উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৪৫ এবং বোনাস পর্ব

0
3

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৫ (১ম ভাগ)||

শূন্য দৃষ্টিতে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অরুণিকা। হেমন্ত হাওয়ার স্পর্শে শিরশিরিয়ে উঠছে তার কোমল কায়া। চোখ-মুখ বেশ উদাস। আর মনে ভয়ংকর তোলপাড়। হঠাৎ তার মনোযোগ কেঁড়ে নিল মেসেজের টুংটাং শব্দ। ধীর হাতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই গা শিউরে উঠলো তার। হিমালয়ের মেসেজ! অরুণিকা দ্রুত ইনবক্সে ঢুকলো। হিমালয় লিখেছে,

“স্বচ্ছ চোখে ভেসে উঠেছে এ কেমন রাগ!
যেই চোখেতে পূর্বে ছিল স্নিগ্ধতার আভাস।
শত ভীড়ের মাঝেও সে কেন নির্বাক?
হৃদয়ে কি তার জাগে না কোনো আশ?
আমি জানতে চাই, তার খোলা চুলের স্পর্শ কে পায়?
কোন ছন্দে তার মন- ভালোবাসার গান গায়?
যাকে দেখলে আমার এই মন- মুগ্ধ,
আমার চোখে হারিয়ে কেন সে হয় না দগ্ধ?
আমি জানতে চাই, কার প্রেমে তার হৃদয় রাঙা,
তার চোখে এ কোন আলো?
প্রশ্ন এক হারিয়ে যাওয়া মনের, যা পুরোটাই ভাঙা-
সে কি বাসে নি কখনো ভালো?
আমি জানি, সে তো এক মিষ্টি হৃদি,
আমার কবিতায় সে নয় কোনো মৃত নদী!”

অরুণিকার চোখে জল ভীড় করলো। ফোনটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো সে। আজ অনেক দিন পর তার হৃদয় মরুভূমিতে বৃষ্টি নেমেছে। নিজের এই প্রশান্তিটা একান্তই তার নিজের। এই অনুভূতি জগতের বেঁধে দেওয়া সময় আর নিয়মের ঊর্ধ্বে। একটু তো প্রশান্তি আশা করতেই পারে সে!

সব বাঁধা কাটিয়ে সে হিমালয়ের কবিতার উত্তরে লিখলো, “আপনি এতোদিন কোথায় ছিলেন?”

“আমাকে খুঁজেছিলেন কি!”

“অপেক্ষায় ছিলাম, আপনার কবিতা আর গল্পের অপেক্ষায়। ”

“আমার জীবনে তো হাজারো কবিতা, হাজারো গল্প। আপনি কোনটা শোনার অপেক্ষায় ছিলেন?”

“আপনি যেটা শোনাবেন, আমি সেটাই শুনবো।”

“একটা গল্প শুনাবো আপনাকে। শুনবেন?”

“আমি অপেক্ষা করছি। আপনি বলুন।”

“একটি ব্যথিত হৃদয়ের গল্প। একটি রাজপুত্রের গল্প। একদিন সেই রাজপুত্র প্রেমে পড়ে যায় এক রাজকন্যার। রাজকন্যাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় সে৷ রাজকন্যাও রাজি।”

এইটুকু পড়ে অরুণিকা লিখলো, “তাহলে ব্যথিত হৃদয়ের গল্প কীভাবে হলো?”

“এই যে একটু পর বুঝবেন।”

“আচ্ছা, তারপর?”

“এরপর তাদের প্রণয় ঘটলো। সখী আর দাসীরা ব্যস্ত তাদের প্রণয়পত্র আদান-প্রদানে। বেশ চলছিল সব। কিন্তু একদিন রাজপুত্র তার প্রেয়সীর রাজ্যে হামলা চালিয়ে বসে। এরপর যুদ্ধ হয়। তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রাণ যায় তার প্রিয়তমার। এরপর রাজপুত্র তার প্রিয়তমার নিথর দেহ বুকে জড়িয়ে কাঁদে, যেই ক্রন্দন আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ সৃষ্টিকর্তা সেই রাজপুত্রের আহাজারি ফিরিয়ে দেয়। এটাই না-কি তার শাস্তি। কলহ, যুদ্ধ, বিশৃঙ্খলার শাস্তি। তারপর আর তার রাজকন্যা ফিরে আসে নি। আজ অব্ধি সেই রাজপুত্র অপেক্ষায় আছে। কখন সৃষ্টিকর্তা তার আর্জি মেনে নিয়ে, রাজকন্যার প্রাণ ভিক্ষে দেবেন।”

অরুণিকার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। লিখলো, “শুধু শুধু কেন যুদ্ধ করতে গেল? সে কি জানতো না ওটা রাজকন্যার সাম্রাজ্য?”

“জানতো না। বা হয়তো জানতো। রাজপুত্রের মন রাজপুত্রই বুঝে।”

“যদি জেনে এই কাজ করে, তাহলে এই শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু তবুও কষ্ট হচ্ছে আমার। রাজকন্যা তো মরলো। কিন্তু রাজপুত্র সারাজীবন কষ্ট পাবে।”

হিমালয়ের কোনো উত্তর এলো না। প্রায় দশ মিনিট অতিক্রম হয়ে গেল। অরুণিকা এবার নিজেই লিখলো, “কিছু বলছেন না যে?”

“কবিতাটা পড়েছেন?”

“জি। সুন্দর ছিল।”

“আপনার ছবি ছেড়েছিলেন দেখলাম। কোথায় গিয়েছিলেন?”

“কন্সার্টে।”

“আপনি কন্সার্টে যান?”

“হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে।”

“কার গান ভালো লাগে আপনার?”

“সবার গানই ভালো লাগে।”

“নির্দিষ্ট কেউ নেই?”

“ছিল! কিন্তু এখন নেই।”

“আচ্ছা! কেন?”

“ব্যক্তিগত জীবনে সেই গায়ক একজন ভয়ংকর খলনায়ক।”

“বলেন কি! কীভাবে বুঝলেন? আপনি কি তাকে চেনেন?”

“হ্যাঁ। একটা মেয়ের সাথে প্রতারণা করেছিল। মেয়েটির দিকে খারাপ দৃষ্টি ছিল তার। প্রচন্ড ভয়ংকর সে।”

অরুণিকা মেসেজটি পাঠিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। এবারও হিমালয়ের কোনো উত্তর আসছে না। অরুণিকা লিখলো, “আপনি কি ব্যস্ত?”

“না।”

“তাহলে?”

“একটা কবিতা লিখছিলাম।”

“তাহলে তো ব্যস্তই।”

“আমার কাছে এটা ব্যস্ততা না। আমার কবিতা তো আপনার সাথে কথোপকথনের একটি অংশ।”

অরুণিকা আনমনে হাসলো। লিখলো, ” এখন কী লিখতে পেরেছেন?”

“না, লিখতে পারছি না। কবিতাটা হয়তো আপনার পছন্দ হবে না।”

“কেন?”

“এই কবিতা এক ললনাকে নিয়ে লেখা। এটা তার সৌন্দর্য নিয়ে লেখা।”

“তাই! তাহলে কেন পছন্দ হবে না?”

“যদি আমি খলনায়ক হয়ে পড়ি।”

“কি যে বলেন।”

“পুরুষ মানুষের ভালোবাসার দৃষ্টি যদি ভয়ংকর হয়, তাহলে কি সেই দৃষ্টির প্রতিফলনে লেখা কবিতা খলকাব্য হবে না?”

অরুণিকা মেসেজটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এবার হিমালয় লিখলো, “এবার আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন!”

“না, আপনি আমার কথাকে অন্যভাবে নিয়েছেন। আপনি হয়তো আমি কি বুঝিয়েছি, সেটা বুঝেন নি। ভালোবাসার দৃষ্টিতে তো বেদনা থাকে না। কিন্তু খারাপ দৃষ্টিতে অনেক যন্ত্রণা থাকে। অনেক অশ্রু থাকে।”

“আচ্ছা! তবে তো সব দৃষ্টি অশুভ নয়, শুভ দৃষ্টিও আছে।”

অরুণিকা হেসে লিখলো, “আপনার দৃষ্টি অবশ্যই শুভ হবে।”

“কীভাবে বুঝলেন?”

“কারণ আপনার মন সুন্দর।”

“আপনি নিশ্চিত?”

“আপনার কথায় মনে হচ্ছে।”

“আমাকে দেখে যদি আপনার ধারণা পালটে যায়?”

“কেন পাল্টাবে?”

“দরুন, আমি দেখতে খুব কুৎসিত। তখন?”

“মানুষের আত্মার সৌন্দর্যই তার আসল সৌন্দর্য।”

“আমি যদি আপনার সামনে এসে দাঁড়াই, ফিরিয়ে দেবেন আমাকে?”

“ফিরিয়ে দেবো কেন?”

“তাহলে তো আসতেই হয়। একনজর আপনাকে দেখতেই হয়। ছবিতেই আপনার স্নিগ্ধ রূপ দেখেছি। এই মিষ্টি কথোপকথনের তরুণী বাস্তবে কেমন, তা দেখার খুব ইচ্ছে আমার। আমি আপনার ঠিকানায় আসবো একদিন।”

অরুণিকার চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। হিমালয় নামক অদৃশ্য মানুষটি তার সামনে আসবে? এর চেয়ে চমৎকার বিষয় দ্বিতীয়টা হতে পারে না তার জন্য। এই মানুষটা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার হৃদয়ে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। মানুষটা অরুণিকার দৃষ্টিতে ভালো মানুষ। সত্য হৃদয়ের মানুষ। আর এই অনুভূতি নিয়ে তার নিজের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। না আছে কোনো দ্বিধা।

(***)

মিডটার্ম পরীক্ষা শুরু। এই কয়েকদিনে অরুণিকা বেশ কয়েকবার আহনাফকে ক্যাম্পাসে দেখেছিল। তবে তা চোখাচোখিতেই সমাপ্ত। আজ অরুণিকার শেষ পরীক্ষা। ভাগ্যক্রমে আহনাফের দায়িত্ব পড়েছে অরুণিকার হলে।

আহনাফ হলে ঢুকেই খাতাপত্র এগিয়ে দিয়ে চুপচাপ তার চেয়ারে বসে রইল। অরুণিকার সিট প্রথম সারিতে। আহনাফ তার মুখোমুখি বসে আছে। বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। এই অস্বস্তির মধ্যে পরীক্ষা দিলে ডাব্বা মারবে সে। আহনাফ বুঝতে পেরে অন্যদিকে ঘুরে বসলো। তবুও অরুণিকার চোখের সামনেই সে। কীভাবে সরবে আহনাফ? বেঞ্চগুলোও এভাবেই বসানো হয়েছে। অরুণিকার সিটটাও তার মুখোমুখি রাখা। এরইমধ্যে সময় হয়ে গেল। প্রশ্ন দিয়ে হলের বাইরে এসে দাঁড়ালো আহনাফ। সে চায় না, তার জন্য অরুণিকার পরীক্ষা খারাপ হোক। প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল। এরপর আহনাফ হলে ঢুকে হেঁটে হেঁটে বিশ মিনিট পার করলো। শরীর ভারী হয়ে আসছে তার। পায়ে জোর পাচ্ছে না। কিন্তু বসতে হলে অরুণিকার সামনে গিয়ে বসতে হবে। তাই পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পার করলো আরো দশ মিনিট। এভাবেই প্রায় এক ঘন্টা পুরো ক্লাসরুমে হেঁটে, দাঁড়িয়ে সময় পার করলো। মাঝে দশ মিনিটের বিরতিতে অন্য এক স্যার এলেন হলে। আহনাফ সেই বিরতিতে বেরিয়ে তার কেবিনে গিয়ে বসলো। পা দু’টি বেশ ঝিনঝিন করছে তার। দু’পা শক্ত করে ধরে বসে রইল সে। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে তার। পকেট থেকে নামহীন ট্যাবলেট বের করে খেয়ে নিল। এটি তার মাথা ঠান্ডা করার একমাত্র ওষুধ। আর আপতত তার মাথা ঠান্ডা করতে হবে।

