনি ছুটি নিয়ে দেশে এসে অরুণিকাকে সব গুছিয়ে দিলেন। তাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করালেন। তার যা যা প্রয়োজন সব কিনে দিলেন। তার বোনের একমাত্র মেয়েকে তিনি অবহেলা করতে চান না। তার মতে অরুণিকা যা করেছে, তার কাছে সেটা বয়সের দোষ। এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা খারাপ ফাঁদে আঁটকা পড়ে। হয়তো সেই বাড়িতে অরুণিকা ভালো শিক্ষা পাচ্ছে না, তাই তার এই পরিণতি!

মামার মন্তব্য শুনে অরুণিকা বেশ লজ্জা পেলো। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,”আমি এমন কাজ করে নি।”

কিন্তু কেউই তার কথা শুনলো না। সবার ধারণা, এমন অপরাধ করে কি কেউ স্বীকার করতে চায়? নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা তো করবেই। এরপর অরুণিকা বুঝে গেল, শত চেষ্টা করেও সে কারো মন থেকে এই মিথ্যে অপবাদটি মুছে ফেলতে পারবে না। তাই সে নতুন করে জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলো। রুহানির সাথে ক্লাস টেনে ভর্তি হলো। আর সেখান থেকেই রুদবার সাথে তার বন্ধুত্ব। অন্যদিকে মিসেস চৌধুরী বছর না ঘুরতেই সব ভুলে গেলেন। ছেলেদের বললেন, “মেয়েটা ছোট ছিল। আবেগে ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু যা করেছে আহনাফের সাথে করেছে। আহনাফ তো আর বাইরের কেউ না। ওর নিজের বর।”

তিনি প্রায়ই অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনার কথা উঠাতেন। কিন্তু কেউই তার এই সিদ্ধান্তে সাড়া দিতো না। অন্যদিকে অরুণিকাকে তাড়াতে পেরে শিরিন সুলতানা আর জাহানারা ইসলাম মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট।

আহনাফ যখন থেকেই শিরিন সুলতানাকে সন্দেহ করা শুরু করলো, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন শীঘ্রই আহনাফ আর অরুণিকার সম্পর্ক ভাঙতে হবে। তিনি ছেলেকে অরুণিকার বিরুদ্ধে অনেক বোঝালেন। আহনাফ বুঝলো না। শীতল সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল মা-ছেলের। তিনি খেয়াল করলেন আহনাফ অরুণিকার প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল। শিরিন সুলতানার সহ্য হলো না এসব। তিনি আহনাফের উপর কালো জাদু প্রয়োগ করলেন। এতে হিতে বিপরীত হলো। আহনাফ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। অরুণিকা আহনাফের খেয়াল রাখতে গিয়ে তাদের নৈকট্য আরো গাঢ় হলো। শিরিন সুলতানার ব্যাপার খানা একদমই হজম হচ্ছিল না৷ একদিন সন্ধ্যায় তিনি আহনাফের কাছে এসে বসলেন। আর বললেন, “তোর তো ভীষণ খারাপ অবস্থা। এতো ডাক্তার দেখানো হলো, কিন্তু কোনো রোগই ধরতে পারছে না তারা।”

আহনাফ বিরক্ত মুখে বলল, “তুমি যাও এখান থেকে। অরুকে পাঠাও।”

শিরিন একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। বললেন, “আমি আমার এক বান্ধবীর ছেলের সাথে দেখা করেছি। সেই ছেলে বেশ ভালো ডাক্তার৷ তোর ব্যাপারে সব বলার পর সে বলল, এসব মানসিক চাপের জন্য হচ্ছে। এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা না-কি মানসিক শান্তি পেলেই আসবে। তোর মন বেশ অস্থির হয়ে আছে, আমি জানি। বাবা, একটাবার আমার আনা ওষুধগুলো খেয়ে দেখ। ভালো না লাগলে বন্ধ করে দিস। তোর কাছে আমার শেষ অনুরোধ। তোর আর অরুর জীবন থেকে সরে যাবো আমি। তুই চিন্তা করিস না।”

মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারলো না আহনাফ। সে ওষুধগুলো খেল। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে সুস্থ হয়ে উঠলো। আর ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়লো সেই ওষুধে। এরপর থেকেই শিরিন সুলতানার উপর অন্ধ বিশ্বাসও জন্মালো আহনাফের। সে মায়ের কথামতো ওঠাবসা করতে লাগলো। বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা ভুলে গেল। সব সিদ্ধান্তেই তাকে নির্ভর হতে হয় শিরিন সুলতানার উপর। যার পরিণতি আজ আহনাফ ও অরুণিকার সম্পর্কে সৃষ্টি হওয়া কঠিন দেয়াল।

শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে অতীতের সেই বিদঘুটে মুহূর্তটি ভাবছিল অরুণিকা। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ মুছে নিলো দ্রুত। রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কাঁদছিস?”

অরুণিকা রুহানির হাত ধরে বলল, “আমি কেন এদের সাথে কথা বলছি, রুহু? এরা আমার সাথে যে অন্যায় করেছে, আহনাফ আমার সাথে যা করেছিল, এরপর আমার এদের সাথে সম্পর্কই রাখা উচিত না।”

“আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না, অরু।”

“কিন্তু এতো সহজে আহনাফকে কীভাবে ক্ষমা করবো আমি? আমি যেই আঘাত পেয়েছি, তার শাস্তি এতো কম কেন হবে? ওতো কোনো শাস্তিই পায় নি। আহনাফ না-কি সব সত্য স্বীকার করেছে। সবাই এখন জানে সেদিন আহনাফ আমাকে ফাঁসিয়েছিল। অথচ মানুষটা বাড়ি ছাড়া হলো না। দাদা-দাদির সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট হলো না৷ এক বেলা ভাত কি কম খেয়েছে? কিন্তু পাঁচ বছর আগে আমার সাথে এরা কি করেছিল!”

অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ভেজা কন্ঠে বলল, “যতোবারই সেই অতীত মনে পড়ে, চৌধুরী সাহেব ও তার বংশের প্রতিটি জীবের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। আমি আহনাফকে ক্ষমা করতে পারবো না, রুহু। সে আমার হৃদয় ক্ষত করে দিয়েছে। আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমি ওকে কখনো ক্ষমা করবো না। আমি ওকে ঠিক সেভাবেই শাস্তি দেবো, যেভাবে ও আমাকে দিয়েছিল।”

এবার অরুণিকার চোখ-মুখ শক্ত হলো। সে মনে মনে ভাবলো, “পাঁচ বছর আগে তুমি আমাকে চরিত্রহীনা বানিয়েছিলে, এখন আমি তোমাকে সেই একই দিন দেখাবো। তোমাকে সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে হবে, আহনাফ। তোমাকে সেই একই যন্ত্রণা অনুভব করতে হবে। যেদিন তুমি আমার যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাবে, সেদিনই আমার মনে লাগা ক্ষত শোকাবে। আর যা হবে, এই বাড়িতেই হবে। অভিনয় সেদিন তুমি করেছিলে, এখন আমি করবো। অনেক মানুষের সামনে আমার নামে অপবাদ দিয়েছিলে তুমি, এই গ্রাম তোমাকে ঠিক একই অপবাদে চিনবে। সরি, আহনাফ। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই নি। কিন্তু আমার মন মুক্ত হবে তোমার দেওয়া আঘাতের শোধ নিতে পারলেই।”

চলবে-

~ অতীত শেষ। এখন শুধু বর্তমান চলবে।

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৮||

কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে দু’তলার বারান্দায় বসে আছে অরুণিকা। হঠাৎ তার মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। তড়িৎ গতিতে চোখ খুললো সে। সামনে তাকিয়ে দেখল আহনাফ তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এখানে?”

আহনাফ একটা প্যাকেট অরুণিকার কোলের উপর রেখে বলল, “তোমার জন্য।”

অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো প্যাকেটটির দিকে। আহনাফ আলতো করে স্পর্শ করলো অরুণিকার পা। অরুণিকা কিছু বলার আগে আহনাফ সেই পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, অরু। আমি কাল সারারাত সেই দিনগুলো নিয়ে ভেবেছি, যেই দিনগুলোতে আমার কারণে তুই কষ্ট পেয়েছিলি। ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি আমি। কিন্তু বিশ্বাস কর, জানি না আমার কি হয়েছিল! আমি তোকে আঘাত করতে চাই নি। বরং তোকে আঘাত করে আমি নিজেই অনেক কষ্ট পেয়েছি।”

আহনাফের গলা কাঁপছে। হাতও কাঁপছে অনর্থক। অরুণিকা শক্ত করে সেই হাত ধরলো। মৃদু হেসে বলল, “ইটস ওকে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।”

এই বলে অরুণিকা প্যাকেট খুলে দেখলো একটা নীল শাড়ি। আহনাফ বলল, “তোকে নীল শাড়িতে খুব সুন্দর লাগে। আজ তুই এটা পরে আমার সাথে দিঘির পাড়ে যাবি।”

অরুণিকা আঁড়চোখে তাকালো আহনাফের দিকে। মনে মনে ভাবলো, “খেতে দিলে বসতে চায়, বসতে দিলে শুতে চায়, এই একটাই স্বভাব এই মা-ছেলের। ইচ্ছে তো করছে, দুইটাকে দিঘির জলে চুবনি দিয়ে আনতে।”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল, “পছন্দ হয় নি?”

অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “কেন হবে না? সুন্দর তো। দাঁড়াও, আমি পরে আসি। এক্ষুনি যাবো না হয়।”

অরুণিকা নিচে নেমে এলো। আহনাফও তার পিছু পিছু এলো। সে নিজের রুমে ঢুকতে যাবে ওমনি আহনাফ তার হাত ধরে বলল, “আমার ঘরে চল না!”

অরুণিকা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না। আহনাফের সাথে তার ঘরে গেল। রুমে ঢুকেই আহনাফ দরজা আটকে দিল। অরুণিকা বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “দরজা আটকালে কেন?”

“কেউ চলে এলে!”

অরুণিকার গা জ্বলে উঠলো কথাটি শুনে। সে নিজের রাগ সংযত করে শাড়িটা খুললো। আহনাফ বলল, “সব তোর মাপে সেলাই করিয়েছি।”

অরুণিকা জোরপূর্বক হাসলো। আহনাফ আবার বলল, “কেমন শাড়িটা!”

“সুন্দর।”

অরুণিকা শাড়ির নিচের পোশাক পরিধান করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। আহনাফ এখনো বসে আছে বিছানায়। অরুণিকা শাড়িটা বুকের উপর জড়িয়ে রেখে বলল, “তুমি না গেলে, আমি কীভাবে শাড়ি পরবো?”

“আমার সামনে পরতে পারবি না? আমি তো তোর বর।”

অরুণিকা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে খুব বিরক্ত হয়ে উল্টোদিকে ফিরে শাড়িটা পরতে লাগলো। আহনাফ হঠাৎ তাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল, “আমি হ্যাল্প করি?”

অরুণিকা আহনাফের দিকে ফিরে শাড়িটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নিজেই পরে ফেলো।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা হালকা হেসে বলল, “মজা করছি। পরিয়ে দাও।”

আহনাফ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে অরুণিকাকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। খুব আগ্রহ নিয়ে আহনাফ তাকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। অরুণিকা তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। খুব শান্ত আর মায়া জড়ানো এই মুখখানা দেখে অরুণিকা ভাবছে, “এই ছেলেকে দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না, তার ভেতর একটা নরপিশাচের বাস।”

আহনাফ শাড়ি পরিয়ে দিয়ে অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে আহনাফের বেশ শান্তি লাগছে। অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে দিতে যাবে, তখনই আহনাফ আরো শক্ত করে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল, “অরু, আমি কেমন পাষাণ! তাই না? তোর হাসিটা আমার কারণে হারিয়ে গেছে। তুই আগে অনেক হাসতি। ইদানিং তুই কেমন অদ্ভুতভাবে হাসিস। আচ্ছা, তুই বল, আমি কী করলে তোর হাসি আবার ফিরে আসবে?”

“তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে। তুমি একবার যদি আমাকে বিশ্বাস করতে পারতে, তাহলে আমাদের সম্পর্কটা এতো বাজে পর্যায়ে আসতো না।”

“আমি তোকে বিশ্বাস করি।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি কি তাহলে বিশ্বাস করো, আমি আবরারকে ধাক্কা দেই নি?”

আহনাফ চুপ করে রইলো। অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বিশ্বাস না করো, অন্তত আমার কথাটা তো একটু শুনবে!”

“বল, আমি শুনছি।”

“তোমার মা’কে দেখেছিলাম সেদিন ছাদে। সেই আবরারকে রেলিঙে উঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কেন? তার উদ্দেশ্য কি? আমি এসবের কিছুই জানি না। চাচী আমাকে ইচ্ছে করে ফাঁসায় নি। আমি ওখানে চলে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে ফেলেছি বিধায়, আমাকে উনি ফাঁসাতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাট ইটস ট্রু, আহনাফ। তুমিই বলো, আবরারকে মেরে আমার কি লাভ হতো? অসুস্থ একটা বাচ্চা ছেলে! ওর সাথে আমার কোনো শত্রুতা ছিল না। তাহলে ওকে আমি কেন মারবো শুধু শুধু? তবে চাচীর সাথে আবরারের অন্য কোনো সম্পর্ক আছে। তুমি একটু ঘাঁটলেই সত্যটা বের করতে পারবে। চাচ্চুর কেইস তুলে ফেলা উচিত হয় নি। কেইস না তুললে আজ সত্যটা বের হয়ে আসতো৷ আমি তখন ছোট ছিলাম, পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যেতেই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিই আমার বুদ্ধি থাকলে আমিই তাদের বলতাম, ইনভেস্টিগেট করে তারপর যাতে আমাকে ছাড়ে। এই অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভয়ংকর।”

আহনাফ অরুণিকাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তুই বলছিস মা মেরেছে আবরারকে?”

“হ্যাঁ।”

“মা হয়ে ছেলেকে কেন মারবে বল?”

“কেন মারবে এর উত্তর খোঁজা খুব জরুরি। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।”

আহনাফ বিছানায় বসে পড়লো। পাশ থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলল, “আমি মা’কে অনেক ভালোবাসি, অরু। এমন কিছু করলে আমার দুনিয়াটা উল্টে যাবে।”

“তুমি সত্য বের না করলে আমার সাথে সংসার করতে পারবে না। তোমারই কষ্ট হবে। এমনও তো হতে পারে, আবরার তোমার ভাই না। ওকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। বা অন্য কিছু।”

“না, তখন আমার বুদ্ধি হয়েছিল। আবরার আমার ভাই। আমি মায়ের সাথে হসপিটালে গিয়েছিলাম। ওকে দত্তক নেওয়া হয় নি।”

আহনাফ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। ঘামাচ্ছে তার হাত-পা। চোখ দু’টি লাল হয়ে গেছে। অরুণিকা আহনাফের পাশে বসে তাকে শান্ত করে বলল, “ইটস ওকে। আর ভেবো না এসব। আর তুমি এতো হাইপার হয়ে যাচ্ছো কেন? তোমার কি হাই ব্লাড প্রেশার আছে?”

আহনাফ কাঁপা গলায় বলল, “না তো! আমি ঠিক আছি।”

“এভাবে ঘামাচ্ছো কেন? তুমি খুব অল্পতেই অস্থির হয়ে যাও।”

আহনাফ জোরপূর্বক হাসলো। বলল, “না আমি ঠিক আছি।”

অরুণিকা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আহনাফের কপালের ঘাম মুছে দিল। রেগুলেটর ঘুরিয়ে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিল। আহনাফ কাঁপা হাতে অরুণিকাকে টেনে নিজের পাশে বসালো। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার ঘুম আসছে খুব। আমাকে জড়িয়ে ধরবি, প্লিজ।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আহনাফের দিকে। অদ্ভুত আচরণ করছে আহনাফ। সে দ্রুত আহনাফের মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার প্রেশার মাপতে হবে? এই আহনাফ? উঠো! এমন ভূতের মতো আচরণ করবে না, প্লিজ।”

অরুণিকা আহনাফকে ছেড়ে দ্রুত রুম থেকে বের হতেই আরাফের মুখোমুখি হলো। আরাফ অরুণিকাকে আপাদমস্তক দেখে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

অরুণিকা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “আহনাফ অদ্ভুত আচরণ করছে। মনে হচ্ছে খুব অসুস্থ।”

আরাফ দ্রুত রুমে ঢুকলো। দেখলো আহনাফ মাথা হেলিয়ে দিয়ে বিছানায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। আরাফ আহনাফের মাথার নিচে বালিশ দিয়ে তার বুকে মালিশ কর‍তে লাগলো। আর অরুণিকা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহনাফের অস্থির ঘর্মাক্ত মুখের দিকে।

(***)

গম্ভীরমুখে বসে আছেন বড় চৌধুরী সাহেব। তার পাশে বসে আছে তার দুই ছেলে। শিরিন সুলতানা চিন্তায় হাঁসফাঁস করছেন। ডক্টর সুমিত সেন বেরিয়ে এলেন আহনাফের রুম থেকে। চৌধুরী সাহেবের বন্ধুর ছেলে তিনি। রাজা গ্রামেই তার বাড়ি৷ সপ্তাহে দু’দিন গ্রামের চেম্বারে বসেন। আহনাফের বুকে অসহ্য ব্যথা হওয়ায় তাকে ডেকে আনতে গিয়েছিল আরাফ। সুমিত সেন একজন কার্ডিওলজিস্ট। আরাফ ভেবেছে তিনি হয়তো আহনাফকে দেখলে ভালোভাবে বুঝবেন। আরাফ যা ভেবেছিল তাই হলো। সুমিত সেন বড় চৌধুরী সাহেবের সামনে বসে বললেন, “আহনাফের হাই ব্লাড প্রেশার।”

আমির চৌধুরী চিন্তিত কন্ঠে বললেন, “হ্যাঁ, তাতো প্রেশার মেপেই বুঝেছিলাম। কিন্তু সুমিত, এই অল্প বয়সে আমার ছেলেটার এই অবস্থা!”

