উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
2

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪০||

সূর্যরশ্মি ম্লান হয়ে এসেছে। চড়া রোদ নেই। তেজস্বী পশ্চিম দিগন্তে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চারিধারে বিস্তৃত তাম্রাভ। মাঠের শিষে শিষে বয়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধ হাওয়া। দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছেও সেই হাওয়ার ধাক্কা লাগছে। রাখল তার গাভীদের নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। আর সেই পথে হাঁটছে রুহানি ও অরুণিকা। রুহানি মুগ্ধ হয়ে দেখছে রাজা গ্রাম। কি সুন্দর ছবির মতো!

সকালের হালকা বৃষ্টিতে পথঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে। অরুণিকা সাবধানে পা ফেলছে। রুহানির জোরাজুরিতেই আজ বাইরে বের হওয়া। তাদের পিছু পিছু হাঁটছে আহনাফ ও আরাফ। আহনাফের দৃষ্টি অরুণিকার চলার পথে। যার দরুন কিছু পথ এগোতেই বেখেয়ালিতে তার কাঁদায় পা পড়তেই সে পিছলে পড়ে গেল। অরুণিকা ও রুহানি শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আহনাফ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কাঁদার উপর বসে আছে। রুহানি তা দেখে শব্দ করে হাসতে লাগলো। আরাফ রুহানির দিকে গম্ভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিতেই, তার হাসি মিলিয়ে গেল। আরাফ টেনে উঠালো আহনাফকে। আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওদিকে একটা টিউবওয়েল আছে। ওখানে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে আসি।”

আরাফ বলল, “চল।”

“না, তুই এখানে থাক।”

আহনাফ এবার অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমার সাথে চল, অরু।”

অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালো আহনাফের দিকে। তার ভাবলেশহীন দৃষ্টি দেখে আহনাফ হাত এগিয়ে দিল। অরুণিকা আরাফের দিকে একনজর তাকিয়ে সামনে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “চলো, আমি আসছি।”

আহনাফ তার শূন্য হাতের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে অরুণিকার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। এবার খুব সাবধানে পা ফেলছে সে। কাঁদায় আহনাফের পুরো শরীর মাখামাখি। অরুণিকা তা দেখে বলল, “বাসায় গিয়ে না হয় গোসল করতে। আবার টিউবওয়েলে কেন যাচ্ছো? ফিরতে গিয়ে যদি আবার আছাড় খাও?”

“এবার আর হবে না। আমার হাতটা ধরে থাকিস শুধু।”

তারা হাঁটতে হাঁটতে উন্মুক্ত মাঠের পাশে বসানো টিউবওয়েলের সামনে চলে এলো। আহনাফ তার পায়ের জুতো খুলে শার্ট খুলতে খুলতে বলল, “পানি দে আমাকে।”

অরুণিকা বিরক্ত মুখে টিউবওয়েল চাপতে লাগলো। আহনাফ তার জুতো ধুয়ে একপাশে রাখলো। শার্টটাও বেশ ভালোভাবে ধুয়ে অরুণিকার হাতে দিয়ে বলল, “আরো শক্তি লাগা না। এভাবে পানি দিচ্ছিস কেন?”

অরুণিকা আরো জোরে জোরে টিউবওয়েল চাপতে লাগলো। আহনাফ দিব্যি গোসল সেরে নিচ্ছে। এদিকে খড়ের গাদায় লুকিয়ে তিনটা মেয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকার দৃষ্টি আঁটকালো সেদিকে। সে ইশারায় তাদের ডাকলো। মেয়ে তিনটি ছুটে এলো যেন৷ অরুণিকা বলল, “লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কি আছে? এখানে এসে দাঁড়িয়ে সরাসরি দেখো।”

আহনাফ মেয়েগুলোকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। মেয়ে তিনটা লাজুক চাহনিতে আহনাফের দিকে তাকাচ্ছে। অরুণিকা বলল, “এই ভাইটা শহর থেকে এসেছে। বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে। আমার তো তোমাদের তিনজনকেই খুব পছন্দ হয়েছে। এখন এই ভাইটা কাঁদায় পড়ে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। তোমরা একটু পরিষ্কার করে দিতে সাহায্য করো। খুশি হয়ে কথা পাকাপাকিও হয়ে যেতে পারে।”

মেয়ে তিনটা মুখে কিছু বললো না। তারা বেশ উৎসাহ নিয়ে আহনাফের জুতো রগড়ে রগড়ে পরিষ্কার করছে। একজন তো বাংলা সাবান এনে সেখানেই আহনাফের শার্ট কেচে দিচ্ছে। আহনাফের প্যান্টেও বেশ কাঁদা। অন্য একটি মেয়ে প্যান্টে হাত দিতেই আহনাফ কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ধমকের সুরে বলল, “এই কি করছো, যাও এখান থেকে।”

মেয়ে তিনটা আহনাফের ধমক শুনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আহনাফ অরুণিকাকে বলল, “তুই কি করছিস, অরু? উল্টোপাল্টা কথা বলছিস কেন?”

অরুণিকা মেয়ে তিনটাকে বলল, “যাও এখান থেকে। তোমাদের বাবা-মা’র সাথে আলাপ করে পরে জানানো হবে।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। মেয়ে তিনটা চলে যেতেই অরুণিকা বলল, “জুতোটাও তো ঠিকভাবে পরিষ্কার করতে পারো নি। শার্ট না-কি ধুয়ে আমার হাতে দিয়েছো! ধোয়ার পরও কাঁদা লেগেছিল। আর ওই মেয়ে তিনটার তোমার কাঁদা মাখা বডি দেখার খুব শখ ছিল। খড়ের পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখছিল। তাই ওদের ডেকে এনে আরেকটু ভালোভাবে দেখার সুযোগ করে দিলাম, সাথে তোমার কাঁদাও পরিষ্কার করে দিলো।”

এই বলে অরুণিকা সামনে হেঁটে চলে গেল। আহনাফও ভেজা শার্ট গায়ে দিয়ে অরুণিকার পিছু পিছু এসে বলল, “তাই বলে তুই মেয়েগুলোকে সুযোগ করে দিবি?”

“তো!”

“আমি তো তোকে অন্য কারো সাথে সহ্যই করতে পারি না।”

“তুমি সাইকো তাই।”

আহনাফ মলিন দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা এখনো হাঁটছে। আহনাফ হুট করে অরুণিকার হাত ধরে তাকে থামিয়ে বলল, “যাকে হৃদয়ের পুরো অংশে জায়গা দিয়েছি, তাকে অন্য কারো হৃদয়ে জায়গা করে নিতে দেখলে বুকটা ফাঁকা হয়ে যায়। সেই ফাঁকা বুকটার আর্তনাদ শুনেছিস তুই?”

অরুণিকা আহনাফের কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ পুনরায় বলল, “যেই পাঁচ আঙুলের ভাঁজ আমার হাতে আবদ্ধ হওয়ার কথা, সেই ভাঁজে অন্য কারো হাত দেখার অনুভূতি ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক।”

অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিতে যাবে তখন আহনাফ বলল, “তোকে ভালোবাসি মানে শুধু তোকে পাশে চাইছি, তা না। তোকে অন্য কারো পাশেও দেখতে চাই না।”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “ছেড়ে দাও আমার হাত।”

“অরু, তুই কি আমাকে আর ভালোবাসিস না?”

অরুণিকা আহনাফের চোখে চোখ রাখলো। আহনাফ কাতর কন্ঠে বলল, “তোর চুল একটা বাইরের ছেলে কেন ধরবে? আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম সেদিন। তাই চুল কেটে দিয়েছিলাম। তুই ছেলেটাকে আঁটকাবি না? তুই আমার সাথে একটা কমিটেড সম্পর্কে আছিস।”

অরুণিকা এক ঝটকায় আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “বারবার কমিটমেন্ট টেনে আনবে না আমাদের মধ্যে। কমিটমেন্ট একবার নয়, দুই দুইবার ভেঙেছো তুমি।”

“আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”

“ধর্ষক এসে যদি ধর্ষিতার কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে কি সব আগের মতো হয়ে যেতে পারে?”

আহনাফ শক্ত কন্ঠে বলল, “অরু, কি বলছিস এসব?”

“ঠিকই বলছি। তুমি আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছো। তোমাকে হাজার বার সত্য দেখানোর পরও তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না। কিন্তু তোমার মাকে তুমি ঠিকই বিশ্বাস করো। সত্য কথা কি জানো? তোমার আমাকে প্রয়োজন, তাই তুমি এতো সুইট হওয়ার চেষ্টা করছো। তোমার মতো ফালতু, ক্যারেক্টারলেস ছেলেদের মেয়ে ছাড়া চলে না। এখন তুমি তো আবার চৌধুরী সাহেবের আদর্শ নাতি। যেখান সেখান থেকে মেয়ে এনে তো নষ্টামি কর‍তে পারবে না। তোমার ইমেজ নষ্ট হবে। তাই আমার সাথে এতো ভাব জমানোর চেষ্টা করছো। যাতে তোমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হয়। ফিজিক্যালি সেটিস্ফাইড হতে পারো তুমি!”

আহনাফ বাকরুদ্ধ হয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা আহনাফের বুকের উপর আঙুল ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে বলল, “ভালোবাসা মানে প্রেমিকার চোখের ভাষা বুঝে তার সব দুঃখ শুষে নেওয়া। আর তুমি? তুমি আমাকে শুধু দুঃখই দিয়ে গেছো। ভালোবাসা মানে প্রেমিকা শত দূরে গেলেও তার যত্ন নেওয়া, আর তুমি আমাকে মামীর সামনে আরো অপদস্ত করেছো। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছো। ভালোবাসা মানে সম্মান করা, আর তুমি আমাকে পুরো ফ্যামিলির সামনে ক্যারেক্টরলেস বানিয়েছো। ভালোবাসা মানে বিশ্বাস, আর তোমার তো আমার প্রতি বিশ্বাসের বও নেই। তোমার ভালোবাসা ফেইক, চিপ, সো-কল্ড ডাস্টবিন।”

অরুণিকা কথাগুলো বলে হনহনিয়ে চলে গেল। আহনাফ নির্বাক দাঁড়িয়ে অরুণিকার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলো।

(***)

বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে রুহানি। ঘুম আসছে না তার। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে স্নিগ্ধ বিকেলের মুহূর্ত। আজ আহনাফকে কাঁদায় পড়ে যেতে দেখেই স্যাঁতসেঁতে পিচ্ছিল পথে পা রাখতে ভয় পাচ্ছিল রুহানি। সে কাঁপা কাঁপা পা এগিয়ে দিতে গিয়েও দিচ্ছিল না। হঠাৎ একটি হাত এগিয়ে এসেছিল তার দিকে। রুহানি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো আরাফ তার দিকে হাত এগিয়ে দিয়েছে। আরাফ তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, “আমার হাতটা ধরো, আমি আছি।”

অপরাহ্নে ঘটা মুহূর্তটি মনে পড়তেই দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো রুহানি। তার কানে এখনো বাজছে, “আমার হাতটা ধরো, আমি আছি।”

রুহানি সেই আবদার ফেলতে পারে নি আজ। সে শক্ত করে আরাফের হাত ধরেছিল। আরাফের হাত স্পর্শ করেই তার মনে হয়েছিল, জীবনে ভরসা করার মতো হয়তো কেউ এসেছে।

রুহানি বালিশ ছেড়ে উঠে বসলো। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, “স্যারকে নিয়ে এভাবে কেন ভাবছি আমি?”

এদিকে অরুণিকা চোখ খুলে রুহানিকে বসে থাকতে দেখে বলল, “ঘুমাবি না?”