দশ মিনিট পর আবার হলে ফিরলো সে। বিরতিতে হলের দায়িত্বে থাকা স্যারটি চলে গেলেন। হাতে আরো পঞ্চাশ মিনিট সময় আছে। আহনাফ আরো বিশ মিনিট হেঁটে পার করলো। এবার সে চেয়ারে বসতে বাধ্য হলো। চাইলে অরুণিকার সিট পরিবর্তন করে দিতে পারতো। কিন্তু ক্লাসে কেউই দেখাদেখি করার চেষ্টা করছে না। তাই অনর্থক সিট পরিবর্তন করার কোনো প্রশ্নই আসে না।

আহনাফ যদিও চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো, তবুও অরুণিকার দিকে চোখ যাচ্ছে তার। ফোন হাতে নিলো সে৷ ফোন স্ক্রলিংয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কিন্তু দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। চোখ বারংবার অরুণিকার চিন্তিত মুখের দিকে আটকাচ্ছে। মেয়েটা লিখছে তো লিখছেই। উন্মাদের মতো লিখছে। আহনাফের মন হেরে গেল এবার। অরুণিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে৷ অরুণিকার চুলগুলো কাঁধের নিচে অব্ধি নেমেছে। ঘন চুলগুলো ঝুঁটি করে রেখেছে সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখ জোড়া বেশ অস্থির। হাত চলছে খালি পৃষ্ঠায়। একটু পরপর কলম কামড়ে কিছু একটা ভাবছে, আবার লেখায় মনোযোগ দিচ্ছে। আহনাফ আনমনে হাসল। তার খুব ইচ্ছে করছিল, অরুণিকার কপালে জমে থাকা ঘামকণা একটুখানি ছুঁয়ে দিতে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলো সে।

ঠিক কতোক্ষণ আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার হিসেব করে নি সে। একটি ছেলে পরীক্ষা শেষে খাতা এগিয়ে দিতেই আহনাফের ঘোর কাটলো। তৎক্ষণাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। আহনাফ সামনে তাকাতেই দেখলো অরুণিকা তার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ বিরক্তি তার চোখে-মুখে।

অরুণিকা কি খেয়াল করে ফেলেছে? আহনাফ সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। এর পাঁচ মিনিট পর সবার খাতা নিয়ে নিলো সে। অরুণিকা এখনো লিখছে। আহনাফ তার সামনে এসে বলল, “আর কতো লিখবে?”

অরুণিকা তবুও লিখছে। আহনাফ এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো বাকী শিক্ষার্থীরা অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ এবার বাধ্য হয়ে টেনে নিলো অরুণিকার খাতা। অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো। আহনাফের বেশ কষ্ট হলো সেই মুখখানা দেখে। কিন্তু তার করার কিছু নেই। এরপর সে খাতাপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অরুণিকাও কলম কামড়ে ধরে প্রশ্ন দেখছে। তাহসিন অরুণিকার সামনে এসে বলল, “কি এতো লিখছিলে?”

অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বলল, “একটা প্রশ্ন আরেকটু বড় করে লিখতে পারতাম।”

“কি যে বলো মেয়ে! আমরা ছেড়ে আসছি, আর তুমি বড় করে লিখতে পারো নি, তাই আপসোস করছো?”

অরুণিকা ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, “আমি যাই লিখি না কেন, নম্বর সেই আন্ডা মার্কাই পাবো।”

“যাই বলো, আহনাফ স্যারকে দেখে আমি তো লিখতেই ভুলে গেছি।”

“কেন?”

“লাস্ট বিশ মিনিট উনি তোমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ইভেন হাসছিলও। তাও আবার মুচকি হাসি।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো তাহসিনের দিকে। তাহসিন হেসে বলল, “স্যারের হয়তো তোমাকে পছন্দ হয়েছে। এমনিতেও ফার্স্ট সেমিস্টারে অনেক জ্বালিয়েছিল তোমাকে।”

অরুণিকা কিছু বললো না। চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো ক্লাস থেকে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন নিয়ে ক্লাসমেটদের সাথে বেশ খানিকক্ষণ বকবক করলো সে। ক্যাম্পাস প্রায়ই ফাঁকা হয়ে গেছে। এবার সে ডিপার্টমেন্টের ওয়াশরুমে গেল। একটু মুখে পানির ঝাপটা দেওয়া উচিত। ওয়াশরুমের কাছে এসে দেখল শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের ওয়াশরুম বন্ধ। আয়ারা ক্যাম্পাসে তালা লাগিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য এতো হুলুস্থুল কেন করে, সে বুঝে না। অরুণিকা এবার নিচে নেমে দ্বিতীয় তলায় গেল। শিক্ষকদের ওয়াশরুম এখনো খোলা। অরুণিকা উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো একবার। তার মনে হলো ভেতরে কেউ নেই৷ সে ধীর পায়ে ঢুকে মনে মনে ভাবলো, “একটু মুখে পানি দিয়েই বেরিয়ে যাবো। এর মধ্যে কে আর আসবে?”

অরুণিকা বেসিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। পানি ছেড়ে চোখ বন্ধ করে পানির ঝাপটা মুখে দিতেই পেছনে দরজা খোলার শব্দ হলো। অরুণিকা হালকা চোখ মেলে আয়নায় আহনাফকে দেখে চমকে উঠলো। সে দ্রুত চোখ মুছে পেছন ফিরে দেখল আহনাফের হাতে একটা সিগারেট। সিগারেট খেতে টয়লেটে ঢুকতে হয়? কি অদ্ভুত! অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “সরি, স্টুডেন্ট ওয়াশরুমে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল।”

আহনাফ সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, যাও তুমি।”

আহনাফ টয়লেটের সামনে থেকে সরে দাঁড়াতেই অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “না, না, শুধু মুখে পানি দিতে এসেছি।”

এই বলে অরুণিকা বেরুতে নেবে তখনই আহনাফ তাকে টেনে একপাশে নিয়ে গেল। অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে অরুণিকার হাত শক্ত করে ধরে নিজের বুকের উপর রেখে বলল, “অরু, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমাকে মাফ করে দেওয়া যায় না?”

আহনাফের শরীর থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। অরুণিকার মাথা ধরে যাচ্ছে সেই গন্ধে। সে আহনাফকে সরিয়ে দিতে চাইলে, আহনাফ উলটো তার ঘাড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “আমার সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না। তোমার গা থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে।”

আহনাফের নেশা ধরেছে বেশ। অরুণিকার কথা তার কান অব্ধি পৌঁছায় নি। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অরুণিকার অধর জোড়া কামড়ে ধরলো সে। অরুণিকা নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আহনাফ এবার অরুণিকার অধর ছেড়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল, “অরু, আমাকে ভালোবাসতে দিবি? আমি তোকে খুব ভালোবাসবো।”

অরুণিকার ঠোঁট কেঁটে গেছে। সে ঠোঁটে হাত দিতেই দেখল রক্ত বেরিয়েছে। অরুণিকা আহনাফের কলার চেপে ধরে বলল, “বল দেখাচ্ছো আমার উপর? পুরুষত্ব দেখাচ্ছো?”

আহনাফ অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, অরু। আমি পাগল হয়ে যাবো। আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আর।”

অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে বের হতে নেবে, তখনই দেখলো ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। আহনাফ অরুণিকার পিছু পিছু এসে দরজা বন্ধ দেখে বলল, “দেখ, নিয়তিও আমাদের আলাদা করতে চায় না!”

অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “এক্সকিউজ মি! এটা কোনো নিয়তি না। এটা তোমার শয়তানি।”

“আমি ভালোবাসলে শয়তানি, আর অন্যদের গুলো ভালো?”

“অন্যদেরটা আমি জানি না। কিন্তু তোমারটার প্রতি আমার কোনো বিশ্বাস নেই।”

আহনাফ আচমকা অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা মুহূর্তেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আহনাফকে। আর টাল সামলাতে না পেরে আহনাফ ওয়াশরুমের মেঝেতে পড়ে গেল। অরুণিকা দ্রুত দরজায় কড়া নাড়লো। ওপাশে কারো নজরে আসার জন্য গলা উঁচিয়ে ডাকলো বেশ কয়েকবার। এদিকে আহনাফের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। হুট করে তার রাগ উঠে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে অরুণিকার ঝুঁটি পেছন দিক থেকে টেনে ধরে বলল, “তুই আমাকে ফেলে যেতে পারবি না। আমি তোকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না।”

অরুণিকা আর্তনাদ করে উঠতেই আহনাফ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “তোকে ভালোবাসি আমি। আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না। হয় তুই আমাকে নিজের হাতে খুন কর, নয়তো তুই আমার হয়ে যা।”

অরুণিকা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তুমি একটা সাইকো।”

আহনাফ অরুণিকাকে দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “*** তোকে আমি।”

আহনাফের এমন কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল অরুণিকা। সে সশব্দে চড় বসিয়ে দিল আহনাফের গালে। আকস্মিক ঘটনায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল আহনাফ। অরুণিকা এবার আহনাফের কলার টেনে ধরে বলল, “আমি কোনো রাস্তার মেয়ে না যে তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলবি।”

আহনাফ বাকরুদ্ধ হয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইল।অরুণিকা আহনাফকে ধাক্কা মেরে বলল, “তোর চোখে পানি দেখে, তূর্যের কথা শুনে, তোর প্রতি মায়া হয়েছিল আমার। কিন্তু তুই একটা ভন্ড। তোর চিন্তাভাবনা নোংরা। ছি! ছি! ছি! একটা ইউনিভার্সিটির স্যার হয়ে এমন নোংরা ভাষা কোথা থেকে আসে? তোকে তালাক দিতে পারতাম আমি? তিন তালাক এখানে দাঁড়িয়েই দিতাম। মেয়েদের যদি এই অধিকার থাকতো, তোকে আমি এখনি ছাড়তাম।”

আহনাফ কয়েক পা পিছিয়ে গেল। নিজের গালে নিজেই চড় খেল। কি বলে ফেলেছে সে! হুঁশজ্ঞান কোথায় হারিয়েছে তার? ইদানিং এমন গালি কীভাবে বের হয় মুখ দিয়ে? আহনাফ অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “সরি, সরি, সরি, আমি ইচ্ছে করে বলি নি। আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমাকে চড় মার। আমাকে গালি দে তুই। কিন্তু মাফ করে দে।”

অরুণিকা সরে যেতেই আহনাফ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মেঝেতে বসে মাথায় হাত দিয়ে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো, “আল্লাহ, কি করে ফেললাম আমি? আমি কি বলে ফেললাম? কি হবে এখন? ও তো আমাকে আরো ঘৃণা করবে?”

আহনাফ নিজের মুখ নিজেই খামচে ধরেছে। অরুণিকা পেছন ফিরে আহনাফের উন্মাদ ব্যবহার দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ইভানকে ফোন করলো সে। কয়েক বার রিং হওয়ার পর ইভান কল ধরতেই অরুণিকা কথা না বাড়িয়ে বলল, “সেকেন্ড ফ্লোরের টিচার্স ওয়াশরুমে আটকা পড়েছি আমি আর আহনাফ। প্লিজ ওকে বের করো। সাইকো হয়ে গেছো ও।”

অরুণিকা কল রেখেই আহনাফের হাত ধরে বলল, “এমন করছো কেন তুমি?”

আহনাফ অরুণিকার হাত টেনে তাকে নিজের কোলে বসিয়ে বলল, “আমাকে মাফ করে দে৷ আমি ফালতু একটা ছেলে। জঘন্য একটা ছেলে। প্লিজ আমাকে মাফ করে দে। আমি মুখ সেলাই করে রাখবো। কথাও বলবো না। তবুও তুই আমাকে ভুল বুঝিস না, প্লিজ। আমি তোকে ছোঁবো না একদম।”

এই বলে আহনাফ ধাক্কা দিয়ে অরুণিকাকে সরিয়ে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “দেখ, একদম দূরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একদম দূরে। কাছেও আসবো না তোর। তাও আমাকে ভালোবাসিস, অরু। আমাকে একটু ভালোবাসিস প্লিজ।”

আহনাফের অস্থির আহাজারি দেখে অরুণিকা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খুলে ঢুকতেই আহনাফের এলোমেলো অবস্থা দেখে চমকে উঠলো ইভান। আহনাফ ইভানকে দেখে বলল, “আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। আমি বেশি উল্টাপাল্টা কথা বলছি।”

ইভান আহনাফের হাত ধরে তাকে নিয়ে বের হওয়ার আগে, আহনাফ পেছন ফিরে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “অরু, আমি চলে যাচ্ছি। তুই চিন্তা করিস না। তুই একদম সেইফ।”

অরুণিকা দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান অসহায় দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে একনজর তাকিয়ে আহনাফকে নিয়ে চলে গেল।

অরুণিকা এখনো স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আর মনে মনে ভাবছে, “আহনাফ মোটেও সুস্থ না। ওর কিছু একটা হয়েছে। এটা সুস্থ মানুষের আচরণ না। সেদিন আরাফ আমাকে বারবার বলছিল, ওর অসুস্থতার কথা। আহনাফ কি মানসিক ভাবে অসুস্থ? কিন্তু কীভাবে সম্ভব! সব তো ঠিক ছিল এতোদিন! হঠাৎ এমন কেন হলো?”