শিরিন সুলতানা চাপা স্বরে বললেন, “ওই মেয়েটাকে আমার ছেলের জীবন থেকে বের করতে পারলেই সব ঠিক হবে। ওই মেয়েটাই আমার ছেলের প্রেশার বাড়াচ্ছে।”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে শিরিন সুলতানার দিকে তাকালো। সুমিত সেন বললেন, “বয়স তো অল্প। তবুও আমি এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না। আজই যদি ইসিজি ও ইকো করানো যায় বেশ ভালো হতো।”

আমির চৌধুরী বললেন, “এখানে তো ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থাও নেই। এখন তো আবার শহরে ফিরতে হবে।”

“আমাদের দেওয়া হাসপাতালটি এখন অনেক উন্নত হয়েছে। ওখানে ইসিজি আর ইকোর ব্যবস্থা আছে। তুমি চাইলে আহনাফকে ওখানে নিয়ে যাও। আমি না হয় থাকবো আজ।”

অরুণিকা এতোক্ষণ এক পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারের কথা শুনে সে এবার বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ালো। মিনিট খানিক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো সে। রুহানির উপস্থিতি পেয়ে অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “একটা অমানুষের জন্য কি আমার কষ্ট পাওয়া উচিত?”

“এভাবে কেন বলছিস, অরু?”

অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বিশ্বাস হচ্ছে না আহনাফকে আমার। মনে হচ্ছে এটাও ওর অভিনয়। হয়তো অতীতের কথা তুলেছি, তাই সেটা কাটানোর জন্য ভান ধরেছিল। ওর চোখের সামনে সত্য, অথচ ও দেখছে না। কেমন উদ্ভট ছেলে!”

বিকেলে আহনাফকে টেস্ট করিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলেন আমির চৌধুরী। বাড়িতে ঢুকতেই তিনি শিরিন সুলতানাকে রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ছেলে সিগারেট খায়, সেটা কি তুমি জানতে?”

শিরিন সুলতানা ভীত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাহমিদ বলল, “হ্যাঁ, ওতো অনেক বছর ধরে সিগারেট খাচ্ছে।”

শিরিন সুলতানা বললেন, “ছেলে কি আমাদের সাথে থাকে? ওতো ব্যাচেলর থাকছে। ওখানে কি করে, না করে আমি কীভাবে জানবো?”

আমির চৌধুরী তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা ওকে নিষেধ করো নি?”

“ও আমাদের কথা শুনে না। ও নিজের মতোই চলে। রুম বন্ধ করে রাখে। আমার মনে হয় ওর ফুল বডি চেকাপ করানো উচিত।”

শিরিন সুলতানা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “ফুল বডি কেন চেকাপ করাবে? আমার ছেলে কি অসুস্থ না-কি! বয়স বাড়লে ছেলেদের এমনিতেই ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। আর আমার ছেলের মাথায় কতো চিন্তা! ওই ষ্টুপিড মেয়েটাই এর জন্য দায়ী।”

আমির চৌধুরী গম্ভীরমুখে বললেন, “অরুকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো। তোমার ছেলে নিজেই স্বীকার করেছে, আসল ষ্টুপিড কে ছিল।”

এই বলে আমির চৌধুরী নিজের ঘরে চলে গেলেন। আর শিরিন সুলতানার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। তিনি মনে মনে ভাবছেন, “ড্রাগসগুলো কি আহনাফের বেশি ক্ষতি করে ফেলছে? কিন্তু আমি তো নিরুপায়। একবার ওদের ডিভোর্স হয়ে গেলেই আমি আহনাফকে রিহাবে পাঠিয়ে সুস্থ করে আনবো। ওই মেয়েটাকে ছাড়ার নামই নিচ্ছে না আহনাফ। বেশি দেরী করা যাবে না। শীঘ্রই ওদের আলাদা করতে হবে। আহনাফ হয়তো ড্রাগস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এজন্যই মেয়েটার ভূত মাথায় উঠেছে। ওই ভূত নামানোর জন্য এবার আরো পাওয়ারফুল ওষুধ দিতে হবে ওকে।”

(***)

তূর্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আরাফ ও তাহমিদের দিকে। তাহমিদ বলল, “তুই আহনাফকে বোঝাতে পারবি। তুই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ও তোর কথা শুনে।”

তূর্য কপাল চেপে ধরে বসে আছে। আরাফ বলল, “দেখ তূর্য, আগে আমাদের ড্রাগসগুলো খুঁজে বের করতে হবে। তারপর ওকে প্রশ্ন করতে পারবো। ওকে রিয়েলাইজ করাতে হবে, ও এডিক্টেট। ওর এক্সিডেন্টের পর এন্টিবায়োটিকের সাথে আমি আরেকটা ওষুধ দিচ্ছি। এটা ওর জন্য ভালো না। কিন্তু ওই মেডিসিন না নিলে ও এগ্রেসিভ হয়ে যাবে। এই তিনদিনে ও একদমই ড্রাগস নেয় নি। তবুও ও এগ্রেসিভ হচ্ছে না। যারা এডিক্টেট, তাদের এতো সহজে ওখান থেকে বের করে আনা যায় না। আমি যেই মেডিসিন দিচ্ছি, এটা ওর কিডনির জন্য হার্মফুল। আমি এভাবে ওকে মেডিসিনটা দিতে পারবো না। তাই তাড়াতাড়ি ওই ড্রাগসগুলো খুঁজে বের কর। তারপরই আহনাফকে প্রশ্ন করা যাবে। আর এরপরই ওর ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করবো।”

তূর্য ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “এটা আন্টি করেছেন?”

“হ্যাঁ।”

অরুণিকার সেদিন রিক্সায় বলা কথাগুলো এবার তূর্যের কাছে সত্য মনে হতে লাগলো। তূর্য তাহমিদ ও আরাফকেও সেই কথা জানালো। তাহমিদ বলল, “এই ব্যাপারে তো মাও বলেছিল। আবরারের মৃত্যুর সাথে চাচির কোনো না কোনো কানেকশন আছে।”

আরাফ বলল, “হয়তো এটাই সত্য। অরু কখনো ভুল ছিল না। ও সব সময় সত্য কথায় বলেছিল। শুধু আমরা ওকে বিশ্বাস করি নি।”

“আবরারের কেইসটা রিওপেন করা উচিত।”

তূর্য বলল, “সম্ভব না। পোস্টমর্টেমই করতে দেয় নি ওরা। ওর হাড্ডিও হয়তো মাটির সাথে মিশে গেছে এতোদিনে।”

“যা করার আমাদেরই করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ চেক কর‍তে হবে।”

“পাঁচ বছর আগের ফুটেজ এখনো থাকবে?”

“ফ্ল্যাটের অফিস রুমের কম্পিউটারে থাকতে পারে। চাচি এখন এখানে। তূর্য, তুই কালই চলে যা। তোর অনেক কাজ। আগে আহনাফের রুমের তালা ভেঙে ওখানে কি কি আছে সব দেখবি। তারপর ফুটেজ খুঁজে বের করবি। ইভান আর ইমনকে গিয়ে সব বলিস। তোরা একসাথে ওদিকটা সামলা। আমরা এদিকে আহনাফকে দেখে রাখবো।”

(***)

সন্ধ্যায় পুকুর ঘাটে এসে বসলো অরুণিকা। স্থির জলে দখল করে নেওয়া সোনালি আভা হারিয়ে যাচ্ছে ধূসর আলোয়। কচুরিপানার মাথায় এসে বসেছে একটা ফড়িং। অরুণিকার দৃষ্টি সেই ফড়িংয়ের দিকে। মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে তার চুলগুলো এসে পড়ছে চোখের উপর। ফড়িং ও একটি মায়াবতী, আহনাফ টুক করে একটা ছবি তুলে নিলো। ফ্ল্যাশ পড়তেই অরুণিকা পাশ ফিরে তাকালো। আহনাফ নীরবে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। অরুণিকা বলল, “তোমার এখন ভালো লাগছে?”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“তোমার তো হাই ব্লাড প্রেশার। মাত্র সাতাশ-আটাশ বছর বয়সেই যদি এই অবস্থা হয়!”