রুহানির কোনো হেলদোল নেই। সে এক দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে লাজুক হাসি। সে চোখ বন্ধ করে তার হাতটা গালে ছোঁয়ালো। মুহূর্তেই যেন পুরো শরীর শিউরে উঠলো তার। অনুভব করতে লাগলো আরাফের হাতটি। নরমও নয়, আবার শক্তও নয়, তবে বেশ দৃঢ় সেই হাতের বন্ধন। সেই দৃঢ়তায় ছিল একরাশ উষ্ণতা।

অরুণিকার ধাক্কায় ঘোর কাটলো রুহানির। অরুণিকা উঠে বসলো। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোর!”

রুহানি লাজুক হেসে বলল, “প্রেম হয়েছে।”

“কার?”

“আমার।”

অরুণিকা বিষ্ময় নিয়ে বলল, “কার সাথে?”

“স্যারের সাথে।”

“আহনাফ?”

রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। এরপর অরুণিকার হাতে হালকা চাপড় মেরে বলল, “দিলি তো রোমান্টিক মুডটা নষ্ট করে? আমার কি মাথা নষ্ট যে আমি বিয়াইত্তা বেডার প্রেমে পড়বো?”

অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “তাহলে কে?”

রুহানি অভিমানী মুখে বলল, “বলবো না।”

রুহানি দেয়ালে হেলান দিয়ে বালিশ কোলে উঠিয়ে বসে পড়লো। অরুণিকা হাত জোড় করে বলল, “মাফ কর, মা। কাহিনি কি বলে আমাকে উদ্ধার কর। ঘুম আসছে আমার।”

রুহানি মুহূর্তেই অভিমান ভেঙে উৎসাহ নিয়ে অরুণিকার হাত ধরে বলল, “আজ কি হয়েছে জানিস?”

“কি?”

রুহানি অরুণিকাকে বলতে বলতেই হারিয়ে গেল অপরাহ্নের শেষ ভাগে।

সরু সাঁকো। নিচে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের প্রবাহ। আরাফ সাঁকোতে উঠে গেল হনহনিয়ে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো রুহানি পা রাখতেই। পা হড়কে গেল তার। চেঁচিয়ে উঠলো সে। আরাফ দ্রুত আঁকড়ে ধরলো রুহানির কোমড়। রুহানি টান খেয়ে আরাফের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে সে। নিঃশ্বাস থমকে গেছে কিছু সময়ের জন্য। হুঁশ ফিরতেই চোখ খুললো রুহানি। মুখোমুখি আরাফকে দেখে শিউরে উঠলো সে। আরাফের নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চশমার আড়ালে লুকোনো চোখগুলো গভীর আর শান্ত। ঠোঁট জোড়া ঈষৎ গোলাপী। ফর্সা গালটি শ্মশ্রু দ্বারা আবৃত। রুহানি শুধু তাকিয়ে দেখছিল সেই সুন্দর পুরুষটিকে।

অরুণিকা রুহানির মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “ভাই, তুই শেষমেশ আরাফের প্রেমে পড়লি?”

রুহানি অরুণিকার মুখ চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল, “আস্তে, গলা ফাঁটিয়ে বলছিস কেন? আর আমি প্রেমে পড়লাম কখন বলেছি? বলেছি, আমি জাস্ট ভালোভাবে ক্রাশ খেয়েছি।”

“ভালোভাবে ক্রাশ খাওয়াও একটা অপশন আছে? আর যাই হোক, আরাফ কিন্তু মানুষ হিসেবে ভালো। কিন্তু দুই পরিবারের যা শীতল সম্পর্ক, বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তোকে।”

“আরাফ স্যারের কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?”

“মোটেও না।”

“শিউর?”

“হান্ড্রেড পারসেন্ট শিউর আমি। কিন্তু আরাফও কি তোকে নিয়ে একই চিন্তা করছে?”

“আরেহ ধুর। এটা কোনো বিষয়ই না। ভাবলে ভাবুক, না ভাবলে নাই। আমি এসব প্র‍্যাক্টিক্যাল চিন্তাভাবনা করতে চাই না। আমি তো আমার ড্রিম ওয়ার্ল্ডেই হ্যাপি। আর সেই ওয়ার্ল্ডের ওয়ান এন্ড অনলি হিরো আরাফ চৌধুরী। লা, লা, লা, লা, লা, লা।”

অরুণিকা রুহানির মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “প্লিজ এসব সুর দেওয়া বন্ধ কর। পুরাই ড্রামাটিক তুই। সারাদিন এসব সিরিয়াল দেখে দেখে তুই বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস।”

“ধুর, তোর টিচার টিচার কথা তোর কাছেই রাখ৷ আমি এতো বাস্তব-টাস্তব চিন্তাভাবনা করে মাথাটা তোর মতো আউলায় ফেলতে চাই না। বেশি বাস্তব চিন্তা করতে কর‍তে মাইনকার চিপায় পড়েছিস। একপাশে হিমালয় তো অন্যপাশে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।”

“ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস?”

“হ্যাঁ, তোর বর।”

“ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে ওর কি মিল?”

“আক্রমণ করে, বড়োজোর এক সপ্তাহ প্রভাব খাটায়, এরপর আবার আবুল। আর যখন আক্রমণ করে তোর মাথার উপর এক্কেবারে সুনামি উঠিয়ে দেয়। আহা! আমার বোনুটা ভাইরাসের খপ্পরে গিয়েই পড়লো! তবে ভাইরাসটা দেখতে সুন্দর।”

অরুণিকা ঠান্ডা গলায় বলল, “মুখশ্রী সুন্দর, অথচ হৃদয় কলুষিত।”

(***)

আরাফ এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি হলেও আজ আকাশ পরিষ্কার। মেঘের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। এক ফালি চাঁদের স্থান হয়েছে সেই আকাশে। তবে আকাশের সৌন্দর্য কৃত্রিম আলোকসজ্জায় ম্লান হয়ে পড়েছে। বিয়ে বাড়ির আলো পুরো গ্রাম আলোকিত করে তুলেছে। আরাফ সেই আলোতে বারান্দায় বসে খোলা চোখে রুহানির মুখখানা কল্পনা করছে। মেয়েটা প্রায়ই শাড়ি পরে। হাওয়ায় যখন রুহানির শাড়ির আঁচল উড়ে, কোনো উপন্যাসের নায়িকার চরিত্রে বসানো যায় তাকে। অকারণেই আরাফের কৌতুহলি মন ভাবছে, “শাড়িতে তো ভালোই লাগে। কিন্তু কপালে টিপ দিলে কেমন লাগবে? আর হাতে চুড়ি পরলে?”

আরাফ হুট করে উঠে বসলো। নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো সে। রুমে ঢুকে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিলো বার কয়েক। এরপর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের মুখোমুখি হয়ে বলল, “আমি আমার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যেতে পারবো না। আমার এসব মোহ থেকে দূরে থাকতে হবে। নয়তো আমার মোহাম্মদপুর গিয়ে থাকা বৃথা হয়ে যাবে।”

(***)

আজ হলুদ অনুষ্ঠান। বরকে হলুদ লাগিয়ে গোসল করানো হবে। সবাই জটলা বেঁধে দেখছে এই দৃশ্য। অরুণিকা বাড়িতে ঢুকে ডায়নিংয়ের কাছে আসতেই একটি হাত তাকে টেনে নিয়ে গেল আবদ্ধ ঘরে। অরুণিকা চমকে উঠলো। সামনে আহনাফকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এভাবে টেনে আনলে যে?”

আহনাফের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। অদ্ভুত তার চাহনি। সে হুট করে অরুণিকার দু’পা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। অরুণিকা হতভম্ব হয়ে গেল আহনাফের আচরণে। আহনাফ কাঁপা গলায় বলল, “অরু, আমাকে একটু ভালোবাসবি? আমি ভুল করে ফেলেছি। আমাকে মাফ করে দে।”

অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে তাকে টেনে উঠাতে গিয়েও পারলো না। উলটো আহনাফ তার কোমড় জড়িয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে তোমার?”

“আমার তোকে খুব খুব খুব প্রয়োজন।”

“কি চাও তুমি?”

“আমরা সব ভুলে সংসারটা শুরু করবো। তুই চলে আয় আমার কাছে। আমরা আলাদা বাসা নেবো। তুই আর আমি থাকবো।”

“তারপর।”

“তোকে ভালোবাসবো আমি। তোর সব অভিযোগ দূর করবো।”

অরুণিকা মৃদু হেসে আহনাফের কপালে চুমু খেলো। আহনাফের কথা আঁটকে গেল গলায়। মিনিট খানিক অরুণিকার দিকে তাকিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে তাকে মেঝেতে শুইয়ে দিল। হাত বুলিয়ে দিল অরুণিকার গালে, ঠোঁটে। পরমুহূর্তেই অধর ছুঁয়ে দিল অরুণিকার থুতনিতে। আহনাফের গরম নিঃশ্বাস অরুণিকার ঘাড়ে এসে পড়ছে, অথচ সে মোটেও আবেগপ্রবণ হলো না। তার চোখে স্পষ্ট প্রতিশোধস্পৃহা। আহনাফ অরুণিকার ঘাড়ে, গলার তার উন্মাদ স্পর্শ দিয়ে গেল। অরুণিকা এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আহনাফ অরুণিকার অধরে চুমু খেল। গভীর চুম্বনেও কোনো হেলদোল নেই মেয়েটির। আহনাফ এবার দ্বিধা নিয়ে সরে পড়লো। অরুণিকাও যন্ত্রের ন্যায় উঠে বসলো। আহনাফ কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। তবে অরুণিকাকে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। আহনাফ চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সরি।”

অরুণিকা গায়ের উড়না ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়তেই আহনাফ ধড়াম করে দরজা বেঁধে দিলো। অরুণিকা একনজর সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। এদিকে আহনাফ দরজা বেঁধে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেঝেতে। নিজের গালে নিজেই এলোপাতাড়ি চড় মারলো। এরপর ক্লান্ত হয়ে ধপ করে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো আহনাফ। আজ আবার সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। শিরিন সুলতানার আনা মেডিসিনগুলো খালি করে ফেলেছে সে। ওষুধগুলো খেলে মানসিক অস্থিরতা কেটে গেলেও, শারীরিকভাবে বেশ অস্থির হয়ে পড়ে সে। আহনাফ এক দৃষ্টিতে ঘূর্ণনরত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো, আর নিজের মনেই বলতে লাগলো, “অরু, তুই ঠিক বলেছিস। আমি ফালতু, ক্যারেক্টরলেস। কিন্তু আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি, অরু। তুই আশেপাশে না থাকলে আমার দমবন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নিজেকে আমি আর ধরে রাখতে পারছি না। দিনদিন হিংস্র হয়ে যাচ্ছি। খুব খারাপ চিন্তা আসে মাথায়। কি করবো আমি? আমি পাগল হয়ে যাবো! পাগল হয়ে যাবো আমি।”

(***)

অরুণিকা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গোধূলীর আলো মাখা আকাশের দিকে। অরুণিকার গলায় উন্মুক্ত দাগ বেশ দৃশ্যমান। আরাফ অগোচরেই তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি ব্যর্থ। ভাই হিসেবেও, বন্ধু হিসেবেও। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস, অরু।”

অরুণিকা আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কেন ক্ষমা চাইছো? তুমি আবার কি করেছো?”

“আহনাফ তোর সাথে জোরাজুরি করেছে, তাই না?”

অরুণিকা মলিন হেসে বলল, “কি আর বলবো! আমার কিছুই বলার নেই।”

“যতোদিন এখানে আছিস, আহনাফ যা করে একটু সহ্য করিস। শহরে ফিরেই তোকে আহনাফের ব্যাপারে জরুরি কিছু কথা বলার আছে। শুধু তোকে না, পুরো পরিবারকে জানাতে হবে। এখন বললে দশ কান হতে সময় লাগবে না।”

এই বলে আরাফ চলে গেল। অরুণিকা ভাবতে লাগলো, “আরাফ কি এমন বলবে আহনাফের ব্যাপারে যা দশ কান হলে সমস্যা?”