(***)

আরাফ ও তাহমিদের সামনে স্তরে স্তরে সাজানো প্যাকেট করা নেশাদ্রব্য। তাহমিদ একটি প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল, “লোকটা সাংঘাতিক। নিজ এলাকায় ডাক্তার পরিচয়ে চেম্বার খুলে বসেছে। আর নাকের নিচ দিয়ে মাদক ব্যবসা করছে!”

আরাফ বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল, “ইয়াবা বিক্রি করছে, তাও আবার অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বলে!”

“এই লোকটা ধরা না খেলে আহনাফ আমাদের বিশ্বাসই করবে না। ওর সামনে প্রমাণ রেখেছি, তবুও এই ছেলে বিশ্বাস করছে না এগুলো ড্রাগস।”

“পাগল হয়ে গেছে ও।”

তাদের কথোপকথনের মাঝে তূর্য এসে বলল, “চল, চল ইভান আর ইমন থানায় গেছে। এই ভন্ডটাকে আজই হাতেনাতে ধরতে হবে। ওরা পুলিশ নিয়ে আসার আগেই আমাদের ওই ভণ্ডের ভণ্ডামি আহনাফের সামনে আনতে হবে।”

তাহমিদ ও তূর্য একটি ব্যাগে অবৈধ দ্রব্যগুলো ঢুকাতে লাগলো। এদিকে আরাফ আহনাফকে রুম থেকে জোর করে বের করে আনলো। ক্যাম্পাস থেকে ফিরেই সে আপনমনে বিড়বিড় করছে। পাঁচ জন আগে থেকেই তাদের পরিকল্পনা মতো আহনাফের সামনে শিরিন সুলতানার মুখোশ উন্মোচনের ছক কষেছিল। আর আজ আহনাফের এই অবস্থা দেখেই সেটা বাস্তবায়নের সংকল্প নিলো পাঁচ জন। ইভান তাই ক্যাম্পাস থেকে এসেই ইমনকে নিয়ে থানায় চলে গেল।

এদিকে আহনাফ বলল, “আমি কোথাও যাবো না।”

আরাফ রাগী স্বরে বলল, “আগে চল, আমাদের সাথে। তুই এতোদিন যা খেয়েছিস, যদি আজ প্রুফ করতে না পারি এগুলো নেশাদ্রব্য, আর তোর মা তোকে মাদকাসক্ত বানিয়েছে, তাহলে এই ব্যাগে যা আছে সব তোর।”

আরাফ তাহমিদের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আহনাফকে ধরিয়ে দিল। আহনাফ বলল, “মা আমার সাথে এমন করবে না।”

“আমি তোকে চ্যালেঞ্জ করছি, তোর বিশ্বাস ভুল।”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ঠিক আছে, চল। আমি বাইকের চাবি নিয়ে আসছি।”

তূর্য বলল, “না, তুই আমার বাইকের পেছনে বসিস। এখন চল।”

এই বলে চারজনই বেরিয়ে পড়ল। এরপর তারা পৌঁছে গেল সেই এলাকায়, যেখানে ভন্ড ডাক্তার সালেহ আলীর চেম্বার। এলাকাটি খুব একটা উন্নত মনে হচ্ছে না। প্রধান সড়কে কয়েকটা পুরোনো তিন-চার তলা ভবন চোখে পড়েছিল। কিন্তু ভেতরে সড়কের দু’পাশেই বস্তি। আর রাস্তাটির শেষ মাথায় রিকশা ও সিএনজি রাখার গ্যারেজ।

আরাফ, তূর্য আর তাহমিদ তাদের মোটর সাইকেল চেম্বার থেকে কিছুটা দূরে থামালো। তূর্যের মোটর সাইকেলের পেছন থেকে নেমে আহনাফ চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। আরাফ বাকীদের উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি আহনাফকে নিয়ে ভেতরে যাচ্ছি। তোরা এখানে থাক।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ আহনাফকে টেনে নিয়ে গেল সালেহ আলীর চেম্বারে। চেম্বারটি সাধারণ চেম্বারের মতো একদমই নয়। চাপা গন্ধ নাকে আসছে। মেঝেটা অসম্ভব নোংরা হয়ে আছে। বসার জায়গাও নেই। দেয়ালেও কেমন ছোপ ছোপ দাগ। ভেতরে অল্প বয়সী এক সহকারী বসে আছে। সে আরাফ ও আহনাফকে আপদমস্তক দেখে বলল, “ডাক্তার ভাইজানের কাছে এসেছেন?

আরাফ মাথা নেড়ে বলল, ” হ্যাঁ।”

“কি সমস্যা?”

“কিছু ব্যক্তিগত কারণে।”

“মানে কি!”

“আসলে, একজন উনার নম্বর দিয়েছিল। শারীরিক অশান্তি দূর করার জন্য উনার শরণাপন্ন হতে বলেছে।”

সহকারীটি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ওইগুলোর জন্য!”

আহনাফ আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ সহকারীর পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ওইগুলো।”

সহকারী টাকা হাতে নিয়ে এক গাল হাসলো। বলল, “ডাক্তার ভাইজান ফ্রি।”

এই বলে সহকারীটি উঠে ভেতর ঘরের দরজা খুলে দিল। এরপর আরাফ ও আহনাফ ভেতরে ঢুকতেই দেখল চেয়ারে মধ্যবয়সী এক লোক বসে আছেন। সহকারী চোখের ইশারায় লোকটিকে কিছু একটা বলতেই তিনি আরাফ ও আহনাফকে বসতে বললেন। তারা বসতেই সহকারীটি বেরিয়ে পড়লো। আরাফ আহনাফকে দেখিয়ে বলল, “আমার ভাই, একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে গেছে। ওকে ওই মেয়ের নেশা থেকে বের করে আনার জন্য আপনার কাছে এসেছি। একজন মিসেস আপনার নম্বর দিয়েছিলেন।”

সালেহ আলী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “মিসেসের নাম কি? এমন মেডিসিনের রেগুলার কাস্টমার আমার চেনা।”

আরাফ ঘাবড়ে গেল। ভাবতে লাগলো, “শিরিন সুলতানার সাথে তার পরিচয় ক’দিনের হতে পারে! যদি নাম বললে সন্দেহ করে বসে?”

আরাফ একটু থেমে বলল, “নামটা না নিলে হয় না? আসলে উনি কাউকে পরিচয় দিতে বারণ করেছিলেন।”

“আমাকে দিলে সমস্যা নেই।”

আরাফ আহনাফের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার সালেহ আলীর দিকে তাকালো। বলল, “জাহানারা ইসলামকে চেনেন?”

সালেহ আলী হেসে বললেন, “আরেহ, উনি পাঠিয়েছেন? উনি আমার বড় আপার বান্ধবী। উনি অবশ্য নিজের কাজে আসেন না। উনার এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বান্ধবীটা কি শিরিন সুলতানা?”

“হ্যাঁ, তুমি কীভাবে জানলে?”

আহনাফ শক্ত হয়ে গেল সালেহ আলীর কথা শুনে। আরাফ প্রসঙ্গ কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, “আরেহ, জাহানারা ইসলাম আর শিরিন সুলতানা দু’জনই আমাদের পরিচিত। অনেক দূর সম্পর্কের। শিরিন সুলতানা আপনার কাছে এসেছিলেন, সেটা জানতাম না। যাই হোক, আপনি ওষুধগুলো লিখে দিলে ভালো হবে।”

“লিখে দেবো কেন? ওষুধ আমার কাছেই আছে।”

সালেহ আলী ডাক দিলেন তার সহকারীকে।

“রহিম, এই রহিম। গুদাম থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে আয়।”

রহিম ছেলেটি মিনিট দশেকের মধ্যেই সেই মেডিসিনগুলো এনে টেবিলের উপর রাখলো, যেগুলো আহনাফ গত পাঁচ বছর ধরে খেয়ে এসেছে। আহনাফ মেডিসিনগুলো নেড়েচেড়ে দেখে বলল, “এগুলো খেলে কি কোনো সাইড ইফেক্ট হয় না?”

সালেহ আলী হেসে বললেন, “এগুলোই তো সাইড ইফেক্ট।”

“মানে!”

“তুমি এসেছো কেন? মন হালকা করতেই তো! মন হালকার মেডিসিন এগুলো। একটা টেবলেট পঞ্চাশ টাকা। পাউডারগুলো পানির সাথে গুলিয়ে খেতে হবে। এক প্যাকেট একশো টাকা। দিনে আর রাতে খেলেই হবে। ভোর হতেই নেশা কেটে যাবে। আর এটা স্পেশাল কাগজ। আগুন ধরালেই ধোঁয়া বেরুবে। এটা সিগারেটের মতো মুখে নিতে হবে না। নাকের কাছে নিলেই হবে। সব অশান্তি কেটে যাবে।”

আহনাফ চেয়ারে ভার ছেড়ে দিতেই সালেহ আলী বললেন, “কি হলো ইয়াং ম্যান!”

আহনাফ ধরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এগুলো ড্রাগস?”

সালেহ আলী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “হুম। ড্রাগস নিতেই তো এসেছো। তোমরাই তো বললে জাহানারা পাঠিয়েছে!”

আরাফ হেসে বলল, “আরেহ, আমি বলেছি জাহানারা পাঠিয়েছেন। ও আমার ভাই। ও কিছু জানে না। তাই জিজ্ঞেস করছে।”

আহনাফ বলল, “এগুলো খেলে কি কি হয়?”

সালেহ আলী গম্ভীরমুখে বললেন, “মাথা ঠান্ডা হয়। সব রঙিন মনে হয়। মনে কোনো অশান্তি লাগে না।”

“ফিজিক্যালি?”

“সেক্সুয়াল আরৌজাল বেড়ে যায়।”

আহনাফ মাথা চেপে ধরে বলল, “আর ছেড়ে দিতে চাইলে?”

“কিছুদিন না খেয়ে থাকা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে তুমি চাইলেও পারবে না। এখন কি নিবে না না-কি!”

হঠাৎ বাইরে থেকে শোরগোলের শব্দ শোনা গেল। কিছু বুঝে উঠার আগেই পুলিশ ঢুকে পড়লো সেই রুমে। সালেহ আলী বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি আর পালাতে পারলেন না। পুলিশ চতুর্দিক ঘেরাও করে ফেলেছে। এদিকে আরাফ সব ক’টা মাদকদ্রব্য পুলিশের হাতে তুলে দিল। সালেহ আলীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। তূর্য আর তাহমিদ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল বিধায় রহিম কোন গুদাম থেকে সেই প্যাকেটগুলো এনেছিল তা দেখে ফেলেছিল। পুলিশের অন্য সদস্যরা এখন সেই গুদামে তল্লাশী চালাতে গিয়েছে। এদিকে দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা ইভান আর ইমনকে ধন্যবাদ দিলেন। এরপর তিনি ফোন হাতে নিয়ে বড় অফিসারকে ফোন করে ঘটনা তদন্তের জন্য অনুমতি চাইলেন। আজই হয়তো সালেহ আলীর রহস্য সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে।

এরপর তারা ছ’জনই মোটরসাইকেল নিয়ে সেই এলাকা থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুদূর যেতেই একটা টংয়ের দোকান চোখে পড়লো। তারা সেখানেই মোটরসাইকেল থামালো। এই কয়েক ঘন্টায় বেশ দখল গেল তাদের উপর। এখন এক কাপ চা খেলে ক্লান্তি কাটবে তাদের।

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৫ (২য় ভাগ)||

ছ’জনের মাঝেই নীরবতা বিরাজ করছে। দোকানদার চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই ইমন একে একে সবার হাতে কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাপ হাতে নিয়ে বসলো, আর বলল, “আরাফ, এই ঘটনা আরো আগে ঘটাতি। ওই বেটাও আরো আগেই ধরা পড়তো।”

ইভান বলল, “কিন্তু অনেক সহজেই ধরা পড়ে গেছে।”

আরাফ বলল, “জাহানারা ইসলামের নাম বলাতেই আমাদের সামনে ধরা পড়েছে। নয়তো পুলিশ কি কখনো এখানে এসে চেক দেয় নি ভাবছিস? অনেক বার চেক দিয়েছে। আর প্রতিবারই টাকা খাইয়ে সরে পড়েছে। এবারও তাই করবে। ঘুষ-টুষ দিয়ে বের হয়ে যাবে। এদের ব্যবসা কখনো বন্ধ হবে না। আর আমরা সমাজের ঠেকা নিয়ে তো বসিনি। রাষ্ট্র সংস্কার এতো সহজ নয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধু আহনাফকে সত্যটা দেখানো। নয়তো ওই বেটা আরো আগেই ধরা পড়তো।”

আহনাফ শক্ত মুখে বসে আছে। তূর্য আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কি ভাবছিস?”