“বেশিদিন বাঁচবো না হয়তো।”

“এর আগেই আমাকে ছেড়ে দিও। বিধবা হওয়ার চেয়ে ডিভোর্সি হওয়া ভালো।”

আহনাফের ঠোঁটের হাসিটা মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই। ক্ষীণ আলোয় সেই ম্লান মুখটা ভালোভাবে বোঝা গেল না। নীরবে অরুণিকার পাশে এসে বসলো সে। অরুণিকা এখনো আবছা আলোয় সেই ফড়িংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বলল, “তুই একটু আগে এই কথা কেন বললি?”

“কোন কথা?”

“বিধবা হওয়ার চেয়ে ডিভোর্সি হওয়া ভালো। তুই এখনো কি সেই সিদ্ধান্তেই আছিস?”

“হ্যাঁ, ভাবছি।”

“তুই আমাকে ক্ষমা করিস নি?”

“করেছি। তবে জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া উচিত।”

আহনাফ হুট করে অরুণিকার হাত ধরে বলল, “এভাবে বলিস না, প্লিজ। আমি অনেক খারাপ, আমি জানি। লাস্ট একটা সুযোগ দে। আমি ভালো হয়ে দেখাবো। একদম চেঞ্জ করে ফেলবো নিজেকে।”

অরুণিকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “দেখি না৷ সিদ্ধান্ত তো এখনো নেই নি৷ ততোদিনে তুমি কতোটুকু চেঞ্জ হও দেখি।”

এই বলে অরুণিকা উঠতে যাবে তখনই পাথরে পা রাখতে গিয়ে পিছলে গেল তার পা। পরমুহূর্তে আহনাফও ব্যস্ত হয়ে অরুণিকার হাত ধরতেই, দু’জনই একসাথে ছলকে পড়লো স্থির জলে। সেকেন্ড খানিক হাবুডুবু খেল অরুণিকা। আহনাফ সাথে সাথেই ধরে ফেলল অরুণিকার হাত। টেনে আনলো নিজের দিকে। কোমর জড়িয়ে তাকে পানির উপরে তুললো৷ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে অরুণিকা। আর আহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অরুণিকা কিছুটা স্বাভাবিক হতেই আহনাফের চোখে চোখ রাখলো। শান্ত দৃষ্টিতে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন বহু বছরের কথা জমে আছে সেই চোখ জোড়ায়, কিন্তু বলার ভাষা পাচ্ছে না। আহনাফ হাত দিয়ে অরুণিকার মুখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলো পেছনে সরিয়ে দিল। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। অসম্ভব চমৎকার লাগছে অরুণিকার চোখ দু’টি। আহনাফ বলল, “কাজল লেপ্টানো চোখ এতো সুন্দর হয়, তোকে না দেখলে আমার কখনোই জানা হত না!”

অরুণিকার ঠোঁট কাঁপছে। আহনাফের খুব ইচ্ছে করলো সেই অধর ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু ফিসফিসানো শব্দ কানে আসতেই তার ঘোর কাটলো। দু’জন মহিলা পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা আহনাফের বুকে ঘুষি মেরে বলল, “ওই উঠাও আমাকে। এখানেই কি ঘর বাঁধবে না-কি?”

আহনাফ টেনে উঠালো অরুণিকাকে। মহিলা দু’জন একে অপরকে বলল, “ধুর, তুই কি ঠাইরজ্জুস? ইবে তো চৌধুরী বাড়ির ছোড নাতি। আর মাইফুঁয়া ইবে ইতের বউ৷ ইতেরা তো গুঁড়ো কালেই বিয়ে গরি ফেলায়ি। জামাই-বউ তো এক্কোয়ারো গোসল গরিত তারে।”

আরেক মহিলা আহনাফকে বলল, “তো নাতি, এক্কানা ফর্দা গরিলে ভালা। তোঁয়ারা জামাই-বউ, না অন্য কিছু মাইনসে কেঁনে বুঝিব?”

অরুণিকা বেশ লজ্জায় পড়ে গেল। সে দ্রুত হেঁটে চলে গেল। আহনাফও তার পিছু পিছু গেল। আর মহিলা দু’জন তাদের যাওয়া দেখে নিজেদের মধ্যেই হাসতে লাগলো।

(***)

জ্যোৎস্না রাত। দিঘির জলে আছড়ে পড়ছে এক ফালি চাঁদের আলো। আর স্থির জলের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তাহমিদ। তার পকেটে হাত। মুখখানা স্মৃতি কাতর। চোখের সামনে ঘুরছে একটুখানি আলো। কোনো টর্চের আলো নয়, অতীতের আলো। এক কিশোরীর লাজুক হাসির আলো। তার নম্র চোখ জোড়ায় লেগে থাকা অব্যক্ত ভালোবাসার আলো। তাহমিদের অতীতে ভেসে উঠলো দিঘি পাড়ের সেই ফেলা আসা বিকেল। স্কুল ছুটির পর বাসায় না গিয়ে ব্যাগ নিয়ে একটি মেয়ে ছুটে আসতো দিঘির পাড়ে।
তাহমিদ প্রায়ই ছুটিতে গ্রামে আসতো। কারণে-অকারণে গ্রামে আসতো। দশ-পনেরো দিন কলেজে যেতো না। বই-খাতা নিয়ে ছুটে আসতো গ্রামে। শুধু একনজর রানী গ্রামের সেই লজ্জাবতীকে দেখতে। মেয়েটিও সেই মিষ্টি। স্কুলের ব্যাগ কাঁধে দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। বাসায় ফিরলেই যে তার মা তাকে পড়তে বসিয়ে দেবে। তখন আর বের হতে পারবে না। অন্যদিকে তাহমিদও মুগ্ধ হয়ে দেখতো সেই মেয়েকে। মেয়েটির সাদা ওড়না হাওয়ার তালে নৃত্য করতো। বুকে হাত রেখে তাহমিদ বারংবার প্রেমে পড়েছিল সেই স্নিগ্ধ কন্যার।

আজও তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে সেই দিঘির পাড়ে। বিকেলেও ঠিক এসে দাঁড়িয়েছিল, সকালেও এসে ঘুরে গিয়েছিল সে। কিন্তু ওপারে শুধু স্মৃতিরাই আছে। তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, চন্দ্রিমা। আকাশে স্থান পাওয়া চন্দ্র তো রোজ দেখি, আমার হৃদয়ের চন্দ্র কোথায় হারিয়ে গেল?”

বুক চিরে শুধু দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে আসে। কোনো উত্তর ফিরে আসে না সেই প্রশ্নের।

(***)

ধবধবে সাদা শাড়ি পরে এদিক-ওদিক হাঁটছে রুহানি। আরাফ বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকতেই রুহানিকে দেখে থমকে গেল। মনে হচ্ছে অন্ধকার ঘরে এক টুকরো মেঘ নেমেছে আকাশ থেকে, যার চোখে অজস্র গল্প। যার হাসিতে ছড়িয়ে পড়েছে স্নিগ্ধতা।

রুহানি আরাফকে দেখে শান্ত হয়ে গেল। এতোক্ষণ শাড়ির আঁচল দুলিয়ে হাঁটছিল সে। আরাফকে দেখে বেশ লজ্জা পেল। মনে মনে ভাবলো, “স্যার কি ভাববেন আমাকে? মনে করবেন মাথায় শিট আছে।”

রুহানি ধীর পায়ে হেঁটে আরাফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আরাফ চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “মধ্য রাতে শাড়ি পরে হাঁটছিলে কেন?”

রুহানি শাড়িটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বলল, “সুন্দর না?”

আরাফ একনজর তাকালো রুহানির দিকে। বলল, “তুমি মনে হয় একটু বেশি শাড়ি পরো?”

“কোথায় বেশি শাড়ি পরি? একটু ভালো লাগে তাই পরি।”

“তাই বলে মধ্য রাতে?”

“কেন শাড়ি পরার জন্য কি দিন হতে হবে? রাত হওয়া যাবে না?”

“তোমার ইচ্ছা। তোমার ইচ্ছে হলে দিনে পরো, ইচ্ছে হলে রাতে পরো, কিন্তু তাই বলে গ্রামে এসে সাদা শাড়িতে পুরো ঘরে হাঁটলে তো মানুষ ভয় পাবে।”

রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “মানে? কেন?”