(***)

গিটার নিয়ে ছাদে বসে আছে তূর্য। চোখ বন্ধ করে গিটারে সুর তুললো সে। গলা ছেড়ে গাইতে লাগল গান। তার মনে জমানো আক্ষেপ বেরিয়ে আসতে লাগলো গানের সুরে।

“খোলা জানালা দখিনের বাতাসে
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে,
তখন তুমি এসে হেসে বলে দাও- আছি তোমার পাশে,
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা, পথ চলতে ভীষণ ভয়।
তুমি এসে বলে দাও, আছি আমি পাশে করো না কিছুতেই ভয়,
কখনো ভাবিনি, চলে যাবে তুমি- আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
কখনো বুঝিনি ফিরে আসবেনা- আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।
.
অনেক পথের পথিক আমি- ক্লান্তি সর্বশেষ
তোমার পথের ঠিকানা খুজে আমি আজ অবশেষ
তুমি আমার প্রথম ও শেষ জীবনের ভালোবাসা
তোমার মাঝেই তাইতো আমার জীবনের শত আশা
কখনো ভাবিনি চলে যাবে তুমি, আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
কখনো বুঝিনি ফিরে আসবেনা, আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।”

গলা ভারী হয়ে আসতেই সুর হারিয়ে ফেললো তূর্য। থেমে গেলো মাঝপথেই। গলা খাঁকারি দিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেল রুদবাকে দেখে। রুদবার ঠোঁটে স্মিত হাসি। তূর্য গিটার হাতে নিয়ে রুদবাকে পাশ কাটিয়ে নেমে যাবে, এমন মুহূর্তে রুদবা বলল, “আমার খুব শখ আপনার সাথে গান করার! আপনি কি আপনার গাওয়া কোনো গানে আমাকে সুর দেওয়ার সুযোগ দেবেন?”

তূর্য দাঁড়িয়ে গেল। পিছু না ফিরেই শক্ত কন্ঠে বলল, “তোমাকে সেই অধিকার দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”

রুদবা এই প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারলো না। সে তূর্যের পথ রোধ করে দাঁড়ালো। মাথা নামিয়ে বলল, “আমি আপনাকে ভালোবাসি, তূর্য।”

তূর্য রুদবার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রুদবাকে আঘাত করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু এই সত্যটা কখনোই পরিবর্তন হবে না যে তার হৃদয় দখল করে রেখেছে এক শ্যামকন্যা। তূর্য রুদবার হাত ধরলো। রুদবা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। তূর্য মলিন হেসে বলল, “তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউওর। কিন্তু কাউকে ভালোবাসার জন্য তোমার মন এখনো শক্ত হয় নি। ভালোবাসা অনেক ভয়ংকর। অনেক পরীক্ষা নেয় এই ভালোবাসা। আমি তোমাকে দেখেই বলে দিতে পারবো, তুমি এই জার্নিতে ফেইল করবে।”

রুদবা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “একদমই না। আপনি আমাকে সুযোগটা দিয়ে দেখুন।”

“শোনো মেয়ে, আমি কাউকে সুযোগ দেই না। তুমি অরুণিকার বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই আমি তোমার সাথে ধোঁয়াশা করতে চাই না। আমাকে ভালোবেসো না। কষ্ট পাবে।”

“যদি বলি, আমি কষ্ট পেতেও রাজি।”

“আমি বলবো, তুমি এখনো অপরিপক্ব। এসব ভালোবাসায় সময় নষ্ট করা মনের সাথে যুদ্ধ করার মতো।”

“তূর্য শেখ যদি কোনো যুদ্ধ ক্ষেত্র হয়, তবে আমি সেই যুদ্ধ জয় করবোই।”

তূর্য ক্ষীণ হেসে বলল, “যদি তূর্য শেখ সত্যিই যুদ্ধক্ষেত্র হয়, তাহলে তোমার জয় অসম্ভব। কারণ এই যুদ্ধ ফিক্সিং।”

“আপনি কি তবে মীরজাফর হতে চান?”

“আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দেই নি। যাকে দিয়েছি, তার জন্য ফিক্সিং করছি।”

রুদবার মুখটা মলিন হয়ে গেল। সে শুকনো কন্ঠে বলল, “কে সে?”

“কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না।”

এই বলে তূর্য নেমে পড়লো ছাদ থেকে। রুদবার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে ভেজা কন্ঠে বললো, “ফেয়ার হবে সব। কোনো ফিক্সিং হবে না। আমি আপনার মনে জায়গা করে নেবোই।”

(***)

শিরিন সুলতানার সামনে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ ও আরাফ। শিরিন সুলতানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাদের দিকে। আরাফ বলল, “আপনি আহনাফকে আবার সেই ড্রাগস দিয়েছেন?”

“পাগল হয়ে গেছো তুমি? আমি আমার ছেলেকে ড্রাগস দেবো?”

“আহনাফের সাথে এক ছাদের নিচে থাকি আমরা। আপনিই ওকে ড্রাগস দিচ্ছেন।”

“উল্টোপাল্টা কথা বলা বন্ধ করো।”

“তাহলে মেডিসিনগুলো ও আবার কীভাবে পেলো?”

তাহমিদ বলল, “আপনি কি আসলেই মা? আপনি কি জানেন আহনাফের হার্ট কতোটা দুর্বল হয়ে গেছে। শুধু আপনার দেওয়া মেডিসিনগুলো পাঁচ বছর ধরে অন্ধের মতো খেয়েছে ও। আপনার কি একটুও মনুষ্যত্ববোধ নেই?”

শিরিন সুলতানা হালকা হেসে বলল, “তোমরা তাহলে জেনে গেছো ও ড্রাগস নেয়? ওকে প্রমাণ করো৷ আমি দিয়েছি সেটা প্রমাণ করো।”

“আহনাফই এর প্রমাণ।”

“যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে অপদস্ত করতে পারে, সে নিজের মা’কেও পারবে। আর তোমরা কি বললে? আহনাফ ড্রাগ এডিক্টেট? একজন ড্রাগ এডিক্টেট ছেলের কথা কেউ বিশ্বাস করবে কেন?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আহনাফ আপনার ছেলে। আর আপনি এসব মেডিসিন দিয়ে ওকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছেন।”

“তোমাদের কথা আহনাফ কখনো বিশ্বাস করবে না। আমার ছেলে আমাকে বিশ্বাস করে। তোমরা গিয়ে যদি ওকে বলো, আমি ওকে ড্রাগস দিচ্ছি, ও তোমাদের অবিশ্বাস করবে। কিন্তু আমাকে না। আর যদি ও তোমাদের বিশ্বাসও করে, তাহলেও বা কি হবে। সবাই ভাববে অরুণিকাকে যেমন মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে, এবার আমাকে দিচ্ছে।”

আরাফ ও তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একটু আগেই আহনাফের রুমে গিয়ে তার অবস্থা দেখেই তারা বুঝে গেছে, আহনাফ আবার সেই পথে পা দিয়েছে। তাই এবার তারা শিরিন সুলতানার মুখোমুখি হতে বাধ্য হলো। কিন্তু শিরিন সুলতানা নির্ভীক। তিনি হনহনিয়ে চলে যেতেই আরাফ বলল, “উনাকে এতো সাহস কে দিয়েছে?”

তাহমিদ বলল, “নিজের ছেলেকে যে ড্রাগস দিতে পারে, তিলে তিলে নিজের ছেলের জীবন যে নষ্ট করে দিতে পারে, তার পক্ষে খুন করা অসম্ভব কিছু না। অরুণিকার কথায় ঠিক। আমার মনে হচ্ছে আবরারকে উনিই খুন করেছেন। আর এর পেছনে অনেক বড় কারণ আছে।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪১ ||

সন্ধ্যা থেকেই ঝড়ো হাওয়া বইছে। নিস্তব্ধ গ্রামে বৃষ্টির সুর ঝংকার তুলছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে কাদামাটির ঘ্রাণ। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে আহনাফ। বাড়িতে কেউ নেই। সবাই পাশের বাড়ির মেহেদি অনুষ্ঠানে গেছে। শুধু সে যায় নি। তার মন আজ প্রকৃতির মতোই ব্যাকুল। শান্ত চাহনি, অথচ হৃদয়ে ঝড় উঠেছে। বজ্রপাতের শব্দ হতেই বিদ্যুতটাও চলে গেল। মুহূর্তেই পুরো গ্রামে ছেয়ে গেল অন্ধকার। তবে এর স্থায়িত্ব বেশিক্ষণের জন্য হলো না। বিয়ে বাড়িতে জেনারেটর চালু করা হয়েছে। পুরো গ্রাম মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো। সেই আলো জ্বলে উঠলো মিনিট খানিকের মধ্যেই। কিন্তু আহনাফ এই মুহূর্তে অন্ধকারের আশ্রয় খুঁজছে। যেই অন্ধকার তার জীবনে নেমে আসা আঁধারের সাথে পাল্লা দিয়ে তাকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারবে। আহনাফ জানালার পাশ থেকে সরে এলো। হঠাৎ তার রুমের দরজা খুলে গেল। সামনে তাকাতেই আহনাফের চোখে একরাশ বিষ্ময় ভীড় করলো। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক স্নিগ্ধ কন্যা, যার পরনে হলুদ শাড়ি, এলোমেলো চুল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে, হাতে এক গুচ্ছ কাচের চুড়ি। মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই স্নিগ্ধ কন্যা। আহনাফ এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। স্নিগ্ধ কন্যার শরীরে লেগে আছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। পারফিউম ও বৃষ্টির স্পর্শের মিশ্রণে এই ঘ্রাণ সৃষ্টি হয়েছে। আহনাফ হাত এগিয়ে দিতে গিয়েও থমকে গেল। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল স্নিগ্ধ কন্যার শত শত অভিযোগ। চোখ নামিয়ে নিলো আহনাফ। পাপ হবে এই মেয়েকে দেখলে। তার দৃষ্টি কলুষিত! এমন স্নিগ্ধ কন্যা তার দৃষ্টিতে এলেই যদি পবিত্রতা হারায়?

অরুণিকা মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে বলল, “তুমি মেহেদি অনুষ্ঠানে যাচ্ছো না?”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “শরীর ভালো না আমার।”

“বাসায় কেউ নেই। একা একা কি করবে?”

“তুই এখানে কি করছিস?”

“দাদি তোমাকে ডেকে দিতে বলেছে। তোমাকে খুঁজছে সবাই।”

“তুই চলে যা। আমাকে ডাকতে আরাফ কিংবা তাহমিদ আসতে পারতো! তুই কেন এসেছিস? তুই আমার কাছে সেইফ না, অরু। আমি ভালো প্রেমিক হতে পারি নি, না পেরেছি ভালো হাসবেন্ড হতে। আমি তো ভালো মানুষই হই নি। পাপ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। তুই কেন সেই পাপের ভাগিদার হবি?”