আহনাফ শুকনো মুখে বলল, “মা, আমাকে ড্রাগস দিয়েছে! আমার নিজের মা, আমাকে নেশাখোর বানিয়েছে! এখন তো আমি এসব ছাড়তেই পারবো না। আমার তো এখন অস্থির লাগছে। আমি পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়েছি। এসব না খেলেই উলটো আমার কেমন যেন লাগে। আর এখন তো আমি একা। অরু আমাকে আর ভালোবাসে না। আমার কি হবে এখন? আমি কি করবো? আমার তো ওসব ছাড়া আর চলবে না। আমার তো ওগুলোই এখন নিত্যসঙ্গী হয়ে যাবে। আমি তো কখনোই এই নেশার জগৎ থেকে আর বের হতে পারবো না।”

ইভান বলল, “কি বলছিস এসব? আমি রিহ্যাব সেন্টারে যোগাযোগ করে ফেলেছি। ওখানে কয়েক মাস থাকলে তুই সুস্থ হয়ে যাবি। ওরাই তোকে থেরাপি দেবে।”

আহনাফ দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে বলে উঠলো, “মা আমার সাথে এমন কেন করলো?”

তাহমিদ চায়ের কাপ রেখে আহনাফের সামনে বসে বলল, “আমাদের অন্তত এখন বিশ্বাস কর। অরু তোকে মিথ্যে বলে নি। আবরারের মৃত্যুর সাথে চাচীর একটা কানেকশন আছে। আর অরু সব জানে। তাই হয়তো উনি তোকে অরুর কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য এমন করেছে। আর দেখ, উনি সফলও হয়েছে। তুই উনার কথামতো অরুকে আঘাত করেছিস, আর অরু আজ তোর সাথে থাকতেই চাইছে না।”

আহনাফ তাহমিদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি সুস্থ হয়ে গেলে কি অরু আমার কাছে ফিরবে?”

“অবশ্যই ফিরবে। আমরা ওকে সব সত্য বলবো। তুই অন্তত অরুকে আবরারের খুনি ভাবা বন্ধ কর।”

“তাহলে কে মেরেছে আবরারকে?”

“আমরা জানি না। কিন্তু অরু এই কাজ করে নি।”

“অরু আমাকে বলেছে, মা আবরারকে রেলিঙের উপর উঠিয়ে দিয়েছিল। আমি ওর কথা বিশ্বাস করি নি। কেন বিশ্বাস করবো, বল? মা নিজের সন্তানের সাথে এমন কেন করবে?”

“তোর সাথে এমন কেন করলো? তোর সাথে করতে পারলে, আবরারের সাথেও করতে পারে।”

“তাই বলে খুন!”

“এখন এই সত্যটা তোর সামনে এনেছি। একটু ধৈর্য ধর, ওটাও সামনে আনবো। তুই এখন চুপ থাক। শান্ত থাক। এসব আজেবাজে জিনিস থেকে দূরে থাক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়। অরু তোর বউ। আল্লাহর কাছে ওকে চেয়ে নে।”

আহনাফ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “আমি তো নামাজই ভুলে গেছি। এই কয়েকদিন সব ভুল পড়েছি আমি। তোরা জোর করেছিলি, তাই নামাজ ধরেছিলাম। কিন্তু আমি নামাজে কিছু পড়ি নি। আমি সব ভুলে গেছি।”

আরাফ আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমরা আছি তো। আবার সব শিখে যাবি। তুই জাস্ট রিল্যাক্স কর। উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?”

আহনাফের অস্থিরতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে সে। বারংবার সেই নেশাদ্রব্য তাকে আকৃষ্ট করছে। আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বাসায় যাই।”

তূর্যও মোটর সাইকেলে উঠে বসল আর বলল, “চল তাহলে।”

এরপর আহনাফকে নিয়ে চলে গেল তূর্য। কথা বাড়ালো না আর। তারা চলে যেতেই আরাফ বলল, “রিহ্যাবে কথা বলেছিস, ইভান?”

“হ্যাঁ, শীঘ্রই নিয়ে যেতে বলেছে।”

ইমন বলল, “কিন্তু আংকেলরা তো সময় চাইছে। ডিলটা কি হয়ে গেছে?”

আরাফ বলল, “হ্যাঁ, কালই ডিলটা ফাইনাল হয়েছে।”

“এখন?”

“এখন আর কি হবে! বাসায় বলবো। কাল সবাইকে সত্যটা জানাতে হবে। দাদাভাই এখনো কিছুই জানেন না। শুধু বাবা আর চাচ্চু জানেন। এখন তো সবাইকে আহনাফের ব্যাপারে জানানোটা খুব প্রয়োজন।”

“এরপর কীভাবে সামলাবি এসব!”

আরাফ হতাশ কন্ঠে বলল, “জানি না। আমাদের সুন্দর জয়েন্ট ফ্যামিলিটা এক্কেবারে এলোমেলো করে দিয়েছে ওই শিরিন সুলতানা। তবে একটা কাজ করেছি।”

“কি?”

“সালেহ আলীর সাথে কনভারসন রেকর্ড করেছি আমি। সবাইকে শোনাবো কাল, আর দেখবো মিসেস শিরিন এর বিপক্ষে কেমন যুক্তি দাঁড় করাই।”

(***)

চৌধুরী ম্যানশনের অষ্টম তলায় বসেছে গোল বৈঠক। আরেফিন চৌধুরী ও আমির চৌধুরী গম্ভীরমুখে বসে আছেন এক কোণে। বড় চৌধুরী সাহেব ও মিসেস চৌধুরী বসে আছেন আরাফ ও তাহমিদের মুখোমুখি। তাওসিফ শাহরিয়ার ও মিসেস তাওসিফ একপাশে বসে কি আলোচনা হবে, তা নিয়েই ভাবছেন। শিরিন সুলতানা চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছেন। শীত শীত আবহে একটু ঘুম জমেছিল, আর ওমনি তাকে ডেকে আনা হলো। এই মুহূর্তে মেজাজটাই খারাপ তার। বড় চৌধুরী সাহেব আরাফ ও তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এভাবে কেন ডাকলে আমাদের?”

আরাফ গলা খাঁকারি দিতেই তূর্য আর ইভান আহনাফকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আর ইমন ঢুকলো হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে। আহনাফকে দেখে মিসেস চৌধুরী বেশ রেগে গেলেন। রাগী স্বরে বললেন, “ও কেন এসেছে এখানে? আমার নাতনির জীবন নরক বানিয়ে কী শান্তি পায় নি!”

আহনাফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফ অরুণিকাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। কিন্তু অরুণিকা দোকানে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারে নি। তাওসিফ শাহরিয়ার বললেন, “কি হলো? তোমরা আমাদের এভাবে কেন বসালে? আর ইমন, তোমার হাতে এই ব্যাগ কীসের? আহনাফ কি এখানে চলে এসেছে?”

শিরিন সুলতানা এই কথা শুনে বেশ খুশি হলেন৷ আনন্দিত কন্ঠে আহনাফের কাছে এসে বললেন, “একদম ঠিক করেছিস, বাবা। ওখানে থাকলে তোর মাথাটা নষ্ট করে ফেলতো ওই মেয়েটা।”

আহনাফের হাত মুঠো হয়ে এলো। রাগী দৃষ্টিতে শিরিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, “ঠিক বলেছো। আমার মাথাটা তো নষ্ট হয়ে গেছে। আর এই মাথাটা তুমি নষ্ট করেছো।”

শিরিন সুলতানা অবাক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকালেন। ইমন ব্যাগটি খুলে তার ভেতরে থাকা সব ড্রাগস টেবিলের উপর ঢেলে দিয়ে বলল, “আহনাফ সব সত্য জেনে গেছে, আন্টি। আপনিই যে ওকে মেডিসিনের নাম দিয়ে ড্রাগস দিচ্ছেন, ও সব জেনে গেছে।”

ইমনের কথায় উপস্থিত সবাই স্তব্ধ। আমির চৌধুরী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “কি বলছো তুমি, ইমন?”

ইভান বলল, “আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে বলার কোনো অধিকার নেই আমাদের। আমরা তিনজন আসি। তাহমিদ আর আরাফ আপনাদের সব জানাবে।”

এই বলে ইভান, ইমন আর তূর্য বেরিয়ে পড়লো। আরাফ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে তার ফোন স্মার্ট ভিউয়ের সাহায্যে টিভির সাথে সংযুক্ত করলো। এরপর সালেহ আলীর কনভারসন রেকর্ডটি চালিয়ে দিল। শিরিন সুলতানা সব শুনে ভীত কন্ঠে বললেন, “মিথ্যে কথা। এই রেকর্ডিং মিথ্যে। আমি কেন ড্রাগস কিনতে যাবো?”

তাহমিদ বলল, “আপনার ছেলে তো মিথ্যে বলবে না।”

শিরিন সুলতানা আহনাফের বাহু ধরে বললেন, “বাবা, আমাকে বিশ্বাস কর, আরাফ আর তাহমিদ ইচ্ছে করে এসব করছে। তুই আমাকে বিশ্বাস করিস, না-কি ওদের?”

আহনাফ শিরিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “কেন করলে আমার সাথে এমন? আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি, মা। কতো বিশ্বাস করি! আমার সাথে কেন এমন করলে? আমাকে তো ভেতর থেকে মেরে ফেলেছো তুমি। আমি আমার সাথেই যুদ্ধ করছি এখন। কিন্তু কেন করছি? যাতে চৌধুরী পরিবারের গায়ে কলঙ্ক না লাগে। আমাকে এই ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রে কেন নামিয়ে দিলে, মা? আমি কাকে বিশ্বাস করবো এখন? যেই নারীর পায়ের নিচে আমার জান্নাত হওয়ার কথা, সে তো আমাকে জীবন্ত জাহান্নামে ফেলে দিয়েছে। আমার জীবনটাই মূল্যহীন করে দিয়েছো তুমি। তোমার এই রূপ যদি বাইরের কেউ দেখে, মায়েদের উপর বিশ্বাস উঠে যাবে সবার।”

শিরিন সুলতানা আহনাফের গাল ধরে বললেন, “আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি তোর কোনো ক্ষতি করি নি।”

আমির চৌধুরী লোকলাজ ভুলে শিরিন সুলতানার সামনে এসে তার গালে সশব্দে চড় বসিয়ে দিলেন। শিরিন সুলতানা গাল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমির চৌধুরী চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “তুই তো আমার ঘর ভেঙে দিয়েছিস। আমার ছেলে, আমার অহংকারকে এক্কেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস?”

শিরিন সুলতানা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তিনি শাশুড়ির পায়ের কাছে বসে বললেন, “মা, ওরা বাবা-ছেলে আমাকে ভুল বুঝছে। কিন্তু আপনিই বলুন, আমি কি নিজের ছেলের সাথে এমন কিছু করবো? নিশ্চয়, আরাফ আর তাহমিদ আগেই ওই লোকটাকে টাকা খাইয়ে আমার বিরুদ্ধে শিখিয়ে দিয়েছে।”

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “মশকরা করো তুমি? ওরা তোমার সতিন না-কি যে তোমার বিরুদ্ধে বলবে? আমি নিজে ওখানে গিয়েছি। যেই মেডিসিন তুমি আমাকে ডিপ্রেশনের ওষুধ বলে দিতে, ওগুলো ড্রাগস। আর তা আমি নিজ চোখে দেখেছি।”

তাহমিদ বলল, “এখানেই শেষ না। অরু আর আহনাফের সংসার ভাঙার জন্য চাচী নিজের ছেলের উপর ব্ল্যাক ম্যাজিকও করেছেন।”

আহনাফ অবাক হয়ে তাহমিদের দিকে তাকালো। শিরিন সুলতানা ঘাবড়ে গেলেন। কাঁপা কন্ঠে বললেন, “যা তা বলছে এরা আমার নামে!”