“গ্রামে জ্বিনের প্রকোপ বেশি। সাদা শাড়িতে তোমাকে দেখলে যে-কেউ জ্বিন দেখেছে ভেবে ভুল করবে।”

রুহানির চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে কিছু না বলে ঠোঁট উল্টে হনহনিয়ে চলে গেল। আরাফ তার যাওয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। আর আনমনে বলল, “সুন্দর জ্বিন।”

মুহূর্তেই চমকে উঠলো আরাফ। নিজের বলা কথায় নিজেই অবাক হলো। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিয়ে ছাড়লো। নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমে চলে গেল। এদিকে রুহানি রুমে ঢুকে শাড়ির পিন খুলছে। অরুণিকা বিছানায় পা দুলিয়ে বই পড়ছিল। রুহানিকে রাগে গজগজ করতে দেখে সে বলল, “শাড়ি পরার ভূত ছুটে গেছে?”

রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে অরুণিকার দিকে ফিরে বলল, “কি বললি? আমি ভূত?”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোকে ভূত বলি নি! বলেছি ভূত নেমেছে কি-না!”

রুহানি শাড়িটা খুলে জামা গায়ে দিতে দিতে বলল, “আমি ভূত না। তোরা দুই ভাই-বোন ভূত।”

“মানে?”

“মানে কি আবার! ওদিকে তোর আরাফ ব্রো আমাকে জ্বিন বলেছে। লোকে আমাকে দেখলে না-কি জ্বিন ভাববে। আর এদিকে তুই আমাকে ভূত বলছিস। তোরাই হচ্ছিস আসল জ্বিন।”

অরুণিকা শব্দ করে হাসলো। বই বন্ধ করে রুহানির হাত ধরে বলল, “আরেহ, আমি তো মজা করে বলেছি। আরাফও হয়তো মজা করে বলেছে। আমার ভাইটা কি একটু মজাও করতে পারবে না? সারাদিন কি মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে?”

“মজা করেছে! কচু মজা করেছে। মুখটা তখনও কুমড়োর মতো ফুলে ছিল।”

রুহানি জামা পালটে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অরুণিকা তার পাশে এসে বসতেই রুহানি মুখ ছোট করে বলল, “যা তোর ওই জালিম বরের সাথে গিয়ে ঘুমা। আমি একা থাকবো আজ। আমি তো জ্বিন। আমার তো চিন্তা নেই। ওরা আমাকে দেখলে সালাম দিতে দিতে পালাবে।”

“তাহলে তো আমার তোর সাথেই থাকা উচিত৷ জ্বিনদের রানী আমার পাশে থাকলে, ওরা আমাকেও সালাম দিতে বাধ্য। ওদের একটু জানিয়ে দিস, আমি তোর মানুষ বোন।”

রুহানি মুখটা আরো ছোট করে অরুণিকাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “কথা বলিস না আমার সাথে। একটু প্রশংসা করে সুন্দর বলা যায় না? সবাই এখন আমাকে জ্বিন বলছে। তোর ভাই জ্বিন। তোর চৌদ্দগোষ্ঠী জ্বিন।”

রুহানি মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লো। অরুণিকাও নিঃশব্দে হেসে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো।

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৯ ||

রবি কিরণ ঠিকরে পড়ছে দিঘির স্বচ্ছ জলে। মৃদু সমীরণের ধাক্কায় জলে দোলা লাগছে আর সৃষ্টি হচ্ছে চমৎকার আলোছায়া। তূর্য নির্নিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে দেখছে সেই নরম ঢেউয়ের খেলা। তার স্মৃতির পাতায় লিখিত তিক্ত সুর গলায় দলা পাকিয়ে উঠছে। শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তূর্য এবার সমীরণের ধাক্কায় দুলে উঠা বটবৃক্ষের পত্ররাজির দিকে চোখ নিবদ্ধ করলো। তার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো মুহূর্তেই। ক্ষীণ স্বরে বলল, “তুমি আমার জীবনে আসা এক কুৎসিত ছলনাময়ী।”

তূর্য দিঘির পাড় ফেলে কয়েক পা সামনে যেতেই থমকে গেল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সাতাশ বছর বয়সী নারী। সেই নারী চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। তার চোখ-মুখ শুকনো। ঠোঁট মলিন। সে অস্ফূটস্বরে বলে উঠল, “তূর্য!”

তূর্যের নিঃশ্বাস আঁটকে গেল। তার কাঁধের ব্যাগটা বেশ ভারী মনে হচ্ছে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে চোখ সরিয়ে দ্রুত পা ফেলে চলে আসতেই সেই নারী কন্ঠ শুধালো, “কেমন আছেন!”

তূর্য থামলো না। সে চলে গেল উদ্দেশ্যহীন পথে। ওদিকে তার যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক জোড়া সিক্ত চোখ। হঠাৎ পেছন থেকে এক মধ্য বয়ষ্ক নারী কন্ঠ ভেসে এলো, “উপমা, তোর মেয়ে তোকে খুঁজছে। তাড়াতাড়ি আয়।”

উপমার হেলদোল নেই। সে এখনো তূর্যের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সাড়ে ছ’বছরের একটি মেয়ে এসে তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। উপমা বাচ্চাটির স্পর্শে তার দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে বলল, “তূর্ণা, মা আমার! কাল রাতে কান্না করেছিলে কেন তুমি? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? এতো বার তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বললে না।”

ছ’বছরের তূর্ণা অভিমানী কন্ঠে বলল, “মা, চলো না আমরা বাসায় ফিরে যাই। আমার এখানে ভালো লাগে না। সবাই আমাকে পঁচা বলে।”

“কে বলেছে তোমাকে পঁচা? আমাকে বলো। আমি তাকে শাস্তি দেবো।”

“সবাই বলে। নানুও বলে।”

উপমা চোখ তুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মধ্য বয়ষ্ক নারীর দিকে তাকালো। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে উপমার দূর সম্পর্কের চাচী হোন। নাম খোদেজা বেগম। তিনি ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, “তোর মেয়ে মারাত্মক মিথ্যে কথা বলে। একদম তোর মতো হয়েছে।”

উপমা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তূর্ণাকে কিছু বলবেন না। আমার মেয়ে মিথ্যে কথা বলে না।”

উপমা হাঁটু ভাঁজ করে তূর্ণার সামনে বসে বলল, “দেখি, মা। বলো কি হয়েছে?”

তূর্ণা পেছন ফিরে খোদেজা বেগমের দিকে তাকালো। খোদেজা হনহনিয়ে চলে গেলেন। তূর্ণা উপমার দিকে ফিরে বলল, “মা, বাবা কোথায়? সবাই বলে আমি পঁচা মেয়ে। তুমিও পঁচা মেয়ে। তাই বাবা নেই আমার।”

তূর্ণার চোখ ভিজে উঠলো। উপমা শূন্য দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার কাছে মেয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মেয়েকে বাবার পরিচয় দেওয়ার ক্ষমতাও নেই তার। উপমা মেয়ের হাতে চুমু খেয়ে বলল, “আমারও বাবা নেই। মা নেই। ওরা আল্লাহর কাছে চলে গেছে। ঠিক তেমনি তোমারও বাবা নেই। এখানে পঁচা হওয়ার কি আছে? আর মন খারাপ করো না, মা। তোমার স্কুল ছুটি ছিল, মায়েরও একটা কাজ ছিল, তাই মা এখানে এসেছি। আজই চলে যাবো আমরা। ঠিক আছে?”

তূর্ণা মাথা নাড়লো। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে উপমা মনে মনে বলল, “কেন এভাবে ঠকালে আমাকে, তূর্য? তোমাকে বিয়ে করেও আমি সমাজের চোখে আজও কুমারী রয়ে গেলাম। তোমার বৈধ সন্তান জন্ম দিয়েও আমি জারজ সন্তানের মা হলাম।”

(***)

তূর্য বাস স্টেশনে এসে বসলো। উপমাকে দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল তার। এখনো নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারে নি সে। চোখের সামনে বারংবার ভেসে আসছিল সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি। হাত মুঠো করে বসে আছে তূর্য। তখনই কানে ভেসে এলো এক জোড়া কপোত-কপোতীর হাস্যজ্বল কথোপকথন।

“এই তুমি আমাকে এখনো একটাও ফুল দিলে না কেন? আমাদের বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে, তুমি আমাকে একটাও ফুল দাও নি।”

ছেলেটি তার স্ত্রীর হাত ধরে বলল, “তুমিই তো আমার ফুল। ফুলকে আবার কি ফুল দেবো? হিংসে হবে না তোমার?”