নিস্তব্ধ কক্ষে অরুণিকার দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট শোনা গেল। আহনাফ অরুণিকার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি মোহাম্মদপুর উঠেছি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, আমার ভাই হত্যার প্রতিশোধ। তোকে আঘাত করার জন্য। ভেবেছি তোকে অনেক কষ্ট দেবো। তোকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পাবো। কিন্তু পারি নি। আমার নিজেরই অনেক কষ্ট হচ্ছে। তোর কাছে ভালোবাসা মানে বিশ্বাস, সম্মান। আর আহনাফের ভালোবাসা অন্যরকম। আমার ভালোবাসার কোনো ডেফিনেশন নেই। আমি শুধু এইটুকু জানি, তোকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না আমি। তোর প্রথম ও শেষ ভালোবাসা হতে চাই আমি। তুই যতোবার প্রেমে পড়বি, ঠিক ততোবারই তোর সামনে যাতে আমি এসে দাঁড়াই। আমি চাই, তোর প্রেম শুধু আমাকে ঘিরেই আবদ্ধ হোক। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি, অরু। তোর ডিকশনারিতে এটা ভালোবাসা না হোক। আমার কাছে এটা আমার শিরায় প্রবাহিত রক্ত। আমার কাছে তুই নিঃশ্বাসের মতো। তোকে হারিয়ে ফেলবো ভাবতেই দম আটকে যায়। আমার ভালোবাসা হয়তো পৃথিবীর কোনো সুপুরুষের সাথে মিলবে না। আমি তো অপসত্ত্ব। আর অপসত্ত্বের ভালোবাসা এমনই হয়।”

অরুণিকা ও আহনাফের দৃষ্টি মিললো। আহনাফ চোখ সরিয়ে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিস। তোকে হারিয়ে ফেলছি, এটা বুঝতে পেরেই আমি অনুভব করেছি এই যন্ত্রণা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। আমাকে এভাবে মেরে ফেলিস না, অরু। আমি এভাবে বাঁচতে পারবো না। আমার সবাইকে হারানোর ক্ষমতা নেই।”

আহনাফ হাত জোড় করে অরুণিকার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। অরুণিকা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। এরপর হালকা হেসে আহনাফের সামনে বসে বলল, “আমি তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিলাম। আমিও চাই তোমার আমার একটা সুন্দর গোছানো সংসার হোক। আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি, আহনাফ। তুমিই তো আমার ভালোবাসার মানুষ।”

আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে তার হাত ধরে উন্মাদের মতো চুমু খেতে লাগলো সেই হাতে। আহনাফের উষ্ণজল অরুণিকার হাত ছুঁয়ে দিতেই অরুণিকার চোখ জোড়ায় ভীড় করলো একরাশ অপরাধবোধ। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যই ছিল সেই অনুতাপ। মুহূর্তেই সেই চোখ জোড়ায় ভীড় করলো রহস্য।

আহনাফ কাঁপা হাতে অরুণিকার নরম গাল স্পর্শ করলো। দু’হাতে আগলে নিলো সেই গাল। এলোমেলো ভাবে হাতড়াতে লাগলো অরুণিকার মুখ, চোখ, নাক, ঠোঁট। নিস্তব্ধ কক্ষে এবার শুধু একপাক্ষিক ফুঁপানো কান্নার শব্দ ছড়িয়ে পড়লো। আহনাফ শার্টের হাতায় চোখ মুছে অরুণিকার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। গভীর সেই স্পর্শ। অরুণিকা চোখ বুজলো সেই স্পর্শে। আহনাফের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অরুণিকার নাকে ও ঠোঁটে আছড়ে পড়ছে। শরীর অসার হয়ে আসছে অরুণিকার। আহনাফ ধীরে ধীরে অরুণিকার হাত স্পর্শ করলো। অরুণিকার আঙুলের ভাঁজে আঙুল জড়ালো। সেই হাত টেনে এনে নিজের গালে ঘষতে লাগলো আহনাফ। তার দৃষ্টি অরুণিকার চোখের গভীরতায় ডুবে আছে। আহনাফের খোঁচা খোঁচা দাড়ি অরুণিকার হাতের উলটো পিঠ ছুঁয়ে দিচ্ছে বারংবার। আর সেই স্পর্শে অরুণিকার শরীর শিউরে উঠছে। আহনাফ এবার অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। টেনে আনলো তাকে নিজের কাছে। অরুণিকার মাথাটা বুকের সাথে ঠেকালো। মাথায় চুমু খেলো। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে। এই বন্ধন এতো দৃঢ় ছিল যে অরুণিকার বেশ অস্বস্তিবোধ হলো। যদি এই মানুষটা আবার তাকে হেনস্তা করে? একরাশ দ্বিধা নিয়েই আহনাফের বন্ধনে সায় দিল অরুণিকা। অরুণিকার সম্মতিতে আহনাফ তার উন্মুক্ত ঘাড়ে অধর ছোঁয়ালো। অরুণিকাও সেই স্পর্শের বিরোধ করলো না। আহনাফ এবার অরুণিকার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করলো। এবারও কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো না অরুণিকা। আহনাফের মন শান্ত হলো। তার মন তাকে জানান দিলো, তার অরু তার কাছেই ফিরে এসেছে। আহনাফ কোলে তুলে নিল অরুণিকাকে। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। অরুণিকা বেশ বুঝতে পারছে আহনাফ তার অনুমতি চায়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য এখানেই শেষ। সে উঠে বসলো। আহনাফ ব্যস্ত অরুণিকার শরীরের ঘ্রাণ নিতে। অরুণিকা ধীর কন্ঠে বলল, “আমাকে আরেকটু সময় দাও।”

আহনাফ থেমে গেল। সোজা হয়ে বসলো সে। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “তুই অনুমতি না দিলে আমি তোকে স্পর্শ করবো না।”

“আমি আগে পড়াশুনা শেষ কর‍তে চাই। আর বাসায় এখনো কেউ পুরোপুরি সম্পর্কটা মেনে নেয় নি। আমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়েও হয় নি। এরপর না হয়!”

আহনাফের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে অরুণিকার হাতে চুমু খেয়ে বলল, “আমি বাসায় ফিরেই আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করবো। সবাই রাজি হবে। মা হয়তো দ্বিমত করবে। কিন্তু আমি রাজি করিয়ে নেবো। এরপর আমরা আলাদা বাসায় উঠবো। মায়ের সাথে তোর অনেক সমস্যা। আমি তোকে ওখানে রাখবো না। দেখিস, আমাদের একটা বাচ্চা হয়ে গেলে, মা ঠিকই তোকে মেনে নেবে।”

অরুণিকা আহনাফের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তার চোখে আবার সেই অনুতাপ ভীড় করলো। কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়াল অরুণিকা। বলল, “অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। দাদি কি মনে করবে? তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছিল! চলো।”

এই বলে অরুণিকা বেরিয়ে পড়লো। আহনাফ চুল খামচে ধরে হাসলো। বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর সে প্রাণ খুলে হাসছে।

(***)

রুহানির দৃষ্টি আজ অস্থির। একটু পরপর চোখ আরাফের মাঝেই নিবদ্ধ হচ্ছে। সবুজ পাঞ্জাবিতে মানুষটাকে চমৎকার লাগছে। চোখে চশমা, গম্ভীর মুখখানায় মৃদু হাসি, চুল খাড়া, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে কনুই অব্ধি। হাতে একটা কালো ডায়ালের ঘড়ি। ফর্সা হাতে বেশ মানানসই সেই ঘড়িটি।
ব্যস্ত মানুষদের এতো সুদর্শন লাগে, এই প্রথম রুহানি দেখেছে। আরাফ একটু পরপর বাবুর্চিদের কাজ দেখছে। কাজের লোকেদের কাজ দেখিয়ে দিচ্ছে। বেশ পরিপাটি মানুষটা! রুহানি মুগ্ধ হয়ে দেখছে আরাফকে। কাল থেকেই তার মাথায় আরাফের ভূত চড়ে বসেছে। স্যার নামক সুন্দর পুরুষটাকে পটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। প্রত্যাখ্যান ফেরত এলেও তার আপত্তি নেই। মানসিক ভাবে প্রস্তুত সে। রুহানি উঠে চলে এলো আরাফের পাশে। নরম সুরে বলল, “স্যার, আমি কি কোনো হ্যাল্প করতে পারি?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “যেখানে বসে ছিলে, ওখানে বসে থাকলেই আমার অনেক বড় হ্যাল্প হবে।”

আরাফের কথার অর্থ মিনিট দুয়েক পর মাথায় ঢুকলো তার। পরমুহূর্তেই মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এভাবে সরাসরি অপমান!”

রুহানি পাশ ফিরে দেখলো আরাফ তার ধারের কাছেও নেই। সে আরাফের দিকে এগিয়ে আসতেই আরাফ তাকে খেয়াল না করে পিছু ফিরলো, ওমনি দু’জনই ধাক্কা খেলো। রুহানি কয়েক পা পিছিয়ে পড়তেই আরাফ তার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। রুহানি ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ। সেও সুযোগ নিয়ে আরাফের বুকে কান পাতলো। অলিন্দ-নিলয়ের কর্মক্ষমতা বোধহয় রুহানির স্পর্শে আরো বেড়ে গেছে! রুহানি মুখ চেপে হাসলো। আরাফ তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। বানরের মতো লাফাচ্ছো কেন?”

রুহানির মুখখানা মুহূর্তেই ছোট হয়ে গেল। অভিমানী কন্ঠে বলল, “একে তো আমি আপনাকে হ্যাল্প করতে চাইছি, আর ওখানে আপনি উল্টো আমাকে বানর বলছেন? আপনার তো আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ধন্যবাদ দিলেও কম হবে। কোথাও কি দেখেছেন স্টুডেন্ট স্যারদের হ্যাল্প করতে আসে? স্টুডেন্টদের হ্যাল্প করা যেখানে স্যারদের দায়িত্ব, সেখানে আপনি ফ্রিতেও হ্যাল্প করেন না। মাস শেষে মোটা মোটা টাকা নিয়ে যান। মা আমাকে এক টাকাও পকেটমানি দেয় না। আর আপনি আমাকে পড়িয়েই আমার ভাগের টাকাটাও নিয়ে যাচ্ছেন। এতো মাস পড়েছি, খুশি হয়ে একটা চকোলেটও উঠে নি আপনার হাতে৷ আর আজ আমি, রুহানি, আমার মন উদার, তাই ফ্রি হ্যাল্প করতে এসেছি। ওখানে আপনি আমাকে বানর বলে অপমান করলেন? আসলে আমারই ভুল হয়েছে। এখন তো কেয়ামতের যুগ চলে এসেছে। এখানে কারো হ্যাল্প করতে চাইলেও দোষ।”

রুহানি থামতেই আরাফ বলল, “হয়েছে। শেষ হয়েছে তোমার কথা? এবার আমি বলি?”

রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আমি কি আপনার মুখে গ্লু লাগিয়ে দিয়েছি? আপনার মুখ, আপনি তো বলবেনই। এটা আপনার অধিকার। স্টুডেন্ট হয়ে স্যারের বাকস্বাধীনতা ধ্বংস করার ক্ষমতা আমার আছে!”

আরাফ হাত জোড় করে বলল, “আল্লাহর ওয়াস্তে, চুপ করো। আমি বলি?”

“হুম, হুম। কন্টিনিউ।”

আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “প্রথমত তুমি গেস্ট, আর এটা তোমার কাজও না। তাই তোমার হ্যাল্পের প্রয়োজন ছিল না আমার। দ্বিতীয়ত, তুমি কি বললে? আমি খুশি হয়ে তোমাকে চকলেট দেবো? তোমার মতো গাধাকে পড়িয়ে উলটো আমার শিক্ষকতার পেশায় প্রশ্নবিদ্ধ হবো আমি। তোমার তো উলটো আমাকে চকলেট দেওয়া উচিত। পরীক্ষা নিলেও ডাব্বা মারো।”

রুহানি আরাফের দিকে আঙুল তাক করে বলল, “ও হ্যালো, গরম পড়লে শরবত, বৃষ্টি পড়লে চা, বিকেলে এলে নানা পদের নাস্তা, দুপুরে এলে যে ভাত গিলে যান, কোথাকার কোন প্রেসিডেন্ট যে আপনাকে এতো আদর সোহাগে মাথায় তুলবে আমার মা? কোনো শুকরিয়া নাই। তাওবা, তাওবা, তাওবা এমন না শুকর করা মানুষ প্রথম দেখেছি আমি। আপনাকে আমি জীবনেও হ্যাল্প করবো না। আল্লাহ হাফেজ।”

রুহানি হনহনিয়ে চলে গেল। আরাফ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসির শব্দ কানে আসতেই পাশ ফিরে দেখলো, তাহমিদ তার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। আরাফ তাহমিদের পেটে হালকা ঘুষি মেরে বলল, “হাসছিস কেন?”