“প্রমাণ আছে।”

মিসেস চৌধুরী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এসব কি বলছো, তাহমিদ?”

তাহমিদ আহনাফের রুম থেকে কয়েকটা কালো সুতোয় বাঁধা কাগজ পেয়েছিল। সেসব পকেট থেকে বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল, “চাচী প্রতি সপ্তাহে বাসায় এসে আহনাফের রুমে এগুলো রেখে যেতেন। আমি একবার খেয়াল করেছিলাম। পরে একদিন কাগজ খুলে দেখি কি সব উল্টোপাল্টা লেখা। আমার সন্দেহ হলে, এসব বুঝবে এমন একজনকে এই কাগজটা দেখায়। উনিই আমাকে বলেছেন, আহনাফের উপর ব্ল্যাক ম্যাজিক করা হচ্ছে।”

মিসেস চৌধুরীর হাত-পা অবশ হয়ে পড়েছে। বড় চৌধুরী সাহেব শিরিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি তো কাফির হয়ে গেছো। তুমি তো মানুষই না।”

শিরিন সুলতানা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন, “ও মিথ্যে বলছে। আমি এসব রেখেছি, এর প্রমাণ কি? নিশ্চয় তাহমিদই এই কাজ করেছে।”

তিনি আবার আহনাফের কাছে এসে দাঁড়াতেই আমির চৌধুরী তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তার গায়ে হাত উঠাতে গেলে, তাওসিফ শাহরিয়ার আর আরেফিন চৌধুরী তাকে শান্ত করিয়ে একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন। শিরিন সুলতানা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন, “আমি আহনাফকে ড্রাগস দেই নি। আমাকে ওই জাহানারা বলেছিল, এসব খেলে আহনাফ সুস্থ হয়ে যাবে। আবরারের মৃত্যুর পর আহনাফ অনেক ভেঙে পড়েছিল। তাই ওর কথামতো ওই মেডিসিন দিয়েছি। ওসব যে ড্রাগস তা আমি জানি না। আর আমি কোনো জাদু-টাদু করি নি। এসব মিথ্যে কথা।”

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “জাস্ট শাট আপ। আর অভিনয় করতে হবে না। তুমিই সব করেছো। এমনকি তুমি আবরারকেও মেরেছিলে।”

আহনাফের কথায় এবার পুরো পরিবার দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলো। আহনাফ বলল, “আমি আজ বুঝলাম, তুমি আমাকে ড্রাগস কেন দিয়েছো। অরু তোমাকে খুন করতে দেখে ফেলেছে, তুমি তাই ওর উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছিলে। অরু এরপর আমাকে বলেছিল, তুমি আবরারকে রেলিঙে উঠিয়ে দিয়েছিলে। যেদিন আবরার মারা যায়, তুমি এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে নিচে নামলে? তুমি আসলে অরুকে দেখেই নিচে নেমে গিয়েছিলে। অরু তো আবরারকে বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারে নি। তুমিও নিচে নামলে, আর আবরারও পড়ে গেল। কিন্তু তুমি ভুল করে ফেলেছো। তুমি টাইম ম্যানেজমেন্ট ঠিক করে তোমার মিথ্যে গল্পটা সাজাতে পারো নি। অরু আমাকে যখন সব বললো, আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি। আর এরপর একদিন তুমি আমাকে এই মেডিসিনগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললে, আমি বেশি ভাবছি তাই উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করছি। আমিও তোমার কথায় মেডিসিন নেওয়া শুরু করলাম। আর ভয়ংকর ভাবে তোমার অন্ধভক্ত হয়ে গেলাম। এরপর তুমি যাই বলতে, আমি তাই করতাম। তুমি আমাকে বলেছিলে, অরুকে যাতে সবার সামনে ছোট করি, আবরারের আত্মা শান্তি পাবে। বলো নি বলো?”

শিরিন সুলতানা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আহনাফ ধপ করে মেঝেতে বসে বলল, “তুমি জিতে গেছো। আর আমি আমার অরুকেই হারিয়ে ফেলেছি।”

আহনাফ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ তার কাঁধে হাত রাখতেই আহনাফ বড় চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যদি অরুকে না পাই, এই মহিলাকে কখনো ক্ষমা করবো না।”

শিরিন সুলতানা এবার আমির চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আহনাফের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলের সাথে এমন করবো তোমার মনে হয়? আমি ওকে ঠিকই ডিপ্রেশনের ওষুধ দিয়েছি। কিন্তু আমার তো মনে হয়, ও নিজেই ড্রাগস নেওয়া শুরু করেছে। আর একটা ড্রাগ এডিক্টেট ছেলের কথা বিশ্বাস করবে তুমি?”

আহনাফ স্তব্ধ হয়ে শিরিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে আছে। শিরিন সুলতানা এবার শ্বশুড়ের সামনে এসে বললেন, “যেই ছেলে নিজের ওয়াইফের খারাপ ভিডিও করতে পারে, নিজের মাকে গালি দিতে পারে, নিজের বাবার গায়ে হাত তুলতে পারে, সে সত্য কথা কীভাবে বলবে?”

এবার শাশুড়ির কাছে এসে শিরিন সুলতানা বললেন, “আপনিও তো মা। আমি আমার নিজের পেটের সন্তানকে ছাদ থেকে ফেলে দেবো? এই অপবাদ আমার উপর দিচ্ছে আপনাদের নাতি। একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, আহনাফ ড্রাগ এডিক্টেট। ও কেন সত্য বলবে? ওর মধ্যে কোনো নীতিজ্ঞান নেই। আমার তো মনে হচ্ছে, ও নিজেই ড্রাগস নিয়েছে। আর এরপর যখন আরাফরা বুঝে গেছে, তখন আমাকে ফাঁসানোর জন্য এই মিথ্যে গল্প সাজিয়েছে।”

মিসেস তাওসিফ বললেন, “আহনাফ কোনো মিথ্যে নাটক সাজায় নি। আমারই তোমার কাজে সন্দেহ হয়েছিল, তাই আরাফ আর তাহমিদকে তোমার ব্যাপারে জানিয়েছিলাম। আর আজ ওরা প্রমাণ সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো তুমি সবার ব্রেইন ওয়াশ করতে চাচ্ছো? আমি তোমার ফোনে সেই ড্রাগ ডিলারের চ্যাট দেখেছি।”

শিরিন সুলতানা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। আমির চৌধুরী শিরিন সুলতানার কাছে এসে বললেন, “ফোন দে তোর।”

শিরিন সুলতানা ভীত কন্ঠে বললেন, “না, নেই আমার কাছে।”

“আমিই নিয়ে আসছি।”

শিরিন সুলতানা স্বামীর পা ধরে বসে বললেন, “হ্যাঁ, সব দোষ আমার। আমিই দিয়েছি আহনাফকে ড্রাগস। কারণ আমার অরুণিকাকে ভালো লাগতো না। ও আমার ছেলেকে মেরেছিল। তাই ওদের আলাদা করার জন্য আমি আহনাফকে ড্রাগস দিয়েছি। ওর উপর কালো জাদু করেছি, যাতে ওই মেয়েকে ভুলে যায়।”

আরাফ বলল, “চাচী, এখন আবরারকে মেরেছেন, সেটাও বলে দিন।”

শিরিন সুলতানা ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি আবরারকে মারি নি। অরুণিকা মেরেছে কি-না সেটাও জানি না। আমি তো ওকে ছাদে যেতে দেখেছিলাম। তাই ওর উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি মারি নি আবরারকে।”

আরাফ বলল, “কাফির আবার আল্লাহর কসমও করে! যে কুফরি করেছে, তার কসমের উপর কোনো বিশ্বাস নেই।”

“আমি মারি নি আবরারকে। আমাকে বিশ্বাস করুন মা, বাবা, আহু, আমি মারি নি আমার বাচ্চাকে। আমি খারাপ। অনেক খারাপ। কিন্তু যা করেছি, অরুণিকাকে আমার ছেলে থেকে দূরে সরানোর জন্য করেছি।”

আমির চৌধুরী স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে বললেন, “তোর ছেলে সুখে থাকলে তোর এতো অসুখ বাঁধে কেন? আমার ভাইয়ের মেয়ের মধ্যে কি কোনো কমতি আছে? এখন তোর এই ড্রাগ এডিক্টেট ছেলের জন্য কোন ভালো ঘরের মেয়ে আনবি তুই? মশকারি করার জায়গা পাস না!”

আমির চৌধুরী শিরিন সুলতানাকে মারলেন কয়েক ঘাঁ। কেউ আটকাতে এলো না এবার। আহনাফের চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমির চৌধুরী বললেন, “আহনাফের সংসার হোক না হোক, আমি তো আর এই ইবলিশের সাথে সংসার করবো না। তালাক দেবো আমি একে।”

মিসেস চৌধুরী আঁতকে উঠলেন। দ্রুত ছেলের কাছে এসে বললেন, “বদনাম হয়ে যাবে আমাদের। এমন করিস না।”

বড় চৌধুরী সাহেব বললেন, “না, বদনাম হলে হোক। যা বদনাম হওয়ার, হয়ে গেছে। আমি এই মেয়েকে আমার ঘরে চাই না। এমন ইবলিশ মেয়েকে আমি আমার ছেলের জন্য এনেছি, আল্লাহ মাফ করুক আমাকে। আমার সংসার ভেঙে দিয়েছে এই মেয়ে। আমির, তুই এই মেয়েকে ওর বাড়ি পাঠিয়ে দে।”

শিরিন সুলতানা শ্বশুড়ের পা ধরে বললেন, “আমাকে মাফ করে দেন, বাবা। এই বয়সে এমন করবেন না। আমার এত্তো বড় একটা ছেলে আছে।”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তোমাকে আমার পরিচয়ের দোহাই দিতে হবে না। আমার মনটা ভেঙে দিয়েছো তুমি। আজ নিজের দোষ ঢাকার জন্য আমার উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছো। সেদিন হয়তো অরুর উপর চাপিয়ে দিয়েছিলে। তুমিই আবরারকে মেরেছো। নয়তো তোমার মতো জালিমের পক্ষে কেইস তুলে নেওয়া সম্ভব? তুমি জানতে ইনভেস্টিগেশন করলে, তুমি ফেঁসে যাবে। তাই কেইস তুলে নিয়েছিলে। তুমি কখনো কারো উপকারে আসবে না। সত্যিই তুমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছো। যতোদিন বেঁচে থাকবো, আমার নিজের এই অস্তিত্বের প্রতি ঘেন্না হবে। তোমার মতো কেউ আমাকে এই পৃথিবীতে এনেছে, এই আপসোস আমার কখনো যাবে না। এখন তোমার এই আহাজারিতে কী আমার সংসারটা ঠিক হয়ে যাবে? ঠিক এভাবেই, আমি অরুর পায়ে ধরে ওর কাছে একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে মানুষ থেকে জানোয়ার বানিয়ে দিয়েছো। ও আমার মুখটাও দেখতে চায় না। আর তুমি ক্ষমা চাও কোন মুখে? আবরারকে মেরেছো কি-না তার প্রমাণ না হয় নেই। কিন্তু আমাকে তো তুমিই খুন করেছো। এর প্রমাণ তো বেঁচে আছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ। আমিই বলছি, শিরিন সুলতানা, তুমি একটা ভয়ংকর মা। তুমি আমার খুনি। তুমি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো। মায়েদের অভিশাপ তো সহজে লেগে যায়। তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের অভিশাপে আমি শেষ হয়ে গেছি। তুমি যতোদিন বেঁচে থাকবে, তোমার হিংসার কারণে আমিও মরবো। আমার এই জন্মের আপসোস, তুমি কেন আমার মা হলে? কেন তোমার অভিশাপ আমাকে স্পর্শ করবে? কেন আমি সুখী হতে পারবো না? আমার কি ভালো থাকার কোনো অধিকার নেই? তোমার অভিশাপ তোমার উপর পড়ুক। আমি মরলে তোমাকে নিয়ে মরবো। তোমাকে আমি আমার বাবার সংসারে চাই না। আমি তোমাকে সংসার করতে দেবো না। আমি নিজেই তোমাদের ডিভোর্স পেপার তৈরী করবো। আমার সংসার ভাঙতে চেয়েছিলে না? দেখো, তুমি আজ এই বয়সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছো।”