তূর্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, অতীতের মিষ্টি একটা দিন।

উপমা নীল সেলোয়ার-কামিজ পরে দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য উপমাকে দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উপমার চোখ চিকচিক করছে। তূর্যকে দেখলেই বেশ শান্তি লাগে তার। আপনা আপনিই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। তূর্য উঁচু গলায় বলল, “শ্যামকন্যা, আমাকে কেমন লাগছে?”

তূর্য সাদা পাঞ্জাবি পরেছে আজ। পাঞ্জাবিতে মানুষটাকে বেশ সুদর্শন লাগে। উপমা ইশারায় বোঝালো, বেশ মানিয়েছে। উপমার উত্তর পেয়ে পাঞ্জাবির হাতা গুঁটিয়ে তূর্য পানিতে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। উপমা চায় না তূর্যের দামি পাঞ্জাবি নষ্ট হয়ে যাক। তাই সে বলল, “না, না এপাড়ে আসতে হবে না।”

তূর্য ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “আসলে কি সমস্যা?”

“পাঞ্জাবি ভিজে যাবে।”

তূর্য উপমার কথা শুনে এক গাল হাসলো। এরপর উপমার দিকে তাকিয়েই পাঞ্জাবি খুলতে লাগলো। উপমা লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। পরমুহূর্তেই চলাৎ করে পানিতে কিছু পড়ার শব্দ হলো। উপমা সামনে তাকিয়ে দেখলো, দিঘির জলে ঝাঁপ দিয়েছে তূর্য। ঢেউ ছুঁয়ে দিচ্ছে তূর্যের উজ্জ্বল কায়া। মিনিট খানিকের মধ্যেই সাঁতরে পার হয়ে গেল তূর্য। উপমা হাত এগিয়ে দিতেই তূর্য শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো উপমার হাত। সেই হাত ধরেই উঠে এলো ডাঙায়। দু’জনের চোখাচোখি হলো। মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেল দু’টি মানব আত্মা। উপমা কাঁপা কন্ঠে বলল, “পাজামা তো ভিজে গেছে। এভাবে কেন আসতে হলো এপাড়ে?”

“তোমার প্রেম সাগরে যেখানে আমিই তলিয়ে যাচ্ছি, একটুখানি ভিজে যেতে আমার আপসোস নেই।”

এতোক্ষণ উপমা খেয়াল করে নি, কিন্তু এবার সে লক্ষ্য করলো তূর্যের হাতে পদ্মফুল। উপমা উৎসুক কন্ঠে বলল, “কি সুন্দর!”

“একদম তোমার মতো, তাই না?”

উপমা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মিথ্যে কথা। আমার মতো কেন হবে? আমি তো ওতো সুন্দর না।”

“কে বলেছে সুন্দর না? তুমি আমার শ্যামকন্যা। অনেক চমৎকার তোমার মুখখানা। পদ্মফুলও যেখানে হার মানতে বাধ্য।”

তূর্য ভেজা হাতে উপমার গাল ছুঁয়ে দিল। উপমা চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো সেই স্পর্শ। মনের প্রশান্তি ঠোঁটে ফুটে উঠলো। তূর্য সেই প্রশান্তির হাসি দেখে বলল, “ভালোবাসি শ্যামকন্যা। তোমার জন্য চাঁদ, তারা নামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। কিন্তু নাম না জানা অজস্র ফুল তোমার পায়ের কাছে এনে রাখবো। সেই ফুল দেখে তুমি বুঝবে আমার শ্যামকন্যা সেই ফুলেরও ঊর্ধ্বে। ফুলগুলো হিংসে করবে তোমাকে। আর সেই হিংসের উত্তাপে আমাদের প্রেম উষ্ণতা ছড়াবে।”

বাসের হর্ণে বাস্তবে ফিরে এলো তূর্য। বাসে উঠে বসলো সে। মিনিট খানিকের মধ্যেই বাস স্টেশনে ছাড়লো। তূর্য জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “জীবনে যদি কোনো ভালো কাজ করে থাকি, সেই ভালো কাজের ফলস্বরূপ আমার একটাই চাওয়া থাকবে। সেই কুৎসিত ছলনাময়ী যেন আমার দৃষ্টি সীমানার ধারেও না আসে। আমি আজও কাউকে জানাতে পারি নি, সেই কুৎসিত মেয়েটা আমাকে কীভাবে ঠকিয়েছিল। সবাই তো ভাবে, আমি তাকে ঠকিয়েছে। সে তো খুব চমৎকারভাবে নিজের কলঙ্ক আমার ঘাড়েই লেপ্টে দিয়েছিল, অথচ একবারও আমার ভালোবাসা বুঝলো না। সে যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতো, তাহলে কি আমার অধিকার অন্য কারো নামে লিখে দিতে পারতো?”

(***)

ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। অরুণিকা চুলায় খিচুড়ি বসিয়েছে। তার চুল এখন কাঁধ অব্ধি এসেছে। প্রায়ই সে ঝুঁটি করে রাখে। চুলার উত্তাপে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আহনাফ পুরো বাড়ি ঘুরে অরুণিকাকে রান্নাঘরে এসে এই রূপে দেখে থমকে গেল। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে শান্ত দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা একনজর আহনাফের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। আহনাফ বলল, “তুই দেখি এখন রান্নাবান্না পারিস!”

অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “ভালো হয়েছে না? পাঁচ বছর আগে রাঁধতে পারি না বলে এক সপ্তাহ ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির ছিলাম। আল্লাহ কি দিন দেখিয়েছিল!”

অরুণিকার কথা শুনে মুহূর্তেই আহনাফের মুখে আঁধার ছেয়ে গেল। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “সরি, অরু। আমার জন্য তুই অনেক কষ্ট করেছিস।”

অরুণিকা প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। আহনাফ শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার গাল লাল হয়ে আছে। আহনাফ তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হুট করে চুমু খেল তার গালে। অরুণিকা চমকে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ তার গালে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।”

আহনাফ ফোন বের করে অরুণিকার বিষ্ময় ভরা মুখখানা ক্যামেরাবন্দী করলো। এরপর অরুণিকাকে সেই ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়ে বলল, “এই ছবি ছাড়িস তো আজকে।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমি ছবি ছাড়বো কি ছাড়বো না, এটা তুমি বলার কে?”

“আপলোড দেওয়ার মতো ছবি, তাই বললাম।”

অরুণিকার দৃষ্টি সূক্ষ্ম হলো। আহনাফ স্মিত হেসে বলল, “আমার ক্ষমতা থাকলে তোকে নিয়ে দুই লাইন লিখতাম। কিন্তু আমার লেখার হাত ভালো না। আমি পড়াই ভালো।”

অরুণিকা চোখ সরিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিল। আহনাফ অরুণিকাকে নিরুত্তর দেখে বেশ দুঃখ পেল। অরুণিকার মনোযোগ পাওয়ার লোভে সে বলল, “রান্না তো হয়েই গেল! আমাকে খাওয়াবি না?”

অরুণিকা খিচুড়ি বাটিতে নিয়ে বাঁকা হাসলো। এরপর আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “টেবিলে গিয়ে বসো। আমি নিয়ে আসছি।”

আহনাফ উৎসাহ নিয়ে ডায়নিংয়ে এসে বসলো। অরুণিকা আহনাফের জন্য নেওয়া খিচুড়িতে লবণ-মরিচ মিশিয়ে ভালোভাবে নেড়েচেড়ে তার সামনে এনে রাখলো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর হাতে প্রথম কিছু খাচ্ছি। খুব এক্সাইটেড আমি।”

“হ্যাঁ, খাও খাও। তোমার জিভে আজীবন লেগে থাকবে এই স্বাদ।”

এক চামচ মুখে নিতেই আহনাফের মুখটা শুকিয়ে গেল। অরুণিকা আহনাফের পাশে বসে বলল, “ওয়েস্ট করা যাবে না। একটুখানি খাবারের মূল্য অনেক বেশি। পাঁচ বছর আগে এই এক বাটি খিচুড়ির দাম হীরার চেয়েও বেশি ছিল।”

আহনাফ এক চামচ খেয়ে পানির জগ হাতে নিতেই অরুণিকা তা সরিয়ে নিয়ে বলল, “পানি খুব সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু খাবার সহজে পাওয়া যায় না। আমি চাই, দামি জিনিসের মূল্যটা তুমি বোঝো। তুমি তোমার কৃতকর্মের জন্য খুব সরি, তাই তো? তাহলে প্রমাণ করো।”

আহনাফ কাঁপা গলায় বলল, “কীভাবে করবো?”