“স্টুডেন্টের বাসায় ভাত গিলে আসলে এমনই হয়।”

“আমি কি খাবো বলেছি ওদের? ওর মা আমাকে জোর করে বসিয়ে দেয়।”

“যাই হোক, মেয়ে তো দিয়ে দিলো বাঁশ।”

আরাফ চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো। এদিকে রুহানি রাগে ফোঁসফোঁস করছে। আর মনে মনে বলছে, “আমাকে প্রত্যাখান করবে? আমাকে বানর বলবে? ইডিয়ট স্যার, তোমাকে পরের বার আমি কলের পানি দিয়ে শরবত বানাই খাওয়াবো।”

(***)

খয়েরী শার্ট গায়ে আহনাফ মেহেদির আসরে ঢুকলো। আহনাফকে দেখে মিসেস চৌধুরী বেশ খুশি হলেন। নাতি অসুস্থ, তাই তিনি বেশ চিন্তিত। আহনাফ আসতেই আসর জমলো। বিয়ে বাড়িতে কি গান-বাজনা না হলে জমে! এই বলে সবাই আহনাফকে গান গাওয়ার জন্য জোর কর‍তে লাগলো। বেশ ভালো গান করে আহনাফ। কয়েক বছর আগেও ছুটিতে গ্রামে এলে সন্ধ্যায় বড়-বুড়োদের আড্ডার পরিসমাপ্তি ঘটতো আহনাফ আর তূর্যের গানে। আজ তূর্য নেই। কিন্তু আহনাফকে পেয়ে তারা সেই মুহূর্তের পুনরাবৃত্তি চায়। আহনাফ সবার অনুরোধে খালি গলায় গান ধরলো। তার দৃষ্টি অরুণিকার দিকে।

“তুমি আমার নও তো সুখ- তুমি সুখের বেদনা,
সব স্বপ্নের রঙ হয় না তো- বেদনার মত নয় রঙা
জীবনের সব কথা নয়- আমি জীবনটাকে বলতে চাই
হয়তো দুর্ভাগ্য নয়- সে তো ভালবাসার কাব্য কয়
আমি কবি নই তবু কাব্যের ভাষায় বলব আজ,
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে- স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চায়।”

আহনাফ গান শেষ করে মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়ালো। অরুণিকাও চোখ সরিয়ে নিলো। এরপর আহনাফ আরাফ ও তাহমিদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কাজ তদারকি করলো। এদিকে গ্রামের সখীদের জোরাজুরিতে দু’হাতে মেহেদি পরেছে অরুণিকা। গল্প করতে করতে সে ভুলেই গিয়েছিল রাতের খাবার খায় নি। এখন ক্ষুধায় তার পেটে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। সে এদিক-ওদিক রুহানিকে খুঁজছে। রুহানি অন্তত ভাত খাইয়ে দিতে পারবে তাকে। অরুণিকা বাড়িতে ঢুকেই রুহানির নাম ধরে ডাকছে, হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ালো আহনাফ। অরুণিকা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। অরুণিকা বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, “এভাবে টপকালে কেন? ভয় পেয়েছি না!”

“তুই আবার ভয় পাস? তুই তো ইদানিং আমাকেই ভয় পাইয়ে দিস।”

“আমি আবার কীভাবে ভয় লাগালাম তোমাকে?”

“এই যে হুটহাট অভিমান করে বসিস। প্রাণ হাতে চলে আসে আমার। এই বুঝি ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলি।”

অরুণিকা ভেংচি কেটে বলল, “আমার এতো উড়ার শখ নেই। আমার বোনুকে দেখেছো?”

“বোনু আবার কে?”

“রুহানি।”

“ওই গাধাটা?”

অরুণিকা নাক ফুলিয়ে বলল, “গাধা বলবে না ওকে।”

“আমি কখন বললাম? আরাফই তো বলে। তবে চিন্তা করিস না, ইংরেজিতে পাশ করবে এবার।”

অরুণিকা চোখ ছোট করে তাকালো। আহনাফ হালকা হেসে বলল,”আচ্ছা, বাদ দে। আগে বল, ওকে কেন খুঁজছিস?”

“ক্ষিধে পেয়েছে। মেয়েগুলো জোর করে মেহেদি লাগিয়ে দিল। কি সুন্দর হয়েছে! এভাবে ধুয়ে ফেলতেও ইচ্ছে করছে না। তাই রুহানিকে খুঁজছি। ও আমাকে খাইয়ে দেবে না হয়।”

আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে বলল, “তুই বস। আমি আসছি।”

অরুণিকা নিজের রুমে এসে বসলো। একটু পর আহনাফকে রুমে ঢুকতে দেখে অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “রুহানি কোথায়?”

আহনাফ অরুণিকার সামনে বসে বলল, “তোর জলজ্যান্ত একটা বর আছে। আর তুই রুহানিকে খুঁজছিস? আমি আছি, আমার দুইটা হাত এখনো অক্ষত আছে। আমি আমার বউকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে পারবো। এখন হা কর। আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।”

আহনাফ বসে পড়লো অরুণিকার সামনে। ভাত মেখে তার সামনে ধরলো। সে এখনো নির্বাক তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। তার চোখের সামনে সেই ছেলেবেলার স্মৃতি ভেসে উঠলো। বাবা-মার মৃত্যুতে কতোদিন নিজ হাতে খায় নি সে। খাওয়া ভুলে গিয়েছিল অরুণিকা। কিন্তু আহনাফ ভুলে নি একবেলাও। প্রতিবেলায় নিজ হাতে অরুণিকাকে খাইয়ে দিয়েছিল সে। আজ অরুণিকা আবারও সেই যত্নবান, দায়িত্বশীল আহনাফকে দেখছে। এই আহনাফকেই তো ভালোবেসেছিল সে। বুকটা হুঁহুঁ করে উঠলো তার। নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে বলল, “এই আহনাফ ভয়ংকর। একে বিশ্বাস করলেই আমি ঠকবো। দু’দুবার ঠকেছি আমি। এবার আমি ঠকবো না, আহনাফ চৌধুরী। ঠকে যাওয়ার যন্ত্রণা কেমন অনুভূত হয়, সেটা তুমি অনুভব করবে এবার। অনেক সহ্য করেছি আমি। হত্যার বদলে হত্যা হয়। ঠিক তেমনি আমার মন হত্যার শোধ উঠাবো তোমার মন হত্যা করে। আমারটা তো নিষ্পাপ ছিল। তোমারটা কলুষিত। দেখা যাক, কার আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বেশি।”

(***)

আহনাফ অরুণিকাকে ভাত খাইয়ে বের হবে ওমনি শিরিন সুলতানা তাকে টেনে নিয়ে গেলেন একপাশে। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি করছো, মা?”

“তুই ওই মেয়ের সাথে ছিপকে আছিস কেন?”

“সি ইজ মাই ওয়াইফ।”

“আহনাফ, তোর মাথা ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে আমার মাথা।”

“নিশ্চয় তুই ওষুধগুলো বন্ধ করে দিয়েছিস।”

আহনাফ প্লেট রেখে হাতটা নীরবে ধুয়ে এসে বলল, “কিছু হলেই ওষুধ বন্ধের কথা কেন বলছো তুমি? কি আছে সেই ওষুধে? অরুর কাছ থেকে দূরে সরানোর মেডিসিন দিচ্ছো না-কি আমাকে? যতোবারই আমি ওর কাছে যাই, তুমি মনে করো আমি ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছি!”

শিরিন সুলতানা ঘাবড়ে গেলেন। ইদানিং আহনাফ তার কথা শুনতেই চাইছে না। ছেলের উপর ভালোভাবেই কালো জাদু করেছিলেন। তাহলে কাজ হচ্ছে না কেন? চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। আহনাফ তার রুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। শিরিন সুলতানা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনই শিষ বাজাতে বাজাতে তার সামনে এসে দাঁড়ালো আরাফ। আরাফকে দেখেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন তিনি। আরাফ বলল, “যদি কেউ ডালে ডালে চলে, আমি চলি পাতায় পাতায়। কেউ পাতায় চলতে গেলে, আমি খুঁজি শিরা। আর কেউ যদি শিরায় এসে দাঁড়ায়, আমি পৌঁছে যাই উপশিরায়। তবে এই উপশিরায় বুদ্ধিহীন নারীদের জায়গা নেই।”

শিরিন সুলতানা শাসিত সুরে বললেন, “তুমি আমার ছেলেকে ম্যানিপুলেট করছো!”

“এক্সকিউজ মি! আমি আহনাফকে ম্যানিপুলেট করছি না। তবে বিষ ছাড়ানোর মেডিসিনও আমার কাছে আছে। ইউ নৌ, আমি এই বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ ডাক্তার।”

“আমি তোমার চাচী। আর তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো?”

“ডিম আগে না মুরগি আগে?”

“কি!”

“এই প্রশ্নের উত্তর জটিল। তবে আপনাকে একটা সহজ প্রশ্ন করতেই পারি। চাচী আগে না চাচাতো ভাই আগে?”

শিরিন সুলতানা ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। আরাফ বলল, “আমি আমার ভাইকে আপনার মতো জালিম মুরগি থেকে প্রটেক্ট করার জন্য যা যা করার সব করবো। ইটস মাই চ্যালেঞ্জ, মিসেস শিরিন সুলতানা। খুব শীঘ্রই আপনাকে এক্সপোজ করবো আমি। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

(***)

প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ইভান, ইমন ও তূর্য আহনাফের রুমের দরজা ভেঙে ভেতরে যা আছে সব ঘেঁটে ফেললো। অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর একটা ডায়েরির ভেতর থেকে একটা চাবি বেরিয়ে এলো। চাবি পড়ার শব্দ শুনেই তিনজনই থেমে গেল। ইমন চাবিটা নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এটা কীসের চাবি?”

ইভান আলমারির দরজা খুলে বলল, “ওই লকারটার চাবি কি-না দেখ। বাকি সব তো চেক করা হয়ে গেছে। ওই লকারটাই খোঁজা বাকি।”

তূর্য চাবিটা নিয়ে সোজা লকারটির সামনে বসে পড়লো। তিনজনের দৃষ্টি স্থির সেই লকারে। চাবি দিতেই লকার খুলে গেল। তিনজনই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। ইভান লকারের হাতলে চাপ দিয়ে খুলতেই চমকে উঠলো। তিনজন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তূর্য মুখ ঢেকে একপাশে বসে পড়লো। ইভান আর ইমন ভেতর থেকে বের করছে একের পর এক নামহীন মেডিসিন, পাউডার, প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়ানো আফিম। ইমন অবাক হয়ে বলল, “ও এগুলো কোথা থেকে পেলো?”

ইভান বলল, “আন্টি এসব আহনাফকে দিয়েছে? আমার জীবদ্দশায় আমি এই প্রথম এমন বিরল ঘটনা শুনলাম, যে মা ছেলেকে মাদকাসক্ত বানাচ্ছে।”

“এগুলো কিসের ট্যাবলেট খাচ্ছে আহনাফ? একটার গায়েও নাম নেই। মূর্খ না-কি ছেলেটা?”

তূর্য বলল, “অন্ধ। আহনাফ অন্ধ হয়ে গেছে। মাকে অন্ধবিশ্বাস করে ও। আর ওর বিশ্বাসের সুযোগ নিচ্ছে ওই ষ্টুপিড মহিলা।”

“এভাবে বলছিস?”