আহনাফ এই বলে বেরিয়ে পড়লো। আমির চৌধুরীও শিরিন সুলতানার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একে একে সবাই বেরিয়ে পড়তেই, মিসেস চৌধুরী তাওসিফ শাহরিয়ারকে বললেন, “তোমার বউকে বলো এই মেয়েকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দরজা আটকে দিতে।”

এই কথা শুনে শিরিন সুলতানা নিজেই চলে গেলেন। এরপর নিজের বাসায় ফিরতেই দেখলেন আমির চৌধুরী আর আহনাফ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আহনাফ শিরিন সুলতানাকে দেখে শার্টের হাতায় চোখ মুছে বলল, “যতোদিন ডিভোর্স হচ্ছে না, উনাকে এখানে থাকতে দাও, বাবা। উনারও তো একই অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত। ভালোবাসার মানুষের অবহেলা, সামনে থেকেও উপেক্ষা সহ্য করা কতোটা ভয়ংকর তা তো বুঝতে হবে। আমি তো তিলে তিলে সহ্য করছি।”

আহনাফ এই বলে চলে গেল। আমির চৌধুরী নিজের কপাল ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মিনমিনিয়ে বললেন, “আল্লাহ, আমার কপালে এই ইবলিশকে কেন রেখেছিল?.আমার বায়ান্ন বছরের সংসার শেষ হয়ে গেছে।”

শিরিন সুলতানা দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেলেন। তার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই শেষ হয়ে গেল। এই আক্ষেপে তার চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। স্বামী-সন্তানের অভিমান, রাগে তার কোনো আসে যায় না। তিনি রুমে ঢুকে বিড়বিড় করতে করতে বললেন, “আরাফ আর তাহমিদ আমার সব প্ল্যান নষ্ট করে দিয়েছে। আমার এতো বছরের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আমিও দেখবো, কীভাবে আমাকে তালাক দেয় আমির। আমির চাইলেও আমাকে ছাড়তে পারবে না। আমার স্বপ্ন পূরণের বাঁধা ওই আবরারকেও আমি আমার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আহনাফ তো কিছুই না। এতোদিন মা হয়ে থেকেছি, এখন যেহেতু সব সম্পর্ক শেষ, এবার আমার ভয়ংকর রূপ দেখবি, তুই আহু। তুই আমার সংসার ভাঙবি? আমি তোর উপর এমন জাদু করবো, তুই আর বাঁচবিই না। এবার তুইও যাবি আবরারের কাছে।”

(***)

শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আহনাফ। চোখের সামনে ভেসে উঠছে শিরিন সুলতানার হাসিমাখা মুখ। ঘুম থেকে টেনে তার নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া, মন খারাপের দিনে তার কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকা, জ্বর হলে তার রাত জেগে জলপট্টি দেওয়া। এসব ভাবতে ভাবতেই আহনাফ ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে। বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সে। তূর্য আর আরাফ দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। আহনাফের চিৎকার শুনে বাকিরাও মোটর সাইকেল রেখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো।

আহনাফ তার ফার্ম হাউজে এসেছে। অন্য কোথাও শান্তি পাচ্ছে না সে। আহনাফকে একা ছাড়ার সাহস হলো না কারো। তারাও পিছু পিছু চলে এসেছে সেই ফার্ম হাউজে। আহনাফ থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে তারা। এদিকে আহনাফ পুকুর ঘাটের সামনে বসে চিৎকার করে নিজের বুকে জমিয়ে রাখা কষ্টদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যর্থ সে। মাথা মাটিতে ফেলে দিতেই তূর্য দৌঁড়ে গেল আহনাফের কাছে। আহনাফকে ধরে বসালো। আহনাফ শুকনো মুখে বলল, “আমি আর পারছি না। আমাকে মুক্ত করে দে, তূর্য। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না। আমাকে মুক্ত করে দে। আমি পারছি না আর।”

আরাফ আহনাফের বাহু চাপড়ে বলল, “এভাবে হেরে যাবি? তোর অরুকে ফেলে চলে যাবি? কার দায়িত্বে রেখে যাবি ওকে?”

“ও আমাকে ভালোবাসে না। আমিও ওকে ছাড়তে পারবো না। আমি মরে গেলে, ও মুক্তি পাবে। ও আমার কাছ থেকে মুক্তি চায়। আমি বাঁচতে চাই না, আরাফ।”

ইভান বলল, “কাপুরুষের মতো কথা বলিস না। তুই মনে কর, এটা তোর অন্ধ বিশ্বাসের শাস্তি। শাস্তির সময় বেশিদিন হয় না। ধৈর্য ধর।”

“আমার সব ধৈর্য শেষ। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

আহনাফ বুকে হাত দিয়ে মাটিতে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “আল্লাহকে বল, আমাকে মুক্তি দিতে। আমি পারছি না রে। আমার পক্ষে সম্ভব না।”

তাহমিদ বলল, “অনেক কম পেইন পাচ্ছিস। এখন মরলে সোজা জাহান্নামে যাবি তুই। তখন এই কথার জন্য আপসোস হবে। কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে। তাই এখন সময় থাকতে নিজেকে শুধরে, আল্লাহর কাছে মুক্তি চা।”

আহনাফ উঠে বসলো। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। তূর্য আহনাফের পিঠে মালিশ করতে লাগলো। আহনাফ বুক চেপে ধরে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোদের বুঝাতে পারবো না, এখানে অনেক ব্যথা। আমার মাথা ধরে যাচ্ছে এই ব্যথায়। মনে হচ্ছে গলায় কাঁটা বিঁধে আছে। নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি না আমি।”

আরাফ বলল, “আমরা পাঁচটা মানুষ তোর পাশে আছি, তাও নিজেকে একা ভাবছিস?”

“তুই তো ডাক্তার হবি। আমাকে কিছু ঘুমের ওষুধ দে। আমি একটু ঘুমাই। আমার সহ্য হচ্ছে না এই পেইন। আমাকে কোনো মেডিসিন দে, আরাফ।”

আহনাফ আরাফের হাত চেপে ধরে বলল, “আরাফ, আমাকে কোনো ইঞ্জেকশন দে, যা দরকার দে। আমার একটু ঘুম দরকার। আমাকে একটু শান্তি দে। প্লিজ, ভাই। আমাকে একটু মুক্তি দে কিছু সময়ের জন্য। আমি এই মুহূর্তে নিতে পারছি না এসব।”

আহনাফ নিজের চুল নিজেই টেনে ধরে বলল, “আমাকে ওই ড্রাগসগুলো দে। ওগুলো খেলে আমার মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়।”

আরাফ মাথা নেড়ে বলল, “ওসব তুই আর পাবি না।”

“আমাকে ঘুমের ওষুধ দে। কিছু একটা তো দে, ভাই।”

আহনাফের এমন অবস্থা দেখে ইমন বেরিয়ে পড়লো। প্রায় আধা ঘন্টা পর ফিরলো সে অরুণিকাকে নিয়ে। আহনাফ এখনো ঘাটের পাশে বসে আছে। তূর্য পাশ ফিরে ইমনের পাশে অরুণিকাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। অরুণিকা সবাইকে মাটিতে বিধ্বস্ত বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলল, “কি হয়েছে তোমাদের? ইমন আমাকে এভাবে নিয়ে এলো কেন?”

অরুণিকার কন্ঠ শুনে আহনাফ পেছন ফিরে তাকালো। আহনাফের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “ওর কি হয়েছে?”

আহনাফ আরাফের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। এরপর ধীর পায়ে হেঁটে অরুণিকার সামনে এসে বলল, “আমার পাশে থাকবি একটু?”

আরাফ অরুণিকার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল, “ওর পাশে থাক একটু, প্লিজ।”

অরুণিকা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে!”

তাহমিদ বলল, “ছেলে তার মায়ের কুকর্ম সম্পর্কে জেনে গেছে। শিরিন সুলতানার সব মিথ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। উনার আসল চেহারা সবার সামনে চলে এসেছে।”

অরুণিকা আহনাফের চোখে চোখ রাখলো। আহনাফ হাতজোড় করে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দে, অরু। আমি অনেক অন্যায় করেছি তোর সাথে। আমাকে ক্ষমা করে দে।”

অরুণিকা কিছু বলার আগেই আহনাফ জড়িয়ে ধরলো তাকে। অরুণিকা বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে অরুণিকাকে। যেন হাত একটু আলগা করলেই হারিয়ে ফেলবে তাকে। অরুণিকা আহনাফকে ফার্ম হাউজের ভেতরে নিয়ে গেল। বেড ঝেড়ে বিছানার চাদর বিছিয়ে শুইয়ে দিল আহনাফকে। অরুণিকা উঠে যাবে, আহনাফ তখনই তার হাত ধরে বলল, “আমার পাশে থাক। আমি প্রমিজ করছি তোকে ছোঁবো না। শুধু তাকিয়ে থাকবো। প্লিজ, একটু বসে থাক।”

অরুণিকা আহনাফের পাশে বসে বলল, “আমি আছি।”

আহনাফ অরুণিকার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর হাতটা ধরে থাকতে দিবি?”

অরুণিকা চোখের ইশারায় সায় দিল। আহনাফ শক্ত করে অরুণিকার হাত ধরে রইল। আরাফ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল অসহায়ের মতো। তূর্য বলল, “আহুকে টুইংকেল ছাড়া কেউই হ্যান্ডেল করতে পারবে না।”

তাহমিদ বলল, “অরুর চোখে আমি সেই ভালোবাসা আর দেখছি না। কীভাবে ওদের মধ্যে সব ঠিক হবে?”

আরাফ বলল, “আমার মন বলছে, সব ঠিক হবে। নয়তো শিরিন সুলতানা জিতে যাবে। ওদের আলাদা করাই তো ওই মহিলার উদ্দেশ্য ছিল।”

ইভান বলল, “উনার আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু। উনি যেহেতু ভালো মা হতে পারেন নি, তাহলে বুঝতেই হবে উনার উদ্দেশ্য সংসার করা ছিল না। এখানে অন্য কিছু আছে। আবরার, আহনাফ, অরুণিকা, আমির আংকেল সব উনার দাবার গুটি।”

তাহমিদ বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছিস, আরাফ?”

“কি?”

“ফোন আনার কথায় খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন উনি। শুধু সালেহ আলীর চ্যাট পড়ার কথা শুনে একদম ব্ল্যাক ম্যাজিকের কথাও বলে দিয়েছে। যেই মহিলা নিজেকে ডিফেন্ড করার জন্য ঠান্ডা মাথায় অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছিল, সে হুট করে সব স্বীকার করে নিলো! নিশ্চয়, ওই ফোনে এমন কিছু আছে, যেটা কেউ দেখলে উনি আরো বাজে ভাবে ফেঁসে যাবে।”

“কি করবো এখন? চাচ্চুকে বলবো ফোনটা নিয়ে নিতে?”

তূর্য বলল, “এতোক্ষণে ফোন নিয়ে সব ডিলিট করে দেবে।”

“তাহলে তো উনার কল রেকর্ড বের করতে হবে। দাদা ভাইকে বলে ওটা বের করা যাবে। উনার ওসির সাথে ভালোই সম্পর্ক।”

“যাই বলিস, আবরারকে মারার কারণটা একটা রহস্য। কেন উনি আবরারকে মেরেছে, এটা জানতেই হবে। একটা অটিস্টিক ছেলেকে মেরে উনার কি লাভ হয়েছিল?”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| বোনাস পর্ব ||

মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ কানে আসতেই আরাফের ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে বিকেল তিনটা। কার্তিকের শেষ সপ্তাহ, আর এই অসময়ে বৃষ্টি! আরাফ বিছানা ছাড়তে ছাড়তেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। বাকীদের ডাক দিল সে। কিন্তু কারো সাড়া পেল না। ইভান ক্যাম্পাস থেকে ফিরে ঘুমাচ্ছে। আহনাফ দু’দিন হলো তার ফার্ম হাউজে। তাহমিদ আর তূর্যও তার সাথে। এদিকে ইমনকে পুরো ঘরে না পেয়ে একাই ছাদে ছুটলো আরাফ। এক সপ্তাহের কাপড় শুকাতে দিয়েছিল ছাদে। এই অসময়ের বৃষ্টি আধা শুকনো কাপড়গুলো নিশ্চয় আবার ভিজিয়ে দিয়েছে। আরাফ ছাদে উঠেই চমকে উঠলো। সিঁড়ি ঘরে রাখা টেবিলের উপর তাদের শুকনো জামাগুলো জড়ো করে রাখা। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে ভাবলো, “এগুলো এখানে কে এনে রেখেছে?”