“খিচুড়িটা খাবে, ব্যস।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় চামচ মুখে নিলো। এভাবে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম চামচ শেষ করতেই চোখ ছলছল করে উঠলো তার। অরুণিকা চামচ হাত থেকে নিয়ে বলল, “হাত দিয়ে খাও। আরো মজা পাবে।”

আহনাফের বাটি ভর্তি করে দিলো অরুণিকা। সাথে মরিচ মিশিয়ে দিলো ইচ্ছেমতো। আহনাফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাটির দিকে। অরুণিকা তাগাদা দিয়ে বলল, “খাও।”

আহনাফ হাত দিয়ে মেখে মেখে সেই খিচুড়ি খাচ্ছে। এখন হাতও জ্বালা করছে তার। ঠোঁট লাল হয়ে গেছে। পানির জগের দিকে তাকিয়ে আহনাফ বলল, “একটু পানি দিবি?”

অরুণিকা চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির হাসি হেসে বলল, “একটু খাবার হবে? এই বাক্যটা কতো দামি ছিল তখন। আর তোমার কাছে এখন পানিটা দামি হয়ে গেছে। দেখেছো, কখন কীসের মূল্য বেড়ে যায়, বলা যায় না। সেদিন ভাতের মূল্য বেশি ছিল, আজ পানির মূল্য বেশি। তুমি আমাকে ভাতে মেরেছো, আমি তোমাকে পানিতে মারলাম। প্লিজ, মৃত্যুর স্বাদটা ঠিকভাবে নাও। নয়তো আমার যন্ত্রণা একটুও অনুভব করবে না। খালি পেটে এভাবেই হাইড্রোক্লোরিক এসিড আমার পাকস্থলীতে টুপটুপ করে পড়েছিল। বুকটা জ্বালা করতো আমার। তোমাকে কৃত্রিম উপায়ে জ্বালাতে চাচ্ছি। একটু জ্বলো। আমিও দেখি, যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা তোমার কতোটুকু। এরপরই তো বুঝবো আমরা সংসার করার জন্য কম্প্যাটিবল কি-না।”

আহনাফ ধীরে ধীরে বাটির খিচুড়ি খাওয়া শেষ করলো।চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে তার। শার্টের হাতায় একটু পরপর নাক ঢলছে সে। ধীর পায়ে হেঁটে হাত ধুয়ে মুখে পানির ছিঁটে দিলে আহনাফ৷ বেসিনে দুই হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। অরুণিকা তার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “ভালোই এডবেঞ্চার হয়েছে, তাই না?”

আহনাফ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। এরপর নীরবে চলে গেল। অরুণিকা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল, “পানি খেলে, তো হেরে গেলে।”

আহনাফ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো চিত হয়ে। ফ্যানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর হুট করে বিছানা ছেড়ে উঠে হন্যে হয়ে ব্যাগে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অনেকক্ষণ খোঁজার পর কিছু না পেয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো সে। অস্থির লাগছে তার। দ্রুত শার্ট খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। এবারও স্বস্তি পাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে জিনিসপত্র যা আছে ভেঙে নিজের ভেতরের যন্ত্রণা প্রশমিত করতে। কিন্তু তাও পারছে না আহনাফ। ফ্যান পূর্ণগতিতে ঘুরছে, তবুও ঘামাচ্ছে সে। শেষমেশ নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলো না আহনাফ। ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে না সে। চোখ-মুখ কেমন লাল হয়ে আছে। চোখে জল, অথচ গড়িয়ে পড়ার সাহস পাচ্ছে না। আহনাফ কাঁপা কন্ঠে বলল, “তুই এতো অভিমানী কেন, অরু? তোকে কীভাবে বোঝাবো আমি সত্যিই তোকে অনেক ভালোবাসি৷ তোর চোখে আমার প্রতি রুক্ষতা সহ্য করতে পারছি না আমি। আমার কষ্ট হচ্ছে, অরু। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার এতো ক্ষমতা নেই। তোর মতো কষ্ট ধারণ করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেয় নি।”

আহনাফ চিৎকার করতে পারছে না, কারণ দেয়ালের ওপারে মানুষ। সে নুইয়ে পড়তে পারছে না, কারণ সে একজন পুরুষ। কিন্তু তার হৃদয়ের হাহাকার বিনা অনুমতিতেই এবার অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়লো। আহনাফ বারবার মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে। তবুও তার চোখ জোড়া হেরে যাচ্ছে হৃদয়ের কাছে। শেষমেশ মেঝেতে বসে ভয়ংকর আর্তনাদ তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো। সে পারছে না আর শক্ত খোলসে নিজেকে ঢেকে রাখতে। সে দুর্বল। ভীষণ দুর্বল তার হৃদয়। আহনাফ বারংবার বলতে লাগলো, “অরু, সব ভুলে আমার কাছে পুরোপুরি ফিরে আয়, প্লিজ। আমি তোকে আমার হৃদয় নিংড়ে ভালোবাসবো। একটুও কষ্ট দেবো না তোকে। শেষ আরেকটা সুযোগ দে আমাকে। আরেকটা সুযোগ শুধু।”

আহনাফের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যেন ওয়াশরুমের চার দেয়ালেই বাঁধা পড়ে গেল। প্রায় এক ঘন্টা পর নিজেকে শান্ত করে বেরিয়ে এলো সে। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখের কোণা জ্বালা করছে তার। ঘুমালেই হয়তো শান্তি পাবে এখন।

(***)

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুহানি। গলায় অরুণিকার দেওয়া মুক্তোর মালা। বিয়ে উপলক্ষে গলায় পরার জন্য কিছু মালা দিয়েছে অরুণিকা। রুহানি সাথে করে কিছু নিয়ে আসে নি। মালাগুলো মিসেস নীহারিকার। অরুণিকা নিয়ে এসেছিল। রুহানি এখন সেগুলোই পরে দেখছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল তার চুলের সাথে আঁটকে গেছে গলায় ঝুলানো মুক্তোর মালাটির হুক। কোনোভাবেই মালাটা খুলতে পারছে না সে। মিসেস নীহারিকার শেষ অলংকার, তাই রুহানি ভয়ে আছে, যদি ছিঁড়ে যায়! রুহানি চুলগুলো এক হাতে সরিয়ে মালাটা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। অরুণিকাকে গলা উঁচু করে বেশ কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু সাড়াশব্দ এলো না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই রুহানি বলল, “অরু, মালাটা গলায় আঁটকে গেল যে! খুলতেই পারছি না।”

রুহানি এই বলে চোখ তুলে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের পাশে আরাফের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলো। পেছন ফিরে বলল, “স্যার আপনি?”

আরাফ কিঞ্চিৎ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমি এখন আপতত তোমার স্যার নই। আমাকে স্যার সম্বোধন না করলেও হবে।”

“তাহলে কি বলবো? আরাফ জি।”

“কি?”

“জি!”

আরাফ চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “এটা আবার কেমন সম্বোধন? সিরিয়াল দেখো না-কি?”

“আপনিও দেখেন মনে হয়।”

“মানে?”

“নয়তো কীভাবে বুঝলেন জি বলে।”

“উফ!”

আরাফ কপাল চেপে ধরে বলল, “চোখে পড়েছে, তাই বললাম। অরুণিকা বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে জানি না। তোমার কিছু লাগলে আমাকে বলতে পারো।”

“গার্লস প্রবলেম?”

“হোয়াট!”

“ওই প্রবলেম না। আই মিন, গলা থেকে মালাটা খুলতে পারছি না, সেই প্রবলেম।”

আরাফ চোখ ছোট করে চাপা স্বরে বলল, “ছাগল!”

রুহানি চুল সরিয়ে বলল, “আপনি পারবেন?”

আরাফ চোখ বড় বড় করে রুহানির কাঁধের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুহানি বলল, “তাহলে বললেন কেন আপনাকে বলতে?”

আরাফ চোখ সরিয়ে বলল, “আমি অরুকে দেখলে পাঠাচ্ছি।”

রুহানি মুখ বাঁকিয়ে নিজেই ব্যস্ত হয়ে খুলতে লাগলো সেই হুক। আরাফ দরজার কাছে এসে কি মনে করে আবার থমকে গেল। আরাফকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে রুহানি বলল, “কিছু বলবেন?”

আরাফ আয়নায় রুহানির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কিছু মনে না করলে আমি হ্যাল্প করতে পারি।”

রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “ওকে।”

আরাফ ভ্রূ সংকুচিত করে বলল, “কি ওকে?”

রুহানি মুখ বাঁকিয়ে ইশারায় গলার দিকে ইশারা করে বলল, “হ্যাল্প ক্যান।”

“হোয়াট?”