“আমার বিন্দুমাত্র রেস্পেক্ট আসছে না উনার প্রতি। এবার ওই মহিলাকে এক্সপোজ করতে হবে। এর আগে এই সাপ্লাইকারীর বিজনেস বন্ধ করতে হবে। সামনে পাই আগে, এমন তুলোধোনা দেবো, পরবর্তী জেনারেশন আর এই বিজনেসে নামবে না।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪২|| ~ স্পর্শকাতর পর্ব ~

দু’হাতে মেহেদি, হেডফোনে বাজছে চড়া গান, আর সেই গানের তালে তালে চোখ বন্ধ করে মাথা দুলাচ্ছে রুহানি। তার ঠোঁটে অপার্থিব হাসি। উঠানের এক কোণে বসে ভেজা প্রকৃতি অনুভব করছে সে। মৃদুমন্দ হাওয়া তার কেশরাশিতে কাঁপন ধরিয়েছে। আরাফ ঘর থেকে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি আটকে গেল রুহানির স্নিগ্ধ হাসিতে। অপলক দৃষ্টি রুহানির কেশরাশির নৃত্য দেখতে ব্যস্ত। হয়তো মেয়েটির প্রেমে পড়ার জন্য এইটুকু মুহূর্ত যথেষ্ট। এই নীরবতা, মিষ্টি হাসি, বন্ধ চোখের মুগ্ধতা আরাফের হৃদস্পন্দন তীব্র গতিতে বাড়িয়ে দিচ্ছে। মন যেই অনুভূতিতে সাড়া দিতে চাইছে তার মস্তিষ্ক সাড়া দিতে পারছে না। তবুও তার মস্তিষ্ক আজ হারতে বাধ্য হলো। তার হৃদয় তাকে টেনে নিয়ে এলো সেই মায়াময়ীর ধারে। আরাফ রুহানির সামনে এসে বসলো। রুহানির কয়েকটা চুল হাওয়ার তালে উড়ে বারবার কপালে এসে পড়ছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে তাতে বিরক্ত সে। ভ্রূ কুঁচকে রেখেছে রুহানি। আরাফ হাত এগিয়ে সেই মুক্ত চুল ক’টি সরিয়ে দিল বিনা অনুমতিতে। আরাফের স্পর্শে চোখ খুললো রুহানি। আরাফকে দেখে চোখে এক রাশ বিষ্ময় ভীড় করলো তার। আরাফ নিজেকে সামলে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “কি শুনছো?”

রুহানি হেডফোন কান থেকে খুলে বলল, “গান শুনছি।”

“আচ্ছা! বৃষ্টির দিনে ভালোই লাগে গান শুনতে৷ রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছো না-কি নজরুল গীতি?”

রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ওরে বাবা, এতো ঠান্ডা গান শুনি না আমি। আমার তো ঝাঁকানাঁকা গান শুনতে ভালো লাগে।”

“রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল গীতি আগে কখনো শুনেছো? এর মধ্যে আলাদা একটা প্রশান্তি আছে।”

রুহানি এক গাল হেসে বলল, “ওসব প্রেমে পড়লে শুনবো। ওসব ঠান্ডা গান শুনে আমি শান্তি পাই না। আমার জন্য ঝাঁকানাঁকায় ঠিক আছে। আপনি শুনবেন?”

রুহানি উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে দিলো একটি বাড। আরাফ সেটি কানে গুঁজে নিতেই চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ভলিউম কমাও। কান ফেঁটে যাচ্ছে।”

“ইইই! কি বলেন আপনি? ফুল ভলিউমে না শুনলে আমি ঝাঁকানাঁকা ফিল করি না।”

“কানে সমস্যা হবে তোমার।”

রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আমার কান আমি বুঝবো।”

“বাট এখন আমি কানে দিচ্ছি।”

“ওহ আচ্ছা! সেটাই বলেন।”

রুহানি দাঁত বের করে হেসে মুখ বাঁকিয়ে ভলিউম কমালো। আরাফ আবার বাডটি কানে নিতেই এবারও ভ্রূ কুঁচকে তাকালো রুহানির দিকে। রুহানি আরাফের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচিয়ে বলল, “মজা না?”

“এটা কোনো গান হলো?”

“গান না তো কি টান পাই? মাই ফেভারিট ব্রেকাপ সং।”

“ব্রেকাপ সং! এর আগামাথাও বুঝো তুমি?”

“হ্যাঁ, বুঝি। আপনি বুঝেন না?”

“না। বুঝার ইচ্ছেও নেই।”

রুহানি শব্দ করে হেসে বলল, “আপনি হিন্দি বুঝেন না?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “না।”

রুহানি খিলখিল করে হেসে উঠলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই রুহানি বলল, “আর আপনি আমাকে গাধা বলেন?”

“এক্সকিউজ মি। হিন্দি জাস্ট একটা ল্যাংগুয়েজ। না জানলে তেমন কোনো সমস্যা নেই। আর তুমি তো বেসিক ইংরেজিই জানো না। আবার বাংলায়ও টেনেটুনে পঞ্চাশ পেয়েছো। এখন আসছো হিন্দির উপর লেকচার দিতে!”

রুহানি আরাফের কান থেকে বাড খুলে নিয়ে বলল, “আপনি এখানে এসেছেন কেন? আমি কি আপনাকে এখানে আসতে বলেছি? আমি কি বলেছি, আসেন আসেন ফ্রিতে জ্ঞান দিয়ে যান?”

আরাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এসব ক্লুলেস গান শুনে সময় নষ্ট করো দেখেই তো ডাব্বা মারো পরীক্ষায়।”

“আপনার এতো সমস্যা কেন? গান শুনছি সমস্যা? হিন্দি গান শুনছি সমস্যা? না-কি ব্রেকাপ সং শুনছি তাই সমস্যা?”

আরাফ রুহানির কথায় থেমে গেল। রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এতো সমস্যা হলে, আপনি একটা গান সাজেস্ট করে যেতে পারেন। আমি ওটা শুনে যদি পরীক্ষায় পাশ করতে পারি!”

আরাফ রুহানির কথা শুনে হেসে উঠলো। রুহানি অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ রুহানির ফোন হাতে নিয়ে স্পটিফাইয়ে সার্চ দিয়ে একটি গান চালিয়ে দিয়ে বলল, “ফুল ভলিউমে শুনতে পারো। অন্তত ইংরেজিতে পাশ করতে পারবে।”

এই বলে চলে গেল আরাফ। রুহানি ভলিউম বাড়িয়ে দিল। কানে বাজছে আরাফের খুঁজে দেওয়া গান। ইংরেজি গান। রুহানি ইংরেজিতে বেশ কাঁচা। সে ধরতে পারছে না গানের একটি শব্দও। দ্রুত লিরিক্স বের করলো সে। তা দেখেই গানটি শোনা শুরু করলো। তবুও অর্থ বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তাই সে পুরো গানের লিরিক্স বাংলা অনুবাদ করলো। আর তা দেখে মুহূর্তেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো লাজুক হাসি। দূর থেকে এই দৃশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে আরাফ। সেও ঠোঁট কামড়ে হাসছে। রুহানির দৃষ্টি এখনো সেই লিরিক্সে, আর কানে বাজছে সেই গান।

“We were both young, when I first saw you
I close my eyes and the flashback starts
I’m standing there- On a balcony in summer air
See the lights, see the party, the ball gowns
See you make your way through the crowd
And say, “Hello”-
Little did I know-
That you were Romeo, you were throwing pebbles
And my daddy said, “Stay away from Juliet”
And I was crying on the staircase-
Begging you, “Please don’t go, ” and I said-
Romeo, take me somewhere we can be alone
I’ll be waiting, all there’s left to do is run
You’ll be the prince and I’ll be the princess
It’s a love story, baby, just say, “Yes.”

(***)

হুট করে রৌদ্রজ্জ্বল ব্যস্ত শহরে নামলো ঝুম বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টির সাথে যুক্ত হলো মাতাল হাওয়া। পথচারীরা ব্যস্ত পায়ে ছুটছে ছাউনির আশ্রয়ে। এমন ঝড়ো হাওয়ায় ছাতাও রেহাই পাচ্ছে না। অনেকেই ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে। তাদের ছাতা উলটে যাওয়ার উপক্রম। তূর্য তার স্টুডিও থেকে বের হতেই বৃষ্টির সাক্ষাৎ পেল। ছাতা সাথে নিয়ে আসে নি সে। তাই দ্রুত মোটর সাইকেলের কাছে এসে হেলমেট হাতে নিতে গিয়েই থমকে গেল সে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে মোটরসাইকেলের সামনের আয়নায়। তূর্য আয়না থেকে চোখ সরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। হৃদস্পন্দন থমকে গেল তার। বৃষ্টির ধারা ভিজিয়ে দিয়ে গেল তাকে। অথচ তার সেদিকে খেয়ালই নেই। সে তো আটকে গেছে কালো শাড়ি পরা এক শ্যামকন্যার দাঁড়িয়ে ছাতা খোলার দৃশ্যে। তুমুল হাওয়ায় শাড়ির আঁচল সরে যাওয়ার উপক্রম। মেয়েটি একসাথে ছাতা আর আঁচল সামলাতে ব্যর্থ। তূর্য নিজেকে আটকাতে পারলো না। দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে লোকচক্ষুর আড়াল করে দাঁড়ালো। তূর্যকে দেখে সেই শ্যামকন্যার চোখ জোড়া থমকে গেল। ছাতাটিও বেঁচে গেল টানাহেঁচড়া থেকে। তূর্যের চোখ জোড়া ক্লান্ত। মেয়েটি ক্ষীণ হেসে বলল, “কেমন আছো?”

তূর্য তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “মিসেস উপমা, আপনার শাড়ি উলটে যাচ্ছে। একটু তো শালীনভাবে রাস্তায় নামা যায়! না-কি আপনার চরিত্রের সাথে এটাই মানানসই, তাই এভাবেই বেরিয়েছেন।”

“আমার খেয়াল হয় নি। তবে ঠিক বলেছেন আপনি। আমার চরিত্রের সাথে এখন সব ভাষায় মানানসই।”

উপমা একপাশে সরে দাঁড়ালো। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে আবার ছাতা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। ছাতা খুলেই উপমা তূর্যের দিকে এগিয়ে এলো। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষ৷ অল্পতেই জ্বর বাঁধিয়ে ফেলে এই মানুষটা। অনেক বছর আগে তার জন্য দিঘি থেকে পদ্মফুল কুঁড়িয়ে আনতে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছিল। বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল উপমা। একটু কাছে এনে জলপট্টি দেওয়ার সুযোগটাও ছিল না। উপমা ছাতা এগিয়ে দিতে গিয়েই থেমে গেল। তূর্যের মাথার উপর ছাতা ধরে দাঁড়িয়েছে অন্য একটি মেয়ে। উপমা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তূর্যের হঠাৎ খেয়াল হলো, তার গায়ে আর বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটাও পড়ছে না। সে পাশ ফিরে রুদবাকে দেখেই চমকে উঠলো। রুদবা বৃষ্টিতে ভিজছে, আর তার দিকে ছাতা এগিয়ে ধরেছে। তূর্য কিছু বলার আগেই রুদবা তার শুকনো রুমাল এগিয়ে দিয়ে বলল, “এভাবে ভিজচ্ছেন কেন আপনি? তাড়াতাড়ি হেলমেট পড়ুন। ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেলবেন।”

অপরিচিত মেয়ের কন্ঠে এমন শাসনের সুর শুনে চোখ ভিজে উঠলো উপমার। বুক ফেঁটে যাচ্ছে তার। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। সামনে হাঁটতে লাগলো এলোমেলো ভাবে। পিছু ফিরলেই হৃদয়ের ক্ষত আরো গভীর হবে৷ না, সে পিছু ফিরবে না। পিছু ফিরলেই নিজের শখের পুরুষের উপর অন্য কারো অধিকার জমাতে দেখলে সহ্য হবে না তার। উপমা দ্রুত পা ফেলে চলে গেল। তূর্য এখনো উপমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “স্যার, আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মেয়েটাকে কি আপনি চেনেন?”

তূর্য মাথা নেড়ে বলল, “না!”

এই বলে ছাতাটা সরিয়ে দিয়ে তূর্য হেলমেট পরে মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। রুদবা দ্রুত তার মোটরসাইকেলের কাছে এসে বলল, “আমি আপনার কন্সার্টের টিকেট কিনতে এসেছি। সামনের মাসে আপনাদের প্রোগ্রাম। আমি খুব এক্সাইটেড।”

তূর্য মোটরসাইকেল স্টার্ট দিতেই রুদবা বলল, “স্যার, আমাকে নামিয়ে দেবেন না?”