আরাফ ছাদে উঁকিঝুঁকি দিতেই যা দেখলো, তা দেখে থমকে গেল সে। কালো শাড়ি পরিহিতা একটি মেয়ে উলটো দিকে ফিরে নাচছে। তার নৃত্যে ছাদে জমে থাকা পানি চলাৎ চলাৎ করে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ছে। মেয়েটি নাচতে নাচতে কোমড়ে বেঁধে ফেললো শাড়ির আঁচল। এরপর সামনে ফিরতেই আরাফ মেয়েটির মুখ দেখেই স্থির হয়ে গেল। এক স্নিগ্ধ ভেজা তিলোত্তমা। ভেজা চুল লেপ্টে আছে তার কপালে, গালে, ঘাড়ে। তার ভেজা মুখখানায় একরাশ মায়া ভীড় করেছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলকণা ঠোঁটের আগায় এসে ছিঁটকে যাচ্ছে মেয়েটির নিঃশ্বাসের সাথে। মেয়েটি নাচছে আর এবার গলায় যোগ হয়েছে সুর। এই মেয়ে গানও পারে? বেশ অবাক হলো আরাফ। মুগ্ধতা নিয়ে ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মেয়েটি হিন্দি গানে নাচছে। কেউ হয়তো তার ভিডিও বানাচ্ছে। সামনে তাকিয়ে লাজুক হাসছে সেই মেয়েটি। আরাফ গেটের ফাঁকে উঁকি মেরে দেখলো অরুণিকা ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দু’বোনের কান্ড দেখে আরাফ মৃদু হাসলো। এবার রুহানির চোখ আটকালো ছাদের গেটে। আরাফ আর রুহানির চোখাচোখি হতেই আরাফ হাসি গিলে ফেলল। রুহানি বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। সে অন্যমনস্ক হয়ে নাচতে গিয়েই পা পিছলে ধড়াম করে পড়ে গেল। আরাফ তা দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো। অরুণিকা দ্রুত এসে রুহানিকে টেনে তুললো। এদিকে আরাফ এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। রুহানি আরাফকে হাসতে দেখে চোখ ছোট করে বলল, “দেখছিস, অরু। তোর ভাইটা কেমন বদমাশ! একটা মানুষ আছাড় খেয়েছে, আর সে কি-না হাসছে?”

অরুণিকা পেছন ফিরে আরাফকে হাসতে দেখে নিজেও হেসে ফেললো। রুহানি অরুণিকাকে হাসতে দেখে ঠোঁট উলটে বলল, “যা, তুই এখন থেকে আর আমার বোন না। ওই বদমাশ স্যারটার বোন।”

এই বলে রুহানি হনহন করে আরাফের সামনে এসে দাঁড়ানোর আগ মুহূর্তেই আবার তার পা পিছলে গেল। আর এবার সে আরাফের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আরাফ রুহানির কোমড় জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। কারো স্পর্শ কোমড়ে অনুভব করতেই চোখ তুলে তাকালো সে। আরাফকে এতোটা কাছে পেয়ে কি বলবে ভুলে গেছে সে। অরুণিকা উঁকি দিয়ে তাদের দু’জনকে একসাথে দেখে মুচকি হেসে তাদের পাশ কেটে নেমে পড়লো ছাদ থেকে। অরুণিকার পদধ্বনিতে আরাফের ঘোর কাটলো। সে রুহানিকে ভালোভাবে দেখে আবার শব্দ করে হেসে উঠলো। আরাফের হাসির শব্দে রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “এভাবে ভ্যাটকাচ্ছেন কেন?”

আরাফ হাসি থামিয়ে বলল, “তুমি যে চিৎপটাং হয়ে পড়লে! এখন আবার আমার উপর ল্যান্ড করেছো। কি শখ টিকটক করার!”

রুহানি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আরাফকে। আরাফ ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগলো। রুহানি অভিমানী কন্ঠে বলল, “একটা মানুষ যদি ভুলক্রমে পড়ে যায়, তাকে সাহায্য করা উচিত। আর আপনি হাসছেন? খুব খারাপ ডাক্তার হবেন আপনি। পেশেন্ট হাত-পা ভেঙে আসলে, খিকখিক করবেন। কিন্তু এরপরই বুঝবেন মজা।”

আরাফ বুকে হাত গুঁজে বলল, “কেমন মজা বুঝবো?”

“পেশেন্টের আত্মীয় এভাবে হাসতে দেখলে মেরে এক্কেবারে চেহারার রং পালটে দেবে। তখন হাসি হাসি মুখটা, কাঁদো কাঁদো মুখে রূপ নেবে।”

আরাফ এখনো মুখ চেপে হাসছে। রুহানি সিঁড়ি ঘরে রাখা কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “ভালো মানুষের কোনো দাম নেই। এবার বুঝো ভ্যাটকানোর ঠ্যালা।”

রুহানি টেবিলের উপর থেকে কাপড়গুলো নিয়ে চোখের পলকেই ছাদের মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। আরাফকে আটকানোর সময়টাও দিল না। এই দৃশ্য দেখে আরাফ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। রুহানি হনহনিয়ে নামতে নামতে বলল, “ভালো মানুষ হলে যদি বিনিময়ে অপমানিত হতে হয়, তাহলে খারাপ মানুষ হওয়ায় ভালো।”

আরাফ উপরের সিঁড়ি থেকে চেঁচিয়ে বলল, “কি করলে তুমি এটা?”

রুহানি নিচের সিঁড়ি থেকে উপরে তাকিয়ে বলল, “প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। আপনিই তো পড়িয়েছিলেন। নিউটনের গতিসূত্র! সেটাই প্রমাণ করে দেখালাম আপনাকে।”

আরাফ হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে রইল। রুহানি চোখ খিঁচে দাঁত কেলিয়ে নেমে পড়লো নিচে।

(***)

কলিংবেলের শব্দ হতেই অরুণিকা দরজা খুলে দেখল পার্সেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক আগন্তুক। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “জি!”

“অরুণিকা চৌধুরী আছেন?”

“আমিই অরুণিকা।”

“আপনার পার্সেল এসেছে।”

“আমি তো কিছু অর্ডার করি নি।”

“হিমালয় স্যার পাঠিয়েছেন।”

অরুণিকার চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে দ্রুত পার্সেল নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। রুহানি চুল মুছতে মুছতে অরুণিকার সামনে এসে বলল, “কি রে, অরু। কে এসেছে?”

“কেউ না।”

এই বলে অরুণিকা রুমে ঢুকে পার্সেল খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রুহানিও রুমে ঢুকে তার পাশে বসে পড়ল। অরুণিকা পার্সেল খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি বই। রুহানি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “এএহ, কেউ না! মিথ্যুক একটা। গিফট-টিফটও পাচ্ছিস, আর আমাকেই বলছিস না! ওই হিমালয় লোকটাই কি দিয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“ভাই, লোকটা প্রতিবারই বই দে। আমি হলে তো নিতামই না। একটা শাড়ি দিতে পারতো। নিরামিষ একটা।”

অরুণিকা বইটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “এটা শুধু বই না। এটা অনুভূতি। আর এই অনুভূতিটা খুব মিষ্টি।”

রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই সত্যি করে বল তো, ওই হিমালয়কে ভালোবেসে ফেলেছিস না-কি?”

“না, ভালো তো বাসি নি। কিন্তু উনার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে। অনেক স্পেশাল ফিল করি আমি। মনে হয়, খুব কাছের কেউ। প্রায়ই আমার মনের কথাগুলো তার লেখায় খুঁজে পাই। আমি ঠিক যেমন পুরুষ পছন্দ করি, ঠিক তেমন পুরুষ চরিত্র নিয়েই তিনি লেখেন। হিমালয়ের লেখা প্রতিটি পুরুষ চরিত্র আমাকে খুব আকর্ষণ করে। আমি সব চরিত্রের প্রেমে পড়ে যাই। তুই জানিস, উনি একটা উপন্যাস লিখেছিল। মহাকাল নাম। আমি সেই উপন্যাস পড়ে খুব কেঁদেছি। এতো চমৎকার সেই পুরুষ।”

“তো কান্না করার কি আছে?”

“একটা ভুলের কারণে তার প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর সেই ভুলের সমাপ্তিও ঘটে। কিন্তু প্রেমিকা মারা যায়।”

“কীভাবে?”

“এক্সিডেন্টে।”

“ও মাই গড। কি ভয়ংকর। শুনতেই কষ্ট লাগছে।”

“জানিস, হিমালয় আজ পর্যন্ত একটাও হ্যাপিং এন্ডিং স্টোরি লেখে নি। সবগুলোই ট্রাজেডি। তবুও আমি উনার ভক্ত।”

“আচ্ছা, এইটাও কি উপন্যাস?”

অরুণিকা পাতা উল্টে বলল, “মনে হচ্ছে কবিতা।”

“উনি কবিতাও লেখে।”

“লিখতো না। ইদানিং হয়তো লিখছে। হয়তো এটাই উনার প্রথম কবিতার বই। আমাকে হয়তো সৌজন্য কপি দিয়েছে। আচ্ছা, তুই যা।”

রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ওকে। পড় তুই হিমালয়ের কবিতা।”

রুহানি চলে যেতেই অরুণিকা দরজা আঁটকে দিল। এরপর বই হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। বইয়ের নাম, খ্রিনি। বেশ ভিন্নধর্মী এই নাম। অরুণিকা এবার বইটির প্রথম চার পাতা উল্টে দেখলো। বইয়ে ছাপানো প্রথম চারটি কবিতা সে আগেও পড়েছে। অরুণিকা এবার পঞ্চম পাতা উল্টাতেই চমকে উঠলো। খালি পৃষ্ঠায় একটি চিরকুট ভাঁজ করে বেঁধে রাখা হয়েছে। অরুণিকা চিরকুটটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো। সেখানে লেখা,

“প্রিয় হৃদি,
বইটি শুধু আপনার জন্য। এখানে সব কবিতাও আমি আপনাকে নিয়েই লিখেছি। কেন লিখেছি, এর উত্তর নেই। এই বইয়ের প্রথম চারটি কবিতা হয়তো আপনার চেনা-পরিচিত। তবে অচেনা আরো এগারোটি পাবেন। তবে আমার অনুরোধ, কবিতাগুলো একদিনে পড়বেন না। আমি চাই, প্রতি মঙ্গলবার ভোরে এই বই হাতে আপনি ছাদে উঠবেন। আর চোখ বন্ধ করে স্নিগ্ধ হাওয়া অনুভব করবেন। নিজের মনে জমে থাকা আক্ষেপ নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে গেলেই আপনি বই খুলে একটি কবিতা পড়বেন। এরপর কিছুক্ষণ হেঁটে বাসায় এসে আয়নায় নিজেকে দেখবেন। আমার অনুরোধটি রাখবেন কিন্তু। আজ আর পাতা উল্টাবেন না। আমি আপনাকে খুব বিশ্বাস করি, হৃদি। আমি জানি, আপনি বিশ্বাস ভাঙবেন না। আপনি আমার এই অনুরোধ অবশ্যই রাখবেন।
আমি আপনার সাথে একবার দেখা করতে চাই। কাল যদি বিকেল চারটায় আপনার দেখা পাই! আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো। ঠিকানা আমি ইনবক্সে দিলাম। এই সাক্ষাৎ শুধু আমাদেরই হোক।
ইতি হিমালয়।”

অরুণিকা চিরকুটটি পড়ে বইয়ের পাতায় রেখে দিল। এরপর যত্নের সাথে আলমারিতে তুলে রাখলো সেই বই। এবার ফোন হাতে নিয়ে দেখলো হিমালয়ের মেসেজ এসেছে। হিমালয় ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছে, যা দেখে চোখ-মুখ বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো অরুণিকার। কাল হিমালয়কে দেখবে এই খুশিতে তার হয়তো আজ ঘুমই আসবে না।