“মানে ইউ ক্যান হ্যাল্প।”

আরাফ মুখ চেপে হাসলো। রুহানি চোখ ছোট করে বলল, “স্টুডেন্টের ভুল হলে শুদ্ধ করে দিতে হয়। এভাবে খিকখিক করে না।”

“আমি কি খিকখিক করলাম না-কি?”

“পুরুষ তাই খিকখিক করতে পারেন নি। এভাবে মুখ চেপে পিক করে হেসে দেওয়া মেয়েদের ভার্সনে খিকখিক করা। ছেলেদের মৃদু হাসি সমান মেয়েদের অট্টহাসি।”

“তুমি কি ছেলেদের উপর রিসার্চ করেছো?”

“না, মুভি-টুভি দেখি। ওখান থেকেই আইডিয়া নিয়েছি।”

“লেইম আইডিয়া নিয়েছো। এসব না করে পড়ালেখা করলে পাশ করে যেতে।”

“ইন্সাল্ট নট।”

“ডোন্ট ইন্সাল্ট মি।”

“আমি আবার আপনাকে কখন অপমান করলাম?”

আরাফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তোমাকে শুদ্ধ করে দিলাম জাস্ট।”

“ওহ, সেটাই বলেন।”

আরাফ মালাটির হুক খুলতে গিয়ে তার ঠান্ডা আঙুল রুহানির ঘাড় স্পর্শ করলো, আর মুহূর্তে রুহানির হৃদস্পন্দন থেমে গেল। সে আয়নায় চোখ রেখে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ দু’আঙুল দিয়ে মালাটির হুক খোলার চেষ্টা করছে, আর রুহানি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। মালাটি খুলে যেতেই আরাফের চোখ পড়লো আয়নায়। রুহানির বন্ধ চোখ জোড়া দেখে মুহূর্তেই তার হাত ফস্কে মালাটি নিচে পড়ে গেল, আর ওমনি চোখ খুলে রুহানি চেঁচিয়ে উঠলো। রুহানির চিৎকারে ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল আরাফ। রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “মালাটা ছিঁড়ে গেলে আপনাকে আমি ফ্যানের সাথে বেঁধে ঘোরাতাম।”

আরাফ রুহানির কথা শুনে বুকে হাত গুঁজে বলল, “ওকে, ট্রাই করে দেখতে পারো।”

রুহানি মালাটি হাতে নিয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “থাক ছিঁড়ে নি। এখন যান আপনি। বেঁচে গেছেন, তাই শুকরিয়া করেন।”

আরাফ আর কিছু বললো না। চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো। এদিকে আরাফ বেরুতেই রুহানি বুকে হাত রেখে জোরে শ্বাস ছাড়লো। এমন অনুভূতি তার আগে কখনোই হয় নি। আরাফের স্পর্শে কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তার। রুহানি তার হাতে বার কয়েক মালিশ করলো। পরক্ষণেই লাজুক হেসে আয়নায় নিজেকে একনজর দেখে নিলো। ওদিকে আরাফের চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে রুহানির বন্ধ চোখ জোড়া। সে এক নজর তার আঙুলের দিকে তাকালো। সামনে হাঁটতে গিয়েই তাহমিদের সাথে ধাক্কা খেলো আরাফ। তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মন কোথায় তোর?”

“রুহা…”

আরাফ থেমে গেল। তাহমিদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরাফ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কিছু না। চল একটু বের হই।”

এই বলে তাহমিদকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হলো আরাফ।

(***)

অরুণিকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আহনাফের তোলা ছবি। নিজের ছবিতে আঙুল ছুঁয়ে দিলো সে। আসলেই তো! খুব সুন্দর হয়েছে ছবিটা। অরুণিকা ছবিটি ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করলো। অনেকদিন ছবি দেয় নি সে। আজ কেন যেন খুব ইচ্ছে হলো ছবিটা ছাড়তে। ছবিটি ছেড়েই হিমালয়ের একাউন্টে ঢুকলো। মানুষটা অনেকদিন অনলাইনে আসে নি। তার ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে হিমালয়ের সাথে। মনে এক গুচ্ছ আক্ষেপ জমে আছে। হিমালয় নামক মানুষটার সাথে কথা বললে সব আক্ষেপ কেটে যায় তার।

অরুণিকা মোবাইল এক পাশে রেখে বিছানায় শুয়ে আছে। হঠাৎ ফোনে টুং করে শব্দ হলো। অরুণিকা ফোন হাতে নিতেই দেখলো হিমালয়ের মেসেজ। এই মানুষটার কথায় ভাবছিল সে, আর তারই মেসেজ এলো? অরুণিকা কৌতুহল নিয়ে হিমালয়ের মেসেজটি পড়তে লাগলো। হিমালয় লিখেছে,

“হাজারটা প্রশ্নে ঘেরা তার অভিমানী চোখ
না বলা কথা আঁটকে আছে বদ্ধ পিঞ্জরে,
তার দৃষ্টি ভুলিয়ে দেয় হৃদয়ের দুঃখ,
কীভাবে মানবো সেই শৃঙ্খল প্রতিটি অক্ষরে?
তার স্নিগ্ধ কোমল ঘর্মাক্ত মুখখানা,
হৃদয়ে বেঁধেছে উষ্ণ ঘর,
বুনছে অজস্র কাব্যলেখা,
তাকে অপর্ণ করা বেশ দুষ্কর।

নাকে জমেছে মুক্ত দানা,
অলক্ষ্যে বসে প্রেম দিচ্ছে হানা,
অদৃশ্য দেয়াল করছে মানা,
ভয় হয়, বেশ ভয় হয়।
হেরে গেলাম না-কি অভিমানী ঝড়ে?
প্রশ্নটা আমার হৃদয়ে কান পেতে রয়।”

অরুণিকার চোখ জুড়িয়ে গেল হিমালয়ের লেখা পড়ে। সে কিছু লিখতে গিয়েও লিখলো না। একটু পর হিমালয়ের আরেকটা মেসেজ এলো।

“আপনি কি আমাকে ক্ষমা করবেন না, হৃদি?”

অরুণিকা মৃদু হেসে লিখলো, “আপনার উপর কখনো অভিমান ছিল না আমার। তবে আপনাকে আমি অত্যন্ত শান্ত মানুষ রূপে কল্পনা করেছি। হঠাৎ এমন কান্ড বাঁধিয়েছেন যে মনে অজানা ভয় ভীড় করলো।”

“কীসের ভয়?”

“আমি মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করেছি। দানবের সাথে নয়।”

হিমালয় বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো, “আপনাকে আঘাত করে আমারই কষ্ট হলো। আপনার সাথে কথোপকথন আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। দয়া করে আমাকে আর দীর্ঘ অপেক্ষায় রাখবেন না।।”

অরুণিকা মুচকি হেসে বলল, “কবিতাটা সুন্দর ছিল। কখন লিখেছেন?”

“এই মাত্রই।”

“তাই?”

“আপনার ছবিটা দেখেই লিখে ফেললাম।”

“ছবি দিলাম তো মাত্র। এতো তাড়াতাড়ি কবিতা লিখে ফেললেন!”

“আপনাকে বলেছি না, আপনার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আপনার সাথে কথা বললে, আপনাকে দেখলে, আমার লেখার গতি বেড়ে যায়। আপনার অভ্যাস বাঁধিয়ে দিয়ে হারিয়ে যাবেন না তো আবার?”

“না।”

“হারাবেন না কিন্তু। আপনি হারিয়ে গেলে, আমি হেরে যাবো।”

(***)

শিরিন সুলতানা আচমকা রুমে ঢুকতেই চমকে উঠলো আহনাফ। ভ্রূ কুঁচকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শিরিন সুলতানা সশব্দে চড় বসিয়ে দিলেন আহনাফের গালে। আহনাফ বিষ্ময়ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি করলাম?”

শিরিন সুলতানা আহনাফের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “সজ্ঞানে ফিরলেই বুঝতি চড়টা কেন মেরেছি।”

“আমাকে সোজাসুজি বলো, কি হয়েছে?”

শিরিন সুলতানা আহনাফের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “মেডিসিনগুলো আবার আনিয়েছি আমি। এগুলো খেলে মাথায় ঢুকবে সব। মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোর! চোখে ওই মেয়েকেই দেখিস এখন। এই মেডিসিনগুলো নিয়ে দেখ, তোর মাথা ধরা এবার পুরোপুরি যাবে।”

শিরিন সুলতানা এই বলে চলে গেলেন। আহনাফও মেডিসিনগুলো একপাশে রেখে দরজা বন্ধ করে দিল।

চলবে-

~কবিতাটা লিখতে গিয়ে চৌদ্দটা বেজে গেছে। সরি।