তূর্য শক্ত কন্ঠে বলল, “যেভাবে এসেছো, সেভাবে যাও। আমি রাইডারের কাজ নেই নি।”

এই বলে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে গেল তূর্য। রুদবা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে তূর্যের চলে যাওয়া দেখছে। তার চোখ ভিজে উঠেছে। হাতে থাকা ছাতা রাস্তায় ছেড়ে দিল রুদবা। ভালোবাসার মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি করা এতো কষ্ট হবে জানলে, সে কি ভালোবাসতো তূর্যকে?

(***)

আয়নার সামনে দন্ডায়মান সবুজ শাড়ি পরিহিতা এক তিলোত্তমা। পাশেই জানালার দ্বার উন্মুক্ত। সেই জানালা গলে প্রবেশ করা শীতল হাওয়া পুরো ঘরে বিচরণ করছে। আর সেই শীতল সমীরণের ধাক্কায় মুক্তকেশিন কেঁপে উঠছে। আয়নার সামনে দন্ডায়মান তিলোত্তমা নিজেকে দেখে বেশ সন্তুষ্ট। তার অধর জোড়ায় স্নিগ্ধ হাসি। সে ওষ্ঠরঞ্জনে হালকা রাঙালো তার অধর। এরপরই আবার অধর জোড়া একটার উপর একটা ঘষে রঙের মিশ্রণ ঘটিয়ে দ্বিতীয় বার হাসলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে হাসছে এক টগবগে যুবক। সেই তিলোত্তমা এবার চোখে গাঢ় করে কাজল আঁকলো। কাজল পরা শেষে চোখ পিটপিটিয়ে চাইলো নিজেকে। এবারও তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। দরজার গা ঘেঁষে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি এগিয়ে সেই তিলোত্তমার পেছনে এসে দাঁড়াতেই আয়নায় তাকে দেখে চমকে উঠলো সেই ললনা। পিছু ফিরতেই চুলের ধাক্কা লাগলো সেই পুরুষের মুখ। চোখ বন্ধ করে নিলো সে। চোখে চশমা থাকায় তার চোখ জোড়া সেই আঘাত থেকে নিস্তার পেয়েছে। ভ্রূ কুঁচকে সেই যুবক বলল,
“এমন ধার তোমার চুলে?”

রুহানি মুখ ছোট করে বলল, “আরাফ স্যার, আপনি? আমি তো ভয় পেয়েছি আপনাকে দেখে। সরি।”

আরাফ চোখ খুলে রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। টিপের পাতায় চোখ পরলো আরাফের। সে রুহানির কানের পেছনে গুঁজে নেওয়া চুলগুলো আলগা করে সামনে এনে দিয়ে বলল, “টিপ ছাড়া নারী একটু বেশি সুন্দর।”

আরাফের স্পর্শে শিউরে উঠলো রুহানি। চোখ বন্ধ করে নিলো সাথে সাথেই। আরাফ সরে দাঁড়ালো। রুহানি চোখ খুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “আপনাকে কে বলেছে এই কথা?”

“পুরুষ মানুষের চেয়ে ভালো নারীর সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা কি অন্য কেউ দিতে পারে?”

“কিন্তু সবাই তো বলে টিপ পরা নারী সবচেয়ে সুন্দর।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তাদের পছন্দের ঠেকা তো নিয়ে রাখি নি আমি। আমার চোখে যা সুন্দর আমি তাই বললাম।”

রুহানি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “আপনি হঠাৎ আমাকে নিজের পছন্দে দেখতে চাইছেন! মতলব কি স্যার? না-কি পরের বার নাস্তা যাতে ডাবল হয় সেই উদ্দেশ্য? হুম, হুম।”

আরাফ শব্দ করে হেসে উঠলো। পরমুহূর্তেই মুখটা গম্ভীর করে বলল, “তুমি কি জানো তোমার মাথায় বড়সড় ঝামেলা আছে?”

রুহানি মুখ ছোট করে বলল, “আপনি কি মাথার ডাক্তার?”

“না, আমি এখনো ডাক্তার হই নি। তবে হয়ে গেলে তোমার জন্য ফ্রি। নাস্তা যা খাইয়েছো সব উশুল করে নিও ওভাবে।”

রুহানি উৎসাহ নিয়ে বলল, “ওকে আপনি আমার সার্জারিও করবেন কিন্তু!”

“তোমার আবার কীসের সার্জারি হবে?”

“মা হলে!”

আরাফ চমকে উঠলো। রুহানি এক গাল হেসে বলল, “টিউশন ফিসও উঠে যাবে। মা আর আমাকে বকতে পারবে না। সবসময় তো বলে এতো এতো টাকার টিচার রাখছি, লাভ কি হচ্ছে? তখন বলতে পারবো ফ্রি বাচ্চা ডেলিভারি হয়েছে।”

আরাফ হাসি চেপে রুহানির কপালে ঠোকা মেরে বলল, “তোমার বয়স কতো মেয়ে?”

“এই তো উনিশ হবে।”

“অরুর ছোট তুমি?”

“হ্যাঁ। দুই বছরের।”

“উনিশ হিসেবে তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছে। মাথাটাই এখনো বড় হয় নি জাস্ট।”

রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “মানে?”

আরাফ রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, “মানেটা বের করতে পারো কি-না দেখো। ব্রেইন ইউজ করলে নিউরন সচল হবে। ধীরে ধীরে তোমার মস্তিষ্কও বুঝবে তোমার উনিশ বছর হয়েছে।”

এই বলে আরাফ বেরিয়ে পড়লো। রুহানি বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আরাফের যাওয়ার পানে।

(***)

রাজা গ্রামে বিয়ের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠান হবে। বরপক্ষ প্রস্তুত। দুপুরের বিয়ে। বিকেল নাগাদ নতুন বউ নিয়ে ফিরবে বর। মানুষের সমাগম হবে বেশ। এদিকে আহনাফের পাশে বসে আছে অরুণিকা। বেশ সুন্দর লাগছে অরুণিকাকে। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রিয় মানুষটির দিকে। একটু পরপর তার অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলছে, “আজকে তোকে এতো সুন্দর লাগছে কেন বল তো?”

অরুণিকা লাজুক হেসে বলল, “তোমার চোখে আমি বারবারই সুন্দর। সুন্দর না লাগলেও এই ডাহা মিথ্যা কথা বলবেই।”

আহনাফ অরুণিকার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলল, “ডাহা মিথ্যা কথা বলি না আমি।”

শব্দ করে চুম্বন করলো সেই ঘাড়ে। অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে রাখলো। আহনাফ ছেড়ে দিতেই সে জোরপূর্বক হাসলো। তখনই আহনাফের ফোন বেজে উঠলো। তূর্য কল দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেই ফোন রেখে দিতেই অরুণিকা বলল, “তোমার ফোনটা একটু দেখতে পারবো?”

“কি দেখবি?”

“সিক্রেট কিছু আছে কি-না?”

“আমার কোনো সিক্রেট নেই।”

আহনাফ ফোনের পাস খুললো অরুণিকার সামনেই। অরুণিকা মনোযোগ দিয়ে মুখস্থ করে নিলো সেই সিক্রেট কোড। এরপর আহনাফের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমি আসি। পরে দেখবো। রুহানি একা বসে আছে। ও তো এখানে তেমন কাউকে চেনেই না।”

আহনাফ অরুণিকার হাতের উলটো পিঠে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি আসিস। তোর সাথে বসলে শান্তি পাই আমি। আমার শান্তি বেশিক্ষণ আমার থেকে দূরে থাকলে, আমি পাগল হয়ে যাবো কিন্তু।”

আহনাফের কথায় অরুণিকার মুখখানায় আবার সেই অনুতাপ ফুটে উঠলো। সে ওভাবেই রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো। দেয়াল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলো, “আমি যা করছি, তা কি ঠিক হচ্ছে?”

পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেলো, সাড়ে পাঁচ বছর আগের সেই অসম্মান। অরুণিকা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “কেউই আমার মন হত্যার বিচার করবে না। আমার অপরাধীর বিচার আমিই করবো।”

(***)

পুরো ঘর নীরব। গ্রামও নীরব। তবে কমিউনিটি সেন্টার থেকে ফিরে এসেছে আহনাফ ও অরুণিকা। বাকীরা বউ নিয়েই ফিরবে। এদিকে অরুণিকা নিজের রুমে ঢুকে শাড়ি খুলতে লাগলো। কিন্তু সে খেয়াল করলো না, একটি ফোন জানালার ধারে স্থির করে রাখা হয়েছে। আর সেই ফোনের স্ক্রিনে রেকর্ড হচ্ছে অরুণিকার আপত্তিকর ভিডিও।

জামা পালটে রুমের বাইরে আসতেই ফোনের স্ক্রিনে টুংটাং শব্দ হলো। অরুণিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আহনাফের একাউন্ট থেকে একটা ভিডিও পাঠানো হয়েছে। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ভিডিওটি ডাউনলোড করলো। ডাউনলোড হতেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। দেয়াল ধরে বসে পড়লো অরুণিকা। নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম। সাথে সাথেই সেই একাউন্ট থেকে একটি মেসেজ এলো। সেখানে লেখা,
“অনেক মিষ্টি কথা বলে তোকে বেডে নিতে চেয়েছি। কিন্তু তুই এখনো সেই শক্তের শক্ত। আমার একটাই শেষ চাওয়া ছিল, তোর সাথে শেষ কাজটা করেই তোকে ডিভোর্স দিয়ে দেওয়া। কিন্তু না, তোর মন পাওয়ার জন্য সবাইকে পাঁচ বছর আগের সত্যটাও বলে দিয়েছি, তারপরও তোর মন গলে নি। এবার আর না। তুই যদি আমার কথায় সাড়া না দিস, এই ভিডিও পাব্লিক করে দেবো আমি। এরপর আর কাউকে তোর মুখটাও দেখাতে পারবি না।”

অরুণিকার হাত থেকে ফোনটা পরে গেল। শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। আহনাফ শব্দ শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ব্যস্ত কন্ঠে অরুণিকার কাছে এসে বলল, “কি-রে কি হয়েছে? অরু, ঠিক আছিস তুই?”

অরুণিকা ছলছল চোখে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল, “কি হয়েছে বল!”

অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গায়ে কেউ গরম পানি ঢেলে দিয়েছে।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন? এমন কেন মনে হবে?”

“জানি না।”

আহনাফ ব্যস্ত হয়ে অরুণিকার হাতে, পিঠে মালিশ করতে লাগলো। অরুণিকা নিজের চুল খামচে ধরেছে। আহনাফ অরুণিকাকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে রুমে এসে শুইয়ে দিলো। অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল, “আমি যদি তোমাকে সম্মতি দেই, তুমি কি আমার কাছে আসবে?”

আহনাফ অবাক হয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে অরুণিকা ধীর হাতে আহনাফের শার্টের বোতম খুলতে লাগলো। আহনাফ তার গালে হাত রেখে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো!”

অরুণিকা ভেজা কন্ঠে বললো, “হ্যাঁ। আসবে না আমার কাছে?”

আহনাফ হুট করে অরুণিকার অধর ছুঁয়ে দিল। অরুণিকাও সেই স্পর্শে সায় দিল। মুহূর্তেই অরুণিকার সম্মতি পেয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো আহনাফ। অরুণিকাকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে লাগলো সে৷ কিন্তু শেষ পরিণতিতে পৌঁছানোর আগেই অরুণিকা চিৎকার করে উঠলো। আহনাফ অরুণিকার মুখ চেপে ধরে বলল, “জাস্ট রিল্যাক্স, অরু। আমি আছি তো। ভয় পাচ্ছিস না-কি?”