(***)

অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহ। স্নিগ্ধ শীতল সমীরণ বয়ে চলেছে নদী পাড়ে। অরুণিকা সাদা শাড়ি পরে এসেছে। হিমালয় তাকে বলেছিল সাদা শাড়ি পরে আসতে। তাই রুহানির সাহায্যে এই শাড়ি পরেছে সে। হাতে লাল চুড়ি, কপালে ছোট্ট একটি লাল টিপ লাগিয়েছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল একটি বেঞ্চে বসে নদীর স্রোত দেখছে অরুণিকা। আবার একটু পরপর ফোনে সময় দেখছে সে। হিমালয় কি আসবেন না? এসব ভাবতে ভাবতেই কারো পদধ্বনি কানে আসতেই থমকে গেল অরুণিকা। হৃদস্পন্দন তীব্র হচ্ছে তার। বুকে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো সে। এমন অস্থির কেন লাগছে, সে নিজেই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো অরুণিকা। সে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, আর বেশ বুঝতে পারছে তার পাশে কেউ বসে আছে। এও বুঝতে পারছে না, মানুষটির মুখ হেলমেট দিয়ে ঢাকা। হঠাৎ পাশের মানুষটি একটি চিরকুট এগিয়ে দিল। অরুণিকার সামনে দৃশ্যমান হলো সাদা গ্লাভসবন্দী হাত, যেই হাতের মুঠোয় একটি চিরকুট। অরুণিকা চিরকুটটি হাতে নিলো। খুলে দেখলো, সেখানে লেখা,
“আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে, হৃদি।”

অরুণিকা এবার পাশ ফিরে তাকালো। তার পাশে বসা মানুষটি হিমালয়! মাথায় সাদা হেলমেট, হেলমেটের গ্লাসটি কালো। পরণে সাদা জ্যাকেট, সাদা ট্রাউজার আর সাদা গ্লাভস। এমনকি পায়ের জুতো জোড়াও সাদা।

অরুণিকা বলল, “আপনার বোধহয় পছন্দের রং সাদা।”

হিমালয় মাথা নাড়লো। কলম বের করে কিছু একটা লিখে অরুণিকার দিকে এগিয়ে দিল। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে হিমালয়ের দিকে। হিমালয় চিরকুট এগিয়ে দিতেই অরুণিকা বলল, “মুখে বলছেন না যে!”

হিমালয় আবার কিছু একটা লিখতে লাগলো। অরুণিকা ততোক্ষণে আগের চিরকুটটি পড়ে নিলো। সেখানে লেখা,
“আমার কোনো পছন্দ নেই। তবে সাদা পবিত্রতার প্রতীক। আপনি আমার কাছে স্নিগ্ধ, পবিত্র একজন। এজন্যই সাদা পরে আসতে বলেছিলাম।”

এবার অরুণিকার দিকে দ্বিতীয় চিরকুট এগিয়ে দিল হিমালয়। সেখানে লেখা,
“আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন। আমি আপনাকে বলেছি, হিমালয়ের কন্ঠ নিষ্প্রাণ।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি, আপনি কথা বলতে পারেন। তবুও হয়তো ইচ্ছে করে ধোঁয়াশা করছেন। সমস্যা নেই। আমি না হয় আজ আপনার লিখিত ভাষার প্রাণ হই।”

হিমালয় অরুণিকার দিকে ঘুরে বসলো। অরুণিকা বলল, “চেহারা দেখাবেন না?”

হিমালয় না সূচক মাথা নাড়লো। অরুণিকা বলল, “কেন?”

হিমালয় লিখলো, “আপনার সামনে আসার সেই বিশেষ দিনটি আজ নয়।”

“আমি সেই বিশেষ দিনটির অপেক্ষায় থাকবো।”

দু’জনের মধ্যে বিরাজ করলো বেশ খানিকটা সময়ের নীরবতা। হিমালয় এক দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা ইতস্ততবোধ করছে। হিমালয় নিজের গ্লাভসবন্দী হাত এগিয়ে দিয়ে ইশারায় বলল তার হাত ধরতে। অরুণিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল হিমালয়ের দিকে। পরক্ষণেই কিছুটা দূরত্ব রেখে বলল, “সরি, আমি আপনার হাত ধরতে পারবো না।”

হিমালয় তাকিয়ে রইল অরুণিকার দিকে। অরুণিকার মাথায় রুহানির কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। রুহানি বলেছিল, আহনাফের ব্যাপারে যাতে হিমালয়কে সব জানিয়ে দেয়। নয়তো হিমালয় যদি তাকে ভালোবেসে ফেলে, বেশ কষ্ট পেতে হবে মানুষটিকে। কিন্তু হুট করে বলে ফেললেও কেমন বেমানান দেখায়।

অরুণিকা কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু একটা ভেবে নিজের মনকে শক্ত করে পাশ ফিরে বলল, “আপনাকে আমার অতীত সম্পর্কে একটা কথা বলার আছে। আপনার লেখা আমার কেন এতো ভালো লাগে জানেন? কারণ আমার জীবনে এমন সুপুরুষের ভীষণ অভাব। আপনি হয়তো ভাববেন, সময় তো এখনো আছে। সুপুরুষ হয়তো আমি একদিন না একদিন পেয়েই যাবো। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো না। আমার সাথে আমার ভাগ্যই পরিহাস করে বসেছে।”

হিমালয় লিখে বলল, “কি হয়েছে? আমি হাত এগিয়ে দিয়েছি বলে কি রাগ করেছেন?”

“না, না। কেন রাগ করবো? আমাদের প্রথম দেখা, এভাবে হাত ধরতে ইতস্ততবোধ হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? আর আমি শুধুই আপনার ভক্ত। তাই ব্যাপারটা ভীষণ দৃষ্টিকটুও দেখায়।”

হিমালয় লিখলো, “আমি হয়তো একটু বেশি ভেবে ফেলেছি!”

লেখাটা পড়ে অস্থির লাগলো অরুণিকার। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “আমি আমার গল্পটা শোনাতে চাই।”

হিমালয় মাথা নেড়ে বলল, সে শুনবে। অরুণিকা সামনে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল, “ছোট করেই বলি। তেরো বছর বয়সে এক শীতের রাতে ঘটা অপ্রত্যাশিত ভুল বুঝাবুঝির দরুন আমার বিয়ে হয়ে যায় আমার এক কাজিনের সাথে। আহনাফ নাম তার। শুরুতে আমার তাকে পছন্দ ছিল না। তার জন্য আমি বেশ বকা খেতাম। সেই বিয়েতে পরিবারের কারো সম্মতিও ছিল না। এ অনেক লম্বা কাহিনী। ওতো বাড়িয়ে লাভ নেই। সংক্ষেপেই বলি। আমার দাদিই প্রথম সম্পর্কটি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি রোজ আমাকে স্বামী ভক্তির জ্ঞান দিতেন। আর ধীরে ধীরে আমি আহনাফের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। পনেরো বছর বয়সে আমার প্রথম প্রেমিক পুরুষ হয়ে পড়ে সেই মানুষটি। এরপর একদিন একটা এক্সিডেন্টে আমার বাবা-মা মারা যায়। আর সেই মানুষটিই একমাত্র আমার পাশে ছিল। আমাকে আগলে রেখেছিল। আমি চোখ বন্ধ করে সেই মানুষটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করি। আমার প্রেম আমার প্রথম ভালোবাসায় রূপ নেওয়ার আগেই সেই মানুষটি আমাকে বাজেভাবে ঠকায়। এখন ছ’বছর হয়ে গেছে আমি আমার মামার বাসায় থাকি। আহনাফ আমাদের ইউনিভার্সিটির লেকচারার। বলা যায় এখন আমার স্যার। পাঁচ বছর পর যখন আমাদের দেখা হয়, তখনও আঘাত কম করে নি সে। ষোলো বছর বয়সে পাওয়া আঘাতে অভিমান করেছিলাম। এবারের আঘাতে ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে গেল। আমার আহনাফের সাথে সম্পর্ক রাখার কোনো ইচ্ছে নেই। আমার মনে মারাত্মক আঘাত করেছে সে। আমি আর বিশ্বাস করতে পারবো না তাকে। আর অবিশ্বাস নিয়ে সম্পর্কে থাকা যায় না। শুধু টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে ওই বাড়িতে। আহনাফের পাশে থাকলে আমি শান্তি পাই না। কিন্তু সে আমাকে ছাড়ছে না। জোর করে নিজের সাথে ধরে রেখেছে।”

অরুণিকা এই বলে হিমালয়ের দিকে তাকালো। হিমালয় সামনে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা বলল, “আমার গল্পটা সত্য। আপনি আমার প্রিয় লেখক। আমার এই গল্প যদি আপনার উপন্যাসের পাতায় উঠে, আমি খুব খুশি হবো। তবে এবার গল্পের পুরুষ চরিত্রটির প্রতি তীব্র ঘৃণা হবে আমার।”

হিমালয় বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে লিখলো, “আপনি যদি সেই মানুষটিকে ভালো না বাসেন, তাহলে আপনাকে সেই সম্পর্কে বেঁধে রাখার কোনো অধিকার নেই তার।”

“হ্যাঁ, জানি। কিন্তু আইনগত সম্পর্ক ভাঙার অনেক নিয়ম আছে।”

হিমালয় লিখলো, “আপনি কি করবেন সামনে? আপনাদের ভবিষ্যৎ?”

“আমি থাকবো না সেই সম্পর্কে। পড়াশুনা শেষ হলে, একটা চাকরি নিবো। এরপর ডিভোর্স লয়ার ঠিক করে বের হয়ে আসবো সেই সম্পর্ক থেকে।”

হিমালয় কিছুক্ষণ নীরব থেকে লিখলো, “যদি সে নিজেকে শুধরে নেয়? ধরুন, আপনার পছন্দের সেই সুপুরুষ হতে পেরেছে।”

অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “সম্ভব না। কারণ ওর মধ্যে হিংস্রতা দেখেছি আমি। একটা মানুষ হিংস্র, আর তার সাথে সারাজীবন সংসার করা অনেক কষ্টকর। অনেকবারই সে আমার উপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল। আমার মনে হয় না, সে কখনো নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবে। আমার কাছে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছিল সে। কিছু সপ্তাহ আগে বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা বিয়েতে। সেখানেই ক্ষমা চেয়েছিল। এরপর আবার সেই হিংস্রতা। তারপর আবার ক্ষমা চাইলো, আমি জানি এবারও কিছু না কিছু করবে। সে একদম উগ্র, একরোখা মানুষ!”

হিমালয় আবার লিখলো, “আপনি কি সত্যিই তাকে ছেড়ে দেবেন?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। হিমালয় লিখলো, “তাহলে তো আমরা বন্ধুই আছি। ভবিষ্যৎ নিয়ে না হয় পরে ভাববো। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করেন?”

অরুণিকা হেসে বলল, “জানি না। হয়তো বিশ্বাস করি। তাই তো এখানে এসেছি।”

হিমালয় মাথা নাড়লো। তার প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। তাদের নীরব কথোপকথনের মাঝেই সন্ধ্যা নামলো। অরুণিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “বেশি অন্ধকার হয়ে গেলে সমস্যা। চলুন, ফেরা যাক।”

হিমালয় অরুণিকার সাথে উঠে দাঁড়ালো। তারা হেঁটে হিমালয়ের মোটর সাইকেল অব্ধি গেল। সাদা মোটর সাইকেলে উঠে অরুণিকাকে ইশারায় বসতে বললো সে। অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আমার একটা কাজ আছে।”

হিমালয় ইশারায় অনেক জোর করলো। কিন্তু অরুণিকা উঠলো না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে অরুণিকাকে রেখে চলে গেল হিমালয়।

হিমালয় চলে যাওয়ার পর অরুণিকা গোধূলি আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ছাড়লো। আজ তার মনের সব কথা বলে দিতে পেরেছে সে হিমালয়কে। এবার আর হিমালয়কে ঠকানোর কোন প্রশ্নই উঠবে না। এরপরও যদি হিমালয় তার সাথে বন্ধুত্ব রাখতে চায়, তবে কোনো আপত্তি নেই তার।

চলবে-