অরুণিকা এবারও চিৎকার করে উঠলো। আহনাফ ভীত কন্ঠে বলল, “এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন? লোকজন কি ভাববে?”

অরুণিকার আর্তনাদ আরো তীব্র হলো। আহনাফ অরুণিকার মুখ চেপে ধরে বলল, “ওকে, ওকে আমি আর আগাচ্ছি না। এভাবে কি কেউ চেঁচামেচি করে না-কি! বাচ্চা না-কি তুই?”

তখনই দরজা খুলে গেল। আরাফ আর তাহমিদ ভেতরে ঢুকতেই অরুণিকা দ্রুত তার জামা ঠিক করে নিলো। আহনাফও ব্যস্ত হয়ে শার্ট গায়ে দিতে লাগলো। আহনাফ রাগী স্বরে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল, “নক করে আসবি না?”

অরুণিকা দ্রুত নিজের উড়না গায়ে জড়িয়ে আরাফের কাছে ছুটে গেল। আহনাফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরাফের পায়ের কাছে বসে পড়লো অরুণিকা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। আরাফ টেনে উঠালো অরুণিকাকে। অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমাকে মেরে ফেলো, ভাই। প্লিজ, আমাকে মেরে ফেলো। আমাকে কেউ বাঁচতে দেবে না। সবাই আবার আমার গায়ে কলঙ্ক লাগিয়ে দেবে।”

অরুণিকা আহনাফের দিকে আঙুল তাক করে বলল, “এই জানোয়ারটা আমাকে মেরে ফেলবে, ভাই। ও আমাকে শেষ করে দেবে।”

এই বলে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো অরুণিকা। অরুণিকার কান্নার শব্দ পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। এমনকি বাড়ির বাইরেও লোক জড়ো হয়েছে অরুণিকা চিৎকারে। এদিকে আহনাফ ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। একটু পরপর কপালের ঘাম মুছছে সে। অরুণিকার কথায় অনর্থক পুরো শরীর ঘামিয়ে উঠেছে তার। মিসেস চৌধুরী অরুণিকার হাতে, গলায় কামড়ের দাগ দেখে নাতনিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আরাফ আর তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা ভেজা কন্ঠে বললো, “দাদি, প্লিজ আমাকে মেরে ফেলো। আমি নিজে মরলে তো আমার বাবা-মার মরণ বৃথা যাবে। মা আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজে মরে গেছে। আমার বায়না রাখতে গিয়েই তো ওরা আমাকে ফেলে চলে গেল। আমার ইনসাফ কেউ করবে না। ওই অমানুষটাকে আমি সুযোগ দিয়েছি, দাদি। কিন্তু ও আমার সাথে সংসার করতে চাই না। ও নিজের তৃপ্তির জন্য আমাকে ব্যবহার করতে চাই। আমি রাজী হচ্ছি না, তাই কি জঘন্য কাজটাই না করলো আমার সাথে!”

বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো অরুণিকা। আমির চৌধুরী রুমে ঢুকে আহনাফের গালে সশব্দে চড় বসিয়ে দিলেন। শিরিন সুলতানা স্বামীকে আটকাতে ব্যর্থ। আরাফ ও তাহমিদ টেনে আমির চৌধুরীকে একপাশে নিয়ে গেলো। আমির চৌধুরী চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “বউয়ের সাথে কেউ এমন পশুর মতো আচরণ করে? নিজের বউকে কীভাবে সম্মান কর‍তে হয়, জানিস না?”

অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল, “ও আমাকে বউ মানেই না। আমার অশ্লীল ভিডিও বানিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে নিজের রুমে ডেকে এনেছে ও।”

আহনাফ অরুণিকার কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল। ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “কি বলেছিস, অরু?”

আমির চৌধুরী নিজেও বেশ অবাক। উপস্থিত সবাই অরুণিকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা নিজের ফোন হাতে নিয়ে মিসেস চৌধুরীর হাতে দিল। তিনি ভিডিও আর মেসেজটি দেখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। মিসেস তাওসিফ ফোনটি হাতে নিয়ে দেখতে চাইলে মিসেস চৌধুরী ফোনটা শক্ত করে ধরে বললেন, “খবরদার, এই ভিডিও আর কেউ দেখবে না।”

তিনি দ্রুত আহনাফের কাছে গিয়ে বললেন, “ফোন কোথায় তোর!”

বড় চৌধুরী সাহেব স্ত্রীর সামনে এসে বললেন, “কি ভিডিও এখানে?”

মিসেস চৌধুরী চেঁচিয়ে বললেন, “তোমার নাতি নিজের বউয়ের নগ্ন ভিডিও করে রেখেছে।”

আহনাফ নিভু নিভু চোখে অরুণিকার দিকে তাকালো। বুক কাঁপছে তার। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। মিসেস চৌধুরী আহনাফের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আহনাফ ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে। মিসেস চৌধুরী চেঁচিয়ে বললেন, “জানোয়ার একটা তুই। শিরিনের পেটে ইবলিশ ধরেছে, ইবলিশ। ছি!”

আহনাফ দু’হাতে ভর দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। আমির চৌধুরী মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বললেন, “কি বলছো মা? আহনাফ এমন করবে না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।”

মিসেস চৌধুরী ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে মিসেস তাওসিফকে বললেন, “বউ মা ভিডিওটা ডিলিট করে দাও।”

মিসেস তাওসিফ ভিডিও ডিলিট করার সময় আহনাফের মেসেজটিও দেখে নিলো। তিনি অরুণিকার ফোন অরুণিকাকেই দিয়ে বললেন, “চাচী ঠিক বলেছে। আহনাফ বেশ বাজে একটা কাজ করেছে। এতো ভালো ফ্যামিলিতে থেকে এই শিক্ষা! আমাদের মান-সম্মান তো ডুবিয়ে দিয়েছে এই ছেলে।”

মিসেস চৌধুরী আহনাফের ফোন খুঁজতে লাগলো তন্নতন্ন করে। ফোন পেতেই তিনি কাঁপা হাতে ফোনটা মিসেস তাওসিফকে দিলেন। মিসেস তাওসিফ আহনাফের ফোন দেখে বললেন, “এখানে তো পাসওয়ার্ড দেওয়া!”

আমির চৌধুরী ফোন একপ্রকার কেঁড়ে নিয়ে আহনাফের চুল টেনে ধরে বললেন, “খুলে দে পাসওয়ার্ড।”

আহনাফ কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে দ্রুত পাসওয়ার্ড খুলে দিলো। আরাফ আর তাহমিদ শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর এই দৃশ্য দেখে অরুণিকার চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। রুহানিও অরুণিকার হাত ধরে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আমির চৌধুরী ফোন এগিয়ে দিতেই মিসেস তাওসিফ সেই ফোনে ধারণ করা ভিডিও ডিলিট করে দিলেন। তাহমিদ বলল, “রিসাইকেল ভিনে জমা আছে কি-না দেখো।”

মিসেস তাওসিফ থেকে ফোন হাতে নিয়ে তাহমিদ সেখান থেকেও ভিডিওটি ডিলিট করে দিলো। এরপর সে অরুণিকার ইনবক্সে ঢুকে পাঠানো মেসেজটি নিজেও দেখলো, আরাফকেও দেখালো। আরাফ ফোন হাতে নিয়ে মেসেজটির দিকে কিঞ্চিৎ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। মেসেজটি বাংলিশে লেখা। আরাফ চোখ তুলে অরুণিকার দিকে তাকালো। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকালো রুহানির দিকে। হাত মুঠো হয়ে এলো তার। ফোনটা ছুঁড়ে মেরে রুম থেকে বেরিয়ে রুহানির হাত শক্ত করে চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল, “আমার সাথে আসো।”

অরুণিকা আর রুহানি দু’জনই চোখ বড় বড় করে আরাফের দিকে তাকালো। রুহানি ভীত কন্ঠে বলল, “আমি কোথাও যাবো না। অরু, প্লিজ আমাকে বাঁচা।”

অরুণিকা চোখ গরম করে তাকাতেই রুহানি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। ওমনিই আরাফ টেনে নিয়ে গেল রুহানিকে।

এদিকে আমির চৌধুরী ছেলেকে ইচ্ছেমতো মারলেন বেল্ট দিয়ে। তাহমিদ অনেক কষ্টে আটকালো তাকে। মাঝে কয়েক ঘা তাহমিদের গায়েও পড়লো। আহনাফ মাথা নামিয়ে নীরবে মার খাচ্ছে। বড় চৌধুরী সাহেব দাঁড়াতে পারছেন না। আরেফিন চৌধুরী বাবাকে নিয়ে গেলেন। তাওসিফ শাহরিয়ার দরজার কাছে যেতেই বাইরের কানাঘুষা শুনতে পেলেন। দুয়েকজন আঁড়িপেতে সব শুনে ফেলেছে। তারাই পুরো গ্রাম রটিয়ে দিয়েছে আহনাফ চৌধুরী তার স্ত্রীর আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে তাকে শারীরিক নির্যাতন করছে। ব্যস, গ্রামে চৌধুরী সাহেবের উঁচু মাথা হেঁট হয়ে গেল। মিসেস চৌধুরী মেঝেতে বসে কাঁদছেন। মিসেস তাওসিফ তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত। শিরিন সুলতানা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন একপাশে। তার চিন্তার কারণ অন্যকিছু। এদিকে আমির চৌধুরী রুমে ঢুকে কাঁদছেন। একমাত্র ছেলের অধঃপতনে অসহায় বাবার কান্নার শব্দ কতোটা ভয়ংকর হয়, এর সাক্ষী হয়ে রইলো চার দেয়াল। তাহমিদ আহনাফের পাশে বসে আছে। আহনাফের চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। তার স্থির দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। অন্যদিকে অরুণিকার ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। সে মনে মনে বলল, “আমার মনে অনেক আঘাত দিয়েছে এই চৌধুরী বাড়ির লোকেরা। আজ থেকে ওদের এই সমাজ ধিক্কার দেবে। আমার মাকে মন থেকে মেনে নেয় নি এরা। বাবা-মা শুধু ভালোবেসে বিয়ে করেছিল বলে এতো অবহেলা করেছিল আমার নানার পরিবারকে। এমনকি আমার মামার চরিত্র নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অথচ সেই মানুষটা আমাকে বাবার স্নেহ দিয়ে যাচ্ছে। এই মানুষগুলোই মিথ্যে অপবাদ শুনে।আমাকে অপমান করে বাড়ি ছাড়া করেছিল। আমাকে এক সপ্তাহ না খাইয়ে রেখেছে। অনাথ তাই ইচ্ছেমতো অবহেলা করেছে, অথচ সব সত্য জানার পরও আহনাফকে কেউ এক বেলা অভুক্ত রাখে নি! ইনসাফ কেউ দেয় নি আমাকে। আমাকে আমি ইনসাফ দিয়েছি। আজকের তারিখটা সারাজীবন মনে রাখবে এই চৌধুরী বাড়ির লোকেরা। কাউকে আঘাত করলে সৃষ্টিকর্তা তাদের সেই আঘাত সেভাবেই ফিরিয়ে দেন। আর আমি ছিলাম সেই আঘাতের উৎস।”

অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকালো। মায়া জড়ানো মুখটি শুকিয়ে গেছে। অরুণিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল, “তোমার এই চেহারা দেখে মায়া বাড়ানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তুমি এই আঘাত ডিজার্ভ করো, আহনাফ। আমি তোমাকে দু দু’বার ক্ষমা করেছি। এভাবে আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলার কোনো অধিকার নেই তোমার। আজ তুমি বুঝবে এই অপমান কতো ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক। চরিত্র কতো বড় এসেট। আজ তুমি বুঝবে, তুমি আমাকে কতোটা খালি করে দিয়েছিলে সেদিন। আজ তুমি সব বুঝবে, আহনাফ। সব বুঝবে।”

চলবে-